একাত্তরের মার্চ মাস শেষ হতে আর মাত্র দুই এক দিন বাকি আছে । এরই মধ্যে জেলা শহর থেকে দলে দলে বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার, উকিল-মোক্তাররা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের তান্ডব থেকে জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধ্যানে ছুটছে তো ছুটছেই । কেউই জানে না তাদের গন্তব্য কোথায় । শুধু চায় জীবন আর মান সম্ভ্রম বাঁচাতে ! গ্রামের কাঁদা মাটির ভাঙ্গা চোরা রাস্তায় গরু, মহিষ অথবা ঘোড়া গাড়ির শোয়ারী হয়ে, কেউবা পায়ে হেঁটেই সাগরের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গভীর গ্রামেরও গভীরে । উদভ্রান্ত, ক্ষুধায় শ্রান্ত, পথ চলায় ক্লান্ত মানুষগুলো জানেনা তারা কোথায় যাবে । শুধু ছুটছে আর চুটছে । চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ, যেন মৃত্যু বিভীষিকা থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া কোন বিধ্বস্ত জনপদবাসী ।
ফয়েজ মিয়ার বাপ দাদারা যমুনার ভাঙ্গনে ছিন্নমূল মানুষের মত আশ্রয় নিয়েছিল জেলা শহর খেকে প্রায় ছয় ক্রোশ দূরে এই মথুরাপুর গ্রামে । সে সময়ই কাজের সন্ধ্যানে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার কোন খবর কেউ রাখতে পারেনি । পূর্বসুরীদের দেহান্তের পর শুধু বৃদ্ধা মাকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তার জীবন যাত্রা । এখন তার ঘরে ছয় আর তিন বছর বয়সের দুটি পুত্র সন্তান আলাল-দুলাল হয়েছে তাদের দাদীর চোখের মনি সেই সাথে আছে আবারও দশ মাসের সন্তান সম্ভবা স্ত্রী রহিমা । সম্পদের মধ্যে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া বিঘা ক্ষাণেক জায়গার উপর ভিটা বাড়ি, সেই সাথে আছে গোটা সাতেক কাঁঠাল গাছ সহ বেশ কিছু ফলফলাদীর গাছ গাছালী । কর্ম বলতে স্কুলের শিক্ষকতা আর অবসরে দুখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুখ দুখের সাথী হওয়ার পাশাপাশি তাদের হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ বপন করা । রহিমার হাতেও ছিল যেন যাদুর পরশ ! বোনা কাটায় সে ছিল অনন্যা । সৃজনশীল একটা মন নিয়ে নির্মল ভালবাসা দিয়ে গেঁথে যেত সংসারে স্বপ্নময় বিনিসুতোর মালা । তার সংসারে যদিও সুখের নহর বইতো না কিন্তু ছিল অফুরন্ত মমতায় ঘেরা আর ভালবাসায় গড়া একটা শান্তির নীড় ।
কিন্তু এই আনন্দের বসন্তে চৈত্রের দাবদাহ সৃষ্টি করেছে কাল বৈশাখীর ঝড় । ঈশান কোনের ঘন কালো মেঘে বিদ্যুতের চমকে এখন দিশেহারা মানবকুল ! সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই শহুরে বিপদের সেই তান্ডব আছড়ে পড়েছে এই মথুরাপুর গ্রামেও ! মানুষজন জীবন বাঁচাতে সব কিছু ভুলে দিক ভ্রান্তের মত, আউলা বাতাসের মত শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না । কেননা তাদের সামনে ভরসার কোন ক্ষেত্র নেই, একদিকে যেমন মানুষের অভাবের তাড়না অন্য দিকে আতঙ্কের নিদারুন ভয়াবহতা ! তাদের সামনে সান্ত্বনার কোন আভাসও নেই ! তাই মানুষ গন্তব্যহীন উদ্দেশ্যে শুধু ছুটছে আর ছুটছে ! সবাই তবু ছুটতে পারছে, ফয়েজ মিয়া তাও পারছে না । কারণ তার ঘরে দশ মাসের পোয়াতি স্ত্রী, বৃদ্ধা মা আর দু’টি দুধের বাচ্চা নিয়ে সে কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে কিছুই ভেবে পায় না । যে কোন সময় আতঙ্কিত রহিমার বিপদ নিয়ে ভেবে ভেবে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে পড়ে ফয়েজ মিয়া ! কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফয়েজ মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে দরজার চৌকাঠে ।
কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাপ-ধুপ, হুড়মুড় করে ষন্ডা মার্কা পাকিস্তানী বাহিনীর সশস্ত্র ঘাতকরা জমদূতের মত এসে দাঁড়িয়ে গেল ফয়েজ মিয়ার উঠোনে । ভয়ালদর্শী দানবদের দেখে থতমত খেয়ে গেল ফয়েজ মিয়া ! বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে দুই হারামীর বাচ্চা এসে দু’পাশ থেকে ফয়েজ মিয়ার হাত দু’খানা ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে উঠোনে এনে দাঁড় করাল । সঙ্গে সঙ্গে অন্য কয়েকজন ঢুকে পড়ল তার ঘরের ভিতরে । বিপদের ভয়াবহতায় ফয়েজ মিয়ার বৃদ্ধা মা তজবী হাতে আল্লাহর নাম জপতে থাকে আর ভয়ার্ত রহিমা শ্বাশুড়ীর আঁচলের তলে আশ্রয়ের ব্যাকুলতায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে । অবুঝ বাচ্চা দু’টো ঘরের এক কোনে জড়সড় হয়ে খরগোসের বাচ্চার মত গুটিসুটি মেরে বসে থাকে । চোখে মুখে তাদের আতঙ্কের ছাপ ! উঠোনে বুটের লাথি আর বন্দুকের বাটের আঘাতে ফয়েজ মিয়ার আর্তনাদে রহিমার অস্থিরতা বেড়ে যায়, তার মধ্যে ঘরের ভিতরে দূর্বোধ্য ভাষায় হৈ চৈ চেঁচামেচিতে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয় রহিমা ও তার শ্বাশুড়ী । দাঁড়ানো মাত্রই হারামীর বাচ্চারা এক ঝটকায় রহিমার শরীর থেকে টান দিয়ে খুলে ফেলে শাড়ীর আবরণ ! আতঙ্কের আতিশয্যে আলাল দুলাল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাদের মাকে, আড়াল করে তার শ্বাশুড়ীও । সম্ভবতঃ অবস্থা আঁচ করতে পেরে ঘরের কোনায় কোনায় কিছু যেন খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসে দানবরা । তবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় উদোম গতরেই ধরে নিয়ে যায় ফয়েজ মিয়াকে । হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ফয়েজ মিয়া তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর বাচ্চাদের অসহায় ভাবে ফেলে যাবার দুশ্চিন্তায় ! পিছু পিছু ছুটে যায় ক্রন্দনরত মা, স্ত্রী আর আলাল দুলাল । কিন্তু ঘাতকদের তিল পরিমানও দয়ামায়ার উদ্রেক হয় না । পরিস্থিতির ভয়াবহতায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় রহিমা, তার শ্বাশুড়ীর আর্ত চীৎকারে পড়শীদের দুই একজন বয়স্কা মহিলা ছুটে আসে তাদের সাহায্যে । তাদেরই সহায়তায় রহিমাকে ঘরে নিয়ে যায় তার শ্বাশুড়ী । কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কন্যা শিশু চীৎকার দিয়ে যেমন জানান দেয় তার পৃথিবীতে আগমনের, ঠিক তখন তখনই ঠা ঠা করা গুলির শব্দে বিদায় জানায় ফয়েজ মিয়া সাধের বসুন্ধরাকে !
স্বাধীন বাংলাদেশের ধ্বংস্তুপের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে এক দুর্দমনীয়, সংকল্পবদ্ধ নতুন এক রহিমা । যার মনের ভেতর বাসা বেঁধে থাকে তার স্বামীর অপূর্ণ স্বপ্ন । সেই স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্খা রহিমাকে ইস্পাত কঠিন এক সংগ্রামী মানুষে পরিণত করে তোলে । স্বামী হারাবার শোক হয় সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার শক্তি । হাল হাতিয়ার ছাড়াই রহিমা শুধু মাত্র অজেয় মনোবল নিয়ে নেমে পড়ে অসম এক জীবন যুদ্ধে । রহিমার মাথায় একটা চিন্তাই সব সময় ঘুরপাক খায় যে, সে যদি ব্যর্থ হয়ে যায়, ব্যর্থ হয়ে যাবে স্বাধীনতার তরে তার স্বামীর জীবন দান । সেও তার স্বামীর আত্মাকে দেখিয়ে দিতে চায়, তার রেখে যাওয়া সন্তানদের স্বাধীন দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সেও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞও বটে । এই ব্রত নিয়েই শুরু হলো তার জীবনের নতুন অধ্যায় । দেখতে দেখতে রহিমার বাড়িটা একটা খামার বাড়িতে পরিণত হয়ে গেল । গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগীর পাশাপাশি পেঁপে, কাকরোল, ডাব, নারকেল, আম, কাঁঠালের আবাদ করে দিন দিন রহিমার দুঃখ, কষ্ট দূর হতে থাকে, সেই সাথে স্থানীয় প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরী করতে থাকে মোমবাতি । দু’ভাই মিলে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে উৎপাদিত সব পণ্যই স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রী করে করে মায়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে ।
