এক
না , না , না – কিছুতেই এ ঘর ছেড়ে বাহিরে পা দেবে না অনিতা । তাঁর নিজের এ ঘর দোর , তাঁর স্বামীর বসত ভিটা । সেখান থেকে তাঁকে
স্থানচ্যুত করে কার এমন সাধ্যি !
কিন্তু গায়েত্রী নাছোড়বান্দা । অনিতার ডান হাতটা সে এমন জোরে ধরেছে যে, অনিতার মনে হোচ্ছে তা ছিড়ে ছিড়ে যাচ্ছে । চিৎকার কোরে ওপাশের অঞ্জনা পিসিমাকে ডাকবে অনীতা সে সাধ্যই নেই তাঁর । অনিতার মুখটা গামছা দিয়ে আস্টেপিস্টে বাঁধা ।
তবুও সে নব উদ্যোগে সবাইকে জানান দিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে চাচ্ছে ; ও শেখর বাবা তুই ওঠ । দ্যাখ , তর মায়ের কি হাল করছে তর বউ আর তার সাধের নাগর খগেন হারামজাদাটা । ঘুম ভাঙ্গে না শেখরের । যেন মরণ ঘুম !
অনিতাকে ঘরের বাহিরে একা গায়েত্রী বের করতে পারছে না দেখে , খগেনও কোথা থেকে ধা করে শয়তানের মতো উড়ে এসে জুরে বসে, অনিতার আরেকটা হাত চেপে ধরে । বলে ; অ মাসিমা এত জোরাজুরি করে নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন , আর আমরাও নাজেহাল হচ্ছি । তারচেয়ে ‘ত্রী’ যা বলছে তা মেনে নিননা !
গামছা বাঁধা মুখটা সজোরে মাথার দু পাশে বারে বারে নাড়ায় অনিতা । না, না কিছুতেই সে গায়েত্রীর নামে নিজের জায়গাজমি লিখে দেবে না । অগত্যা লিখে দিতেই যদি হয় , তাহলে তা সে তাঁর নিজের পেটের ছেলে শেখরের নামেই লিখে দেবে । কিন্তু কোথায় শেখর ? তাঁকেও কি রাক্ষসী গায়েত্রী আর হারামজাদা খগনাটা মিলে বেঁধে রেখেছে নাকি ঘুমের ঔষুদ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে । আর এ কোনটাই না হলেই বা কি ক্ষতি ! সে তো ম্যালাদিন হয় মাকে বিশ্বাস করা বাদ দিয়ে বউয়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়েছে !
মাঝে মাঝে চাপাস্বরে চিৎকার কোরে উঠছে গায়েত্রী আর বলছে , ভালোয় ভালোয় সম্পত্তি লিখে দিলে তাও ভিটায় থাকতে পারবে । না হলে কোন জলে হাপিশ কোরে দেব তা গায়ের কাকপক্ষীটিও টের পাবে না ।
দুই
অঞ্জনা পিসি তো বাড়ীতে নাই । মনে করতেই এক অজানা আশঙ্খায় বুকটা ধক করে উঠে অনিতার । সে থাকলে , পাড়ার দশঘর মানুষ ডেকে এক্ষুনি গায়েত্রীর থোঁথা মুখটা ভোঁতা করে দিত । অঞ্জনা পিসিকে খুব ভয় পায় গায়েত্রী আর খগেন । সাক্ষাৎ জম ভাবে । আজ সে নাই , দিন তিনেক হয় গ্যাছে দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়ীতে , আর এই সুযোগে অনিতাকে শেষ করে দিতে এসেছে গায়েত্রী আর খগেন !
কেন যে অঞ্জনা পিসির কথা আগে থেকে মেনে চলে নাশম্পরকে! এখন নিজের উপরে নিজেরই ভারী রাগ হচ্ছে তাঁর ।
অঞ্জনা পিসি শেখরের স্বর্গীয় পিতা কিশোর কুমার দাস এর আপন ছোট পিসি । বলতে গেলে বেঁচে থাকা বংশধরদের মধ্যে সেইই বয়সে সবচেয়ে বড় । যেমন বয়সে বড় সে , তেমনই তাঁর আচার বিচার আর পারিপার্শ্বিক ব্যাপারে জ্ঞাণ বিচার ।
অনিতাকে সেই বিয়ের কাল থেকেই ভারী পচ্ছন্দ পিসিমার । আহা , কি শান্ত শিষ্ট আর মায়াভরা মুখের কচি কুমারী মেয়েটিকে বিয়ে কোরে ঘরে তুলে এনেছে আমাদের কিশোর ! যেমন চেহারা তেমনি তাঁর স্বভাব ! সাত গাঁয়ে খুঁজেও এমন মেয়ে মেলা ভার !
