১
নব্বই বছরের দবির উদ্দিন পশ্চিমের আকাশে তাকিয়ে নিজের জীবনের সীমান্তকে অনুধাবন করছেন। অস্তগামী সূর্যের মত তারযে বিদায় আসন্ন। যাই যাই করছে জীবন শুধু যেন আঁকড়ে ধরে আছে শিকড় অগভীর মাটি; পৃথিবীর আলো বাতাশে টিকে থাকার জন্য। কখন যে উপড়ে ফেলে সে শিকড় মৃত্যু নামের অমোঘ সত্য,কখন যে নিভে যায় চোখের আলো কে জানে। সময়ের বহু পথ হেঁটেছে সে, কখনও বন্ধুর কখনও মসৃণ তবুও জীবন বড় আরাধনার বড় ভালবাসার। আদর্শবান সত্যবাদী দবির উদ্দিন কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি, কষ্টকে মেনে নিয়েছে কিন্তু নিজের সুখের জন্য অন্যায় করেনি। গ্রামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এই বৃদ্ধ দবির উদ্দিন। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। ছেলে মেয়েদেরকে নিজের আদর্শে মানুষ করেছে সে। সে ছেলে মেয়েদেরও এখন ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে। সময় বদলে দিয়েছে অনেক কিছু, একদিক শূণ্য করে অন্য দিক পূর্ণ করে দেয় পৃকৃতি। শুধু আসা যাওয়ার এ ধ্রæব সত্য বদলায়নি, বদলায়নি জীবনের প্রতি ভালবাসা আর মৃত্যুর প্রতি অনিহা। দবির উদ্দিন ইজি চেয়ার থেকে উঠে এসে গ্রীলে মাথা ঠেঁকিয়ে দিগন্তে উদাস দৃষ্টি রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কোথায় যাব বেলা শেষে? কেমন করে যাব? এ সুন্দর পৃথিবীকে ছেড়ে কেমন করে মাটির নীচে থাকব? দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে এল। এরিমধ্যে নিলয় মাথার টুপি ঠিক করতে করতে এসে বলল, দাদু কি করছ? আযান হচ্ছে, এস নামায পড়বে । নিলয় হল ছেলের ছেলে অর্থাৎ দবির উদ্দিনের নাতি। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সে। ইদানিং ধর্মের প্রতি তার অগাধ আস্থা ও আনুগত্য বেড়েছে সেই সাথে বেড়েছে তার কর্মতৎপরতা। মাঝে মাঝে সবাইকে ধর্মীয় জ্ঞান দেয় আর বোঝাতে চেষ্টা করে এ দুনিয়া কিছু নয় পরকাল হল আসল ঠিকানা। এ নিয়ে উদার পন্থী দবির উদ্দিনের সাথে মাঝে মধ্যে ছোট খাটো ঝগড়া হয়ে যায় তার। দবির উদ্দিন শহরে থাকতে চায়না। ইট পাথরে গড়া এ শহরটাকে তার কাছে খাঁচা মনে হয়। গ্রামেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর যৌবন, পৌঢ়ত্ব বলতে গেলে দীর্ঘ জীবনের প্রায় পুরোটাই। ছেলে মেয়ে ঢাকায় থাকে বলে বাধ্য হয়েই তাকে মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতে হয়। গ্রামে বাড়ীঘর জমিজমা সবই আছে। ছেলে মেয়েরা বাবার সেবা যতেœর জন্য লোকজন রেখে দিয়েছে তাছাড়া ছোট ভাইয়ের ছোট বিধাবা মেয়ে তার ছেলেটাকে নিয়ে দবির উদ্দিনের কাছে থাকে। তেমন কোন অসুবিধা হয়না কিন্তু বড় সমস্যা হল অসুস্থ্য হলে ভাল ডাক্তার পাওয়া যায়না। এবার ঢাকায় এসেছে তিন মাস হয়ে গেল। হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় ছেলে মেয়ে দুজনে মিলেই যেয়ে নিয়ে এসেছে। এখন সুস্থ্য হলেও পাঠাতে চাইছে না তারা কিন্তু দবির উদ্দিন গ্রামে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ইচ্ছা গাঁয়ের শ্যামল ছায়ায় যেন তার মৃত্যু হয়। তার ছোট ভাই খবির উদ্দিন, দুই বোন, নিজের বউ আরও কত আপনজন কত চেনা জানা মানুষ পরপারে চলে গেছে। সে জানে তাকেও একদিন যেতে হবে ওদের পথ ধরে। নিলয়ের ডাকে দবির উদ্দিন ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, দেখ্ দাদু, সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে কেমন হাসতে হাসতে। আর সেই হাসিতে পৃথিবীটা কেমন রঙ্গিন হয়ে উঠেছে আর পাখিরা ফিরছে গান গেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। নিলয় দবির উদ্দিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু, তুমি কবি হয়ে গেলে নাকি? চল, নামায পড়তে হবে। দবির উদ্দিনও নাতিকে বাম হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু ভাই, এসব বুঝতে কবি হতে হয়না। তবে এক সময় আমি কবিতা লিখতাম।
-তাই নাকি? জানিনাতো। সূর্য আবার হাসে নাকি? কিযে বলনা তুমি, পাখি গান করে, নদী সুর তুলে। এসব কি একটা কথা হল নাকি। পাখি কিচির মিচির করে আর ডাকাডাকি করে। নদীতে পানি ঢেউ তুলে, সুর তুলে কোথায়? ইসলামে গানবাজনা আর সুর টুর হারাম। দবির উদ্দিন নিলয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। নিলয় স্মিত হেসে বলল, কি হল দাদু, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
-তোকে দেখছি।
-আমাকে দেখার আবার কি হল?
