সার্জেন্টের শেষ যুদ্ধ

দিগন্ত (মার্চ ২০১৫)

শামীম খান
  • ১৩
  • ২৩
( ১ )
হালকা হালকা বৃষ্টি ঝরছে । তাতেই ভিজে উঠেছে তমিজ । এক ঘণ্টার বাস জার্নি শেষে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । পথচারী নেই বললে চলে । খেয়া ঘাটের দোকানটা বৃষ্টির কারনে সন্ধ্যার আগেভাগেই ঝাঁপি ফেলে দিয়েছে । কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে সামনে ঝুঁকে বসে আছে তমিজ দোকানের বেঞ্চে ।বুকের নীচে বৃষ্টি থেকে আগলে রাখছে লাল , নরম আরেকটি ব্যাগ । লাইবেরিয়া থেকে ফেরার পথে দুবাই এয়ার পোর্টে তিন ঘণ্টা যাত্রা বিরতি ছিল । সেখানে ডিউটি-ফ্রি শপ থেকে কিনেছিল সে ।মাথার চাঁদি থেকে উষ্ণ পানির একটি স্রোত কানের গোঁড়া ছুঁয়ে সুড়সুড়ি কেটে নেমে যাচ্ছে । অন্য সময় হলে আরামটা উপভোগ করতো সে । সার্জেন্টের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে । ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাড়ীতে যেতে তিন ঘণ্টার বেশী লাগে না । খেয়ার দেখা নেই । সব খেয়া ঘাটেই বড় বড় গাছ থাকে । অন্তত রোদ-বৃষ্টিতে ঠাই নেয়ার কাজ চলে । কানাইবাড়ীর এই ঘাটটা ন্যাড়া ।
বাঁ দিকের বাঁকের আড়াল থেকে দেখা গেল নৌকাটি । শুন্য থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো যেন । তিন জন যাত্রীর নামা শেষে ছোকরা মাঝি নিজেই নেমে গেল । ঠিক সাথে সাথেই খপ করে তার হাতটা ধরে ফেললো তমিজ , ‘ডিপার্টমেন্টের লোক । এখনি ওপারে পৌঁছে দিতে হবে’। পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করলো সে । মাঝি বিনা বাক্যে নৌকা ঘোরাল , সেটা কি টাকার মন্ত্রে নাকি আর্মির ভয়ে , বোঝা গেল না । ততক্ষনে বৃষ্টির ফোঁটা আরও ভারী হয়েছে । শরীরের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে ধারাগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মত বিঁধছে । মাঝ নদীতে যেতে না যেতেই হাওয়া প্রবল হয়ে ঘূর্ণির আকার নিল । একটু আগে যে ঢেউগুলো এক চাষে ফেলে রাখা জমির ছোট বড় ঢিলার মত ছিল , হঠাৎ কোন জাদুবলে সেগুলো বিশাল ফনা তোলা সাপের মত হয়ে তেড়েফুঁড়ে আছড়ে পড়ছে নৌকার গায়ে । মাঝির দিকে তাকিয়ে নিজে কতটা ভিজেছে বুঝতে পারে সার্জেন্ট । তবু বুক দিয়ে ঢেকে রাখে সে ছোট ব্যাগটি । সহসা মড়াৎ শব্দে ঘাড় ফেরালো তমিজ । হালের ভাঙ্গা হাতলতুকু হাতে নিয়ে মাঝি তার দিকে বোকার মত তাকিয়ে আছে । নৌকায় দ্বিতীয় কোন বৈঠা নেই । মাঝির মাকে নিয়ে একটি জঘন্য গালি জিহবা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে দাঁতে আটকে ফেললো তমিজ । শান্তিরক্ষী মিশনে এক পেট্রোল ডিউটিতে এনিমি ফায়ারে পড়েছিল সে । সেদিন তার এস এম জি থেকে একটি কার্টিজও ফায়ার হয় নি । অলৌকিকভাবে পুরো পেট্রোল পার্টি রক্ষা পেয়ে যায় । ভুল কার্টিজ ভরার দায়ে কেউ তাকে কোয়ার্টার গার্ডে পাঠায় নি , এক্সপ্লানেশন ও চায় নি ।
সে যখন বাড়ী পৌঁছুল ততক্ষনে রাত ন’টা বেজে গেছে । বারো মাসি রাখাল নেজাম গোয়াল থেকে বেরুচ্ছিল । তমিজকে দেখে উচ্ছ্বসিত হোল সে ।
-ইরু এখনো জেগে বসে আছে । তার ধারনা ছিল আপনি সন্ধ্যার আগে আসবেন ।
বাড়ীতে লোকজন নেই । ভাইদুটো বৌ নিয়ে এতো দিন একসাথে ছিল । বাবার অনুরোধে মিশনের টাকা থেকে প্রত্যেককে পাঁচ লাখ করে দিয়েছিল তমিজ । এখন তারা টোনা-টুনি , অন্য ডালে ঘর বেঁধেছে । বুড়ো বাবাকে দেখে রাখার কেউ নেই । আলেয়া বাড়ীতে একমাত্র মহিলা । এতো রাতে নেজামের ঘোরাফেরা ভাল ঠেকে না তমিজের ।
-তুই শুতে যাস নি !
