রজনীকে দেখলে আমার রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির কথা মনে পড়তো। রজনীর পুরো নাম আমার জানা ছিলনা। আমি তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তেমনিভাবে কারো সাথে পরিচয় হয়ে ওঠেনি। ক্লাস শেষে ছেলে মেয়েরা যখন সেমিনার কক্ষে, মধুর ক্যান্টিনে কিংবা টিএসসিতে বসে আড্ডা জমাতো তখন আজন্ম লাজুক আমি সোজা চলে যেতাম হলে। বাকি সময়টা টেবিলে ঘাড় গুঁজে বই পড়তাম। কখনো পাবলিক লাইব্রেরী বা নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলো থেকে একা একাই ঢু মেরে আসতাম। এভাবেই আমার দিনগুলো কাটছিল। হটাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম ক্লাসের প্রায় সব ছেলেই কোনা না কোন একজন মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। সে হোক আমাদের ক্লাসের বা অন্য ডিপার্টমেন্টের। বিষয়টা লক্ষ্য করার পর নিজেকে কিছুটা ব্যর্থ মনে হতে লাগলো। অথবা মধুর ক্যান্টিনের সামনে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছটার মত নিজেকে একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হল। বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবতে থাকলাম। কেউ একজন তো ক্লাস শেষে আমার জন্যও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কোন এক চঞ্চল মেয়েকে নিয়ে আমিও কি পারিনা সারা শহর রিক্সায় ঘুরতে? কিংবা এই যে আমি প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা মহিলা সমিতিতে যাই নাটক দেখতে, কেউ একজন তো আমার সাথে আমার পাশে বসে নাটক দেখতে দেখতে আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারে পরম ভালবাসায়। এসব নিয়ে যখন আমার ভিতরে তোলপাড় হচ্ছিল, ঠিক তখনি আমার মনে পড়লো রজনীর কথা। ওকে প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম। রজনী দেখতে সুন্দরী নয়। আবার আমার দৃষ্টিতে সে অসুন্দরও নয়। সে ছিল শ্যামলা। তবে কালোর দিকটা একটু বেশি। যৌবন ভারে টলমল। অটুট স্বাস্থ্য। দু’টি ঘন কালো চোখ। মায়াবী মুখ। এ মুখের আকর্ষণ আমি এড়াতে পারতাম না। আমি আসলে এরকমই। সেই ছোটবেলা থেকেই। খেলায় যে দল হারতে থাকে নিজের অজান্তেই আমি সেই দলের পক্ষ নেই। কেন যেন কেবল দুর্বলের জন্যই আমার মন কাঁদে। ক্লাসের অন্য মেয়েদের ভিড়ে রজনীকেই কেবল আমি আলাদাভাবে দেখতাম। কেমন সহজ সরল আর দুঃখী চেহারার একটি মেয়ে। কেউ ওর দিকে তেমন একটা তাকাতোনা। তবু ওকে দেখতাম নিয়মিত ক্লাস করতে। আমি ক্লাসে এসে অন্তত একবার ওর দিকে তাকাতাম। রজনী জানে সে সুন্দরী নয়। সে জন্য তার কোন দুঃখও নেই। আমি তার ভিতর কোন অহংকারও দেখতাম না। যখন সে হাসত সারা শরীর দুলতো। কেমন শিশুদের মত মনে হত। মাঝে মাঝে আমি আড়াল থেকে মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখতাম। রাতে ওকে নিয়ে ভাবতাম। তবে ওর সাথে কখনো কথা হতনা। কতদিন ক্লাসে যাওয়ার সময় ভাবতাম আজ কথা বলবো। ওকে চা খাওয়ার প্রস্তাব করবো মধুর ক্যান্টিনে। কিন্তু ওর সামনে গিয়ে কিছুই বলা হতনা। সেদিন ক্লাস বন্ধ ছিল। আমি সেমিনার কক্ষে বসে নোট করছিলাম। এক ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই রজনীকে দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল কারো জন্য অপেক্ষা করছে। নোট করা থেকে আমার মন উঠে গেল। থুতু ফেলার ছলে বাইরে এলাম। থুতু ফেলে রজনীর দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে আবার সেমিনার কক্ষে ঢুকতে যাবো ঠিক তখনি পিছন থেকে সে বলল, শুনুন। আমি একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। বুকের ভিতরের ফুসফুস ওঠানামার শব্দ কানে এসে বাজলো। মনে হল শব্দটা বুঝি রজনীও শুনছে। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমাকে বলছেন? রজনী সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। ও কিছুটা ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি কি স্যার এএফ রহমান হলে থাকেন? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ও বলল, আপনি রেজাউলকে চেনেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেষ বর্ষে পড়ে। বললাম, চিনি। আমার পাশের রুমে থাকে। ও বলল, ওর কোন মোবাইল নম্বর আছে আপনার কাছে? আমার কাছে একটা নম্বর ছিল, কিন্তু বেশ কিছুদিন হল বন্ধ পাচ্ছি। শেষ কথাটি সে একটু হতাশার সুরে বলল। রেজাউলকে আমি চিনি এবং তার নম্বরও আমার কাছে ছিল। হলের বড় ভাই। রাজনীতি ফাজনীতি করে বেড়ায়। কোন বিপদ আপদে প্রয়োজন হতে পারে তাই তার নম্বরটা নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তাকে কখনো ফোন করার প্রয়োজন পড়েনি আমার। তাই জানতাম না যে তার নম্বরটা বন্ধ। ফোন দিতে গিয়ে রজনীর কথার সত্যতা বুঝতে পারলাম। ওকে বললাম, আমার কাছে এই নম্বরটাই ছিল । আপনি চাইলে আমি ওর বর্তমান নম্বরটা ম্যানেজ করে দিতে পারি। রজনী কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, আপনি ওকে এই চিঠিটা একটু দেবেন। আর বলবেন কাল বিকেল পাঁচটায় যেন পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে একটু আসে। তাহলেই হবে। বলেই সে তার ব্যাগ থেকে একটি ইনভেলপ বের করে দিল। আমি হাতে নিতেই ও আর দেরি করলো না। সেমিনার কক্ষে আর ভাল লাগলো না। হলে ফিরতে ফিরতে রজনীর কথা ভাবছিলাম। রেজাউলের সাথে কি তাহলে রজনীর প্রেমের সম্পর্ক? স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিলাম তাই। না হলে রেজাউলের কথা বলতে গিয়ে রজনী অমন লজ্জা পাচ্ছিল কেন? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব। রেজাউল তো রুমাকে ভালবাসে। রুমা লালমাটিয়া মহিলা কলেজে পড়ে। আমার সাথে পরিচয় আছে। রেজাউলই একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। রুমাকে কতদিন দেখেছি হলের ওয়েটিং রুমে রেজাউলের জন্য বসে থাকতে। আমাকে দিয়েও তো কতদিন স্লিপ পাঠিয়েছে রেজাউলের কাছে। হতে পারে রেজাউলকে রজনীর অন্য কোন কারণে প্রয়োজন। সব সম্পর্কই যে প্রেম হতে হবে এমন কেন ভাবছি আমি? নিজেকে গালি দিলাম পুরনো আমলের ধ্যান-ধারনার জন্য। হলে ফিরে কেন যেন কিছুই ভাল লাগ ছিলনা। পাশের রুমে একবার উঁকি মেরে দেখলাম রেজাউল বিছানায় শুয়ে মোবাইলে ক্ষীণ স্বরে কথা বলছে কারো সঙ্গে। রজনীর চিঠিটা আমি তাকে দিলাম না। কেন জানি দিতে ইচ্ছা করলো না। কেন এমন করলাম তার কোন ব্যাখ্যাও খুঁজে পেলামনা। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। বারবার চিঠিটার দিকে মনোযোগ আটকে যাচ্ছিল। ক্লাসের পড়া তৈরি করতেও ইচ্ছা হচ্ছিল না। নিজেকে যখন খুব বিপর্যস্ত মনে হতে লাগলো ঠিক তখনি মনে হল আমি আসলে রজনীকে খুব ভালবাসি। প্রচণ্ড ভালবাসি আমি ওকে। রজনীর চিঠিটা ছিল অনুযোগে ভরা। ও লিখেছে, তুমি কেন আমার সাথে এমন করছ। তোমার কথায়, তোমার উৎসাহে আমি রাতদিন পরিশ্রম করে এখানে চান্স পেয়ে ভর্তি হলাম আর তুমি এখন আমাকে এড়িয়ে চলছ। তোমার ফোন বন্ধ কেন। দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। প্লিজ আমার সাথে এমন করোনা। কাল একবার পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এসো বিকেল পাঁচটায়। অনেক কথা আছে। আমি অপেক্ষা করবো। ইতি রজনী। রজনী রেজাউলকে ভালবাসে। তাদের দু’জনের একসময় হয়তো গভীর প্রেম ছিল। কিন্তু এখন রেজাউল রজনীকে ভুলে গেছে। রুমাকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফুলের মত নিষ্পাপ আর সহজ সরল মেয়েটিকে সে সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মনে মনে রেজাউলের প্রতি ঘৃণা জন্মাল। পরদিন রজনীকে আর ক্লাস করতে দেখলাম না। আমারও ভাল লাগলো না ক্লাস করতে। দুইটা ক্লাস করে হলে চলে গেলাম। রজনীর অনুপস্থিতির কোন কারণ খুঁজে পেলামনা। কোনমতে সময়টা পার করে বিকেল ঠিক পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে গেলাম। দুর থেকেই রজনীকে দেখলাম লাইব্রেরীর সামনে পায়চারী করছে। কাছে গিয়ে বললাম, রেজাউলকে চিঠি দিয়েছি। আসবে বলেছে। রজনী আমাকে ধন্যবাদ জানালো। আমি রজনীকে মিথ্যা বললাম। কিন্তু আমার ভিতর কোন অপরাধ বোধ কাজ করলো না। নিষ্ঠুর সত্য কথাটা বলে মেয়েটিকে কষ্ট দেয়ার মত দুঃসাহস আমি দেখাতে পারলাম না। লাইব্রেরীতে বসে সময় পার করছিলাম। বই পড়ায় মন বসাতে পারছিলামনা। আমার মন আসলে ছিল রজনীর দিকে। একটু পর পর বাইরে এসে আড়াল থেকে ওকে দেখে যাচ্ছিলাম। মেয়েটি গভীর আগ্রহে রেজাউলের জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলে আমি রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালাম। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, রেজাউল আসেনি? ও আমার দিকে তাকাতে পারলো না। মনে হলও সে গভীর হতাশায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। আমি পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, হয়তো কাজে আটকে গেছে কোথাও। আমি আবারো বলবো। চলুন যাওয়া যাক। সন্ধ্যা হয়ে এলো। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। রজনী বিড়বিড় করে বলল, চলুন। আমি আর রজনী পাশাপাশি হাঁটছি। সে কোথায় যাবে আমি জানিনা। আমি কোথায় যাবো তাও জানিনা। শুধু এটুকু জানি যে রজনীর পাশে আমাকে কিছুক্ষণ হাটতে হবে। সূর্যের শেষ রশ্মি তখন দিগন্তে বিলীন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিতর জমাট বাঁধা অন্ধকার। দু’একটি রিকসা একটু পর পরই আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। তখনো রাস্তার পাশের বাতিগুলো জ্বলে ওঠেনি। রজনী আমার সাথে সাথেই হেটে চলেছে। বাসে বা রিক্সায় ওঠার কোন তাড়া দেখছিনা তার ভিতর। দুজনেই চুপচাপ। টিএসসি থেকে মোড় নিয়ে আমরা নিউ মার্কেটের দিকে হাঁটতে থাকলাম। আমি আসলে হলের দিকেই হাঁটছিলাম। রজনী কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হল না। আমার ভালই লাগছিল রজনীর পাশে হাঁটতে। হটান একটা রিক্সা উল্টোদিক থেকে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রিক্সায় রেজাউল আর রুমা। রেজাউল আমাদের দেখে না দেখার ভান করলো।রুমা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। মুখে হাসি। দুজনকে বেশ মানানসই মনে হল। রেজাউলও সুন্দর। রুমাও সুন্দর। আমার পাশে রজনী। সে ওদের চলে যাওয়া রিক্সার দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটিকে আপনি চেনেন? আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। বড় অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। রজনীর গোপন ব্যথাটা বুঝি এখনই আমার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই বুঝি মেয়েটির চোখের পানি আমার কাছে ধরা পড়ে যায়! আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, কত আর হাঁটবেন। একটা রিক্সা ডেকে দেই? রজনী আমার কথার কোন জবাব দিল না। শান্ত এবং আহত স্বরে বলল, এই মেয়েটির নাম বুঝি রুমা? বুঝলাম আর লুকবার কিছু নেই। রজনী হয়তো আগে থেকেই কিছুটা জানতো। মনে হয় বিশ্বাস করতে চায় নি। সহজ সরল মেয়েদের যা হয়। আজ প্রমাণ পেল। আমি রজনীর দিকে একবার ভাল করে তাকালাম। ওকে ওর চেয়েও অনেক বড় মনে হচ্ছিল। তার ভিতরকার শিশুটা যেন মরে গেছে। এ যেন অন্য রজনী। রজনীও আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তার দৃষ্টিতে একরাশ ঘৃণা। এই প্রথম পুরুষ হয়ে জন্মে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল। রজনীকে একটি রিক্সায় তুলে দিলাম। আমি হলের গেট পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেলাম। কেন যেন মনে হল হলে যাবনা। হাঁটবো। আজ আমি অনেক হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে মধ্য রাতে হলে ফিরবো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Rajib Ferdous
ধন্যবাদ মাসুদ গল্প পড়ে মন্তব্য করার জন্য। আমাদের দেশের এরকম হাজারো রজনীদের তারপর কি হয় তা হয়তো আমরা জানার চেষ্টা করিনা। কিংবা জানলেও পাত্তা দেইনা। অনেকে আবার বলি, ঠিকইতো আছে। এর চাইতে বেশি ওর মত মেয়ে আর কি পেতে পারতো। হায় আমাদের মানসিকতা।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।