-তোর মধ্যে আমি কোন অশুভ ছায়া দেখতে পাচ্ছি, যারা পাখির গান, নদীর কলতান, ¯^র্গীয় সুরকে হারাম বলে অপমান করে, তারা এ সুন্দর পৃথিবীকে ভালবাসেনা।আল্লাহকেও ভালবাসেনা কেননা এসব সৌন্দর্য আর সুর সৃষ্টিকর্তারই রূপ আর গুণের বহিঃপ্রকাশ।
-দাদু, তাবলীগে আমাদেরকে অনেক কিছু শেখায়। টিভি দেখাও হারাম। আরও বলে ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে মরে গেলে বেহেশত্ একবারে কনফার্ম। যারা আল্লাহ ও ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকে হত্যা করলেও পাপ হয়না বরং পূণ্য হয়। নিলয়ের কথায় উদার দবির উদ্দিন আতকে উঠে বলল, কি বলছিস তুই! কে দিয়েছে সে শিক্ষা? একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার জীবন দেবার ক্ষমতা নেই মানুষের আর তারা মানুষ হত্যার কথা বলে? যারা আল্লাহকে অ¯^ীকার করে তাদের বিচারতো আল্লাহই করবেন। ইসলামের মর্ম বাণীতো শান্তির কথা বলে। কেউ যদি ধর্মের বিরুদ্ধে বলেই থাকে তাকে যুক্তি আর ভালবাসা দিয়ে সত্যকে যদি বোঝাতে পার তবেইনা ইসলামের সার্থকতা।
-ধর্মকে বাঁচাতে যদি হানাহানির প্রয়োজন হয় তবে তাই করতে হবে। আল্লাহর পথে জেহাদ করে শহীদ হওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
-ভুল দাদু ভুল। এসব শিক্ষা আর অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে নিষ্ঠুর আর বর্বর করে তোলে। তুমি যদি কারুর ক্ষতি কর তোমার ক্ষতির আশংকা থেকে যায়। নিজের এবং অন্যের জীবনকে নিরাপদ আর সুন্দর রাখাই মানব ধর্ম আর সেই সাথে সৃষ্টি কর্তাকে স্মরণ করা।
-দাদু, এসব এখন থাক্, চল নামায পড়তে যাই।
-হে চল্, তবে একটা কথা বলি, ভুল পথে পা দিস্না, তোকে আমরা বড় ভালবাসি, তোর অধঃপতন আর অপমৃত্যু আমরা দেখতে চাইনা।
আজকাল তোকে কেমন যেন হয়।
নিলয় দবির উদ্দিনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, কি যে বলনা, আমি তোমার নাতি, আমি কি কোন খারাপ কাজ করতে পারি। দাদু,
তোমাকেও অনেক ভালবাসি। আমি এমনিতেই বললাম। বাদ দাওতো এসব। চল, নামায পড়তে যাই।
২
নিলয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে কথা বলছে ফিসফাস করে। এ বিষয়টি দবির উদ্দিন জানালা দিয়ে খুব মনোযোগের সহিত দেখতে লাগল। কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। এরি মধ্যে মিলি এসে নিলয়ের পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নিলয়ের ফিসফাস কথা মনোযোগের সাথে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তুু সব বোঝা যাচ্ছেনা কিছু বোঝা যাচ্ছে। নিলয় সামান্য রেগে বলল, বেটা যা করার আজকের মধ্যেই সারতে হবে। আর দেরি করা যাবেনা। এসব সহ্য করা গোনাহ।্ সাবধান, খুব গোপণে করতে হবে। আমাদের পবিত্র ধর্মকে বাঁচাতে হবে। এটা আমাদের কর্তব্য। ঈমানী দায়িত্ব। এরি মধ্যে নিলয় পাশ ফিরতেই মিলিকে দেখে চমকে উঠে বলল, কি ব্যাপার তুমি কখন এসেছ? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন ? মিলি কপালের চুল সরাতে সরাতে বলল, কিসের এমন ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছ?
-সে তুমি বুঝবে না। এটা অন্য ব্যাপার। এবার বল, কেমন আছ? খুব ব্যস্ত থাকি, তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনা।
-কি নিয়ে এমন ব্যস্ততা তোমার, যা আমি জানতে পারিনা।
-আরে পারবেনা কেন তবে এটা তোমার না জানাই ভাল। এবার বল, কি খবর তোমার।
-আমার খবর দিয়ে তোমার কাজ কি?
-ছড়ি, তোমার সাথে অনেক দিন হল দেখা হয়না আমার, খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করব ঝামেলায় আছি।
-তুমি আমাকে আগের মত আর ভালবাসনা, ইদানিং লক্ষ্য করছি তুমি কেমন যেন হয়ে গেছ। নিলয় হেসে বলল, কি যে বলনা। আমি অনেক
ভালবাসি তোমাকে, অ--নেক।
-নিলয়, আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি। আমি চাইনা কোন কারণে তোমাকে হারিয়ে ফেলি। তোমার কথা বার্তায় আজকাল আমার ভয়
হয়। না জানি তোমাকে হারিয়ে ফেলি।
-আরে হারাবে কেন, এ বাড়ীর সবাই তোমাকে পছন্দ করে।
-তা করে কিন্তু আজকাল তুমি কিসব কথাবার্তা বল, তাতে আমার ভয় হয়।
-দুরঃ কিসব চিন্তা করনা। আমি ইসলামের রক্ষক হতে চাই মাত্র। পাশ করার পর একটা চাকরি পেলেই তোমাকে বউ করে এ বাড়ীতে নিয়ে
আসব। আরতো মাত্র কটা দিন।
-ইসলাম রক্ষার নামে আবার নিজকে বিনাশ করনা যেন। কিছু শয়তান মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজের ¯^ার্থ উদ্ধার করতে চায় তাদের
কথায় মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিওনা প্লীজ।
-আরে কি বলছ তুমি। তা হবে কেন। চল দাদুর কাছে যাই। যেতেই নিলয়ের মায়ের সাথে দেখা। মিলি সালাম দিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করল। নিলয়ের মা বলল, এই আছি কোন রকম। শরীরটা বেশী ভাল না, কোমরে ব্যথা। তোমার বাবা-মা ভাল আছে?
