নেপোলিয়ান বলছেন-আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেবো।
সেই কত শতাব্দীর আগের কথা!পিতামহ আর পিতার কাল অতিক্রম করে স্বামী আক্কাস মিয়ার কালে এসে পড়েছেন জরিনা বেগম।তবুও তার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে এসে পৌঁছায়নি সেই মনীষীর বাণী।যদি এসে পৌঁছায়তো তবে বোধ করি এতো দিনে ঐ ডিমের উষ্ণ উত্তাপে এতোদিনে জরিনা বেগম হয়ে উঠতেন গতানুগতিক জীবন ধারার বাইরে ভিন্ন মাত্রার কিছু।সন্ধান
করতে পারতেন সংসারের বাইরে তার নিজস্ব একটি জীবনের।
জরিনা বেগমের বয়স পঁয়ত্রিশের দোর গোঁড়ায়।দুই মেয়ে তিন ছেলের জননী।বড় মেয়ে সুর্বনা।সব চেয়ে কনিষ্ঠ ছেলেটি হামা গুড়ি দিতে দিতে সবে মাত্র কেবল দাঁড়াতে শিখেছে।তার বয়স প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি জরিনা বেগম হিসাব রাখে নাই।কিন্তু সুর্বনা হিসাব কষে রেখেছে।জরিনা বেগম তার কোনও সন্তানের জম্ম দিন তারিখ সাল ফুটনোট করে রাখে নাই।তাই সুর্বনাও তার নিজের জম্ম দিন তারিখ সালের কিছুই জানেনা।মাধ্যমিক ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষার রেজিষ্টেশন করার সময় দেব নারায়ন স্যার সুর্বনার চেহারার অনুপাতে হিসাব কষে আনুমানিক একটা জম্ম তারিখ তার নাকের ডগার উপর দিয়ে রেজিষ্টেশন ফরমে বসিয়ে দিয়েছেন।সুর্বনা বলি বলি করেও দেব নারায়ন স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস করে কিছু বলে উঠতে পারেনি।সে শুধু তার জম্ম তারিখ না জানার কারনে।
মাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেও কোনও ফলপ্রসূ উত্তর পাওয়া যায়নি।শুধু বলে আমরা তোকে বানের জলে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।শুধু সুর্বনা নয়, সুর্বনার মতো হাজারও ছেলে মেয়ের আনুমানিক জম্ম তারিখ মাধ্যমিক ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষায় নথিভুক্ত করা হয়।বাংলদেশের মতো একেই রকমের গণহারে জম্ম তারিখ নথিভুক্ত করার নিয়মের প্রবনতা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে আছে কিনা তা আমার জানা নেই।বিদেশীরা আমাদের সনদ নথিপত্রে এই রকমের গণহারে জম্ম তারিখ দেখে কপালে চোখ তুলে বলে-তোমাদের দেশে একেই দিনে কি সবাই জম্ম গ্রহণ করে।বাঙ্গালী প্রতি উত্তর করতে জানে না।নাক চুলকিয়ে মাথা নিচু করে,বিব্রত বোধ করতে করতে ফিরে আসে।অজ্ঞতা যে শুধু মূর্খতা তা নয়,অন্ধত্বও বটে।জম্ম তারিখের মতো একটা তারিখ এই রকমের গণহারে পাবলিক পরিক্ষার নথিপত্রে বসিয়ে দিয়ে বাবা মা কিংবা শিক্ষকরা ভাবেন তার সরকারী চাকুরির বয়স সীমা পার হয়ে গেলেও নথিভুক্ত কাগজপত্রের বয়স সীমা সরকারী চাকুরির বাজারে তাকে প্রতিযোগিতায় ধরে রাখবে।মূলতঃ এই মানসিক চিন্তা ভাবনা থেকেই মাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষার নথিপত্রে এই রকম গণহারে আনুমানিক জম্ম তারিখ বসানোর প্রবনতা।এটা কোনও জাতীয় বিপর্যয়ের ইস্যু না হলেও ব্যক্তি জীবনের একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের ইস্যু তা জীবনের পরর্বতিতে ধাপে ধাপে অনুভব করা যায়।