(এক)
দুপুরের রাগী সূর্যটা সেই কখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। পূর্ব পাশের ছোট নদীটার তীর ঘেসেই যে বাড়িটা তার ছাদে এসে মিছিল জমিয়েছে উঁচু উঁচু কড়ই গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেড়িয়ে আসা হলুদ বর্ণের তির্যক আলোর বর্ণালী। বাড়িটার ছায়া দ্বিগুণের বেশী হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে নদীটার মাঝামাঝি। ছাদের উপর ইজিচেয়ারে বসে সেই ছায়ার ক্রম দীর্ঘায়িত হয়ে যাওয়ার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকালেন আসাদ সাহেব। আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে বুঝতে পারলেন। একটু পরেই মুয়াজ্জিন সাহেব তা জানিয়ে দেবেন সগর্বে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। আলনা থেকে পাঞ্জাবীটা পড়তে পড়তে একটু উঁচু গলায় বললেন ‘শুনছো, আমি মসজিদে যাচ্ছি, রাতের জন্য কিছু আনতে হবে কি? ফেরার পথে নিয়ে আসব’। ‘কিছু আনতে হবে না, আমিনার জন্য একটা কলম নিয়ে এসো মনে করে’ রান্না ঘর হতে জবাব এল ভেসে। যিনি জবাব দিলেন তিনি আসাদ সাহেবের স্ত্রী আসমা। আসমা ইসলাম। আসাদুল ইসলাম নাম থেকে ইসলাম শব্দটি নিয়ে নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছেন তিনি নিজেই। আসাদ সাহেব আপত্তি করে বলেছিলেন ‘আসমা আখতার কি ভালো নয়?’ জবাবে আসমা বেগম বলেছিলেন ‘ভালো, তবে যে নামে তুমি নেই তার অপেক্ষা খারাপ’। মৃদু হেসেছিলেন আসাদ সাহেব সেদিন। বুঝতে পেরেছিলেন সেদিনের সেই অষ্টাদশী সেই মেয়েটার সাথে তার জীবনটা ভালোই কাটবে। হয়েছেও তাই। আজও সুখী আছেন আসাদ সাহেব। ষোল বছরের দাম্পত্য জীবনে খুবই সুখী তিনি। আমিনা তাদের একমাত্র মেয়ে যার বয়স এখন বারো বছর। মায়ের মতই দেখতে হয়েছে। মায়ের মতই বিনয়ী এবং নম্র। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে সে। আসাদ সাহেব বেড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমিনা উঠে এলো পড়ার টেবিল হতে। ‘মা, আসরের আযান হয়েছে?’ আসমা বেগমকে আমিনার প্রশ্ন।
-না, এখনও হয়নি, কিছুক্ষণ পরেই হবে।
-আব্বু এতো আগেই মসজিদে গেল যে।
-যেতে যেতে আযান হয়ে যাবে তাই গেল। আর মসজিদে একটু আগেই যাওয়া ভালো।
-তুমি নামাজ পড়বে না? এখনও রান্না নিয়েই আছো।
-হুম, পড়ব। আমার তো আর মসজিদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তুই টেবিল হতে উঠে এলি কেন?
-এই সময়ে পড়াশোনা করা ঠিক নয়, তাই উঠে এলাম। তাছাড়া নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।
-ও, তবে যা ওযু কর গিয়ে। আমি আসছি। নয়ত দুজনে একসাথে ভীর লেগে যাবে।
আমিনা চলে গেল। গোসলখানার ভিতরে পানির টেপ ছেড়ে ওযু করতে থাকল। পানির কলকল শব্দ ভেসে আসছে রান্না ঘরে। আসমা বেগম বসে আছেন সে শব্দ বন্ধ হবার অপেক্ষায়। বন্ধ হওয়ার মানে আমিনার ওযু শেষ হয়েছে। অজান্তে একটা স্মিথ হাসি বেড়িয়ে আসে আসমা বেগমের ঠোঁটের কোনায়। মেয়েটা ঠিক তার মতই হচ্ছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন মেয়ের জন্য। আসমা বেগমের দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন। পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হল। আসমা বেগম উঠে গেলেন ওযু করতে। ওযু করা শেষ করে ঘরে এসে দেখেন আমিনা নামাযে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তার চেহারাটা শুধু অনাবৃত। একটু দূর হতে তাকালেন নিজ মেয়ের চেহারার দিকে। চোখ দুটো আনত সিজদার দিকে, ঠোঁট দুটো মৃদু নড়ছে। দেহটা অনড় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব লাগছে এ দৃশ্য তার কাছে। গত তিন বছর ধরে দেখে আসছেন এ দৃশ্য থেকে আমিনা প্রথম নামাজ পড়া শুরু করে। প্রতিবারই তার কাছে নতুন ভাবে নতুন সৌন্দর্য লেগেছে। সত্যিই তাঁদের মেয়েটা বড় সংযমী, আপনার দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রত্যয়ী। আমিনা আলতো হেলে রুকুতে গেলে ঘোর কাটে আসমা বেগমের। আজও আমিনা রুকুতে যাওয়ার পর বাস্তবে ফিরলেন আসমা বেগম। মেয়ের পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘আল্লাহু আকবার- আল্লাহ সবচেয়ে বড়’।
নামাজ শেষ করে মসজিদ হতে ফিরছেন আসাদ সাহেব। রাস্তার মোড়ে দোকানটা নজরে পড়তেই কলমের কথা মনে পড়ল তার। দশ টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য একটি কলম কিনে নিলেন। কালো কালির। আকাশটাও কালো হয়ে আসছে, মেঘ করছে। বৃষ্টি হতে পারে। রাস্তার দু’পাশের বাড়িঘর, দোকানপাট, গাছপালাগুলোর কালো কালো ছায়া গুলোও বেড়ে চলেছে। মনটা কিছুটা উদাস হয়ে যায় আসাদ সাহেবের। কত সুন্দর সুশৃঙ্খল ভাবে চলছে সব। দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, খোলা আকাশে আলো, মেঘলা আকাশে বৃষ্টি। আনমনে নিজের অজান্তে আসাদ সাহেব একটি বারের জন্য বলে উঠেন ‘হে সৃষ্ট জগতের স্রষ্টা সুনির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা তোমার সৃষ্টি, আপন কর্ম সাধনে দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী’।
(দুই)
বৃষ্টি হবে হবে করেও কাল বৃষ্টি হল না। আজকের আকাশটা অনেক পরিষ্কার। কিছুটা গরম পড়েছে। অন্যান্য দিন আসরের পরের সময়টা ছাদেই কাটান আসাদ সাহেব। আজও মসজিদ হতে ফিরে ছাদের উপরে এসে বসেছেন। বাড়ির ছায়াটা এখন অনেক দীর্ঘ হয়ে নদীটার এপার ওপার ছাইয়ে গেছে। এপারে কিছু হাস দল পাকিয়ে প্যাক প্যাক করে ডাকছে। সারাদিনের শেষে এখন হয়ত একটু আড্ডাবাজি করছে সবাই। একটু পরেই খোঁয়াড়ে ফিরে যাবে। ছাদের উপরের হালকা ফুরফুরে বাতাসে চনমনে হয়ে উঠেছে আসাদ সাহেবের মনও। হাসের দলের উপর থেকে চোখ তুলে তাকালেন আকাশে, পূর্ব দিগন্তে। মনে হল একটু অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু আগেও যা পরিষ্কার ছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুরো আকাশটা ছেয়ে গেল কালো মেঘে। আজ বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। বৃষ্টি আসতে পারে ভেবে ছাদ হতে শুকনো কাপড়গুলো নিতে এসেছে আমিনা। এসেই দেখে তার বাবা ইজিচেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘তুমি এভাবে বসে আছো কেন, আব্বু। বৃষ্টি আসছে তো-’ পেছন হতে প্রশ্ন করে সে।
-হুম আসছে। এখনও আসে নি। তুই কাপড়গুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলি কেন, বৃষ্টি এলে তো ভিজে যাবে।
-না ভিজবে না। বৃষ্টি আসার আগেই আমি ফুড়ুৎ করে নিচে নেমে যাব। কিন্তু তুমি যেভাবে বসে আছো মনে হচ্ছে শিলাবৃষ্টি হলেও তুমি এখান থেকে উঠবে না।
মৃদু হাসলেন আসাদ সাহেব। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল তাঁর মা তাঁকে শাসন করছে ‘আসাদ তাড়াতাড়ি নিচে আয়, বৃষ্টি নামবে এখুনি’
-হাসছ কেন আব্বু। তোমার কি চিন্তা হচ্ছে না, কি অন্ধকার করেছে! ঝড়-তুফান হতে পারে।
-তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস মা। যা কাপড়গুলো নিয়ে নিচে যা। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে।
মুখটা একটু ভার করে নিচে নেমে যায় আমিনা। ‘কিরে তোর আব্বু কই?’ নিচে নামতেই কানে শুনতে পায় মায়ের অনুসন্ধানী প্রশ্ন।
-আব্বু ছাদে চেয়ার পেতে বসে আছে। বললাম বৃষ্টি আসছে নিচে নেমে আসো, আসল না। আমাকে নিচে নামিয়ে দিল।
-তুই কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখ আমি দেখছি।
ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলেন আসমা বেগম। আসাদ সাহেব তখনও ইজি চেয়ারে বসে আছেন। তাকে দেখে একটু নির্লিপ্তই মনে হচ্ছে। ‘এই তুমি এখানে বসে কি করছ?’ ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন আসমা বেগম।
-এইতো বসে আছি। একটু বাতাস খাচ্ছি।
-এটা কি কোন বাতাস খাওয়ার সময় হল। বৃষ্টি পড়ছে।
-দু’এক ফোঁটা পড়ছে। এতে কিছু হবে না।
-কিছু হবেনা কে বলল। এটা হচ্ছে সংকেত। জোরাল বৃষ্টির সংকেত।
-তবে তুমি বলছ জোর বৃষ্টি হবে?
-হুম। নেমে আসো তাড়াতাড়ি।
-আসছি, তুমি একটু এদিকে এসো।
-কি?
-আহা এসো না, বসো। বলেই চেয়ারের ডান দিকের হাতল থেকে হাতটি সরিয়ে নিলেন আসাদ সাহেব। আসমা বেগম ইঙ্গিত পেলেন কিছু একটার, গোপন ইঙ্গিত।
-বলি হচ্ছে টা কি হ্যাঁ? আমাদের কি আর এখন সেই সময় আছে। ঘরে বারো বছরের একটা মেয়ে।
কিন্তু মনে মনে নিজেকেও সংবরন করতে পারছেন না আসমা বেগম। আজ অনেক অনেক দিন পর সেদিন গুলোর মতো একটি দিন এসেছে। সেদিন কত সাহসই ছিল মনে। লোকটার ডাকা না ডাকাকে উপেক্ষা করে কতবার নিজেই ধরা দিয়েছে লোকটার কাছে। আজও কি তাঁর মনে সেই সাহস আছে, আছে কি সেই উদ্দম; সেই প্রতয়? বৃষ্টির ফোঁটা আরও অনেক বড় হয়েছে। একটু ঘন ঘনই পড়ছে এখন। আসমা বেগম এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। চেয়ারের হাতলেও বসেন নি, নিচেও নেমে যাননি। তার মনে খেলা করছে কিশোরী মনের বাতাস। যেন ধীরে ধীরে সাহসের সঞ্চারণ ঘটছে মনে। আর একটু বেশী প্রত্যয়ী হয়ে উঠছেন নিজের অজান্তেই। কিন্তু এগুতেও পারছেন না। সুপরিচিত সেই লজ্জাটা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। অপেক্ষা করছেন আরেকবার কেন ডাকছে না লোকটা। আসাদ সাহেব মাথাটা ঘুরিয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। চোখের দিকে নজর পড়তেই এক নিমেষে পড়ে ফেললেন তার ভাষা।
-কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো কেন, আসো।
-হুম আসছি জনাব। আজ আপনার মনটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। চেয়ারের হাতলে বসে পড়ে আসমা বেগম।
-জানো আমি সুখী। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া তোমাকে আমার জীবনে পেয়ে। জানো আমি সব সময়ই দোয়া করতাম আমার জীবনটা যেন এমনি সুখের হয়। যেন প্রতিবার সালাতের শেষে বাড়ি ফিরে তোমার মত এক পুণ্যবতী স্ত্রীর মুখ দেখতে পারি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।
-তুমি যে ভাবে বলছ মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে করলে। জনাব ভুলে যাবেন না আপনার এখন বারো বছরের একটি মেয়ে রয়েছে।
-সেকারনেই তো ভাবি আমি সুখী। ঐ মেয়েটিই তো আমার সুখের প্রমাণ।
বৃষ্টি অনেক বেড়েছে। দু’জনের শরীর ভিজে চপচপে এখন। মাথার পানি গড়িয়ে এসে নাকের ডগা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছিল আসমা বেগমের। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আসাদ সাহেব।
-হাসছ কেন?
-তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই।
-বুড়ির আবার কি সৌন্দর্য?
-নিজেকে কি বুড়ি মনে হয় তোমার। তাহলে আমি নিশ্চয় বুড়ো হয়ে গেছি।
-ওমা, তা বলেছি নাকি? তুমিতো এখনও সেদিনের মতই আছো।
-কোনদিনের মতো?
-যে দিন আমায় প্রথম ঘরে আনলে। আমি তো তোমায় দেখে মনে মনে অভিভুত হয়ে গিয়েছিলাম। পুরুষেরও এতো রুপ হয়।
-তাহলে আমার কি অবস্থা হয়েছিল বল তোমাকে প্রথম দেখে। সত্যি বলতে তুমি আজও আমার কাছে তেমনি আছো। থাকবেও সবসময়।
-তুমি এতো ভালো কেন বলতো, কত সুন্দর করে কথা বল।
-জানিনা, তবে ইচ্ছা ছিল জীবনে একজন ভালো মানুষ হবো, মন্দের হাতছানি আসেনি তা কিন্তু নয় কিন্তু তা হেরে গেছে আমার মনের প্রতিজ্ঞার কাছে, দৃঢ় প্রত্যয়ের কাছে। যেমনটা প্রত্যয়ী হবার দোয়া করেছি সুমহানের কাছে।
-আর সে কারণেই তুমি হতে পেরেছ সত্যিকারের একজন আলোকিত মানুষ।
-কিন্তু অপূর্ণ ছিলাম। কিন্তু এই অপূর্ণতার কারণ যে আমার চেয়ে তিনি ভালো জানতেন। তাইতো তোমাকে দিলেন আমার জীবনে। আজ আমি পূর্ণ। আসাদ সাহেব আসমা বেগমের একটি হাত ধরলেন আলতো করে।
-সত্যিই আমি সৌভাগ্যবতী সৎ, ধার্মিক, একজন আদর্শবান প্রত্যয়ীর সহধর্মিণী হতে পেরে। আসমা বেগমও অপর হাতটি রাখলেন আসাদ সাহেবের হাতের উপর।
রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি ঝরছে। আসমা বেগমের চেহারা এখন ভেজা। চোখের সুরমা কিছুটা ধুয়ে গেছে, কিছুটা হালকা লেপটে আছে চোখের পাতার নিচে। চেহারাতে অপ্রস্তুত ভঙ্গী স্পষ্ট। আসাদ সাহেব তাকিয়ে আছেন সেই অপ্রস্তুতির দিকে যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন কোন এক অত্যাকাঙ্খিত সুখানুভুতির জন্য। তার পাঞ্জাবী ভিজে লেপটে গেছে গায়ের সাথে। কাঁচা পাকা দাড়ি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে বুকের উপর। ঘন দাঁড়িতে কিছু বিক্ষিপ্ত জলকণা ঝিকমিক করছে। আসমা বেগমও তাকিয়ে আছেন সেই ছিটে ফোঁটা উজ্জল জলকণার দিকে। একেকটা জলকণা যেন এক একটি হীরের কণা। তার মনে চাচ্ছে ঐ জলকণা দিয়ে নাকফুল বানিয়ে পড়তে, মনে চাচ্ছে আজ অনেক দিন পর নিজেকে সাজাতে, মধ্যবয়স্ক এক প্রানপ্রিয় পুরুষের জন্য।
