লাঙ্গাডু রহস্য

দিগন্ত (মার্চ ২০১৫)

তাপস এস তপু
  • ১০
  • ২৮
আজ বাংলা মাঘ মাসের ১৩ তারিখ। এটা অবশ্য আজ বলার জন্য তেমন মূখ্য কোন বিষয় না- এরপর যা আজ বলতে যাচ্ছি সেটা এই মাঘের কনকনে শীতে গায়ে ঘাম ঝরিয়ে দিতে যথেষ্ট!
আমি বিভূতি, আমার আগের গল্পে নিজের কথা সামান্য বলেছি। আজ পুরোপুরি বলছি- আমি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বয়েস পঞ্চাশ হয়নি তবে আমার জুলফিতে সাদা পাঁক দেখা গেছে বেশ আগে-ভাগে। অপরিচিত যে কেউ রাস্তায় ভুল করে কাকু বলে ডাকে। খারাপ লাগে না –সেটা শুনতে। এই বিষয়টা অবশ্য অনেককেই আমার বয়েস নিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। শিক্ষক জীবনটা তেমন ভালোলাগেনি তাই অবসর নিয়েছি নিজের ইচ্ছায়। ব্যাপক ভ্রমণের শখ, বাংলাদেশের প্রতিটা কানাকোনা ঘুরে দেখার ইচ্ছে আমার, সেই সাথে হালকা লেখালেখির ব্যামো। একটা সাময়িকীতে লিখছি গত মাস তিনেক। এডিটিং প্যানেলেও কাজ করছি পাশাপাশি। এই যা ছোট করে আমার জীবনচরিত।
তবে ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে আমি যেখানেই যাই- সেখানেই প্রতিবারই আমার ভিন্ন এক-একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়। অভিজ্ঞতা বললে ভুল হবে- এগুলোকে নিছক অভিজ্ঞতা বলে চালিয়ে দেয়া যায়না। আরো উপড়ি কিছু থাকে তার সাথে সাথে…
আজকে সেরমই একটা কিছুই লিখছি,
গত সপ্তাহে আমার ইচ্ছে ছিল রাঙ্গামাটি যাবার, মানে রাঙামাটির লাঙ্গাডুর এক বাংলোয়। সব প্রস্তুতিও প্রায় শেষ করে এনেছি- সেখানকার বাংলো বুকিং, বাসের টিকেট সব; কিন্তু আমার রাঙ্গামাটি যাত্রা মাটি হল ঠিক তার আগের দিন -আমার এক কাছের বন্ধুর মৃত্যুতে! আমার কলেজের বন্ধু ছিল বিমল। কিশোরগঞ্জের ছেলে। আমার কলেজ জীবনে দেখা সেরা ছেলেদের একজন! হঠাত করে বড় অসময়ে চলে গেল বিমল। রাঙামাটি যাওয়া ক্যান্সেল করে গেলাম বন্ধুর বাড়ি।
ফিরে আসবার পর, ফিরতি ভাল তারিখ না পাওয়ায় রাঙ্গামাটিও আমার যাওয়া আর হল না। আমি অবসরে আছি সে ঠিকাছে- কিন্তু হাতে যে কাজ ছিলনা মোটেই তা নয়। কাগজে একটা লেখা জমা দেবার কথা ছিল তার দুদিন পরই। হাতে কাজ, বন্ধুর মৃত্যু - তাই আর ট্যুরের ঝামেলায় গেলাম না। পরে সময় করে যাব বলে ভেবে রেখেছি। হটাত, তার দিন তিনেক পর আমার কাগজের অফিসে একটা ফোন পেলাম।
হ্যালো, বিভূতি সাহেব বলছেন?
হ্যা বলছি…
(লোকটা ফোনের ওপাশে মৃদ্যু হাসির শব্দে বললেন) আমি সামসুল আলম, এক সপ্তাহ আগে আপনার
নামে একটা বুকিং করা হয়েছিল আমাদের বাংলোয়। আসলে আমি জানতে চাচ্ছি- আপনি কি আসছেন রাঙ্গামাটি? আমাদের এখানে এখন একটা বাড়তি অফার আছে! এখন এলে বাড়তি এই সুবিধা পাচ্ছেন।
অফারের কথা শুনে মাথায় একশ ওয়াটের বাতি ঝলক দিল, কি অফার বলুনতো?