একটা মিথ্যা আনুমানিক জম্ম তারিখ নথিপত্রের সনদে সর্ব ক্ষেত্রে সত্য হয়ে উঠে।চৌর্যবৃত্তির প্রথম ধাপেই এই রকম একটা ভুল নিয়ে জীবনের কর্মক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রবেশ করে।নিজের সাথে এই রকম জুয়াচুরি প্রতারণা করে সারাটা জীবন চৌর্যবৃত্তি করেই র্বেঁচে থাকতে হয়।অধিকাংশ বাঙ্গালীর জীবন চৌর্যবৃত্তিতে ভরা।পরের ধনে পোদ্দারি করেই নিজেকে খুব বাহবা দেয়।অথচয় নিজের পকেটের কানাকড়ি অপাত্রে মুক্ত হস্তে দান করতেও বাঙ্গালী আজ বিষন কৃপণ।শুনেছি বাঙ্গালী চিরকালেই অথিতি পরায়ণ।গল্প কবিতায় গানে ভাবুক প্রকৃতির।কিন্তু আজ বাঙ্গালী তার নিজের জীবনের চর্চা দেখে নিজেই টোল খেয়ে পড়ে।চৌর্যবৃত্তিই হয়ে উঠছে বাঙ্গালীর বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন।
জরিনা বেগম অল্প কিছুদিন হয় আবার খুব অসুস্হ্য হয়ে পড়েছেন।তার বীজতলায় আরও একটি বীজের অঙ্কুরোদগমের পথে।পৃথিবীর মুখ দেখবে বলে সদ্য ঘোষণা করেছে।মিত্তির বাড়ির ঘরের বউরা ঐ বয়সে এসে শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য রীতিমত উদ্বিগ্ন।সকাল বিকাল দু বেলা নিয়ম করে ফিটনেস সেন্টারে,বিউটি পার্লারে দৌড় ঝাঁপ করেন।সেখানে আজ এই শিমুলতলী পল্লিতে জরিনা বেগমের মত নিরক্ষর মেয়েরা ঘনঘন সন্তান প্রসব দানে কুড়িতেই বুড়ি হয়ে উঠছে।প্রজননের ক্ষেত্র হিসাবে সন্তান উৎপাদন করাই এদের মতো মেয়েদের এক মাত্র সংসার ধর্ম।তার বাইরে সন্তান লালন পালনে মহান কর্তব্যটি প্রকৃতির উপরেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত থাকেন।
আজকাল তাই সংসারের হাড়ি পাতিলের খবরা খবর সুর্বনাকেই রাখতে হয় বলে তার পড়াশুনায় বিষন রকমের একটা ব্যবধানের তৈরি হয়েছে।সামনে তার মাধ্যমিক ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা।তার জন্য যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন সে তুলনাই তার প্রস্তুতি মোটেই তেমন সন্তোষ জনক নয়।বাবা আক্কাস মিয়ার আয়ের সীমাবদ্ধতায় আলাদা করে গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ার সে সুযোগ সম্ভাবনা যে একেবারেই অপ্রতুল।পথে পথে এই রকমের হাজার প্রতিবন্ধকতা সত্বেও এতটুকু পথ সে অতিক্রম করে আসতে পেরেছে।তা কেবলি নিজের আত্ম বিশ্বাসের উপর করে!
মাঝে মধ্যে ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে,নাকি বাবা মা তাকে এতটুকু পড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে বিড়ালের গলায় ঘণ্টী বাঁধার মত তার গলায়ও একটা কিতাবী ঘণ্টী বেঁধে দিতে চাইছেন।ভাল উঁচু ঘরের বিয়ের সম্বন্ধ আসবে বলে।আজকাল দেখেছে সুর্বনা বিয়ের পিড়ীতে বসতে গেলেও মেয়েদের শিক্ষাকে পাত্র পক্ষ মেয়ের যোগ্যতার মাপকাটিতে বিচার করে দেখে।এই জিনিসটা আগে ছিল কিনা?সে জানে না।শুধু মনে মনে একদিন ব্রত নিয়েছিল।মানুষের আকার নিয়ে জন্তুর মত বেঁচে থাকা নয় সুর্বনা।এতোটুকু বোধ যদি তার ভিতরে না জম্মালো তবে এতোদিনের পড়াশুনায় সে কি শিখেছে।
