গত কয়েকদিন যাবত স্নেহা তৌহিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে । কিন্তু, করা যাচ্ছেনা । কারণ, তৌহিদ যে ফোন নাম্বার দিয়েছিল, তা প্রায় সময়ই বন্দ থাকে । অবশ্য তৌহিদের সিম কয়েকটা । কোনটা, না কোনটা চালু থাকে, কে জানে ।
আজও কয়েকবার চেষ্টা করল । আশা, যদি ফোন ধরে । ফলাফল শুন্য । ফোন নাম্বার বন্দ । ঘাপটি মেরে বসে রইল স্নেহা । মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল । একটু পরে আবার ফোন দিল । এবার ফোন ঢুকল । ক্রমাগত রিং হচ্ছে । অবশেষে ফোন ধরল তৌহিদ । রাগান্বিত স্বরে জিগ্যেস করল, “কেন ফোন করেছ?”
স্নেহা থতমত খেল । তারপর জিগ্যেস করল, “ভালো আছ?”
আছি । স্নেহা, আমি তোমাকে আগেই বলেছি, “আমি যার সঙ্গে প্রেম করব, তাকে বিয়ে করবনা ।’’
“তাহলে তুমি তোমার বক্তব্যে অনড়?”
“হু ।”
“তোমার আমার এতদিনের সম্পর্ক?”
“আপাতত তার যবনিকা টানছি । তোমার আমার মাঝে যা ঘটেছে, সব ভুলে যাও!”
“তাহলে আমাকে কেন ভোগের সামগ্রী বানালে?”
ওপাশটা নীরব । কিছুক্ষণ পর তৌহিদ বলল, “তোমার পেছনে আমার যত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তা শোধ করার জন্যই…।”
“বিনিয়োগ মানে?”
“তোমার সাথে এতদিন ফোনে কথাবার্তা বলেছি, তোমাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছি; তোমাদের বাসায় গিয়েছি । আমার খরচ হয়নি?”
“এই ছিল তোমার মনে! ছিঃ ছিঃ ।”
“আমাকে আর কখনো ফোন দেবেনা । তোমার পথ তুমি ধরো । আমাকে পাবেনা । রাখি ।”
লাইন কেটে দিল তৌহিদ । চুপচাপ বসে রইল স্নেহা । কেমনে যে কী হয়ে গেল, সে কিছুই বুঝতে পারলনা । নিজের কৃত ভুলের জন্য অনুশোচনা হতে লাগল তার ।
টেবিলের দিকে নজর গেল স্নেহার । দুটো পুতুল একত্রে দাঁড়িয়ে আছে । একটা পুরুষ অন্যটা নারী । এগুলো তৌহিদ তাকে দিয়েছিল । বলেছিল, “তোমার আমার প্রেমের স্বীকৃতিসরূপ এই পুতুল দুটি তোমাকে উপহার দিলাম । যতনে রেখো ।” সেই স্মৃতি আজো ধরে রেখেছে স্নেহা । অথচ তৌহিদ তাকে ভুলে গেছে ।
স্মৃতি পীড়া দেয় স্নেহাকে । সে ভুলতে পারেনা কোনকিছু । প্রতিদিন নিভৃতে চোখের জলে ভাসে । তৌহিদ কীভাবে তাকে ভুলে গেল, সে ভাবতেই পারেনা । অথচ কত কথাই তাকে বলেছিল তৌহিদ । তাকে কখনো ভুলে যাবেনা । তার সাথে ঘর বাঁধবে । সবই কী মিথ্যে? বুকে বালিশ চাপা দিয়ে চোখ বুজে রইল স্নেহা । কান্না পাচ্ছে তার ।
তৌহিদ যেদিন স্নেহাদের বাড়ি এসেছিল, তাকে সুদর্শন লাগছিল । শিক্ষিত ছেলে সঙ্গত কারণেই আধুনিক, স্টাইলিশ । তাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যায় স্নেহা । সুন্দরের প্রতি মানুষের চিরন্তন আগ্রহ । সে বুঝতে পারলনা, আলোর নিচেই অন্ধকার, ফুলের সাথেই কাঁটা থাকে ।
বহুজনের ভিড়ে স্নেহাকে দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠে তৌহিদ । ভালো লাগে তাকে । মনে মনে তাকে কামনা করে । সুযোগ খুঁজতে থাকে কখন স্নেহাকে প্রস্তাব দেয়া যায়!
স্নেহা যথেষ্ট সুন্দরী । এলাকায় তার বেশ চাহিদা । বহু সুদর্শন ছেলে তার পিছে ঘুরঘুর করে । তাকে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব । সে কাওকে পাত্তা দেয়না । অন্যান্য সুন্দরীদের মত তার মাঝেও রুপের অহমিকা কাজ করে ।
একদিন সন্ধ্যাবেলা স্নেহা একা ফুলের বাগানে দাঁড়িয়েছিল । বাড়ির সবাই তখন নানা কাজে ব্যস্ত । তৌহিদ তাকে লক্ষ্য করল । ভাবল, আশপাশে কেও নেই । নিভৃতে একটু কথা বলা যাক । সুযোগ পেলে আসল কথাটাও পাড়া যাবে ।
দুটানায় পড়ে গেল তৌহিদ । যাবে, না যাবেনা! প্রস্তাবে কি রাজি হবে স্নেহা? রাজি না হলে তো মান-ইজ্জত সব যাবে । এত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা ঠিক না । রাজি হলে হল, না হলে নেই ।
তৌহিদ ধীরে ধীরে স্নেহার পিছে এসে দাঁড়াল । স্নেহা টের পেলনা । কিছু সময় অতিবাহিত হল । গলা খাকারি দিয়ে তৌহিদ বলল, “কী করছেন এখানে?” স্নেহা চমকে গেল । নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, কিছুনা । এমনি দাঁড়িয়ে আছি । কিন্তু আপনি এখানে?”
“একা একা ঘরে ভালো লাগছিলনা । তাই চলে এলাম ।”
স্নেহা কিছু বলল না । শুধু মুচকি হাসল ।
স্নেহার ছোট ভাই পুলক এর খৎনা । বাড়িতে বিশাল আয়োজন । অনেকটা হঠাৎ করেই এই আয়োজন করা হয়েছে । বাড়িতে উৎসব উৎসব আমেজ । এলাকার মুরব্বীদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ।
ভাইকে স্নান করিয়ে বাবার কাছে রেখে এল স্নেহা । একটু পরেই তার খৎনা করা হবে । অজানা ভয়ে খুব কাঁদছিল পুলক । বাবা বললেন, “কিছু হবেনা, বাবা! ভয় করিসনা । আমি আছি তো!”
তৌহিদ ঘরে একা বসে আছে । আজ তার মন ভালো নেই । কারণ, এক সপ্তাহ হল, রোকন ভাইয়ের সাথে তার প্রবাসী বন্ধুর বাড়ি এসেছে । গত দুদিন তার হদিস নেই । কোথায় গেছে, বলে যায়নি কিছু!
স্নেহা তার ঘরে খাবার নিয়ে এল । “কী ব্যাপার, মন খারাপ?” স্নেহা জিগ্যেস করল ।
তৌহিদের মুখে কথা নেই । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল । হঠাৎ স্নেহার দিকে তাকাল সে । আসমান থেকে পরি নেমে এল নাকি ঘরে! এ যে স্নেহা । সে চোখকে বিশ্বাস করতে পারলনা । সাজ-সজ্জায় পরিপূর্ণ শাড়ি পড়া স্নেহাকে দারুণ আবেদনময়ী লাগছিল । কামনার দৃষ্টিতে তৌহিদ তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল । স্নেহা লজ্জা পেল । তার সুপ্ত যৌবন বুঝি আজ জাগরিত হল । সে দৌড়ে বাইরে চলে এল ।
চাঁদনী রাত । তারায় তারায় পূর্ণ আকাশ । চাঁদের আলোয় ভুবন আলোকিত । উঠোনের পাশেই বাতাবি লেবুর গাছ । ফুল ফুটেছে । কিছুদিন পর লেবু ধরবে । ওপাশ হতে নির্মল বাতাস আসছে ।
বাড়িতে গল্প গানের আসর বসেছে । প্রধান বক্তা স্নেহার দাদা । অবশ্য দাদীও সঙ্গে আছেন । দর্শক শ্রোতার মধ্যে আছে পুলক, স্নেহা, তৌহিদ, স্নেহার খালাত বোন স্নিগ্ধা, কাজের ছেলে তাজিম ও আরও কয়েকজন । স্নেহার বাবা-মা বাড়ির বাইরে আছেন ।
তৌহিদ ও স্নেহা পাশাপাশি বসে আছে । দাদা ইতিমধ্যে গল্প শুরু করে দিয়েছেন । পেছনের, বর্তমানের; ও আগামীর গল্প । ভূতের গল্প, পরির গল্প । ইতিহাস ও রাজনীতিও স্থান পেল সেখানে । মীর জাফরের চক্রান্ত, সিরাজের পরাজয়, ফকির বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, সিপাহ বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলন, চিটাগাঙের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও তৎ পরবর্তী রাজনীতি ।
রাত্রি গভীর হয়ে এল । মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে । ছোটরা ঘুমিয়ে পড়েছে । স্নেহা তৌহিদের পিঠে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছে । পুলক স্নেহার কোলে ঘুমিয়েছে । দাদীও দাদার পিছেই ঘুমিয়ে পড়েছেন । দাদা গল্প বলেই চলেছেন । এবার পৌরাণিক গল্পের পালা । উল্লেখ্য, দাদা বৃটিশ আমলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন । তিনি বেশ মনোযোগী ছাত্র ছিলেন । পাঠ্য বই ছাড়াও বিভিন্ন বই পড়তেন তিনি । বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেও তাঁর দারুণ জ্ঞান । অথচ, কোন বিশেষ ধর্ম বিষয়ে তার বাড়াবাড়ি নেই । তিনি বহু দেশ ঘুরেছেন, বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন । তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ ।
পনেরো দিন হল এই বাড়িতে এসেছে তৌহিদ । এতদিনে সকলের বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছে । স্নেহার সাথেও তার সখ্য গড়ে ওঠেছে । মনে হচ্ছে সে এই বাড়িরই একজন । তৌহিদ লক্ষ্য করল, সবাই তার প্রতি আগ্রহী । একটু স্বস্তি পেল সে । এবং নিজেকে নিয়ে খুব সম্মানিত বোধ করল ।
“কী করছ?” স্নেহার চপল কণ্ঠস্বর শুনে সচকিত হল তৌহিদ । চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিল সে । রাত একটা বেজে গেছে । এতক্ষণ ঘুম আসেনি । মাত্র চোখ বুজে আসছিল । তাই চেয়ারেই…।
এতরাত্রে পূর্ণ যুবতী একটা মেয়ে তার ঘরে সে ভাবতেই পারেনা । চোখ কচলাল । না, সবই ঠিক আছে । এ স্নেহাই । স্নেহাকে এখন অনেক সুন্দর লাগছে । অবশ্য যারে ভালো লাগে, তারে আপাদমস্তক ভালো লাগে । আর রাতের বেলা সব মেয়েকেই ভালো লাগে ।
তৌহিদের মনে অদ্ভুত এক পাগল জাগল । উন্মাদটা উথাল পাথাল ছুটাছুটি শুরু করছে । ধাওয়া করছে পেছন থেকে । তৌহিদ ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেনা । সে কী করবে? তাছাড়া স্নেহা যে ঢিলেঢালা পোশাক পড়েছে, তাকে দেখে যে কেও উৎসুক হবে । এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।
তৌহিদ মুখ ভার করে অন্যত্র তাকিয়ে ছিল । এমন ভাব ধরল যে বিশাল কিছু ঘটে গেছে । স্নেহা আলতো করে তার পিঠে হাত রাখল । দেহ শিহরিত হল তৌহিদের । ভেতরে কীসের যেন ঢেউ খেলে গেল! কোন কথা বললনা । শুধু বসে রইল ।
স্নেহা কী জিগ্যেস করবে বুঝতে পারছেনা । তৌহিদের সামনে এসে দাঁড়াল । তার মুখ তুলে ধরে জিগ্যেস করল, “তৌহিদ, কী হয়েছে তোমার; এমন করছ কেন?”
একটু ইতস্তত করে তৌহিদ বলল, “এখানে কেও আমাকে ভালবাসেনা ।”
“মানে?”
“ভালবাসলে তো …।”
সাহস করে অতৃপ্ত বাসনার কথা বলে ফেলল তৌহিদ । কোন সাড়া না পেয়ে খুব লজ্জিত হল । কেমন করে বলতে পারল সে? একটু দ্বিধা কাজ করলনা ।
“না, এটা হবেনা; তৌহিদ!”
“কেন হবেনা? আমি তো তোমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি । শিগগিরই তো তোমাকে বিয়ে করছি ।”
অতঃপর তৌহিদ স্নেহার খুব কাছে গেল । স্নেহা বাধা দিতে পারলনা ।
“স্নেহা, স্নেহা ।” মায়ের চেঁচামেচিতে স্নেহার ঘুম ভাঙল । “কিরে, এত বেলা হল, এখনো ঘুম থেকে ওঠছিস না? আজ না তোকে দেখতে আসবে । তাড়াতাড়ি ওঠ, রেডি হয়ে নে!”
স্নেহা কোন সাড়া-শব্দ করলনা । টেবিলের পুতুল দুটো বুকে চেপে ধরল । কান্না পেল খুব । কিন্তু এই দুঃখের কথা কার কাছে বলবে? বুঝল, কী এক অশুভ ছায়া তার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে ।
১১ অগ্রহায়ণ ১৪১৮ বঙ্গাব্দ