নাইয়র

নববর্ষ (ডিসেম্বর ২০১৪)

আল মামুন খান
  • ৪৬
কালিগঙ্গা নদী যেখান থেকে বাঁক নিয়ে ডানে চলে গেছে, এর পরের দুটি বাঁকের পরই পারুলের গ্রাম। বেশ বড় একটি বাজার। লঞ্চ ঘাটটি ও বাজারের একেবারে শেষ মাথায়। ঢাকা থেকে বড় লঞ্চ পারুলকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে, সেখানথেকে এই বাজার পর্যন্ত টেডি লঞ্চ (এক তলা ছোট লঞ্চ) চলাচল করে। কিন্তু তারও নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। ভোর রাতে সে টার্মিনালে নেমেছে। আর টেডি লঞ্চ ছাড়বে সেই দুপুরে। এতোক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।
এখন অবশ্য পারুলের জীবনে কোনো কাজেরই কোনো মানে নেই। এটা ঠিক এই মুহুর্তে ওর ধারণা। একটু পাগলাটে ধরণের মেয়ে হিসাবে ওর সুখ্যাতি রয়েছে। তাই বলে অন্য আর দশটা মেয়ের মতো অবলা বোবা প্রানী ভাবলেই ভুল করতে হবে। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা না করলে দু'ভাবে সে বাড়ি যেতে পারে। এক হল, পিরোজপুর শহরে গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে নাজিরপুর, তারপর ভ্যান বা রিক্সায় করে শ্রীরামকাঠী বাজার। এরপর পায়ে হেঁটে বাড়িতে। তাও হাঁটতে হবে প্রায় আধা ঘন্টার মত।
কোনো কিছু চিন্তা না করেই একটা নৌকা ভাড়া করল পারুল। সাথে জিনিসপত্র বলতে একটা মোটামুটি ধরণের সুটকেস। আর চেইনওয়ালা একটা ছোট ব্যাগ... পলিথিনে রয়েছে পাউরুটি যার অর্ধেকটা সে লঞ্চে খেয়েছে। চারটি মর্তমান কলাও ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। আর নিজের শরীরের চামড়ার নীচে ভাঙাচোরা একটা হৃদয়। ব্যস ! লাগেজ বলতে শুধু এইগুলোই। তবে ওর কাছে ভাঙাচোরা মনটার ওজনই বেশী হবে বলে মনে হল।

একা মেয়েমানুষ এতোদূর নৌকায় যাবে। কয়েকজন আগ্রহী হল ওকে নিয়ে যাবার জন্য। সাধারণত আজকাল এতো দূরে সেই আগের মতো ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে কেউ যায় না। পারুলের ছেলেবেলায় বাবা মায়ের সাথে সে অনেক এভাবে গিয়েছে। বিশেষ করে মায়ের সাথে তাঁর নাইয়র যাবার সময়গুলো কতটা আনন্দে কেটেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো... প্রায় শেষ মুহূর্তে সেটাকে গোপন করে তিনজন মাঝির ভিতরে অপেক্ষাকৃত যুবক জনকেই বেছে নিলো সে। সবাই এ ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষ ই বেছে নিতো। কিন্তু বাকি দুজনের চোখের নজর সে এই অল্প সময়েই পরখ করে দেখেছে। এই যুবক লোকটিকেই ওর মেয়েলি ইন্সটিংক্টে অধিকতর নিরাপদ মনে হয়েছে।
নিরাপদ!
হাসি গোপন করতে চাইলেও সম্পুর্ণ গোপন করা গেলো না। মাঝি তিনজন ওকে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে একে অন্যের দিকে তাকালো। তাতে 'মেয়েটি পাগল নাকি' টাইপ নীরব ভাষা জড়িয়ে ছিল। পারুল ও ব্যাপারটা খেয়াল করল। কিন্তু কোনো কথা না বলে নিজের লাগেজের দিকে হাত বাড়াতেই ওর ভাড়া করা মাঝি ওকে থামালো। বলল,' আপনে নৌকায় ওঠেন। আমি ওগুলান উঠাইতেছি।' কিছু না বলে পারুল ওর পার্স হাতে নৌকায় উঠে যায়। মালামাল নিয়ে মাঝিও উঠে। দড়ি খুলে একটা বাঁশের লগি নিয়ে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নৌকাকে টার্মিনাল থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। স্রোতের অনুকুলেই যাবে ওরা। নির্দিষ্ট স্রোতে গিয়ে নৌকা পড়তেই মাঝি বৈঠা হাতে নেয়। ভিতরে বসে পারুল সব দেখে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। নদীর মাঝে বয়ে যাওয়া বাতাস খুব আরামপ্রদ। তবে একটানা শরীরে লাগলে ঠান্ডা লেগে যায়ই।
এই লোকটাকে সে ভাড়া করেছে।
লোকটাকে না লোকটার নৌকাকে? নাকি দুজনকেই?
ভাবনাটা কেমন যেন একটা মাতাল করা অনুভুতি জাগায়। ঠিক এই একই চিন্তা যদি মাঝির দিক থেকে হতো? চিন্তার জগতে সেটাকে কি শোভনীয় বলা যেতো? কেন এমন হয়? একজন পুরুষ একজন মেয়েকে ভাড়া করেছে- শুনতেই খারাপ বোধটা প্রথমে কেন জাগে মনে? সে নিজে যদি একজন পুরুষ হতো, আর মাঝির যায়গায় যদি কোনো মহিলা হতো? তখন কি এই খারাপ বোধটুকু আসত? আজকাল ট্রেনচালক, বৈমানিক থেকে শুরু করে আরো অনেক গুরুত্তপুর্ন পদে মেয়েরা রয়েছে।
লোকটা একমনে নৌকা বেয়ে চলেছে। কত বয়স হবে। ২৮ কি ৩০ বছর। পারুল তাঁকে জিজ্ঞেস করে, 'তোমার নাম কি ভাই?' ভাই বলাতে মাঝি লোকটা একটু চমকে গেলো কি? নাহ! মানুষকে পরখ করতে করতে সে একটু বেশীই দেখছে বোধ হয় আজকাল। মাঝি তাঁর নাম জানালো, ' মোসলেম খাঁ'। পারুলের কাছে খাঁ শব্দটি হাসির উদ্রেক করলেও নিজেকে গম্ভীর রাখতে পারল সে। আরো গম্ভীর হয়ে বলল, ' শোন ভাই মোসলেম খাঁ, আমি একটু ঘুমাতে চাই। তোমার নৌকায় পর্দার ব্যবস্থা নাই। আর থাকলেও আমি দিতাম না, আমার কেমন কবর কবর লাগে। আমি ঘুমালে আবার আমার কাপড় চোপর ঠিক থাকে না। তুমি আবার তাকাইয়া থাকবা না।'
মাঝি ছেলেটা লজ্জা পেলো পারুলের কথায়। কিছু না বলে একমনে বৈঠা বেয়ে চলল। পারুল ডানকাতে হাতের নীচে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কতবার এভাবে নাইয়র এসেছে... এই একই পথে। কিন্তু এবারই ওর শেষ নাইয়র আসা। আর কখনো যে ফিরে যেতে হবে না ওকে। ওর পেছনের পথটি একেবারে বন্ধ করে দিয়েই সে এসেছে।
দু'ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে হাতের উপর পড়তেই ওর ভিতরের রুদ্ধ এক শ্রাবণ মেঘ তাঁর প্রচন্ড ঘনঘটা নিয়েই ধরার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
... ... ...

