কালবেলা

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

সোহেল আহমেদ পরান
  • ১১
  • ২১
প্রচণ্ড গরম। হাঁসফাঁস অবস্থা। এতোটুকু স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। কদিন থেকেই শুরু হয়েছে এমন। জ্যৈষ্ঠের খরতাপ বুঝি একেই বলে। বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশটা একটু মেঘও করে না। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা গরম লু হাওয়ার ধাক্কা খেলো পারু। অফিসে এসি থাকায় তিন-সন্ধ্যের এই ঢাকার খোলা আকাশটাও বড্ড নির্দয় ঠেকে তার কাছে। অফিস থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিটের মতো অপেক্ষা করতে হয় পারুকে রিকশা পেতে। এতেই ঘেমে একাকার হয়ে যায় সে। দেশটা কি মরুময় হয়ে যাচ্ছে? চরমভাবাপন্ন?- নিজেকেই প্রশ্ন করে মনে মনে পারু। নাকের উপর জমা ঘামবিন্দু ব্যাগে রাখা টিস্যু দিয়ে মোছার চেষ্টা করে সে। হঠাৎ হাসি পেয়ে যায় পারুর। নাকের উপর ঘামলে মেয়েরা নাকি বরের আদুরি হয়। এই প্রচলিত কথা বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক- পারুর সংসারটা অসুখী নয়। স্বামী আশিক ব্যস্ত-চাকুরে হয়েও বেশ কেয়ার নেয় পারুর। 'নামকরণ যথার্থ হইয়াছে'- বলা যায় আশিকের ক্ষেত্রে।

আশিককে নিয়ে টুকরো স্মৃতি মনে পড়ায় একটু জোরেই হেসে ওঠে পারু। হাসির শব্দে পিছনে ফিরে দেখে রিকশাচালক ছেলেটি। একটু অপ্রস্তুত-লজ্জা পায় পারু। কিন্তু তার হাসিটা একেবারে মিইয়ে যায় ভিন্ন কারণে। রিকশাচালক ছেলেটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে সে।

বয়স পনেরো-ষোল হতে পারে। শরীরের গড়ন মাঝারি। কালো অপরিপুষ্ট গঠন। কিন্তু মুখটা খুব মায়াভরা। পেছনে তাকানোর সময় পারু ছেলেটির মুখ দেখেছে। একটা বিষন্ন মায়াবী মুখ। পুরো মুখ ঘামে ভেজা। গাল বেয়ে পরছে ঘাম। পারু লক্ষ্য করলো- গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা একদম লেপ্টে আছে শরীরে ওর। গেঞ্জিটা অনেক জায়গায় ছেঁড়া। শরীরে ঘামাচিগুলো লাল ফোস্কার মতো হয়ে আছে।

কষ্ট হয় পারুর। জিজ্ঞেস করে সেঃ "এই শরীর নিয়ে তুমি এই গরমে আবার রিকশা চালাচ্ছো, কষ্ট হয় না?"

-" না আফা, আমাগো কষ্ট হইলে ত পেট ভরবো না" - নির্লিপ্ত জবাব ছেলেটির।

একদম থতমত খেয়ে যায় পারু। কিছু বলতে পারে না সে কিছুক্ষণ। সহসা কোনো গরমবোধ আর থাকে না পারুর। সত্যিইতো এতোটুকু গরমে হাঁপিয়ে ওঠা পারু নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করে। অফিসে এসির ঠাণ্ডা। বাসায় এসি না থাকলেও মাথার উপর ফ্যান আছে। ফ্রীজের শীতল পানি খাবার ব্যবস্থা আছে। অফিস থেকে পনেরো মিনিটের রিকশা-দূরত্বে বাসা পারুর। এটাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। ঢাকার অসহ্য জ্যামের কবলে পরতে হয় না তাকে।

ছেলেটার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলো পারু।
-"কী নাম তোমার?"
- সোহাগ
-থাকো কোথায়? কার সাথে?
-নামাপাড়া বস্তিতে । মা আর এক বইন - এই তিনজন আছি এইহানে।