-কালা গাইটা গাভিন । ওটারে এক বালতি কুড়োর জাউ দিলাম ।
একটু থেমে নেজাম আবার প্রশ্ন করে ,
-আমার জন্যি ঈদে কি আনলেন , ভাইজান ?
-সকালে দেখবি , এখন ঘুমাতে যা ।
একবার এক ছুটিতে না বলে বাড়ী এসেছিল তমিজ ।সবার সাথে দেখা হলেও সেদিন ইরু ছিল পাশের বাড়ীতে , খেলায় মত্ত । সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আঁতিপাঁতি করে কিছু খুঁজতে থাকে মেয়েটি । শেষে এক পর্যায়ে বলেই ফেলে , ‘মা , বাড়ীতে বাবা বাবা গন্ধ পাচ্ছি কেন’ ! হঠাৎ দরোজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল তমিজ । মেয়েটির মুখখানি বড়ই মায়া কাড়া ।
এই ঈদে অনেক অনুনয় বিনয় করেও ছুটি পায় নি সে । অথচ সুবেদার মেজর এক সপ্তাহ আগে তাকে পাকা কথা দিয়েছিল । সে অনুযায়ী বাড়ীতে সবাইকে বলে রেখেছে তমিজ । শেষ অবধি তাকে দুই দিনের উইক পাস নিয়ে আসতে হলো ।ভাগ্য ভালো , ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজর আব্দুল গফুর তার কোর্স মেট । বি এস এম নিজ থেকে রবিবার অর্থাৎ ঈদের দিনের দায়িত্ব নিয়েছে । বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা থেকে সোমবার সকাল সাতটা । তিন দিনে ঈদ সেরে তাকে ব্যাটালিয়নে হাজির থাকতে হবে ।
( ২ )
দরোজার একটি পাল্লা খুলে দাঁড়িয়ে আছে ইরু । হাতে হ্যারিকেন আর তোয়ালে । জ্যোৎস্নার কোন সুবাস থাকে না । কিন্তু বাবা এলে হঠাৎ বাড়ীটা সুবাসিত চাঁদের আলোয় ভরে ওঠে । তার ইচ্ছে করছে লাফিয়ে বাবার কোলে উঠতে । কারো কোলে ওঠায় মায়ের বারন । সে নাকি বড় হয়ে যাচ্ছে । বাবা নিশ্চয়বারনের বেড়াজালের বাইরে ।ছোট থেকে যাবার কোন ওষুধ হয় না কেন ? সারা জীবন বাবার ছোট্ট খুকী থেকে যেতে চায়সে । সার্জেন্ট হাঁটু গেঁড়ে বসে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেছে । মাখনের মত নরম শিশুটি বাবার শক্ত বুকে মিশে আছে ।হঠাৎ খেয়াল হোল তার , হাউইতজারের গোলা ষ্টীলের পাত ভেদ করতে পারে ঠিকই , বাবার বুক ভেদ করতে পারে না । আর্মস ম্যানুয়ালে কথাটি ভুলক্রমে উহ্য রয়ে গেছে ।
‘দেখতো মা , ব্যাগটি কেমন !’ শিমূলের চেয়ে লাল স্কুল ব্যাগটিওর হাতে দিয়ে বাবা তাকিয়ে আছে । ইরুর চোখে পানি এসে গেল । এই রকম একটা ব্যাগের শখ তার অনেকদিন । বাবা ঠিকই মনে রেখেছে । মিশন-কন্টিনজেন্ট দেশে ফেরার বেশ ক’দিন পরে তাদের লাগেজ এসে ঢাকা পৌঁছায় । গত ছুটিতে তাই ব্যাগ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে আসতে হয়েছিল বাবাকে । পিতার স্নেহাদ্র হাতটা অনেকক্ষণ তার ছোট্ট মুঠিতে ধরে রাখে ইরানী।
( ৩ )