-জী ভাল। মা সবসময়ই আপনাদের কথা বলে।
-আসতে বল একদিন। তুমিওতো অনেকদিন আস না, যাও ঘরে যেয়ে বস। বাবা তোমার কথা বলছিল। আমি একটু শুয়ে থাকি। কোমরের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। মা চলে গেলে দুজনেই দবির উদ্দিন সাহেবের ঘরে যেয়ে বসল। মিলি সালাম বলল, কেমন আছেন দাদু? দিয়ে দবির উিিদ্দন সাহেব খাটে হেলান দিতে দিতে বলল, মরণের অপেক্ষায় আছি। নাত বউ, তুমি কেমন আছ? মিলি বলল, নাত বউ হওয়া আর হবেনা বলে মনে হচ্ছে।
- কেন হবেনা। আল্লাহ চাহেতু হবে। নিলয় হেসে বলল, দাদু, মেয়ে মানুষের শুধু আজেবাজে চিন্তা। মনে বিশ্বাস রাখতে পারেনা।
- হুম্, মেয়ে মানুষের সব চিন্তাই পুরুষ মানুষের কাছে আজে বাজে। নিলয় মাথার চলি ঠিক করতে করতে বলল, মিলি, বেপর্দা থাকা গোনাহ্,
তুমি বোরকা পরতে শুরু কর। মিলি হেসে বলল, তুমিতো দেখছি পাকা মুসল্লী হয়ে গেছ।
-এটা হাসির কথানা। আমার বউ হতে হলে তোমাকে ধর্মীয় সকল বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে। মেয়েরা খোলামেলা চলা পাপের কাজ।
-কেন আমি কি বেপর্দা? আমি বোরকা না পড়লেও খুব শালীনভাবে চলাফেরা করি। শুধু মেয়েদের জন্য পর্দা না, পুরুষের জন্যও পর্দা আছে
তবে তুমি পর্দা করছনা কেন?
- আরে পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষ এক হল নাকি। মেয়েদেরকে দেখলে পুরুষ আকৃষ্ট হয় এতে মেয়েদের গোনাহ্ হয়। মিলি উঠতে উঠতে
বলল, তাই নাকি? যে দেখে তার গোনাহ্ হয়না? দবির উদ্দিন সাহেব আগ্রহ নিয়ে নিরবে ওদের কথা শুনতে লাগল। নিলয় বলল, আরে সে
কারণেইতো মেয়েরা পর্দার ভেতরে থাকবে।
-ভাল যুক্তি রপ্ত করেছ, পুরুষের পূণ্য রক্ষার জন্য নারীকে হতে হবে আবৃত কিংবা গৃহ বন্দী? চমৎকার ধর্মানুরাগ। আচ্ছা তোমার প্রতি যে
আমার ভাল লাগা ভালবাসা এটা কেমন করে হল?
-দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, জানা হয়েছে এভাবে।
-এ থেকে কি প্রমাণিত হয়না যে পুরুষ মানুষকেও নারীর ভাল লাগতে পারে? নারীও পুরুষের মত ভাল মন্দ বোধের ধারক? তাই যদি হয়
পুরুষ কেন পর্দা করবে না। আমি মনে করি যারা পাপ চিন্তাকে দমন করার ক্ষমতা রাখেনা তারা প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। নারী মেধায়
মননে আর প্রজ্ঞায় পুরুষের চেয়ে কম কিসে কেন তারা নিজকে ¯^াধীনভাবে বিকশিত করতে পারবে না?
-নারীর এত সবের প্রয়োজন নেই। পুরুষই তাদের দেখা শোনা করবে। এটাই নিয়ম।
-দেখা শোনা নয় বল ধর্মের নামে করুণা,শাসন আর শোষণ। নারীর সকল মেধা মনন প্রতিভা সে শাসনের শিকলে ধুকে ধুকে মরবে অনাদরে
অবহেলায়। আমিতো জানি ধর্মে নারীর কোন কাজে বাধা নেই তবে নারীকে সাধারণ পর্দার করতে হবে। যা নারীর কল্যাণের জন্যই
প্রয়োজন।
-এটা তোমাদের ভুল ধারণা, নারীর ঘরেই মঙ্গল। তোমরা এসব বোঝনা বলেই নারীর এত অপমান আর লাঞ্চনা। চারিদিকে এত অনাচার
আল্লাহর বিধান কি মিথ্যে। ধর্মের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে তা এখনি নির্মূল করা উচিৎ।
-ভাল কথা, চারিদিকে যে দূর্নীতি, ঘুষ, রাহাজানি, হীনতা শঠতা এসবের বিরুদ্ধে আগে নাম। এসবওতো কোরাণ হাদিসের বিরুদ্ধে। ওসব
নিয়েতো কখনও কাউকে আন্দোলনে নামতে দেখলাম না। এটা কি ঈমানী দায়িত্ব নয়? এবার দবির উদ্দিন সাহেব হাতবালি দিয়ে বলল,
চমৎকার বলেছ নাত বউ, তুমিই ওকে পথে আনতে পারবা।এরি মধ্যে নিলয়ের মোবাইল বেজে উঠল। নিলয় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে
একটু ইতঃস্তত করে বলল, মিলি তুমি বস, আমার একটা জরুরী কল এসেছে। একটু কথা বলে আসি। চলে গেল নিলয়। মিলি মনে মনে
ভাবল, নিলয় আসলে কি করছে।
৩
রাতে হঠাৎ করেই দবির উদ্দিন সাহেবের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ইদানিং মৃত্যুর কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে। ¯^প্নে সে দেখেছে কার কবর যেন খোঁরা হচ্ছে আর লাশ নিয়ে এস্ছে কারা যেন। ভয়ে আর কষ্টে হঠাৎ ঘুমটা তার ভেঙ্গে গেল। তা ছাড়া কি কারণে যেন তার মনটা কেমন আনচান কওে ইদানিং। না জানি কোন বিপদ সংকেত। ফুরিয়ে এসেছে বেলা ফিরতেতো হবেই একদিন, টিকে থাকার সংগ্রাম যতই করুক মৃত্যুর কাছে পরাজয় যে অবধারিত। সে অজানা নিষ্ঠুর মৃত্যুকে যেন সবারই ভয়। পাশেই নিলয় নিঃচিন্তে ঘুমুচ্ছে। দবির সাহেব নাতির সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, একদিন সবাইকে ছেড়ে আমি চলে যাব। কেমন করে থাকব? চলে যদি যেতেই হয় তবে কেন এ মায়ার বাঁধনে বাঁধলে খোদা। তারপর নিলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারে বসল। বেশীক্ষণ বসে থাকতে ভাল লাগলনা তার। উঠে বারান্দার এপার থেকে ওপারে পায়চারী করতে লাগল। হঠাৎ চেয়ারটায় পা লেগে পড়ে গেল দবির সাহেব। পড়ে যাওয়ার শব্দে সবারই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের দরজা খোলাই ছিল। নিলয়ের বাবা-মা তড়ি গড়ি করে রুমে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে খুঁজতে লাগল দবির সাহেবকে। নিলয় হন্ত দন্ত হয়ে বারান্দায় এসে দেখে দবির সাহেব চেয়ার ধরে নিচে বসে আছে। নিলয় দবির সাহেবকে জড়িয়ে ধরে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বলল, দাদু এত রাতে তুমি বারান্দায় কেন এসেছ? পড়ে গিয়েছিলে? ইস্রে কেন যে অন্ধকারে বারান্দায় এসেছ? ব্যথা পেয়েছ? নিলয়ের বাবা-মা বারান্দায় এসে নিলয়ের কথার পুনরাবৃত্তি করল কেন এত রাতে বারান্দায় এসেছে। ওরা সবাই অস্থির হয়ে উঠল। নিলয়ের মা দবির সাহেবকে ধরে বলল, ব্যথা পেয়েছেন বাবা? এ শরীর নিয়ে কেন যে এখানে এসেছেন। চলুন ঘরে । নিলয়ের বাবা বলল, ঘরে আসেন: প্রেসারটা মেপে দেখি। নিলয়, তুই কি টের পাসনি?