আরো কিছুকথা হলো সোহাগের সাথে। ওদের গ্রামের বাড়ি ছিলো জামালপুরের ইসলামপুরের বাগান গ্রামে। বাড়িটা অবশ্য নাম মাত্রই ছিলো। ওটা আসলে ছিলো একটা ঘর। একটি ছোট ছনের ঘর। বাবা দিনমজুরের কাজ করতো। সেই ভোরে বেরিয়ে যেতো। আর ফিরতো সন্ধ্যের পর। বাড়ি ফিরেই খোঁজ নিতো সোহাগের। দুই বোনের পর অনেক আদরের ছিলো এই সোহাগ। বাবা-ই তার নাম রেখেছিলো। সোহাগ। আহা । একরাতে বাবা সফর আলী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড ডায়রিয়া আর জ্বর নিয়ে তিন দিন ভোগে এ পৃথিবী থেকে চলে যায় সফর আলী।

বাবার মৃত্যুর পর সংসার নিয়ে অকুল পাথারে পড়ে সোহাগের মা। তিন জন মানুষের মুখের খাবার যোগানোর চিন্তা শোককেও হার মানিয়ে যায়। সত্যিসত্যি সব চুকিয়ে সফর আলীর মৃত্যুর দুই মাসের মাথায় বাগান গ্রামের দীর্ঘ স্মৃতি পিছে ফেলে ঢাকায় পাড়ি জমাতে হয় তাদের। বাগান গ্রামে পড়ে থাকে দুরন্ত শৈশব, অবারিত সবুজ আর সোহাগের শিক্ষিত হবার স্বপ্ন। বাবার কথায়- মানুষের মতো মানুষ হবার সেই উচ্চাশা!

বড়বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো আগেই। তাই দ্বিতীয় বোন সাহিদা আর মাকে নিয়ে খিলক্ষেত নামাপাড়ায় বস্তিঘরে ঠাই হয় সোহাগের। আট ক্লাস পড়া সোহাগ ঢাকায় এসে রিকশা চালানোর চেয়ে ভালো কাজ আর পারে নি যোগাড় করতে। কৈশোর তার থমকে যায় রিকশার প্যাডেলে। এক লাফে বাগান গ্রামের খেলার কিশোর হঠাৎই দায়িত্বশীল হয়ে যায়। পরিস্থিতি তাকে পরিবারের কর্তা বানিয়ে দেয়!

কথা বলতে বলতে বাসার সামনে এসে যায় পারু। সোহাগের কথা শুনে একটা প্রস্তাব দেয় পারু সোহাগকে। প্রতিদিন সকালে পারুকে অফিসে পৌঁছে দেয়া আর বিকেলে বাসায় দিয়ে যাওয়া। সোহাগ খুশি-মনে রাজি হয়।

বাসায় ফিরে পারু প্রতিদিনের মতো সাবলীলভাবে কাজর্কম করতে পারলো না। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে লেবুর সরবত - এ গরমে তার পছন্দ। প্রতিদিনই সে করে তা। আজ সে ভুলে গেছে তা। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতেও ভুলে গেছে সে। একটা ঘোর কাজ করে তার মনে। প্রতীজ্ঞা করে- "গরম লাগছে" এরকম বিরক্তি সে কখনো আর প্রকাশ করবে না আর।

ভালোই চলছিলো। প্রতিদিন সকালে অফিসে পৌঁছে দেয়া আর বিকেলে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া। গত একমাসে সোহাগ যেনো অপরিচিত কেউ নয় আর। পরিবারের সদস্য যেনো একজন। পারু জানে- এটা তার ভাবনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তবু একটা এমন ছেলের, এমন একটা অসহায় পরিবারের পাশে মনের দিক থেকে থাকতে পেরেও ভালো লাগে পারুর।

এর মধ্যে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো সোহাগকে পারু। গরমে শরীরের ফোস্কাগুলোর জন্য কিছু ঔষধও কিনে দিয়েছে। বাসায় পড়ে থাকা একটা পুরনো মোবাইল সেট দিয়েছে সে সোহাগকে যোগাযোগের জন্য। খুব খুশী সোহাগ। সোহাগের তার মা ও বোনও খুব খুশী এতে। পারুর ভালো লাগে। কাউকে খুশী করার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ ও শান্তি পাওয়া যায় মনে।

প্রতিদিন সকালে সময় হবার আগেই চলে আসে সোহাগ। একদিনও ব্যতিক্রম হয় নি। কিন্তু আজ বাইরে বেরিয়ে সোহাগকে দেখতে পেলো না পারু। একটু বেখাপ্পা লাগে ব্যাপারটা তার কাছে। অপেক্ষা করে গলির ধারে। কিন্তু না। দেখা নেই সোহাগের। মোবাইল ফোনে কল দেয় পারু। মোবাইল বন্ধ। বেশ উদ্বেগ কাজ করে পারুর মধ্যে। অন্য একটা রিকশা ডেকে উঠে যায় পারু। যেতে যেতে আরো কয়েকবার চেষ্টা করে ফোনে। না। সংযোগ পাওয়া গেলো না।

অফিস থেকে এক ঘন্টা আগে ছুটি নেয় পারু। নামাপাড়া বস্তি হয়ে তারপর বাসায় যাবে সে। বস্তির পরিবেশ অল্পবিস্তর জানা আছে পারুর। সোহাগের দেয়া তথ্য মতো পৌঁছে যায় সে। কাছাকাছি পৌঁছে টের পেয়ে যায় পারু। একটা ভীষণ চিকন কষ্ট টের পায় সে বুকের ভেতর।
-- গতরাতে আগুনে পোড়ে গেছে বস্তির প্রায় পঁচিশটি ঘর। এর মধ্যে সোহাগদের ঘরও ছিলো।

কিছুই আর ভাবতে পারে না পারু। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এই বস্তি নিয়ে অনেক রাজনীতি চলে। চলে চাঁদাবাজি। আবার বস্তির\আগুনলাগা নিয়েও থাকে অনেক ষড়যন্ত্র! শিকার শুধু অসহায়রা। রাঘব বোয়াল ঠিক পেয়ে যায় ভাগ। এ এক কঠিন দুষ্টচক্র।

বুকের ব্যথাটা আরো বেশি করে টের পায় পারু। অসহায় লাগে তার। বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়ায়। ততক্ষণে সামনে ঘুঁটঘুঁটে আঁধার
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জাকিয়া জেসমিন যূথী ভাইয়া, গল্প ও লিখেন? লহুব ভালো লাগল। ভোটও রইলো।
মাঝেসাঝে লেখার চেষ্টা করি আপু... অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক বেশ ভালো লাগলো পড়ে । ভোট রইলো । রইলো শুভেচ্ছাও ।
হাসনা হেনা সোহাগদের পরিবারের কি হয়েছিল তার বিবরণ থাকলে ভাল হত। ভাল হয়েছে।
ধন্যবাদ মতামত দেয়ার জন্য। শুভকামনা রলো
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ আমার বয়স একেবারে কম নয় । আমরা যা দেখে এসেছি এখন আপনারাও তাই দেখছেন । তেমন কোন পরিবর্তন নেই । তাহলে উন্নতিটা কোখায় ? আর এই দুঃখ কষ্ট গুলো শুধু মাত্র কবি লেখকদেরকেই আবেগাপ্লুত করে, আর কাউকে কেন ছুঁয়ে যায় না ! গল্পটা ভাল লাগল । যদিও এ গল্পের সাথে বাস্তবতার কোন অমিল নেই, তবুও এটা গল্পই । ভোট রেখে গেলাম ।
সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম সানাউল্লাহ ভাই। শুভেচ্ছা রলো
আহমেদ ভালো লিখেছেন।সফলতা কাম্য
ভালোবাসা গ্রহণ করুন আহমেদ ভাই। অনেক ধন্যবাদ
Fahmida Bari Bipu ভাল লাগল। মানুষ আর প্রকৃতির বৈরিতার মাঝে চলে কিছু মানুষের জীবন। ভোট রইল।
আন্তরিক ধন্যবাদ আর অশেষ কৃতজ্ঞতা আপা। শুভকামনা রলো
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।ভোট রেখে গেলাম।
ভালো লাগায় শুভেচ্ছা জানবেন ভাই...। হা যাবো আপনার বাড়ি। ধন্যবাদ
রোদের ছায়া অল্প পরিসরে বেশ ভাল লিখেছেন কিন্ত. অনেক অনেক শুভকামনা
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা রলো আপা ...
ফয়সল সৈয়দ পড়ে ভাল লাগলো।
ভালোলাগায় আন্তরিক ধন্যবাদ। পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞা রলো Faisal Sayed ভাই ...
সোহানুজ্জামান মেহরান বেশ ভালো হয়েছে গল্পটি। ভোট করে গেলাম। আশা করি পরবর্তিতে আরো ভালো গল্প পাবো।
পড়ে মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। হাঁ ভালো লেখার প্রত্যয়ে মনের তাগিদে লিখি। লেখার ইচ্ছেও রলো। অনেক শুভকামনা মেহরান ভাই

১৮ এপ্রিল - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী