প্রেম কাজে বেলে

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

সবুজ মজুমদার
  • 0
  • ১০০
আমি মোঃ মোবারকর হোসেন, পিতা মৃত: হাজি আলী আহম্মেদ, গ্রাম- সোনাপুর, ডাকঘর: নয়া হাঁট, উপজেলা: সোনাইমুড়ি, জেলা: নোয়াখালী।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশের বালূঘাট গ্রাম থেকে ২৭ শে মার্চ ১৯৭১ ইং তারিখে দক্ষিণ খাঁন এলাকায় আসি। সেখান থেকে দুই তিন দিন পর নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সঙ্গে দুই/তিন জন সাথি ছিলো, পায়ে হেঁটে তারাবো ঘাঁটে আসি। সেখান থেকে বাসে নরসিংদী লঞ্চ ঘাটে আসি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাধ্যমে লঞ্চের ব্যবস্থা করতে নরসিংদী থেকে নবীনগর আসি লঞ্চে করে। সেখানে মাদ্রাসা বা কলেজে ঐ রাত্র যাপন করি। পরের দিন সকালে দুই তিন জনের সাথে নৌকা ভাড়া করে কুমিল্লা কুটি বাজারে আসি। সেখানে আমরা খাজনা আদায়কারী নায়েব সাহেবের কাচারিতে উঠি। ঐ রাত্রে নায়েব সাহেবের মেহমান হিসাবে আমাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করে খাওয়ান, ঐ রাত্র ঐ খানে থাকি। সকালেও ভালো নাস্তা করান। নাস্তার পরে আমরা রওনা দিলাম জাপরগঞ্জ/বাগমারা সড়ক দিয়ে রিক্সা, বেবিট্যাক্সি,ি পায়ে হেঁটে লাকসাম এসে পৌছি। লাকসাম স্টেশন মাষ্টারের নিকট জানতে পারলাম যে, নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে কোন ট্রেন ছাড়বেনা। তখন আমি একা রেল লাইন দিয়ে পায়ে হেঁটে সোনাইমুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে রাস্তার দু পাশে স্থানীয় মানুষেরা ডেকে ডেকে ঢাল রুটি খাওয়াইয়াছে। আড়াইটা তিনটার দিকে আমি সোনাইমুড়ি আসিয়া পৌছি। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমি আমার বড়ির দিকে রওনা হই। বিকাল ৪/৫ টার দিকে আমি বাড়িতে পৌছি। বাবা, মা, কাকা বাড়ির অন্যান্যরা আমাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তারা ভাবছিল আমি মারা গিয়াছি। আমাকে আর পাওয়া যাবে না। গ্রামে আমি তেমন পরিচিত নয়। বাড়ি এবং পাশের বাজার এই পর্যন্তই আমি চিনি। কয়েকদিন বাড়িতে রইলাম। একদিন হঠাৎ গ্রামে কয়েক জন ছেলের সাথে ইন্ডিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে কানকির হাঁট চলে এলাম। এখানে এসে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা না পেয়ে রাত্র কাটিয়ে পরের দিন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কাউকে না বলে আসতে বাবা কান্নায় ও দু:চিন্তায় অস্তির। দিনের ১০/১১ টায় আমাকে পেয়ে খুব খুশি। এর ভিতরে হঠাৎ একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে আমিশাপাড়া এলাকায় এসে রাস্তার পার্শে এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তখন মানুষ আতঙ্কে অস্তির। আমার কাকা আব্দুল গনি সাহেব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত ই.এম.ই কোরের নায়েব সুবেদা। আমার চাচাত ভাই নূরুল আমিন সাহেব ই.পি.আর. থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে এম.এ.এস. এ টেলিফোন কমপ্লেইন অপারেটরে চাকুরী করতেন। দেশের যখন অসহযোগ আন্দোলন চলে তখন আমার চাচা আব্দুল গনি সাহেব চৌমূহনী কলেজে ছাত্রদের ট্রেনিং দেন। আমার চাচাতো ভাই নুরুল আমিন সাহেব আমাদের ০৮ নং সোনাপুর ইউনিয়নে ছাত্র শ্রমিক জনতা সকলকে ট্রেনিং দিতেন। আশে পাশে এলাকা থেকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা আমাদের বাড়ীতে এসে আমার চাচার সাথে পরামর্শ করতেন।
একদিন সকাল ১০/১১টায় আমি উঠানে আমার ছোট চাচাতো ভাই বোনদের নিয়ে খেলতে ছিলাম। এমন সময় চাচা আমাকে ডেকে বললেন, মোবারক, আমি ইন্ডিয়া যাবো, তুমি আমার সাথে যাবে কিনা? আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কখন যাবেন? ওনি বললেন এইতো কিছুক্ষণ পরে। আমি লুঙ্গি/শার্ট চাচীর দেওয়া মশারী ও কিছু চিড়া বেগে ভরে তৈয়ার হয়ে গেলাম। আমার আর তর শয়না। কখন বাড়ী থেকে বের হবো। বেলা ৩/৩.৫ টায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লাম। চাচা আগে আমি পিছনে। পথ প্রদর্শক হিসাবে আমার এক চাচা (সিদ্দিক কাকা) আমাদের সাথে এলেন। ই.পি.আর.