এই সপ্তাহে কেউ বুকিং কিংবা রি-বুকিং করলে বুকিং মানির জন্য ৫০% ছাড়! তাছাড়া খাবার- দাবাড় সম্পুর্ন ফ্রি! শুধু থাকার খরচ এই যা!
চকচকে চোখে লোকটাকে বলে দিলাম, আমি আসছি!! মানে বাংলো রিবুকিং !
অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা নিউমার্কেট, শীতের কিছু পোশাক- এই মাফলার, জুতো, হাতের একটা টর্চ, এক বক্স সিগারেট আর একটা লাইটার কিনে ফেললাম।
ব্যাগ গুছানোই ছিল, পরেরদিন সেটা হড়কে বেড়িয়ে পড়লাম রাঙ্গামাটির পথে...
লম্বা এক বাস ভ্রমণ শেষে রিসোর্টে এলাম যখন-তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। এই শীতে উত্তর কোণথেকে ধুন্ধুমার বাতাস বয়ে আসছে। ভাল শীত এখানে। গলায় পেঁচানো মাফলারটা এবার কান পর্যন্ত টেনে দিলাম। আমি এসেছি রাঙ্গামটির লাঙ্গাডু এলাকায়। পথেই ঝরনার শন্দ পেলাম, উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড়, দেখেই মন একরকম উৎফুল্ল হয়ে গেল। লাঙ্গাডুর পাশ দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ।
উঁচু বাংলো পর্যন্ত হেঁটেই আসতে হলো। হাতের ট্রাভেল ব্যাগ টেনে রিসোর্টের একতলা পাকা দালানের ভেতরে ঢুকে গেলাম। পাহাড়ের টিলায় একতলা বাংলো। কি নয়াভিরাম দৃশ্য! অপুর্ব! চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বিকেলের অল্প আলো এখনো আছে।
দালানের বাইরে ১০০ ওয়াটের একটা হলদে বাতি জ্বলছে, তবে ভেতর বেশ অন্ধকার! তবে বাইরে পর্যাপ্ত আলো আছে।

(আমাকে দেখেই হাসোজ্জ্বল মুখে, চেক শার্ট কালো প্যান্ট পড়া ব্যাক্তি ছুটে এলো)
-হ্যালো স্যার, আমি সামসুল আলম।
-হ্যালো, আমি বিভূতি। আমার নামেই ঢাকা থেকে এখানে বুকিং দেয়া হয়েছে। (হাত মেলালাম লোকটির সাথে)
-জ্বী স্যার। আসুন আমার সাথে।
বাংলোর রিসিপশন রুমে আমাকে বসতে বলল লোকটি। কিছুক্ষন পর একটা বড় সাইজের এন্ট্রি বুক বের করে আমাকে ডাকল আবার,
-আসুন স্যার! এই নিন, এখানে একটা সই করুন। (ডান হাতে হোটেলের এন্ট্রি খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল সে- হাতে কাল বলপয়েন্ট নিয়ে খচখচ করে সই করলাম, তারপর মুখের মাসলগুলোতে মৃদু টান এনে-হালকা হাসি দিলাম)
সে ফিরতি হাসি দিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
স্যার, এক মিনিট!- আমার লোক এগিয়ে দিবে আপনাকে।
এরপর সে উঁচু স্বরে ডাকল, আখতার … আখ… তার… কোথায় গেলি?
কিছুক্ষন পর, খুড়িয়ে খুড়িয়ে একজন এলো সেখানে, বেশ বয়েস লোকটার। ষাট! নাহ পঞ্চাশ- চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। বাম পা কিছুটা খাটো তাই খুড়িয়ে হাঁটছে। ইঞ্চি দুয়েক কম হবে পা-টা।
আমার দিকে ইশারা করে ভাঙ্গা গলায় আখতার বলল, ‘আসেন স্যার, আসেন- আমার সাথে...’