আলেয়া ভেবে পায় না , এত ভোরে বাবা আর মেয়ে বিছানা ছেড়ে কোথায় গেল । এই মাত্র ফিরেছে তারা । দুজনের হাত ভর্তি কদম ফুল । তমিজকে এখন বেশ লাগে আলেয়ার । বিয়ের পরে একসময় লোকটির সব রোমান্টিকতাকে ছেলে ভুলানো কৌশল ভাবতো সে । ছুটিতে এলে শহর থেকে বেলী ফুলের মালা , বকুল ফুলের বালা কত কি না আনত তমিজ । হাসিমুখে পরে নিত আলেয়া ঠিকই,ভেতরে ভেতরে একজন শুধু মুখ ভার করে নিরানন্দ বসে থাকতো । দেবর রমিজ কিভাবে যেন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল । দু বছর আগে একগাছি সোনার চেন সাথে ‘আর’ লেখা একটি লকেট নিয়ে রাত দুপুরে দরোজায় হাত রেখেছিল সে । খোলা দুয়ার দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রমিজ হয়ে ওঠেহালাকু খান।তাতার দস্যুর বেশেবারবার লুটতে থাকেবাগদাদের সম্ভ্রম । শেষ বার টের পেয়ে জান শ্বশুর সাহেব । অন্যের মেয়েকে বলেননি কিছুই । শুধু নিজের ছেলেকে তিন দিনে বিয়ে দিয়ে বৌ তুলে এনেছেন । ছয় মাস আগে তমিজ সাত ভরি গহনার বিশাল সেট কিনে দিয়েছে তাকে । না দিলেও একই ভাবে সারা জীবন সাড়া দিয়ে যেত আলেয়া । দশ বছরের বিয়ে করা বউয়ের মন পেতে সাত ভরি গহনার দরকার পড়েনা । আজ বরষার কদম তোড়ায় বন্দনার সুঘ্রান । গোপন ঘরে রোরুদ্যমান বিক্ষুব্ধ রমণীটি সে কদমে হাত রেখে হেসে ওঠে । শক্ত পোক্ত মানুষটি আসলে ততখানি বোকা যতটা না হলে প্রেমিক হওয়া যায় না ।
কাল ঈদ । প্রতিবেশী বেলায়েতদের বাড়ীতে নতুন ঘর উঠছে । আজ ও কাজ থামেনি । গেরস্থ বাড়ীতে ঘর তোলা উৎসবের ব্যাপার । বাড়ীর উঠোনে ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে গোল্লাছুট খেলছে । এক সময় বেলায়েতের বাবা এ বাড়ী সে বাড়ী কামলা দিত । এখন তার তিন ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে । সম্পদ আর প্রভাব দুটোই বেড়েছে ব্যাপক । তমিজের বাবার ঘরটা পুরনো হয়েছে । এক পাশে কাঁত হয়ে খামগুলো জানান দিচ্ছে এ ভার তারা আর বেশী দিন বইতে পারবে না । ভাইদুটো ব্যবসায় নেমেছে শহরে । অল্পদিনেই তারা ব্যবসা বুঝতে পেরেছে , আশার বিষয় । কিন্তু বাড়ীতে টাকা খরচ করবে প্রত্যাশা করা যায়না । বেশ কয়েক লাখ টাকা পেয়েছিল তমিজ । বাবার হজ , ভাইদের ব্যবসা , স্ত্রীর গহনা আর বিঘা দুয়েক জমি কিনতেই সব শেষ । সংসারের সবখান এখনো দারিদ্র ছড়ানো । ছোট্ট একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় সে ।
মেয়েকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামটা দেখতে বেরিয়ে পড়লো তমিজ । অজগাঁয়ের রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে , পাকা হয়েছে । বিদ্যুৎ আসেনি এখনো , তবে খুব বাকী নেই । ছুটির দিনেও স্কুলের চারিপাশে অনেক লোকের আনাগোনা । একটা দোকান থাকলে ব্যবসা জমতো বেশ , চায়ের ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো হতো , ভাবতে থাকে তমিজ । মানুষের হাতে পয়সা এসেছে , কিন্তু কাজে লাগাচ্ছে ক’জন ? সবাই আছে জমিজমা বাড়ানোর চেষ্টায় । কোর্ট-কাছারী , স্কুল-কলেজ আর মোকামের কাজে রোজ আড়াই কিলোমিটারপায়ে হেঁটে এই গ্রাম থেকে গঞ্জে যায় অন্তত একশো মানুষ । দশটা ভ্যান রিক্সা নামাতে লাখের বেশী খরচ হবে না । দশ জন দরিদ্র যুবকের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা পাকা হয় । সাথে সাথে এতগুলো মানুষের যাওয়া আসারও একটা ব্যবস্থা করা যায় । হাঁটতে হাঁটতে ওরা গ্রামের প্রান্ত ঘুরে বাড়ীর পেছনে ফিরে আসে । তমিজদের একটি পুকুর আছে এখানে । সংস্কারের অভাবে মর্যাদা হারিয়ে ডোবায় পরিনত হয়েছে । কখনো সুযোগ হলে পুকুরটি গভীর করে , পাড় বাঁধিয়ে মাছ চাষ করবে , মনে মনে ভাবতে থাকে তমিজ । পুকুরে মাছ , পাড়ে হাঁসমুরগির ফার্ম । সাথে দুটো অস্ট্রেলিয়ান গাভীর লালন পালন করতে পারলে একটি পরিবার হেসে খেলে চালিয়েও কিছু জমানো যায় ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে । বাবার সাথে ‘মাছ ধরা’ খেলবেইরু । একজনকে জেলে হতে হবে । লম্বা ওড়নাটা উঠোনে ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় বসে থাকবে জেলে , যেন নদীতে বড়শী ছেড়ে অপেক্ষা করছে । দাওয়ায় বসে বাবা-মেয়ের আনন্দ দেখতে দেখতে সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আলেয়া । ইরু এখন একটা বোয়াল মাছ হয়েছে । খুব কসরত করেও জেলে মাছটিকে ডাঙ্গায় ধরে রাখতে পারছে না , বারবার জলে লাফিয়ে পড়ছে । জীবনটা যেন হাজারো ফাঁদের মঞ্চ । কুশীলবেরা জেনে না জেনে ক্ষনে ক্ষনে ধরা পড়ছে একেক রঙেরফাঁদে । সব ফাঁদই প্রাণঘাতী নয় । কিছু কিছু ফাঁদ বড়ই মধুর । খেলার এ পর্যায়ে খাবারের গন্ধ পেয়ে দূর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসছে সার্জেন্ট বড়শীর ফাঁদে । কাঁত হয়ে পড়া ঘরটির জানালা দিয়ে দৃশ্যটি দেখতে দেখতে বাড়ীর বৃদ্ধের চোখে আনন্দাশ্রু নেমে আসে । তার সৈনিকসন্তানটি যুদ্ধের চেয়ে ভালোবাসতে শিখেছেঅনেক বেশী ।
শেষ রাতে রওনা হতে হবে । সাইড ব্যাগটা এরই মধ্যে নারিকেলের চিড়া , খেজুরের পাটালী , শুকনো পিঠে দিয়ে ভোরে ফেলেছে আলেয়া । দুচারটে জামা কাপড় ব্যাগে ভরে সন্ধ্যায়শুয়ে পড়লো তমিজ । রাত এগারোটায় মোবাইলে ফোন এলো । চেনা মানুষের অচেনা কণ্ঠে নিদ্রা কেটে গেল । সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো একটা লম্বা কাপড়ের এক প্রান্ত ওর বাঁ হাতে অন্য প্রান্ত ইরুর পায়ে বাঁধা । সন্ধ্যায় ওকে তৈরি হতে দেখেই বুঝে নিয়েছে মেয়েটি । ডাক পড়েছে , ফিরতে হবে তাকে । চাঁদের নরম আলোয় রূপালী চারিধার । তবু এক অনিশ্চিত অন্ধকার রাস্তাটাকে অচেনা করে দিয়েছে ।
( ৪ )
ভোর পাঁচটায় এডজুট্যান্টকে ব্যাটালিয়নের মুল ফটকের সেন্ট্রি পোস্ট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে অবাক হোল তমিজ । সুবেদার মেজর , বি এস এম সবাই এই সাত সকালে তার সাথে । তড়িঘড়ি ইউনিফর্ম পরিয়ে তাকে টু আই সি’র অফিসে আনার কাজটি করলো তারই কোর্স মেট ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজর আব্দুল গফুর । প্রতিটি কাজেই আজ গভীর উৎসাহ তার। এবার টু আই সি তাকে সি ও’র নির্দেশ পড়ে শোনাতেই প্রচণ্ড আক্রোশে গফুর তার বেল্ট আর টুপিটা ছিনিয়ে নিল । তমিজের দুচোখ ফেটে পানি আসতে শুরু করেছে । ইরুর মুখটা খুব মনে পড়ছে তার ।রাত এগারোটায় গফুর তাকে মোবাইলে জানিয়েছিল , ‘সি ও সাহেব নিজে ব্যারাক লাইনে এসে সন্ধ্যায় প্যারেড স্টেট নিয়েছেন । তোমাকে না পেয়ে এ ডবলু ও এল ডিক্লেয়ার করা হয়েছে । সকাল ছয়টার মধ্যে ব্যাটালিয়নে রিপোর্ট না করলে সাতটায় বাড়ীতে সিভিল পুলিশ আসবে’ । এতোগুলো কথা বললো বি এস এম , একবারও বললো না এসবের পেছনে তার নিজের ভুমিকা কি ছিল । পৈশাচিক উল্লাস যেন ঝরে পড়ছিল তার প্রতিটি কথায় ।আঠারো বছর আগে রিক্রুট ট্রেনিঙের সময় ই বি আর সি’তে ঘটে যাওয়া একটা তিক্ততার জের এতদূর চলে আসতে পারে জানা ছিল না তমিজের ।
সন্ধ্যায় কমান্ডিং অফিসারের সামনে আনা হোল সার্জেন্টকে । কোয়ার্টার গার্ড থেকে কনফারেন্স রুমে নেবার পথে সুবেদার মেজর প্রস্তাবটি দিলেন । সাথে এটাও জানিয়ে দিলেন , সে প্রস্তাবটি মেনে নিলে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর রাসেল তার হয়ে সি ওকে সুপারিশ করবেন । দুরন্ত পাঁকে পড়ে নিজেকে বাঁচাবার একটা পথ খুঁজছে তমিজ। এক বছর বাদেই পুরো ব্যাটালিয়ন মিশনে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে । এবার যেতেপারলে তার সব স্বপ্ন-সাধই পূর্ণ হবে । সি ও’র সামনে দাঁড়াবারআগ মুহূর্তে সুবেদার মেজর আবার তমিজের কানের কাছে গুনগুন করলো আবার , ‘পায়ের উপর ঝাপিয়ে পড় , চোখের পানিতে ভিজিয়ে দে’ । তমিজের শরীরটা গুলিয়ে উঠলো ।
প্রকাণ্ড একটা টেবিলের ওপাশেবিচারকের আসনে বসে আছেন অধিনায়ক। তাঁর দুপাশে টু আই সি এবং অন্যান্য অফিসাররা । বিচার শুরুর আগে কমান্ডিং অফিসার টু আই সি’র সাথে নিচু কণ্ঠে কিছু জরুরী বিষয়ে আলাপ সেরে নিচ্ছেন । তমিজ দরদর করে ঘামছে । সবকিছু শুন্য শুন্য লাগছে ।বাবার ঘরটা হেলে পড়েছে । আলেয়ার বাবা-মায়ের হজে যাবার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেছে । ছোট্ট সংসারের অন্নের জোগান হয়না সামান্য ক্ষেতিবাড়ীতে । ইরুকে শিক্ষার আলো দেখাতে চায় সে । মেয়ের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য টাকা চাই , অনেক অনেক টাকা । ভাইগুলো স্বার্থের প্রয়োজনে তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে । এই দুঃসময়ে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনে একবার সি ও’র পায়ে ঝাপিয়ে পড়া খুব বড় বিষয় হবে কি , ভাবতে থাকে তমিজ ! অধিনায়কের চেয়ারের ঠিক পেছনে চোখ পড়ে সার্জেন্টের । কনফারেন্স রুমেদেয়াল ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটাটিদশটার উপর থেমে আছে এক সপ্তাহ ধরে । ঈদের পরে তার উপরই কারিগর ডেকে সারিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল এস এম । ঘড়ির ঝুলন্ত পেন্ডুলামটি এখনো নিয়ম মেনে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ডানে বামে দোল খাচ্ছে । মিনিটের কাঁটাটি ঘুরে চলেছে নির্দিষ্ট গতিতে । কিন্তু ঘণ্টার কাঁটাটিকে নাড়াতে পারছে না । ঠিক তারই মত । আট বছর বয়স থেকে তমিজ ঘুরে চলেছে , নিরন্তর ঘুরেই চলেছে । কিন্তু সংসারের চাকাটি ঘোরাতে পারেনি আজো। সেই বয়সে মাকে হারানোর পর থেকে নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি গৃহস্থলী সামলানো , ভাইদের তালিম , বাবার খেদমত সবই করেছে সে । কতটা এগুতে পেরেছে ? পেন্ডুলামের মত তার মনটিও এদিক ওদিক দোলা খেতে থাকে ।নিজেকে পদদলিত করে ক্ষমা ভিক্ষা নিয়েএক বছর পরে আবার মিশনে যাবে সে । টাকার সাথে ঘরে আসবে নতুন নতুন সাধ , নতুন কিছু অপূর্ণতা। আর দশ জনের মতই সাধ আর সাধ্যের চিরন্তন কুহেলিকায় আমৃত্যু ডুবে থাকবে সেও । সাধ যেন আকাশ , সাধ্য হোল পৃথিবীটা । দূর থেকেমনে হয় স্বপ্নময় আকাশটা দিগন্তেএসে পৃথিবীতে ধরা দিয়েছে । স্বপ্ন ছোঁয়ারপ্রমত্ত নেশায় সহস্রবার তমিজ ছুটেছে দিগন্তের দিকে । আশাহতের বেদনায় নিজেকে রক্তাক্ত করার চেয়ে বেশী কিছু হয়ে ওঠেনি কখনো । গতবার মিশনে থাকতে বাবার চিঠি পেয়েছিল , ‘খোকা , বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে যাচ্ছে , কিছু একটা কর’ । নিষ্ফল আক্রোশে সে গোপনে অশ্রু ঝরিয়েছে রাতের পর রাত । আরও রক্তক্ষরন নিশ্চিত জেনে সেই‘কিছু একটা করা’ হয়নি তার । বাবাকে না পেয়ে প্রানের চেয়ে প্রিয় মেয়েটির মানসিক বিকাশ হবে আস্বাভাবিক । ছয় বছরে কটা দিন সে দিতে পেরেছে মেয়েকে ? এভাবেই বড় হয়ে ইরু একদিন অন্যের ঘরে চলে যাবে । বাবার হাতে বর্ণমালা শেখা হবেনা তার । মেয়েকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো হয়ে উঠবে না বাবার ।তাকে নিয়ে গর্বের সীমা নেই ইরুর । অন্যের পায়ে ঝাপিয়ে পড়তে দেখলে ইরু কিভাবে মেনে নিতো , ভাবতে চেষ্টা করে সার্জেন্ট ! নিষ্পাপ মেয়েটির পিতাকে অপমানিত করার আয়োজন করেছে সে !নিজেকে ভীষণ নিষ্ঠুর লাগছে তার নিজের কাছেই । জানালা দিয়ে চোখে পড়ছে ব্যাটালিয়নের মাঠে উড্ডীন লাল-সবুজের একটি পতাকা । সৈনিক জীবনের প্রারম্ভে ঐ পতাকা ছুঁয়ে ওরা সততা , নিষ্ঠা আর সত্যবাদিতার শপথ নিয়েছিল একদিন ।
