( ১ )
হাঁফরের আগুনে টকটকে লাল হয়ে উঠলো আমার বুক-পিঠ । এবার রমাকান্ত একটা সাঁড়াশী মত জিনিস দিয়ে আমাকে তুলে আনতেই তার নাদুস নুদুস ছেলেটা হাতুড়ী তুলে নিল হাতে । শশীকান্তর মোটা হাতুড়ীর মার খেয়ে কোঁকিয়ে উঠতেই রমাকান্ত কায়দা মত মারছে ছোট হাতুড়ীটি দিয়ে । ছন্দে ছন্দে মার খেতে খেতে জন্ম হোল আমার । খুব কাঁদছিলাম । পাশ থেকে একটা বড় ছোরা মুচকি হেসে বলেছিল , ‘ও কিছু নারে , বার্থ-ক্রাই ! দেখবি এ ব্যথা তোর মনেও থাকবে না’ । তারপর ক্রমশ জুড়াতে জুড়াতে খেয়াল করলাম , কি ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণতা আমার দুধারে ! হাতে নিয়ে পরখ করতেই শশীকে রক্তাক্ত করে দিলাম । নিজের ক্ষমতায় ভীষণ গর্ব হচ্ছিল আমার । আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম , আমার ভিতরে জেগে উঠেছে কিছু অতীন্দ্রিয় অনুভূতি । মানুষের সব কথা আমি শুনতে পাচ্ছি , বুঝতে পারছি ! বলা কথারা যখন থেমে যাচ্ছে , নেমে আসছে না-বলা কথার বহুমাত্রিক জগৎ । রহস্যময় সে জগতে আমি তন্ময় হয়ে দেখতে থাকি বলা কথাগুলো কত মেকি আর হালকা ! এত বড় ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়া বদলে দেয়া কোন ব্যাপারই নয় । আমিও তাই চেষ্টা করাছিলাম । হায় অদৃষ্ট ! কোন ইচ্ছাকেই আমি কাজে পরিণত করতে পারিনা । যখন যার হাতে , আমি তার ইচ্ছার গোলাম ।
আরও কয়েক ভাইয়ে সাথে সারাদিন রাস্তার ধারে চটের উপর পড়ে ছিলাম । ইতিমধ্যে আমার কয়েক ভাইয়ের মালিকানা বদল হয়ে গেল । আমাকে কেউ ছুঁয়েও দেখল না । এমন সময় এলো বশির । বাজারে ছোট খাট একটা ব্যবসা আছে তার । এক কোনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে কেমন যেন এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এবং দরাদরি ছাড়াই আমাকে কিনে নিল পাক্কা তিনশো টাকায় । আমি তার মহানুভবতায় মুগ্ধ হলাম ।
বশির ছিল আড্ডাবাজ , বেপরোয়া আর আবেগপ্রবণ মানুষ । তিনকুলে তার বৌ ছাড়া আর কেউ ছিলনা । আর ছিল এক বন্ধুবৎসল প্রতিবেশী , আলি । দুজনার তখন গলায় গলায় ভাব । তাদের আড্ডা যখন জমে উঠত , বশিরের তখন মোকামে যাবার সময় । আড্ডার নেশায় বন্ধুদের সাথে পড়ে থাকতো সে । ব্যবসায় লোকসান দেয়া যেন কোন ব্যাপারই নয় । কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গ সে ছাড়তে পারবে না । এসব সত্ত্বেও তার ব্যবসা দিনে দিনে বেড়েই চলছিল । কখনো সামান্য লোকসান হোলে অন্য কোন খাত থেকে অযাচিত লাভ হয়ে যেত ।
এই আড্ডা ছিল রুমানার চোখের বালি । লোকসানের খবর শুনলেই তার বুঝে নিতে কষ্ট হতো না এটা আড্ডার ফল । এ নিয়ে বৌয়ের সাথে ও মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হতে লাগলো বশিরের । আর দশ জনের চেয়ে বৌকে বেশী ভালোবাসতো কিনা বশির তা জানিনা , তবে বৌয়ের কোন সাধ সে অপূর্ণ রাখতো না । কখনো অন্য শহরে গেলে রাত্রে বৌয়ের ছবি পাশে শুইয়ে ঘুমাতো ।
সেই সন্ধ্যার কথা খুব মনে পড়ে । টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরছিল । বশির যখন বাড়ী ফিরল মুল দরোজা ছিল বন্ধ । ভেতরে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল । তবু ঘরে ঢুকে বুঝতে বাকী রইল না বাড়ীতে স্ত্রী রুমানা ছাড়াও আছে আরও কেউ । আলো আঁধারিতে শোবার ঘরে রুমানার আর্তকণ্ঠ শোনা গেল , তুমি এসেছ ! আমিতো এদিকে মরতে বসেছি । এতক্ষনে রান্না ঘর থেকে আচনক গরম পানির গামলা হাতে বেরিয়ে এলো আলী । কিছু শোনার আগেই ভীষণ ক্ষেপে গেল বশির , ***** বাচ্চা , বন্ধুর বৌয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে এসেছিস ! বৌটি কসম কেটে বলতে লাগলো , আমি ইলেকট্রিক তারে শক খেয়েছি । অজ্ঞান হয়ে মরতে পড়েছিলাম , ভাইজান আর ভাবী চিৎকার শুনে ভেতরে এসে আমাকে বাঁচিয়েছেন । আরেক কোন থেকে ডেটলের শিশি হাতে ছুটে এলো আলীর স্ত্রী , ফাতেমা । কিন্তু ততক্ষনে সর্বগ্রাসী ক্রোধ বশিরকে নিয়ে গেছে ভিন্ন দুনিয়ায় । প্রচণ্ড ক্ষোভে আমাকে সেদিয়ে দিল আলীর বুকে ।
আলীর ভাগ্য ভাল ছিল বলতে হবে । বুকের বাম পাশের চামড়া আর ফুসফুসের সামান্য অংশ কেটেছে মাত্র । হৃদপিণ্ডের উপর আমার বিদ্বেষ কম ছিল কিনা এটা একটা প্রশ্ন রয়ে গেল । তবে লক্ষ্যচ্যুতি বশিরকে বাঁচাতে পারেনি । এটেম্পট টু মার্ডার । রাতেই পুলিশ এলো । বশিরের নতুন ঠিকানা হোল হাজতখানা , আলী আর রুমানার হাসপাতাল ।
তখনো বন্ধুর বিরুদ্ধে লড়ার কোন ইচ্ছা ছিল না আলীর । ওদিকে আইনকে সবল আর সচল রাখতে চাই টাকা । সরকার বাদী মামলায় সে রসদ যোগাবে কে ? বর্ষার সেই রাতে ঘরের কানাচ থেকে আমাকে কেউ খুঁজে নিল না । অথচ আলামত হিসেবে আমি ছিলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ । দুইজন পুলিশ আসক্তিহীন দুরত্ব থেকে এদিক সেদিক আলো ফেলে আমাকে দেখতে পেল না ।
( ২ )
হাসপাতালে কি ঘটেছিল , সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা ছিল আমার ক্ষমতার অতীত । তবে ধারণা করতে পারি , নতুন সমীকরণে দুটি দূরবর্তী নক্ষত্রের মাঝে তৈরি হয়েছিল প্রচণ্ড আকর্ষণ । আপন অক্ষ ছিঁড়ে ফুঁড়ে তারা চলে এসেছিল নতুন সৌর সমাজে । ফাতেমা সেখানে থেকেও নেই , আরও উপেক্ষিত ছিল দম্পতিটির একমাত্র সন্তান , নীরব । দুটো পরিবারই ভারসাম্য হারিয়ে টলটলায়মান ।
সুস্থ হয়ে রুমানা বাড়ী ফিরে এল । আমাকে তুলে লুকিয়ে ফেললো শয্যার নীচে । দুই ফ্ল্যাটে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে । পত্নীর সাথে উপপত্নীর সংঘর্ষ । সর্ব শক্তিতে একজন পুরুষকে কাছে টেনে নিতে চাচ্ছে দুই মেরু থেকে দুই নারী । একবার একজন জয়ী হোলে পরেরবার সে মালা ছিনিয়ে নেয় অন্যজন । দ্বন্দ্বের পারদ ক্রমশই উপরে উঠছে । এক দুপুরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সাথে শুরু হোল বাসন-কসন , চামচ-খুন্তি ছোঁড়াছুঁড়ি । কোন এক ফাঁকে রুমানা আমাকে গেঁথে দিল ফাতেমার বুকে । স্বস্তি এটুকুই , আবারো লক্ষ্যচ্যুত হয়েছি । এবার হাসপাতালে গেল ফাতেমা । তবে রুমানাকে হাজতে যেতে হোল না । আইন তাকে শক্ত রশিতে বেঁধে ফেলতেই অর্থ এসে রশিটিকে কেটে দিল । খোদ স্বামী সাক্ষী দিল , ফাতেমার পাগলামির ধাত আছে । আত্মহত্যার চেষ্টা প্রমাণ করতে ডাক্তারের সার্টিফিকেটও পাওয়া গেল ।
হাসপাতালে তার কেমন সময় কেটেছে জানা গেল না । তবে প্রতি মুহূর্ত সে নিশ্চয় প্রতিশোধের স্বপ্ন দেখেছে । কোন রকমে সুস্থ হয়ে সে ফিরে গেল বাপের বাড়ী । এখন আমার এ ঘরেই থাকে আমার মালিকের স্ত্রী আর তার শত্রু । নিশীথ রাত্রে তাদের উল্লাস দেখে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে , হে পরমেশ্বর , আমার এ ইহজীবনের আর প্রয়োজন কিসে !
( ৩ )
আকাশে খুব মেঘ করেছে । দুপুর শেষ না হতেই যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে । ঘন ঘন দেয়া ডাকছে । একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি নামবে । রুমানার কাঁধে নেমে এসেছে আলীর দুহাত । মানব-মানবীর প্রেমে আমিও বুঝি আজ অভিমান ভুলতে বসেছি ! বিধাতা যে পাপ ভূলে গেছেন , আমি তা ধরে রাখছি কেন !
চারিধার আঁধার করে বৃষ্টি নামলো । নিসর্গের সে কল্লোলে মিলিয়ে যাচ্ছে মানবীর শীৎকার । এমন সময় দরোজায় কড়া নড়ল । সাহসী যুগল ক্ষণিক থমকে আবারো নেমে গেল প্রেম সরোবরে । নাহ , বিভ্রম নয় । সত্যি কড়া নাড়ছে কেউ । অগত্যা আলীকে উঠতেই হোল । আর আলিঙ্গন মুক্ত হতেই একটা তীব্র ভয় রুমানাকে গ্রাস করেছে । দরোজা খুলেই প্রেমিক পুরুষ গর্জে উঠলো , তুমি ! রুমানা আড়াল থেকেই চিনে নিয়েছে শত্রুকে । মুহূর্তের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশে আমাকে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে আগন্তুকের বুকে ।
মৃত্যু শ্বাস উঠে গেছে বশিরের । রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে । সবটুকু শক্তি একত্রিত করে এটুকুই শুধু বলতে পারলো সে , ‘ছাড়া পেয়ে মক্কা চলে যাচ্ছিলাম । যাবার আগে ভাবলাম শত্রুতা মিটিয়ে সব কিছু তোমাকে উইল করে দিয়ে যাই’ । রক্তে ভেজা উইলটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বশিরের চোখদুটো শূন্যে স্থির হয়ে গেল । এই প্রথম , আমি লক্ষ্যভেদ করেছি ।
২২ জুলাই - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী