ট্রেন উঠে বুঝতে পারি যে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। আমি আর আমি নই। আর.কে সিং নামের ৪৬ বছরের একটা অশরীরী আমার ওপর ভর করেছে। যাকে জানি না, চিনি না, তার পরিচয়েই কাটাতে হবে এই দীর্ঘ পথ।
লাল জ্যাকেট পরা কুলিটা যখন কনফারমড টিকিটটা আমার হাতে ধারালো তখন ট্রেন চলতে শুরু করেছে। টিকিটের আসল মালিকের নাম আর বয়সটা ওর মুখে যখন জানতে পারি তখন আমি ট্রেনের ভেতরে। ভেবেছিলাম ম্যানেজ করে নেবো। কিন্তু লাগেজগুলো নিজের বার্থে রাখতে গিয়েই ইন্দ্রকে দেখি। গায়ে কালো কোট যখন, এই কোচের এ্যাটেনডেন্ট হবে।
এই মুহূর্তে সব রাগটাই গিয়ে পড়ে মৌ-এর উপর। আপের বাড়ী নিয়ে বাড়াবাড়িটা ওর বরাবরের অভ্যাস। বিয়ে হওয়া থেকেই শ্বশুরমশাইকে বায়ুরোগে ভুগতে দেখেছি। ইনকাম ট্যাক্সের বড় অফিসার হওয়ার সুবাদে একটু হাঁচি, কাশি হলেই সুপারস্পেশালিটি হসপিটালের এ.সি. কেবিন আর তাই নিয়ে মা-মেয়ের মসান আদিখ্যেতা।
আমার হয়েছে শাঁখের করাত। দিল্লির এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরীটা শ্বশুরমশাইয়ের সুপারিসে বলে আমাকেও একটু আধটু ওদের তাঁবেদারি করতেই হয়।
'অন্যের টিকিটে রেল ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ' সেটা জেনেই আমি ট্রেনে উঠেছি। এখন আমার মান ইজ্জত সবই ইন্দ্রর হাতে। প্রায় একযুগ আগের সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার হাতে গরম সুযোগটা তার হাতে যে এইভাবে তুলে দেবো ভাবিনি।
এখনও ইন্দ্রর মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন নজরে এলো না। কানের পাশে দু-একটা চুল সাদা হলেও বেশিরভাগটাই ঘন কালো আর পরিপাটি করে আঁচড়। আগের মতোই শ্যামল দোহারা চেহারা, পাঁচ ফুটের ওপর উচ্চতা। দুটো চোখে কালো ফ্রেমের পুরনো স্টাইলের চশমা, যার পিছনে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ঠিক আগের মতোই।
ইন্দ্র যখন অন্যান্য যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষায় ব্যস্ত আমি নিজেকে একটু আড়াল করেই নিজের কুপেতে চলে আমি। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় নরম বিছানাটা দেখে কবিগুরুর বিখ্যাত গানের লাইনটা মনে পড়ছিলো,
মাল্য যে দংশছে হায়, তব শয্যা যে কন্টকশয্য।
ইতিমধ্যে সান্ধ্য চায়ের আসর শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার কুপেতে আমি ছাড়া সবাই অবাঙালি ব্যবসার খাতিরে কোলকাতায় সেটেল্ড। আমার চেহারায় বা আদব কায়দায় একটা পাতি বাঙালিয়ানা খুব স্পষ্ট। সেই কারণে ওরা আমার সাথে ভাঙাচোরা বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে।
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমি একটু এড়িয়ে গিয়ে শুধু হাঁ, হুঁ দিয়েই সারি।
সন্ধ্যে হতে এখনও বাকি। ট্রেনের গতি সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আমার হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানিটা। তবুও যতটা পারি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি।
'সিং' টাইটেলটা বেশ গোলমেলে। অনেক সময়ই বাঙালি 'সিংহ'দেরও সিং বেরোয়। যেমন দত্ত- দত্তা হয়, ভট্টাচার্য ভট্টাচারিয়া- অনেকটা সেরকম। ভয়টা শুধু ইন্দ্রকে নিয়েই। ওর চোখে ফাঁকি দেওয়া কি সহজ হবে?
স্কুলের মাঠে এ্যানুয়াল ফাংশনে স্টেজে রুনা লায়লা গান গাইছিল। গানের মূর্ছনায় সবাই মসগুল। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে ঈপ্সিতা আমাকে ইশারা করে। ও আমার থেকে দু-ক্লাস নিচে পড়তো।
একতলার সিঁড়ির নিচেটা বেশ অন্ধকার। দুজনে সেদিকেই চলে যাই। হঠাৎই ঈপ্সিতা আমাকে জড়িয় ধরে চুমু খায়। প্রথমে একটা তারপর অনেকগুলো। থামার নাম নেই। ওই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। হাত পা রীতিমতো কাঁপতে থাকে। যদিও একটা মিষ্টি আবেশ আমাকে আচ্ছন্ন করে তোলে।
ফিরে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি পেছনে ইন্দ্র। সেদিনও ওই কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখা।
তারপর দু-তিন দিন ভয়ে ভয়েই ছিলাম। হেডমাস্টারের কানে গেলে নিশ্চয় গর্জেন কল। তারপর রাস্ট্রিকেট। কপালে কি আছে কে জানে!
কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আড়ালে পেয়ে ইন্দ্র বলেছিল, স্টুডেন্ট লাইফে এগুলো কনসেনট্রেসন নষ্ট করে। কেরিয়ারের পক্ষে খুব খারাপ।
আমাদের কুপে থেকে কিছুটা দুরে ইন্দ্র নিজের কাজে ব্যস্ত। এক একজনের টিকিট নিয়ে চার্টে টিক লাগাচ্ছে। সন্দেহ হলে কারো কারো আইডি কার্ডও দেখতে চাইছে।
ট্রেনের গতিটা একই। হাল্কা দুলুনিতে অনেকেরই চোখ ঢুলুঢুলু। জানালায় চোখটা রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। আর.কে সিং নামটা বারবার মনে রাখার চেষ্টা করি। ভুলে গেলেই সর্বনাশ। আলিবাবার চিচিং ফাঁক, চিচিং বন্ধ এর
মতো। মনে থাকলে রাজা- ভুললে মৃত্যু। জেল, জরিমানা, বেইজ্জতি। খবরেরকাগজের স্কুপ নিউজও হতে পারে। দিল্লিতে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বাঙালি যুবক অন্যের টিকিটে রেল ভ্রমণের দায়ে জেলে।
মা বলতেন, বিপদে পড়লে রামকৃষ্ণের নাম জপ করবি। বিপদ কেটে যাবে। আর.কে কথাটার মধ্যেও বোধহয় তাঁরই ইচ্ছা লুকিয়ে আছে।
আমাদের বাড়ীর নিচের তলাটা ভাড়া দিতে বাবার সায় ছিলো না। মা-ই জিদ করে।
- সদ ব্রাক্ষ্ণণ। ছেলেপিলে নিয়ে বিপদে পড়েছে। নবদ্বীপে নিজের জমিজমা বাড়ী আছে। রিটায়ারের পরে সেখানেই চলে যাবে। কটা দিনের জন্য থাকতে চাইছে।
মা-এর ওকালতিতে বাবাকে রাজী হতে হয়। ইন্দ্র আমার সাথে একই ক্লাসে পড়তো। বারবার ভালো রেজাল্টের জন্য সরকারী স্কলারশিপও পেতো।
ইন্দ্রর বাবা ছিলেন রেলের ফোর্থক্লাস স্টাফ। চার ভাই-বোনের মধ্যে ইন্দ্রই বড়। সামান্য আয়ের সংসার চলতো না বলে ওর বাবা বারে বেবারে পুজো আচ্ছার দিনে বাড়ী বাড়ী পুজো করতো।
প্রথম প্রথম ইন্দ্রকে নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। সমস্যা শুরু হল মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরুনোর দিন। বাড়ী ফিরেই একটা মৃদু ভূমিকম্পের আভাষ পাই। উৎসস্থল আমাদেরই নিচের তলায়।
- তিনটে সাবজেক্টে টিউশন দিয়েও টেনেটুনে পাস। নিচে ইন্দ্রকে দেখে এসো। একটাও টিউশন নেই। পরের থেকে বই খাতা চেয়ে চিন্তে ফার্স্ট ডিভিশন, ছ'টায় স্টার।
রান্নাঘরে মা নিজের মনে গজগজ করতে থাকে। খবরের কাগজের আড়ালে বাবার নীরব অভিব্যক্তিতে একটা মৃদু ভৎর্সনার ইঙ্গিত। সেদিনই বুঝতে পারি যে আমাদের বাড়ীর নিচের তলায় মা খাল কেটে যে কুমীরটা ঢুকিয়েছে তার বিশালাকার মুখটা থেকে আরো কিছুদিন আমরা নিষ্কৃতি নেই।
ট্রেনের গতিটা একটু কমেছে। হয়তো সিগন্যাল পায়নি। তখনই ইন্দ্র আমাদের কুপেতে ঢুকে পড়ে। আমরা ঠিক উল্টোদিকের বার্থের কোনায় বসে পড়ে। বাকি যাত্রীরা এক এক করে নিজেদের টিকিট এগিয়ে দেয়। আমিও পকেট থেকে টিকিটটা বার করে হাতে রাখি। মুখটা জানলার বাইরের দিকে করে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করি।
এ দিকে ৪৬ বছরের আর.কে সিং লোকটা তখন ক্রমশই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। আমার অনধিকার উপস্থিতিটা কোনমতেই সে মেনে নিতে পারছে না। যেনতেন প্রকারেণ আমার আসল পরিচয়টা সকলকে জানিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমরা অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছিল। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসেও ঘামতে শুরু করি। আর মাত্র দু-একজনের পরেই আমার শুনানি, তারপর শাস্তি ঘোষণা। কালো ফ্রেমের হাই পাওয়ার চশমার আড়ালে থাকা দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখের আড়ালে শুধু স্পষ্ট একটা প্রতিহিংসার আভাষ।
চশমা ছাড়া ইন্দ্র কিছুই দেখতে পেতো না, স্কুলে আমরা সবাই জানতাম। একবার চশমার একটা কাঁচ ভেঙে যাওয়ায় ইন্দ্র প্রায় এক সপ্তাহ স্কুলে আসেনি।
এদিকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসছলো ইন্দ্র নামক ভাইরাসটা আমার ভুত, ভবিষ্যৎ বর্তমানকে দুর্বিসহ করে তুলেছিলেন। যেভাবেই হোক ওকে হারানো তখন আমার কাছে শুধুই একটা সুযোগের অপেক্ষা।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন সুযোগটা হাতের মুঠোয় চলে এলো। অন্য স্কুলে পরীক্ষার সীট পড়েছিল। সেকেন্ড হাফে ছিলো অঙ্ক পরীক্ষা। টিফিন করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার মুখেই টয়লেটের দিকে নজর পড়ে। ওপরের তাকে চশমাটা খুলে ইন্দ্র বেসিনে মুখ ধুচ্ছিলো।
পাড়ার কেষ্টদা বলতো যুদ্ধ আর ভালবাসায় সবকিছুই ঠিক। ইন্দ্র আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ওর জয় আমার পরাজয়ের নির্ণায়ক। পা টিপে অতি সন্তর্পণে ওর পাশেই পৌঁছে যাই। আমার উপস্থিতিটা বুঝে ওঠার আগেই তড়িৎ গতিতে ওর চশমাটা তুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। আমার শরীরের সমস্ত গ্রন্থিতে তখন একটা আদিম জিঘাংসা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাওয়ার পথে সেকেলে ওই কালো ফ্রেমের চশমাটা দু-হাতের তালুতে সজোরে চেপে ধরি। টুকরো টুকরো করে ভেঙে বারান্দা থেকে অনেক দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিই।
ইন্দ্রর হাতটা এখন সরাসরি আমার দিকে বাড়ানো। ৪৬ বছরের আর.কে সিং লোকটা এখন বেপরোয়া। প্রাণপণে আমাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
কালো ফ্রেমের হাই পাওয়ারের কাঁচের আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ আমার দিকে তাক করে আছে। ওর দিকে তাকাবার সাহস হয় না। যান্ত্রিক টিকিটটা এগিয়ে দিই।
ইন্দ্র টিকিটটা দেখে চার্টে টিক করে। তারপরে ফিরিয়ে দেয়।
আমাদের কুপ থেকে ইন্দ্র বেরিয়ে যেতেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। শরীরটা বেশ হাল্কা ফুরফুরে মনে হয়। বুঝতে পারি, এতদিন পরে ইন্দ্র হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি।
ইন্দ্র বাকি অধ্যায়টা শুনেছিলাম আমাদের ক্লাসের পার্থর মুখে। হায়ার সেকেন্ডারিতে অঙ্কে ব্যাক পেয়ে ওর পড়াশোনা শিকেয় ওঠে। তারপরে সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে কোনরকমে রেলে একটা চাকরী জুটিয়েছে।
বাইরে বেশ অন্ধকার। ট্রেনটাও এখন সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলেছে। টিকিট পকেটে রেখে কুপে থেকে বেরিয়ে টয়লেটের দিকে পা বাড়াই।
- হ্যাঁরে, মাসিমা মেসোমশাই ভালো আছেন?
এখন রাজধানী এক্সপ্রেসের খালি লবিটায় ইন্দ্রর মুখোমুখি আমি। নির্মল সহিষ্ণুতার মুখোমুখি কৃতকর্মের এক তীব্র অনুশোচনা।
কি জবাব দেবো ভেবে পাই না। ঈষৎ ঘাড় হেলিয়ে বলি, - হ্যাঁ, ভালো। তুই কেমন?
ও জবাব দেয় না, অথবা আমি শুনতে পাই না। আমাকে পাশ কাটিয়ে উল্টোদিকে চলে যায়। ট্রেনটা এখন প্রাণপণে এগিয়ে চলেছে। সামনে আঁকা বাঁকা রেললাইনটা সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে দুরে-দূরান্তরে। যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
১৭ জুন - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
২৯ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৮৪
বিচারক স্কোরঃ ২.৯২ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৯২ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