বসন্ত এলেই প্রকৃতি তার রূপ যৌবনকে নতুন রূপে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ফুলের সৌরভে মুখরিত হয়ে অলিরা ফুলের সান্নিধ্য পেতে ব্যকুল হয়ে উঠে। রক্ত রাঙা শিমুল, পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসা কোকিলের কুহু কুহু কণ্ঠ শুনে সেই বসন্ত আরও উদাসীন হয়ে যায়। আর এই উদাসী বসন্ত বকুলকে আরও উদাস করেছিল সেদিন; যেদিন সে জয়িতাকে প্রথম দেখেছিল।
আজ পূর্নিমার রাত, পুকুর ঘাটে একাএকা বসে আছে বকুল। আজ তার পাশে জয়িতা নেই, শুধু একটা কদম গাছ। কদম গাছটার নিচে বসে আকাশের ঝলমলে চাঁদটাকে দেখছে। মনের অজান্তেই হারানো দিনের স্মৃতি গুলো বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।
ফাল্গুন মাস, পূবের জানালাটা খোলা। ঝিরিঝিরি বাতাস এসে আচমকা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমি শ্রাবণের পড়ার টেবিলের চেয়ারটায় বসে আছি। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাহিরে চোখ পড়তেই দেখি একটি মেয়ে আসছে। আগে কখনো তাকে দেখিনি বা তার সাথে আমার কোন পরিচয়ও ছিলনা। আমি যে ঘরটায় বসে আছি মেয়েটি সেই ঘরটায় আসল। মেয়েটি খালার কাছে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শিখতে এসেছে। অদুরেই একটি মাদুর পেতে খালা আর সে বসেছে, খালা তাকে সেলাইয়ের কাজ শিখাচ্ছে। সে কথায় কথায় হাসছে, হাসলে তাকে খুব সুন্দর দেখায় মসৃণ গালে টোল পড়ে। বসে বসে আমি তার হাসির দৃশ্যটি দেখছি, কি যে ভাল লাগছে। কখনো মেয়েটি আমাকে দেখছে আবার সুই সুতা নিয়ে কাপড় সেলাই করছে।
হঠাৎ মেয়েটি খালাকে জিজ্ঞেস করে, ভাবী তোমাদের ঘরে বসা এই ছেলেটি কে?
”আমার বোনের ছেলে”, খালা উত্তর দেয়।
বেড়াতে এসেছে বুঝি? মেয়েটি পাল্টা প্রশ্ন করে।
”না”, আমাদের বাড়ীতে থাকবে এখানে থেকে পড়াশুনা করবে।
ও তাই! চোখ বাঁকা করে আমার দিকে তাকালো।
কিছু সময় পর মেয়েটি সুই সুতা গুলো খালার হাতে দিয়ে সে তাদের বাড়ীতে চলে গেল।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর শ্রাবনের কাছ থেকে তার পরিচয় জেনে নিলাম। খালাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় তার বাড়ী, সে হিন্দু মেয়ে নাম জয়শ্রী চৌধুরী, কিশলয় শিশু নিকেতনে নবম শ্রেণীতে পড়ে। সে প্রতি দিনই এ বাড়ীতে আসে খালার কাছে কাপড়ের সেলাইয়ের কাজ শিখতে। আস্তে আস্তে জয়শ্রীর সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি তাকে জয়িতা বলে ডাকি, প্রায় দিনই সেলাইয়ের কাজ বাদ দিয়ে জয়িতা আমার সাথে গল্প গুজব করেই বাড়ী চলে যায়।
প্রতি দিনের মত আজও সুই সুতা নিয়ে জয়িতা সেলাইয়ের কাজ করছে আর আমি পূবের জানালাটার পাশে চেয়ারটায় বসে আছি । খালা আজ বাড়ীতে নেই, ডাক্তার দেখাতে গেছেন। হঠাৎ জয়িতা আমার কাছে দৌড়ে এসে দুহাতে আমার গাল চেপে ধরে, মুখের কাছে মুখ এনে বলে কিরে বকুল আমাকে দেখলে তুই এত ভাল হয়ে যাস্ কেন?
তোকে খুব ভাললাগে।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ, তাই।
আমাকে তুই ভালবাসিস, তাইনা?
জানিনা।
অ্যা... জানিনা, জয়িতা মুখে ভ্যাংচি কাটল। ছেলে মানুষের কি যে অভ্যাস সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই তাদের মাথাটা ঘুরে যায়। আমাকে দেখার পর তোর মাথাটাও যে এলোমেলো হয়ে গেছে সেটা আমার আর বুঝার বাকী নেই।
জয়িতার কথা শুনে লজ্জায় আমার মুখ থেকে আর একটি কথাও বের হয়নি। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। কিছু সময় দুজনেরই নীরবতায় কাটল। অনেকক্ষন গল্প গুজব করার পর জয়িতা হঠাৎ বলল চল বেড়াতে যাবে।
কোথায়?
আমাদের বাড়ী।
খালা যে আজ বাড়ী নেই।
তাতে কি, ভাবিকে পরে আমি বলবো।
আচ্ছা চল্।
জয়িতা তাদের বাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। জয়িতার সাথে হেঁটে যাচ্ছি আমার কি যে ভাল লাগছে। জয়িতা আমার সামনে সামনে হাঁটছে অনেক্ষন পর হঠাৎ বলল, বকুল এখানে একটু দাঁড়া ।
কেন, কি হয়েছে?
কালি ঘরটা দেখছিস্ না?
হ্যাঁ দেখছি।
দেবীকে প্রণাম করে আসি।
দেবীকে প্রণাম করলে কি হয়!
মিলন হয়।
তোর হবে?
হয়তো।
জয়িতা দেবিকে প্রণাম করে আসল। কালী মন্দির থেকে সামান্য হাঁটার পর তাদের বাড়ী। বাড়ীর সামনে কদম গাছটার নিচে সে বসে পড়ে এবং আমাকেও বসতে বলে। আমি জয়িতার কাছা কাছি বসি, তার মুখ খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রোদের মাঝে হেঁটে আসার কারনে তার নাকের নিচে চিনির রোয়ার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে, দেখতে কি যে ভাল লাগছে। আমি জয়িতার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। জয়িতা আমার দিকে তাকায়।
কি দেখছিস?
তোকে।
দেখার কি হল।
খুব সুন্দর লাগছে।
তার পর দুজনেই কদম তলা থেকে উঠে তাদের বাড়ীর ভেতরে যাই। জয়িতা তার মায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর তাদের বাড়ী থেকে বের হই। জয়িতা আমার সাথে কালী মন্দির পর্যন্ত আসল। এবং আমাকে বলল দেখ বকুল আকাশে কি সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ, চল কালী ঘরের সামনে বসে দুজনে গল্প করি। আমি বললাম, না কালী মন্দিরের সামনে বসা ঠিক হবেনা তারচে ভাল হবে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।
দুজনে মিলে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, চাঁদের আলো পুকুরের পানিতে পড়ে ঝলমল করছে। চারদিকে সুনসান নির্জনতা, আমি আর জয়িতা পাশা পাশি বসে আছি। কিন্ত আমার একটু একটু ভয় হচ্ছিল, যদি কেউ দেখে ফেলে। বিষয়টি জয়িতাকে বলার পর সে বলল এ সময় এখানে কেউ আসবেনা। বাবা দিদিকে নিয়ে চিনু পিসিদের বাড়ী গেছে আর দাদা তো ময়মনসিংহে থাকে, বাড়ীতে শুধু মা আর ছোট বোন চিত্রা এ সময়ে ওরা কেউ পুকুর ঘাটে আসবে না।
জয়িতা গভীর দু’চোখে আমার দিকে তাকায়, এক হাতে আমার গাল টেনে ধরে। চারদিকের নির্জনতা আমাকে আরও উদাস করে দেয়। জয়িতা আমাকে বলে কিরে বকুল তুই এত ভাল কেন? তোকে আমার খুব পছন্দ হয়।
সত্যি!