এর আরও একজন লোক আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়াছিল। কোথাও সম্মুখ যুদ্ধে। ইন্ডিয়াতে যাবে চিকিৎসার জন্য। তার হাতে বাঁশের একটি লাঠি ছিল। লাঠির ভিতরে দায়িত্বপূর্ণ কারো একটি চিঠি ছিল। আমরা হাটতে হাটতে চৌদ্দগ্রাম থানার এক গ্রামে এলাম। সিদ্দিক চাচার শ্বশুর বাড়িতে সন্ধ্যা বেলায় আশ্রয় নিয়েছি। রাত্র ওখানে ছিলাম। সকালে নাস্তা করে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম ভারতের উদ্দেশ্যে। সিদ্দিক চাচা গ্রামের বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিল। হাটতে হাটতে বেলা সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার টার দিকে আমরা ডিমাতলী সীমান্তে এসে পৌছলাম। ট্রাংক রোড পার হয়ে ভারতের হীমাতলী সীমান্তে বি.এস.এফ এর তিন চার জন জোয়ানের সাথে দেখা হল। আমার চাচা তাদের কাছে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তারা চাচাকে সালাম করে হেন্ডশেক করে চেয়ারে বসতে দিলেন। আমি পাশে দাড়ানো। তারা জিজ্ঞাসা করলো আমি কে? চাচা উত্তরে বললেন আমার ছেলে। মিনিট দশেক এখানে সৌহার্দপূর্ণ আলাপ করার পর একজন পাহাড়ি লোককে ডেকে আমাদের গাইড হিসাবে দিয়ে দিলেন। তার কাঁদে একটি গাদা বন্দুক ছিল। সে আমাদেরকে "ছোত্তাখোলা" ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের পাশেই তার বোনের বাড়ি। সন্ধ্যা সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ টার দিকে আমরা ছোত্তাখোলা ক্যাম্পে উপস্তি হই। ক্যাম্পটি স্থানীয় ভাবে একটি ছোট হাটের পাশে। আমার চাচা ফেনির এম.এন.এ খাঁজা সাহেবের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করেন। উনি খাঁজা সাহেবের নিকট থেকে একটি চিঠি নেন বিলেনিয়া যাওয়ার জন্য। ঐ রাত্রে আমরা ওখানে একটি দুচালা ছনের ঘরে (সাপ্তাহিক হাটের ব্যবসায়িদের) রাত্রি যাপন করি। ছাত্র, শ্রমিক, সামরিক বাহিনীর অল্প সংখ্যক লোক সেখানে ছিল। রাত্রে গোল হয়ে মাটিতে বসে রুই মাছ দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম। পরের দিন চাচা ভাতিজা আবার রওয়ানা দিলাম বিলোনিয়ার উদ্দেশ্যে।
হাটতে হাটতে বিকাল ৪/৫ টার দিকে বিলোনিয়া উপস্থিত হলাম। চাচা গেলেন সুবিদার/নায়েব সুবেদারদের তাবু টাঙ্গানো ক্যাম্পে। আমি গেলাম বিলোনিয়া প্রাইমারী স্কুলে। এখানে দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো, দুপুরে এবং রাত্রে। বাড়ী থেকে চাচী কিছু চিড়া দিয়ে ছিল। দু'টার মুট খেয়ে পানি খেয়ে থাকি।
এইভাবে ৫/৬ দিন পর আমার চিড়া শেষ হয়ে গেল। পকেটে টাকা নাই। এর ভিতর হঠাৎ একদিন আমার বন্ধু ফয়েজদের বাড়ীর কর্মচারীর সাথে দেখা হল কিচেন রুমে। সেই আমদের পাক করে। বন্ধুর খোজ খবর নিজের খবর সবই দিল নিল। রাত্রে খাওয়ার পর কিছু ভাত বাকী থাকে। সে সকালে গোপনে এক প্লেট আধা প্লেট যা পারে আমাকে দিত। আমি চুপে চাপে এটা খেয়ে নিতাম। এভাবে কয়েকদিন চললো। সমবয়সী ছেলেদের সাথে দল বেধে বিলোনিয়া শহরের এদিকে সেদিকে ঘুরা ফিরা করে দিল কাটাতাম। প্রত্যেকদিন সকালে কিছু পিটি করি ফেনীর কলেজ ছাত্র স্কাউটদের দ্বারা। একদিন ৪/৫ জন মিলে মহল্লার ভিতরে ঘুরতে গেলাম দেখি এক বাড়িতে শ্রাদ্ধ খাওয়াচ্ছে। আমরা বসে গেলাম কলা পাতা নিয়ে। পাঠার গোস্ত না কিসের গোস্তা নানিনা তবে চারটা খেয়ে নিলাম। আমরা স্কুল রুমে ঘুমাতাম। এক রাত্রে ভরতীয় সামরিক বাহিনীর কর্নেল অথবা ব্রিগেডিয়ার পদের একজন এসে আমাদের দেখে গেল। আরেক রাত্রে এক যুবক (কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হবে) এসে বলল অনেক বুলেটের ব্যাঙ এসেছে তোমরা কেকে যাবে ওগুলি আনতে। ঐ রুমে আমি সবার আগে হাত তুললাম। বেশ কয়েকজন একত্র য়ে রওয়ানা হলাম। বুলেটের বাঙ্ আনতে। দেখি আমাদের সেনা বাহিনীর সব অফিসার লুঙ্গি/পেন্ট পড়ে নদী পার হচ্ছে। ঐ দলে জিয়াউর রহমান সাহেবও ছিল। একজন বললেন উনি মেজর জিয়া সাহেব। নদীর মাঝখানে (মাটি ফেলে পায়ে হাটার ব্যবস্থা করলেন বর্ষা ছিল না) আমি জিয়া সাহেবকে দেখে বললাম আমি ছাত্র। আমি শ্রমিকদের সাথে কাজ করব না। উনি দাঁড়িয়ে আমাকে শান্তভাবে বললো, আমরা সবাই এখন এক, আমরা সবাই এক সাথে কাজ করবো। ওপার থেকে বুলেটের বাঙ্ নিয়ে অনেক কষ্ট করে স্কুলে নিয়ে এলাম আমরা কয়েক জনে। বিলোনিয়াতে সেনা বাহিনীর একটা মিটিং হয়ে ছিল। নোয়াখালীর দক্ষিণে চর এলাকায় মুক্তি বাহিনীর শক্ত ঘাটি করবে। সেখান থেকে কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামের সেনা নিবাসে গেরিলা আক্রমন করবে। এর ভিতর বহুবার বর্ডার সাইডে আক্রমন করা হযেছে। এভাবে ঘুরু ফিরা করে বিলোনিয়া শহরে দিন যাচ্ছে। বিভিন্ন জনের মুখে জানতে পারলাম মাইদির এম.