-আমিতো ঘুমিয়ে ছিলাম। দাদু তুমি আমাকে ডাকলেইতো পারতে।
-তোমরা এমন অস্থির হচ্ছ কেন? আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি। নিলয়ের বাবা দবির সাহেবকে ঘরে আনতে আনতে বলল, কি বলছেন, অস্থির হবনা?। যদি আরও কিছু হয়ে যেত। আব্বা আপনি এখনও আগের মতই আছেন। আপনার কি খারাপ লাগছে? দবির সাহেব বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। আমাকে গ্রামে রেখে আয়। আমার মনে হয় আমার ফেরার সময় হয়ে আসছে। নিলয়ের বাবা আবেগে দবির সাহেবের হাতখানি বুকের সাথে মিশিয়ে ম্লান মুখে বলল, বাবা এভাবে বলবেন নাতো। খুব খারাপ লাগে। নিলয় বলল, দাদু আর কক্ষণও এসব বলবে না। তোমাকে আমরা কোথাও যেতে দেবনা। দবির সাহেব মৃদু হেসে বলল, যেতেতো হবেই দাদু। আমাকে কালই গ্রামে পাঠিয়ে দে, আরিফ। নিলয়ের বাবা প্রেসার মেপে বলল, প্রেসারটা বেড়েছে, ঔষধ দিচ্ছি, খেয়ে চুপ কওে শুয়ে থাকুন। দেখি কাল গ্রামে পাঠানো য়ায় কিনা। গ্রামে থাকলে আমরা আপনার জন্য চিন্তিত থাকি। দবির সাহেব পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, তবুও আমি গ্রামেই যেতে চাই।
দবির সাহেবকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা নিলয়ের উপরই পড়ল। সকালে নাস্তার টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতে মা সবাইকে ডাকল। নিলয় এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মা, দাদুকে বাবা নিয়ে গেলে হয়না? আমার জরুরী কাজ আছে।
-তোর পরীক্ষা শেষ। এখন আবার কিসের কাজ?
-আছে, আমি তাবলীগে যাব আমাদের টিমের সাথে।
-টিম আবার কিসের?
-আছে, সে তুমি বুঝবেনা।
-তাবলীগে কি আল্লাহ বসে থাকে? আল্লাহকে ঘরে বসেই ডাকা যায়। নিলয় অবাক হয়ে বলল, কি বলছ মা,তোমারত মা হিসাবে খুশি হওয়ার
কথা। তাবলীগে গেলে অনেক কিছু জানা যায় বোঝা যায়,আল্লাহর সান্যিদ্ধ পাওয়া যায়।
-বাবা, চারদিকে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। ভাল কিছু শিখতে যেয়ে হানাহানি আর বিভেদ শিখিসনে। তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। এরি মধ্যে নিলয়ের বাবা আর দবির সাহেব এসে চেয়ারে বসল। দবির সাহেব বসতে বসতে বলল, কি কথা হচ্ছিল মা ছেলের সাথে? মা নাস্তা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখেন বাবা, কয়দিন পর পরই ও তাগলীগে যায়। এখন বলছে, আপনাকে নিয়ে যেতে পারবেনা। নিলয়ের বাবা বলল, তাবলীগে গেলে পরে যাবি। আমার জরুরী কাজ পড়ে গেছে নাহয় আমিই নিয়ে যেতাম। যা, ক দিন গ্রামে ঘুরে আয়। আমরা পরে যেয়ে বাবাকে দেখে আসব। দবির সাহেব চুপ করে নাস্তা খাচ্ছিল। মা বলল, বাবা আপনি আলুর দম পরোটা খেতে পছন্দ করেন তাই করেছি।
-হে বউ মা। কিন্তু আগের মত খেতে পারিনা। তোমরা আমায় এত ভালবাস, তাই আর মরতে ইচ্ছে করছেনা। নিলয় দবির সাহেবকে বাম হাতে ধরে বলল, দাদু তোমাকে না বলেছি মরণের কথা বলবেনা। দবির সাহেব ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমারতো মরণের সময় মরব কিন্তু যখন দেখি তরতাজা তরুণদের অপমৃত্যু তখন মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। আজকে পত্রিকায় দেখলাম মেডিকেলের একজন মেধাবী ছাত্রকে কারা যেন হত্যা করেছে। সে অমানুষদের শাস্তি কবে হবে। মানুষ মানুষের প্রাণ নাশে। কি কষ্টের বিষয়। নিলয় গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, নাস্তিকদের এভাবেই মরণ হওয়া উচিৎ। আল্লাহ রসুলের বিরুদ্ধে কথা বলে। দবির সাহেব খাবার মুখে পুরতে যেয়ে থেমে গিয়ে বলল, কি বলছিস দাদু! নাস্তিক হলেই তাকে হত্যা করতে হবে এটা তুই কোথায় শিখেছিস? ছিঃছিঃ! নিলয়ের বাবা বলল, তুই