হ্যাঁ সত্যি। যে দিন প্রথম তোর সাথে আমার দেখা হয়েছে সেদিনই তোকে আমার খুব ভাল লেগেছে।
আমারও যে তোকে পছন্দ, তোকে দেখার পর শ্রাবণের কাছে তোর পরিচয় জানতে পারি। কিন্তু সমস্যা হল তুই হিন্দু আর আমি মুসলিম। এ ছাড়া খালাকে তুই ভাবী বলে ডাকিস।
তোর খালাতো আমার আপন ভাবী না। তাছাড়া হিন্দু মুসলিম তাতে কোন সমস্যা নেই, তোকে আমার চাই।
আর জয়িতাকে ছাড়াতো আমারও চলবেনা। সত্যি সেদিন জয়িতার কথাগুলো শুনে আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। আমি যদি রবি ঠাকুর বা জীবনানন্দ হতাম তাহলে হয়তো হৃদয়ের অনুভূতিটা সাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করতে পারতাম। কথা বলতে বলতে এক সময় জয়িতা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকে টেনে নেয়। এর আগে কখনো আমি মেয়ে মানুষের সংস্পর্শে আসিনি। জয়িতার বুকে যে নরম বিড়াল ছানার শরীরের মত, আমি নি:শব্দে তার বুকে পড়ে থাকি। তার চুলের ঘ্রাণ আমাকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। আমিও জয়িতাকে জড়িয়ে ধরি, সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় আর হাসে। বলে দুষ্ট ছেলে।
ভাদ্র মাস, ধবধবে সাদা চাঁদের আলোয় চারদিকটা কি সুন্দর ফর্সা দেখাচ্ছে আর ঝিরিঝিরি পূবালী হাওয়ায় পুকুরের পানি একটু একটু নড়ছে। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। নির্জন পরিবেশে এমনি এক সুসময়ে পুকুর পাড়ের জলপাই গাছটার নিচে জয়িতার পাশে বসে আছে বকুল। এই মুহূর্তে বকুলের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটি হচ্ছে জয়িতা। জয়িতাকে ছেড়ে চলে যেতে বকুলের মন না চাইলেও সারা রাত্র তো আর পুকুর ঘাটে থাকা যাবেনা। বাধ্য হয়েই দুজনকে বাড়ী যেতে হল। সেদিন সারা রাত্র জয়িতা বা বকুল কারো চোখে ঘুম আসেনি ।
আস্তে আস্তে বকুল আর জয়িতার সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে লাগল। দুজনই মনস্থির করেছে পড়াশুনা শেষ করার পর তাদের বিয়ে হবে। পারিবারিক ভাবে যদি না মেনে নেয় তবে তারা কোর্ট মেরিজ করবে। সবে মাত্র দুজনেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কে কোথায় ভর্তি হবে তা নিয়েও দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়। হঠাৎ বকুলের খালা তাদের সম্পর্কের বিষয়টি টের পায়। এবং এখানকার কাউকে কিছু না জানিয়ে শুধু বকুলের মাকে বিষয়টি জানায়। বকুলের মা ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু কিছুতেই বকুল মানতে রাজি না। এক পর্যায়ে জয়িতার পরিবার সহ সবাই বিষয়টি জেনে গেল। পড়াশুনা শেষ করার আর কোন অবস্থান থাকল না। কারন জয়িতার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে আর কোথাও ভর্তি না করিয়ে এখনি বিয়ে দিয়ে দিবেন। সেই উদ্দেশ্যে জয়িতাকে সুনামগঞ্জ তার মামার বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হল, আর এদিকে বকুলও বাড়ী চলে গেল। দুজনেই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