পি. কচি সাহেব বিলোনিয়া ডাক বাংলায় আছেন। এর ভিতর একদিন নোয়াখালী জেলার এক চিত্র নায়য়িকাও এসে উপস্থিত হন ডাক বাংলায়। কিচ সাহেব হলো আমার বন্ধু ফয়েজ সাহেবের খালাত বা মামাতো ভাই। একদিন ৬/৭ জন মিলে আমি এম.পি সাহেবের কাছে উপস্থিত হলাম। আমি বল্লাম আমি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় টপী (ফয়েজ) আমার বন্ধু। আমি এখানে ট্রেনিং এর কোন ব্যবস্থা পাইতেছিনা। আমাদেরকে এখানে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দিন। উনি আমাদেরকে বললেন যে, তোমরা "রাজনগর" ক্যাম্পে যাও। সেখানে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আছে। আমাদের নাম লিখে একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমার হাতে উনি। ঐ দিনই আমরা ৬/৭ জন ১/২ টার দিকে রওয়ানা দিলাম রাজনগর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। এম.পি সাহেব আমাদের ৬/৭ জনের টিম লিডার বানিয়ে দিলেন আমাকে বিলোনিয়া থেকে রাজনগর ক্যাম্প যাওয়া পর্যন্ত। আমরা মানুষকে জিজ্ঞাস করে এই ভর দুপুরে রৌদ্রে হাটতে হাটতে সন্ধ্যাবেলা রাজনগর এসে পৌছলাম। এসে দেখালাম বাংলাদেশ থেকে আগত রিফিউজি অনেক হিন্দু মুসলিম পরিবার এখানে ক্যাম্পে আছে। বিভিন্ন জনের কাছে জিজ্ঞাসা করে ট্রেনিং সেন্টারের দিকে যাওয়ার পথে লুঙ্গি পড়া গেঞ্জি গায়ে (পাশে কুড়ে ঘর) সুন্দর হালকা চেহারার এক ভদ্র লোক রাস্তার পাশে বসা। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কোথা থেকে এসেছো কোথায় যাইবা? আমি বললাম আমরা বিলোনিয়া থেকে এসছি এম.পি কচি সাহেব আমাদেরকে পাঠাইয়াছে ট্রেনিং এর জন্য। এই লোককে আমরা গ্রাম এবং বাড়ীর ঠিকানা ও বললাম। আমার চাচার নাম ও বললাম। চাচার সাথে ভারত এসেছি এও বললাম, আমার চাচাকে উনি চিনছেন। ইনিউ হলেন আমাদের এম.এন.এ হানিফ সাহেব।

রাজনগর ক্যাম্প:
আমি এখন রাজনগর ক্যাম্পে এলাম। এসেই দেকি কয়েক জন ছইয়াল ছোন আর বাঁশ দিয়ে নূতন ঘর বানাইতেছে। একটি ঘর পূর্ব পাশ্চিম লম্বালম্বি। আরেকটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি। পূর্ব পাশ্বে গাড্ডার পাশেই পক্ ঘর। তার পাশেই একটি ছোট বিশ্রাম ঘর। এই বিশ্রাম ঘরে এম.পি. এম.এন. এ ও অন্যান্য দায়িত্বপূর্ণ লোকেরা বসেন। টিলায় একটি মাঝার শরীফ (কবর) আছে পাকা করা। এই টিলার উত্তর পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা রাজনগর থেকে পশ্চিম দিকে আঁকা বাকা হয়ে গিয়াছে। এখানে প্রতিদিন সকালে আমাদের পিটি করানো হয়। পিটি ইন্সট্রাকটর সেনা বাহিনী এবং নৌ বাহিনীর তিনজন লোক ছিলেন। এখানে সকালে চিড়া ভিজাইয়া গুড় দিয়া দুই মুটি দিতেন নাস্তার জন্য। আমি এই চিড়া বণ্টন করতাম। সকাল ১৫/১১টায় খিদা লাগতো। ৪/৫ জন মিলে জঙ্গলে চলে যেতান- জাম, ডউয়া, চাম্বর খেতে জঙ্গ দল বেঁধে ছোন কেটে মাথায় করে নিয়ে আসতাম। ক্যাম্পের ভারতীয় ইনচার্জ ছিলেন ক্যঅপটেরন আর.পি.সিং উনি মাঝে মাঝে আমাদের ক্যাম্পে ভিজিট করতেন। আমাদের এম.পি. এম.এন.এ সাহেবরা ও প্রতি দিন আসা যাওয়া করতো। ক্যাম্পে প্রতিদিন ছেলেদের সংখ্যা বাড়তে ছিল। কখনো কখনো ২/৩ জন করে রাত্রে পালাইয়া যাইতো। ওখানে জোক আর মশার খুব উপদ্রব ছিল। একমাত্র আমার নেওয়া একটি মশারী বের করে ছিল। সকালে চিড়া ভিজা নাস্তা বিকালে ডাল ভাত রাত্রে ডাল ভাত বা কখনো মাছ তরকারী। ডাল কম হলে পাশের গর্ত থেকে লাল পানি দিয়ে দিত। রাত্রে ডালের সাথে এভাবে দিন যাচ্ছে, ওখানে একদিন কয় টার সময় ডাক পড়লো আর.পি.সিং সাহেব শিকারে যাবেন। কয় জন ছেলের দরকার। আমিও আরও কয় জন উনার জীপে করে জঙ্গলে চলে গেলাম। আমাদের সাথে অন্য কেহ ছিল কিনা মনে নাই। শিকারে গিয়ে গুলির আওয়াজে দুই/একটি শুয়র ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নাই। হরিন পাওয়া গেল না। বিকালে চলে এলাম আমরা ক্যাম্পে। এভাবে তিন বেলা রিফুজি খানা-ফাকে ফাকে বাগানে গিয়ে নানা রকম ফল ফলাদি খেয়ে দিন যাচ্ছে।