শ্বশুরালয় নয় তার আপন মাতৃগৃহেই এই নিয়ে মায়ের সাথে প্রতিদিনকার খিট্মিট্ লেগে আছে।আলোর নিচেই প্রাদ প্রদীপ অন্ধকার।এ কথাটি যে নেহাত ভিত্তিহীন অমূলক নয়।কথাটি যেন আবারও তপ্ত বালুর মত ঝিলিক দিয়ে উঠে।অজ্ঞতা তার মাকে যত তাড়াতাড়ি বশীকরণ করে অন্ধকারে তলিয়ে দিতে পারে।জ্ঞান যেন তাকে ততোবেশি আলোর দিকে উদ্ভাসিত করে ধাবিত করে।তাই যেন সুর্বনা মা, তাকে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসির গান শুনিয়ে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন তার এতোদিনের সব অর্জন।
স্বভাবত বেশি সন্তান হওয়ার কারণে জরিনা বেগম-সুর্বনার মা-তার পরিচর্যা করতে পারেন না।কোনও একটাকে গোসল করিয়ে দেয় তো অন্য দুটিতে ধূলি মাটিতে মাখামাখি অবস্হা।এক একবার ধৈর্যের সীমান্ত পাঁচিল ভেঙ্গে এক একটাকে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে নাকের ডগায় দম আনিয়ে ছাড়েন।তাই দেখে অন্য সবাই ভয়ে সিঁধিয়ে যায়।কেউ কেউ নেড়ি কুকুরের বাচ্ছা শাবকের মত মিঁইয়ে মিঁইয়ে দৌড়ে পালায়।পারত পক্ষে সেদিন আর কেউ জরিনা বেগমের কাছে ভিড় তো না।রান্না ঘরের শেকল তুলে মধ্য দুপুরের অলস নিদ্রায় ক্লান্ত জরিনা বেগম।
সুর্বনা তার ভাই বোন গুলিকে খুঁজে খুঁজে ধরে এনে রান্না ঘরের শেকল খুলে সবে মাত্র খেতে বসেছে।তাই দেখে অকারনেই জরিনা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন।মুখে অকথ্য খিস্তি খেঁউড়ে করেন।এক পর্যায় উপচে পড়া জলের মত করে সুর্বনার এতোদিনের জমানো ক্রোধ দপে উঠে মায়ের উপর।মা-মেয়ের লঙ্কা কাণ্ডে বাড়িটা যেন হয়ে উঠছিল রাম-রাবনের কুরুক্ষেত্র।পাশের বাড়ির জানালার খিড়কিতে কৌতূহলী মুখের দৃষ্টি বাড়ে।সতীনে সতীনে এমন ঝগড়া হয় কিনা কে জানে!যতটা ঝগড়া হয়ে গেল মা আর মেয়েতে।বাঙ্গালী চিরকাল শাশুড়ী বউয়ের ঝগড়া দেখেছে।মা মেয়েতে এমন ঝগড়া কে কবে দেখেছে না শুনেছে।কলি কাল আর কাকে বলে-বাচা-কালে কালে যে আরও কত কিছু দেখবো।তা আল্লাহেই জানে।মায়ের চেয়ে মাসির দরদ যাদের বেশি উদলে উঠে।পাশের বাড়ির ধাই বুড়িমা তাদের মধ্যেই একজন।সুর্বনাকে শুনিয়ে তারেই আলাপ করতে লাগল জরিনা বেগমের সাথে।
সুর্বনা ভাবে সব যুগেই কলি কাল থাকে।তবুও সেই কালকে মানুষ প্রজম্মের পর প্রজম্ম মানুষ অতিক্রম করে এসেছে।
সুর্বনা বারান্দায় শতরঞ্জি পিছিয়ে বসেছিল।তার খানিকটা দুরে ধাই বুড়িমা,এবার একটু জোড়েই বলে উঠল-কি লো তোর মেয়ে তো দেখতে শুনতে বেশ ভালোই হয়েছে।তো এবার দেখে শুনে বিয়ের ব্যবস্থা করলেই হয়।ঘরে বসিয়ে বসিয়ে এমন দুধ কলা দিয়ে পোষা কেন?মেয়ে ছেলে যত অল্প বয়সে বিয়ে হয় ততোই মঙ্গল।নাগো-ধাইমা সবেতো ষোলতে পড়ল।গাঁয়ে গতরে আর একটু ঢাঙ্গর হউক।
ঢাঙ্গর হবে কি লো,পুরুষ মানুষের হাতের ছোঁয়া লাগলে মেয়ে মানুষের শরীর কচি লাউয়ের ডগার মত তর তরিয়ে বেড়ে উঠে।দেখি জরিনা এক খিলি পান দে,পান চিবতে চিবতে ধাই বুড়ি মা জরিনা বেগমের কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিসিয়ে কি যেন বলল।ধাই বুড়ি মা যাওয়ার সময় সুর্বনা কেবল শুনতে পেল।যদি হয় আমাকে একবার খবর দিসলো…..
রাত্রে সুর্বনার বাবা বাড়ি ফিরলে জরিনা বেগম মেয়ের নামে রাজ্যের সব নালিশের ফর্দ নিয়ে বসে।সত্য মিথ্যা যাচাই করার অবশরটুকু পর্যন্ত দিতে চাইনা।সে যা বলবে তাই সত্য বলে বিবেচিত হবে,এই রকম একটা ধারণা জরিনা বেগম স্বামী আক্কাস মিয়ার উপর সব সময় চাপিয়ে দিয়ে এসেছে।ধীরে ধীরে জরিনা বেগমের গলা উপর দিকে চরতে থাকে-আমি কোনও কথা শুনতে চাই না।যত শীঘ্রই পারো ঐ ধীরেঙ্গী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে আপদ বিদায় করো।অমন মেয়ের মুখ দেখাও যে পাপ!-নিজের মেয়ে সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে তোমার বাঁধছে না,মুখে একটু লাগাম দাও।আসতে না আসতে শুরু করলে কি শুনি?
মেয়ে তার সোমত্ত হয়েছে সে জানে,কিন্তু মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করলেই তার মনটা টক দইয়ের মত কষিয়ে উঠে।ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে তো আর মেয়ে বিয়ে দেওয়া যায় না।পাড়া প্রতিবেশী না হউক,দু চারজন জ্ঞাতি গোষ্ঠীর আত্মীয় স্বজনকেও যে নিমন্ত্রণ করতে হয়।তার উপর পাত্র পক্ষের অমীমাংসিত পণের দাবি তো রয়েই গেল।চণ্ডী পাঠ তো অনেক করলে এবার একটু ক্ষান্ত দাও।তোমার স্বভাব আজকাল যা হয়েছে না।অভাবে স্বভাব নষ্ট আর কি!কিছুখন চুপ থেকে আক্কাস মিয়া আবার বলল-মেয়েটাকে আগে পরীক্ষাটা দিতে দাও।পাশ দিতে পারলে ভালো গেরস্ত বাড়ির সম্বন্ধ আসলেও আসতে পারে।তুমি ওতো তারা হুড়ো করো না তো।গরম তৈলের কড়াইয়ের উপর কাঁচা মাছের টুকরো ছেড়ে দিলে যেমনি ছেদ করে উঠে স্বামী আক্কাস মিয়ার মুখের কথা শুনে জরিনা বেগম অনেকটা সেই রকম ছেদ করে উঠল।
মুখ ভেংচি কেটে বলল-দু কলম বিদ্যের জোড়ে ফুটন্ত জলের মত তোমার মেয়ের মুখে বুলি ফুটছে।মুখে মুখ চালায়।পড়ালেখা শিখে তোমার মেয়ে এই ভদ্রতাআদব লেজ শিখছে।মনে করছে আমি কিছু বুঝি না।যখন তখন বুকের সিনা ফুলিয়ে ঘর হতে বাহির হয়ে যায়।পড়া লেখা এবার মাথায় তুলো, অনেক হয়েছে।আর না,পড়া লেখা শিখে তোমার মেয়ে জর্জ ব্যারিস্টার হবে না।মেয়ে হয়ে জম্মেছে যখন পরের ঘরে যেয়ে চুলোর হাঁড়ি ঠেলতেই হবে।স্বামীর কাছে চিঠি চালাচালি করার মত বিদ্যেটুকু থাকলে মেয়ে ছেলের আর কিছু লাগে না।কোন দিন দেকবা রাস্তা ঘাটের ছেলে ছোকরার হাত ধরে বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের নাম উদ্ধার করছে।তুমি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো।পাত্রের সন্ধানে…..মেয়ের মতিগতির হাব ভাব আমার কাছে খুব সুবিধের মনে হয় না।এক সাথে এতো গুলি কথা বলে জরিনা বেগম প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছেন।
জরিনা বেগমের কোন কুমন্ত্রণা বলে আক্কাস আলী মিয়া সে রাত্রে মেয়ে সুর্বনার উপর খুব চওড়া হয়ে উঠলেন।সোমত্ত মেয়ের শরীরে হাত তুলতে যেয়ে প্রথমে যেন হাতটা একটু কেঁপে উঠল।কাঁপা কাঁপা হাতেই মেয়ের দু গালে দুটি চড় কষিয়ে দিলেন।পড়ার সব বই খাতা উঠানের ধারে ডোবা জলের দিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন।যাওয়ার সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে বলে গেলেন-সুর্বনা কাল থেকে তোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ।বাবার মুখের তীব্রতার ঝাঁঝে সুর্বনার শরীরের রক্ত কণিকা প্রবাহ যেন পুরোদমে জমাট বাঁধা বরফের মত হিম শীতল হয়ে আসে।
