দৃশ্যপট : ১
এ কোন বিশাল শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছে মন ? নিজেকে বড্ড বেশি একা লাগে আজকাল। অধরার সাথে সেই কবে কথা হয়েছিলো, তা ঠিক মনে নেই। ভেতরটা কেমন যেনো খালি, খালি লাগে। শরৎ এসে চলে যায় কাশফুল গুলো অভিমানে ঝরে যায় এমন করে কয়টা শরৎ যে কেটে গেলো তুমি বিহীন, অধরা তোমারও কি আমার জন্য মন কাঁদে? আমার মতো তোমারও কি মনে পড়ে সেই শরতের কথা? সমুদ্রের অনেক দূর জলরাশি আর আকাশ- যে মিলেমিশে রাতের এই জ্বলে থাকা বাতির আলোতে এক হয়ে গেছে, সেই দূরে তাকিয়ে থেকে অনেক চেঁচিয়ে এই কথাগুলো বলছিলো আলিফ। ঠিক এমন সময়-
– আপনার মনে কি অনেক কষ্ট ? আচমকা পিছু তাকায় আলিফ, ডানে বামে কেউ নেই, আমাকে বলছেন?
– হুম আপনাকেই বলছি। আমি আপনাকে প্রায় অনেকটা সময় ধরেই দেখছিলাম, এই বিশাল সমুদ্রের তীরে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে কি দেখছিলেন এমন করে?
– দেখছিলাম রাতের এই নির্জনতায় রূপালী চাঁদের আলোয় ঢেউ গুলো দেখতে কেমন লাগে।
– আপনিতো অনেক সুন্দর করে কথা বলেন।
– আলিফ একটু মৃদু হেসে বলল, আপনার মনটা এখনো অনেক সুন্দর, তাই হয়ত আপনার কাছে শুধু আমার কথা নয়, সব কিছুই সুন্দর লাগবে।
– “নিয়ম” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার এই মনটা কোনো একদিন আর সুন্দর থাকবেনা?
– আমি কিছুই বলতে চাচ্ছিনা, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আপনার নামটা, আমি কি আপনাকে চিনি বা আপনি আমাকে?
দৃশ্যপট : ২
– এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, চলেন একটু হাঁটি।ওহ একদম ভুলে গেছি, আমার নাম “নিয়ম”। ঢাকা উত্তরা থেকে আসছি।
– আমি “আলিফ” ঢাকা আজিমপুর আমার বাসা। ”নিয়ম” আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর।
– থ্যাংকস, আমার এই নামটা আমার আব্বু রেখেছেন।
– আপনার আব্বু কে বলবেন এরকম আর একটা সুন্দর নাম যেনো আমার জন্য রাখেন।
– কেনো আপনার নামটাতো সুন্দর।
– আরে আমার জন্য না। আমার অনাগত ভাগনির জন্য।
– মেয়েই যে হবে আপনে কি করে জানেন ?
– আমার বিশ্বাস।
– আচ্ছা বলবো।
– আপনে কি একাই আসছেন ? বলল আলিফ।
– না আমার ভাইয়া আর ভাবি আসছে, ভাইয়ার নতুন বিয়েতো, তাই হানিমুনে আসছে। আমি হলাম আমার ভাইয়টার সব, তাই যখন যেখানে যাবে আমাকে সঙ্গে নিবেই। আমি কেনো একা, একা হাঁটছি তাতো বুঝতেই পারছেন।
– তবে আমার জন্য কিন্তু খুব ভালো হয়েছে বলল -আলিফ।
– তা কেমন ভালো?
– এই যে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন, আমি একজন সঙ্গী পেলাম।
– কেনো আপনার সাথে কেউ আসেনি?
– আমি একটা শূন্য মানুষ একটু পূর্ণতার আশায় এই বিশাল সমুদ্রের কাছে আসি। কে আসবে আমার সঙ্গে বলুন ?
– এতটা শূন্য কি ভাবে হলেন ?
– বলবো, যদি এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে সঙ্গী হন তো !
– খানিক গালে হেসে বলল হলাম না হয় সঙ্গী। তা কতদিন আছেন ?
– আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল আলিফ জানিনা। এমন সময় “নিয়মের” মুঠোফোনটা বেজে উঠলো।” নিয়মের” ভাই ফোনের ও প্রান্ত থেকে। কিরে নিয়ম কই তুই। তাড়াতাড়ি আয়, রুমে চলে যাবো।
– আচ্ছা ভাইয়া আসছি। “আলিফ” সাহেব আজ আমাকে যেতে হবে। আসি।
– যাবেন, অবশ্যই। ভাল থাকবেন। কাল আসবো ঠিক এখানেই, আসবেন তো ?
– নিয়ম একটু হাসি দিয়ে বলল আসবো।
দৃশ্যপট : ৩
আজকের দিনটা গত কাল থেকে একে বারেই ভিন্নতর। চোখ দুটো কোনো ভাবেই এমন মধুর ঘুম মিস করতে চাচ্ছে না। সকালের সোনালি রোদ জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বার বার উঁকি দেয়। সে আলোয় আলিফের আর ঘুম হলোনা। এক মগ ব্লাক কফি, আর একটা কবিতার বই নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। এ ভাবেই সারাটা সকাল কাটিয়ে দিলো। দুপুরবেলা আবার ঘুম। ঘুম থেকে উঠে লাঞ্চ শেষ করে আবার সেই সমুদ্র তীরের কাছাকাছি অনেক গুলো গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে।
– কখন এলেন? বলল “নিয়ম”।
– এইতো অনেক ক্ষণ। আপনি আসবেন ভাবিনি।
– ভ্রু বাঁকা করে তাকায় নিয়ম। এমন কেনো মনে হলো আমিতো কথা দিয়েছি আসবো।
– না আমি অপরিচিত একজন মানুষ কেমন না কেমন তাই ভাবলাম হয়তো আসবেন না।
– হুম তা অবশ্যই ঠিক আপনি অপরিচিত ছিলেন কিন্তু এখন পরিচিত। আর দেখে তো মনে হয় অতটা খারাপ হবেন না। বলেই অনেক হাসতে লাগলো, আলিফও সাথে সাথে হেসে দিলো।
– এখানে কি করছেন। একা একা ভাল লাগে ?
– ঝরে পড়া শুকনো পাতাদের ঝরে পড়ার শব্দ শুনছিলাম। আমার বুকের ভেতর যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ।
– আপনি যে কি অদ্ভুত কথা বলেন। যাই হোক আজ আর অন্য কোনো কথা নয়। কেনো এমন শূন্য আপনার জীবন। তাই শুনবো।
– তাই ঠিক আছে বলবো চলেন সমুদ্রের কাছে গিয়ে বসি।
– প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। ২০০৮, এর রোজার ঈদের পর আমি আর আমার কয়েক জন বন্ধু মিলে এইখানে মানে এই কক্সবাজার বেড়াতে আসি। তারপর একদিন হঠাৎ করেই ঠিক এখানে দেখা হয়ে যায় অধরার সাথে। যাকে আমি অনেক ভালবাসি আমার অস্তিত্ব জুড়ে যার বসবাস। যার জন্য আমি এখনো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ফিরে আসি এখানে।
দৃশ্যপট : ৪
– নিয়ম” অবাক হয়, অধরা ? জানেন আমার ভাবির নাম ও অধরা। তারপর ?
তারপর অধরার সাথে পরিচয়, এক সাথে সমুদ্র দেখা, শেষে বিকেলের সূর্য ডুবা দেখা, রাগ অনু রাগ ভাললাগা থেকে ভালবাসা। খুব ভালভাবেই যাচ্ছিল আমাদের সম্পর্কটা। এতটাই ভালবেসে ছিলো সে আমাকে, কত রাত জোছনার জল আর এই সমুদ্রের জলে স্নান করেছি দুজন তার কোন হিসেব নেই। এখনো এই সমুদ্রের জল তার সাক্ষী বহন করে। অধরার পায়ের নখ থেকে মাথা পর্যন্ত আমি জানি। তার পশমের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে আমার স্পর্শ। আচ্ছা “নিয়ম” এত কিছুর পর কি কোনো মেয়ে ভুলে যেতে পারে ?
– আমি অন্যদের কথা জানিনা, তবে আমি হলে বিষ পান করে মরতাম, তবু ভালবাসার মানুষকে ছাড়া এক দিন ও থাকার চিন্তা করতাম না। তারপর ?