সি , ও সাহেবের ভরাট কণ্ঠে চিন্তায় ছেদ পড়লো । বয়ান দিতে বলছেন অধিনায়ক । সার্জেন্ট শান্ত স্বরে বলতে শুরু করলো , ‘আমি সৈনিক নম্বর ৯৯৯......১৩২৯ সার্জেন্ট তমিজুদ্দীন সজ্ঞানে ঘোষণা করছি যে , আমি আমার মেয়েকে তার সাথে ঈদ করার ওয়াদা করেছিলাম । মেয়েটি আমার প্রতীক্ষায় ঐ দিনটি সামনে নিয়ে পথ চেয়ে ছিল । এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে , সুবেদার মেজর আমাকে ছুটির ব্যাপারে নিশ্চিত করেছিলেন ঈদের এক সপ্তাহ আগেই । আমার ছুটি হয়নি । পরিশেষে আমাকে দুই দিনের সপ্তাহান্তিক ছুটি নিয়ে চলে যেতে হয় । সে হিসেবে ঈদের দিন আমার কাজে ফিরে আসার কথা । বি এস এম আব্দুল গফুর আমাকে ঈদের দিন ছুটি কাটাতে উৎসাহিত করে । যেভাবেই হোক আমি সামরিক নিয়ম ভঙ্গ করেছি । আমি অপরাধী ,তাই যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত ।
একবার কমান্ডিং অফিসারের দিকে তাকাল সার্জেন্ট । বেরেট ক্যাপের নীচে দুটো অগ্নি গোলোক জ্বলজ্বল করছে ।সব কিছু নির্বাক ছবির মত লাগছে । ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কি বলছেন কিছুই শুনতে পারছে না সার্জেন্ট । কোয়ার্টার গার্ডে নেয়ার নির্দেশে সম্বিৎ ফিরে এলো । এতক্ষনে দুপাশের জটলা থেকে এবার অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে ভেসে আসছে তার কর্ণবিবরে ।‘চাকুরীচ্যুতি’ , ‘কোয়ার্টার গার্ডে আঠাশ দিন’ , ‘যাক , পেনশনের পাঁচ লাখ টাকা নিতে পারবে , বেচারা’ আরও অনেক বাক্য আর বাক্যাংশ ঘূর্ণাবর্তে উড়তে থাকা ছেঁড়া কাগজের মত ভেসেভেসে আসছে তার দিকে। বাইরের আরেকটি জটলা থেকে এডজুটেন্টের উঁচু কণ্ঠটি শোনা গেল এবার , ‘সার্জেন্ট আব্দুল গফুর , অনৈতিক ভাবে সহকর্মীকে বিপথগামী করার দায়ে তোমাকে পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা ব্যাটালিয়নের জাহাঙ্গীর টিলা ক্যাম্পে জরুরী বদলী করা হলো । আগামী তেইশ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ আগামী কাল বিকাল পাঁচটার মধ্যে সেখানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তোমাকে রিপোর্ট করতে নির্দেশ দেয়া হোল’ । তাকাবার আগ্রহ অবশিষ্ট থাকলে তমিজ দেখতে পেত শোকে , বিস্ময়ে শোকে আব্দুল গফুরের চোয়াল ঝুলে পড়েছে আর চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ।
যুদ্ধ ছাড়াও বিজয় স্পর্শ করা যায় সে অভিজ্ঞতা ছিলনা সার্জেন্টের । মুক্ত হাওয়ায় এবার বুক ভরে শ্বাস নিল সে ।ব্যাটালিয়নের বিউগল বেজে উঠেছে । নিয়মমাফিক সন্ধ্যা ছয়টায় পতাকা নামানোর কুচকাওয়াজ শুরু হয়েছে । সন্তানের সামনে সম্মান নিয়ে দাঁড়াতে পারার বিজয়টি ততক্ষনেসার্জেন্টের বুকের ভেতর পতাকার মত উড়তে শুরু করেছে।


কিছু শব্দের প্রায়োগিক অর্থ –
এ ডবলু ও এল – যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জনবলের বাইরে থাকা ।