বকুল শ্রাবণকে দিয়ে জয়িতার মামার বাড়ীর ঠিকানা সংগ্রহ করে এবং কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে সুনামগঞ্জে যায়। বন্ধুদের সহায়তায় সুনামগঞ্জ নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেবিট করে জয়িতাকে বিয়ে করে। ঘটনাটি জানা জানি হওয়ার পর তাদের দুই পরিবারের কেউই বিয়েটি মেনে নেয়নি। বিয়ের দুই দিন পর রাতের বেলায় বকুল তাদের বাড়ীতে এসেছিল, কিন্তু বকুলের বাবা ছেলেকে অনেক বকাঝকা করেন ও বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। আর এদিকে জয়িতার বাবাও মেয়েকে অপহরন করা হয়েছে বলে আদালতে মামলা দায়ের করেন। বকুলের বাবা ছেলেকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছেন আর জয়িতার বাবা করেছেন মামলা, কোন উপায়ন্তর না দেখে দুজনেই ঢাকায় চলে যায়।
শ্রাবণের পরিচিত দুর সম্পর্কের এক চাচার বাসায় এসে উঠল বকুল আর জয়িতা। বকুল আরও দু একবার ঢাকায় এসেছে তার মামার বাসায় কিন্তু জয়িতা কখনো ঢাকায় আসেনি। বাসার কর্তা কালাম মিয়া, তিনি ভাড়ায় রিক্সা চালান আর তার বউ রহিমা খাতুন একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরী করেন। বারান্দা সহ একটি ছোট্ট রুম, পরিবেশ খুব একটা ভাল না। রাতে খওয়া দাওয়ার পর ভেতরের রুমে খাটের উপর জয়িতা আর বকুলকে শুইতে বললেন রহিমা খাতুন, আর বারান্দায় পাটি বিছিয়ে তারা দুজন থাকবে। কিন্তু বকুল বাঁধা দিয়ে বলল, না চাচী আপনারা সারা দিন অনেক কষ্ট করে এসেছেন, ভেতরেই থাকেন। আমরা দুজন বারান্দায় থাকতে পারব।
বিয়ের পর বকুল আর জয়িতা এলাকায় যে কয়েক দিন ছিল নাওয়া, খাওয়া, ঘুম কোনটাই ঠিক মত হয়নি। আজ নতুন পরিবেশে দুজন এক সাথে শুয়ে আছে। জয়িতা কোন দিন ফ্লোরে শুয়ে ঘুমায়নি, আজ সে পরিস্থিতির স্বীকার যদিও তার কষ্ট হচ্ছে বকুলের ভালবাসার টানে এই কষ্ট সে মেনে নিয়েছে। হঠাৎ বকুল শুয়া থেকে উঠে জয়িতাকে জিজ্ঞেস করল
তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা? সত্যি আমি তোকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি।
কিসের কষ্ট, তুই যত দিন আমার পাশে থাকবি ততদিন আমার কোন কষ্টই হবেনা।
অ্যা.. কষ্টই হবেনা, শুধু কি পাশে থাকলেই চলবে? মুখে ভ্যাংচি কাটল বকুল।
কেন, আর কি করতে হবে? জয়িতার মুখে প্রশ্ন।
চলব কিভাবে, থাকব কোথায় একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবেনা।
ও তাতো করতে হবেই। দুজনে মিলে চাকরী করব। চাচীকে বলে তাদের ফ্যাক্টরীতে একটা ব্যবস্থা করে নিবে।
