ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন আজিজুর রহমান আজিজ । পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ঢাকার গাজীপুরেই তাঁর জীবন কেটে গেছে । নেতাদের সাথে থেকে থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েক দফায় জেল-হাজত খেটে খেটে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনায় তিনি আর খুব একটা বেশী দুর এগোতে পারেন নি । তারপরও তিনি দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আমলে ডাক বিভাগে একটি চাকরী পেয়েছিলেন ।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা পেরিয়ে যাবার পর একটু বেশী বয়সেই তিনি বিয়ে করেন । তিন মেয়ে আর এক ছেলের জনক আজিজ মিয়া ছিলেন পৈত্রিক সুত্রেই একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ । সংসার জীবনে পুরোপুরি সফল না হলেও তিনি ছিলেন একজন প্রতিবাদী মানুষ । দ্রোহের আগুন তার শরীরের শিরায় শিরায় নেচে বেড়াতো । কাঙালের স্বভাব নিয়ে তিনি পৃথিবীতে আসেন নাই । কর্ম জীবনের পরিচয় তাঁর ছোট হলেও তার মনটা ছিল অনেক বড়, তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ । বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের দোরগোড়ায় তখন আজিজ মিয়ার চেতনার শাণিত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই তার একমাত্র ছেলে হাফিজুর রহমান হাফিজ দেশ-মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ।
হাফিজুর রহমান হাফিজও আজ বয়সের ভারে প্রায় ন্যুজ দেহ নিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তির উপর একখানা দোকান করে সংসারটাকে টেনে-হিঁচড়ে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন । একাত্তরে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই তিনি স্থানীয় একটি হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন । বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন করলেও আর্থীক দৈন্যতার কারণে তিনি আর সামনে এগুতে পারেন নি । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার বাবা আবারও চাকরীতে যোগ দেন । হাফিজ ও তার পূর্বের শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান । কিন্তু মায়ের অসুস্থতা জনিত কারণে খরচের মাত্রা দিন দিনই বেড়ে চলায় সংসারের আর্থীক সংকট মোটেই কাটছিল না । তারপরও ম্বাধীনতার কয়েক বছর পর সংসারের অচলাবস্থা দূর করার জন্য তিনি অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ে করতে বাধ্য হন ।
বিপ্লবের চেতনায় লালিত হলেও তিনি ছিলেন তার মায়ের মত খুব চাপা স্বভাবের মানুষ । তা ছাড়া বাবার জীবনের পরিণতির কথা ভেবে তিনি আর রাজনীতির মাঠে পা বাড়ান নি । সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি যখন নতুন জীবন শুরু করেন, তখনই তার বাবা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন । কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য তার বাবাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল বটে, কিন্তু আর্থীক দুরবস্থার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠে নি ।
শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায় । স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরুর প্রথম দশকেই ভুল চিকিৎসায় বাবাকে হারানোর ধাক্কাটা হাফিজ মোটেই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেন নি । কারণ তত দিনে তার অনেক সহযোদ্ধা সহ অনেকেরই বিত্তের আধিক্য রীতিমত চোখে পড়ার মত অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে । অথচ তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্বেও সঠিক চিকিৎসার অভাবে অসময়েই বাবাকে হারালেন ! শুধু তাই নয়, বাবার মৃত্যুর পর তার পেনশনের টাকাটা পাবার জন্য তাকে যে পেরেশানি সহ্য করতে হয়েছে সেটা বলার মত নয় ! শুধু কী পেরেশানি ! অবশেষে ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হয়েই টাকাটা তুলতে হয়েছে !