এর ফাঁকে ফাঁকে মোস্তাফিজ ভাই (দুইবার এম.পি বেগমগঞ্জ থানা এলাকার) অন্যান্য মাঝারী ধরনের নেতৃবৃন্দকে ট্রেনিং এ যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেন। সবাই আশ্বাস দিত। সবচেয়ে অনুবিধা আমি এখানে কাহারো সাথে পরিচিত নয়। নিজেই ধীরে ধীরে সকলের সাথে পরিচিত করে নিয়েছে। একদিন গোডাউন থেকে চাউলের বস্থা আনার জন্য কয়েক জনের ডাক পড়েছে। রাস্তা ছিল কাচা কিছুটা কর্দমাক্ত। গরু গাড়ীতে করে চাউল আনার ব্যবস্থা হল। দাস নামে এক হিন্দু ছেলে ও ছিল আমাদের সাথে। সে বস্তা গুরু গাড়ীতে উঠাতে গিয়ে স্লিপ খেয়ে কিছুটা হোচট খেল। সে তার অসুবিধার কথা আমাকে বল্লো। আমি ক্যঅম্পে এসে ডাক্তার কেন ক্যাম্পো পাওয়া যায় না, ডাক্তার নেতাদের পিছনে ব্যস্ত থাকে আমাদের প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। এ ধরনের বাক্য উচ্চস্বরে বলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও চেচমেচি করেছি। এঘটনা হলো সন্ধ্যা বেলায়। ব্যাশ আমার বিপদ। ক্যাম্পে খিছু পেতী নেতা থাকাতো। এরা যুবক বয়সের। আমার এই কথাগুলি এম.পি. এ. এন.এ দের নিকট অভিযোগ করেছিল যা আমি জানতাম না। পরের দিন বেলা ২/৩ টার সময় ওসি ফারুক নামে (যাকে ঐ দিনই প্রথম দেখেছি, আমি কোন দিন দেখিও নাই চিনওনা) এক লোক দুইতিন জন পাতি নেতা সাইজের ক্যাম্পে এসে একছেলের মাধ্যমে আমাকে ক্লাব ঘরে ডেকে নিল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো কিছুটা। চাপের মুখে আমার নাম বাবার নাম গ্রামের নাম কার সাথে এসেছি ? মজার কথা হলো আমি আমার আশে পাশের গ্রামের নাম ঠিকমত বলতে পারি নাই। আমি বলেছি আমার চাচা নায়েব সুবেদার আবদুল গণি সাহেবের সাথে এসেছি। এই ক্যাম্পে এম.পি. কচি সাহেব পাঠাইয়াছে। বেগমগঞ্জ থানার ওসি ফারুক নামে লোকটি আমার উপর রাগান্বিত হয়ে একজনকে বললো, এর ঘারে দুই মন লাকড়ীর বোঝা দিয়ে দোড়াইতে বল। যে পর্যন্ত গিয়ে পড়ে যায় সেখানে তাকে গুলি করে ফেলে দিও। আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। কারণ আমি এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ অন্যায় করি নাই যে, আমাকে এতবড় শাস্তি পেতে হবে যা মৃতু্য সমতুল্য। আমার পাশে দাড়ানোছিল এ.এম.সি কোরের একজন নায়েক। যিনি একদিন আমাদের বাড়ীতে এসে আমার কাকার সাথে আলাপ আলোচনা করেছিলেন, তখনকার পরিস্থিতির উপর। ওনি ওদেরকে বলল ও'ছেলে মানুষ বুঝতে পারে নাই। ও আর এসব করবে না বলে আমাকে বললো তুমি তোমার জায়গায় যাও। ইম আমার সমবয়সীদের নিয়ে প্রতিদিনের মত চলছি। তার পরেরদিন বা দু'চারদিন পরের ঘটনা কিনা আমার জানা নাই। সকালে সবাইকে পিটি ও হালকা ট্রেনিং দেওয়ার পর দেখি ক্যাম্প ইনচার্জ কেপ্টেন আর.পি.সিং (ভারতীয়) আমাদের এম.এন.এ হানিফ সাহেব, এমপি মোমেন (চার এলাকার) সাহেব ও অন্যান্য এম.পি এবং আওয়ামী লীগের কিছু সদস্য উপস্থিত হল। আমরা সবাই গোল হয়ে বসলাম। এমন সময় ক্যাপ্টেন আর.পিসিং. সাহেব বললেন "ইহাঁ কেন আদমি ডাক্তারকা লিয়ে বোলাহায়" সবার মাঝখান থেকে আমি হাত তুলে বললাম হামনে বোলাহে। এই বলে ঐ দিনের ঘটনা উদর, বাংলা, ইংরেজীতে সকলের সামনে সাহস করে বললাম। ওনি তখন শান্তনার সুরে বুঝাইয়া বললেন ভাইসাব হামারা ইয়ে এলাকা পাহাড়িয়া জংলী আনডেলোপমেন্ট এলাকা ইহাঁ ডাক্তার মিলনা মুসকিল হ্যায়। আপলোককা গঁওমেবি ৬/৭ মাইল দূর দূর ডাক্তার কাবি কাবি মিলতা হ্যায়। এই ভাবে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে ঐ দিন মিটিং শেষ করলেন। ঐ দিন গত রাত অথবা দুই তিন দিন পরের এক রাত্রে ৮/৯ টার সময় তখনকার ছাত্রলীগের এক মাঝারী নেতা আমাকে ডেকে নিয়ে এক গাছের নিচে বসলেন। "আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনাকে যদি কখনো ট্রেনিংএ পাঠানো হয় আপনি যাবেন কি না? উত্তরে আমি বললাম আমিত ট্রেনিং নেওয়ার অপেক্ষায় ঘুরতেছি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনাকে যদি একটি চাকু দিয়া ঢঅকা রেডিও অফিস ধ্বংস করতে পাঠানো হয় আপনি তা পারবেন কিনা? উত্তরে আমি তাকে বললাম যদি আমাকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হয় তাহলে আমি পারব"। আমার "অজান্তে হয়ে গেল আমার ইন্টারভিউ"। পরের দিন কমল দা নামে এক ছাত্র নেতা আমার নিকট এসে বললো তোমার যা যা আছে তা নিয়ে রেডি থাক। তোমাকে ট্রেনিংএ পাঠানো হবে। তবে কাউকে এ কথা বলবা না। আমি ৩টা কি সাড়ে তিনটায় মিলিটারির গাড়ী করে তোমাকে নিয়ে যাবো। আমি এ কথা শুনে আনন্দে ডগমগ। আমার মশারী, শার্ট ব্যাগে ঢুকাইয়া এদিক সেদিক পাইচালী করতেছি। ওখানে যারা আমার অজান্তে আমার যাওয়ার ব্যাপারে জানত তাদের কেহ কেহ আমার প্রতি বেশ আনন্দভাব। বেলা তিনটার দিকে সামরিক বাহিনীর একটি ট্রাক রাজনগর ক্যাম্পের উত্তর পাশে এসে দাড়াল। কমল দা এসে আমাকে বললো গাড়ীতে এসে বস। আমি গিয়ে বসলাম। আমার সাথে আরও একজন অন্যজায়গা থেকে আনা হয়েছে। তার নাম আহাম্মেদ করিম। সে চৌমুহনী ডেলটা জুট মিলের এক পার্টনারের ছেলে বলে পরিচয় দিয়াছে। পরে ট্রেনিং পিরিয়ডে এই ছেলেটির সাথে আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। আধা ঘন্টা পরে গাড়ী ছাড়ল, গাড়ী গিয়ে থামলো রাজনগর ক্যাম্পের পাশে আর.