আচ্ছা, কাল সকালে চাচীকে বলব দেখি যদি কোন রকম ব্যবস্থা হয়।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন, এভাবে এক সপ্তাহ যায় কিন্তু চাকরীর কোন ব্যবস্থা হয়নি। বকুল আর জয়িতার কাছে যে টাকা ছিল তাও প্রায় শেষের পথে। কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা বকুল, কিন্তু এই মুহুর্তে বাড়ী যাওয়াও তার ঠিক হবেনা কারন জয়িতার বাবা মামলা করে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত কালাম চাচাকে বলে তার মালিকের রিক্সার গ্যারেজ দেখা শুনার কাজ নিয়েছে। বকুলের কাজ হচ্ছে সারা দিন গ্যারেজ দেখা শুনা করবে, এবং কে কে রিক্সা নীল তা লিখে রাখবে। আবার যখন রিক্সা ফেরত দিবে তখন টাকা সহ বুঝে রাখতে হবে। এই কাজের জন্য বকুল মাসে পাবে ৪৫০০ টাকা আর দুপুরের খাবারটা গ্যারেজ মালিক দিবে।
গ্যারেজে কাজ নেওয়ার পর বকুল কালাম চাচার মাধ্যমে সিঙ্গেল রুমের একটি বাসা ভাড়া নীল। নতুন বাসায় বকুল আর জয়ীটার নতুন সংসার শুরু হল। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বকুলের ডিউটি, এজন্য নাস্তা বানাতে সকাল ছয়টায় উঠতে হয় জয়ীটাকে। ছয়টায় না উঠলে চুলা পাওয়া যাবেনা, এ বাড়ীতে আটটি রুম আছে আর চুলা আছে মাত্র চারটি প্রতি দুই রুমের জন্য একটি করে চুলা। সিরিয়াল দিয়ে রান্না করার দৃশ্য জয়িতা আগে কখনো দেখেনি কারন সে গ্রামের মেয়ে, গ্রামের মানুষ কখনো সিরিয়াল দিয়ে রান্না করেনা। কিন্তু শহরের শুধু ফ্ল্যাট বাসায় সিরিয়াল দিতে হয়না এছাড়া যত প্রকারের বাসা আছে সব খানেই সিরিয়াল আর সিরিয়াল।
বাড়ীতে থাকতে জয়িতা কখনো রান্না বান্নার কাজ করেনি, কিন্তু প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হত। এখন নিজের সংসারের কাজ নিজেকেই করতে হবে। কেউ তো আর তাকে সাহায্য করবেনা, জয়িতা আসলে রান্নার কাজ একেবারেই পারেনা। পাশের রুমের এক ভাবীর সহায়তায় রুটি বানানো শিখেছে। একদিন দুপুরে ভাত রান্না করার সময় ফেন পড়ে গিয়ে ডান হাতটা পুড়ে গেছে, আবার তরকারি রান্না করতে লবণ দেয়নি। রাতে রকুল বাসায় ফিরে দেখল জয়িতা শুয়ে আছে। ডান হাতটা কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো।
এই যে ম্যাডাম, সংসারের কাজকর্ম করতে করতে খুব ক্লান্ত বুঝি? কথাটি বলতে বলতে বকুল জয়িতার পাশে এসে বসল। এবং জয়িতার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল
এই কি হয়েছে, তোর হাতে কাপড় প্যাঁচানো কেন?
ফেন পড়ে পুড়ে গেছে।
কি আমার রাঁধুনিরে...! আবার হাত পুড়ে গেছে। দেখি দেখি? অনেকটা পুড়ে গেছে নাকি অল্প।
অনেক না একটু, কথাটি বলতে বলতে জয়িতা উঠে বসল এবং হাতের প্যাঁচানো কাপড়টা খুলে পুড়ে যাওয়া ক্ষত স্থানটা বকুলকে দেখাল।
ইস্ লাল হয়ে আছে, ভালই তো পুড়েছে দেখছি। খুব যন্ত্রনা করছে তাই না? কোন ঔষুধ পত্র লাগিয়েছিস্?