সে সব দিনগুলোতে অনিতাও দিনকে দিন ভারী নেওটা হয়ে পড়েছিল পিসিমার । আজোও তেমনি আছে তা !
শেখরের বাবা মারা যাবার বেশ আগেই তাঁর সব জমা সম্পদ জমি জমা ঘড় দোর , অনিতার নামে লিখে দিয়েছিলেন । তাঁর ভয় ছিল পাছে বোকাসোকা অনিতা আর ছেলেকে ভাগীশরিকরা ফাঁকি দেয় । আর একাজে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশী সাহস যুগিয়েছিল , সে হোল কিশোরের পিসিমা , মানে অঞ্জনা পিসি !
অনিতার স্থির বিশ্বাস অঞ্জনা পিসি ঘরে থাকলে এই রাত বিরেতেও সে কোথা থেকে ক্ষিপ্ত বাজ পাখীর মত লম্বা পাখা উড়িয়ে এসে হাজির হোত । তারপর গায়েত্রী আর খগেনকে ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে কোথায় যে সে নিয়ে যেত তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন !
খগেন এতক্ষণে অনিতার হাতটা ছেড়ে গায়েত্রীর একটা হাত তাঁর নিজের হাতের সাথে পেঁচিয়ে রেখেছে আর ফিসফিস কোরে তাঁর কানে কানে কি যেন বলছে । আর তাতে কোরে গায়েত্রীর সাদা ফ্যাকাসে মুখটায়ও মাঝে মাঝে ক্যামন যেন একটা লালের ছোপ ভেসে ভেসে উঠছে ।
ওহ , তাহলে তলে তলে এই! এই খগেন হারামজাদাটা গায়েত্রীর পিসতুতো দাদা ফাদা কিছুই না ! আহা , কেন যে সেদিন অনিতা অঞ্জনা পিসির কথামতো ছেলে শেখরের কানে গায়েত্রী আর খগেনের সেই লটর পটর সম্পকের কথাগুলো জানায়নি । বরঞ্চ ছেলে কষ্ট পাবে ভেবে নিজেই নিজের আঁচল দিয়ে সযতনে সব ভেসে বেড়ানো শোনা কোথাগুলো , সব চাপা সন্দেহগুলো লুকিয়ে রেখেছে !
তিন
অঞ্জনা পিসির সব সময় একটা ইচ্ছে ছিল সরল সোজা অনিতাকে একটু চালাক বানানো । তবে একথা অস্বীকার করার জো নেই যে , এই পিসিমার বুদ্ধিতেই চিরদিনের বোকা অনিতা এই প্রায় শেষ বয়সে এসে বুদ্ধিমতী হতে শুরু কোরছিল । কিন্তু সেটুকুই ! তা আর কাজে লাগলো কই ? না হলে কি আর এই অসময়ে এসে অনিতাকে কানার হাট বাজারে এসে খাবি খেতে হয় !
অঞ্জনা পিসি পানের বাটা থেকে মিহি কোরে কাটা সুপারী , খড় আর চুন দিয়ে খিলি পান বানাতে বানাতে এক গোছা খিলি অনিতার মুখে পরম যতনে গুজে দিতে দিতে পাঁচ কান বাঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতো ; ছেলের বউয়ের দিকে একটু নজর দিস অনি । মানুষজন নাকি নানান কথা বলে ।
কি কথা বলে গো পিসি ? কি নানান কথা , অনিতা নীচু গলায় পিসিকে জিজ্ঞেস করতো । সে উপরে উপরে পিসির সামনে এমন ভাব দেখাতো যেন কিছুই হয় নি । কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর আত্নারাম তখন খাঁচা ছাড়া ।
নেকী ! কিছুই জানিস না ? কিছুই নজরে পড়ে না তর না ? দু চক্ষের মাথা খেয়ে বসে আছিস বাঁদরমুখি । কান খুলে শোন , চোখ মেলে দ্যাখ পাড়াশুদ্ধ ছি ছি পড়ে গ্যাছে তর বউ আর সেই খগেন মিনসেটার কান্ড কারখানায় ।
অনিতা ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করা শুরু করে !
পিসিমার অনিতার এই ভাবটা একেবারের অপছন্দের । এতো বছর হয় ঘর সংসার করলো সে , সাদা কালোর ভেদ ঢুকলো না এখনও মাথায়! অঞ্জনা পিসি মুখ বাঁকিয়ে বলে ; ধুমড়ি , তুই চিরকালটা মুখ্যই থাকলি ত আমি আর কি করি । তোর চোখে কি মাছি মশা কি কিছুই পড়ে না । তুই বোধহয় মশা মাছি সব জল দিয়ে গুলে গুলে খাস !