পি.সিং সাহেবের অফিসের সামনে। আমরা নেমে আর.পি.সিং সাহেবের অফিসে গেলাম। সেখানে উপস্থিত ছিল আর.পি.সিং, এম.এন.এ জনাব হানিফ, জনাব মুস্তাফিজ ভাই আরও অন্যান্য। আর.পি.সিং হাসেবে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো ÒI hope you will be the best guiralla Ó । ব্যাস এ পর্যন্তই। ছালাম দিয়ে আবার উঠলাম গাড়িতে। গাড়ী চলছে আমার অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। শেষ সময় উদয়পুর হোল্ডিং ক্যাম্পে এসে থামল। এখানে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ছাত্রদের বাছাই করে এনে জড়ো করা হয় ট্রেনিং ক্যাম্পএর উদ্দেশ্যে। এখানে সম্ভাবত সাত আট দিন ছিলাম। একদিন জনাব আ.স.ম. আব্দুর রব ভাই এসে একটা লিষ্ট করে নিল আমাদের। একদিন ১০/১১ টার সময় গাড়ি এসে আমাদের সবাইকে আগরতলা বিমান বন্দরে নিয়ে গেল। কার্গো বিমান এসে থামলো দেখলাম বিমান থেকে খসরু ও অন্যান্যরা নামতেছে, আর আমরা লাইন ধরে উঠার জন্য প্রস্তুত। বিমানে উঠলাম দুপাশের লম্বা লম্বা সিট। আমি গোল জানালার পাশে বসলাম। দৃশ্য দেখতেছি নিচে তাকালে দেখা যায় ছোটছোট মানুষ, গরু-ছাগল, পাহাড় গুলি সবুজ সারিবদ্ধ মনে হয যেন নিখুত আর্ট করা। বিমানে এ প্রথম উঠা। তাও আবার কার্গো বিমানে। বিমানের গ্যা গ্যা আওয়াজ কান বন্ধ করে দেয়। এভাবে এক সময় আসাম গোহাট্টি বিমান বন্দরে বিরতির জন্য থামল। ওখানে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার হিসাবে পরটা,ভাজি,চা নিয়ে আসা হলো। দুপুরের লান্স এভাবে হলো গোহাট্টি বিমান বন্ধরে। কিছুক্ষণ পর বিমান ছাড়ল ইউপির উদ্দেশ্যে। তখন সূর্যডুবু ডুবু অবস্থায় ঝলমলে দেখাচ্ছিল। এখানে আগেই আমাদের জন্য তাবু টাংগানো ছিল। আমরা তাবুতে গিয়ে বসলাম। সাথে সাথে চা আসল আমরা চা পান করলাম। কিছুক্ষণের ভিতর সামরিক ট্রাক আসলো ৪/৫ টা আমরা উঠে বসলাম। ট্রাক রওয়ানা দিল সাহারান শহরের উপ দিয়ে দেরাদুনের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল্ রাত্র হয়ে গেল গভীর, সেখভানে এক গ্রোরিশন ওয়ার্কশপএ এসে ট্রাক থামলো। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমাইয়া পড়লাম। ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৪ টার দিকে আমাদের ঘুমথেকে জাড়ালো এবং চা, মুরি দিল। নাস্তা খাওয়ার সাথে সাথে আবার ট্রাকে উঠে পড়লাম। এবার চলছে দেরাদুন জেলা- তেন্দুয়া গেরিলা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। ট্রাকের পিছনে দুপাশের দৃশ্য দেখতেছি। অপরূপ সুনদর এই পাহাড়িয়া এলাকাটি। বৃটিশ সরকার পাহাড়ের পেট কেটে কেটে রাস্তা বানিয়েছে এই পাহাড় থেকে সামনের পাহাড়ের পর আর কিছু দেখা যায় না। মনে হয় যেন সামনের পাহাড়টি শেষ। এভাবে যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে ময়ুর, বাঘ, শিয়াল, বানর, হনুমান বিভিন্ন জীবযন্তু দেখলাম। পাহাড়ের ভিতরে গর্ত করে মানুষ তাকে তাও দেখলাম। সকাল ৯ টা ১০ টার সময় আমরা দেরাদুন ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হলাম। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পিটি গ্রাউন্ডে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়ালাম। মেজর মালহুত্রা, আরেক ক্যাপ্টেন লেপ্টেন্যান্ট কর্ণেল ডোগরা সাহেব সহ উস্থিত ছিলেন। মেজর মালহুত্রা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন আমাদের উদ্দেশ্যে। তার পর বেরাক দেখাইয়াদিল, বিছানা পত্র, ডাংরী, জংলী বোট, জোতা, সামরিক ট্রেনিংএর জন্য সবই ছিল। ডাংরী পড়ার পর আমার কাছে খুব মজা লাগলো। কারণ আমি আকারে সবার মাঝে ছোট ছিলাম ভাল্লুকের মত লাগতো। শুরু হলো ট্রেনিং অল্প সময়ে ( মোট-৩৯ দিন) বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং দেওয়া হলো। যাকে লিডার ট্রেনিং বলা হত বা (Second Lietenant commssion training) এই ট্রেনিং সেক্টর টি হলো এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থানীয় গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প, বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় গেরিলা ক্যাম্প এখানে আমরা (৩৯) ঊনচলি্লশ দিন ছিলাম।
এই ক্যাম্পের বৈশিষ্ট্য হলো ঝবধ ষবাবষ থেকে সাড়ে বার হাজার ফিট উপরে। নুতন যে কোন লোক পাঁচ মিনিট হাঁটলে দম নিতে হয়। আকাশের মেঘ গুলি ক্রস করতে গাড়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ে, নীচের দিকে তাকালে মানুষ গুলিকে খুব ছোট আকারের দেখায়। এখানে আমাদেরকে যুদ্ধের কলা কৌশলসহ এস.এম.জি, এল.এম.জি, গ্রেনেড, এঙ্প্লোসিভ, মহিন পোত সহ লিখিতভাবে নানা রকম ধারনা দিয়া ছিল। লেকচারের সময় ভারতীয় ফুল ল্যাপ্টেন্ট দুজন আমাদের সাথে বসে ক্লাস নিতেন। আমি এল.এম.জি ঋরৎবরহম এ সুবধিা করতে পানি নাই। কিন্তু পষড়ৎরহম এবং গ্রেনেড ঞযৎড়ঁরহম এ খুব ভাল করেছি। মাঝে মাঝে ঘরমযঃ পেট্রোল বা মার্চ হতো। আমরা একজন আরেক জনের পিছনে বেল্ট ধরে ধরে হাটতাম। কারণ যদি বেখেয়ালে নিচে পড়ে যাই তাহলে আর রক্ষা নাই। ওখানে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম। প্রথম প্রথম শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। ওখানে নতুন যেকোন লোকের গায়ে জ্বর-শরীর ব্যথা হয় আমারও হয়েছিল। আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সিরাজুল আলম খা সাহেব ঐ ক্যাম্প ভিজিটে গিয়েছিল। সাথে ছিল শেখ ফজলুল হক মনি, তোফয়েল ভাই। সিরাজুল আলম খা আগে সাথে ভারতীয় গ্যারিলা প্রধান মেজর জেনারেল ওভান সাহেব। পিছনে তোফায়েল ভাই ও মনি ভাই। ওনারা হাসপাতালে ঢুকে যারা অসুস্থ সবাইকে দেখলেন। আমার সিটের সামনে জোনারেল সাহেবসহ দাঁড়ালেন প্রায় ১ মিনিট। অন্য কোন রোগীর পাশে দাঁড়ায়নাই। হাসপাতালে আমি দু'তিন দিন ছিলাম। বাংলাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রামের ব্যাপারে ভারতে যতগুলি ট্রেনিং ক্যাম্পছিল, এই কেন্দুয়া ক্যাম্পেটি হল সবচেয়ে সপিস্টিকেটেড ট্রেনিং ক্যাম্প। এই ক্যাম্পেই ব্রিটিশ ভারতীয় সামরিক অফিসারদের ট্রেনিং দেওয়া হত। যেমন- বাংলাদেশে জোনারেল ওসমানী, পাকিস্তানের আইয়ুবখান, ইয়াহিয়া খান, ভারতের সর্বাধিনায়ক মানেক শাহ। এঁনারা সবাই এখান থেকে ট্রেনিং নিয়েছিল। আমি ভাগ্যবান যে আমিও এখান থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। এখানে আমি মুজিব বাহিনীর তৃতীয় ব্যাচে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ট্রেনিং পিরিয়ডে প্রতি দশজনকে নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। আমার টিম লিডার ছিল ফেনীর ভি.পি.জয়নাল ভাই। স্বাধীন হওয়ার পর যিতি দুই দুবার বি.এন.পি.র পক্ষ থেকে এম.পি. হয়েছিলেন। তৃতীয় সেশনে আমরা বেগমগঞ্জ থানার ১১ জন ট্রেনিং নিয়েছি। ট্রেনিং পিরিয়ডের অনেক স্মৃতির মাঝে একটি স্মৃতি আমার অনেক মনে পড়ে তা হলো একদনি এম.টি. প্লাটোন ইয়ার্ড জৈনিক শিখ সুবেদার সাহেব আমাদের এল এমজির উপর ট্রেনিং দিচ্ছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের মুখামুখি হয়ে গেলে উত্তেজিত অবস্থায় এক সৈন্য অপর সৈন্যের অস্ত্র নিয়ে টানাহেচরা করে। কোন মতে, অস্ত্র ছাড়া যাবে না এধরনের একটি উদ্দেশ্য সুবেদান সাহেব আমাকে বললেন তার হাতের এল.এম.জি.টি ধরে টানা হেচড়ার জন্য। উনি দুই হাত শক্ত করে এল.এম.জি ধরে হাতের কুনুই পাকা ফ্লোরের সাথে টাচ করে রেখেছিল। আর আমি শত্রু পক্ষের সৈন্য, তার হাতের এল.এম.জি ধরে তাকে সহ টাকা হেচড়া করে এল.এম.জি কেরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে কিছুতে এল.এম.জি ছাড়তেছেনা আমি পাকা ফ্লোরে তিন চার হাত টেনে তা কুনুইয়ের চামড়া কেটে রক্ত ঝরঝর করে বের হচ্ছিল। এটা দেশে সে লাফ দিয়ে উঠে আমাকে মাংকি বলে এক ধমক দিল। আমি ভেবা চেকা খেয়ে জয়নাল ভাইকে বললাম ভাই ওনার কাছে মাপ চেয়ে নি। উনি বল্লেন না লাগবেনা এর জন্য কিছুই হবে না। আমি মনে মনে কিছুটা সাহস পেলাম। দুনিয়াতে যদিতিন বাঁচব এ স্মৃতিটা আমি কখনোই ভুলব না।