হ্যাঁ, পাশের রুমের ভাবী একটু মলম লাগিয়ে দিয়েছিল। এখনও ব্যথা আছে।
আচ্ছা আমি দোকান থেকে ঔষুধ নিয়ে আসছি। বলেই বকুল রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
ব্যথার টেবলেট আর একটা মলম নিয়ে এসেছে বকুল। জয়িতাকে একটা ব্যথার টেবলেট খাইয়ে দিল আর পুড়ে যাওয়া ক্ষত স্থানে একটু মলম লাগিয়ে দিল। কিন্তু রাতের খাবারের জন্য রান্না বান্না এখনো হয়নি। বকুল হাত মুখ ধুয়ে নিজেই রান্না বসিয়ে দিল। রাত দশটা বাজে সবার রান্না শেষ, এখন আর রান্নায় কোন সিরিয়াল নেই। এক চুলায় ভাত আর অন্য চুলায় তরকারী বসিয়েছে। রান্না শেষ করে বকুল আর জয়িতা খেতে বসল, কিন্তু জয়িতা পুড়ে যাওয়া হাত দিয়ে তো আর খেতে পারবে না। বকুল নিজে আগে খেল তার পর জয়িতাকে খাইয়ে দিল। পাঁচ সাত দিন পর জয়িতার হাত একটু ভাল হয়েছে, কিন্তু পুরো পুরি ভাল হতে আরও প্রায় দশ বার দিনের মত লাগবে।
কষ্টের মাঝে যে সুখ আছে সেটা বকুল আর জয়িতাকে দেখলেই অনুভব করা যায়। বকুল সারাদিন গ্যারেজে অনেক কষ্ট করে আর জয়িতা সংসারের কাজ কর্ম নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সিরিয়ালে রান্না করা, চুলা, টয়লেট পরিষ্কার এবং পুরো বাড়ীটা সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার করতে হয়। এসব কাজ জয়িতা কখনো করেনি। কিন্তু আজ; বকুলের ভালবাসার টানে সে সব করতে পারে।
সারাক্ষন সে বকুলকে ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চায়। বকুলের মনে সে উৎসাহ উদ্দীপনা যোগায়। সারা ঢাকা শহর বকুল আর জয়িতা দুজন মিলে ঘুরেছে। যে দিনই বকুল গ্যারেজ থেকে ছুটি পেয়েছে সে দিনই দুজন মিলে ঘুরতে বেরিয়েছে। জাতীয় যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, সংসদ ভবন, শিশু-পার্ক, আহসান মঞ্জিল এমন কি কমলাপুর রেল ষ্টেশনও বাদ যায়নি। দুজনে মিলে অনেক অনেক মজা করেছে। মুর্দা কথা জয়িতার আচরনে বকুল এতটাই মুগ্ধ ছিল যে, রাতে গ্যারেজ থেকে বাসায় ফেরার পর বকুলের কোন কষ্টই মনে হত না।
প্রায় ছয় মাস পর বকুলের ছোট চাচা ফোন করে বললেন
কোর্টে হাজিরা না দেওয়ার কারনে তোর নামে ওয়ারেন্ট বের হয়েছে, পর পর দুটি সমন নোটিশ এসেছে। এখন তুই তাড়াতাড়ি বাড়ী আয় বাবা, আগামী ১২ তারিখ কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। তোর বাবাকে রাজি করিয়ে আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, একজন উকিলের সাথেও চুক্তি হয়েছে কোর্ট তোকে আটকাবে না। যত দ্রুত সম্ভব তুই বাড়ী চলে আয়।
ছোট চাচার সাথে কথা বলার পর বকুল বিষয়টি জয়িতাকে জানাল। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নীল আগামী কালের মধ্যে তারা বাড়ী চলে যাবে।
গ্যারেজের মালিককে বিস্তারিত বলে বকুল সাত দিনের ছুটি নীল। পরদিন সকাল বেলা বকুল আর জয়িতা বাড়ী যাওয়ার জন্য রওনা দিল। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে কাকলী এন্টার প্রাইজ নামক বাসে তারা চড়ল। সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। বাসটি যখন লক্ষিগঞ্জ বাজারের কাছাকাছি আসল তখন বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সাথে মুখো মুখি সংঘর্ষ হয়। বাসটি দুমরে মুচরে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে যায়। বাস এবং ট্রাকের চালক ঘটনা স্থলেই মারা যায়।
বাসের যাত্রীদের মধ্যে ঘটনা স্থলে মারা যায় তিন জন এবং আহত অবস্থায় প্রায় পনের বিশ জনকে নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল সহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে মারা যায় আরও দুই জন। এর মধ্যে জয়িতাও ছিল।
বকুলের মাথায় আঘাত লেগেছিল, নেত্রকোনা থেকে তাকে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়েছে। প্রায় চার ঘণ্টা পর বকুলের জ্ঞান ফিরলে চোখ খুলে দেখে জয়িতা তার কাছে নেই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১৩ নাম্বার ওয়ার্ডের ৪৬ নং বেডে শুয়ে আছে। নার্সের কাছে জানতে পারে নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল থেকে তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। বকুল তার ছোট চাচাকে ফোন করে ঘটনাটি জানায়।
জয়িতার জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এই মুহুর্তে জয়িতা কোথায় কি অবস্থায় আছে কিছুই সে জানে না। মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে তাও জানেনা। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, হঠাৎ শ্রাবণের কথা মনে হতেই তাকে ফোন করে ঘটনাটি জানায় এবং নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল সহ ক্লিনিক গুলোতে খোঁজ নিতে বলে।
শ্রাবণ নেত্রকোনার প্রতিটি ক্লিনিক তন্ন তন্ন করে খোঁজে শেষ পর্যন্ত সদর হাসপাতালে গেল কোথাও জয়িতার সন্ধান মেলেনি। জরুরী বিভাগে কথা বলে জানতে পারল, এক্সিডেন্টের যে রোগী গুলো এসেছে তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছে এবং একজন মহিলাও আছে। শ্রাবণ লাশ ঘরে গিয়ে দেখল সত্যিই তো জয়িতার মরা দেহটি মেঝেতে পড়ে আছে। জয়িতার মরা মুখটি দেখে শ্রাবণের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসল আর বকুলের কথা মনে হতে লাগল। নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে জয়িতাকে পাওয়া গেছে এই সংবাদটি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে মারা গেছে বকুলকে বলেনি।
এরই মধ্যে ছোট চাচা বকুলের কাছে পৌঁছে গেল। হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে ছোট চাচা বকুলকে নিয়ে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে চলে আসে। হাসপাতালের বারান্দায় শ্রাবণের সাথে তাদের দেখা হয়। শ্রাবণ তাদের দুই জনকে নিয়ে জয়িতার লাশের কাছে যায়। জয়িতার মরা দেহটি দেখামাত্র বকুলের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল পা দুটি অবশ হয়ে গেল, বকুল মাটিতে পড়ে গেল। ছোট চাচা এবং শ্রাবণ বকুলকে টেনে উঠাল, বকুলের মুখ থেকে কোন কান্নার আওয়াজ বের হল না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, সত্যি তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছিস্ আমি এখন কাকে নিয়ে বাচঁব। দুজনে বকুলকে ধরে হাসপাতালের বারান্দায় নিয়ে গেল। জয়িতার বাবাকে সংবাদ দেওয়া হল।
সন্ধ্যার কিছু সময় আগে পোস্টমর্টেম করার জন্য মোটা করে দুজন লোক জয়িতার লাশ নিয়ে যাচ্ছে। ছোট চাচা, শ্রাবণ আর বকুল দাঁড়িয়ে আছে, বকুলের মুখ থেকে আর একটি কথাও বের হল না, পাথরের মুর্তির মত দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে জয়িতার লাশের দিকে তাকিয়ে রইল।