আজকাল বড় আল্লাহওয়ালা হয়ে গেছিস নাহ? খবরদার ওসব কক্ষণও বলবি না। আগে ভাল মানুষ হ তারপর ওসব। নিলয় বিরক্ত হয়ে বলল, বাবা, ধর্ম কর্ম না করলে মানুষ হব কি করে। এ ধরণের কথা বলনাতো, গুনাহ হবে। দবির সাহেব বলল, দাদু ভাই, তোমার কথাবার্তা শোনে মনে হচ্ছে তোমার মস্তিস্ককে কেউ ধোলাই করেছে। সব ধর্মেরই মূল কথা হল মানবতা,সততা আর সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা। দাদু ভাই, ধর্মের প্রতি আনুগত্য থাকা ভাল কিন্তু না বোঝে তা ব্যবহার করা ভালনা। নিলয় উঠতে উঠতে বলল, তোমাদের সাথে কথা বলে লাভ নাই, ধর্মীয় উপদেশ দেয়াও পূণ্য। মাকে বললাম বোরকা পরে বাইরে যাবে, মা তা করেনা। বললাম বাইরের পুরুষ মানুষের সামনে পর্দা ছাড়া যেওনা। এসব বললে মা হাসে। এত আরবী নাম থাকতে,আমার নাম রেখেছে নিলয় আর আপার নাম রেখেছে নিলু। মা হেসে বলল, কেন তোরতো আরেকটা ভাল নাম আছে।
-সেটাও আরবী নাম না। বাবা বলল, নাম টাম দিয়ে কিছু হয়না কর্মেই মানুষের পরিচয়? হঠাৎ করে তোর এ পরিবর্তন কেন বুঝলামনা। শুন্, কারু কথায় কান না দিয়ে ধর্মের প্রকৃত বিষয়গুলি জানার ও বোঝার চেষ্টা কর। দবির সাহেব একই কথা বললেন। এসব শোনে নিলয় বিরক্ত হয়। বাসার সবাইকে তার থেকে সে আলাদা ভাবে। মিলির সঙ্গেও এসব নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয় মাঝে মধ্যে।
৪
দবির সাহেব গ্রামে ফিরে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। গাঁয়ের এ শ্যামল ছায়া, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, পাখির গান, নদীর কলতান এসব তাকে বড় টানে। জীবনের অনেককিছু বদলে গেছে কিন্তু বদলায়নি এসবের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। বাড়ী ফিরতে বিকেল গড়িয়ে পড়েছে। ভাইয়ের মেয়ে লায়লা বেগম খবর পেয়ে আগেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। বিধবা লায়লা দবির সাহেবের বড় যতœ আতœী করে। মোটামোটি অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছে সে। একটি মাত্র ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ীতে এসে উঠেছিল। বাবার সম্পত্তির অনেকখানিই নষ্ট করে ফেলেছে চার ভাই মিলে যা আছে তাদেরই যেন হতে চায়না। দবির সাহেব দিল দরাজ মানুষ, তাই ছেলে সহ নিজের বাড়ীতে নিয়ে এসেছে ওদেরকে এবং ছেলেটাকে লেখা পড়া করিয়েছে। ছেলেটা এম,এ পাশ করে ভাল একটা চাকুরী করে চট্রগ্রামে। মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে কিন্তু দবির সাহেবকে ফেলে সে যাবেনা অকৃজ্ঞের মত। এই তার কথা।
দবির সাহেব পশ্চিমের উঠোনে এসে চেয়ার টেনে বসল। পাশেই ছোট্র একটা বাগান। বাগানে তেমন একটা ফুল নেই। কি কারণে যেন কয়েকটা ফুল গাছ মরে গেছে। দবির সাহেব লায়লাকে ডেকে এনে বলল, কিরে, ফুল গাছগুলি কি কারণে মরল? লায়লা বলল, চাচাজী, ঠিক বুঝতে পারতেছিনা কি কারণে এমন হইছে। রশিদ যতœ করছে ঠিকই।
-রশিদকে বলবি কয়েকটি ফুল গাছ এনে আবার লাগিয়ে দিতে।
-জ্বী বলব। চাচাজী, চা নাস্তা এখানে দিব, নাকি ভিতরে যাইয়া খাইবেন?
-এইখানেই নিয়া আয় আর নিলয়কে আসতে বল। লায়লা চলে গেল। অনেকদিন গাঁয়ের উন্মুক্ত দিগন্তে সূর্য ডোবা দেখেনা সে। এ বাড়ীটির দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকটা বেশ খোলা মেলা তাই ভাবল আজ চা খেতে খেতে নিলয়কে সাথে নিয়ে সূর্যাস্ত দেখবে সে। একটু পরে লায়লা নাস্তা নিয়ে এসে বলল, চাচাজী, নিলয় বাবাজী, ফোনে কতা কইতেছে। এহন চা খাইব না। আপনি নাস্তা খান, আমি চা আনতেছি।
-যেয়ে নিলয়কে বল, আমি আসতে বলেছ্।ি
-জ্বী, চাচাজী, রাতে কি খাইবেন, কি রান্না করব? রুটি খাইবেন?
