বুক পকেটে হাত পড়তেই আবারো সেই উত্তেজনাটি অনুভব করলো এহসান । এবার যেন কানের ভেতরে এসে ফিসফিস করল সে , ‘আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি ।’ মেয়েটির কণ্ঠে কি নেশা আছে ! ডাক শুনলেই দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে কেন এহসান ? শুন্য কামরায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কান চুলকালো সে । ছয়টি লাশই গোসল সারিয়ে কাফন পরানো শেষ । দ্রুত হাতে ঘরটা পরিপাটি করে ফিরতি পথে পা বাড়ালো সে । ডানে বামে টানা দুশো এগারো সারি কবর কাফন-ঘর আর তার বাসস্থানের মাঝে । চারিপাশে শুধু শুন্যতা । রাত-বিরাতে একা চলতে ভয় লাগে না এহসানের । তবে দিনে জায়গাটাকে অচিনপুর অচিনপুর লাগে । হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় যেন একটা ঘোরের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছে । পড়াশোনার সবটাই তার মাদ্রাসায় । কামেল শেষে একটি নতুন মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজ করতো । সেই সুবাদে এবাড়ী ওবাড়ী মিলাদ পড়ানো কম হতো না । কবর জিয়ারত রুটিনের ভেতরেই ছিল । দেশে এই সব জায়গায় প্রচুর গাছ-গাছালী থাকে । ডালে ডালে ফুল , আর পাখিদের কলকাকলিতে অচিনপুর অচিনপুর ভাবটা ঢাকা পড়ে যায় সেখানে । অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে । মনে হয় কাছের মানুষটি দিব্যিতো ফুলের বনে ঘুমিয়ে আছে । এখানে কবরস্থানে কোন গাছ-পালা থাকে না । ফুল নেই , পাখি নেই , বড়ই শুন্য চারিদিক । সারাদিন গড়ে দুঘণ্টার বেশী জনপ্রাণীর পদচারনা হয়না এ চত্বরে । তাছাড়া এই অন্তিম নিবাসটি গড়ে উঠেছেও শহরের দূর প্রান্তে । তিন পাশে মরু । তার মাঝে পনেরো ফুট উঁচু দেয়াল তোলা সুবিশাল চত্বর । দৈর্ঘে বা প্রস্থে এক কিলোমিটারের কম নয় । লাশবাহী গাড়ী আর কবর-খোদক ক্রেনের চলাচলের জন্য ভেতরেও আছে পাকা রাস্তা , শাখা রাস্তা , তস্য শাখা ...............। ফি বছর পেছনের দেয়ালটি ভেঙে মরুভূমির কিছু অংশ কবরখানায় টেনে নেয়া হয় । সেই কটি দিন কর্মচাঞ্চল্যে ভরে ওঠে জায়গাটি । এহসানের তখন খুব ইচ্ছা করে ভাগ্যবান ঐ মানুষগুলোর কাছে যায় , সুখ দুঃখের কথা বলে । হয়ে ওঠে না । তাকে আসতে দেখলে মেরামতকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ নাকে রুমাল চেপে দূরে চলে যায় , যেন মড়ার গন্ধ মেখে আছে তার গায়ে , অথবা যেন সে নিজেই একটি জীবন্ত মড়া ।
কত কবর আছে এখানে ? হাঁটতে হাঁটতে ভাবে এহসান । দশ হাজার ? নাকি আরও বেশি ? কে জানে ! একদিন জিগ্যেস করতে হবে আবু রাইদকে , ভাবে সে । আবু রাইদ কবরখানার ম্যানেজার । আরব হলেও লোকটা একটু ভিন্ন । আর দশ জনের সাথে তাকে তুলনা করলে অবিচার করা হবে । চার বছর আগে আক্ষরিক অর্থে রাস্তা থেকে ধরে এনে তাকে কাজে লাগিয়েছিল আবু রাইদ । তখন অবশ্য তার নিজেরই বড় দুর্দিন । ভালো বেতন দিয়েও কবরখানায় কোন লোককে স্থায়ী করতে পারছিল না । যাকে ডেকে আনে , দুই দিন থেকে পালিয়ে যায় । এরমধ্যে একবার এক আফগানী এসে মহাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসলো । কাজ শুরু করে তিন দিনের মাথায় আবোল তাবোল বলতে শুরু করে লোকটা । ভাব গতি ভালো ঠেকলো না , দেরী না করে ডাক্তার দেখালো আবু রাইদ। কিন্তু পেটে ওষুধ পড়ার আগেই আফগানী আক্রমণ করে বসলো তাকে । রক্তারক্তি ব্যাপার । কবরস্থানে কখনো পুলিশ আসে না । সেই প্রথম এসেছিল । হাতকড়া পরিয়ে আফগানীকে নিয়ে যাবার আগে তল্লাশি চলল পুরো কবরস্থান জুড়ে । তারাই খুঁজে বের করেছিল , দুটি কবরের পাশে কে যেন সুড়ঙ্গ কেটে রেখেছে । কবর দুটি ছিল দুজন অল্প বয়সী মেয়ের । বেলচার দাগ দেখে বোঝা যায় সদ্য খোঁড়া হয়েছে । কিন্তু আফগান যুবক জিজ্ঞাসাবাদের হালতে ছিল না । ঘটনাটা কবরস্থানেই মাটি চাপা দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন বুদ্ধিমান পুলিশ কর্তা । আবু রাইদ কথা রেখেছে । শুধু প্রথম দিন গল্পচ্ছলে তাকে শুনিয়ে রেখেছিল মাত্র । কেন শুনিয়েছিল বুঝতে পারেনি সেদিন । বুঝেছিল এক মাস পরে , যখন মড়া ঘাঁটাঘাঁটি করে বিরক্ত হয়ে বিষাদ বদনে সে আবু রাইদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল । আবু রাইদ তাকে একবারও থেকে যেতে বলেনি । শুধু বলেছিল , তোমার আকামা ( রেসিডেন্স কার্ড ) তো আমাকে পুলিশের হাতে জমা রাখতে হয়েছে । কোথায় যেতে হবে ভেবে দেখেছো ?’ এদেশে আকামা , পাসপোর্ট সবই কফিলের কাছে জমা রাখতে হয় । প্রথম কফিলের কাছে সে ছিল তিন বছর । সে সময়কালে একবারই নিজের আকামাটা হাতে পেয়েছিল সে , হাসপাতালে ভর্তির উছিলায় । সেদিনই পালিয়েছিল এহসান ।
কবরখানায় চার বছর গড়িয়ে গেছে , দ্বিতীয়বার কাজটি ছাড়ার কথা মুখে আনেনি এহসান । প্রথম তিন বছর যেখানে ছিল , সে স্থানের কথা মনে হোলে এখনো তার শরীর শিউরে ওঠে । একপাল উটের সাথে তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল গভীর মরুভূমিতে । দিনের পর দিন মানুষের মুখ দেখতে পেতো না । কফিলের কাছে বেতন জমা হতে থাকে । পালিয়ে যেতে পারে , ছুঁতো দেখিয়ে বকেয়া শোধ করতো না লোকটা । কালে ভদ্রে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে আনা হত । ঐ মুহূর্তটুকুই একটু প্রান ভরে শ্বাস নিতো এহসান । হাসপাতাল শেষে মরুভুমিতে ফেরার পথে হাতে পায়ে ধরে ফোন করতে হতো । দুপাশে রোদনরত স্বামী-স্ত্রী , এপাশে স্বামীর পেছনে দণ্ডায়মান নরপিশাচটি । দু মিনিট যেতে না যেতেই ঘোঁত ঘোঁত করে উঠত লোকটি , ‘ইয়াল্লাহ মোহাম্মাদ , লেশ ইফকি ? হোরমা আন্ত ???’( এই হতচ্ছাড়া , কাঁদছিস কেন মেয়েমানুষের মত ?) । কথা শেষ না করেই গাড়ীতে উঠতে হতো । শুরু হতো পুনরায় অনির্দিষ্ট কালের মরুবাস । দুই সপ্তাহ পরপর এক ব্যাগ রুটি , এক ড্রাম পানি , কিছু কাঁচা পেঁয়াজ আর দেশের চিঠি নিয়ে উটগুলোকে দেখতে আসতো কফিল কিংবা তার ছেলেরা । মানুষের সাথে কথা বলতে ব্যাকুল হয়ে উঠত মরুচারী । হায় , এদের কাছে কুশল বিনিময়ও খুব খরুচে ব্যাপার । পুরনো চিঠিগুলো বারবার পড়তো আর নিজের দুর্দশা লিখে পাঠাতো এহসান । প্রথম প্রথম সহানুভূতি জানালেও পরে আর কেউই তাকে বুঝতে চাইত না । কেন যেন তসলিমা এক পর্যায়ে ভাবতে শুরু করলো স্বামী তাকে ইচ্ছে করেই টাকা পাঠাচ্ছে না । পাশের বাড়ীর রহমতুল্লাহ একই সময়ে মালয়েশিয়া গিয়েছিল । দুই বছরের মাথায় টিনের ঘর ভেঙে বাড়ীতে নতুন দালান তুলেছে । কত জনের স্বামী সিঙ্গাপুর গেল , ইতালী , জাপান গেল । কই , আর কাউকেই তো এমন কষ্টের চিঠি পেতে হয় না । টাকা চেয়ে চেয়ে পাগল প্রায় ভাদ্রবধূটি এক সময় চিঠি লিখা ছেড়ে দিল । তিন মাস পর একটি চিঠি পেয়েছিল এহসান , শ্বশুরের । মেয়ের তালাক নিয়ে ভাবছেন । মাথাটা ঘুরে উঠেছিল । তার দুই দুটি সন্তানের মা তাকে ফেলে চলে যেতে চায় ! মরুভূমিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল সে । দুরের এক রাখালের চোখে পড়ে । হাসপাতালে নিয়েছিল কফিল । এহসানের তখন সুস্থতার চেয়ে পালানো ছিল অনেক জরুরী হয়ে পড়েছে । এদেশে আইন আজনবীর পক্ষে কোন কালেই ছিল না । তিন বছরের বকেয়া বেতন , অত্যাচার , অবিচার সব কিছু পরকালের আশায় তুলে রাখার পরও তার নতুন পরিচয় , সে একজন হুরুফের ( পলাতক ) আসামী । আইন কখনো নাগালে পেলে জানতে চাইবে না , কেন সে পালিয়েছিল । নির্ধারিত শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে । পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের মত হুরুফের আসামীরও আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন অধিকার নেই ।
এই কবরখানায় লুকিয়ে আছে সে চারটি বছর । আইনগত ভাবে কাফালা বদল করা হয়নি , হয়তো কোনদিন হবেও না । তবু দ্বিতীয়বার কাজটি ছেড়ে যাবার চেষ্টা করে নি সে । মরুভূমিতে উটের সেবা যত্ন করে যা পেতো এখানে বেতন তার তিনগুন । আবু রাইদ কাল নয় পরশু বলে ঘোরায় না , মাসের ত্রিশ তারিখেই বেতনটা হাতে তুলে দেয় । আরও আছে , বখশিশ । মৃতের অর্থশালী আপনজনেরা প্রায়শই সেই লোকটাকে হাত খুলে খুশী করে যায় যে তার বাবার বা ভাইয়ের শেষ গোসলটা নিজ হাতে সেরেছে , শেষ পোশাকটা পরিয়ে দিয়েছে পরম মমতায় । তাদের সাথে দেখা হয় না এহসানের , নিয়ম নেই । যারা দেবার , আবু রাইদের কাছেই রেখে যায় । প্রথম মাস শেষে বেতন আর বখশিশ মিলে দশ হাজার রিয়াল হাতে এলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি এহসান । কবরখানায় মৃত মানুষের ভেদাভেদ নেই । সেখানে সাদা-কালো , ছোট-বড় , ধনী-গরীব সবাই সমান । মানুষগুলোকে গোসল করিয়ে সাদা পোশাক পরাতে পরাতে প্রতিবার এহসানের মনে হয় সে এক একটি চিঠি ভাঁজ করে খামে মুড়িয়ে দিচ্ছে । অচেনা অক্ষরের চিঠি , ঈশ্বরের ঠিকানায় । প্রতিদিন সকালে এ্যাম্বুলেন্সে করে লাশগুলো পৌঁছুলেই একটা কলিং বেল বেজে ওঠে তার ঘরে । ওজু , গোসল সেরে ছুটে আসে এহসান । পরম মমতায় চিঠিগুলো ভরতে থাকে খামে ।