ততদিনে তার বড় ছেলে শহিদুর রহমান শহীদ আর ছোট ছেলে সাইদুর রহমান সাঈদ এসে তাদের সংসারটাকে আনন্দময় করে তুলেছে । পারিবারিক জীবনে তার অভাব-অনটন থাকলেও দাম্পত্ত জীবনে তারা ছিলেন খুবই সুখী । কারণ তার স্ত্রী ছিলেন যেমন রক্ষণশীল তেমনি তার মতই অন্তর্মুখী । স্বামী, শ্বাশুরী আর সন্তানদের বাইরে তার আর কোন জগৎ ছিল না । স্বামী সোহাগী সালেহা ছিলেন স্বল্পে তুষ্ট একজন নির্ভেজাল প্রেমিকা অর্দ্ধাঙ্গিনী । তার ভালবাসায় ছিল না এক রত্তি খাদ । তার সংসারই ছিল তার তীর্থস্থান ! তিনি যেমন ছিলেন স্বামীর সুখ-দুঃখের সাথী, তেমনি ছিলেন সন্তানদেরও খেলার সাথী । সারাদিন তাদের নিয়েই সময় কাটাতেন ।
চারিত্রিক বৈশিষ্টে সমুজ্জল হাফিজ মাষ্টার ততদিনে বাবার পেনশনের টাকায় পৈত্রিক ভিটায় ছোট-খাট একটা দোতলা বাড়ী করে তাতে নিজে থাকেন আর নিচতলায় ভাড়া দিয়ে বেশ সচ্ছলতার দেখা পান । পাশাপাশি চালাতে থাকেন একটা বইয়ের দোকানও । কারণ তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান মানুষ, সব সময়ই তিনি ছিলেন শিক্ষকতার সাথে টিউশনি কিংবা কোচিং সেন্টার ব্যবসার ঘোর বিরোধী । কেননা তার বিশ্বাস ছিল, কোন শিক্ষক যদি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তার সামর্থ্যের সব টুকু ঢেলে দেন তাহলে তার ছাত্র-ছাত্রীদের কখনও প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারে বাড়তি পড়াশোনা করার প্রয়োজনই পড়ে না ।
ইতোমধ্যে মাতৃবিয়োগের পাশাপাশি সংসারে যুক্ত হয়েছে নতুন অতিথী, তার কন্য সন্তান শাহনাজ । একদিকে শোকের অশ্রু অন্যদিকে খুশির বন্যা ! আল্লাহ্ যা চান বা করতে পারেন, যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না ! আর এখানেই আল্লাহতা’লার মহত্ম ও বিশালত্ব ! কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দিন দিন এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যা ইতোপূর্বে এমন করে আর কখনও হতে দেখা যায় নি । শুরু হয়েছে অর্থ উপার্জনের নতুন নতুন ফন্দি-ফিকির ! আস্তে আস্তে জম-জমাট হতে শুরু করেছে সদ্য গজিয়ে ওঠা গার্মেন্টস ব্যবসা । তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করেছে গার্মেন্টস নারী শমিকদের উপর যৌন হয়রানী, চাঁদাবাজী আর রাজনীতির ভুল পথে এগিয়ে চলা !
মক্তিযুদ্ধ অধ্যায় টা যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে বাণিজ্যিক সম্ভার ! কেমন যেন এলো-মেলো বাতাসের ঝাপটা এসে লাগতে শুরু করেছে আশাহত মানুষের মাঝে ! এমন কোন সপ্তাহ যায় না যে তাকে কোন সালিস-দরবার করতে হয় না ! কিন্তু ক্রমেই পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, সালিস-দরবার করাও যেন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ! সব সময়, সব খানেই তিনি দলীয় রাজনীতির একটা অপয়া প্রভাবের ষ্পর্শ অনূভব করেন ! তাই আস্তে আস্তে তিনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন । এখন মাষ্টারী আর দোকানের বাইরের কোন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না । তারপরও মাঝে-মধ্যেই নতুন সংস্কৃতির নানাবিধ উটকো ঝামেলা তাকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয় !
এমন একটা সচেতন পরিবারের আদর্শ আর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে এসেছে তিনটি ভাই-বোন, শহীদ, সাঈদ আর শাহনাজ । দাদা-বাবার আদর্শ ওদের ভিতকে এমন ভাবে মজবুত করেছে যে, কোন বড় ধরনের ঝড়-ঝাপটাও ওদের কে টলাতে পারে না । কিন্তু রক্ত বলে কথা ! সাঈদ আর শাহনাজ বাবা-মায়ের মত অন্তর্মুখী চাপা স্বভাবের এবং আদর্শ মন্ডিত ও । কিন্তু শহীদের মাঝে দাদার উষ্ণ রক্ত ধারা যেন মাথা চারা দিয়ে উঠেছে ! দ্রোহের আগুনে ঝলসে উঠেছে তার আপাদমস্তক ! সে সময়কে মূল্য দিতে চায়, দেশকে ভালবেসে অনিয়মের খাদ থেকে টেনে তুলতে চায়, অস্থিরতা মুক্ত করতে চায় জাতিকে ! সে অপরাজনীতির বিষাক্ত থাবা থেকে সুস্থ রাজনীতিকে অবমুক্ত করে সবার মাঝে সাবলীল জীবনধারার প্রবাহ কে সঞ্চারিত করতে বদ্ধ পরিকর । এ জন্য সে যে কোন ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত ! আর এ কারণেই তাকে বার বার জেল-হাজতের চৌকাঠ মাড়াতে হয় ! ফলে ছোট ভাই সাঈদ ইতোমধ্যে সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে চাকরীর চেষ্টা করতে থাকলেও শহীদ এখনও পর্যন্ত ছাত্রত্বের বন্ধাত্বই কাটিয়ে উঠতে পারে নাই ।
