আবিদ ও আবীর দুই ভাই । আবিদের বয়স বারো, আর আবীরের দশ । তারা ঢাকার একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ে । আবিদ সপ্তম শ্রেণিতে, আবীর পঞ্চম শ্রেণিতে ।
তাদের অনেক দিনের ইচ্ছে নানার বাড়ি যাবে । তাদের নানার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় । মা-বাবাকেও একাদিকবার বলেছে তাদের মনের কথা । স্কুল, প্রাইভেট থাকার কারণে যাওয়া সম্ভব হয়না । তাদের বাবা আফজাল সাহেব একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন । মা ফারহানা বেগম একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন । তারা প্রচণ্ড রকম ব্যস্ত । ঠিকমত ছেলেদের সময় দিতে পারেন না । যাব, যাব বলে ছেলেদের দাবিয়ে রেখেছেন ।
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেট পড়া আর ভালো লাগেনা । শহরের যান্ত্রিকতায় দুই ভাই হাঁফিয়ে ওঠছিল । আবিদ একদিন মাকে বলেই ফেলল, মা, আমরা নানার বাড়ি কবে যাব?
ফারহানা বেগম বললেন, এখন তো তোমাদের স্কুল খোলা । তোমার বাবার, আমারও তো ছুটি নেই । সামনের শীতের ছুটিতে ।
আবিদ কিছু বললনা । গভীর আনন্দ নিয়ে সামনের শীতকালীন ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল । দুই ভাই নানার বাড়ি গিয়ে কী করবে, না করবে; তার পরিকল্পনা করছিল ।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শীতকালীন ছুটিতে তাদের স্কুল পনেরো দিনের জন্য বন্দ হল । মা দুই সপ্তাহের ছুটি পেলেন । কিন্তু বেসরকারি চাকুরে বাবার ছুটি মিললনা । ফারহানা বেগম তাকে ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলেন না । আফজাল সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ছেলেদের অনেকদিন কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়না । তাদের মন সবসময় বিষণ্ণ থাকে । অনেক দিন পর ওদের ছুটি মিলল । তুমি ওদের নিয়ে চলে যাও ।
ফারহানা বললেন, তুমি কবে আসবে?
আফজাল বললেন, আমি দু একদিনের মধ্যেই চলে আসব ।
আফজাল সাহেব স্ত্রী সন্তানদের ময়মনসিংহের বাসে তুলে দিলেন । বাস দ্রুতবেগে চলতে লাগল । আবিদ ও আবীর জানালার পাশে বসল । প্রচণ্ড গরমে জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস আসছিল । গা জুড়িয়ে গেল । তারা দুই ভাই গাঁয়ের গাছগাছালি অনেকদিন দেখেনি । ছুটে চলা ছোট ছোট বাড়িগুলো তাদের কাছে খেলাঘরের মত লাগছিল । তিন ঘণ্টা পর বাস ভালুকায় পৌঁছল ।
গ্রাম বাংলার মেঠুপথ ধরে হাঁটছিল তারা । গাছে গাছে পাখি ডাকছিল । পাখির ডাক তারা আগে কখনো শুনেনি । খুব ভালো লাগছিল সেই কিচির মিচির শব্দ । হাটুরেরা হাটে যাচ্ছে, কুমোর মাটির হাঁড়ি নিয়ে যাচ্ছে ।
সামনে পড়ল বিশাল শালবন । তার পাশেই একটা নদী বয়ে যাচ্ছে । নাব্যতা তেমন নেই । নদীর ধারেই সরষেখেত । আবির মাকে জিগ্যেস করল, মা, এগুলির নাম কী?
মা বললেন, সরসে । সাথে সাথে ছেলেরা দৌড়ে সরষে খেতে নেমে পড়ল । কী দারুণ গন্দ! এমন সৌন্দর্য তারা জীবনে কখনো দেখেনি । হাতে থাকা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে লাগল আবিদ । তারা যে সরষে মাড়িয়ে যাচ্ছে, সে দিকে তাদের খেয়াল নেই । মা চেঁচামেচি করছিলেন, বাবারা, ওঠে আয় । খেতের ক্ষতি হচ্ছে । কিন্তু কে কার কথা শোনে ।
আবীর মাকে জিগ্যেস করল, মা, সরষে দিয়ে কী হয়?
মেজাজ খারাপ হয়েছিল । মা ধমকের সাথে বললেন, সরষে থেকে তেল হয় । আবীর আর কিছু জিগ্যেস করলনা । দুই ভাই খেত থেকে ওঠে এল ।
এদিকে আবীর-আবিদদের বিলম্ব দেখে নানার বাড়ির লোকজন চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে । সকাল ১০টায় রওনা দিলে দুপুর ১টার মধ্যেই তাদের পৌঁছার কথা । আর এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে । এখনও তারা আসছেনা । পথে কোন সমস্যা হয়নি তো? বিচিত্র রকমের ভাবনা সবার মাথায় খেলা করছে । সবাই যখন চুপচাপ, চিন্তামগ্ন হয়ে বারান্দায় বসে আছে; নানা আবুল কালাম বললেন, কেও একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আয় তো পথে গাড়ি নষ্ট হল কিনা । না, থাক । আমিই যাচ্ছি । এই বলে তিনি যখন ওঠে দাঁড়ালেন, নানী সফুরা বেগম বলে ওঠলেন, কষ্ট করে আপনাকে আর যেতে হবেনা । ওরা এসে পড়েছে ।
ফারহানা বেগম মা-বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন । নানা আবীরকে কোলে তুলে নিলেন । আবিদকে জড়িয়ে ধরলেন । তারপর মেয়েকে বললেন, এতদিন পরে এলি মা?
ফারহানা বললেন, কী করব বাবা! বাচ্চাদের স্কুল বন্দ হয়না, আমি, তোমাদের জামাই সবসময় ব্যস্ত থাকি । তাই এতদিন আসা হয়নি ।
পথে কোন সমস্যা হয়নি তো? সফুরা বেগম জানতে চাইলেন ।
ফারহানা বললেন, না, আবিদ- আবির এক সরষে খেতে নেমে পড়েছিল । অনেক ছবি-টবি তুলল । এ জন্যই দেরি হয়ে গেল ।
ভাইয়ের বউ সুরাইয়া বেগম জানতে চাইলেন, জামাই এলনা?
ফারহানা বললেন, বেসরকারি চাকরি বোঝই তো । একটু বিশ্রাম নেই । ছুটি পায়নি, তাই আসতে পারেনি । আমাদেরকেই পাঠিয়ে দিল ।
আবুল কালাম বললেন, থাক মা, এবার তোরা বিশ্রাম নে! অনেক ক্লান্ত লাগছে তোদের । আমি আবিদকে নিয়ে বাজারে যাই ।
আবীর কোল থেকে নামতে চায়না । সেও বাজারে যাবে । কী আর করা! তিনি দুই নাতিকে সঙ্গে নিয়েই বাজারের দিকে রওনা দিলেন । হাতে মস্ত বড় চটের ব্যাগ । অনেক দিন পর মেয়ে, নাতিরা এসেছে । তার মনে খুব আনন্দ । তার ঘরে আজ চাঁদের হাট বসেছে । যাহোক, বাজার থেকে অনেক বড় একটা রুই মাছ কিনলেন । তরি-তরকারি কিনলেন । সাথে একজোড়া দেশী মুরগীও নিলেন । নাতিদের কিছু খেলনা কিনে দিলেন । ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে তারপর বাড়ি ফিরলেন ।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে । মুড়িঘণ্ট, মাছ-মাংস, মাষডাল আরও অনেককিছু রান্না করা হয়েছে । পিঠাও বানানো হবে। আবির মুড়িঘণ্ট খেতে পারছিলনা । ভাই বৌ সুরাইয়া তাকে কাঁটা বেছে দিচ্ছিলেন ।
খাবার ফাঁকে নানা আবুল কালাম বললেন, অনেকদিন পর আমার মায়ের সাথে খাচ্ছি । দুনিয়ার সব শান্তি যেন এখন আমার ঘরে । ফারহানা বেগম বাবার কথা শুনে হাসলেন ।
সফুরা বেগম জিগ্যেস করলেন, কয়দিন থাকবি?
আবীর বলে ওঠল, পনেরো দিন থাকব ।
আবুল কালাম বললেন, পনেরো দিন কেন? একমাস থাকবি ।
রাতে দুই ভাই আবিদ-আবীর নানার সাথে ঘুমোবে । ফারহানা আবীরকে নিজের কাছে নিতে অনেক জোরাজুরি করলেন । কিন্তু সে যাবেনা । নানার সাথেই থাকবে । নানাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে তারা ।
নানা বললেন, অনেক দিন পর এসেছ তোমরা । এখন বলতো কে কী করতে চাও?
ওরা কিছুক্ষণ ভাবল । তারপর আবিদ বলল, নানা, আমি নৌকায় চড়ব!
নানা বললেন, ঠিক আছে । আমাদের পুকুরে নৌকা আছে । তোমাকে নিয়ে কাল নৌকা চালাব ।
এবার আবীরের পালা । বল, কী করতে চাও? নানা জানতে চাইলেন ।
আবীর বলল, আমি গরুর গাড়িতে চড়ব!
নানা বললেন, ঠিক আছে । তোমাকে কাল গরুর গাড়িতে চড়াব ।
গভীর রাত্রি নেমে এল । চারদিক নিঝুম হয়ে এসেছে । মানুষের কোলাহল নেই । সবাই নিবিড় ঘুমে অচেতন । শুধু নানা আবুল কালামের চোখে ঘুম নেই । তিনি কী যেন ভাবছেন!
সকাল হতেই সফুরা বেগম পিঠা বানাতে বসেছেন । পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, কলাই পিঠা, দুধ চিতই ইত্যাদি । সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে । কাঁচা খেঁজুরের রস দিয়ে ক্ষীর রেঁধেছেন । বাচ্চারা ক্ষীর খাচ্ছে ।
আবিদ, আবীর, আর তাদের ছয় বছরের মামাত বোন শায়লা পুকুর পাড়ে খেলাধুলা করছিল । আবীরের হাতে ছোট্ট একটা কাগজের নৌকা । নানা বানিয়ে দিয়েছেন । ঘাটে নেমে সে নৌকাটা জলে ভাসিয়ে দিল । কী সুন্দর করে নৌকাটা ভাসছে!
নৌকাটা পুকুরের মাঝখানে চলে যাচ্ছিল । কীভাবে আনা যায়? আবীর ভাবছিল । ভাবতে ভাবতে সে জলে নেমে গেল । নৌকাটা তার আনতেই হবে । একটু একটু করে সে এগোতে লাগল । হঠাৎ সে তলিয়ে যেতে লাগল ।
আবিদের হঠাৎ খেয়াল হল, আবীর পুকুর পাড়ে নেই । সে কিছুক্ষনণ তাকে ডাকল । কিন্তু কোন সাড়া নেই । কোথায় গেল, আবীর? আশপাশে খোঁজ নিল । না, আবীর কোথাও নেই ।
সে দৌড়ে ঘাটে নামল । ওই তো দূরে আবীরের মাথার চুল দেখা যাচ্ছে । ভাইকে বাঁচাতে সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
আবীরকে সে টেনে ঘাটে তুলল । হঠাৎ নৌকাটা দেখতে পেল সে । আবিদ ভাবল, মাঝখানে বোধহয় বেশি জল নেই । ভাইয়ের নৌকাটা আনতে তৎখনাৎ সে জলে নেমে পড়ল । সে বুঝতেও পারলনা আজই তার মৃত্যু হবে ।
পুকুরের মাঝখান থেকে সে কাগজের নৌকাটা তুলে পাড়ে ছুঁড়ে মারল । কিন্তু পাড়ে পৌঁছাতে পারলনা । বাতাসে জলেই পড়ে গেল । আর আবিদ পুকুরের কালো জলে তলিয়ে গেল ।
আবীর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ঘাটে । তার পেটে জল ভর্তি । এলাকার লোকজন এসে তাকে বাড়ি নিয়ে গেল । কেও জানলনা আবিদ পুকুরে ডুবে গেছে ।
আবীরের পেট চেপে জল বের করে আনা হল । মাথায় তুলে ঘোরানো হল । হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এল । সে দ্রুত শ্বাস নিতে লাগল । চোখ মেলে কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে প্রথমেই বলল, ভাইয়া পুকুরে ডুবে গেছে ।
লোকজন দৌড়ে পুকুরে নামল । অনেক খুঁজাখুঁজি করল । তাতে কোন লাভ হলনা । শেষে জাল ফেলা হল । ওঠে এল আবিদের নিষ্প্রাণ দেহ । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করলেন । এই নিষ্পাপ, অবুঝ বাচ্চার অকাল মৃত্যুতে সবাই ব্যথিত হল, মা-বাবার জোড়া মানিকের একটা মানিক হারিয়ে গেল । এলাকাতে শোকের ছায়া নেমে এল ।