আবুল কালামের সামনে এখন দুইটা বড় চিন্তা। একটা তার নিজের শরীর নিয়ে। আর একটা ছেলেকে নিয়ে। ছেলে এইবার ম্যাট্টিক দেবে। বাড়তি টাকার দরকার। আবুল কালামের অবশ্য এই সবে কোন সায় ছিলনা। যা হচ্ছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হচ্ছে। ছেলে আর তার মা মিলে তাকে রাজি করিয়ে ছেরেছে। টাকা আসবে কোত্থেকে এইটা আর কেউ ভাবেনি। আবুল কালামের ভাবনা ছিল অন্য রকম। ছেলে গায় গতরে বেশ বেড়েছে। ষাট কেজি পর্যন্ত ওজন তুলতে পারে। মেঘনা ঘাট থেকে ট্রলারে আসা যে মাল খালাস হয় তাতে ষাট কেজির অনেক বস্তা থাকে। প্রতি বস্তা চার টাকা বিশ পয়সা । সারা দিনে পঞ্চাশ বস্তা খালাস করতে পারলে দুইশো টাকার উপরে আয়। মানে মাসে ছয় হাজার টাকা। আর তার আয় আছে হাজার আটেক। সব মিলিয়ে মাসে তের চৌদ্ধ হাজারের একটা অংক। তার অন্তত এই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থাটা কাটবে। অবশ্য আবুল কালাম জানে, সে যেভাবে মাসের অংক ধরে হিসাব কষছে, সেভাবে সব মাসে কাজ হয়না। এই যেমন এই মাসটা। মাসের আছে আর মাত্র চার দিন। অথচ তার পাঁচটা হাজার টাকাও এখনো আয় হয়নি। এ মাসে মালের আমদানি কম। আর ঘাটে যেন দিন দিন কুলির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এক বস্তার পিছনে চার পাঁচজন করে কুলি এসে হাজির হয়। নতুন কুলির সংখ্যা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। তারা আড়তদারকে টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। আবুল কালাম স্মৃতি হাতড়ায়। বছর পাঁচেক আগেও এই মেঘনা ঘাটে তাদের হাতে গোনা কয়েকজনের রাজত্ব ছিল। মাল খালাসির সময় আড়তদার তাদের সাথে কত নমনীয় সুরে কথা বলতো । কুলিও তেমন একটা ছিলনা বলে তাদের কতই না কদর ছিল। সারাদিন কাজও হত প্রচুর। সেসব কিছুই এখন স্মৃতি। আবুল কালামের দ্বিতীয় চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে তার শরীর। বয়স তার কতই বা হবে? চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। শরীর এখনি কুঁজো ধরে গেছে। রাতে শিরদ্বারার ব্যথায় মাঝে মাঝেই চিৎকার চেচামেচি করে। মাঝে মাঝে কাজেও যেতে পারেনা। নব্বুই কেজি ওজনের বস্তা টানতে তার সমস্যা হয় ইদানিং। আড়তদারের কাছে তার কদর কমে যাচ্ছে দিন দিন। দ্রুত মাল খালাসের জন্য আড়তদারের পছন্দ। সুঠাম দেহের অল্প বয়স্ক কুলি। এত সব কিছু জেনেও আবুল কালাম প্রতিদিন কষ্ট করে হলেও ঘাটে যায়। ঘাট পাড়ে বসে অন্যদের সাথে অপেক্ষায় থাকে কখন মাল বোঝাই ট্রলার এসে পাড়ে ভীড়বে। যদিও ইদানিং মাল আসছে কম কম। নব্বুই কেজি ওজনের একটি বস্তা ট্রলার থেকে মাথায় করে টেনে পঞ্চাশ মিটার দূরে ট্রাকে তুলে দিতে পারলে ছয় টাকা চল্লিশ পয়সা পাওয়া যায়। একটি বস্তা টানার পর তার হাফ ধরে যায়। হাত পা কাঁপে। কিন্তু সে সেটা আড়তদারকে বুঝতে দেয়না। বুঝতে দিলেই সমস্যা। পরে তাকে কাজ দিতে আড়তদার দশবার ভাববে। এমনিতেই এখন কাজ কম। সারাদিন বড়জোর বিশ বস্তা তার ভাগে পড়ে। তাতে সারা মাসে যা আয় হয় পেটটাই খালি কোনমতে চলে তিনজন মানুষের। শখ আহ্লাদ আর কোনটাই পুরণ হয়না। তার নিজের শখ বলতে কিছুই নাই। এক সময় মদ জুয়ার নেশা ছিল। ওসব ছেড়েছে অনেক আগেই। এখন কেবল তার সংসারের চিন্তা। আর কাজের জন্য নিজের শরীরটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এর মধ্যে আড়তদার একটা সুসংবাদ শুনিয়েছে। সামনের মাসে