এক রকম ভালই আছে এহসান । কবরস্থানের ভেতরেই দেড় রুমের ফ্রি কোয়ার্টার । পুলিশের ভয়ে বাইরে বেরুতে পারে না । তবে শত ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহে একটি দিন তার ফরমায়েশ অনুযায়ী সওদা পাতি এনে দেয় আবু রাইদ । কাঁচা বাজার জমানো থাকে ফ্রিজে । রান্না-বান্না শিখে নিয়েছে সেই কবে । হাতে অখণ্ড অবসর । চাইলে দেশে কথা বলতে পারে । একটা মোবাইল আছে , একটু পুরনো মডেলের । ইন্ডিয়ান আর পাকিস্থানীরা বলে ‘বন্ধু মোবাইল’ । মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় আর পাকিস্থানীদের মধ্যে খুব ভাব । উর্দু ভাষীরা পরস্পর ‘ভাই’ , বাঙ্গালীরা ওত কাছে নয় , তারা ‘বন্ধু’। মোবাইলের প্রথম জামানায় এই মডেলের মোবাইল প্রতিটি বাঙ্গালীর হাতে হাতে দেখা যেত । সেই থেকে খানিকটা শ্লেষ মেশানো তাদের দেয়া এই নাম ‘বন্ধু মোবাইল’ । এখন চিঠির যুগ শেষ হয়েছে । কতদিন চিঠি পায়না সে মনে করার চেষ্টা করলো সে । তসলিমার শেষ চিঠিটি পেয়েছিল এই কবরখানাতেই , দুই বছর আগে । ‘...............ইমন এখন স্কুলে যাচ্ছে । ক্লাস সেভেনে পড়ার চাপ অনেক । একজন লজিং মাস্টার খুঁজে পাওয়া গেছে । ছাতিমতলা হাইস্কুলের ভূগোল স্যার , রমিজ মিয়া । অঙ্ক , ইংরেজীতেও নাম করেছেন । বাসুদেব মাস্টার প্রশংসা করেছেন । উত্তর ডাঙ্গায় আমাদের ‘কোন্যার ভুই’য়ের পাশে খবিরের জমিটির কথা তোমার মনে আছে কিনা জানি না । খবিরের মায়ের অবস্থা জটিল , ঢাকায় নিতে হবে । জমিটা সস্তায় ছেড়ে দেবে বলছে । .................. ’ । ঈশিতার কথা কিছুই লিখে নি । সাড়ে চার বছরের মেয়ে , এখনো কথা বলতে পারেনা । সবাই বলে , বোবা । হয়তো তসলিমাও জানে , তাই মেয়েকে বাইরে পাঠায় না । বাপের বাড়ীও নিয়ে যায়না তাকে । এভাবেই যেন পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় সন্তানটিকে , এমনকি বাবার কাছ থেকেও । । এহসানের কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস , মেয়েটি তাকে দেখতে পেলে ঠিকই ‘বাবা’ বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়বে ।
( ২ )
ছোট্ট বাসাটিতে ঢোকার মুখে সে দেখল নিলুফা বারান্দায় বসে আছে । খোলা হাওয়ায় তার চুল উড়ছে । এমন দৃশ্য সে অনেকদিন দেখেনি । তবু একটু বিরক্ত হোল । একে তো পরনারীকে আবেগ নিয়ে দেখে ফেলার পাপ , তার উপর তৃতীয় পক্ষের ভয় । অন্য কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হতে কিছুই বাকী থাকবে না । “কবরখানায় পলাতক আসামীর ঘরে আরেক পলাতকা” আরবীতে এই ধরনের শিরোনাম , নীচে দুজন বাঙালী নর-নারীর ফটো ! খবরের কাগজে এমন একটা বক্স নিউজের ভয় প্রথম থেকেই তাকে তাড়া করে ফিরছে । মেয়েটি অল্প সময়েই এখানে সহজ হয়ে উঠেছে । এটাও ভালো কিছু নয় । বিরক্তি নিয়ে গলা খাঁকারি দিল এহসান । মেয়েটি চমকে উঠে লম্বা ঘোমটা টেনে ভেতরে ছুটে গেল ।
গত রাতের ডাল আর ভুনা গরুর মাংস ছিল ফ্রিজে । হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল এহসান । তারপর নিজের মত খাওয়া দাওয়া সেরে বালিশে মাথা এলিয়ে দিতে দিতে বুক পকেটে হাত রাখল সে । সাথে সাথেই পাশের কামরায় মেয়েটি গলা শোনা গেল । দরোজার নীচ দিয়ে মেয়েটির শাড়ীর প্রান্ত আর ফর্শা দুটো পা দেখা যাচ্ছে ।
-আপনি কি জেগে আছেন ? কণ্ঠের মধুরতায় আবারো মুগ্ধ হোল এহসান । গলায় কপট গাম্ভীর্য এনে জবাব দিল , তোমার নাম কি ?
-আগে তো বলেছি তিন বার ।
-আবারো বলো , ভুলে গেছি ।
-নিলুফা ।
-তুমি কি সত্যি মানুষ ? নাকি জীন-পরী ? ওপাশ থেকে কোন জবাব আসে না , নীরব সময় গড়াতে থাকে । আবার প্রশ্ন করে এহসান ।
-দেশে কোথায় বাড়ী তোমার ? আচ্ছা বল , এখানে কি ভাবে এলে ? কতদিন এসেছ ? মেয়েটি কোন কথা বলছে না । অন্ধকারের ভেতরে তার ছোট ছোট নিঃশ্বাসের শব্দ । হঠাৎ মেয়েটি কথা বলল ,
-আপনার কথা বলেন ।
-আমার কথা শুনতে চাও ! বেশ খুশী খুশী লাগছে এহসানকে । মধুমতীর পাড়ে ছাতিমতলা গ্রামে আমার বাড়ী । মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি । মা আমাকে একটা পরীর সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল । ছেলে বড় হোলে প্রত্যেক মা-ই কম বেশী এসব বলে । আমি শুনে হাসতাম । একদিন আমাদের থেকে দুই গ্রাম পশ্চিমে আবু তালেব শেখের মেয়ে তসলিমাকে এনে মা বলল , বাজান , কথা দিছিলাম পরী ধরে আনবো । আইনা দিলাম । তুমি বাইন্ধে রাইখো । মাকে বললাম , পরী কি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় আমার জানা নেই । মা হেসে কুটিকুটি । হাসতে হাসতে বললেন , এক পাঙ্খা বান্ধবা একটা পোলা দিয়া আরেক পাঙ্খা একটা ফুটফুইটটা মাইয়া দিয়া । এবার গলা ধরে আসে এহসানের । নিলুফা , আমি আমার পরীরে বেঁধে রেখে এসেছি । আমার পরী আমাকে ছাড়া শুন্যে তড়পাচ্ছে ,.....................।
-পরীকে ছেড়ে আসলেন কেন এই মরুর দেশে ?
-উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না । দেশে চাকুরী ছিল । টুকটাক ক্ষেতি-বাড়ীও ছিল । খেয়ে পরে ভালই ছিলাম । আমার স্ত্রী বিদেশে পাঠাতে রাজী হয়নি । এক রকম জোর করে চলে এসেছি । ভেবেছি দুইবছর কাজ করে বাড়ী ফিরবো । ফাঁকে হজটা সহজে সেরে নেয়া যাবে । আর হাতে যে নগদ টাকাটা আসবে ছোট্ট পরিবারের জন্য তা অনেক । কথা বলতে বলতে এহসানের মনে হোল দেয়ালের ওপারে কেউ নেই । নিজের কল্পনার সাথে কথা বলছে সে । ডুকরে কেঁদে উঠলো সে ।
( ৩ )
অন্ধকারে ঘুম ভেঙ্গে গেছে এহসানের । রাত্রি গভীর । কয়েক সহস্র কবর আর একজোড়া মানব-মানবী নিশ্ছিদ্র আঁধারের চাঁদর মুড়ি দিয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে । লোকটি হঠাৎ খেয়াল করলো তার পেটে কিছু একটা নড়াচড়া করছে । ক্ষুধা , সাত বছরের । শয্যার খুব কাছ থেকে মাংসের ঘ্রাণ ভেসে আসছে । একটি অনাস্বাদিত সাহস সঞ্চয় করে উঠে বসলো এহসান । ঠিক তখনি তার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলো । এই একটা নতুন রোগ দেখা দিয়েছে । কাঁপ-কাঁপানি রোগ । বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে হাত পা কাঁপতে থাকে । কাঁপ-কাঁপানি উপশমের আশায় এহসান স্থান কাল পাত্র ভুলে গুনগুন করতে লাগলো , ‘কে যাও ভাঁটির দেশের নাইয়ারে ভাই সারি গান গাইয়া ............... ।’ গানটা ছেলেবেলায় খুব দরদ দিয়ে গাইতে পারতো এহসান । বাপের বাড়ীর কথা মনে হলেই মা গানটি গাইতে বলত তাকে । মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আর সে ভাবে গাওয়া হয়নি । মেয়েটি কি তার গান শুনতে পাচ্ছে ? ভ্রূক্ষেপ নেই এহসানের । গাইতে গাইতে এক অলক্ষ্যে সে ফিরে গেল মধুমতীর পাড়ে , ছায়া ঢাকা ছাতিমতলা গ্রামে । কুঁড়ে ঘরে মাটির সিথানে শুয়ে আছে ছোট্ট এহসান । কাচনীর বেড়া ছিঁড়ে এক বিঘত জোছনার আলো ঢুকে পড়েছে ঘরের অন্ধকারে । রূপোর মত চকচকে একটুকরো জ্যোৎস্না । সেদিকে চেয়ে ছেলেটি গেয়েই চলেছে । মায়ের দুচোখ ভিজে উঠেছে । গভীর আবেশে মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ছেলেটির মাথায় ।
এহসানের যখন ঘুম ভাঙ্গল পূবের আকাশ তখন ফর্শা হয়ে এসেছে । মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখছিল সে । শুয়ে শুয়ে স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করে সে । নাহ , মনে পড়ছে না । স্বপ্নটা হারিয়ে গেছে , কিন্তু মিষ্টি আবেশটা রয়ে গেছে এখনো । উঠে বসতেই প্রথমে তার চোখ পড়লো পা দুটোর দিকে , ফুলে ঢোল হয়ে গেছে । ভ্রু কুচকে গেল এহসানের । তার বংশে পা ফোলা ভালো রোগ নয় । মৃত্যুর ঠিক পনেরোদিন আগে দাদার পাদুটো হঠাৎ করেই ফুলে উঠেছিল । বয়স হলেও বৃদ্ধের মনের জোর ছিল অটুট । প্রথমে ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিতে চায় নি । দিন সাতেক পরে যখন পেটটিও ফুলে উঠলো , কাতর কণ্ঠে সন্তানকে ডাকল অগ্রজ , ‘হোসেন রে , আমারে বিজিতেনের কাছে নিয়ে চল ।’ সে সময়ে গোপালগঞ্জে কোন পাস করা ডাক্তারই ছিল না । ডাঃ বিজিতেন ছিলেন মুহকুমা শহরের একমাত্র এল এম এফ । বাবার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল । ফোলা পা নিয়ে বাবা অবশ্য ছয় মাস টিকে ছিল । কিন্তু খোস পাঁচড়া তার জীবনটাকে অসহ্য করে তুলেছিল । দিন রাত নারিকেলের খোল দিয়ে গা চুলকাতে হতো ।