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না।
পানির ছলাত ছলাত আর বৈঠার সাথে নৌকার কাঠের ঘর্ষণ মিলে অদ্ভুদ এক শব্দ হচ্ছে। একটা চিল অনেক নীচুতে শব্দ করে নৌকার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। উঠে বসেছে পারুল। ঘুম থেকে উঠে মানুষ এক ধরণের ঘোরের ভিতরে থেকে যায়। সেটা কাটাতে কিছু সময় পার হয়। পারুলের গভীর ঘুম থেকে উঠলেই কেন যেন মরে যেতে ইচ্ছে করে। ছই এর ফাঁকা দিয়ে ওদের বাজার দেখা যাচ্ছে। এখনো অনেকটা দূরে। সবসময় ঠিক এতটা দূর থেকে চির পরিচিত সেই বাজার...নদীর বুক থেকে জন্ম নেয়া খাল... আর এদের দুয়ের সঙ্গমস্থলের পানির ঘুর্ণি... এসবকিছু পারুলকে কেন জানি উত্তেজিত করে এসেছে। আজ মন খারাপের এই উৎসবমুখর দিনেও মোহনার কাছাকাছি এসে নিজের ভিতর সেই একই আবেগ অনুভব করে পারুল একটু অবাক হল। তবে কি কিছু কিছু আবেগের কখনোই মৃত্যু হয় না?
হয়তবা।
আবার নাও হতে পারে। সে তো আর অনুভুতি বিশেষজ্ঞ নয়। মাঝি মোসলেম খাঁ ওকে একবার দেখে পানির দিকে নজর দিলো। এই মুহুর্তে তাঁকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে। এখানে দুইটা স্রোত... একটা ঘুর্ণিকে পাশ কাটিয়ে যার যার গন্তব্যে বহমান। খুব পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে মোসলেম খাঁ সুন্দরভাবে নৌকাকে খালের দিকের স্রোতে নিয়ে গেলো। এই সেই শ্রীরামকাঠী খাল! নিজের বাড়ির গন্ধ মাখা আজন্ম শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের সময়গুলো কাটিয়েছে সে এর তীরে... ছবির মত সুন্দর একটি গ্রামে!

বাজারের পশ্চিমপাশ দিয়ে খালটি বয়ে গিয়ে পুরনো মধুমতি নদীতে গিয়ে মিশেছে। ভীমকাঠী হাই স্কুলের পাশে নৌকা আসতেই পারুল মাঝিকে নৌকা পাড়ে ভেড়াতে বলে। নৌকা একটা কালো রং করা সেতুর পিলারের গায়ে গিয়ে থামে। এই পাশে দু' একটা হিন্দু বাড়ি। তারা ব্যবসার খাতিরে তাদের মুল বাড়ি থেকে এই বাজারে নতুন ঘর করেছে। একটা লম্বা শান বাঁধানো সিঁড়ি দেখতে পেল পারুল। পানির অনেকটা গভীরে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এটা নতুন দেখল। আগে কখনো এই সিড়িটি দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না সে। একজন মধ্যবয়স্ক হিন্দু নারী খালের পানিতে গোসল করছে। কেন জানি দৃশ্যটা খুব ভালো লাগল পারুলের।

নৌকা থেকে নেমে পারুল একা বাজারের মিষ্টির দোকানের দিকে আগালো। মন্ডল মিষ্টান্ন ভান্ডার। এর মালিক পরাণ মন্ডল গত হয়েছেন অনেক আগে। এখন তার ছেলে এটা চালায়। সন্তোষ মন্ডল- পারুলের সন্তোষ কাকু। দোকানে বসা ছিলেন। পারুলকে দেখে চোখে স্নেহের ভাব ফুটে উঠে। একটু খুশীও হন। এই খুশী কেন? ওর বয়সী সন্তোষ কাকুর মেয়ে যে পারুলের সই ছিল। এখন বিয়ের পরে জামাইকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। হাসির সাথে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন আছিস মা? কখন এলি ? জামাইবাবাজি কই?' পারুল ও হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, ' একটু শ্বাস নিয়ে নাও কাকু। একবারে কয়টার উত্তর দেবো?' হাসির ভিতরে মনের মলিনতা বের হল কি...জামাই এর কথা বলাতে একটা নপুংশক জানোয়ারের চেহারা ভেসে উঠে একমুহুর্ত... নিজেকে পিছন থেকে বর্তমান দৃশ্যপটে নিয়ে আসে পারুল। মিষ্টির ভিতরে চিনির দানা, এখানে সবাই বলে 'দানাদার' এইটি বাবার অনেক পছন্দ। এর সাথে ছোট ভাই ও বোনের পছন্দের গুলোও মিলিয়ে কয়েক কেজি কিনলো। দাম দেবার বেলায় সন্তোষ কাকু জিভ কামড়ে অনীহা প্রকাশ করেন। দুজনের ভিতর অনেকক্ষণ তর্ক চলে। শেষে মিষ্টি না নেবার হুমকিতেই হার মানতে হয় সন্তোষ কাকুকে।

মায়ের জন্য পান কিনতে তামাক পট্টিতে যেতে হল। চলার পথে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা। কুশল বিনিময়ের বাইরে তেমন কোনো কথা বলা হল না। আসলে চলার পথে আমরা শুধু সৌজন্য বজায় রাখতে 'কি খবর?' 'কেমন আছেন' জাতীয় কথা বার্তা বলে থাকি। ওদুদ কাকু এখনো শক্ত সামর্থ রয়েছেন। ওকে দেখে হাসলেন এবং যথারীতি সেই একই প্রশ্ন, 'জামাই বাবাজী আসে নাই?' একটা প্রচন্ড ক্রোধ পারুলের ভিতর থেকে বের হয়ে চার দিককে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইলো! তবুও তাঁকে মুখে হাসি বজায় রেখে প্রসঙ্গ পালটে কিছু কথা বলতেই হয়। এরা যে ওর বড়ই আপন! সেই শিশু বেলা থেকে ওনাদের কোলে পিঠে বড় হয়েছে সে। আজ কীভাবে তাঁদের সেই আদরকে উপেক্ষা করে?

মোসলেম খাঁ নৌকায় ঊঠার সময় পারুলের হাত থেকে প্যাকেটগুলো রাখতে সাহায্য করে। পারুলের বুকের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে... এতোটুকু পথ হাটতেই কেন যেন হাফিয়ে উঠেছে। মনটাও তেতো হয়ে আছে। এই সমাজে একজন নারী হয়ে জন্ম নেয়াটা কি অভিশাপ? তাঁকে কেন সব সময়ই একজন পুরুষের ছায়ায় থাকতে হয়?
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থাকে পারুল। নৌকা কবিরাজ বাড়ি পার হয়ে মৃধাদের ঘাটলার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। মাটির রাস্তা দিয়ে কয়েকটি উৎসুক মুখ নৌকার ভিতরের আরোহিনীকে দেখার চেষ্টা করে। সেদিকে পারুলের কোনো খেয়াল নেই। সে চিন্তার ভিতরে এক বিবশ অসহায়ত্তের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে। আসলে গ্রামের এই সোজা মানুষ গুলোর কোনো দোষ নেই। তাঁরা আবহমানকাল ধরে এটাই দেখে আসছে। একজন নারী ধাপে ধাপে একজন পুরুষের অবলম্বনে বেঁচে থাকে। অবশ্য প্রকৃতি এবং আমাদের পুরুষ প্রধান সমাজই এই সিস্টেমের জন্য দায়ী।
রাস্তা থেকে একটা পরিচিত গলার চীৎকারে পারুলের ধ্যান ভাঙ্গে।
ওর ছোট ভাই মাহমুদ বাজার থেকে ফেরার সময় কীভাবে ওকে নৌকায় দেখে ফেলে। ' আপায়! আপায় আইসে' বলে চীৎকার করে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। বাড়ী এখান থেকে কম করে হলেও আরো কুড়ি মিনিটের পথ। একবার মাহমুদকে ডাকে ওর সাথে নৌকায় আসার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পাগলা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে সে শিকদার বাড়ির দিকে ছুটছে। পারুলের আসার খবর একেবারে সবাইকে জানিয়ে ওদের বাড়ির ঘাটে অপেক্ষা করবে।

প্রতিবার নাইয়র আসার সময় ওর মানুষটি সাথে থাকত। মানুষ না বলে অমানুষ বললেও কম বলা হবে। তাই এবারে ওকে একা দেখেই সবার চোখে লাগছে। পারুল বাজী ধরে এ কথা বলতে পারে, সন্ধ্যার ভিতরে পুরো গ্রাম জেনে যাবে যে, রশীদ শিকদারের মেয়ের সাথে তাঁর স্বামীর ছাড়াছাড়ি (ডিভোর্স) হতে যাচ্ছে। যদিও আরো তিনমাস লাগবে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মুক্ত হতে। তবে এর পর থেকেই সহানুভুতির উছিলায় অনেকের আগমন হবে যাদের ভিতরে বেশীর ভাগই থাকবে অহেতুক কৌতূহল নিবৃত্ত করার দলে। কিছু থাকবে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার জন্য। তৃতীয় একটি দলও থাকবে। সব থেকে ভয়ংকর হল এই শেষের দলটি। এরা সহানুভুতির আড়ালে- ওর নিশ্চিত ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে ওর একহারা লোভনীয় দেহকে ভোগ করার কুৎসিত বাসনা পোষন করবে।