নাকি ইন্ডিয়া থেকে প্রচুর চাল আসবে। আর প্রচুর চাল আসা মানে প্রচুর বস্তা। বিষয়টা মনে পড়লে আবুল কালামের মেজাজটা একটু ফুর ফুরে হয়ে যায়। পাড়ে বসে আয়েস করে একটা আকিজ বিড়ি ধরায় তখন। বিড়িতে টান দিতে দিতে ভাবে শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে এ কয়টা দিন। কাজ আসলে সারাদিন যে করেই হোক একশো বস্তা টানতে হবে। একশো বস্তা টানতে পারলেই সাতশো টাকার মত। তার তো রাজার হালে সংসার চলে যাবে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় তখন আর ছেলেকে মেট্টিক দিতে মানা করবে না। দিক না। পড়ালেখা করলে মন্দ কি। সে নিজেও চায়না ছেলে তার মত কুলি কামার হোক। আড়তে যে খাতা-পাতি হিসাব করে চ্যাংড়া করে পোলাটা, আবুল কালাম শুনেছে তার নাকি মাসে পনের হাজার টাকা ইনকাম। আবুল কালাম ভাবে ছেলে পড়ালেখা শিখে যদি ওই রকম কিছু একটাও হতে পারে মন্দ কি? আবুল কালাম সামনের মাসের আশায় দিন গুনতে থাকে। সেদিন কাজের চাপ একটু কম থাকায় আবুল কালাম আড়তদার রইস উদ্দিনকে প্রশ্নটা করেই বসলো, মাহাজন সাব সামনে মাসে তাইলে ম্যালা কাজ আসতাছে নাকি কি কন? আমরার দিক কইলাম এট্টু খেয়াল টেয়াল রাইখেন। আড়তদার রইসুদ্দিন পান চিবাচ্ছিল আয়েস করে। আবুল কালামের কথা শুনে পানের পিক গা বাঁচিয়ে কিছুটা দূরে ফেলতে ফেলতে বললো, তুই তো নব্বুই কেজি টানতে নেড়ি কুত্তার মত হাস ফাস করস। সারাদিন কয় বস্তা আর টানবি? কামের হিসাব নিয়া তর লাভ আছে? তর শরীরে যা কুলায় টানিস। আড়তদারের শেষের কথাটি আবুল কালামের মনে ধরে। ঠিকইতো । তার শরীরে যা কুলায় ততটুকুই তো টানবে। তবু কাজ বেশি থাকলে চিন্তা থাকেনা । এই আরকিা। সে আর কোন কথা বাড়ায়না আড়তদারের সাথে। এর মধ্যে একদিন ঘাট পারে কুলিরা বলাবলি করছিল ইন্ডিয়া থেকে যা মাল আসছে তা খালাস করতে নাকি বাইরে থেকেও কুলি ভাড়া করে আনতে হবে। আর কাজটা নাকি সরকারি। দিনকার টাকা দিন দিয়া দিব। আবুল কালাম অবাক হয়। হায় আল্লাহ এত কাজ! এত রাজকীয় ব্যপার স্যপার। টাকা নিয়ে আবুল কালাম ভাবছে না। ভাবছে কাজ নিয়ে। যে করেই হোক তার শরীরটা ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর কাজ করতে হবে তাকে। সে এই ঘাটের পুরনো কুলি। তার অপারগতায় অন্য ঘাটের কুলি তার কাজ বাগিয়ে নিলে এ তার জন্য বিরাট লজ্জার ব্যপার হবে। আবুল কালাম স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেয়। সারাদিন সে পাঁচ সাতশো টাকা আয় করছে। সংসার চলছে তার রাজার মত। যা ইচ্ছা তাই খাচ্ছে। যা শখ তাই কিনছে। বউ, ছেলে সবার আব্দার রাখছে। সবাই খুশি। সে স্বপ্ন দেখতে দেখতেই সিদ্ধান্ত নেয় এবার কিছু টাকা লোন করা যায়। ছেলে অন্তত মেট্টিকটা দিক। সময় হাতে বেশি নেই। লোন করতে গিয়ে আবুল কালাম একটু বেহিসেবি হয়ে যায়। দুই হাজারের জায়গায় সে দশ হাজার টাকা লোন করে ফেলে একটি এনজিও ফার্মের কাছ থেকে। দশ হাজারের জন্য তাকে মাসে পাঁচশো করে দিতে হবে। আবুল কালাম হিসাব কষে ফেলে। সামনের মাসে তো কাজের অভাব হবেনা। তখন শোধ দেয়া যাবে। আর মাসে মাসে পাঁচশো। এ আর এমন কি। কাজ হলে পাঁচ হাজারো কোন ঘটনা নয় তার কাছে। আপাতত টাকাটা তার খুব দরকার। ছেলের ফর্ম পুরণ ছাড়াও তার নিজের শরীরের একটু যত্ন আত্তি দরকার। পারলে একটা ডাক্তারও দেখানো যেতে পারে। কিছু ভিটামিন খেলে শরীর একটু বল পাবে। তাছাড়া এই কয়টা দিন একটু ভাল মন্দ খেতে