কামরার বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াতেই মনের কোনে জমে ওঠা দুশ্চিন্তাটা হালকা হয়ে গেল । সূর্য ওঠেনি । শুধু তার আনগত রশ্মি এসে পড়েছে দিগন্তের ওপর এক খণ্ড মেঘের ওপর । একটা চায়ের কাপের মত লাগছে মেঘটিকে । আরও লাল হয়ে উঠেছে কাপটি । মনে হচ্ছে কাচের পেয়ালায় গোলানো হয়েছে রক্তলাল জবার পাপড়ি । এমন পানীয় মাঝে মাঝে দেখা যায় আবু রাইদের টেবিলে । ‘কারকাদে’ বলে আরবীতে । জবার নির্যাসে নাকি অনেক শক্তি । মোহাবিষ্টের মত তাকিয়ে ছিল এহসান । ঠিক তখনি কলিং বেলটি বেজে উঠলো । একটু অবাক হোল সে , এতটা সকালে সাধারণত এ্যাম্বুলেন্স আসে না । লাশগুলো গুনে নিল এহসান । তেরটা । চাপটা আজ একটু বেশী । দ্রুত হাতে সাফ করে চলেছে এহসান । কাজ করতে করতে মৃতদের সাথে কুশল বিনিময়ও সেরে নিচ্ছে এহসান । এটা তার পুরনো অভ্যাস । শেষ লাশটিকে সালাম জানিয়ে টেবিলে শুইয়ে দিতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো তার । একি দেখছে এহসান ! তার সামনে যে শুয়ে আছে সে আর কেউ নয় , এহসান নিজেই । পেটে যা ছিল হড়হড় করে বেরিয়ে এলো । এও কি সম্ভব । বাম বাহুতে কাঁটা দাগ , বাম কানটা একটু ছোট । সামনে যে শুয়ে আছে সে ঠিক তারই জমজ , আরেকজন এহসান ! জ্ঞান হারিয়ে লাশের সারিতে লুটিয়ে পড়লো সে । জ্ঞান যখন ফিরল তখন এহসান হাসপাতালে । এরই মধ্যে দুই দিন কেটে গেছে । জ্ঞান ফিরতে দেখে আবু রাইদ এগিয়ে এলো ।
( ৪ )
‘ডেলুশোনাল ডিজওয়ার্ডার’ , প্রবীণ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লতিফ আব্বাস প্রিয় ছাত্রটিকে এমন সিভিয়ার একটা কেস দেখাতে পেরে নিজেই খুব উত্তেজিত । আজকের দুনিয়ায় সব কপাট যেখানে উন্মুক্ত সেখানে মনের ঘরে এভাবে বিষ বাষ্প জমে থাকতে তিনি নিজেও খুব বেশী দেখেছেন , মনে করতে পারেন না । ‘বুঝতে পেরেছ সামির , স্ট্রেস থেকে শুরু হয়েছে সব । একসময়ে প্রচণ্ড হতাশার সাথে যোগ হয়েছে ডেস্পারেট এটেম্পট টু সারভাইভ ইন দ্যা পুওরেস্ট সিচুয়েশান এভার । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাবযেক্ট এ পর্যায়ে আত্মহত্যা করে ল্যাটা চুকিয়ে ফেলে । এহসান সেটা করে নি । সে তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে আবিষ্কার করেছে একটা ফ্যান্টম ক্যারেক্টার । সাইকো এনালাইসিস করে নিলুফা নামের যে ক্যারেক্টারটা পাওয়া গিয়েছে সে হোল এহসানের অপপ্রেসড সেক্সুয়াল ডিজায়ার । টম হ্যাঙ্কসের ‘কাষ্ট এওয়ে’ ছবিটি দেখে থাকলে এহসানের পকেটের ছোট্ট আয়নাটিকে তুমি সহজেই তুলনা করতে পারবে নারকেলের খোল দিয়ে বানানো উইলসনের সাথে । আয়নায় স্পর্শ করলেই তার নিঃসঙ্গতা আর হতাশা শুনতে পায় নিলুফার কণ্ঠস্বর । তীব্রতম কষ্টের ভেতর সামান্য সুখ । শেষটায় হালুসিনেসন আরও ব্যাপক হয়েছে । অন্যের লাশকে নিজের মনে করে ফেলেছে সাবজেক্ট ।‘’ ডাঃ সামির বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে প্রোফেসরের কথাগুলো শুনছিল । তার কণ্ঠে শুধু একটি কথাই শোনা গেল , ‘পুওর ফেলো । ভেরী স্যাড আউটকাম।’