মন্ডল বাড়ী...তালুকদার বাড়ী...ব্যাপারি বাড়ী ধীরে ধীরে পার হয়ে যায়। খালের পানিতে গু ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়তেই পারুল আলগোছে নজর সরিয়ে নেয়। ভাবে- ওর নিজের জীবনও কি এই গু এর মত অনিশ্চিত হয়ে গেলো না? সে ও এখানে সেখানে ধাক্কা খেতে খেতে একসময় মিলিয়ে যাবে...
কলঘরটি পার হয়ে ওদের শিকদার বাড়ির ঘাটের কাছাকাছি পৌছালো। একটি কৃষ্ণচুড়া গাছ তাঁর বিশালতা নিয়ে খাল এবং রাস্তার বেশ অনেকটা যায়গায় ছায়া দিচ্ছে। ফুলগুলো লাল আগুন হয়ে চোখের দৃষ্টিকে কেড়ে নেয়। এই গাছের নীচে একটি কাঠের ক্লাব ঘর! এখন আর সেটি ক্লাব ঘর নেই। অনেক আগে কখনো ছিল।
এখানে একজন কবি বাস করে। এখনো করে কিনা জানে না। গতবার নাইয়র এসেও তাঁকে পেয়েছিল। ওর মামাতো ভাই। দুনিয়ার কোনো কাজে তাঁর মন বসে না। সে কবিতা ছাড়া আর কোনো দিকে মন দেয় না।
এই কবিই পারুলের হৃদয়কে হরণ করেছিল একদিন! সে ও যদি একটু বুঝতো! আজ হয়তো পারুলকে এভাবে রিক্তহাতে ফিরে আসতে হতো না।
একটু যদি পারুলের দিকে তাকানোর তাঁর সময় হতো! কবিতার সাদা খেরো খাতাকে কিছু সময় বন্ধ রেখে যদি সে পারুলের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করতো... কিংবা কোনো এক ঘোর বরষায় এই ক্লাবঘরে এক যুবতীর নিজেকে বিলিয়ে দেবার প্রচ্ছন্ন সম্মতির ভাষাটুকুও যদি সে দেখতে পেত সেই চোখে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেটাকে লুকানোর কোনো চেষ্টাই করল না এবারে পারুল। চোখ ঝাপসা হয়ে সামনের সবকিছুকে ঢেকে দিয়েছে। পুরনো স্মৃতি মেঘ হয়ে এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো! একজন কবি ওর মনের গহীনে এখনো এতোটা আবেগ নিয়ে বাস করছে! কই, আগে তো এভাবে অনুভব করেনি? এটা কি একজনের চলে যাওয়াতে সৃষ্ট শুন্যতাকে প্রকৃতির নিয়মে আপনাতেই ভরাট করার এক অটো প্রোসেস?
ভাবালুলতায় বিহ্বল পারুল ঘাটে ওর জন্য অপেক্ষারত মানুষদের দিকে নৌকার ছইয়ের ভিতর দিয়ে তাকায়। কিন্তু কাউকে চিনতে পারে না। যে মানুষটিকে গত পাঁচ বছরে দেহ-মন সব দিয়েছিল, সেই তাকেই চিনতে পারলনা! নিজের ভিতরে কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণের প্রথম ভালোবাসা যা এতোদিনে ফিকে হয়ে এসেছে ভেবেছে, আজ প্রচন্ড উদ্দামতায় তাঁকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করে এটা উপলব্ধিতে এলো যে, সে আসলে মানুষ চেনার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।
নিজেকে চেনাটা যে বড্ডো কঠিন!
শিকদার বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়তেই পারুল এই নির্মম সত্যটিকেও আজ জেনে গেল।
... ... ...
দেখতে দেখতে তিনটি মাস কেটে যায়।
সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আগামি কাল পারুল মুক্ত হতে যাচ্ছে! মোবাইলে ওর উকিলের সাথে কথা হয়েছে। এই নতুন বছরেই সে ভারমুক্ত হতে পারবে সেই নরপশুর থেকে।
এদিকে মধুমাস... জামাই ষষ্ঠী শেষ হয়। গ্রামের ঘরে ঘরে আনন্দ... যাদের ঘরে বিবাহিত মেয়ে রয়েছে, সেখানে এক স্বর্গীয় প্রফুল্লতা বিরাজ করছে। বাবা-মা জামাইদেরকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। শ্যালিকা ও দুলহা ভাইদের মধুর খুনসুটি... শ্যালক দুলাভাই মিলে মজার সময়গুলো কাটানো... আর কি চাই!

পারুলের এই দিনক'টি যে কীভাবে কেটেছে, একমাত্র সেই জানে। সেদিন নৌকা থেকে নামার পরে ওর বাবা এগিয়ে আসে। হাসিমুখে নৌকার ভিতর থেকে বিশেষ একজনের অপেক্ষায় থাকে। মেয়ে নেমে বাবার কদমবুচি করে। মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। ছোট ভাই-বোন বোনের আনা মমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পারুলের মা মেয়ের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা অমঙ্গল আশংকায় তাঁর বুক কেমন করে।মেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। দুফোটা চোখের জল সামলাতে মেয়ের পৃথিবী দুলে ওঠে যেন। আকাশ মাথায় ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম হয়। মাঝিকে প্রাপ্য টাকার চেয়েও অধিক বখশিস দিয়ে বিদায় করে। দুপুরের খাবার খেয়ে যাবার কথা বললেও সে রাজী হয় না।
বাবা জিজ্ঞেস করে, ' কিরে, দুলহা মিয়া কই? তোরে একা পাঠাইলো?' ঘাটে আরো অনেক কৌতূহলী মানুষের সামনে পারুল বলে, 'ঘরে চল বাবা। সে আসে নাই।' বাবা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করে... তারপর মেয়ের পিছু নিয়ে বাড়ির ভিতরে রওয়ানা হয়। একটা নষ্ট অতীত পিছনে ফেলে পারুল অনিশ্চিত এক জীবনের দিকে পা বাড়ায়।

বাড়ীর ভিতরে মা বাবা সময় পায়... পারুলও। এখন তো তাঁর অফুরন্ত সময় আর সময়। ভনিতা না করে বলে, ' আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছি বাবা!' নিজের কানে ঠিক এই কথাগুলোই শুনেছে কিনা ওর বাবার ধান্ধা লাগে। বলে,' বুঝলাম না মা। ঠিক কইরা ক'তো কি হইছে?' কি বলবে পারুল। ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারেনা। একই কথা আবার বলে। ওর বাবার হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কথা আসেনা। বুকের ভিতর একটা ব্যথা কিছুক্ষণ ঘুরপাক খায়। আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ওর মায়ের দিকে তাকায়। নীরবে দু'জনের কথা হয়। পারুলের মা চোখের পলক ফেলে। সেখানে ' আমি দেখছি' এরকম কিছু জবাব পেয়ে পারুলের বাবা ঘর থেকে বের হয়। একজন পরাজিত ভাঙাচোরা মানুষ দুজন নারীকে একা রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
মা মেয়ে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। এরপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পারুল সব কথা মায়ের সাথে শেয়ার করে। নিকট অতীতের ধুম্রজাল ভেদ করে স্মৃতিরা ডানা মেলে কালো আকাশে... ... ... বেশ আগে ফিরে যায় পারুল।
পিরোজপুর সরকারী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করার পরেই পারুলের জন্য প্রস্তাব আসতে শুরু করে। পারুলের আরো পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাবা-মা'র ইচ্ছের কাছে তাঁর এই সুপ্ত ইচ্ছের মৃত্যু হয়। এলাকার একজন সেই সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। ছেলে ঢাকায় থাকে। অনেক বড় ঘর। অন্তত পারুলদের তুলনায় পার্থক্য বেশী চোখে পড়ার মত। হাবিব মুন্সীকে নিয়ে পারুলের বাবা আর সাবেক চেয়ারম্যান মালেক শিকদার ঢাকা গিয়ে ছেলেকে দেখে আসে। সুদর্শন ছেলে তাঁদের মন কাড়ে। তারপর নিজেদের বাড়ী... সামাজিক স্ট্যাটাস এসব কিছু মিলিয়েই তাঁরা খুশী হয়। 'নাহ, মেয়ে আমার সুখেই থাকবে' বাড়ি এসে পারুলের মাকে কত বড় গলা করে বাবা বলে। মা ও খুশী হয়। সপ্তাহখানেক পরে ছেলের অভিভাবকরা ঢাকা থেকে এসে পারুলকে দেখে যায়। তাদেরও মেয়ে পছন্দ হয়। দুপক্ষের ইচ্ছেতেই দিনতারিখ ধার্য হয়।
খুব ধুমধাম করে পারুলের বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামের সবাই এই নব দম্পতিকে দেখে ইর্ষা করে। মনে মনে বলে,'বাহ! কত সুন্দর জুড়ি'। আসলেই তাই। প্রথম দেখায় পারুল নিজেও মাহতাবকে দেখে চোখের আলোয় জ্বলে ওঠে। ওর হৃদয়ের বীণা অচেনা সুরে বেজে উঠে। কিন্তু তাঁর এই আনন্দ... হৃদয়ের তারে বেজে ওঠা মধুর ঝংকার অচিরেই শেষ হয়ে যায়। ঢাকায় গিয়ে নিজের শ্বশুর বাড়ীতে তৃতীয় দিনেই সবার আসল চেহারা সামনে চলে আসে। মাহতাব যে একজন অ্যালকোহলিক! শুধু এটা হলেও ব্যাপার ছিল না। সময়ের সাথে সাথে পারুল মানিয়ে নিতো... মাহতাবকে ফিরিয়ে আনতো এই মরন নেশা থেকে। কিন্তু ড্রাঙ্ক অবস্থায় সে পারুলের সাথে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করা শুরু করে। একজন বিকৃতমনা নপুংশক সে। পারুলের সাথে টর্চার করা ছাড়া একজন পুরুষ হিসাবে সে ওর সামনে দাঁড়াতে পারে না। একজন অক্ষম পুরুষ সে।

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে পারুল। কি করা উচিত তাঁর। নিজের ভাগ্যের ওপর তো তাঁর কোনো হাত নেই। এই স্বামী-সংসারেই তাঁকে মানিয়ে চলতে হবে। কিন্তু মাহতাব দিন দিন ওকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেই চলে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেখে ও না দেখার ভান করেন। বরং শ্বাশুড়ি ছেলেকে ঠিক করতে না পারার দায় ওর ওপর চাপাতে চায়। বিভিন্ন মানুষের উদাহরণ টানেন। তাঁরা কীভাবে মদ্যপ স্বামীকে পথে এনেছে সেগুলো সবার সামনে আলোচনা করেন... ওর ব্যর্থতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।

কিছুদিন পরে শুরু হয় অন্যদিক থেকে কথার নির্যাতন। মাহতাবের আত্মীয়-স্বজন নতুন বউকে দেখার জন্য আসে। আর মহিলাদের মেয়েলি টাইপ কথাবার্তা তো ঘুরতে থাকে মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে ছেলেকে কি দিলো না দিলো সেগুলো নিয়ে। পারুলের বাবা তাঁর যতটুকু সামর্থ্য করেছেন। কোনো দিক থেকে কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তারপরও মাহতাবদের সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী তাঁর সেভাবে দিয়ে থুইয়ে খুশী করাটা সম্ভব ও ছিল না। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জিনিসপত্র দেখে মোটেও খুশী হয় না। ইচ্ছেকৃত কথার বাণে জর্জরিত করে পারুলকে। প্রতিদিনই সে মরতে থাকে এই পরিবারে।

এভাবে মাস ঘুরে বছর যায়... আরো সময় কাটে উদ্বেগ অশান্তি আর হীনমন্যতায়। এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকুরি নেয় পারুল। কচি কচি বাবুদেরকে নিয়ে জীবনের একটি না পাওয়া আশার মিছে স্বপ্ন দেখে সে... অতৃপ্তি মিটাতে চায়। এদিকে মাহতাবের মা দাদী হবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে। আর সন্তান না হবার জন্য মুহুর্তে মুহুর্তে পারুলকে দোষারোপ করে। পারুল সব সত্য জেনেও নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে চুপ থাকে। এর মাঝে জামাই ষষ্ঠীর দিনে ওরা দুজন পারুলের বাড়ীতে নাইওর আসে... দুজনে খুব স্বাভাবিক থাকে... মিথ্যে অভিনয় করে। এরপর ফিরে এসে আবারো সেই রোবট জীবনে অভ্যস্ত হয়। সেই তুতু ম্যায় ম্যায়... দিনরাত গঞ্জনা সহ্য করে যাওয়া... রাতের পর রাত অক্ষম পুরুষটির বিকৃত যৌন জীবনের সাধ মিটানো... নির্ঘুম কাটানো রাতের পর রাত।

এরপর একদিন ওরা পারুলের সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়। পারুলের বাবাকে কথায় কথায় গাল দেয়াটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মাহতাবের তিন নম্বর ভাইয়ের জন্মদিনের উৎসব। অনেক মানুষ এসেছে। সেই অনুষ্টানেই মাহতাব ড্রিঙ্ক করে এসে সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে পারুলের সাথে ঝগড়া শুরু করে। ধীরে ধীরে সে উগ্র থেকে উগ্রতর রূপ ধারন করে। এক পর্যায়ে গায়ে হাত তোলে। আর ওর বাবা-মাকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল তো রয়েছেই। পারুলের মাথার এক পাশে মাহতাবের উন্মত্ততায় কেটে যায়। মুখে ও চোখের পাশে কালসিটে দাগ পড়ে । আর হৃদয়ের ক্ষত সেতো বাইরে থেকে দেখা যায় না। এতোগুলো মানুষের সামনে প্রচন্ড অপমানে সে নিজের রুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়। মাহতাব দরোজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করে... একপর্যায়ে পারুল ভিতর থেকে দরোজা খুলতে বাধ্য হয়। উপস্থিত অতিথিরা সবাই চলে যেতে যেতে ওর শাশুড়ির কথা শোনে। সে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বউ এর যত দোষ বলতে থাকে। এক সময়ে মাহতাব রুমের ভিতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে। আহত পারুলের উপর ওর বিকৃত কাম-লালসা মেটাতে চায়। কিন্তু একজন অথর্ব পুরুষ সময়ের আগেই নিঃশেষ... নিস্তেজ হয়ে নিজের বুঝটা বুঝে নেয়।

একটা সপ্তাহ নিজের বাহ্যিক ক্ষতগুলো ঠিক হবার জন্য পারুল স্কুলেও যায় না। ওর এক সহকর্মী বাসায় আসে। সে সব দেখে, শোনে। দুঃখ পায়। প্রতিবাদ করার কথা বলে। পারুল চুপ করে শোনে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
কিছুদিন পরে পারুল ও মাহতাবকে রেখে বাসার সবাই তাদের গ্রামের বাড়িতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যায়। সপ্তাখানেক থাকবে। প্রথম রাতেই বাজারের এক মেয়েকে নিয়ে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরে মাহতাব। পারুলের শেষ যে সুতোটুকু ছিল মাহতাবের সাথে- সেই ভালোবাসার লিঙ্কটা এক নিমিষে কেটে যায়। নিজের চোখে মাহতাবের এতোটা নীচে নেমে যাওয়া দেখে নিজের প্রতিই ঘৃনায় দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিবাদ করলে ওকে মেরে ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দরোজা বন্ধ করে দেয়। একই সাথে দরোজা দুই দিক থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। পারুলের মনের দ্বারও একেবারে বন্ধ করে দেয় সে নিজেই। সেই রাতটা সহকর্মীর বাসায় কাটায়। পরের দিন সহকর্মী ওকে এক মহিলা সংগঠনে নিয়ে যায়। এরা নারীর উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। তারাই তার স্বামীকে ডিভোর্স এবং নারী নির্যাতনে মামলা করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু পারুল শুধু ডিভোর্স দিতে চায়। বাড়িতে বাবা-মাকে কিছুই জানায় না। মাহতাবের পরিবারের সবাই এসে সব ঘটনা শোনে। প্রথমে একটু হৈচৈ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারুলের পাশে মহিলা সংগঠনটি থাকায় তারাও চুপ মেরে যেতে বাধ্য হয়। কারণ তা না করলে মামলায় জড়াতে হবে এটাও বুঝে যায় তারা। শেষে উভয়পক্ষের সম্মতিতেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। পারুলের পরিচিত উকিল জানায় সব কিছু শেষ হতে আরো তিনমাস সময় লেগে যাবে।
তিনমাস। মানে সামনের বছর। ইংরেজী নববর্ষ! পারুলের জীবনেরও নতুন করে শুরু করার বছর। একটি নতুন বছর হয়ত ওকে নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাবে।
হয়ত নেবে না। জীবন তো এমনই অনিশ্চয়তায় ভরা। তাই তো জীবন এতো রোমাঞ্চকর!
... ...
জীবনের সকল আশা নিরাশায় পরিণত... শুন্য বুকে শেষ হয়ে যাওয়া অনুভূতি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে পারুল।
তবে সে আশা হারায় না। জীবনের পথে পথে বাধাঁ থাকেই। তাকে অতিক্রম করে সামনে আগানোটাই তো মানব ধর্ম। জীবনে যখনই উপলব্ধি হয় যে আমি তো শেষ, ঠিক সেখান থেকেই আবার নতুন জীবনের পথচলা শুরু হয়। পারুল ও সেভাবে জীবনের পথে চলা শুরু করে।
হেঁটে হেঁটে খালের পাশের কৃষ্ণচুড়া গাছ যে ক্লাব ঘরটিকে পরম মমতায় ছায়া দিয়ে রেখেছে- সেদিকে মনের অজান্তে কখন যে সে চলে এসেছে টেরও পায়না। এখানে যে মানুষটি থাকে, তার প্রতি প্রকৃতি যতটা মমতা ঢেলে দিচ্ছে... পারুলের মনের গভীরে তার থেকেও ঢের মমতা জমে আছে। কিন্তু এতোদিন সে সেটা অনুভব করতে পারেনি।
অনুভব করেনি?
নাকি জোর করে দমিয়ে রেখেছিল। আজ রিক্ত হবার দরুন ই কি সেই মমতা সেনাবাহিনীর মত চারদিক থেকে ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছে?
পায়ে পায়ে ঘরটির দরোজার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে। ওকে যা সিদ্ধান্ত নেবার এখুনি নিতে হবে। দরোজার ওপাশে জীবন ওর জন্য পুর্ণতার ডালি নিয়ে হয়তোবা অপেক্ষা করছে... হয়তো এগুলো সব ওর অলীক ভাবনা। আর ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে- সেই নোম্যান্ডস ল্যান্ডে পায়ের নীচে মাইন বসানো। খু্ব সাবধানে সেই পথে চলতে হবে। কি করবে পারুল? জীবন-মৃত্যু এক পলকের দূরত্বে... কত কাছাকাছি! ভালোবাসার ঘ্রাণ ছোট্ট সেই ঘর থেকে ওকে আহ্বান করছে।
কিন্তু সব ডিসিশন কি পলকেই নেয়া যায়!!
... ... ...
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। তবে এই লাইনটার ভিতরে যে আবেগ ও সুর মুর্ছনা রয়েছে, ঠিক তাতে অনুপ্রানিত হয়েই সবাই এই ফুল ছিড়ছে না। অধিকাংশই অন্যের দেখাদেখি পেতে চাইছে। ছোট ছেলেদের দলই এই কাজে অধিক উৎসাহী। বৃষ্টি শুরু হলে আর গাছে ফুল ধরলেই ওদের গাছতলায় আনাগোনা বেড়ে যায়। ডালসুদ্ধ ভেঙ্গে নিয়ে আসে। আর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বাড়ি ফেরা কোনো পথিক চকিতে গাছের দিকে তাকায়। দুষ্ট ছেলের দলের নিকট ইচ্ছের অজান্তেই একটা ফুল চেয়ে বসে। তবে কি এটাই ঠিক, এই সময়টাতে আমাদের অবচেতন মন কদমের অপেক্ষা করে?
আবার স্কুল পলাতক কোনো ছেলে লুকিয়ে নতুন বিড়ি বা সিগ্রেট ফুঁকছে... একটু ঘন জঙ্গলে বা বাগানবাড়ীর অব্যবহৃত কোনো নিভৃত কোণে। তারও হঠাৎ ইচ্ছে হল,কদম লাগবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সাথের হতচ্ছাড়াকে সঙ্গে নিয়ে বেপারী বাড়ির কবরস্তানের পাশের কদম গাছটির নীচে হাজির। নিজে ওঠে না। সঙ্গীকে গাছে উঠিয়ে ছিড়ে আনতে বলে। এই ফুলই শিকদার বাড়ীর অষ্ঠম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটির পড়ার টেবিলে দেখা যায় সুর্য পাটে যাবার আগে। খুব যত্নে রেখে দেয়া... যেন কত সাধনার জিনিস! এভাবেই বর্ষা আর কদম ফুল- আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। হোক না তা শহর কিংবা গ্রামে। সব যায়গায়ই তো মানুষের ভিতরে হৃদয় ই থাকে, নাকি অন্য কিছু?

হাঁটু পর্যন্ত কাঁদায় মাখামাখি হয়ে কবি মুজিবর মোল্লা শ্রীরামকাঠী বাজার থেকে ভিজে ভিজে ফিরছে। তবে পথের এই কষ্টকর পদযাত্রা তাঁকে একটু ও নিরাশ করেনি...অথবা পারেনি মেজাজ খারাপ করা অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে জনপ্রতিনিধিকে একটি বিশেষ শব্দে সম্বোধন করাতে। আসলে সেই শুরু থেকেই ওর মাথায় বর্ষা আর কদম এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে, চলার পথ আর আশেপাশের কোনো কিছুই তাঁকে প্রভাবিত করছে না। ওর পাশ দিয়ে কয়েকজন দ্রুত হেঁটে চলে গেলো। দু'জনের মাথায় বিশাল কচু গাছের পাতা। ছাতা হিসাবে ব্যবহার করছে। একজন পলিথিন দিয়ে মাথাকে এমনভাবে ঢেকে নিয়েছে যে, বৃষ্টি নিজেই এতোটা ভড়কে গেছে, পারলে ওর মাথার আশপাশ দিয়েও যাবে না । মুজিবর নিজে অবশ্য ছাতা মাথায় দিয়ে আসছে। একটা কোনার শিক যে সূতার সাথে সেলাই অবস্থায় থাকে, সেটা ছিড়ে গেছে। এখন এক কোনা বেঢপ ভাবে ভাঙা হাতের মত বাঁকা হয়ে ঝুলছে। জোর বাতাস ওর ছাতাটিকে কয়েকবার উড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল।

শিকদার বাড়ির আগেই মোল্লা বাড়ি। ওর নিজের বাড়ি। ওরা মোল্লা বংশ। শিকদাররা ওদের আত্মীয়। মুজিবরের মামা বাড়ী। পারুল ওর ফুফাতো বোন। পাশাপাশি দুই বাড়ী। চলতে চলতে থমকে যায় কবি মুজিবর। সবাই ওকে কবি ডাকতে ডাকতে সে নিজেও তাঁর নামের সাথে এই উপাধিটা লাগাতে দ্বিধা করেনা। পারুল! পারুলকে কেন মনে হল? আরো তো ওর ভাই-বোন রয়েছে... তাঁদের কথা কেন মনে হল না? এতোক্ষণ বর্ষা-কদম এগুলোর সাথে সাথে তাহলে ওর অবচেতন মনে পারুল ও কি সেই বাজার থেকেই ছিল? নিজেকে জিজ্ঞেস করে মুজিবর। বলো, বলো কবি? সেই বাজার থেকে নাকি আরো অনেক আগে থেকে? হ্যা... আট আটটি গ্রীষ্ম পেরিয়ে কদম নিয়ে উচ্ছ্বাস করার সেই সময়কে পেরিয়ে...তারও আগে থেকেই পারুল হৃদয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়িয়ে আছে। নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি! কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে না? না, সময় আপেক্ষিক... এর শুরু বা শেষ নাই। যখনই তোমার মনে হবে শুরু করা যায়- তখনই সময়ের শুরু। দেরী বলতে কিছু নাই। কৃষ্ণচূড়া গাছটির সামনের কালভার্ট পার হবার সময় এক দমকা বাতাস ওর হাত থেকে ছাতাটি ঊড়িয়ে নিয়ে একেবারে ক্লাব ঘরটির দরোজার সামনে নিয়ে ফেলে।

মেয়েলি হাসির শব্দে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বাস্তবে ফিরে এলো সে।
যার কথা এতো তন্ময় হয়ে ভাবছিল, সে ই ওর দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ওর দরোজার চৌকাঠ ও উপরের সামান্য শেডের আশ্রয়ে থেকে পারুল বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে চাইছে। কবি'র এই অবস্থা দেখে না হেসে পারল না। বৃষ্টি উপেক্ষা করে একটু এগিয়ে ছাতাটি হাতে তুলে নেয়। কবি'র হাতে দিতে দিতে বলে,
- কোনো কিছুই দেখছি তোমার হাতে থাকে না কবি!
কিছু না বলে ছাতা হাতে নেয়। চাবি বের করে দরোজা খোলে। নিজে ভিতরে ঢুকে বাইরে দাঁড়ানো পারুলের দিকে তাকায়। একটু ইতস্তত বোধ করে। ভিতরে ডাকবে কিনা? ইতোমধ্যে সে ভিজে একাকার। বেশীক্ষণ এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।ঘরের ভিতরে ছাতাটি মেলে দিয়ে ওকে বলে,
' ভিতরে আসবে?'
চকচকে চোখে একঝলক হাসি নিয়ে পারুল বলে,'কেন?'
এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। তবুও বলে,' তোমার ঠান্ডা লাগবে যে।' এবারে পারুল ভিতরে আসে... ওর একমাত্র খাটটির উপরে বসে পা ঝুলিয়ে দেয়। তারপর বলে,'আমাকে ভিতরে না ডেকে তোমার ছাতাটা দিলেই তো বাড়ি যেতে পারতাম!' মুজিবর কথা না বলে মেলে দেয়া ছাতাটি বন্ধ করে পারুলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ কবির চোখে চোখে তাকিয়ে থাকে পারুল। কেন জানি মুজিবর চোখ নামিয়ে নেয়। ছাতাটি আগের মত রেখে দিয়ে পারুল বলে,' তোমাকে সব কিছু বলে দিতে হয় কেন কবি? নিজের থেকে কিছুই কি পারো না তুমি?' একটু হাসে মুজিবর। একটা গামছা বাড়িয়ে দেয় পারুলের দিকে। যেন যেটুকু পারে বৃষ্টির ছোঁয়া মুছে ফেলুক। নিজেও হাত দিয়ে মাথার চুলে এক বিশেষ পদ্ধতিতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পানি ফেলে দেয়। টেবিলের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে। এবারে বলে,
' আমি কিছুই পারি না তোমাকে কে বলল? আমি কবিতা লিখতে পারি... তোমাকে ছুঁয়ে দেয়া নির্লজ্জ বৃষ্টির তোমার শরীরে একে দেয়া অদৃশ্য আল্পনাকে আমার লেখায় ফোটাতে পারি।'
- হ্যা, আপনি অনেক পারেন।
'ব্যঙ্গ করলে?'
- না, রঙ্গ করলাম। তোমার সাথে তো আমার রঙ্গ করার সম্পর্ক।
মুজিবর ভেবে পায় না কি বলবে। এই মেয়ের প্রতি ওর যে একটা বিশেষ মায়া রয়েছে, সে কি তা জানে? না জানাই ভালো। মায়া কাউকে বুঝতে না দেয়াই ভালো। কারন একবার বুঝিয়ে দিলে, তা থেকে ফিরে আসা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

কিন্তু পারুলের থেকে ওর ফিরে আসার দরকারটাই বা কি? সে কি পারুলকে এখনো ভালোবাসে? এখনো? তার মানে ওকে আগেও ভালবাসত! তবে সময় থাকতে সে প্রকাশ করেনি কেন? তবে কি সে একজন ভীরু? নিজের মনে মুহুর্তের ভিতরে কত রকম প্রশ্ন জেগে উঠে। পারুলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় অবশেষে।
- কবি। তোমার ক্যাসেট প্লেয়ারটাও কি তোমার মতো? নাকি বাজে?
' ওটা ওর কাজ ঠিক মতই করে। আমার মত না।'
ক্যাসেট প্লেয়ার টি অন করে দিতেই সাগর সেনের গলায় রবি ঠাকুরের অমীয় বাণী বেজে উঠে-
" আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলংকভাগী" ... ... ...
বাহিরে তুমুল বর্ষণ... কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ক্লাব ঘরটির টিনের চালে বৃষ্টির কান্না... ঘরের ভিতরে একজন হৃদয়ভাঙা যুবতী কন্যা... তন্ময় হয়ে শুনছে এক বিশ্ব কবির... একজন প্রেমিক পুরুষের হৃদয় উজাড় করে লেখা গান!

গান শেষ হলে পারুল নিজেই ক্যাসেট বন্ধ করে দেয়। বলে, ' উফ! অসম্ভব সুন্দর একটা গান! আমার খুব ভালো লাগে।' কবি মুখে বলে, 'হ্যা!' আর মনে মনে বলে,' তোমাকেও আমার খুব ভালো লাগে পারুল!... গানের মতো ভালো লাগা নয়... গান শুনলে হৃদয়ে যে অদ্ভুদ ভাব জাগে তার মত না... একেবারে অন্যরকম।'
আজ কবি মুজিবরের কি হয়েছে কে জানে
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ “ওটা ওর কাজ ঠিক মতই করে। আমার মত না।” মানে কী ? ভাগ্যিস ! কবি মুজিবর মোল্লাকে মাহতাবের মত নপুংশক ঘোষনা দেবার আগেই গল্পটাকে শেষ করেছেন । নইলে শেষ ভরসা টাও কালিগঙ্গা নদীতেই ডুবে যেত ! ভীষণ ভাল লাগল আপনার চমৎকার গল্পটা । নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল ।
গল্পের আরো কিছু অংশ ছিল, কিন্তু মনে হয় শব্দের লিমিটের জন্য সেটুকু পোষ্ট হয়নি। ভালো লাগল আপনার সুন্দর অনুভূতি।। আর 'ওটা ওর কাজ ঠিক মতই করে, আমার মত না' এখানে কবি মুজিবর পারুলের ভালোবাসাকে সবার সামনে স্বীকার করে ওকে নিজের করে নিতে চায়নি। এরপরেই পারুলের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়। আসলে মুজিবরের সাহস ছিল লা ভালোবাসাকে সবার সামনে নিয়ে আসার। একটু ভীরু টাইপের, কিন্তু নপুংসক নয়। ভালো থাকুন আপনি। শুভ সকাল।
ভীষণ ভাল লাগল আপনার প্রতি উত্তর টা । ভাল থাকবেন সব সময় ।
মালিহা তাসনীম খুব ভালো লাগল। কিন্তু ভোট দেবার কিছু খুঁজে পেলাম না।
ভালো লাগেনি ৫ জানুয়ারী, ২০১৫
ভালো লাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এখানে কোনো ভোটের ব্যাপার স্যাপার ছিল কি?

২৫ সেপ্টেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৩০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