-আমি রুটিই খাব। নিলয় কি খাবে জিজ্ঞেষ কর। হেরে রশিদটা কোথায়. ওকেতো দেখছিনা।
-ওর শশুর মারা গেছে তাই সেখানে গেছে। মৃত্যুর কথা শোনে দবির সাহেবের নিজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেল। মনে মনে ভাবল, আমিও
চলে যাব কিন্তু কোথায় যাব? আবির ছড়ানো পশ্চিমে দিগন্তে দবির সাহেবের উদাস দৃষ্টির ম্লান আলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। এরি
মধ্যে নিলয় এসে দবির সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বলল, দাদু কি ভাবছ এমন করে? দবির সাহেব বলল, দেখ্, সূর্যটা কেমন রং ছড়িয়ে
ওপারে চলে যাচ্ছে; সে জানে আবার ফিরবে এ ভুবনে কিন্তু আমরা আর ফিরব না। নিলয় হেসে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, দাদু
তুমি মৃত্যু নিয়ে এত বেশী ভাব কেন? তুমি একজন বাস্তববাদী মানুষ। বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেয়াইতো বুদ্ধিমানের কাজ। দবির সাহেব
বলল, মেনেতো নিতেই হবে। তবে তোকে আমি একটা কথা বলতে চাই।
-বল, কি বলবে?
-এ ছোট্র জীবনটাকে অন্ধ বিশ্বাস আর লোভের শিকলে বন্দী করবি না। লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশী।
-আমাকে নিয়ে তুমি এত ভেবনাতো। নাও নাস্তা খাও। দাদু কয়দিন এখানে থাকব।
-অবশ্যই থাকবি। গাঁয়ের এ উদার প্রকৃতির মাঝে নিজকে বিলিয়ে দে, দেখবি মনের জটিলতা কমে গেছে।
-আমার মনে জটিলতা আছে তোমাকে কে বলল?
-আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি। তুই বিশ্বাস আর বাস্তবতাকে একবারেই অঅলাদা করে ফেলেছিস।
-বাদ দাও এসব কথা, এখন খাও।
রাতে নিলয় দবির সাহেবের সাথেই ঘুমিয়েছে। অনেক রাতে নিলয়ের ফোন বাজতেই দুজনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিলয় ফোন হাতে নিয়ে বাইরে চলে যেতেই দবির সাহেব জানতে চাইল কার ফোন, নিলয় বলল, আমার এক বন্ধুর।
-এত রাতে কেন?
-দরকার আছে। তুমি ঘুমাও, আমি বাইরে কথা বলছি। নিলয় প্রায় আধা ঘন্টা কথা বলে রুমে ফিরল। তখনও দবির সাহেব ঘুমায়নি। পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, এত রাতে কিসের এত কথা। মিলি ফোন করেছিল নাকি?
-নাহ্, বললাম না আমার এক বন্ধু। নিলয় কেমন যেন অস্থিরতা বোধ করতে লাগল। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বারান্দায় চলে গেল।
দবির সাহেব সবই লক্ষ্য করল আর মনে মনে ভাবল। এমন করার কারণ কি? প্রশ্নও করেছে নিলয়কে কিন্তু কিছু না বলে চুপ থেকেছে।
৫
নিলয় সকালে ঘুম থেকে উঠেই বলল সে এখনই ঢাকায় চলে যাবে। এ কথা শোনে সবাই অবাক হল। কালইতো বলল ক দিন থাকবে গ্রামে হঠাৎ করে আবার কি এমন হল যে এখনই চলে যেতে হবে। লায়লা বলল, না আজ যাওয়া যাবেনা ভাইজান । ভাবীর জন্য কিছু পিঠা বানায়ে দিব তা ছাড়া তোমাকেতো কিছুই খাওয়ানো হইলনা বাবা। নিলয় ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, আরেকবার এসে খাব। আমাকে আজই ফিরতে হবে। কারু কথাই শুনলনা নিলয়। নাস্তা পর্যন্ত করলনা। দবির সাহেবের কাছে নিলয়ের হঠাৎ চলে যাওয়ার বিষয়টি ভাল মনে হলনা। বার বার নিলয়কে তীক্ষè দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আর বার বার প্রশ্ন করল, কি হয়েছে? নিলয় হাসির ভান করে বলল, কিচ্ছু হয়নি দাদু।
-কিছু একটা হয়েছে,রাতেও কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছিল তোকে। আমার কাছে লুকোবিনা।
-তুমি অযথা চিন্ত করনাতো। নিজের দিকে খেয়াল রাখবে, ঠিক মত ঔষধ খাবে। আর একটা কথা, বার বার মরণের কথা বলবেনা, মনে থাকে যেন। লায়লা আন্টি, আপনি দাদুকে বেশী ঘুরাঘুরি করতে দেবেন না, ঔষধ পথ্য যেন ঠিকঠাক মত খায়। আমি আবার এসে সবকিছুর হিসাব নেব। লায়লা হেসে বলল, ঠিক অঅছে। তবে না খাইয়া বাইর হওয়াটা ঠিকনা। অনেক বলাবলির পরও কিছুই খেলনা। দবির সাহেব ধরে নিল কোথাও কোন একটা সমস্যা হয়েছে না হয় এমন করবে কেন। লায়লা আফসোস করে বলল, ছেলেটা এতদিন পর আইল কিছুই খাওয়াইতে পারলাম না। চাচাজী, নিলয় বাবাজী কেমন বদলাইয়া গেছে। আমারে কত ভাল ভাল কতা কইল, এমনে চলবেন, এমনে চলবেন না, এই দুনিয়াডাই সব না। মরতে হইব। আর কত কি। দবির সাহেব হেসে বলল, আর বলিস না ইদানিং ধর্মের প্রতি তার বড় অনুরাগ জন্মেছে। তবে আগের থেকেই ও ধর্ম ভীরু কিন্তু এতটা ছিলনা। এ অবস্থা দেখে আমার ভয়ই হয়।
-কি কন চাচাজী ভয়ের কি আছে। এইডাদ-খুবই ভাল কতা। চাচাজী, আমি মিনতি দিদির সাথে কতা কইতে ছিলাম; নিলয় বাবা দেইখ্যা আমারে বলল কি জানেন? বলল বিধর্মীদের সাথে এত মাখামাখি ইসলামে নিষিদ্ধ। গুনাহ্ হবে।