কোয়ার্টার গার্ড – সেনানিবাসের কারাগার ।
প্যারেড স্টেট – উপস্থিত জনবলের বিবরন ।
ই বি আর সি – সামরিক প্রতিষ্ঠান ।
উইকপাশ – সপ্তাহান্তিক ছুটি ।
বি এস এম – ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজর । সার্জেন্ট পদবীর এন সি ও’র গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট ।
এস এম – সুবেদার মেজর , গুরুত্বপূর্ণ জে সি ও পোস্ট ।
এডজুটেন্ট – শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেন যে অফিসার ।
টু আই সি – উপ-অধিনায়ক ।
সি ও – অধিনায়ক ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Arif Billah অনবদ্য রচনা। শামীম ভাই আপনার জন্য শুভকামনা ।ভোট থাকল।
অনেক ধন্যবাদ আরিফ ভাই । শুভ কামনা আর দোয়া রইল ।
সেলিনা ইসলাম সত্যের জয় সব সময় হয় ! সার্জেন্ট তমিজুদ্দীন-এর সৎ সাহসিকতার বিজয়ানন্দ দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে গেছে! অসাধারণ গল্পের পটভূমি! শুভকামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ অনুপ্রেরনাদায়ী মন্তব্যের জন্য । শুভ কামনা রইল ।
ruma hamid শামিম ভাই ,আপনার লেখার জন্য শুভকামনাতো রইলই । আপনার ছোট্ট পুচকি মেয়েটার নাকে টোকা দিয়ে গেলাম । সে দেখতে ঠিক আমার মেয়ের মতোয় । ভালো থাকুন ।
প্রিয় বোন রুমা , অনেক ধন্যবাদ । তোমার মন্তব্যে সব সময় সাহস পাই । কি নাম রেখেছো তোমার মেয়ের ? ওর জন্য অনেক দোয়া রইল । এ সংখ্যায় লেখা পেলাম না । আশা করি ' ভয় ' এ লেখা পাঠাবে । ভাল থেকো । শুভ কামনা নিরন্তর ।
ধন্যবাদ শামীম ভাই । আমার মেয়ের নাম তাসনিম ইকবাল যারীন ।সময় পেলে অবশ্যয় আমার লেখা পাঠাবো । ভয় সংখ্যায় পাবেন আশা করছি । দোয়া করবেন, ভালো থাকুন ।
শেখ শরফুদ্দীন মীম ভালো লিখেছেন। ভোট রেখে গেলাম। সময় করে আমার কবিতাটি( আলোর সন্ধানে) পড়বেন।
আখতারুজ্জামান সোহাগ তমিজের দৃঢ়তা ভালো লেগেছে। আর সব মিলিয়ে দারুণ। আপনার লেখার হাত বরাবরই ভালো। শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ সোহাগ ভাই । এই গল্পটির মান নিয়ে আমি নিজে সন্দিহান । আপনার মহানুভবতায় মুগ্ধ হলাম । কৃতজ্ঞতা আর শুভেচ্ছা রইল । দোয়া করবেন ।
সৃজন শারফিনুল অসাধারণ গল্প,,.. ভালোলাগা আর ভোট রইলো সর্বোচ্চ।
টোকাই ভালো লাগলো । ভোট রইলো সাথে ।
Fahmida Bari Bipu অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য। ভীষণ ভাল লাগলো গল্পটা। ভোট রইল সর্বোচ্চ। এ ব্যাপারে কার্পণ্য নেই কোন। সেরা ২৫এ অবশ্যই থাকছে গল্পটি।
দীপঙ্কর বেরা বাহ , খুব সুন্দর । ভোট । আপনার মতামত ও ভোটে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি । ভাল থাকবেন ।

২২ জুলাই - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী