তামার বিষ

মা (মে ২০১১)

boka bahadur
  • ২২

চোখের দৃষ্টি দিয়ে যদি কাউকে ভষ্ম করা যেতো তাহলে আবলুস মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি এতক্ষনে ভষ্ম হয়ে যেতো। লোকটি কি নির্লজ্জের মতো হাসছে। পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ছে হাসির সাথে সাথে। হাসিটা আবলুস মিয়ার একদম পছন্দ না। তার পছন্দ মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁতের হাসি। যে হাসি তাকে নিয়ে যায় জীবনের কিছু হারানো স্মৃতির কাছে। তার মনে পড়ে যায় ফুলবানুর কথা। ফুলবানু যখন মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়তো তখন আবলুস মিয়ার বুকে কতো পদ্মা-মেঘনা বয়ে যেত তা কেবলই আবলুস মিয়া জানতো। ফুলবানুর সাথে আবলুস মিয়ার পরিণয় পরিনতি পায়নি। ফুলবানু বিয়ে করে চেয়ারম্যানের ছেলে সালামতকে। তখন থেকে আবলুস মিয়ার মধ্যে নারী জাতির উপর তীব্র ঘৃণা জন্মে। তারপর আবলুস মিয়া শহরে চলে আসে। শহরে আসার পর নানা জায়গায় কাজের জন্য ধরনা দিয়েও কোন কাজ জোটাতে পারল না। আবলুস মিয়া ঘুমাতো কমলাপুর ষ্টেশনে। একদিন রাতে সেখানে আসে কালো চশমা চোখে এক লোক। এসে আবলুস মিয়াকে কষে লাথি লাগায়। লাথি দিয়ে বলে “পইর্যাট পইর্যাে ঘুমাস, কাম করবার পারস না?” আবলুস মিয়া থতমত খেয়ে যায়। কোনমতে জিজ্ঞেস করে “কি কাম করুম? কাম দিবো ক্যাডা?” লোকটা বললো “ল আমার লগে, তোরে কাম দিমু।” আবলুস মিয়ার মনে আছে সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি আবলুস মিয়ার জন্মের সময়ও পড়েছিল। যে সে বৃষ্টি না, ঝুম বৃষ্টি। আবলুস মিয়া জন্মের পর গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল। তার নানী তাকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। কিছু উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দের সাথে বলে “পোলা হইছে, আবলুস কাঠের লাহান কালা পোলা। ওর নাম দিলাম আবলুস মিয়া।” এগুলো আবলুস মিয়ার শোনা কথা। কিছু শোনা মায়ের কাছে, কিছু অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে। কথায় আছে শোনা কথায় কান দিতে নাই। কিন্তু এই শোনা কথাগুলোয় কান না দিয়ে আবলুস মিয়ার কোন উপায় নাই।
আবলুস মিয়া পরে জানতে পারে চশমা চোখের লোকটির নাম বাদশা। সে মেয়েমানুষের ব্যাবসা করতো। আবলুস মিয়াকে বানালো তার এসিসট্যান্ট। আবলুস মিয়ার কাজ ছিল খদ্দেরদের রুমে পৌঁছে দেওয়া, আর টাকা বুঝে নেওয়া। তার কাজ খুব বেশি না। তাই খন্ড খন্ড অবসরে সে গল্প করতো দুলালের সাথে। দুলালও বাদশার কাজ করে। দুলালের কাজ হলো ঘর ঝাঁট ফাই-ফরমাশ খাঁটা। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সে মেয়েদের ঘরে উঁকি দিতো। আজও দিলো এবং দেখল খদ্দের নির্লিপ্তভাবে নিজের নোংরা আন্ডারওয়্যার টেনে কোমড় পর্যন্ত তুললো। তারপর আন্ডারওয়্যারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মনের সুখে গোপণাঙ্গ চুলকালো। আবলুস মিয়া ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নেয়। সরে আসে ঘরের সামনে থেকে। লোকটি পরম তৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে এলো। এসে আবলুস মিয়ার দিকে ১০০ টাকার দু’টো নোট বাড়িয়ে ধরে নির্লজ্জের মতো হাসতে লাগলো। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসি। যে হাত দিয়ে মনের সুখে গোপণাঙ্গ চুলকিয়েছিল, নোট দু’টো সেই হাতে ধরা। নোংরা হাতটির দিকে তাকিয়ে রাগে এবং ঘৃণায় আবলুস মিয়ার গা রি রি করছে। আবলুস মিয়া গায়ের সমস্ত জোর একত্র করে চিৎকার করে “দুলাল; দুলাল” দুলাল তখন একটি বিড়ালের নাক দিয়ে দড়ি ঢোকাতে ব্যস্ত। আবলুস মিয়ার চিৎকারে চমকে ওঠে, হাত ফস্কে পালিয়ে যায় বিড়ালটি। দুলাল অস্ফুট স্বরে বলে “হালা, মেকুড়ের বাইচ্চা।” সে আবলুস মিয়ার সামনে গিয়ে বলে “কি লাগবো? কন”। আবলুস মিয়া কর্কশস্বরে বলে “ট্যাকাডা ল, হারামজাদা”। দুলাল ক্ষিপ্ত স্বরে বল, “গাইল্যান ক্যা? গাইল্যান ক্যা, হু?” আবলুস মিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়ে দুলালের উপর। সে কষে চড় লাগায় দুলালের গালে। হতো আরেকটি চড় মারতো। কিন্তু এমন সময় কাঁশতে কাঁশতে বাদশা এসে ঘরে ঢোকে। সে মুহুর্তেই ঘরের উত্তেজনা আঁচ করতে পারে। জিজ্ঞেস করে, “কি হইছে মিয়ারা? অ্যা? অইছেডা কি?” দুলাল মাথা নিচু করে থাকে। আবলুস মিয়া বলে, “কিছু না”। বাদশা বলে, “কিছু না তো মনে হইতাছে না।” দুলাল তখন তড়িঘড়ি করে বলে, “নাহ, কিছু না।” খদ্দের এতক্ষন সবই দেখছিল। এবার সে হাসি আরো বিস্তৃত করে বলে “হ, হাছাই কিছু না।” বলে টাকাটা বাড়িয়ে ধরে আবলুস মিয়ার দিকে। আবলুস মিয়া দাঁতে দাঁত চেপে টাকাটা নেয়। দুলাল বেরিয়ে পরে বিড়ালটা খুঁজতে। আসলে তাদের সম্পর্কটাই এমন। কারো প্রতি কারো কোন অভিযোগ নেই। আছে কেবলই সম্পর্কের উত্তেজনা।

সেদিনের ঘটনার পর আবলুস মিয়ার মন ভালো নেই। টাকা দেখলেই তার গা গুলিয়ে আসে। ছুঁতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা জিনিস হচ্ছে টাকা। কিন্তু টাকা না ছুঁয়ে সমাজে বাস করা প্রায় অসম্ভব। তাই কারনে অকারনে তার টাকা ছুঁতে হয়। এবং সাথে সাথে সে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুঁইয়ে ফেলে। ব্যাপারটা শুচিবায়ুতে রুপ নেয়। সবাই আড়ালে হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। দুলাল, এমনকি মেয়েগুলোও। কেউ কেউ তো তামাশা করে বলেই ফেলে “টাকাডা কি ধুইয়া দিমু নাকি?” এদের মধ্য যারা একটু বেশী সাহসী তারা বলে “টেকাডা সোনা-রুপার পানি দিয়া পাক কইরা লও মিয়া” আবলুস মিয়া বিরক্ত হয়। প্রচন্ড মাত্রায় বিরক্ত। দুই পয়সার মাগীদের সাহস দেখে বিস্মিতও হয়। কিছু বলে না। বিষ দৃষ্টিতে তাকায় শুধু। কি আর বলবে! যদিও আবলুস মিয়ার রোজগার এদের ঘিরে, তবুও সে কোনদিন এদের সাথে শোয়া তো দূরের কথা, ভালো করে কথাও বলেনি। কি কথা বলবে! এরা তার কাছে কেবলই প্রাণহীন দেহ। যে দেহে মন আছে কেবলই গুমড়ে থাকা কষ্টের জন্য আর কখোন-সখোন ঢূঁড়ে ঢুঁড়ে কাঁদার জন্য। তাছাড়া, এদের সাথে কথা বলতে গেলেই তার মনে পরে যেত ফুলবানুর কথা। ফুলবানু যেন হাসতো মুক্তোর মত দাঁত বের করে। এই মেয়েদের মাঝে একটি মেয়ে একটু যেন আলাদা। সে শান্ত। তার মাঝে সময়ে সময়ে ফুলবানুর এবং মায়ের ছায়া খুঁজে পেত আবলুস মিয়া। সে কিছুই বলে না আবলুস মিয়াকে। তাকে হাত ধুঁতে দেখে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দিন যায়। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে মেটির দীর্ঘশ্বাস। আর সবাই আগের মতো। না, সবাই না, আবলুস মিয়া হতে থাকে জীর্ন-শীর্ন। মনের রোগ তার দেহকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে। করে তোলে হাড়-চামড়া সর্বস্ব কংকাল।

আবলুস মিয়াকে দেখলে এখন যে কেউ শিউরে উঠবে। চোখ আছে চোখের জায়গাতেই। তবে খোলার শক্তিটুকু তার নেই। চোখ গরম করে নাকের সামনে উড়তে থাকা মাছিটির দিকে তাকাবার শক্তিও তার অবশিষ্ট নেই। একটু পানির জন্য বুক হাঁসফাঁস করছে। এমন সময় একটি কোমল হাত তার কপাল স্পর্শ করলো। আবলুস মিয়া মুখের ভেতর অসাড় জিবটা নাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। হাতটি সরে গেল। মুহুর্ত খানেক পর আবলুস মিয়া অনুভব করলো কেউ তার মুখে শক্ত কিছু একটা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অজানা ভয় গ্রাস করল তাকে। সে চেষ্টা করল শরীরের সব শক্তি প্রতিবাদ করার। কিন্তু, পরক্ষণেই বুঝতে পারল ওটা একটা নিরীহ চামচ। শক্ত ঠোঁটে পানির স্বস্তিকর পরশ পেল আবলুস মিয়া। জিবে পেল পানির সুমিষ্ট স্বাদ। কয়েক চামচ পান করার পর আবলুস মিয়া চোখ খোলার শক্তি পেল। চোখ খুলে দেখতে পেল সেই মেয়েটিকে। যে সবার চেয়ে বেশি সাহসী, যে মেয়েটি অন্য সব মেয়ের চেয়ে বেশিই জ্বালাতন করত আবলুস মিয়াকে। বলতো “মাইনষে ট্যাকা পায় না, আর হ্যায় ট্যাকা ছোঁয় না, ঢং! তামার বিষে পাইছে!” আবলুস মিয়ার চোখে ভেসে উঠে ফুলবানুর মুখ, সেই মেয়েটির মুখ যে দীর্ঘশ্বাস ফেলত আর মায়ের মুখ। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মনে পড়ে যায় মা ও এভাবেই অসুখের সময় খাবার তুলে দিত মুখে। আবলুস মিয়া চোখ বন্ধ করে ভাবে তবে কি মা ফিরে এলো!?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন ঘটনা এত দ্রুত এগিয়েছে যে তাল সামলানো যাচ্ছিল না । তবে নারী তথা মেয়েরা যে মায়ের জাত, এই বক্তব্য তোমার গল্পে বেশ সুন্দরভাবে উঠে এসেছে । আবলুস মিয়ার চরিত্রে একটা শিক্ষনীয় বিষয় আছে তা হলো, যে কেও চাইলে তার কৌমার্য রক্ষা করেও যে কোনো কাজ করতে পারে যদি তার বিবেকের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা থাকে ।
boka bahadur ধণ্যবাদ সবাইকে।
শাহ্‌নাজ আক্তার দুই - একটা লাইন ছাড়া পুরো গল্পটি ভালো হযেছে ,
খন্দকার নাহিদ হোসেন তুমি খুব ভালো গল্পকার। এটা তোমার প্রথম লেখা হতেই পারেনা! ৫ এর বেশি দিতে পারলে ভালো লাগতো।
boka bahadur বিনয় কি আপনার মজ্জাগত সম্পদ? @ বিন আরফান ভাই।
boka bahadur ধন্যবাদ। প্রথম গল্পেই এতোটা প্রসংশা আশাতীত। আমি ভাবিনি মেয়ে লেখক না হয়েও এতোটা সাড়া পাবো! দন্যবাদ আবারও।
sakil বোকা বাহাদুর নামটা দারুন . ভালো লেগেছে .
বিন আরফান. গল্প তার প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে হাজির হয়েছে . ফুটে উঠেছে গল্পের কারুকার্য. শিক্ষার আছে অনেক কিছ. এমন কি গল্প লেখাও. নিয়মিত লিখুন. শুভ কামনা রইল. তবে গল্প লিখে বিষয় ভিত্তিক জমা দেয়ার জন্য আর পরি সমাপ্তিতে বিঘ্ন ঘ্তানেন না. কোন অংশেই না. তবেই গল্প তার পরিপূর্ণতা ও আত্ন তৃপ্তি পাবে. পাঠকও বটে. আর আপনি পাবেন উত্সাহ.
boka bahadur আপনাদের মত কয়েকজন ভালো মানুষ আমার লেখা পড়ে আহা-উহু করেন বলেই সাহস সঞ্ছয় করে লিখি। দোয়া করবেন।
ফাতেমা প্রমি ভাই বোকা বাহাদুর-খুব ভালো লেখার হাত আপনার। সাবলীল লেখা..অনেক ভালো লাগলো আপনার বর্ণনাভঙ্গি।

০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