পারলে নিজেকে ফিট রাখা যাবে। এমনি ভাবনা থেকে আবুল কালাম বাড়তি লোনের বিষয়টা সিদ্ধান্ত নেয় । সবকিছুই ঠিকঠাক মত চলতে থাকে। আবুল কালামের প্রতিটি সকাল হয় নতুন স্বপ্ন নিয়ে। মাস শেষে নতুন মাস আসে। মাসের দুই তারিখে সরকারি কিছু লোক জন এসে ঘাটপাড় পরিদর্শন করে যায়। ঘাটপাড়ে গড়ে ওঠা কিছু খুপড়ি চায়ের দোকান আর সব হকারকে নোটিশ দিয়ে যায় তারা ঘাটপাড় ফাঁকা করতে। ট্রলার এসে পড়বে দু একদিনের মধ্যে। একটি দুটি নয়, বিশ থেকে ত্রিশটি ট্রলার। সরকারী লোকজনের কথা বার্তা আর কাজ কর্ম দেখে আবুল কালামের বুক চওড়া হয়। এত গুলা ট্রলার, মানে শয়ে শয়ে বস্তা। আহ্! সে আর কিছু ভাবতে পারেনা। তারপর সেই কাঙ্খিত দিনটি এল। এক সকালে আবুল কালাম ঘুম থেকে উঠে ঘাট পারে গিয়ে দেখে এক অবাক দৃশ্য। নিজের চোখকে যেন তার বিশ্বাস হয়না। শয়ে শয়ে বস্তা বোঝাই ট্রলার ঘাটপার আলোকিত করে আছে। আবুল কালামের মনে হয় এত সুন্দর দৃশ্য সে তার জীবনে কখনো দেখেনি, কোনদিন হয়তো আর দেখবেও না। সে দৌড়ে আড়তদারের কাছে যায়। কিন্তু আড়তদারের ঘরে অনেক সাহেবি লোকের ভীড়। সে ঢুকতে পারেনা। তার খুব জানতে ইচ্ছা করছিল মাল খালাস হবে কখন থেকে। তবে সে বাইরের অন্য কুলিদের কাছ থেকে জানতে পারে দু একদিনের মধ্যে নাকি মাল খালাস করবে। আবুল কালাম ফুরফুরে মেজাজে আবার ঘাট পাড়ে এসে একটা আকিজ বিড়ি ধরায়। বিড়িতে টান দিয়ে আপন মনেই গেয়ে ওঠে…মন তুই রইলি খাঁচার আশে, খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে….। তারপর দুই দিন নয়, পাঁচদিন পর মাল খালাসের বন্দবোস্ত হয়। কিন্তু সেই দিন আবুল কালামের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মেঘনা ঘাটপাড়ের দিনমজুর আবুল কালাম। যে নব্বুই কেজি ওজনের বস্তা মাথায় করে ঘাট পাড় থেকে ট্রাকে নিয়ে গিয়ে মাত্র ছয় টাকা চল্লিশ পয়সা আয় করে প্রতি বস্তায়, সে সভ্যতার এত মার প্যাঁচ বোঝেনা, বুঝতে চায়ওনা। কিন্তু সেই সকালে আবুল কালাম সভ্যতার কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। যখন সে দেখে বিশাল বিশাল দানবীয় কিছু যন্ত্র তাদের পাষানের মত কৃত্রিম হাত দিয়ে একটা নয়, দুইটা নয়, অমন দশটা করে নব্বুই কেজি ওজনের বস্তা কয়েক মিনিটেই ট্রলার থেকে তুলে ট্রাকে লোড দিচ্ছে , আর সেই কাজটি পরিচালনা করছে একজন মাত্র মানুষ, তখন আবুল কালামের হুশ ফেরে। ঘাটপারে ওরকম দশটার মত যন্ত্র আনা হয়েছে। আবুল কালাম অবাক তাকিয়ে দেখে সেই সব সভ্যতার কাজ কারবার। কে যেন তার কানের কাছে ফিশ ফিশ করে বলে যায়, কিরে আবুল? দেখছোস তো? একটা বস্তা টানতে কুইজ্যা অয়া যাস, মেশিনে ক্যামনে দশটা কইর্যাে বস্তা লয়। আড়তদার কইলো সরকারী কাজকাম এমনি। দুই দিনে সব মাল খালাস অইয়া যাইবো। আমরার আর দ্যাহন ছাড়া কি করমু। সতীর্থের কাছে কথা গুলো শুনতে শুনতে আবুল কালামের একটা অদ্ভুত চেহারা মনে পড়ে। সেই চেহারার সাথে কখনো মিল খুজে পায় তার ছেলের, কখনো মিল খুজে পায় তার বউয়ের, কখনো মিল খুজে পায় এনজিওর সেই ম্যানেজারের, কখনো আবার মিল খুজে পায় আড়তে চাকরি করা সেই চ্যাংড়া করে ছেলেটার। আসলে চেহারাটা কার আবুল কালাম ধরতে পারেনা। সে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাসরিন চৌধুরী
বেশ লিখেছেন --নীচের দিকটায় কিছু বানান ছুটে গেছে। শুভেচ্ছা জানবেন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।