নান্দনিক জীবনের ভাগীদার হওয়া বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার ! তারপরও আছে উত্থান-পতনের নানান খেলা । আকাশে আছে যেমন বাতাসের ঢেউ, তেমনি আছে সাগরে তরঙ্গ মালা ! ছন্দে ছন্দে হাসে জোয়ারের জল, ভাটির টানে কাঁদায় বালুচরের মরীচিকা ! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ । তারপরও নদীর পাড় ভাঙ্গা, সাগরের জলোচ্ছাস, ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝরের তান্ডবের সাথে জড়াজড়ি করেই সময়ের সিড়ি বেয়ে এগিয়েছে মানব জাতির ইতিহাস ! যার প্রভাবে কারও হয়েছে সর্বনাশ, কারও হয়েছে পৌষ মাস !
এ দেশের মানুষ ভৌগলিক অবস্থান আর মানসিকতার গঠণ প্রক্রিয়ার তারতম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উত্তরাধিকারী সুত্রে নিঃস্ব প্রায় ! যদিও দু’চারজন ভাগ্যবান উত্তরণের সোপান বেয়ে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের ভেলায় বিচরণশীল, তবে তারা মোট জনসংখ্যার শতকরা হিসে্বে একেবারেই নগন্য ! সেই হতভাগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীরই একজন অসহায় অংশীদার হ’লো ছমিরন নেছা । উনিশ’শ সত্তরের বারই নভেম্বরের জলোচ্ছাসময় কাল রাত্রির আগে তার ছিল সাজানো গোছানো আনন্দময় সংসার । স্বামী ছিল, সন্তান ছিল । ছিল নিজস্ব ঘর-বাড়ি আর গরু-ছাগলের বাথান । সেও ছিল পৌরুষ দীপ্ত সবল স্বামীর আবেষ্টনে তৃপ্ত নারী, তারও স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া !
সেও তার রসিক স্বামীর সাথে চাঁদনী রাতে শুষে নিত আনন্দ সুধা ! ভ্রমর তুল্য স্বামীকে বিলিয়ে দিত মধুময় ফুলের শোভা ! সুখের শয্যায় ছিল অফুরন্ত ভালবাসা ! সন্তান-সন্ততি ভরা বাড়ির উঠন ছিল যেন প্রেমের কানন ! ওরা হাসতো-খেলতো, ছড়াতো আগামীর প্রভা ! সাগরের গর্জন ছিল ওদের কাছে সুরের ঝংকার, ঝিনুকের মালা গেঁথে ওরা সাজাতো রঙিন বাসর । সাগরের ঢেউয়ের সাথে ছিল ওদের হৃদয়ের বন্ধন ! ওরা সাম্পানে ভাসতো ছন্দের তালে তালে ঢেউয়ের ডগায় । গাংচিল ওদের পড়শি ছিল, ওদের মত করেই বাড়ি ফিরতো গোধূলি বেলায় ।
মাত্র একটি রাত, মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল সব কিছু ! জলোচ্ছাসের ধ্বংসলীলা কেড়ে নিল ছমিরনের জীবনের ছন্দ ! ছন্দ-পতন ঘটলো ছমিরনের স্বর্গসুখে ! নিমেষের হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তার স্বামী-সন্তান, ঘর-গৃহস্থালী, সহায়-সম্পত্তি, স্বপ্ন-ভালবাসা সব-সব ! আজ সে নিঃস্ব, অসহায়, সর্বহারা !
দীর্ঘ দিনের অভাব-অনটনে, অবহেলা-অনাদরে সে আজ সমাজের জঞ্জাল ! যদিও সে এখন আর আগের মত চোখে দেখতে পায় না, তবু অন্তর্চক্ষু দিয়ে সে দেখতে পায় অমলিন স্মৃতির পাতায় সেঁটে থাকা সোনালী অতীতের মনোমুগ্ধ চিত্র ! অনুভব করে স্বামীর সোহাগ আর সন্তানের মায়া ভরা ভালবাসা ! সুখের বিয়োগ ব্যথা আর স্বপ্নের অপমৃত্যু মাঝে মাঝেই শ্রাবণের ঢল নামায় তার আলো হীন নেত্রে । একাকিনী জীবনের এই বিষাদময় উপাখ্যান, যেন ধু-ধু বালুচর ! এও কী শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবন ?
সময়ের পরিক্রমায় আজ তার ঠিকানা হয়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকার একটা ব্যস্ত যাত্রী ছাউনীতে । দিনমান ছাউনীর বাইরে বসে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের আশায় সেই দু’টি হাত, যে দু’টি হাত জুড়ে লেগেছিল সুখের পরশ ! ‘দাদী’ ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ফিরে আসে ভাবনার অলিন্দ থেকে বাস্তবে । মন উতল করা দাদী ডাকে ছমিরন আবার ভাবে, আজ তার সন্তানদের সন্তানরাও হয়তো এমন করেই দাদী বা নানী বলে ডেকে ডেকে তার হৃদয় টা শীতল করে দিত ! ভাবতেই হু-হু করে ওঠে ছমিরনের অন্তরের অন্তঃস্থল ! নিজের অজান্তেই দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বিষাদের অশ্রুধারা । “কী দাদী, আবার কাঁনতাছো, তোমারে না কইছি, আর কাঁনবা না । তুমি তো তোমার স্বামী দেখছো, পোলাপাইন দেখছো, সুখ দেখছো-শান্তি দেখছো ! কিন্তু আমরা কী দেখছি ? আমরা তো কিছুই দেহি নাই ! আমরা তো কাঁন্দি না ! আর কাঁনবা না কইলাম, তোমার কাঁন্দোন দ্যাখলে আমাগোও কাঁন্দোন আহে !”
রাতের গভীরতা বাড়তেই যাত্রী ছাউনী ফাঁকা হয়ে যায় । নামহীন, পরিচয়হীন আট-দশজন পথকলিই এখন ছমিরনের পরিবারের সদস্য, অথবা গরু-ছাগলের বাথান ! ওরা ছমিরনকে ভালবেসে ‘দাদী’ বলে ডাকে । ওরা জানেই না কেমন করে মা, দাদী, নানী কে আদর করে চুমু দিতে হয়, কেমন করে ভালবেসে তৃপ্তি পেতে হয়, তবুও ওরা ওদের মত করে ছমিরনকে ভালবেসে গোসল করিয়ে দেয়, খাবার খাইয়ে দেয়, শয্যা পেতে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ! আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ব্যতিক্রম হয়েছে চিত্তে ! ওরা আজ বিনোদিত ! রাস্তার ঐ পাড়ের বিশাল অট্রালিকার অঙ্গখানি মরিচা বাতি’র আবেষ্টনে ঝলসে উঠেছে, সেই সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশও । “দাদী দেহ, ঐ বাড়িত কাইল বিয় অইবো, আমাগো হেরা কাইল ভাল-মন্দ কিছু খাওন দিতে পারে, অনেক দিন হয়, এমন খাওন খাই নাই ! কী দাদী, কেমুন দেহা যায় লাল-নীল বাত্তির আলো ? সুন্দর না ?” ছমিরনের মনটা ভারী হয়ে ওঠে, উদাস হয়ে যায় তার দৃষ্টি ! “আইচ্চা, থাউক, তোমার আর কিছু কওন লাগবো না, তোমার বিছনা কইরা দিছে, চল শুইবা চল ।”
মাঘের কনকনে শীত । চেয়ে-চিন্তে পাওয়া ছিন্ন কাঁথা আর কম্বল পেঁচিয়ে ওরা পরস্পরে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে । ওদেরই মাঝে শুয়ে আছে ছমিরন নেছা, যেন সত্যি-সত্যি সে এই পথকলিদের আপন দাদী । তবুও ঘুম নেই দুই চোখে, চোখের তারায় ভাসে ফেলে আসা জীবনের জলজলে ছবি । উদাসী মন হারিয়ে যায় কল্পনায় ! ভাবে, যদি সব কিছু ঠিক-ঠাক থাকতো, তাহলে তার নাতি-নাতনীরাও হয়তো এদের মত করেই তাকে ঘিরে শয্যা বিছাতো, তবে যাত্রী ছাউনীর এই ভাঙ্গা-চোরা রাস্তার বুক জুড়ে নয়, হয়তো বা সামনের ঐ বাড়ির মত কোন ঝলমলে মহলে । স্বপ্নের জাল বুনতে কার না ভাল লাগে ! তাই ছমিরন নেছাও হারিয়ে যায় কল্পনার স্বর্গ রাজ্যে । কিন্তু এ কী ! কারা যেন ধমকাচ্ছে, ছেদ পড়লো তার অধরা ভাল লাগায় ।
“ওই, ক্যাডারে তোরা ? উঠ, উঠ, এইডা কী গুমাইবার জাগা ! উঠ ব্যাডা, নইলে দিমু কিন্তু দুই চারডা লাঠির গুতা ।” কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায় সবারই, ভয়ের চোটে ধর-ফরিয়ে উঠে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আগন্তুকদের ইয়া বড় বড় লাঠির দিকে । ভয় পেয়ে যায় অশীতিপর বৃদ্ধা ছমিরনও । আবার ধমক ! “ওই ব্যাডা, দেহস কী ? উঠস না ? ভাঙ্গা গলায় ভয় জড়ানো কন্ঠে ছমিরন বলে, “কী অইছে বাবা ? তোমরা কারা ?” ক্রুদ্ধস্বরে জবাব আসে, “ ওই বুড়ি, দেহস না আমরা কারা ! আমাগো পোষাক চিনস না ?” ছমিরনের মিনতি ভরা আবদার ! “ তা বাবা আমাগো কী কুনো দোষ অইছে ? আমরাতো বাবা রাইতে এহেনেই গুমাই, আমাগো তো বাবা কুনো জাগা-বাসা নাই, কই যামু এত রাইতে ?” এবারে অধৈর্য হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে আসমান-জমিন, “দোষ-ঘাইট বুজি না, কই যাবা জানি না । কাইল ন্যাতার মাইয়ার বিয়া, এম পি, মিনিষ্টার আইবো, তোমাগো এহেনে থাহন চলবো না । যেহানে খুশি সেহানে যাও, এই ছ্যামরারা উঠস না ! দিমু নাকি দু’চারডা লাগায়া ?” ভয়ার্ত পথকলিরা তারপরও মিনতি জানায়, “ স্যার গো, কই যামু এই ঠান্ডায় ? আমাগো বুড়া দাদী তো খুলা আকাশের তলে শুইলে মইরা যাইবো, তারে না অয় একটু থাকবার দ্যান । আমরা যামুগা, আমরা থাকুম না, খালি একটু দাদীরে থাকবার দ্যান !”
না ! কোন কথাই শুনলো না ! ওদের কুকুরের মত দূর দূর করে তাড়িয়ে দির ! এখন ওরা কী করবে, কোথায় যাবে ! কোথাও তো একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই ! পুরো রাতই তো পড়ে আছে ! কিন্তু কোথায় যাব বললে তো আর চলবে না, কোথাও না কোথাও একটু ঘুমাবার ব্যবস্থা তো করতে হবে । শেষ পর্যন্ত বেশ খানিকটা দূরের একটা ডাষ্টবিনের উল্টা পাশের উন্মুক্ত ফুটপাতেই ঘুমাবার ব্যবস্থা করলো ওরা । নিজেদের কষ্ট হলেও ছমিরনের শরীরে বেশী করে শীত বস্ত্র জড়িয়ে দিয়ে শুইয়ে দিল । গভীর রাতের হেস্তা-নেস্তায় কাহিল ছমিরন দ্রুতই ঘুমিয়ে গেল । কিন্তু এই ঘুমই যে ছমিরন নেছার শেষ ঘুম হবে, তা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি । মাঘ মাসের শেষ রাতের প্রচন্ড ঠান্ডা বাধাহীন ভাবে ছমিরনের দূর্বল দেহটাকে একেবারে জমিয়ে ফেলেছে ! সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সবাই জেগে উঠলেও ছমিরনের শক্ত দেহটা আর জাগলো না !
হায়রে পৃথিবী ! হায়রে পৃথিবীর মানুষ ! পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন পথকলিদের হৃদয়ে যে টুকু মায়া-মমতা, ভালবাসা এখনও অবশিষ্ট আছে, সভ্য(!) সমাজের সুসভ্য(!)দের মাঝে সেই আবশেষটুকুও এখন আর অবশেষ নেই ! এখন সমাজটা এমনই যে, সমাজের কারও দিকে কারও নজর দেবার ফুরসৎ ই নেই ! সব কিছুই চলছে একেবারেই স্বাভাবিক গতিতে ! শুধু পরিত্যক্ত পথকলিদের আজ নিরন্ন অবসর, ব্যথিত প্রহর ! ওদেরই ধরপাকড়ে, চেষ্টা তদ্বিরে দিনের পড়ন্ত বেলায় “আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে”র পক্ষ থেকে কয়েকজন সেবক এসে নিয়ে গেল ছমিরন নেছার বে-ওয়ারিশ লাশবাহী গাড়ী আর অন্য পথে নেতার বাড়িতে আসতে থাকলো এম,পি, মিনিষ্টারের ঝকমকা দামী দামী গাড়ী !