বেশ ভালই চলছে রহিমার পাঁচ মানুষের সংসার তবে ভাল চলছে না তার শ্বাশুড়ীর শরীর স্বাস্থ । অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে । ডাক্তার সাহেবও বলে দিয়েছেন, বয়স হয়েছে, কখন কি হয়ে যায়, ভাল মন্দ যা খেতে চায়, খাওয়াবেন । এ কথা শোনার পর থেকেই আলাল সব সময় তার দাদীর কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করে আর যখন যা খেতে চায় খাওয়ায় । দাদীও তাদের সবার জন্য আল্লাহ্তা’লার কাছে নামাজের পাটিতে বসে প্রাণ ভরে দো’য়া করে । রহিমাও কখনও বিশেষ করে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে শ্বাশুড়ীকে যেন মায়ের মতই ভালবাসে, শ্বাশুড়ীও তাকে ছেলের বৌ মনে না করে মেয়ের মতই মনে করে । কিন্তু বেশী দিন আর এ ভাবে চলল না । ঠিকই এক সময় আলালের দাদীর জন্য পরকালের ডাক এসেই গেল । তার মৃত্যুতে বাড়ীর সবাই কষ্ট পেলেও তাদের মনে সান্ত্বনা একটাই যে, তারা তাকে কখনও অবহেলা করে নাই । সম্মানের সাথে বিদায় দিতে পেরেছে ।
এবারে বুঝি রহিমা একেবারেই একলা হয়ে গেল । ছেলে মেয়েরা সবাই তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত । সংসারের সমস্ত কাজ কাম সেরে যে সময়টুকু পেত, শ্বাশুড়ীর সাথে সুখ দুখের গল্প করে মনটাকে একটু হালকা করার সুযোগ পেত । সে সুযোগটুকুও আল্লাহ্ কেড়ে নিল । এখন তার অন্তর্দেশ জুড়ে শুধু একাকিত্বের হাহাকার আর এই হাহাকারের কারণেই যে সেখানে নিয়ত চলছে রক্তক্ষরণ তাতো রহিমা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পায়নি । তাই বুঝি আজকের পূর্ণিমার ভরা জোছনার প্লাবণে উত্তাল হয়ে উঠলো হৃদয় । রাতের সব কাজ সেরে উঠোনেই মাদুর পেতে বসে পড়ে স্মৃতির জানালা খুলে । খুঁজে ফিরতে থাকে কোলাহলময় জীবনের ইতিকথা । মনে পড়ে ভরা যৌবনের চাঁদনী রাতের কথা, যে রাতে ফয়েজের সাথে তার ডিঙ্গি নায় চড়ে ঘুরে বেড়াতো কাশবনের পাশ দিয়ে চিক চিক করা ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় তার একান্ত সান্নিধ্যে । সুঠাম দেহের সেই ফয়েজের ভালবাসার স্মৃতি আজ বড় বেশী করে মনকে উতলা করে তুলেছে । মনে পড়ে বাদল রাতে হাট থেকে ভিজতে ভিজতে বাড়ী এসে একটু উষ্ণতার বড় বেশী কাঙাল হয়ে যেত ফয়েজ । আদর করে সোহাগ করে নাকে নোলক পড়িয়ে দেবার কথাও আজ বড় বেশী করেই রহিমাকে আবেগাপ্লুত করে তুলছে । কখন যে নিজের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা অশ্রু, বুঝতেই পারেনি । চোখ মুছতে গিয়েই ধরা পড়ে যায় আলালের চোখে ।
মা, তোমার শরীর খারাপ করেনি তো ?
আলালের প্রশ্নে নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে বলে,
আলাল, আয় বাবা আমার পাশে বস । তোর তো পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল ।
এবার একটা চাকরী বাকরী যোগাড় করে নিয়ে বিয়ে সাদী কর, এখন আর তোকে বাড়ীর চিন্তা করতে হবে না । দুলাল আছে, হেনা আছে, ওদের কে নিয়ে আমি এদিক টা সামাল দিতে পারব ।
এবার আলাল তার মায়ের কথার জবাবে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না । বলতে লাগল,
সারা জীবন তো তুমিই যুদ্ধ করলে মা । এবার আমাকে করতে দাও । দুলাল, হেনার পড়াশোনা শেষ হয়নি, পড়াশোনা শেষ করে দুলাল একটা চাকরী ধরলে, হেনার বিয়ে সাদী দিয়ে তারপর আমার বিয়ের চিন্তা কর । তার আগে আর একটি বারও এমন কথা বলো না ।
হাসতে হাসতে রহিমা বলতে থাকে, ততদিনে তোর কি আর বিয়ের বয়স থাকবে রে পাগল ছেলে ।
মা, আমি তো সেই বাবারই সন্তান, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে । আমি তো সেই মায়েরই সন্তান, যে তার সন্তানদের স্বাধীন দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে তার জীবনের সাধ আহলাদ সবই বিসর্জন দিয়েছে । তবে আমি কেন আমার ছোট ভাই বোনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ন্যুনতম এই ত্যাগটুকু স্বীকার করতে পারব না ! বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে আলাল ।
ততক্ষণে পূবের চাঁদ অনেকটাই পশ্চিমে হেলে গেছে । উঠতে গিয়েও উঠা হলো না তাদের । কারণ ততক্ষণে দুলাল আর হেনা এসে যোগ দিয়েছে তাদের আলোচনায় । সকলেরই চোখের মনি, হেনা তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে প্রশ্ন করল, মা, আজকের রাতটা বড় সুন্দর ! বাবা থাকলে আরও ভাল লাগত ।