আমার ট্রাভেল ব্যাগের চাকাগুলোকে সচল করে লোকটির পিছু পিছু টেনে নিয়ে চললাম।
ঘর দেখিয়ে দিয়েই চলে গেল আখতার, বলল কিছু লাগলে ডেকে নিতে।
বাংলোয় থাকার জন্য ঘরটা বেশ। একটা টেবিল আছে জানালা ঘেঁষে; দেয়ালে পুরোনো কিছু শিল্পকর্ম। চুনকাম করা দেয়াল। দক্ষিণে লোহার শিকের একটা মাত্র জানালা। রাঙামাটি আদিবাসী এলাকা। মাঝে বাঙালী মেলে, তবে কম। তবুও হরহামেশাই এখানেই বাঙ্গালী-আদিবাসী গন্ডগোল বাঁধে। সে কারনে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে সবসময়। আসবার পথে তাদের কয়েকটা ফাঁড়ি চোখে পড়েছে।
বাংলোয় এটাচড বাথরুম। হাত-মুখ ধুয়ে সাথে আনা ব্যাগের বোঝা হালকা করলাম। লেখার খাতা, টর্চ, টেবিলে রাখলাম। পোশাক ব্যাগেই রাখলাম –বাইরে বার করে ধূলো ফেলার মানে হয়না।আমার জানালায় বাইরে দাড়ানোর কোন জায়গা নেই। জানালার বাইরে অনেক নীচু খাদ। রুম টা খুব একটা পরিস্কার নয়, এখানে ওখানে ধূলো পড়ে আছে।
জানালায় উকি দিলাম একবার। এখান থেকে বেশ নীচু। একবার পড়ে গেলে শেষ!
লম্বা ভ্রমণের জন্য অনেক ক্লান্ত লাগছিল- আর দাঁড়াতে পারলাম না। শরীরটা লেপের ভাজে মুড়ে নিলাম।
ঘুম ভাঙল কর্কশ ডাকে...
-স্যার… স্যার… (ভাঙ্গা গলায়)
কে? (আড়মোড়া দিয়ে)
আমি স্যার, আখতার। আপনের রাতের খাবার দেয়া হইছে, খাইবেন না?
হ্যা, ও... আচ্ছা। আমি আসছি। হাত মুখ ধুয়ে হাতঘড়িতে চোখ দিলাম। একি! রাত ১১ টা। পাক্কা চার ঘন্টা ঘুমিয়েছি!
ব্যাগের সাইড পকেটে রাখা আমার সিগারেট প্যাকেট থেকে একটা খস করে ধরিয়ে দরজায় তালা দিলাম। এখানে আরো কয়েকজন আছেন। সম্ভবত, ঢাকার লোকজনই হবেন। একজনের সাথে চোখচোখি আমার। ভদ্রলোক কিছু বললেন না, হাতে সুস্পষ্ট মাসল- সম্ভবত ব্যায়াম করেন। আমিও মুখ লুকোনো স্বভাবের লোক তাই আর যেচে কথা বলতে গেলাম না। আরেকজন আছেন চোখে চশমা, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি আর চাঁদর। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাংলোর বাইরে এলাম। কক্সবাজারের একটা বাতাস পাচ্ছি এই উঁচুতে। সময় করে সেখানেও যাব ভাবছি।
(স্যার খাইতে আসেন) আখতার আবার ডেকে গেল…
সিগারেটের ধোঁয়া নেভাতে গিয়েই চোখ পড়ল কালো চশমা পড়া একজন আমাকে আড়াল থেকে ফিরে ফিরে দেখছে, আমি পাত্তা দিলাম না। এও আরেকজন গেস্ট। সব মিলিয়ে ছ’জন আছি এখানে।
খাবার টেবিল দেখেই মন চাঙ্গা হয়ে গেল। নাহ- এদের দেখে যেরম ভেবেছিলাম এরা ততটা খারাপ নয়। খাবার-দাবাড়ের হরেক আয়োজন। সামসুল আলম এখানে আসার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন যেকোন সমস্যায় তিনি সাহায্য করবেন। এরপর জম্পেশ করে খাবার শেষ করলাম সবাই।
সবার জন্য পান সাজানো আছে ট্রেতে। শুধু পান খেলাম। জর্দা খেলাম না, অভ্যেস নেই। কালো চশমা পড়া ভদ্রলোক, এমনকি সামসুল আলম নিজেও পান খেলেন না। আমি সিগারেট ধরিয়ে বাংলোর বারান্দায় এলাম। একরাশ ধোঁয়া ছেড়েছি হটাত,
হ্যালো, আমি উদ্দীপ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। এখানে বেড়াতে এচছি। আপনি?
আমি বিভূতি, ঢাকায় থাকি। একটা সাময়িকীতে একটু আধটু লিখি।
ও আচ্ছা! আজই এলেন বুঝি?
হ্যা। আপনি?
আমি অ্যাথলেট। এখন খেলিনা, মাঝে খেলতাম মোহনবাগানে। এখন দেশ-বিদেশ ঘুড়ে বেড়াই। দাদার অনেক সম্পত্তি আছে, তাই চিন্তা নেই। (বলেই একগাল হাসল ছেলেটি)
আচ্ছা, পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। রাত হয়েছে খুব। এখন আসছি- কাল কথা হবে।
কাল কি আমার সাথে বেড়োবেন ঘুরতে? একসাথে গেলে ভালো হয়!
দেখা যাক, আসি এখন। (মৃদু হেঁসে তাকে বিদায় দিলাম) লোকটার বডি কনফিগ সেইরকম, মাসল হাত দিয়ে দেখানো যায়, এনাটমির চার্ট লাগবে না। নাকে ঘুষি পাঁকালে কাহিল হতেই হবে।
বিকেলে ঘুমোনোয় ঘুম পাচ্ছিল না। তাই হাতে কাগজ নিয়ে বসলাম। আগামী মাসের সংখ্যায় কিছু কাজ বাকী আছে।
কটা বাজে দেখিনি, একমনে কাজ করছিলাম। হঠাত... দেখি- কড়কড় শব্দে দরজার হাতল ঘুরছে। মনে হচ্ছে কেউ দরজার নব বাইরে থেকে ঘুরাচ্ছে। টর্চটা ঝটপট হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ধীরে দাঁড়ালাম। করিডোরে কোন আলো নেই সেটা রাতে খেতে আসায় পথে দেখেছি। চোর হলে টর্চের দরকার আছে।
ঘর থেকেই গলায় স্বর উঁচু করে বললাম, ‘কে?’
কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। হাতলও আর ঘুরছে না। টর্চ জ্বালিয়ে ঝটপট দৌড়ে দরজা খুলে বাইরে ছুটে এলাম। আজব… কেউ নেই! লম্বা করিডোর খালি! বাংলোর করিডোর বেশ লম্বা। একটা ইংরেজী ‘O’ শেইপড মত। সুতরাং দৌড়ে কেউ চলে গেলে চোখে পড়ার কথা। অবাক হবার মতই ব্যাপার।
হাতের টর্চ শক্ত করে ধরে করিডোরের এদিক-ওদিক আলো ফেললাম, কিন্তু দেখি কেউ নেই। টিমটিমে আলো জ্বলছে করিডোরে। করিডোর ধরে বাইরে বারান্দায় দিকে এগুতেই সেখানে কেউ আমাকে দেখেই বাইরে সরে গেল। আমি সেদিকে ছুটে গেলাম।
জোর গলায় বললাম,- কে? কে ওখানে?
-আপনি এত রাতে? (আমাকে দেখেই সে)
-জ্বী আমি। আমাকে দেখে ছুটলেন যে?
-কই! (অবাক হয়ে) নাতো! এখানে দাঁড়িয়ে আছি- ঘুম আসছিল না। বেশ লাগছে কিন্তু! আপনিও থাকতে পারেন।
-কিন্তু আপনি হটাত, এত রাতে, টর্চ হাতে?
-না, মানে চা খাবো ভাবছিলাম। তাই বেড়িয়েছি। (দরজার নবের কথা বলব- কি বলব না করে শেষতক বললাম না ) এত রাতে কাউকে পেলাম না, চা খাওয়া হল না। আচ্ছা আসি (এই বলে মৃদু হাসি দিলাম)
আরে! একি চলে যাচ্ছেন?
হ্যা, কাল কথা হবে।
আচ্ছা। শুভরাত্রি।
উদ্দীপ! সে কেন আমার রুমের দরজার নব ঘোরাবে? অন্তত তাকে দেখে চোর মনে হয় না। যদি করেও থাকে তবুও কয়েক সেকেন্ডে তো আর লম্বা করিডর থেকে বাংলোর বারান্দায় যাওয়া যায় না। ( তখনি, দরজায় শব্দ হল- ঠক…ঠক)
-কে?
-আমি বাবু, আখতার!
-এত রাতে কি চাই?
-আপনার দরজার হাতলে একটা কাগজ আছে বাবু!
-কাগজ! কই দেখি?
-এই যে,
-আচ্ছা, তুমি যাও। শোন ‘চা’ হবে?
-না বাবু, এত রাতে পাইবেন না। এহন তো রাইত দুইটা বাজে, সকালে পাইবেন।
-আচ্ছা তুমি যাও। (খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল আখতার, রাতে পাহারা দিচ্ছে সে)

বেসিন থেকে পানি নিয়ে বার কয়েক মুখে ঝাপটা দিলাম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে কাগজের টুকরো টা খুলে দেখলাম, আনাড়ী হাতে লিখা “চলে যা, নাইলে মরবি”
সিগারেটটা হাত থেকে পড়ে গেল। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। একি! এতো সাক্ষাৎ হুমকি! কিন্তু কেন?
সকাল বেলাতে দরজায় কড়া নড়ছে, ধুম ধাম!!
বাবু উঠেন উঠেন!! সকাল হয়ে গেছে, চা খাইবেন না?
হাত-মুখ ধুয়ে ‘চা’ খেলাম জবরদস্ত চা। মনটা চাঙ্গা হয়ে গেল। চায়ের নেশা বড় জটিল; খেলেও ভাল লাগে আবার না খেলেও চলে না।
সকালে বাকী তিনজনকে দেখতে পেলাম না। এরা আশেপাশে আছেন কি আছেন না, খোঁজ নেয়ার কি দরকার! তবে বাইরে ঘুরতে যেহেতু যাচ্ছি তাই কাউকে পাশে পেলে ভাল লাগত। একা যাবার চেয়ে দু-তিনজন মিলে ঘুরতে যাওয়াটা বেশ জমে। ঘন্টা দুয়েক বসে থেকেও যখন দেখলা কেউ এলো না, তখন নিজেই বেড়িয়ে পড়লাম।
রাঙামাটির কাউখালি, লাঙ্গাডু এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদ। বিদ্যুৎ প্রকল্প আছে কাপ্তাই হ্রদে।ঘুরতে ঘুরতে অনেকখানি এসেছি একা। হটাত দেখি বাংলোর সেই মাসল ম্যান ‘উদ্দীপ’ ছোট একটা নালার পাশে কি একটা করছে।
-এই যে! শুনছেন? (আমাকে দেখে মনে হয় ভুত দেখল)
- আরে আপনি? এখানে? একা!
-হ্যা ঘুরতে বেড়িয়েছি, আপনাকে পেলাম না, রাতে বললেন একসাথে ঘুরবেন! তাই একাই বেড়িয়েছি। কিন্তু আপনি একা ওখানে কি করছেন?
- পাখি দেখি। দেখছেন না এক ঝাঁক পাখি!!
-কই, দেখছি নাতো!
-এই তো এখানেই ছিল। একটু আগে। মিস করলেন হয়ত! নিন, চলুন ফিরে যাই।
-এখনি ফিরব!