মায়ের সাথে ঝগড়া,বাবার হাতের চড় খেয়ে যতটা না কষ্ট সে পেয়েছে।তার চেয়ে এই একটি মাত্র কথায় তার কষ্টের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে উঠল।শরীরের ওজনের চেয়ে আজ যেন তার মনের ওজন খুব বেশি পায়াভারি হয়ে উঠছে।সুর্বনা প্রতি শব্দটি করার মত সাহসটি পর্যন্ত পেল না।আমড়া কাঠের পতুলের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবার বৈশাখী লঘু ঝড়ের কান্ডকীর্তি দেখতে লাগল।চোখের পাতা দুটি ভোরের কুয়াশা ফোটার মত একটু একটু করে ভিজে উঠছিল।কিছুক্ষণ বাঁধে হেঁচকির মত উঠে।তারপর দপাশ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
যখন জ্ঞান ফিরে দেখে পূর্বের জানালা দিয়ে সুর্যের আলোর একখানি লম্বা ফালি তার পায়ের গোড়ালিতে এসে পড়েছে।এতো বেলা পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে ছিল নাকি অজ্ঞান হয়ে সারা রাত এখানেই পড়েছিল।ঠিক মনে করে ঠাউরে উঠতে পারে না।নাড়া চাড়া করতে গিয়ে টের পেল সারা শরীর অসাড়ের মতো অবশ।ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু একবার ঘরের চার পাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল।তার এই কোনার ঘরটায় আসবাব বলতে একটা চৌকি দেয়ালে লটকানো একটা বেতের আয়না।চৌকি ঘেঁষা পড়ার টেবিল।প্রথমে সুর্বনার চোখ পড়ে সেদিকে।টেবিলের উপর বই পত্র সব এলোমেলো হয়ে আছে।সারা ঘরের মধ্যে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই খাতার ছেঁড়া পাতা।হাত বাড়িয়ে তার দু একটা পাতা কুড়িয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে।তার এতো দিনের লালায়িত স্বপ্ন সব যেন বাবার এক বৈশাখী তাণ্ডবে পথের ধুলো মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল।নিভু নিভু লন্ঠন আলোর মতো নিষ্প্রভ হয়ে আসে তার ভূত-ভবিষ্যতের সব সম্ভাবনার পথ।তবুও সুর্বনার মত মেয়েরা পথ চেয়ে থাকে দিন পাল্টাবে বলে….
ক্লাস এইটে পড়ার সময় একবার বাংলা ক্লাসের নিয়াজ উদ্দিন স্যারকে সুর্বনা প্রশ্ন করে ছিল-বঙ্গ নারী জাগরণের অগ্রদুতেরা সব কোথায়?তারা বোধ দয়
কাঁদা জল মাড়িয়ে শিমুলতলীর পল্লীতে আসার আগেই ক্লান্ত হয়ে ফিরে যান।নিয়াজ উদ্দিন স্যার সুর্বনার মুখের কথা শুনে চট জলদি করে কোনও উত্তর দিতে পারলেন না।প্রথমে একটু ভীমরতি খেলেন পরে ধাতস্থ হয়ে সময় নিয়ে বললেন-আমাদের উপর তলার বড় বড় কিছু রাগবো বোয়াল আছে যাদের মধ্যমা আঙ্গুলের ঈশারায় এরা শিমুলতলী পল্লীতে আসার আগেই মাঝ পথে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়ে উঠেন।কিন্তু কেন?এখানে আসাটা তাদের বিষন প্রয়োজন।আর ঠিক তখনি স্কুল দপ্তরীর ছুটির ঘণ্টির শব্দটি টং টং সশব্দে স্কুল ছুটি হওয়ার শেষ ঘন্টাটিও বেজে উঠল।
