ভোর রাতে বিকট একটা শব্দে অলকার ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শম্ভুকে পায় না। ছেলে মেয়ে দুটো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। - এত ভোরে গেলো কোথায়? আগলটা খুলে অলক বাইরে বেরিয়ে আসে। একটু একটু করে আলো ফুটছে। অচলা বৌদির মেজছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে। এলোমেলোভাবে অনেক কিছু অলকাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। নদীর ধারে তেঢ্যাঙা শিরিস আলকার খুব চেনা। প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে পা-দুটো টেনে অলকা শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ***** বলি বলি করেও শম্ভুর সামনে মুখে রা কাড়তে পারে না। এটা ছোটবেলার অভ্যাস। হরিমতি বলতো, বাপ সোহাগীর পেট ফাটে তবু মুখে ফোটে না। একদোয়াত কালির অভাবে চড়কতলায় শেতলা মন্দিরের দোরগোড়ায় মখ গুঁজে স্কুলের সময়টা পার করে ঘরে ফিরতো। ছাগল গরু বাঁধতে গিয়ে কেউ দেখতে পেয়ে হরিমতিকে নালিশ করে। হরিমতি মেয়ের কষ্টটা বুঝতো। একটা মানুষের দিন মজুরিতে পাঁচ পাঁচটা পেট। অলকার কোলেই ভাই বোনেরা বড় হয়েছে। রান্নাবান্না ছাড়া হরিমতিকে কুটোটিও কাটতে দিতো না। স্কুলের পথেই অলকাকে দেখে শম্ভুর পছন্দ হয়ে যায়। - ছেলের তিনকুলে কেউ নেই। নিজস্ব পৈত্রিক ভিটে আর বিঘে খানেক জমি। বলদ লাঙল নিজস্ব শুধু হাতপুড়িয়ে খায়। সারাদিন দিন মজুরি খেটে সন্ধ্যের মুখেই পরান ঘরে ফেরে রোজকার মতো। অলক একঘটি ঠান্ডা জল নিয়ে বাপের সামনে হাজির হয়। যুগলপিষি শম্ভুর দূত হয়ে এসে তখনই কথাটা পাড়ে। ছেলের মেয়েকে পছন্দ। নিজের খরচাতেই শাঁখা সিঁদুর দিয়ে ঘরে তুলবে বলেছে। এখন কত্তাগিন্ন হ্যাঁ করলেই হয়। ***** ফুলশয্যার রাতে আচমকাই শম্ভু কান্ডটা করে বসে। বিয়ের পর নয় নয় করে দশটা বছর হয়ে গেলো শম্ভু প্রথমটা মেয়েই চেয়েছিল। সাততাড়াতাড়ি নামই ঠিক করে ফেলে সে, 'পাপড়ি'। আসলে ফুল ভালোবাসতো ভিষণ। নিজস্ব একবিঘে জমি ছাড়াও বেশ কিছু জমি ভাগে করতো। গাধার খাটুনি খাটতে পারতো। কাকভোরে উঠে গরু লাঙ্গল নিয়ে যে বেরুতো, ফিরে আসতো সন্ধে নামতে। নিজের হাতেই গরুগুলোকে গোয়ালে বেঁধে জাব জল দিতো। পাপড়ি ছোট থেকেই বাপের ন্যাওটা। এই সময়টা সেও পিছন পিছন ঘুরতো। রঙিন সুতোয় বোনা লাল নীল ফুলের একটা সাজি ওদের শোবার ঘরে টাঙানো ছিল। নিচে লেখা 'সংসার সুখি হয় রমনীর গুণে' শম্ভুর মা'য়ের হাতে তৈরি। অলকা অনেকবার জীদ করলেও মাঠের কাজে শম্ভু ওর সাহায্য নিতে রাজী না। ছেলেমেয়েরা ঘুমোলে অলকা চুপিসাড়ে শম্ভুর বলিষ্ঠ শরীরটা দখল নিতো, ওর নরম দুটো হাত আবাধে শম্ভুর গোটা শরীরটাকে অনেকক্ষণ জরীপ করতে থাকতো। ছেলেবেলায় নিজের প্রিয় পুতুলটার মতো। শম্ভুর মেদহীন পেশীবহুল দেহটা নিস্তেজ হয়ে নিঃস্বর্তে আত্মসমর্পণ করতো। ফুলসজ্জার রাতে শম্ভু প্রায় জোর করেই নিজের জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। কনের সাজটুকুও বদলাতে সময় দেয়নি। ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত ছিলো সেটা। ছোট ছোট চারার মাথায় ধানের শিশগুলো এলোমেলো হাওয়ার সাথ খেলে বেড়াচ্ছিল। বিয়ের পর কটা বছর ওদের সুখেই কাটছিলো। বিশেষ করে যে বছর মিঠুন হলো সে বছর শম্ভু ফসলের দাম ভালোই পেয়েছিল। অলকা না চাইতেই ওকে দুহাতে চারগাছা ব্রোঞ্জের চুড়িও কিনে দিয়েছিলো। ***** ***** গত বছর থেকেই ওদের সময় খারাপ হতে করলো। প্রায় ১৪-১৫ দিন ধরে অশ্রান্ত বৃষ্টিতে পাকা ধান জলের তলায় তলিয়ে গেলো, একটা দানাও ঘরে তোলা গেলো না। এবছরও আমন ধানের ফলন ভালোই ছিল। শম্ভুকেও কিছুটা উৎসাহিত মনে হয়েছিলো। আমায় পুজোর সময় পায়েল গড়িয়ে দিতে হবে বলে দিচ্ছি। আদর খেতে খেতে আব্দার। একটু দুরেই মিঠুন খেলায় বিভোর ছিলো। দিদির আর্জ্জি মিটাতেই সেও দৌড়ে এসে বাবার গলাটা ধরে, আধো সুরে বলে, আমাকেও লাল জুতো আর বন্দুক কিনে দেবে। - হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ, ধান উঠলে তোদের সব দাবী মিটিয়ে দেবোখোন। দুটো ছেলেমেয়েকে শম্ভু বুকের মধ্যে চেপে ধরে। রান্নাশালা থেকে অলকা মুখ টিপে ওর এক হাতে শাঁখাটা ভেঙেছে। ঘোষালগিন্নি বলেছিলেন, '- শাঁখা ভেঙে গেছে বলতে নেই বাছা, বলবে বেড়ে গেছে।' পাশের বাড়ীর আচলা বৌদি একটু বেশীই খুঁতখুঁতে প্রকৃতির। বলেছিলো, এয়োতি মানুষ হাত খালি রাখতে নেই। কজ্বীতে আঁচলটা জড়িয়ে রেখো। এতকিছুর পরেও শম্ভুর সামনে মুখে 'রা' কাড়তে পারে না অলকা। সংসারে নানান চাহিদা মেটাতে এমনিই মানুষটা কাহিল তার ওপর আবার বাড়তি চাহিদা। মন সায় দেয় না। ***** অলকার কোন হুস ছিলো না। শরীরটাকে নিয়ে পা-দুটো আর এগুতে পারছিলো না। শাড়ীর আঁচলটা ধুলোয় লুটোচ্ছিলো। চোখের সামনে চাপ চাপ ধুঁয়া পায়ে চলার পথটাকে ক্রমশই অস্পষ্ট করে তুলছিলো। নদীর পাড়ে সিরিস গাছটা তো ওর খুব চেনা। তাহলে এতো দুর মনে হয় কেন? কোথা থেকে কি হয়ে গেল, অলকা কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলো না। এবছর ফলন খুব ভালোই হয়েছিল। কিন্তু দর কোথায়? ধান পাটায় পড়ার আগেই মহাজনদের লাইন পড়ে যায়। ফোড়েরা যা দাম দেয় তাতে সারা খোলের দামই পুরো হয় না। শম্ভু কেমন যেন দিশাহারা হয়ে পড়ে। ধানগুলো জলের দরে বিক্রি করে কোনক্রমে দেনা মেটায়। এরই মধ্যে যেটুকু জমা পুঁজি সবটুকুই শেষ কোথা থেকে কি যে হয়ে গিয় ছিলো। অলকার হাতে কগাছা ব্রোঞ্জের চুড়িগুলো বিক্রি করে সেই টাকাতেই নুন-ভাত জুটছিল। শম্ভুও অনেকটা পাল্টে গেলো। হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎই গুম মেরে গেলো। ছেলে মেয়ে দুটোও বাবাকে একটু এড়িয়ে চলছিল। - প্রকৃতির মার-দুনিয়ার বার। তাবলে চাষির ছেলে চাষ করবে নাতো কি চণ্ডীপাঠ করবে? দুলাল শ্যাকরার কথাটা একেবারে ফেলতে পারে না শম্ভু। কিন্তু কপর্দকশূন্য অবস্থা। সার, খোল, বীজ তারপর মুনিষ মজুর ঠেলা। দুলাল শ্যাকরা যেন মুখিয়ই ছিল। সটান শম্ভুর মুখের মধ্যে যেন হাতটা ঢুকিয়ে বাকি কথাগুলো টেনে বার করে আনল। - সে ব্যবস্থা আমিই করবো। ভরাভত্তি সংসারটা তো আর ডুবতে দিতে পারি নে। শম্ভুর মাথায় যেন ভুত চেপেছে। শেষ সম্বলটুকু ওই জমি আর পৈত্রিক ভিটে। দুলাল শ্যাকরার কথামতো টিপ ছাপ দিয়ে দলিলটা তার হাতে তুলে দেয়। এই প্রথম একবিঘে জমিতে শম্ভু আলু চাষ করলো, সার খোল, বীজ সবই দুলালের। তাছাড়াও মনুষ্য মজুরের জন্য নগদ আলাদা। সবুজ সবুজ নধর আলু গাছগুলো শম্ভুর আশার মতোই লক লকিয়ে উঠতে লাগলো নরম তুলোর মতো মাটি। হাত ঢোকাতেই সাদা ধবধবে একরাশ নিটোল আলুগুলো মাটির ওপরে ভেসে ওঠে। বাড়ী ফিরে গামছার খুঁটে আলুগুলো দাওয়ায় নামিয়ে রাখে। অনেকদিন পর অলক শম্ভুর সারা মুখে একটা প্রশান্তি লক্ষ করে। ***** তিন দিন ধরে একঘেয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থামার নাম নেই, তার উপর মাঝরাত থেকে শুরু হল শিলাবৃষ্টি। সারারাত ওরা দুজনেই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পাকা পাকা আলুগুলো একহাঁটু জলের নীচে। ভেজা ওই আলুগুলোর একহাঁটু জলের নীচে। ভেজা ওই আলুগুলোর বাজার দাম নেই, শম্ভু জানে, তার মতো একটা গরীব চাষির স্বপ্ন যেমন। অলকা একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায় আর কখন যে চোখ দুটো বুজে আসে বুঝতে পারে না। তেঢ্যাঙা সিরিস গাছটা এখন অলকার সামনে। প্রাণপণ পা-দুটোকে সামনের দিকে টানতে থাকে সে। খোলা দৃষ্টিতে ঘন মেঘ করেছে। সব কিছু আবছা আবছা। শুধু সামনের ওই গাছটার অনেক উঁচু একটা ডালে শম্ভুর নিথর শরীরটা হাওয়ার সাথে খেলা করছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।