সি-লেভেল থেকে এ ক্যাম্পটি সাড়ে বার হাজার ফিট উপরে বলে এখানকার আবহাওয়া ঠান্ড ও অঙ্েিজন পিউর। এখানে মাত্র ৩৯ দিন ছিলাম। সম্পূর্ণ সামরিক নিয়ম কানুনের মধ্যে আমরা এখানে ট্রেনিং নিয়েছি। ট্রেনিং শেষ দিনক্ষণ ঠিক হল একদিন আবার কার্গো বিমানে করে আগরতলা উদয়পুর হোল্ডিং ক্যাম্পে এলাম। সঠিক মনে নাই এখানে কয়দিন ছিলাম। উদয়পুর থেকে আমাদেরকে একদিন এক কর্ণেল সাহেব এসে লাইন ধরাইয়ে বলল কে কোন অস্ত্র নিবে। যাদের শরীর উঁচু স্বাস্থ্যবান তাদের এল.এম.জি আমার মত উচ্চতা কম বা অল্প শরীর তারা এস.এল. আর নিল কেহ কেহ স্টেনগান নিল। গ্রেনেট কম্বলচারী, প্রত্যেককে দুইটা করে এক কোট গুলি দেওয়া হলো।
কে কোন জেলায় বা কোথায় যাবে তাও জিজ্ঞাসা করা হল। কেহ ঢাক, কেহ নোয়াখালী বিভিন্ন জন বিভিন্ন জায়গার নাম বললো। আমি শিশুকাল থেকেই ঢাকায় লেখা পড়া ও বড় হয়েছি। কিন্তু নোয়াখালীতে আমার জন্য রাজী হলাম। কারণ: যুদ্ধে যদি আহত বা নিহত হই তাহলে আমার বাড়ীতে আমার বাবা মা ভাইয়ের নিকট আমার লাশ পৌছানো যাবে। ঢাকাতে আমার খোঁজ কেহ নিতে পারবেনা। কারণ আমার বাড়ী ঢাকা সেনানিবাসের পাশ্বর মানিকদি গ্রামে। তাও আবার বাড়ীটি এয়াক ফোর্সে এর ফ্যামিলি কোর্যাটার্স এর জন্য সরকার একোয়ার করে নিয়ে গেছে। ঐ সময় খীলক্ষেত সরকার বাড়ীর পাশে আমাদের আড়াই কাঠা জমি ছিল মাত্র। যাহোক উদয়পুর থেকে একদিন রাজনগর ক্যাম্পে এলাম। খুব সম্ভব বেলা ২টা আড়াইটার সময়। সন্ধ্যার দিকে আবার রওয়ানা দিলাম সামরিক ট্রাকে করে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। এই ট্রাকে আমাদের জন্য সব আমর্স এমুনেশনন্স ছিল। রাতের অন্ধকারে ত্রিপুরার পাহাড়িয়া অঞ্চলের আঁকা বাঁকা উঁচু নিচু কাঁচা পথে আমরা সীমান্তে এসে পৌঁছালাম। প্রত্যেকের হাতে যার যার আমর্স তুলে দিলেন। "আমরা সীমান্ত দিয়ে মনের আনন্দে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা প্রতিজ্ঞা নিয়ে লাইন ধরে বাংলাদেশে ঢুকে পরলাম।"
আমাদের এঙ্প্লোসিভের গাট্টিটি ছিল তখনকার দিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকা শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভঁূইয়া সাহেবের মাথায়। উনি লুঙ্গিকে হাটু পর্যন্ত উঠাইয়া আমাদের সকলের আগে আগে হেটে রওনা দিলেন। বেশ লম্বা লাইন গভীর রাত্র হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা বৃষ্টি মাথায় হাটতেছি। হাটতে হাটতে এক ঝোপের পাশ দিয়ে হাটতে গিয়ে হঠাৎ আমাদের উঠাইয়া আমাদের সকলের আগে আগে হেটে রওনা দিলেন। বেশ লম্বা লাইন গভীর রাত্র হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা বৃষ্টি মাথায় হাটতেছি। হাটতে হাটতে এক ঝোপের পাশ দিয়ে হাটতে গিয়ে হঠাৎ আমাদের ওহভড়ৎসবৎ আমাদেরকে বিপদজনক সংকেত দিল। সংকেত দেওয়ার সাথে সাথে হুড়া হুড়ি করে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে গাছের কানায় আমার বেগ আটকে গিয়ে আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। আর আমি গিয়ে পড়লাম রাজাকার বা চোরের গায়ের উপর। ঐ বেটার শরীর ছিল খালী, আমাদের ভয়ে সেও আত্মগোপন করেছিল। তার গায়ে লোম সব কাঁটার মত অবস্থা ছিল। আমি আমার ব্যাগ আর পেলাম না। ব্যাগে ছিল ট্রেনিং এর মূল নোট বইগুলো। ট্রেনিং এর সব কিছু এই নোট বুকে লিখা ছিল। আমি এই জজ্ঞলের ভিতর দিয়ে পালাতে গিয়ে পাশে এক ডোবার পারে গিয়াছিলাম। ডোবাটি ছিল গোবরের গর্ত। পানি এবং গোবরে আমার কোমর পর্যন্ত ডোবে গিয়েছিল। আমার সাথে আরও ২/৩ জন ছিল। তাদেরকে বল্লাম অন্য দিক দিয়ে যাওয়ার জন। এফাকে আমরা পশুরাম নদীও পার হরাম। নদী পার হতে একটি কোশা নৌকা পেলাম ঐটা ওখানে বাধা ছিল হয়তো আমাদের জন্য। নদী পার হওয়ার সময় আমাদের একজনের এস.আর.টি নদীতে পড়ে গেল। সময়টা ছিল খুব ভোর রাত্র। আমরা যে স্থানটা থেকে নদী পার হচ্ছিলাম তার এক দেড় মাইল দুরে ফুলগাজি/গুনবতি রেওয়ে স্টেশন দেখা যায়। সেখানে পাকিস্তানী সৈন্য উপস্থিত ছিল। তখন ভোরের আলো। আমারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গাইড হারা হয়ে গেলাম। চার পাঁচ জন একত্রে হয়ে হাটা শুরু করলাম। আমিত কোন জায়গার নাম ধান কিছুই নাজি না। আমাদের মাঝে দুই একজন অল্প অল্প জানতো, তাদের কথায় এগিয়ে যাচ্ছি সামনে। গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসা করে আমাদের এক গ্রুপের খোঁজ পেলাম। এক বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তারা কেসার পড়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্চে। আমরাও তাদের সাথে নৌকায় উঠে গেলাম। কেসার পাড়া রুহুল আমিন সাহেবের এক বাড়ির পাশে এক খোলা মেলা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ভঁূইয়া সাহেবকে অল্প সময়ের জন্য দেখলাম। উনার নির্দেশে আমরা এক প্রুপ কাশিপুর চলে এলাম। নৌকা করে । দুপুরের খাবার ওখানে সেড়ে নিলাম। বর্তমানে আমার যে শ্বশুর বাড়ি ঠিক ঐ বাড়ীর পুকুর পাড়ে খালের পাড়ে নৌকা থামলো। ২-৩ জন নৌকা থেকে নামলাম, এদকি সেদিক তাকালাম নতুন জায়গা বলে। নৌকা দেখে দুই তিন জন বার তের বৎসরের ছেলে আসলো খালি গায়ে আমাদের নৌকার পাশে। তাদেরকে আমি সেখান থেকে সরাইয়া দিলাম। মজার কথা এরাই আমার ছেলে মেয়েদের মামা বর্তমানে। এদের কেউ আজ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যাংক অফিসার। আরও মজার কথা নৌকা নিয়ে আমার শ্বশুরের চাচাতো ভাইদের বাড়ীতে আমাদের আশ্রয়য়ের ব্যবস্থা করলাম। আমি কি জানতাম সেদিন, চবি্বশ বছর পর এরা আমাদের আত্মীয় হবে। এভাবে এ গ্রাম থেকে ঐ গ্রামে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। আমার মনে পড়ে আমরা আবুল খায়ের কোম্পানীর মালিকের বাড়ির কাঁচারীতে বসে ওনার সাথে কথা বলে ছিল। তখন তিনি গ্রামের একজন সাধারণ ও সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। বর্তমানে এ পরিবারটি আমার ছেলে মেয়ের এক মামার চাচা শ্বশুর। রেল রাস্তার পূর্ব পাশ্বর্ে অনেক গ্রামে ছিলাম। বেশী মনে পড়ে মির্জাপুর গ্রামের কথা। এ গ্রামের বড় বাড়ির পাশের এক গরীব বাড়িতে একবার আমরা কয়েক দিন ছিলাম। আমরা ৫-৬ জন নুরনবী নামে একটি ছেলে আমাদের নেতৃত্বে ছিল। কারণ সে ঐ আশে পাশের এলাকা চিনত। এই বাড়ির একটি ঘটনা আমার সব সময় মনে পড়ে। আমরা সারাদিন একটা রুমে চুপ চাপ বসে থাকতাম। একদিন ঐ ঘরের বয়স্ক মহিলার বোন পুত বেড়াতে এলো খালার বাড়িতে। খালা পড়ল মহা বিপদে বোন পুত্রকে নিয়ে। বোন পুত যেন টের না পায় তাহার ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা আছে। কোন পুতকে নানাভাবে কথাবার্তা বলে বিদায় দিতে পেরে তাহার আনন্দ দেখে কে। তাহার চেহারাটা আনন্দে ডগ মগ করছিল। এ দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত সহায়ক এ দেশের গ্রামের অশিক্ষিত মা বোনেরা। এনাদের স্বাধীনতার আনন্দের সম্মান আমরা দিয়েছি কি না তাহার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব না। আরও একদিনের এক ঘটনা আমারা কয়েকজন কোথাও যাচ্ছি। এক বৃদ্ধ ফকির আমাদের উদ্দেশ্যে করে বল্লো আমার কাছে তেমন কিছুই নাই। আধা কেজির মত সারা দিনের ভিক্ষার চাউল আছে। আপনারা আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। হে জাতি এ হাড্ডিসার ভিক্ষুকের স্বাধীনতার ঋণ কি কোন দিন দিয়েছি। এ দেশ প্রেমিকের কথাকি আমরা কি কখনো স্মরণ করেছি? একদিন রাত্রে আমাদের জেলা কমান্ডার বেলায়েত ভাইকে দেখলাম আমাদের কয়েকজনের সাথে দেখা করলো। উনার সাথে দুই তিন জন ছাত্র নেতা ছিল।
চৌমুহুনী তেকে মাইর তিনেক পূর্বে চৌমুহুনী, ফেনী সড়কের পাশে বিরাট এক গাছ রাস্তা
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মা'র চোখে অশ্রু যখন ভালো লেগেছে অনেক বড় গল্প এটি
সূর্য পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলেছি, এতো ইতিহাস, এটাতো ভাই গল্প না। আত্মজীবনী। তাও মনে হলো আরো বাদ পড়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ইংরেজী শব্দ ছিল সেগুলো বাংলা বর্ণে রূপান্তরিত হয়ে একটা ভজকট অবস্থা হয়েছে। পুরো ইতিহাস না টেনে সংক্ষিপ্ত করে লিখলে অনেক ভালো হতো । দোয়া রইলো আপনার জন্য ........
নষ্ট কবিতার একটি অংশ ( Nirob Ouhan Masum) আপনার লেখার ধরনটি বেশ অদ্ভুদ । সত্যিই অনেক ভার লাগলো । আর আপনার লেখাটি আমার নিকট সেরা হয়ে রইলো ।ধন্যবা আবারও লিখবেন । এবং আমার লেখাগুলো পড়ার আমন্ত্রণ রইলো ।
বিষণ্ন সুমন আল্লাহ আপনার ভালো করুন ভাই, ভোট দিলাম
জাবেদ ভূঁইয়া ভাল লাগল ।আর বড় লেখা ।অনেকটা ইসলামিক দৃষ্টিকোন থেকে লিখা ।আমার মনে হয় ইসলামিক দৃশ্টিকোন থেকে এটাই মনে প্রথম আমার পড়া গল্প ।ধন্যবাদ লেখককে এরকম একটা আকর্শনীয় লেখা লেখার জন্য ।
বিষণ্ন সুমন জটিল একটা লিখা ........
বিন আরফান. এরকম, ইসলামিক ধাচের লেখা কম লুকেই লিখে. আমার সাথে আপনার বিসয়্গ্ত মিল আছে . কেহ মাইন্ড কোর্লেঊ বলতে ধিধা নেই, এ সংখ্যার সেরা গল্প . সালাম ভাই আপনাকে . ভোট দিলাম, দোয়া করি আরো ভালো লিখেন

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