-হ্যা, চলুন অচেনা এলাকা। পাহাড়িদের ভয় তো আছেই।
(লোকটির কথায় একটু অবাক হলাম এখানে পাহাড়িদের সমস্যা আছে, বাংলাদেশের বাইরের কেউ হয়ে কিভাবে জানে? হয়ত লোকের মুখে শুনেছে, আমরা সব কথা কেন জানি লুকিয়ে রাখিতে পারিনা)
-বললাম, চলুন আমারও খিধে পেয়েছে।
বাংলোয় ফিরে দেখি সবাই টেবিলে বসে গেছে।
গতকাল রাতে দেখা সাদা চাঁদর পড়া লোকটির নাম মজিদ খান। ঢাকায় থাকেন। চিটাগং পোর্টে ব্যাবসা আছে। মাঝে মাঝেই আসেন এখানে। সময় কাটাতে। খাবার টেবিলে কথা হল। খুব একটা কথা বলেন না, বড়লোক দের এই এক রোগ। আমি লেখক শুনে নাক সিটকে গেলেন! কাল চশমা পড়া লোকটি কথাই বলেন না। কারন তিনি বাংলা পারেন না। তিনি নেপাল থেকে এসেছেন। ইংরেজীতেও খুব পটু নন। তবে তিনি দেখতে মোটেই নেপালীদের মত নন। তাকে দেখে কিঞ্চিৎ খটকা লাগল আমার!
ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্য চা পাতি এনে রেখেছি সামসুম আলম সাহেবকে বলে। এখানে খাবার জন্য চায়ের ফ্লাক্স এনে রেখেছি আজ। গত রাতের চা খাওয়ার ব্যাপারটা বাহানা ছিল সত্যি কিন্তু রাতে চা হলে মন্দ হয় না। ঘুম না এলে ভাল কাজে দেয়। ডাইউরেটিক্স বলে কথা!
আজ বাংলোয় আমার ২য় দিন। মধ্যরাতে ভারী কিছু টেনে নেয়ার শব্দ পেলাম। রাত জেগে একটা আর্টিকেল নিয়ে বসে ছিলাম। ঘড়িতে দেখি রাত ২টা ১৭ মিনিট। এত রাতে কে? চোর নয়ত! তাছাড়া গতকালের হুমকির কথা আজকে সামসুল সাহেবকে বলতে ভুলে গেছি। বেড়াতে এসে জান দেয়ার কোন মানে হয়! কিছুক্ষন পর শব্দ কমে যেতেই টর্চ নিয়ে বের হলাম। বিড়ালের মত পা ফেলে এগুচ্ছি করিডোরের পশ্চিমকোণে। এদিকে বেশ অন্ধকার। টর্চের আলো একপলক জ্বালাই আবার নেভাই। শুন-শান নীরবতা এদিকে। মেঝেতে কিছু একটা ভারী কিছু টেনে নেয়ার দাগ দেখতে পাচ্ছি। সম্ভবত কাঠের বক্স হবে এবং সেটা বেশ ভারী অবশ্যই কেননা বস্তা হলে মেঝেতে শক্ত দাগ পড়বার কথা নয়।
-এই যে! কে? কে এখানে?
-আ...আ...আমি আমি বিভূতি! বিভূ...তি!
-এত রাতে কি করেন এইখানে? যান নিজের ঘরে যান! যান!
-কে তুমি?
-আমি আখতার, পাহারা দেই। এত রাইত্রে বাইর হওয়া ভাল না। যান ঘুমান।
রুমে ফিরেই খটকা লাগল। আমার টেবিলের কাগজে কেউ না কেউ হাত দিয়েছিল। ঘরে আলাদা একটা পারফিঊমের গন্ধও পাচ্ছি। এই পারফিউম আমি ব্যাবহার করি না। কিন্তু রহস্যের বিষয় এই বাংলোয় এ গন্ধ অন্তত এই দুদিনে আমি পাইনি। নতুন কিছু রয়ে গেছে রয়ে আজ টেবিলে “সাবধান, নইলে বিপদ আছে”। দরজায় তালা দিয়ে করিডোরে গেছি। আখতার পাহারাদারের ঘরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে কে?
