ঝুলন্ত চিঠি

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

Jyotirmoy Golder
ছাত্র রাজনীতির কবলে পড়ে ক্যাম্পাসে চরম সংঘর্ষ বিদ্যমান। সকাল থেকে সমস্ত ক্লাস রুমে তালা ঝুলছে। একের পর এক সেন্ডিকেট এ মিটিং বসছে কিন্তু সব ব্যর্থ, প্রশাসনের ক্ষিপ্র বাধা ত্রিমুখী সংঘর্ষে রূপ নিলো। হলে বন্দি হাজার ছাত্র। দুপুর হতে না হতেই সিন্ডিকেটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, হল ভ্যাকেন্ট। বিকাল ৫টার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হলো সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী কে।
সামনে পাওয়া শার্ট প্যান্ট গুলো তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে বের হয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে, সময় স্বল্পতায় কোন বই বা অন্য কিছু নেবার চিন্তা করলাম না। কাছে যে টাকা আছে তাতে কোনমতে ট্রেনের একটা টিকিট হয়ে যাবে। স্টেশনে পৌছাতেই হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়, টিকিট কাটলাম বটে তবে কোন সিট নেই। ট্রেনের লম্বা হুইসল জানালো ছাড়বার সময় হয়েছে। দ্রুত করে একটা রুমে উঠে বসলাম। আমার মতো অনেকে সেখানে কষ্ট করে দাড়িয়ে আছে, তাদের সাথে আমিও দাড়িয়ে রইলাম। হটাৎ নাম ধরে কে যেন ডাকলো, তাকিয়ে দেখি কিছু দুরে একটা সিটে পুলক দা বসে, আমি ৩য় বর্ষে পড়ি, সেদিক থেকে সে আমার থেকে দুই বছরের বড়। সে আমার ডিপারমেন্ট এর বড় ভাই, এম.এ. শেষ বর্ষে পড়ে। পুলকদা বললো আমি একটু পরে নেমে পড়বো ঈশ্বরদী, তুমিও আমার সাথে নেমে পড়ো, কালকে সকালের ট্রেনে চলে যেয়ো। ট্রেন খুলনা পৌছাতে রাত ১০টার বেশি বাজবে, আর সেখান থেকে বাড়ি যেতে বাসে আরো দুই ঘন্টার বেশি লাগবে, এবং ততো রাত অবধি হয়তো কোন বাস ও থাকবে না। কিন্তু কি যেন ভেবে তাকে না করে দিলাম। একটু পর পুলকদা নেমে গেলেন এবং আমি তার সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। সমস্ত রুমে অনেক ভিড়, কে কোথায় যাবে, কি ভাবে যাবে, কবে ক্যাম্পাস খুলবে ইত্যাদি কথা-বার্তায় সমস্ত রুম গরম হয়ে উঠেছে। সর্বপরি এক বয়সী এবং একি ক্যাম্পাসের হাজারটা স্টুডেন্ট যেখানে। চেনা কাউকে খুজতে না গিয়ে কখন যেন নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
প্রচন্ড শব্দ আর ঝাকুনিতে ঘুম ভাঙলো, উপর থেকে একটা ব্যাগ এসে মাথার উপরে পড়লো, সমস্ত রুমে হইচই পড়েগেলো। তড়িঘড়ি করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম।