– তারপর কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরি একই সাথে। অধরার বাড়ি ছিলো মোহাম্মদপুর। তার সাথে আমার নিয়মিতই দেখা হতো কথা হতো। ঢাকা শহরের এমন কোনো জায়গা নেই যে দু- জনের পায়ের ছাপ পরেনি। জীবনের যতো স্বপ্ন ছিলো সবই অধরাকে ঘিরে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সে একদিন ফ্রান্স চলে যায় আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে। আজ দু-বছর হয়। তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সে কেমন আছে তা ও জানিনা। শুধু তার এক বান্ধবীর কাছে একটা ছোট চিঠি রেখে গিয়েছিলো। যা আজও আমি যত্ন সহকারেই রেখে দিয়েছি। চিঠিতে শুধু লেখা ভাল থেকো চিন্তা করোনা আমি তোমার আছি- তোমারই থাকবো। তুমি শুধু আমার অপেক্ষায় থেকো।
আর তার সেই কথা মনে রেখেই আমি আজো তার অপেক্ষায় আছি। সে আমায় বলেছিল যদি কোনদিন হারিয়ে যাই। ঐ সেই সমুদ্র সৈকতে এসো আমাকে পাবে। আর আজ তার সেই কথা মনে রেখে আজও তার অপেক্ষায় আছি যদি সত্যি সে ফিরে আসে, তাই এই সমুদ্রের কাছেই আজও বসে থাকি তার অপেক্ষায়। হাজার ও স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই সমুদ্রের মাঝে। সমুদ্রের মাঝ থেকে শোঁশোঁ করে যে হাওয়া আসে। সে হাওয়ায় আমি এখনো শুনতে পাই অধরার” সেই কণ্ঠস্বর। তাই বারবার এই সমুদ্র আমায় টানে। মনে হয় এখানে আসলেই আমার সব সুখ।
-আপনি এখনো তার অপেক্ষায় আছেন ? যে আপনাকে শূন্য করে দিয়ে গেলো, কি লাভ তার কথা মনে রেখে ? সব ভুলে কি আবার নতুন…! আলিফ “নিয়মের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল।
– না আমি পারব-না, আমি অধরাকে ভুলতে পারব-না। অধরাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজেকেই ভুলে যাওয়া। তার পর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে অনেকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজন। হঠাৎ করে ভেসে আসা দমকা হাওয়ার ধাক্কায় ঘোর কাটে দুজনের।
– আচ্ছা আলিফ আপনি এত ভাল কেন বলেন তো ?
– আলিফ অনেক শব্দ করে হাসে, আমি যদি ভাল মানুষ হতাম তবে কি “অধরা” আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতো !!
– “অধরা” হয়তো কোনোদিন আপনাকে ভালবাসতে পারেনি। তাই হয়তো চিনতে পারেনি আপনাকে। আলিফ একটা কথা বলি?
– বলেন?
– কেউ যদি আপনাকে ভালবাসে নতুন করে একটা সুন্দর জীবনের গল্প লিখে দেয় আপনার জীবন খাতায়, তা হলে কি অনেক বড় ভুল হবে?
– আমি কিছুই বলতে পাড়বো না, শুধু জানি অধরার সাথে একবার হলে ও আমার দেখা হওয়া প্রয়োজন। আমি একটিবার তার মুখোমুখি হতে চাই।
– আমি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো যেনো আপনার মনের আশা পূরণ হয়। আজ তা হলে উঠি কাল আবার আসবো। আমি কি আপনার মোবাইল নাম্বার টা পেতে পারি?
– অবশ্যই এটা হলো আমার নাম্বার ০১৯১১…………।
– আজ তা হলে আসি ভাল থাকবেন।
দৃশ্যপট : ৫
“নিয়ম” নিজের অজান্তেই আলিফের মায়ায় পড়ে যাচ্ছে। কিসের সেই মায়া তা সে নিজে ও জানেনা। আজকাল নিজের অজান্তেই আলিফ কে নিয়ে যা-তা ভাবছে। সারাক্ষণ কি যেনো একটা ঘোরের ভেতর থাকে। আলিফের সমস্ত দুঃখ কষ্ট যেনো তার নিজস্ব।
নিয়মের ভাবি “অধরা” প্রায় ভাবে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে নিয়ম কে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা আর হয়না। তবে আজ বলেই ফেলল। – কিগো আমার মিষ্টি ননদিনী সারাদিন কি একাই হাঁটো, একাই সমুদ্র দেখো। একা সমুদ্র দেখতে ভাল লাগে?
– হুম তোমাকে তো বলাই হয়নি সমুদ্র আমার অনেক প্রিয়, এই সমুদ্র আমায় অনেক কিছু দিয়েছে। এই সমুদ্র আমায় ভালবাসতে শিখিয়েছে। একা বললে ভুল হবে, একজন আসে প্রতিদিন সমুদ্র দেখতে, ওনার সাথেই সময় দেই, মানুষটা খুব ভালো, তবে অনেক কষ্ট মানুষটার মনের ভেতর।
– তাই !! তবে একদিন নিয়ে আসো মানুষটার সাথে কথা বলি। তুমি চাইলে আজি ডিনারে আসতে বলতে পার।
– সত্যি বলছ ভাবি আজ ডিনারে আসতে বলবো। কিন্তু ভাইয়া ?
– তোমার ভাইয়াকে আমি ম্যানেজ করবো।
– আমার লক্ষী ভাবি। আমি এক্ষণি আসার জন্য বলছি। নিয়ম অনেক আনন্দ নিয়ে ফোন করলো আলিফকে। ফোনের ও প্রান্ত থেকে…।
– হ্যালো কে বলছেন ?
– আমি, আমি নিয়ম”।
– অহ্ আপনি। তা ভাল আছেন তো ?
– হ্যা ভাল আছি, আমি একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি। আমার কথাটা রাখবেন তো ?
– আমি যদি আপনার কথাটা রাখি তবে কি অনেক খুশি হবেন ?
– আমি যে কতটা খুশি হবো তা আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না।
– তাই ?
– হ্যা তাই ?
– আচ্ছা কথা দিলাম রাখবো।
– আজকের ডিনারটা আমাদের সাথে করবেন। ভাবি কে আপনার কথা বলেছি। কি আসবেন না ?
– কথা যেহেতু দিয়েছি আসতেই তো হবে। আসবো। কোথায় কখন আসতে হবে?
– আমাদের হোটেলের নিচে যেই রেস্টুরেন্টটা আছে এখানে। ঠিক রাত নয়টার সময়। কি আসবেন তো ?
– আচ্ছা আসবো।
দৃশ্যপট : ৬
আলিফ আকাশি রঙের একটা শর্ট পাঞ্জাবী আর কালো রঙের জিন্স প্যান্ট পড়ল। আজ অনেক দিন পর এক সাথে, কারোর সাথে ডিনার করবে তাই একটু ভাল লাগছে ভাবতেই। ”অধরার” সাথেই অনেক গুলো রাত ডিনার করে ছিলো এক সাথে এই রেস্টুরেন্টে, তবে অনেক কিছুর মতো ঐ সেই রাতের কথা ভুলতে পারেনি আলিফ। এমন সময় আলিফের মুঠোফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ফোনটা আর কারোর না ”নিয়মের”।
– এই যে আলিফ সাহেব কোথায় আপনি। আমারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
– আমি আসছি পাঁচ মিনিট লাগবে।
”নিয়ম” হাত দিয়ে ইশারা করলো আলিফকে। – হাই আপনার ভাইয়া ভাবি কোথায় ?
– ভিতরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। চলুন যাওয়া যাক।
নিয়ম” আর ”আলিফ” যখন রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলো, আর ঠিক তখনি ”অধরার” চোখ পড়লো ”আলিফের দিকে। অধরার সমস্ত পৃথিবী যেনো ঘোলাটে হয়ে গেলো। এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সময় যে অধরার জীবনে আসবে তা কোন দিন কল্পনা করেনি। অধরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠলো। অনেক হাসি আনন্দ নিয়ে যখন আলিফ অধরার দু-চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, আলিফ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পাড়ছিল না নিজের চোখ দুটোকে। হঠাৎ করেই যেন আলিফের সমস্ত শরীরের রক্ত গুলো জমাট বেঁধে গেলো। যে ”অধরাকে” আর একবার দেখবে বলে মাসের পর মাস সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে দিলো; সেই ”অধরাকে” এমন ভাবে দেখবে আলিফ তা কখনো ভাবেনি। লাল শাড়ি হাত ভরতি চুড়ি কপালে টিপ, নাকে নাকফুল, দুহাত ভরতি মেহেদীর আল্পনা। অনেক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল দুজন দুজানার দিকে।
– ভাবি আমি তোমাকে যে মানুষটির কথা বলে ছিলাম উনি হলেন সেই আলিফ। আলিফ উনি হচ্ছেন আমার ভাবি, আর উনি হলেন আমার সেই ভাইয়া।
– হাই আমি ইমতিয়াজ আহম্মেদ। দাঁড়িয়ে কেন বসুন, খেতে খেতে না হয় কথা বলবো।
– হ্যা শিওর। বলল আলিফ।
– তারপর কোন হোটেলে উঠেছেন ?
– এইতো শাপলা হোটেলে।
– তাই আমরাও তো এই হোটেলেই। তা কোন রুম আপনার ?
– আমার ১৩৭ নাম্বার রুম।
– তাই !! আমাদের ১৪০-৪১ নাম্বার রুম। পাশাপাশি তো আছি। তা একাই আসছেন ?
আলিফ আড়চোখে তাকায় ”অধরার দিকে, আর বলে, একা মানুষ তো একাই আসবো।
– তাই কোনো ব্যাবসায়িক কাজে নাকি ঘুরতে আসছেন ? আলিফ আবার ”অধরার দিকে তাকায় এবার অধরার চোখে চোখ রেখে বলল। না ব্যবসা বা ঘুরতে কোনটাই নয়। আমি প্রায় দু-বছর আগে একজন কে হারিয়ে ফেলেছি তাকে খুঁজতেই এখানে আসা।
– তাই তাহলে তো আরো কিছু দিন থাকবেন তাইনা ?
– না ভাবছি কাল চলে যাবো। “অধরা” আবারও তাকায় আলিফের দিকে। নিয়ম প্রশ্ন করে কেনো চলে যাবেন কেন ? – যাকে খোঁজার জন্য এখানে আসা, কিন্তু আজ হঠাৎ করে জানলাম তাকে আর কোন দিন পাবনা তাই। ভাবছি কাল চলে যাব।
– কি ব্যাপার ভাবি তুমি কিছু বলছো না যে। অধরা চমকে যায় ”নিয়মের” কথায়। – না মানে ইমতিয়াজ, আমার অনেক খারাপ লাগছে, মাথাটা অনেক ধরেছে। প্লিজ আমি একটু রুমে যাই। তোমরা ডিনার শেষ করে না হয় এসো। বলল অধরা।
– অনেক বেশী খারাপ লাগছে ? ডাঃ ডাকতে হবে।
– আরে না তেমন কিছু না। ডাঃ ডাকতে হবেনা। আমি আসি।
– একা যেতে পাড়বে তো ?
– হ্যাঁ পাড়বো। তোমরা ডিনার শেষ করে এসো।
দৃশ্যপট : ৭
অধরা রুমে গিয়ে বালিশের ভেতর মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আলিফ এখনো এতো ভালবাসে, এখনো এই সমুদ্রের কাছে শুধু তার জন্য বসে থাকে। এই ভেবে অধরার কান্না আরো বেড়ে যাই। আগের আলিফ আর এখনকার আলিফের মধ্যে অনেক ফারাক। আলিফের দু-চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। শুকিয়ে গেছে অনেক। মনে হয় অজস্র রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে আলিফের সাথে। ইচ্ছে করছে আলিফকে একবার জড়িয়ে ধরে কান্না করতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয়। তার পর ও অধরার অবচেতন মন কিছুতেই মানছে না। তাই ঠিক করে ফেলল আজ যে ভাবেই হোক কথা বলবেই।
– ইমতিয়াজ সাহেব আজ তাহলে উঠছি ভাল থাকবেন। ভাল থাকবেন “নিয়ম”। আমি আপনাদের কোন দিন ভুলবো না।
– তো কাল কি সত্যিই চলে যাবেন ? বলল ”নিয়ম”।
– হ্যাঁ আমি কালকেই চলে যাব। আসি ভাল থাকবেন।
”নিয়মের” আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর সেই কষ্টটা শুধুই আলিফের জন্য। “নিয়ম” আজ সত্যি বুঝতে পারছে আলিফকে সে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু আলিফ কাল সকালে চলে যাবে। তা হলে কি আর কক্ষনো আলিফকে বলা হবেনা কতটা ভালবাসে। আর কি কক্ষনো এক সাথে সমুদ্র দেখা হবেনা ? যে ভাবেই হোক আলিফকে বলতেই হবে। হ্যাঁ আমি আজ রাতেই বলবো আমি কতটা ভালবাসি তাকে সে কথা।
দৃশ্যপট : ৮
আর ওদিকে অধরা অস্থির হয়ে আছে শুধু আর একবার আলিফের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু কি ভাবে, ইমতিয়াজকে রেখে কি ভাবে যাবে সে- অধরার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ইমতিয়াজ সাহেব ডাক দিলো।
– অধরা আমার ঘুমের ঔষধ আর এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো। ইমতিয়াজ সহেবের প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ঘুমের ঔষধ না খেলে তার ভাল ঘুম হয়না। আর অধরা ইমতিয়াজ সাহেবের সেই বদ অভ্যাসের সুযোগ নিতে একটুও ভুল করেনি। তাই তো ”অধরা” দুটা ঘুমের ঔষধ পানির সাথে মিশিয়ে দিল, আর একটা হাতে করে নিয়ে গেলো। ইমতিয়াজ সাহেব ঘুমের ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে গেলেন। আর অধরা দরজা খুলে আস্তে আস্তে চলে গেলো আলিফের রুমে। রাত প্রায় একটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ করেই আলিফের রুমের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আলিফ রুমের ভিতর থেকে- এত রাতে আবার কে আসলো। দরজা খুলতেই কোনো কিছু না বলেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ে অধরা।
– এত রাতে তুমি ?
– হ্যাঁ আমি।
– তুমি কেনো আসছো এখানে, চলে যাও কেউ দেখে ফেললে তোমার সংসার ভেঙে যাবে। আমি চাইনা তোমার ঐ সুন্দর হাতের মেহেদি শুকানোর আগেই মুছে যাক।
আর ওদিকে “নিয়মের” আর দেরি সইছে না, আলিফকে ভালবাসি কথাটি না বলা পর্যন্ত নিয়মের দু-চোখে ঘুম নেই, সেই একটি মাত্র কথা ভালবাসি। তা বলার জন্য আলিফের রুমের দিকে যেতে লাগলো হঠাৎ নিয়মের চোখ পড়লো আলিফের রুমের জানালাটার দিকে। জানালার পর্দার আড়ালে দুজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে, আর খুব ভাল করেই বুঝা যাচ্ছে একটা মেয়ে, আর একটা ছেলে। নিয়মের হিসেব যেন কিছুতেই মিলছে না। আলিফের রুমে এমন মধ্য রাতে মেয়ে মানুষ !! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। তাই কৌতূহল নিয়ে ”নিয়ম” জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
আর রুমের ভিতর অধরা বলছে – না আমি যাব না।
আলিফ অধরার কথায় হাসে, হা, হা, হা, যাবেনা, কেন যাবেনা। – আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি…। আলিফ অধরার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ভালবাস তুমি আমাকে? এই বলে আলিফ আবার হাসে, হাসি থামিয়ে চীৎকার করে বলে, লজ্জা করে না তোমার। সারা দিন রাত অন্য একজনের সাথে এক খাটে ঘুমিয়ে আমাকে এসে বলছো ভালবাসার কথা !! আমার স্বপ্নগুলো তো ভেঙেই দিয়েছ, এবার যাকে স্বপ্ন দেখালে তার স্বপ্ন গুলো আর ভেঙ্গো না।
– অধরা কান্না করে আর বলে আলিফ শুধু একবার আমার কথা গুলো শোনো, আমি কেন তোমার সাথে…। আলিফ আবার থামিয়ে দেয় অধরাকে। আলিফ কাঁদে আর বলে, তুমি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে যাও। আমি তোমার এই মুখটা আর দেখতে চাইনা। আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। তুমি যাও, তুমি যাও।
অধরা বের হয়ে যাওয়ার সময় ”নিয়মের” সামনে পড়ে যায়। অধরা কিছু বলতে পারেনা। মাথা নিচু করে শুধু কাঁদছে। ”নিয়ম” ”অধরার” মুখটাকে দু-হাত দিয়ে তোলে দু- চোখের পানি মুছে দিয়ে শুধু একটি কথাই বলল, ভাবী তুমিই কী সেই ”অধরা”… ?