-এসব ওর বাড়াবাড়ি। সবইতো আল্লাহর সৃষ্টি। ও কিছু না খেয়েই এমন তড়িগড়ি করে গেল আমার ভাল লাগছে না। তাছাড়া রাতেও কেমন
যেন মনে হল ওকে। আমার চিন্তা হচ্ছে।
-আপনি কোন চিন্তা করবেন না, নিলয় বাবা বুদ্ধিমান ছেলে।
-জানিনা ওর মাথায় কি চেপেছে। আল্লাহ যেন ওকে কোন খারাপ পথে না নেয়।
রাতে নিলয়ের বাবা ফোন দিয়ে জানতে চাইল দবির সাহেব কেমন আছে আর নিলয় কি করছে। দবির সাহেব অবাক হয়ে বলল, কেন বাসায় যায়নি? নিলয়ের বাবা জানাল নিলয় ঢাকায় যায়নি। নিলয় কোথায় গেল এই নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। আত্মীয় ¯^জনদের কাছে ফোন করেও কোন খোঁজ পাওয়া গেলনা।
দুদিন পর নিলয় বাসায় ফিরল। বাবা-মা জানতে চাইলে বলল, কোন বন্ধুর বাসায় ছিল। এজন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কেন ফোন দিয়ে জানায়নি প্রশ্ন করলে সে জানাল ফোন দেয়ার সুযোগ ছিলনা। তারপর নাস্তা খেয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। ভার্সিটিতে ঢুকতেই কে একজন কালো বোরকা পরা মহিলা নিলয়ের পথ আগলে দাঁড়াল। নিলয় একটু বিব্রত হয়ে বলল, কে আপনি? সড়ে দাঁড়ান। সে মহিলা গম্ভীর গলায় বলল, নাহ্ পথ ছাড়ব না, তোমাকে হাইজ্যাক করব। নিলয় বিরক্ত হয়ে বলল, এসব কি করছেন, পথ ছাড়েন বলছি। নিলয় যতই পাশ কেটে যেতে চাইল ততই মহিলা পথ আগলে ধরে বলল, তোমাকে নিয়ে যাব, চল অঅমার সাথে। নিলয় এটা সেটা বলে মহিলাকে তিরস্কার করতে লাগল। পাশ দিয়ে দুজন ছাত্রী যাচ্ছিল এসব দেখে এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে নিলয় ভাই?
-দেখুনতো এ মহিলা কি চাইছে। আমার পথ আগলে রেখেছে। ওরা নানা প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেলনা শুধু বলল, আমি ওকে ছিনতাই করব। আপনারা যান, এটা আমাদের ব্যাপার। এক জন ছাত্রী বলল, কে আপনি? কি চান?
-নিলয়কে চাই। আরেকজন ছাত্রী বলল, নামও জানে দেখছি, এই তাড়াতাড়ী বল, নইলে এখনি পুলিশ ডাকব। নিলয় বলল, এই আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? ভাল হবেনা পথ ছাড়–ন। নিলয় পাশ কেটে যেতেই বোরকা পড়া মহিলা নিলয়ের হাত ধরে বলল, খবরদার পালাবে না। ছাত্রীরা শেষ পর্যন্ত মহিলার মুখোশ টেনে খুলে ফেলল। মুখের উপর থেকে নেকাব খোলার পর মিলির চেহারা দেখে নিলয় হেসে বলল, ওরে দুষ্টু, ফাজলামু আমার সাথে। ছাত্রী দুজন বলল, কি ব্যাপার চেনেন নাকি? নিলয় হেসে বলল, জী। ছাত্রী দুজন বলল, এসবের মানে কি? মিলি হেসে বলল, এসবের মানে আপনারা বুঝবেন না। ওরা যেতে যেতে বলল, আমাদের বুঝে আর কাজ নেই, চল যাই। ওরা চলে গেল। নিলয় বলল, তুমি এখানে এসেছ কেন?
-বোরকা পরে তোমাকে দেখাতে এসেছি। এ দুদিন কোথায় ছিলে? সবাইকে টেনশনে রেখে তুমি উধাও হয়ে যাও, নাহ। তোমার জন্য যে আমরা টেনশনে থাকি তাকি তুমি বুঝ?
-বাব্বাহ্ ধন্য হলাম। একদিন যদি চিরতরে উধাও হয়ে যাই;তখন কি করবে?
-অলক্ষনে কথা বলনাতো।
-ঠিক আছে, বলবনা। আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে যে তুমি আমার কথামত বোরকা পড়েছ। তুমি এখন যাও, আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
-তাড়িয়ে দিচ্ছ আমাকে?
-তাড়াব কেন, ক্লাস আছে। বাসায় এস।
-নিলয় একটা কথা বলি, বেশী বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেতে উঠ না। কার নষ্ট চিন্তা কখন তোমাকে পেয়ে বসে তা বলা যায়না।
-তুমি কি আমাকে এত দূর্বল ভাব। যাও বাসায় যাও। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
নিলয়ের বাবা-মা দুজনই দবির সাহেবকে দেখে তিনদিন পর ঢাকায় ফিরেছে। বাসায় ফিরেই মা বিছানায় শুয়ে পড়েছে। জার্ণি করলে তার মাথা ব্যথা করে, বমি হয়। বাবা কাজের মেয়েকে ডেকে বলল সবকিছু গোছগাছ করতে। তারপর কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে কাজের মেয়েকে চা দিতে বলল। এরি মধ্যে কলিং বেল বাজতেই মা কাজের মেয়েকে বলল দেখার জন্য। কাজের মেয়ে রাহেলা দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখে দৌড়ে বারান্দায় এসে বলল, খালুজান পুলিশ আইছে। নিলয়ের বাবা অবাক হয়ে বলল, পুলিশ? পুলিশ আমার বাড়ীতে কেন? তুই যা আমি দেখছি। নিলয়ের বাবা দরজা খোলে জানতে চাইল কি কারণ। পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল, আপনি নিলয়ের কে হন?
-আমি নিলয়ের বাবা।
-নিলয় কোথায়?
-ভার্সিটিতে, কিন্তু কেন?
-আমরা তাকে গ্রেফতার করতে এসেছি। এ কথা শোনে নিলূেয়র বাবা আতকে উঠল, কেন? কি করেছে সে?
-মেডিকেলের ছাত্র মিলন খাঁনকে সে আর তার বন্ধুরা মিলে খুন করেছে। নিলয়ের বাবা জোর গলায় বলল, অসম্ভব, আমার ছেলে এ কাজ
কক্ষণও করতে পারে না। এটা মিথ্যা তথ্য। আপনারা ভুল করছেন।
-আপনি ভুল করছেন, আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। মা শোনে উঠে এসে বলল, কি হয়েছে? পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল, আমাদেরকে বাসা সার্চ করতে দিন। আপনার ছেলে ইসলাম পন্থী একটি সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য। এটা নিশ্চিত যে এ খুনের সাথে আপনার ছেলে জড়িত। একজন সদস্য ধরা পড়েছে সেই সবার নাম বলেছে। মা চিৎকার করে বলল, অসম্ভব, আমার নিলয় খুন করতে পারেনা। মিথ্যা কথা।
-সত্য কি মিথ্যা তার প্রমাণ খুব তাড়াতাড়িই পাবেন। ভেতরে ঢুকে নিলয়কে তন্ন তন্ন করে খুঁজল ওরা কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। তারপর যেতে যেতে বলল, ধরা তাকে পড়তেই হবে। আমরা আবার আসব। বাবা-মা কেউ আর কিছুই বলতে পারলনা শুধু যন্ত্রণায় কোকাতে লাগল আর মনে মনে প্রার্থনা করল আল্লাহ এ কথা যেন মিথ্যে হয়।
৬
দবির সাহেবের কানেও নিলযের অপকর্মেও সংবাদ পৌঁছে গেছে। দবির সাহেব এ কথা শোনে ভীষণ মর্মাহত হল। নাতিকে প্রচন্ড ভালবাসে সে কিন্তু সে একি করেছে। দবির সাহেব মনে মনে অনেক কিছু ভেবেছিল নিলয়ের চালচলন দেখে কিন্তু সে খুন করবে এ কথা সে ¯^প্নেও ভাবেনি। শেষ অবধি এত অধঃপতন। এ যেন ভাবতে পারেনা দবির সাহেব। জীবনের প্রান্তে এসে এমন একটা ধাক্কা খাবে কখনও সে ভাবেনি। এর পরিণতি কি হবে কে জানে। অন্যায়ের বিচারতো হতেই হবে। আর যদি এ জঘণ্য অপরাধের বিচার নাহয় তবে অপরাধযে ডালপালা মেলে সবকিছু গ্রাস করবে। প্রিয় নাতিকে হারাবে তা ভাবতেই তার বুকটা হাহাকার করে উঠে। এ বয়সে যেন এসব চিন্তার ভার তার সইছে না।
রাতে বিছানায় শুয়ে দবির সাহেব ছটফট করতে থাকে কিন্তু ঘুম আসেনা। শরীরটাতে আর আগের মত বল পায়না সে। এ খবর শোনার পর খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। ভাবল বারান্দায় যেয়ে বসবে। উঠতে যেয়েই দবির সাহেব আবার বসে পড়ল। লায়লা টের পেয়ে এসে বলল, চাচাজী আপনি এখনও ঘুমান নাই?
-ঘুম আসেনারে মা, কি হয়ে গেল। এখন কি হবে।
-এইডাদ মিছা অইতে পারে।
-নাহ্, মিছানা, এইটা সত্য।
-আমারদ একবারেই বিশ্বাস অয়না, নিলয় বাবাজী এমন কাম করতে পারেনা। এরি মধ্যে দরজা ঠক ঠক আওয়াজ হয়। লায়লা বলল, এত
রাইতে আবার কে আইল।
-দেইক্ষা খুলিস। লায়লা দরজায় এসে জানতে চাইল কে, বাহির থেকে বলল আমি নিলয়। লায়লা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলল, আস বাব,া ভেতরে আস। দবির সাহেব বলল, কে আসছেরে লায়লা? নিলয় দবির সাহেবের রুমে ঢুকতেই দবির সাহেব বলল, আমার বাসায় কোন খুনির জায়গা নাই, কেন আসছস? চলে যা আমার সামনে থেকে। এ খুনির মুখ দেখাও পাপ। নিলয় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, দাদু আমরা মানুষ খুন করি নাই, নাস্তিক আর জানোয়ার খুন করেছি আল্লাহর নামে। আমরা পাপ করিনি। ইসলাম রক্ষার জন্য, শান্তি রক্ষার জন্য ধর্মদ্রোহি কতল করেছি। দুর্বল দবির সাহেব গর্জে উঠল, তোকে মানুষ খুন করে ইসলাম রক্ষা করার অধিকার কোন খোদায় দিয়েছে? ভুল বিশ্বাস তোদেরকে অন্ধ করে তুলেছে। বের হ তুই আমার বাড়ী থেকে। আমার কষ্ট আর বাড়াসনে। লায়লা বলল, চাচাজী শান্ত হন। না বুঝে করছে।
-এখন বুঝবে। সে ধর্মদ্রোহী হলে তার বিচার আল্লাহ নিজেই করতে পারে। এখন তোকে কে বাঁচাবে? তুই আমাদের কথা একটুও ভাবলি না।
-নিলয় বলল, আল্লাহর নামে মরতেও আমরা প্রস্তুত। আমি থাকতে আসিনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার জন্য দোয়া কর। যাই
আন্টি। পুলিশ আমাদেরকে খুঁজছে। আর দেরি করা ঠিক হবেনা। দবির সাহেব হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। নিলয় আল্লাহ হাফেজ বলে
আবার চলে গেল। প্রিয় নাতিকে তাড়িয়ে দিয়ে দবির সাহেবের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। ছোট মানুষের মত হাউমাউ করে কাঁদতে
লাগল।
দুদিন পর খবর এল চট্রগ্রামে পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে দুজন মারা গেছে আর দুজনের মধ্যে নিলয় একজন। এ খবর শোনে দবির সাহেব শোকে দুখে কাতর হয়ে পড়ল। অপ্রত্যাশিতভাবে সহসাই উদীয়মান উজ্জল সূর্যটা অস্তমিত হল চির অন্ধকারে। নিলয়ের মত সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ সে ভুল পথের পথিক হয়ে অসময়ে পাড়ি জমায় পরপারে আর আপনজনদের জন্য রেখে যায় সীমাহীন কষ্ট।