কিছুক্ষন পর জানতে পারলাম ট্রেনটা অন্য লাইনে উঠে যাওয়াতে সামনের ৩টি বগি লাইনচ্যুত, আহত বা নিহতের সংক্ষা কেউ কিছু বলতে পারে না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ৭টা বেজে ৫২ মিনিট। হইচই এর মাঝে কিছু এক বয়সি মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেন লাইন ধরে পায়ে হেটে যাবো। আঁকাশে চাঁদের উপস্থিতি বলে দিলো সেই হবে পথ প্রদর্শক। তারুন্যের ছাপ পড়লো দুচোখে, ওদের সাথে একমত হয়ে ব্যাগ পিঠে নিয়ে রওনা হলাম ১১জন এক বয়সি মিলে।
সবাই একি ক্যাম্পাসে পড়ি এবং সমবয়সী। পথ চলতে চলতে সবাই পরিচিত হয়ে নিলাম। ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে আমরা হেটে চলেছি লাইন ধরে, উপরে চাঁদ আর আমাদের মুখে কথার বৃষ্টি। পাশ থেকে কেউ একজন গান ধরলো....পথের ক্লান্তি ভুলে।
রেললাইনেই, কিছু খাওয়ার জন্য এক হয়ে বসলাম। ঘড়িতে রাত ১১টা বেজে ২১মিনিট আমরা সংখ্যায় এখন সাত। এরি মাঝে চার জন তাদের গন্তব্যে পৌছে গিয়েছে। যার ব্যাগে যা ছিল বের করে সবাই ভাগাভগি করে খেয়ে আবার হাটতে শুরু করলাম। চাদের আলোয় আমরা রেল লাইন ধরে হেটে চলেছি। কারো চোখে ঘুম অথবা ক্লান্তি কোনটাই প্রাধান্য পাইনি, একমাত্র গন্তব্যই আমাদের চূড়ান্ত। সময়ের সাথে সাথে আমরা এখন তিন জনে এসে দাড়িয়েছি। সাথে যারা ছিল তারা এরি মধ্যে তাদের গন্তব্যে চলেগেছে। কিছুদূর যাবার পর আমাকে ডেকে রিপন বললো; আপনি আমাদের সাথে যেতে পারেন তারপর সকালে না হয় বাড়ির জন্য বের হবেন। তাকে না বলতেই সে আমাকে বললো; আপনি তাহলে রেল লাইন ধরে না গিয়ে সোজা এই পথটা দিয়ে যেতে পারেন। দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে, হেটে যেতে ঘন্টা দুই লাগতে পারে। ওটা কাশিয়া গ্রাম। কাশিয়া গ্রাম গেলেই তো আপনি আপনার পথ পেয়ে যাবেন। কাশিয়া গ্রাম থেকে আর দুটো গ্রাম পরে আমাদের বাড়ি। আমি ওদের দুইজনকে বিদায় দিয়ে মাঠের মাঝে সরু পথ ধরে হাটতে শুরু করলাম। এবার আমি একা যাত্রি, দূরের আলোটাই আমার প্রথম গন্তব্য। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১২ টা ০৯ বাজে। সরু পথ ধরে হাটতে হাটতে এক সময় খোলা একটা মাঠের মাঝে এসে পড়লাম। ঘড়িতে অনেক বাজে, প্রায় দু’ঘন্টার বেশি হেটেছি কিন্তু আলোটা এখনোই সেই একি ভাবে দূরেই মনে হতে লাগলো। নিজেকে অনেকটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে, পা জড়িয়ে আসছে। মাঠের একপাশে একটা গাছ পড়ে আছে। গাছটায় বসে ব্যাগটা পাশে রেখে একটু বিশ্রাম নিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিক বলতে পারবো না। হটাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস ছুয়ে গেলো, চোখ খুলে দেখি সামনের সরু পথটা ধরে কে যেন সাদা পোশাকে হেটে আসছে। একটা ভয় মনে ঠাই নিয়েছে নিজের অজান্তে, সাথে বাতাসটা কেমন যেন ভারী বলে মনে হচ্ছে।
শরীর জুড়ে কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। লোকটা ক্রমান্নয়ে কাছে আসছে কিন্তু চাদের আলোয় তার কোন অবয়ব ভালো বোঝা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। এক সময় বুঝতে পারলাম আমার সামনে কেউ এসে দাড়িয়েছে। কাপা স্বরে কে বলতেই প্রতি উত্তর ।
আমাকে চিনবেন না। আপনি কোথায় যাবেন ? গ্রামের নাম বলতে লোকটা আমাকে বললো; আপনি পথ ভুল করেছেন। এদিকে দিনের বেলাতেও কেউ আসে না। তবে আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার গলা শুকিয়ে আসছে, এমন সময় তিনি আবার বললেন; একটা উপকার করবেন। এবার সবটুকু শক্তি দিয়ে উত্তর দিলাম। হ্যাঁ বলুন কি উপকার। তিনি বললেন এই চিঠিটা একটু ঠিকানায় পৌছে দেবেন। চিঠি ? তিনি আমার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে নিরবে বললেন; হ্যা একটা
চিঠি। যা আমি বহুদিন ধরে বয়ে চলেছি। আপনি যদি ঠিকানায় একটু পৌছে দেন তবে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। কিছু বলবার আগেই তিনি বললেন ; আমাকে ভয় পাবেন না। আমি চোখ বন্ধ করে হাত পাতলাম। হাতের উপরে ঠান্ডা একটা কাগজের স্পর্শ বুঝে প্রশ্ন করবার আগেই তিনি উত্তর দিলেন। হ্যা পারতাম, আমি পৌছে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়।
একটু সাহস করে বলে ফেললাম কেন সম্ভব নয়। তিনি উত্তরে বললেন; শুনবেন কেন আমি টিঠিটা পৌছে দিতে পারিনি। হ্যা বলুন, প্রতি উত্তর পেয়ে তিনি আমার পাশে একটু দুরে মাটিতে বসলেন আন্দাজ করতে পারলাম। একটা বাতাস শো শো করে বয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে তার কথা শুনবার জন্য স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করতে থাকলাম। তিনি আবার বললেন আমাকে ভয় পাবেন না, শুনুন তাহলে কেন চিঠিটা আমি আজো বয়ে চলেছি;

আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ি। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে শুনি লুৎফর যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং এ যাচ্ছে। সে মাকে বলতে এসেছিলো। বইগুলো টেবিলে রেখে বের হয়ে গেলাম এবং লুৎফর কে খুজতে তাদের বাসায় গিয়ে শুনি সে চাচিকে বলে ট্রেনিং এর জন্য চলেগেছে, চাচি আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন। আমি কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি আমজাদের খোজে ওদের বাড়ি গেলাম এবং সেখানে লুৎফর কে পেয়েগেলাম। ওরা দু’জনই আমার ছোট বেলার বন্ধু, আমরা একসাথে বড় হই এবং আমরা একি স্কুলে পড়তাম। আমি লুৎফর কে বললাম আমি তোদের সাথে যাবো। লুৎফর আমাকে বললো; আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমরা এখুনি বের হবো। তুই আমাদের সাথে যেতে চাইলে তাড়াতাড়ি মাঠের পাশে বটগাছের কাছে আয়, আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করবো। আমি আর দেরি না করে বাড়িতে এলাম এবং মায়ের সামনে দাড়াতেই মা চোখের জল মুছে বললেন। সাবধানে যাস। তোদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আমি চেয়ে থাকবো। সেই রাতেই আমরা নদী পার হয়ে ইন্ডিয়া গেলাম ট্রেনিং নিতে।
ট্রেনিং শেষে আমরা ফিরে এলাম। আমজাদ কে ৯ নম্বর সেক্টরে দেওয়া হলো, আমি আর লুৎফর ৮ নম্বর সেক্টরে পড়লাম। লুৎফর আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। আমরা একটানা ৫দিন মাদারিপুর একটা ঝোপের আড়ালে আটকা পড়ে রইলাম। চারপাশে পাকিস্তানিদের ঘাটি, বের হবার কোন পথ নেই আবার তারা সংখ্যায় আমাদের থেকে অনেক বেশি। রাতের অন্ধকারে আমাদের গ্রæপ থেকে ৪ জন চলেগেলো যশোর। ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করবো। ওরা আর একটা গ্রæপ এর সাথে ফিরে এলে আমরা হানাদারদের ঘাটি আক্রমন করবো। আমরা ৫ দিন কিছু খাইনি। বাশবাগানের পাশে ঝোড়ঝাড়টাই আমাদের প্রতি প্রহরের সাক্ষী। কিছু দুরে হানাদারদের বিশাল ঘাটি। একটু পর পর হানাদারদের বুটের শব্দ আমাদের বুকের ঘরে ঠকঠক আঘাত হেনে যায়। এই বুঝি হানাদারদের বুলেট এসে ঝাঝরে দেয়। মাঝরাতে ধর্ষিতা কোন বোনের চিৎকার শুনে বের হয়ে গেলাম। আমার পাশে একটা আলো এসে পড়তেই মাটিতে মিশে গেলাম। আলোটা ঘুরে যেতেই ফিরে এলাম ঝোপের মধ্যে।
পাশথেকে মতিন বললো এর থেকে একটাকে নিয়ে মরা অনেক বেশি সুখের। চল অমরা আজ রাতেই ঘাটিটা গুড়িয়ে দেই। ইয়াকুব বলে উঠলো; ক্ষুধার্ত নেকড়ে সিংহের থেকে হিংস্র বটে কিন্তু একশোটা কুকুর একটা সিংহের জন্য ভয়ংকর। লুৎফর বললো; এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত একটা পরাজয়ের জন্য কম কিছু নয়, ওরা ফিরে আসুক। এভাবে ঝোপের ভিতরে ৬দিন কেটে গেলো, ৭দিনের দিন সন্ধ্যায় ওরা যশোর থেকে ফিরে এলো। আমরা সংখ্যায় ভারি হলাম। লুৎফর সবাইকে বললো; আজ রাতে আমরা হানাদারদের ঘাটি আক্রমন করবো।
লুৎফর সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে বললো; একটা কাগজ আর কলম এনে দিতে পারবি। আমি সেই রাতেই পায়ে হেটে চলেগেলাম মেহেরপুর। সমস্ত বাড়ি ঘর হানাদাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। একটা ভাঙা বাড়ির ভিতরে ঢুকে কোথাও কেউ আছে কি দেখতে লাগলাম। হটাৎ একজন বৃদ্ধা ল্যাম্পো ধরিয়ে আমার সামনে এসে বললেন; খোকা ? আমার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রæ গড়িয়ে পড়লো। আমি না বলতেই তিনি বললেন; ও আমি ভেবেছিলাম আমার খোকা।
তিনি বললেন; আমার খোকা কেমন আছে বলতে পারো। কোন উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বললেন; ভাত খাবি বাবা। ঠিক মতো খেতে পাস না বুঝি ? তোরা কেমন আছিস ? সারাক্ষন বুঝি তোদের পালিয়ে বেড়াতে হয়। আয় তোকে ভাত দেই। আমি উত্তরে বললাম। আমাকে এখুনি যেতে হবে। তুমি আমাকে একটা কাগজ আর কলম দিতে পারবে। বৃদ্ধা উত্তরে বললেন; ওরা খোকার বইগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। তুই একটু দাড়া বাবা, আমি দেখি কোথাও একটা কলম পাই কিনা। একটু পরে বৃদ্ধা একটা কাগজ আর একটা কলম এনে দিলেন আমার হাতে।
কলমের পিছনটা আগুনে পুড় গেছে। হয়তো খোকার পোড়া কলমটাকেই বুকে আগলে রেখেছে বৃদ্ধা। কলম আর কাগজটা নিয়ে বৃদ্ধাকে বললাম আমি আসছি। বৃদ্ধা আমার হাতে গামছায় বাধা একটা টোপলা দিয়ে বললেন; এতে কিছু চিড়ে আর কয়েক টুকরো গুড় আছে, তোরা সবাই মিলে খাস। ঘরে আর কিছু নেইরে, তোদের দেবার মতো।
হটাৎ বুটের শব্দ, আমি টোপলাটা ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। কিছুদুর যেতেই বুলেটের শব্দ আমার কানদুটো ভারী করে তুললো। হয়তো হানদারদের বুলেট, বৃদ্ধাকেও শেষ রেহাই দিল না। একটানা দৌড়াতে দৌড়াতে মাঝরাতে আমি মাদারিপুর সেই ঝোপের ঝাড়ে ফিরে এলাম। লুৎফর আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। অন্যরা সবাই সবার পজিশনে চলেগেছে। লুৎফর আমাকে বললো; আমরা ভোর হবার আগেই হানাদারদের ঘাটি আক্রমন করবো। হাতে সময় খুব কম। তুই একটু চুপ করে বসে নে।
লুৎফর একটু গাছের ফাকাতে গিয়ে চাঁদের আলোয় কাগজে একটা চিঠি লিখে আমার হাতে এনে দিয়ে বললো; কালকে হানাদারদের ঘাটি আক্রমনের পরে এই চিঠিটা নিয়ে প্রিয়ন্তীকে দিস। দেখিস, আমরা কাল হানাদারদের ঘাটি গুড়িয়ে দেবো। আর যদি কারো বুকে গুলি লাগে সে যেন আমি হই। চিঠিটা হাতে নিতেই একটা বুলেট লুৎফরের বুকে এসে বিধলো। আমাদের কথার মাঝে হানাদারদের দু’জন সৈন্য কখন আমাদের পিছন দিকে বন্দুক তাক করেছিলো তা আমরা একট্ওু বুঝতে পারিনি। লুৎফরের বুকে গুলি লাগার শব্দ শুনতেই হাতের মেশিনগানটা আর থামিয়ে রাখতে পারলাম না। আরো পরে আক্রমন করবার কথা থাকলেও আমি টিগার চেপে হানাদার দু’জনের বুক ঝাঝরে দিলাম কিন্তু চোখের জল থামিয়ে রাখার শক্তি আমার ছিল না। লুৎফরের বুকের রক্তে আমার দু’হাত ভেসে যেতে লাগলো। লুৎফরকে স্বজোরে বুকে জড়িয়ে ধরে গুমরে কেঁদে উঠলাম। চিঠিটা যে প্রিয়ন্তীকে দেবার জন্য লুৎফর আমার হাতে দিয়েছিলো, তার সাথে লুৎফরের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।



লুৎফর প্রিয়ন্তীকে কথা দিয়ে এসেছিল, যুদ্ধ থামলে সে প্রিয়ন্তীকে বউ করে ঘরে নিয়ে আসবে।
কিন্তু ............
গুলির শব্দ পেয়ে আমাদের সবাই চারপাশ থেকে হানাদারদের ঘাটি আক্রমন শুরু করলো। আমি পিছন থেকে না গিয়ে সামনের দিক থেকেই অগ্রসর হলাম। হানাদারদের ঘাটি মুহূর্তে গুড়িয়ে গেলো। আমরা সফল হলাম কিন্তু লুৎফরসহ আরো ৮জন কে হারালাম। সবাই আমরা এক হয়ে যশোরের দিকে অগ্রসর হলাম। ভোরের আলো পৃথিবীকে ছুঁয়ে দিয়েছে। সূর্যের লাল আভা দিগন্তের কপালে লাল টিপ পরিয়েছে, আমরা ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। হটাৎ লুৎফরের জন্য ভিতরটা কেমন যেন করো উঠলো। পকেটের ভাজে চিঠিটার শূন্য উপস্থিতি, থমকে দাড়ালাম।
শুলতান বললো; কিরে থামলি কেন ? কোন উত্তর না দিয়ে পিছু ফিরে চাইলাম। হয়তো লুৎফরকে যখন বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তখন চিঠিটা সেখানে ফেলেদিয়েছি। শুলতান কে বললাম, আমি একটু পরে আসছি। তোরা আমার জন্য অপেক্ষা না করে এগিয়ে যা।
আমি যশোরে তোদের সাথে দেখা করবো। ওরা সবাই আমার জন্য থেমে গেলো। আমাকে রেখে কেউ যেতে রাজি হলো না কিন্তু আমার কথাতে ওরা সামনে এগিয়ে গেলো। আমি পিছনের পথ ধরে ফিরতে লাগলাম মাদারিপুর। সকালের সূর্য সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেছে। আমি একা ছুটে চলেছি পুরানো গন্তব্যে। দীর্ঘ ৩ঘন্টা ৪৯ মিনিট পর আমি ঠিক ঝোপের কাছে ফিরে এলাম। একটা কুকুর লুৎফরের দেহটাকে ছিড়ে খাচ্ছে, একটু পাশে রক্তে মাখা চিঠিটা পড়ে আছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কুকুরটা দৌড়ে পালালো। একদল মানুষরুপী কুকুরের ঠকঠক বুটের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো। আমি চিঠিটা হাতে তুলে নিতেই একটা বুলেট আমার বুকে বিধেগেলো। পরপর কয়েকটা বুলেট আমার সমস্ত শরীরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিলো। শক্ত করে চিঠিটা হাতের মুঠোয় আটকে ধরে রইলাম। হানাদারদের ঘাটি গুড়িয়ে দেওয়াতে, আরো বেশি সংখ্যায় হয়ে তারা গুড়িয়ে দেওয়া ঘাটিতে ওত পেতেছিলো। আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো, শক্ত করে চিঠিটা ধরে রাখলাম। আমি লুৎফর কে কথা দিয়েছিলাম, চিঠিটা প্রিয়ন্তীকে পৌছে দেবো কিন্তু হানাদারদের বিষাক্ত ছোবল আমার পায়ে মৃত্যুর শিকল পরালো। সেই থেকে চিঠিটা আমি আজো বয়ে চলেছি। তুমি এটা প্রিয়ন্তীকে একটু পৌছে দিও, আর বলো, চিঠিটা লুৎফর তাকে লিখেছিলো।
হটাৎ শো শো শব্দটা থেমে গেলো, কোথাও কোন শব্দ নেই। ভারী বাতাসটা যেন মুহূর্তে উধাও হয়েগেলো কিন্ত আমার হাতের মুঠোয় একটা কাগজের টুকরো অনুভব করতে লাগলাম। অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে থাকলো।
চোখ বন্ধ করে তখনো আমি বসে। হটাৎ একটা বৃদ্ধ কন্ঠস্বর। কে তুমি বাবা ? এত ভোরে এখানে কেন মরতে এসেছো। চোখ খুলতেই দেখি আমার সামনে একজন বৃদ্ধ দাড়িয়ে।
তিনি আমাকে জানালেন। আমি যেখানে বসে আছি তার পিছনে একটা বদ্ধভূমি। ১৯৭১ এর যুদ্ধের সময় এখানে গণকবর দেওয়া হয়। কিন্তু দিনের বেলাতেও এখানে কেউ ভয়ে আসে না। যুদ্ধের সময় বৃদ্ধের একটা সন্তানকে এখানে কবর দেওয়া হয় যেনে, বৃদ্ধ প্রতি ভোরে এখানে এসে একবার ঘুরে যায়।
বৃদ্ধকে কিছু না বলে হাতের কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তেমাখা একটা কাগজ আমার হাতে যা অনেক যন্তে বহু ভাজে বিভক্ত। দেখে নিশ্চিত হলাম এটা সত্যি একটা চিঠি।
ভাঁজ না খুলে, চিঠিটা যন্তে ব্যাগের ভিতরে রেখে দিলাম এবং বৃদ্ধের কাছ থেকে বাড়ি ফিরবার পথ যেনে নিলাম। ফিরবার সময়, মনে হাজার প্রশ্ন এসে জাল বুনতে শুরু করলো। রাতে আমি কার সাথে কথা বলেছি ? আর সত্যি সে কে ছিল ? মনে করতে লাগলাম রাতের কথাগুলো। একসময় মনে পড়লো, রাতের অন্ধকারে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে কন্ঠস্বরটি আমাকে একটা ঠিকানা দিয়েছিলো চিঠিটা পৌছে দেবার জন্য। আমি ব্যাগ থেকে একটা কলম বের করে ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে ব্যাগে রেখে দিলাম। বাড়ি ফিরে পরদিন ঠিকানাটা এবং চিঠিটা নিয়ে প্রিয়ন্তীর খোজে বের হলাম। ১৯৭১ সালের প্রিয়ন্তী হয়তো আজ ৫২ বছর বয়সকে পিছে ফেলে এসেছে। লোকমুখে জানতে জানতে সন্ধ্যায় আমি ঠিকানার কাশিমপুর গ্রামে এসে একজন বৃদ্ধ দাদুর মুখে শুনলাম সৈয়দ নামে একজন শিক্ষকের প্রিয়ন্তী নামে একটা মেয়ে ছিলো। যুদ্ধের আগে যার বিয়ে ঠিক হয় কিন্তু যুদ্ধের সময় সৈয়দ মাস্টারকে হানাদাররা ধরে নিয়ে যায় এবং পরে তার আর কোন খোজ পাওয়া যায় নি। মাস্টারের মেয়ে আগের রাতে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়াতে হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে যায় এবং পরে একজন সম্ভ্রন্ত পরিবারের ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। অনেকের কাছে জানবার পর একজন ভদ্রলোকের থেকে জানতে পারি প্রিয়ন্তী নামের মেয়েটির বিয়ে হয় জাহারপুর একটি ছেলের সাথে। জাহারপুর এর ঠিকানাটা অনেক কষ্টে যোগাড় করে সেদিন বাড়ি ফিরে আসি এবং পরদিন জাহারপুর গিয়ে জানতে পারি কাশিমপুরের প্রিয়ন্তী নামের যে মেয়েটি জাহারপুর চৌধুরী পরিবারে বউ হয়ে আসে, সে মেয়েটিসহ তারা এখন স্বপরিবারে ঢাকায় থাকে।
তাদের ঠিকানা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি কিন্তু প্রিয়ন্তীকে দেখার ইচ্ছা আমার মাঝে চেপে বসে। আর তাছাড়া সেই রাতের ছায়মূর্তি এবং চিঠিটা আমাকে প্রতি মুহূর্ত তাড়াকরে চলে। এদিকে ক্যাম্পাস স্বাভাবিক হওয়াতে ক্লাস শুরু হয়ে যায়। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে না ফিরে সোজা ঠিকানা ধরে ঢাকায় চলে যাই। অনেক কষ্টে চৌধুরী পরিবারে গিয়ে দেখা পাই প্রিয়ন্তী চৌধুরীর। কিন্তু দুই সন্তানের জননী প্রিয়ন্তী চৌধুরী আমাকে স্পষ্ট জানান। তিনি লুৎফর নামে কাউকে চিনতেন না কোনদিন। এবং তিনি এটাও জানান, তিনি কাশিমপুর এ সৈয়দ মাষ্টারের মেয়ে ছিলেন কিন্তু তার যুদ্ধের কথা কিছু মনে নেই।
ঢাকা থেকে সোজা ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন বারবার আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে থাকে। সেদিনের ছায়া মূর্তি যদি ঠিক বলে থাকে তবে আজকের প্রিয়ন্তী চৌধুরী সেদিনের সেই প্রিয়ন্তী, যার সাথে ৪২ বছর আগে লুৎফরের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এবং এই সেই প্রিয়ন্তী যে একদিন লুৎফরকে কথা দিয়েছিলো তার জন্য পথ চেয়ে থাকবে।
মাঝরাতে চিঠিটা হাতে তুলে নিতে চোখের সামনে সেই সাদা পোশাকের ছায়মূর্তি যেন ভেসে উঠতে লাগলো, সেই কন্ঠস্বর, সেই শো শো শব্দ আর সেই ভারী বাতাস। সবটাই যদি ঘোর বা মোহ হয় তবে হাতের চিঠিটা কোথা থেকে এলো আর চিঠিতে কেনই বা রক্তের ছাপ। প্রশ্নকে পিছনে ফেলে একা নির্জণ রুমে বসে চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলাম।

রক্তে মাখা চিঠিটায় স্পষ্ট অক্ষরে লেখা কিছু শব্দ বুকে দাগ টেনে গেলো;

প্রিয়ন্তী,
ভালোবাসা নিও। আজ রাতে আমরা হানাদারদের ঘাটি আক্রমন করবো। আমরা এখানে দীর্ঘ ৭ দিন ঝোপেড় আড়ালে প্রতি প্রহর গুনেছি। আমাদের কারো পেটে কোন খাবার পড়েনি, প্রতি মুহূর্ত হানাদারদের বুটের শব্দ আর আত্মউল্লাস অমাদের বুকে বারুদ হয়ে নতুন এক একটা স্বত্তার জন্ম দিয়েছে। একজন প্রিয়ন্তীকে ফেলে আসতে হয়েছে, কিন্তু শত শত প্রিয়ন্তীর ধর্ষিত আর্তনাদ প্রতি প্রহরে আমাদের কানে এসে যন্ত্রনার ছিটেফোটা ছিটিয়ে দেয়। বুকের রক্তে বারুদের জন্ম হয় সহস্র যন্ত্রনায়, তবু আমরা অসহায়, সংখ্যায় সামান্য, শত্রুর মোকাবেলা করবার পর্যপ্ত গুলি বা অস্ত্র কোনটাই আমাদের নেই। শুধু বুকভরা স্বদেশ প্রেম আমাদের চূড়ন্ত জয়ের একমাত্র হাতিয়ার।
একটু পরে আমরা হানাদারদের মুখোমুখি হবো। যদি কারো বুকে গুলি লাগে সে যেন আমি হই। আমার জন্য অপেক্ষায় থেকো কিন্তু আমার জন্য প্রতিক্ষায় থেকো না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইদুল আলম সিদ্দিকী শুভ কামনা রইল লেখাটার জন্য...।
গোবিন্দ বীন বেশ ভাল চমৎকার।। "আমার চলতি সংখ্যায় কবিতা গুলো পড়ার আমন্ত্রণ করে গেলাম। আশা করি আমার পাতায় আসবেন "
thanks...............abong apnar patay nimontron korbar jonno onek khushi holam
মাহমুদ হাসান পারভেজ খুব ভালো লাগলো গল্পটি। শুভকামনা সবসময়।
onek valo laglo apnar kotha gulo............apnar protio onek onek suvo kamona roilo
সোপান সিদ্ধার্থ এরকম লক্ষ লুৎফরদের কাছে আমরা ঋণী। প্রিয়ন্তীরা ভালো থাকুক। ভালো লিখেছেন প্রিয় জ্যোতির্ময় হালদার। শুভ কামনা ও ভোট রেখে গেলাম।
apnar jonno onek onek suvo kamona ..............apnar lekha kotha gulo onek besi valolaga hoye thakbe...........
শামীম খান সুন্দর লিখছেন জ্যোতির্ময় । শুভকামনা আর ভোট রইল ।
অনেক ভালোলাগলো আপনার শুভ কামনা পেয়ে..............আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো....

২৭ জুন - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