সকালবেলায় সামসুল আলমকে গতদুদিনের চিঠির কথা বললাম না। আমার মাথায় অন্যকিছু খেলছে। আজ একটা গুরুত্বপূর্ন কাজ করতে হবে আমাকে। এই কাজ সামসুল সাহেব কে দিয়ে হবে না।
ফিরলাম, একদম বিকেল বেলায়।
বাংলোয় ফিরতেই দেখি সব চুপচাপ, সামসুল আলম সাহেব রিসিপশনে বসে ছিলেন। তিনি আমাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, “ভাল আছি কি নেই” কিন্তু আজ সেটা করলেন না। তবে তাকে পাস করে রুমে আসার পথে গতকাল রাতের সেই পারফিউমের গন্ধটা স্পষ্ট নাকে এলো। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে বললাম, ভালো আছেন সামসুল সাহেব?
উনি বললেন, জ্বী।
তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই মাথার পেছনে সশব্দে বারি দিল কেউ। তীব্র একটা ব্যাথা আর চোখে ফুলঝুরি! এরপর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমার সামনে হাতে বেসবল খেলার স্টিক হাতে উদ্দীপ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কালো চশমা পড়া সেই নেপালী লোক। আমার বিছানায় পা তুলে বসে আছে মজিদ খান। তিনি বসে পা নাচাচ্ছেন। আমার হাত-পা চেয়ারে শক্ত করে বাঁধা।
মজিদ খান বললেন, কি? এত সাহস কেন আপনার? আপনি কে?... আমাদের কাজে বাগড়া দেন!
আমি কি করেছি?
কি করেন নাই! আমাদের কাজে যারা বাগড়া দেয় তাদের আমরা বাঁচতে দেই না। (রাগে দাঁত কটমট করছেন তিনি)
এবার নেপালী লোকটি হিন্দিতে বলে উঠল, তুম সমঝতে কিয়া? হ্যা? উল্লু!
বললাম, দেখুন আপনারা ভুল করছেন, আমি...
চুপ করুন, আমার হাতে কি দেখেছেন, মাথায় আরেকটা মারলে না- খুজে পাওয়া যাবে না। মেজাজ পুরো খারাপ করে দিয়েছেন আমার! চা খান আপনি? তা আবার রাত দুটোয়!!
নেপালী লোকটি বলল, আখতার! আখতার! ইধার আও সালে, জলদি আও।
দরজা ঠেলে আখতার এলো, কি সাব?
সামসুল কো বুলাও, জলদি! যাও!
সামসুল আলম এলো মাথা নিচু করে।
কি? তোমাকে কি বলা হয়েছিল? কোন সমস্যা যাতে না হয় আমাদের! এখন কি হলো? (কড়া গলায় বললেন মজিদ খান)
সামসুল আলম দুহাত জোড় করে বলল, ‘সরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে, আমি বলছি স্যার উনি শোনেন নাই’
তাহলে আর কি? গুডবাই মিস্টার টিচার! মজিদ খান বাকা চোখে আমার দিকে তাকালেন।
(হটাত শোরগোল শোনা গেল বাইরে থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, আত্বসমর্পণ করুন, নয়ত আমরা কঠোর ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব)
কে? কে? কারা? মজিদ চেচিয়ে উঠলেন...
উদ্দীপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, স্যার! আর্মি!
কি? কে?
স্যার আর্মি!
হোয়াট দ্যা হেল...?
আমার মৃত্যু এদের হাতে আর হলো না। গ্রেফতার করা হল অস্ত্র ব্যবসায়ী মজিদ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের...
আর্মি ডাকার কাজটি আমি করেছি ৩য় দিন সকালে। কাজ ছিল আগেই বলেছি।
ও হ্যাঁ, বাকী অংশটুকু না বললে কেমন হয়। দ্বিতীয় রাতে যখন বেড়িয়েছিলাম, তখনি বুঝেছিলাম কিছু একটা যোগসুত্র আছে অতিথি তিনজনের মাঝে। উদ্দীপ নামের লোক প্রথমবার রাঙামাটি এসে কি করে একা অচেনা বনে একা পাখি দেখতে যান কারও কোন সহযোগিতা ছাড়া? যেখানে সসস্ত্র বাহিনী এলাকায় পাহারা দেয়- সেখানে আখতার এত রাতে কি চোর পাহারা দেয় সেটা মগজে না ধরার মত কিছু নেই। প্রথম দিন খাবারের পর টেবিলে রাখা পান-জর্দা কেন আমি ছাড়া কেউই খায়নি? যেখানে দিব্যি মজিদ সাহেবকে পরেরদিন পান খেতে দেখেছি। অবশ্য সেদিন রাতে পানের জর্দায় ঘুমের ওষুধ দেয়া ছিল আর আমি পানে জর্দা খায়নি সেদিন। তবে সে পান খেয়ে আমি ঘুমিয়েছি কি নিশ্চিত হতে মধ্যরাতে আমার রুমের দরজার নব ঘুরানো হয়েছিল। সেদিন রাতে উদ্দীপ নামের লোকটি হাওয়া খায়নি বাংলোর বারান্দায়, পাচারের কাজ তদারকি করছিল। অস্ত্র পাচারে জড়িত এরা সবাই।
সবশেষ চিঠি, মানে সতর্ক বাণী। এটা যে সামসুল সাহেবের নিজের দেয়া তা কি এখনো বুঝতে পারেননি? তবে এই চিঠি যে সামসুল সাহেব নিজেই দিতেন এটা আমি বুঝেছি প্রথম হুমকির পরেনদিন। কারন দ্বিতীয় রাতে টর্চ নিয়ে বের হবার আগে আমি রুমে তালা দিয়ে বেড়িয়েছিলাম। ফিরে এসে আমি চাবি দিয়ে দরজা খুলেছি। তবে তার পারফিউমের বুদ্ধিটা সত্যিই অসাধারণ। তাই হুমকির কথা আর তাকে বলিনি পরেরদিন। সামসুল সাহেব জানতেন এরা পাচারে জড়িত। তারা যে বাংলোয় শুধু ট্যুরিস্টদের ভাড়া দেন এই বোঝাতে আমায় অফারের লোভ দেখিয়ে এখানে আনেন তিনি যাতে আর্মিরা বিশ্বাস করে এটা ট্যুরিস্ট বাংলো। আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আর্মিদের বোঝাতে!
আজ চলে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি এখনো ঠিক করিনি। তবে রাঙামাটির লাঙ্গাডুর সুউচ্চ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিগন্তের মেঘগুলোকে খুব কাছে মনে হচ্ছে। পাখা থাকলে উড়ে যেতাম সন্দেহ নেই, দুহাত মেলে একবুক নির্মল বাতাস নেয়ার সুখ ঢাকা গিয়ে পোড়াবে আমায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ সুদারুণ গল্পকথন । ভাল লাগলো ।
অনেক ধন্যবাদ জালাল ভাই। দোয়া রাখবেন :)
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন চমতকার একটা রোমাঞ্চ গল্প। ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
দোয়া রাখবেন। শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদ স্যার। :)
সৃজন শারফিনুল অসাধারণ লাগলো ভোট দিতে ভুলিনি ...।
সৃজন ভাই, :) অনেক ধন্যবাদ।
শেখ শরফুদ্দীন মীম অনেক ভালো লাগলো। ভোট রেখে গেলাম। সময় করে আমার কবিতাটি( আলোর সন্ধানে) পড়বেন।
অনেক ধন্যবাদ ভোটের জন্য, আরো ভাল লাগল আপনার ভালো লেগেছে জেনে ।
রবিউল ই রুবেন খুব ভালো.
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
টোকাই সুন্দর । ভোট রেখে গেলাম ।
অসামান্য কৃতজ্ঞতা :)
রুহুল আমীন রাজু সুন্দর গল্প .....ভালো লাগলো.(আমার পাতায় 'কালো চাদ গল্পটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো )
ধন্যবাদ আপনাকে :)
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ গল্পটা গোয়েন্দা কাহিনী না হলেও কোন অংশে কমও নয় ! বেশ ভাল লাগল ।

০৮ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