হঠাৎ কোথায় যেন বাজ পড়ল দুজনকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে। দু জনেই হেসে ফেললেন। আসমা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন আসাদ সাহেবও। জোরাল বৃষ্টিতে ভিজতে এখন তাদের ভালোই লাগছে। মেয়েটার কথা মনে পড়ল আসমা বেগমের। কাল বিকেলে মেঘ দেখে বায়না ধরেছিল বৃষ্টিতে ভিজবে, শেষে বৃষ্টি হয়নি। আসমা বেগম বললেন ‘মেয়েটাকে একটু ডাকো না, কাল বলেছিল ভিজবে’। মৃদু হাসলেন আসাদ সাহেব। একটু গলা চড়িয়ে ডাকলেন মেয়ের নাম ধরে। আমিনা হয়ত নিচে এ অপেক্ষাতেই ছিল। ও সাথে সাথে ছুটে এল ছাদে। দৌড়ে এসে আসাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরল আমিনা। ‘মুখে বলল আব্বু তুমি খুব ভালো, খুব বেশী ভালো’। আসাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আলতো করে। ডান হাতটি বাড়িয়ে রাখলেন আসমা বেগমের কাঁধে। পূর্বের ছোট নদীটার দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে তিনজন। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ছন্দিত হচ্ছে নদীর বুক। কালো আকাশ ধীরে ধীরে আরও কালো রঙ ধারন করছে। মেঘের দাপটে গোধূলির লালিমা হালকা নজরে পড়ছে। আসরের সময় ফুরিয়েছে বুঝা যাচ্ছে। একটু পড়ে হাতের বাঁধন আলগা করলেন আসাদ সাহেব। মাগরিবের সময় হয়ে আসছে, মসজিদে যেতে হবে। যে সুমহান তার প্রতিটি দিনকে এমন মধুময় করেছেন তার জন্য মাথা না নোয়ালে বড়ই অকৃতজ্ঞতা হবে।
(তিন)
মাগরিবের আযান এখনও হয়নি। আসাদ সাহেব বসে আছেন মসজিদের ভেতরে প্রথম কাতারে। আরও অনেকেই বসে অপেক্ষা করছেন আযান হবার। আসাদ সাহেবের মনটা প্রশান্তিতে ভরে আছে। মসজিদের ভেতরটাই যে প্রশান্তিদায়ক পরিবেশে ভরপুর। আসাদ সাহেব দুই হাত তুললেন সম্মুখে। কায়মনোবাক্যে মহা মহিমের দরবারে জানালেন নিজের যা আকুতি।
-‘হে রাহিম, রাহমান, জীবনে সুখি হবার যে শপথ একদিন নিয়ে ছিলাম তোমার করুণাতে আজ তা আমার করায়ত। আজ আমি সুখি। আমি কৃতজ্ঞ তোমার নেয়ামতে। হে সর্বশক্তিমান, আমাকে দৃঢ়তা দাও, এ সুখ যেন আমার গোমরাহির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে শক্তি দাও দূর করতে জাগতিক মোহ। ধৈর্য দাও সুখে এবং দুঃখে। সাহস দাও মনে। যে সুখের মুকুট আজ পেয়েছি তা রক্ষায় আমাকে করে দাও দৃঢ় প্রত্যয়ী’।
হাতের তালু সারা চেহারায় স্পর্শ করে মুছিয়ে দিলেন। যেন যা চাইলেন তার সবটাই পেয়ে গেছেন আর তা মেখে নিলেন কপলে, চোখে, চেহারায়; দেহের সবেচেয়ে সম্মানিত স্থানে। তখনি মসজিদের মিনার হতে ভেসে এলো মুযাজ্জিনের ধ্বনি। ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহ...... আল্লাহ সবেচেয়ে বড়......’
-‘যে আল্লাহ আমাকে এতটা প্রত্যয়ী করেছেন সত্যিই তিনি অনেক বড়; সবচেয়ে বড়’। আনমনে একটিবার মনে মনে বলে গেলেন আসাদ সাহেব।