প্রিয় জানপাখি,
আজ অনেক বছর পর তোমাকে লিখছি। এখন থেকে রোজ তোমাকে লিখবো বলে ঠিক করেছি। এখন তো আমার হাতে অফুরন্ত সময়! যেহেতু পোষ্ট করার কোন সুযোগ নাই, তাই সাল-তারিখ দেবোনা কোন চিঠিতেই! এই ডায়েরীর পাতাতেই ওদের আটকে রাখবো, মৃত প্রজাপতির দেহ যেভাবে কাঁচের ফ্রেমে বন্দী করে রাখা থাকে প্রজাপতি প্রদর্শনীতে, ঠিক তেমনি! ছেলেমেয়েদের বলবো আমার কবরে যেন এই ডায়েরীটা দিয়ে দেয় ওরা, তোমার কাছে গিয়ে দেখাবো কত কী লিখেছি তোমাকে! জানো, তোমার আমার সন্তানেরা অনেক বড় হয়ে গেছে এখন! অথচ মনে হয় এই তো সেদিন জন্মালো ওরা!
তুমি চলে যাওয়ার পর আমার একাকীত্বের দিনগুলোতে আমাদের তিনটি সন্তানকে ঘিরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতাম বিভোর হয়ে। শিমুল তখন দশ বছর, সুমনা আর মিতু আট আর চার বছরের।সারাক্ষন ওরা আমার পিছু পিছু ঘুরতো! আমাকে রেখে স্কুলে পর্যন্ত যেতে চাইতো না।বাধ্য হয়ে তিনটাকেই একই স্কুলে দিয়েছিলাম। বিদ্যাময়ী স্কুল এন্ড কলেজ, তোমার শিক্ষকতার শুরু যেখানে। সকালে তিনটাকেই তৈরি করিয়ে স্কুলে নিয়ে গিয়ে যার যার ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে মাঠের কোণের তোমার সেই প্রিয় নিমতলায় বসতাম। গল্প বা উপন্যাস পড়ে সময়টা পার করতাম, কখনো সখনো অন্য অভিভাবকদের সাথেও আড্ডা জমতো ওখানে। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার জ্বালা সন্তানদের ঘুমিয়ে পড়ার পর নির্জন রাত্রিগুলোতে আর সুযোগসন্ধানি কিছু পুরুষ আত্মীয়ের ইঙ্গিতপূর্ণ কথার তীরে বিদ্ধ হলেই টের পেতাম শুধু। তখন এছাড়া আর তেমন করে একাকীত্বের কষ্টটা বোঝার সময় পেতাম না।পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে পূণর্বার বিয়ে করার চাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম।আমার দৃঢ়তার কারনে তাঁরা আর উচ্চবাচ্য করেনি।সকাল থেকে রাত নয়টা দশটা অব্দি বাচ্চারা আমাকে নিঃসঙ্গতা কি তা বুঝতে দিত না। কখনো ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে বাইরের আকাশের দিকে চোখ রেখে একটু উদাস হলেই ওরা এসে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিতে দিতে বলতো, ‘ মা, মন খারাপ কেন করে আছো? আমরাতো আছিই তোমার সাথে, আমরা তোমাকে কখনো কষ্ট দেবোনা মা!’। শিমুল বলতো ‘আমিই তো তোমার বাবা’, সুমনা বলতো ‘আমি তোমার মামণি’। তখন মিতু কেঁদে দিয়ে বলতো ‘ওরা তো সব হয়ে গেলো, এখন আমি কী হবো?’ তখন আমি বলতাম তুমি আমার সৎ মা হবে। মিতু খুশি হয়ে উঠতো, ভাবত এটা খুবই মজার সম্পর্ক! আমি মনে মনে আঁৎকে উঠতাম! কী হতো যদি ওদের কপালে সৎ মা জুটতো?
একদিন গভীর রাতে তোমাকে ভেবে কাঁদছিলাম খুব, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। পাছে আমার কান্নার শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে যায়, তাই ব্যালকনীতে দাঁড়ালাম বৃষ্টির শব্দের সাথে কান্নার শব্দকে মিশিয়ে দেবার জন্য। হঠাৎ পেছন থেকে সুমনা আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! কিভাবে যেন ও টের পেয়ে গিয়েছিলো আমি ব্যালকনিতে কাঁদছি। আমি কোলে নিয়ে বললাম ‘ কিরে পঁচা মেয়ে, কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?’ সুমনা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘আমি কক্ষনো তোমাকে ছেঁড়ে কোথাও যাবোনা মা, কক্ষনো না!’। আমি বললাম তুই বড় হয়ে বিয়ে করে তো শ্বশুরবাড়ী চলে যাবি, তখন? ও বললো, ‘ না, কক্ষনো না, আমি বিয়েই করবোনা!’।
আর একদিনের ঘটনা। শিমুল, সুমনা আর মিতু মেলায় যাবে। বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে, বুটিকের যে অর্ডারগুলো নিয়েছি সেগুলো পরদিন সকালেই নিতে আসবে। তাই শিমুলকে বললাম ওদের দুজনকে মেলা থেকে ঘুরিয়ে আনতে। যথারীতি ওরা তৈরি হয়ে গেটে গিয়ে রিকশায় উঠলো। আমি রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে। রিকশা চলতে আরম্ভ করতে না করতেই মিতু শিমুলের কোল থেকে লাফিয়ে নামলো রাস্তায়। আর একটু হলেই পাশের ড্রেনে পড়েছিলো আর কি! রাস্তায় নেমেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো! আমরাতো অবাক! ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘ কী হয়েছে রে পাগলী? কাঁদছিস কেন? বল্ আমাকে’। কাঁদতে কাঁদতে অবশেষে ও বললো, ‘আমি তোমাকে ছেঁড়ে গেলে শেয়াল এসে তোমাকে নিয়ে যাবে, মেলায় যাবোনা আমি’। শিমুল আর সুমনা গেলো। পরে এই ঘটনা নিয়ে মিতুকে ওরা দু’জন মাঝে মাঝেই ক্ষেপাতো।মিতুর কাল্পনিক শেয়ালের অস্তিত্ব ছিলোনা সত্যি কিন্তু পুরুষরুপী হায়েনারা যে আমাদের চারিদিকে বন্ধুর ছদ্মবেশে ওঁৎ পেতে ছিলো তা ওদের বুঝতে দেইনি কখনো। বিধবাদের জন্য এই সমাজ আজো নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেনি গো! স্বামীহারানো মেয়েরা পাড়ার মোড়ের বড়ই গাছের মতো, ছেলে, বুড়ো সবাই ঢিল ছোঁড়ে দু’ একটা বড়ই এর আশায়, পাকা বা কাঁচা যাই হোক সমস্যা নেই!
দেখতে দেখতে কত্তগুলো বছর কেটে গেলো! সুমনা আর মিতুর এখন নিজেদের সংসার হয়েছে।সুমনা আমেরিকায় আর মিতু সুইটজারল্যান্ডে। আমাকে শেয়ালে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে ওরা আজোও কেঁদে ওঠে কিনা মাঝরাতে জানিনা, পাঁচ বছর দেখা নেই! শিমুল আলাদা বাসা নিয়েছে, এই বাসা থেকে নাকি ওর অফিস ওনেক দূর হয় তাই! প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহে একদিন আসতো, এখন মাসে একদিন আসে; আর আসে যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন সন্ধ্যাবেলায়, আমার হাতের মুড়ি মাখা আর আদা চা খেতে! তোমার সাথে এই একটা জায়গায় ওর খুব মিল! শিমুল ব্যালকনিতে বসে, এটা ওটা গল্প করে, কোনকিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে। তারপর বলে ‘মা, বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ আর সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখোতো, আদা চা দিয়ে খাবো’। আমার মনটা ভরে যায়! যাক, আমার হাতের মুড়ি মাখাটার কথা তো ওর মনে আছে এখনো! রাত নামার আগেই ও চলে যায়, অফিসার্স ক্লাবে। আমি আবার অপেক্ষায় থাকি, আবার একটা বৃষ্টি ভেজা দিনের অপেক্ষায়! এমনকি শীতকালেও!
প্রায় ছয়মাস পর শিমুলের ছেলে আর বউ এসেছিল আজ, শিমুলও এসেছিলো। এদিকে ওর কোন এক বন্ধুর ম্যারেজ ডে তে দাওয়াত ছিলো, তাই ফেরার পথে দেখা করে গেছে আমার সঙ্গে। বাড়ীর দলিলটাও নিয়ে গেছে, কোন্ এক ডেভেলপার কে দেখাবে বলছিলো। তোমার লাগানো আমগাছটা বোধহয় এবার কাটতে হবে! দিন দিন সবকিছু কেমন জানি পাল্টে যাচ্ছে গো! স্মৃতি আমাদের সময় ছিলো বেঁচে থাকার মূল্যবান প্রেরণা, আর ওদের কাছে এখন স্মৃতি মানে পিছুটান, সামনে এগোবার বাঁধা! তোমার চলে যাওয়ার সময় ওদের বয়স কম থাকায় তোমার স্মৃতি ওদের তেমন একটা মনে নেই। কিন্তু আমি ওপারে চলে গিয়ে যে ওদের পিছুটান হতে চাইনা গো! এখন দিনরাত শুধু এই ভয়ই পাই, নইলে তোমার কাছে যাবার জন্য সেই কবে থেকেই তো আকুল হয়ে আছি! কিন্তু ওদের সামনে এগোবার পথ আটকাতে যে ইচ্ছে করেনা! যাক ওরা, এগিয়ে যাক… ইতি-
তোমার প্রজাপতি
বাবার উদ্দেশ্যে লেখা মায়ের চিঠিটা পড়া শেষ হতে না হতেই শিমুলের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, বৃষ্টিভারাবনত জমাট-কালো মেঘের মতো তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকলো অবিরাম, শ্রাবণধারার মতো! শৈশবের সেইসব টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো একের পর এক! সন্ধ্যার অন্ধকারে মায়ের সেই প্রিয় ব্যালকনীতে বসে ঐ মুহুর্তে শিমুলের ভেতরটা কী এক ভীষন কষ্টে দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো! ডুকরে কেঁদে উঠলো সে! হঠাৎ পিঠে কোমল হাতের স্পর্শে ফিরে তাকালো।তাঁর স্ত্রী রিনভী মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো ‘তোমার এত ভেঙে পড়লে চলবে? মিতু আর সুমনা তো পৌঁছাবে পরশু, কত কাজ পড়ে রয়েছে! ড্রয়িংরুমে সবাই অপেক্ষা করছে মায়ের কুলখানির ব্যাপারে ডিসিশন নেয়ার জন্য।ওঠো, আর কেঁদোনা প্লিজ, নিজেকে একটু সামলে নাও, চলো’।মায়ের ইজি চেয়ারটা ছেড়ে উঠবার মুহুর্তে শিমুল আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়…