কাউকেই লোকটি ঠিক ভাবে চিনতে পারছে না । রোগীকে সুস্থ করা অসম্ভব জেনে হাসপাতাল থেকে বাংলাদেশ এম্ব্যাসীর সাথে যোগাযোগ করা হয় । এরপর আর বড় ঝামেলা হয়নি । খুব সকালে দেশে ফিরে এসেছে লোকটি । কিন্তু এ নিয়ে তার কোন উচ্ছ্বাস নেই । পাদুটো আরও ফুলেছে । ভাবলেশহীন মুখে সে এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখছে । সবকিছুই খুব অপরিচিত লাগছে তার । মাঝে মাঝে সে বিড়বিড় করছে , ‘মাবুদগো । বড় অচিনপুর লাগে ।’ দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই । গ্রাম ভেঙে দেখতে এসেছে তাকে । তাদের আগ্রহ শুধু এহসানই নয় । ছয় বছরের মেয়েটিকেও মন দিয়ে দেখছে তারা । এতদিনে সবাই ধরেই নিয়েছিল ঈশিতা নামের মেয়েটি বোবা । আজ সকাল থেকেই মেয়েটি কথা বলতে শুরু করেছে । এই অলৌকিক ঘটনায় ইমাম সাহেব কোরান খতম দেবার নিয়ত করেছেন । তিন জন সঙ্গী সহ তিনি সাবিনা শুরু করেছেন । পুরুষেরা বারান্দায় বসে হুঁকো টানছে । বেকী বেড়ার আড়ালে বসেছে মেয়েদের বৈঠক । শোকের ভেতরেও চলছে এক ধরনের উৎযাপন । দুপুরের আগে তসলিমাকে উঠতে হোল এসব ফেলে । বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ জামাই দেশে ফিরেছে , শুনে আনন্দে আত্মহারা শ্বশুর তড়িঘড়ি ছুটে আসছিল মেয়ের বাড়ীতে । খাল পেরুতে কাঠের সেতুতে পা হড়কে নীচে পড়ে গিয়েছিল । বৃদ্ধ বাবাকে দেখতে গেল তসলিমা । আর সূর্য পাটে যাবার ঠিক আগে এহসানের মৃত্যু হোল ।
( ৫ )
পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে । রাজধানীর একটি নামকরা মানসিক হাসপাতাল । ডাক্তারের রোগী দেখা শেষ হয়েছে বেশ আগেই । ভর্তি হওয়া পেসেন্টদের দেখে বেরিয়ে আসছেন তিনি । গাড়ীতে ওঠার ঠিক আগে তার চোখ পড়লো ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে থাকা মধ্যবয়সী একটি মানুষের দিকে । চেহারা আর পোশাকে শ্রমজীবী বলেই মনে হয় । পাশে দাঁড়ানো ছয় সাত বছরের মেয়েটির দিকে দৃষ্টি গেল ডাক্তারের । সস্নেহে কাঁধে হাত রেখে ডাক্তার জিগ্যেস করলেন , তোমার বাবা ? মেয়েটি উত্তর দিল না , মাথা নাড়াল শুধু ।
-টিকিট করো নি কেন ? এখন যে রোগী দেখার সময় শেষ হয়ে গেল ।
-আমাদের কাছে যে টাকা-পয়সা নেই । কথাটা বলতে বলতে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে মেয়েটি । কৌতূহলী ডাক্তার লোকটির কাঁধে হাত রেখে জিগ্যেস করলেন , কি হয়েছে আপনার ? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে লোকটি । তার হয়ে মেয়েটি বলতে শুরু করলো , দুনিয়াটাকে বাবার কাছে অচিনপুর মনে হয় । কেঁপে উঠলেন ডাক্তার । এ দৃশ্যের মঞ্চায়ন তিনি আগেও একবার দেখেছেন । একটু পরেই লোকটি মেয়েকে ফেলে পালিয়ে যাবে ! বাবা ও মেয়েকে শক্ত হাতে জাপটে ধরেলেন ডাঃ ঈশিতা । বাবাটিকে আজ কিছুতেই হারাতে দিবেন না তিনি । মেয়েটিও ছোট্ট হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে বাবাকে ।