যুগ পাল্টালো বটে,উপর তলার মানুষ যেন টোল খেয়ে তাকে স্বাগত জানাল।করমর্দন করে শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেল আধুনিকায়নের কালচার ভেবে।সেই অনুপাতে জরিনা বেগম আর আক্কাস আলী মিয়ার মত মানুষের মন পর্যন্ত পাল্টালো না,অনাচার অধর্ম হবে বলে।শোবার ঘর সে তো অনেক দূরের কথা….একবিংশ বিশ্বয়ানের যুগে বসবাস করেও আপাদমস্তক রয়ে গেলেন সে কালের অচল মুদ্রার মত।মানুষ মরে যেয়ে হয়ে উঠে লাশ,সংস্কার মরে যেয়ে হয়ে উঠে প্রথা।এই রকমের স্হাবর পরিবর্তন সর্ব যুগেই আছে কিন্তু জরিনা বেগম আক্কাস আলী মিয়ার মত মানুষের কোনও যুগেই পরিবর্তন নাই।এরা সর্ব কালেই সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে জড় পদার্থের মত পড়ে স্হবির হয়ে বেঁচে থাকে।এরা মরে যেয়ে বড় জোর মৃত লাশ হয়ে উঠতে পারে।কিন্তু সংস্কার ভেঙ্গে প্রথায় পরিণত হতে পারে না।গল্প উপন্যাসের চরিত্রে নয়,বাস্তবে জরিনা বেগম আর আক্কাস আলী মিয়ার ম ত চরিত্র এ সমাজে ঢের বেশি আছে যার হিসাবের কোনও ইয়াত্ব নাই।এদেরকে আজও ঘর কুনো কোলা ব্যাঙ বলেই মনে হয়।চার দেয়ালের চৌহদ্দি এদের পৃথিবীর সীমা রেখার ব্যাস।কিন্তু ততোদিনে চৌকাষ্ঠের বাইরের পৃথিবীতে বাহারী রকমের রং লেগেছে।জানালার খিড়কিতে দাঁড়িয়ে সে রং এর ঝটা দেখতেও ভয় পান জরিনা বেগম,আক্কাস আলী মিয়া।কিন্তু সে ভয় পাইবে কেন?সে একালের মেয়ে সুর্বনা,সুর্বনা আক্কাস।
গেরস্তের বাড়ির মেয়ে খিড়কিতে দাঁড়ানো যে পাপ।এতে যে গেরস্ত বাড়ি অমঙ্গল হয় পোড়ামুখী।তাও জানিস না।মাতামহীর সাবধান বাণী একদিন হয়তো মাকেও তার বয়সে শুনতে হয়েছে।এখন যেমনী মায়ের মুখে তাকে উঠতে বসতে শুনতে হয়।সংস্কার অনেকটা সংক্রামক ব্যাধির মত একবার ছড়ালে তা বোধোদয় বংশ পরিক্রমাকেও ছাড়িয়ে যায়।
স্বামী শাশুড়ী সংসারে মেয়ে যেন সত্বী সাবিত্রী স্ত্রী হয়ে উঠতে পারে।মেয়ের স্বভাব দোষে বাবা মাকে যেনও কোনও কথা শুনতে না হয়।সুর্বনাকে বন্দী খাচার তোতা পাখির মত দিন রাত তাই পড়াতে লাগল জরিনা বেগম।কিন্তু মেয়ে যে তার এতো গোঁয়ার হবে কে জানে?কিছুতেই পোষ মানা তোতা পাখি হতে চাইছে না।জরিনা বেগমও সহজে হাল ছাড়বার মত অত সহজ পাত্রী নয়।মেয়ের চুলের গুছি ধরে মাটিতে কপাল ঠুকে দেন।হায় আল্লাহ দশ মাস দশ দিন এ আমি কেমন ধাছের মেয়ে পেটে ধরেছি।আক্ষেপের চুড়ান্ত চুড়োয় জরিনা বেগম।
এক রাশ দুঃখ অপমানের গ্লানি বোধ নিয়ে সেইদিন ভরা কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে সুর্বনা যে কোথায় হারিয়ে গেল।তার খোঁজ আর কেউ দিতে পারল না।সুর্বনার পড়ার ঘরে তথ্য তালাশী করে আক্কাস আলী মিয়া কেবল একটি মাত্র চিরকুটের মত কাগজ উদ্ধার করতে পেরেছেন।মুক্ত দানার মত করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-মা আমি চললাম।পুরুষ মানুষ ঘর ছাড়লে হয় বাদশা….আর মেয়ে মানুষ ঘর ছাড়লে হয় বেশ্যা।আমি না হয় বেশ্যাই হলাম।
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