হাফিজ মাষ্টার এখন অবসরে ! ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন ই-বুকের ছড়াছড়ি ! তা ছাড়া পাড়া-মহল্লা, গলি-ঘুপচির মধ্যে বেঙের ছাতার মত যে ভাবে কোচিং সেন্টারের নামে শিক্ষা বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তাতে বই পড়ার মানুষ কই ! তাই বাধ্য হয়েই হাফিজ মাষ্টার এখন সংসারের চাহিদা মেটাতে বইয়ের দোকান বন্ধ করে দিয়ে একটা ঔষধের দোকান খুলে বসেছেন । বেশ ভালই চলছে ! চলবেই তো ! যে ভাবে ভেজালের সয়লাব ! তার উপর মানুষের মাঝে যে ভাবে অস্থিরতা জেঁকে বসেছে, আয়ুস্কাল না ফুরানো পর্যন্ত সুস্থ থাকার জন্য ঔষধের বিকল্প যতদিন বিজ্ঞানীদের মগজ দিয়ে না বেরুচ্ছে, ততদিন ঔষধের ব্যবসা রমরমা থাকবে তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় ।
বয়সের ভারে হাফিজ মাষ্টার প্রায় ন্যুজ দেহ নিয়েই ব্যবসাটা চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন, যদিও অভিজ্ঞ একজন কর্মচারী আছে, তারপরও সাঈদ চাকরীর প্রস্তুতির পাশাপাশি বাবাকে সময়-সুযোগ মত সহযোগিতা করছে । আর শহীদ তো আছে তার ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ! বাবার বারণ শোনার মত মানষিকতা এখন আর তার মাঝে অবশিষ্ট নেই । বরং সংকটের মুখে শহীদ বাবার কাছেই বার বার ছুটে আসে অধিকতর সুপরামর্শের আশায় ! তার একই কথা, একই যুক্তি, “আমরা সবাই যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, তাহলে একদিন দেখবে, তোমাদের মতই তোমাদের উত্তরসূরীদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ! তোমাদের মত করে জীবন বাজি রেখে আবার লড়াই করতে হবে ! কিন্তু একাত্তরে যারা স্বাধীনতার প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, তাদের সঙ্গে জাতি যে আচরণ করেছে, তাতে জাতির দুর্দিনে আর কেউ এগিয়ে কি না সে ব্যাপারে আমার মনে সংশয় আছে ।”
আবার সেই ভুল চিকিৎসা ! কিন্তু হাফিজ মাষ্টারের ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা যে ভাবে তার বাবাকে হারিয়েছেন, সে ভাবে তারা তাদের মা কে হারাতে রাজি নয় । শহীদের এক কথা, “তোমার স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ আর মানুষ নেই বাবা, প্রায় সবাই অমানূষ হয়ে যাচ্ছে ! না হলে সবার চোখের সামনে কী করে এত ডায়গোনষ্টিক সেন্টার আর ক্লিনিক গজিয়ে উঠল, যে গুলো হয়েছে চিকিৎসা বা সেবা কেন্দ্রের পরিবর্তে ডাক্তারদের কমিশন উপার্জনের উপলক্ষ মাত্র ! তুমি যে ভাবে তোমার বাবাকে হারিয়েছ, আমরা সেই একই ভাবে আমাদের জননীকে হারাতে চাই না ! শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু বিক্রী করে হলেও আমরা আমাদের মায়ের জীবন প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাব ! বিনা যুদ্ধে আমরা পরাজিত হতে রাজি নই !”
একদিকে মাষ্টার পত্নীর শরীরের ক্রমোবনতি অন্য দিকে অসৎ মানষিকতা সম্পন্ন তথা কথিত ‘মানুষের’ নোংরা অর্থলিপ্সা ! তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ঘুষ দিয়ে নিজের, মায়ের আর শাহনাজের পাসপোর্ট তৈরী করে ভিসা লাগিয়ে মা কে দেশের বাইরে নিয়ে গেল শহীদ এবং আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সব সহকারে মাত্র কয়েক হাজার টাকা খরচের মাধ্যমে তাদের মায়ের রোগ নিরাময় সম্ভব হলো ! এখানেও শহীদের আত্মা অতৃপ্ত ! তার পিতাকে লক্ষ্য করেই তার খেদোক্তি, “কেন আমরা আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চিকিৎসা বাবদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেব ! দেশের স্বাধীনতার বয়স চার দশক পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্য আর অস্থিরতা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না !” জবাবে তার বাবারও খেদোক্তি, “কিন্তু দেশ তো আর তোমাদের মত গুটিকয়েক শহীদের কথায় চলে না, চলে আঁতেলদের স্বেচ্ছাচারিতায় !”
স্ত্রী’র চিকিৎসায় বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল ! তারপরও হাফিজ মাষ্টার খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে এই বলে যে, তার স্ত্রী এখন তার কৃপায় সুস্থ । ইতোমধ্যে মেয়ের পড়াও শেষ, অথচ সবাই বেকার ! বড় ছেলে আছে তার আদর্শের লড়াই নিয়ে, ছোট ছেলেটা হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজছে, কিন্তু ঘুষ বাণিজ্যের দাপটে চাকরী এখন হীরার হরিণ ! বিপদে-আপদে, চাঁদাবাজির দাপটে কখনও কখনও সন্নিহিত এলাকার গার্মেন্টস মালিকদের দু’চারজন যে হাফিজ মাষ্টারের কাছে আসে না তা নয় ! ইচ্ছা করলে সেখানে হয়তো সাঈদের একটা চাকরীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু সেখানেও গার্মেন্টস মালিকদের হতাশার গল্প শুনে নিরুৎসাহিত হন হাফিজ মাষ্টার ! তাদের ভয়, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অচিরেই যদি বন্ধ না হয়, তবে কারখানা বন্ধ হতে খুব একটা বেশী সময় লাগবে না । বেসরকারী অন্যান্য চাকরী-বাকরী ও হয়ে গেছে একেবারেই মুখ চেনা-চিনির ব্যাপার ! ডিউটিও করতে হয় নিদেন পক্ষ্যে দশ-বার ঘন্টা ! তারপর আছে রাস্তার যানজটে আরও দু’এক ঘন্টার হয়রানি ! সর্ব ক্ষেত্রেই একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা ! যাকে বলে নৈরাজ্য বা অস্থিরতার চুড়ান্ত ! জীবন এখন কারও জন্যেই সুখকর নয় ! কোন রকমে আয়ুস্কালটা পার করে দিতে পারলেই যেন বাঁচা !
মেয়ের বিয়ের জন্যেই কী মাষ্টার কম পেরেশানিতে আছেন ! আজ-কাল যে হারে ছেলে-মেয়েদের সংসার ভাঙছে, তাতে আত্মীয়-স্বজন এখন আর কারও বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না ! বাধ্য হয়েই অভিভাবকদের ঘটকদের উপরই নির্ভরশীল হতে হয় ! সেখানেও অপেক্ষা করছে সাংঘাতিক বিড়ম্বনা ! আজকাল তো দেশে ঘটকালী রীতিমত একটা ঘৃণিত পেশায় পরিণত হয়েছে ! নানান বেশ-ভূষায় ভাল মানুষীর আড়ালে চলছে একটা প্রতারণার ব্যবসা ! বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকগণ হয়ে পড়েছে তাদের কাছে জিম্মী ! ঘটকালীর নামে তারা রীতিমত পাত্র-পাত্রী বিকিকিনির হাট বসিয়ে ফেলেছে ! ভালকে মন্দ, আর মন্দকে ভাল বানিয়ে দু’হাতে রোজগারের ধাঁন্ধায় নেমে পড়েছে ! অস্থিরতা নেই কোথায় ! হবেই বা না কেন ! দেখার তো কেউ নেই ! যেন একটা হরিলুটের গোয়াল !
ওদিকে প্রতিপক্ষ সংগঠণের ছাত্র নাম ধারীদের হাতে মার খেয়ে বড় ছেলেটা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে ! হাফিজ মাষ্টার এবং তাদের মত মানুষ আজ দিশেহারা ! তারা যেন আজ সমস্যার মহা সাগরে হাবু-ডুবু খাচ্ছে ! তাদের চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাসে ও কেউ এমন একটা অস্থিরতার মধ্যে জীবন-যাপন করেছে বলে তাদের জানা নেই ! তাই হাফিজ মাষ্টার এবং তাদের মত অসহায় মানুষ আজ শহীদদের দিকে প্রত্যাশার দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে এই অসহিষ্ণু পরিবেশ আর অস্থিরতার ভেতর থেকে নির্মল একটা আদর্শ সমাজ ব্যবস্থাকে বের করে এনে সবার মাঝে মুক্তির অনাবিল আনন্দ কে ছড়িয়ে দিবে, এই আশায় ! সবার মাঝেই জিজ্ঞাসা, ওরা পারবে তো ? কিন্তু কেউ জানে না সে দিন কতদূর !