অনিতা মাথা নাড়ে ঘনঘন । তার মানে না খায় না ! কিন্তু কি হোয়েছে বলবে তো পিসিমা । তারপর বলে ; পিসি -দেখো , এমুন কিছু বোল না যাতে আমার শেকু কষ্ট পায় । কি কোরছে বউ ? গায়েত্রী কি খারাপ কিছু কোরছে ? কি করছে গো সে পিসিমনি । পন্যি পন্যি করে কইলাম , বাছা ঐ মর্দানি মেয়েটারে ভালবাসিস না । ভাব করিস না । কিন্তু কে শোনে কার কথা । এখন এসব সামলা । বলে কাঁদতে থাকে অনিতা !
আবার কান্দন । চখের জল মোছ । তারপরে কথা ।
অনিতা ভয়ে ভয়ে নিজের আচলে দু চক্ষের জল মোছে !
জানিস না সে কি করছে । নিজের চোখকান খোলা রাখ , দেখতে পাবি –বোলতে বোলতে অঞ্জনা পিসি উঁচু মোড়াটা ছেড়ে উঠে পড়ে । তাঁর এখন নাইতে যাওয়ার সময় হয়েছে ! এতসব ভেত-কাদুনি মানুষ নিয়ে তার দিন চলে না !
অনিতাও আস্তেশুস্তে বুকের আলগা আঁচলটা কোনরকমে মাথায় টেনে উঠে পড়ে !
চার
চোখে পড়ছে বটে অনিতার ।অঞ্জনা পিসি তো আর মিথ্যা কথা বলেননি । তাঁর কি এমন কি লাভ নাত বউয়ের নামে সত্যমিথ্যা এটা সেটা বানিয়ে বানিয়ে বলা!
হায় ভগবান , শেখর দোকানের কাজে শহরের বাহিরে গেলেই গায়েত্রীর একেবারে পোয়াবারো ! শ্বাশুরি টাশুরী কিছুই মানে না সে ! কোনরকমে দুপুরের নাওয়া খাওয়া শেষ কোরে , ঠোঁটে গালে রঙ লাগিয়ে পাট ভাঙ্গা চকচকে একটা শাড়ী কুঁচি বেঁধে পরে , ঘর থেকে ধা বেড়িয়ে পড়ে সে।
পথের ওধারে মুদির দোকানটা ঘেঁসে বাইক হাতে তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে গায়েত্রীর সেই দূরসম্পর্কের পিসতুতো ভাই খগেন । তাগড়া কালো ইয়া জোয়ান । দেখলেই মেজাজটা কেমন খিঁচরে আসে । আর তাকে দেখতে পেলেই পথের এক পাশ থেকে বত্রিশ দাঁত বের কোরে গায়েত্রী দেয় এক মন মাতানো হাসি । ডবকা মুখের ডবকা হাসি । আসলেই গায়েত্রীর মুখটা কেমন জানি বিশ্রী রকমের পুরু আর চ্যাপ্টা । গোল গোল ড্যাব ডেবে দুই চোখ । আর ক্যামন জানি ভ্যাদা রকমের ফরসা গায়ের রঙ । আর তাই দেখেই শেখর নাকি পাগল হয়েছিল একদিন !
যা হোক , বেপরোয়া গায়েত্রী সবার চোখের সামনে দিয়ে আঁচল উড়িয়ে খগেনের সঙ্গিনী হোয়ে বেরিয়ে পড়ে দিন বিহারে । ছোট্ট উপজেলা , নামে মাত্রই শহর । রাস্তা ঘাটগুলো সবে পাকা হোতে শুরু কোরছে । বড়সর গাছগুলো দুহাতে ছেটে কুটে তাদের বুকে বেয়ে গড়ে উঠছে এন্তার সরকারী দালান কোটা ! মানুষজন নতুন নতুন দোকান পাট খুলতে শুরু করছে ! নিত্য নতুন মানুষ , বাড়ী ঘর আর ছোট বড় যানবাহনের আনাগোনা ।
গায়েত্রী খগেনের বাইকে চড়ে রাস্তায় বের হোলে পরিচিত মানুষজন কানাঘুষা করে । দূর থেকে কেউবা টিপ্পুনি কেটে বলে- এ কার ঘরের বউ গো । গদাই খগেনের নাকি না সেই হাব্দা শেখরের ? আহা , যেন এক ঢাকাই ছবির নায়িকা গো । দ্যাখ দ্যাখ কেমন গাঁ ঘেঁসে দাদা না ফাদার কোল জুড়ে বসেছে ! ভ্যাদা মাছ বটে বেচারী শেখরটা । কিচ্ছু জানলোও না বুঝলোও না !
গায়েত্রী বা খগেনের কানে এতশত কথা পৌঁছায় না । লোকে যা বলে বলুক । লোকের কথা কানে তুললে কি আর পরের বউকে কোলে বসিয়ে বাইকে ঘোরা যায় !
খগেন গায়েত্রীর কানের কাছে মুখটা এনে বলতে থাকে ; এই ত্রী তুই যে আমার শাথে ঘুড়তে আসছিস , তর জোয়ান শ্বাশুড়ী কিছু বলে না ?
জোয়ান ? তুমার যে চোখ খগেন দা । কারে যে কি কও । হে আবার অত জোয়ান হোল কি করে !
উস্মার আঁচ পেয়েই পরক্ষণেই দ্রুত প্রসঙ্গ পালটায় খগেন!
এই ত্রী , তোর স্বামীর বাড়ীটা কতখানি জমির উপর রে ?
ঠোঁট বাঁকায় গায়েত্রী। বলে , আর স্বামীর । জমিজমা ঘরবাড়ী তো সব সেই বুড়া ব্যাটা কোনকালে এই বুড়ীটার নামে লিখে দিয়ে গেছে । ব্যাটার কাজ দেখো , আচ্ছা আপন ছেলে কি তর পর ?
খগেন বলে বুড়ীটা মরলে তো সব পাবি তোরা । মাইরি , ম্যালা টাকা পাবি জমি বিক্রি করলে। কতখানি জমিরে , আবার জানতে চায় খগেন। জানাটা তাঁর এক্ষণে অতি জরুরী !
গায়েত্রী মাথা ঝোঁকায় । সত্যি জানে না সে !
জানিস না ? তাহলে ঐ হাবাটারে কি দেইখা বিয়া করলি ? জানি না না , এই জমির লোভেই তো তুই আর তোর বাপ সত্য মিথ্যা বলে তাঁরে বিয়া করতে বাধ্য করলি । এখুন কস জানিনা না । এই ভেতর বুদ্ধি তর ধরমে সইবে না ত্রী । আমার কাছ থিকা তো কথা নিলি , চুপ থাকার কথা ! সম্পর্কের কথার !
গায়েত্রী ভয়ে ভয়ে কিছু বলে না !
শোন , আজই কিন্তুক ঐ মেয়ে লোকটার কাছে যেয়ে জমিজমার হিসাব জানতে চাইবি ! কইবে না ? কওয়াবি । ক্যামন ধেই ধেই কোরে জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে । আমার ভাগটা আগেভাগে না নিতে পারলে---- আমার কিন্তু তর সইছে না এই তরে বলে দিলাম ত্রী!
গায়েত্রী খগেনকে চেনে জানে অনেকদিন । জমির ভাগ না পেলে সে যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে , তাও বেশ ভাল ভাবেই জানে সে !
পাঁচ
খগেনের কথামতো স্বামীকে আগেভাগে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দাইয়ে ঘুমের ঔষুদ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে গায়েত্রী । আর জেগে থাকলেই বা সে কি করতে পারতো । যে ভালো কোরে কথা কইতে পারে না , ভালো করে গায়েত্রীর শরীরের চাহিদা মেটাতে পারে না , সে আবার পুরুষ মানুষ নাকি !
তাঁর আবার শখ কত ! খগেন ভালবেসে গায়েত্রীকে ত্রী বলে ডাকে । এ নামটা নাকি শেখরেরও খুব পচ্ছন্দের । সেও এই নামে গায়েত্রীকে ডাকতে চায় । কিন্তু গায়েত্রীর তাতে বেজায় আপত্তি ! মুখ টিপে ছলনাভরা হাসি হেসে সে স্বামীকে অনেকদিনই বলেছে ; যেদিন খগেন দার মতো আমাকে মোটর বাইকের পেছনে নিয়ে ঘুড়াতে পারবে , সেদিনই তুমি আমায় ঐ নামে ডাকতে পারবে । আর সেই সাথে মায়ের জমি জমা নিজের নামে যেদিন লিখে নিতে পারবে সেদিন !
শেখর ভিমরি খায় । মোটর বাইক জমিজমা ঘরবাড়ী ! তারপরই নাকি গায়েত্রীকে সেই ত্রী নামে ডাকা । দ্যাখা যাক মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজী করা যায় কিনা ।
কিন্তু গায়েত্রী আর খগেনের হাতে এত সময় নেই । সেই কবে সাত মন তেল জুটবে আর রাধা নাচবে । কবে অনিতা তাঁর নিজের ছেলের নামে সব সম্পত্তি লিখে দেবে । এরপর সেখান থেকে অনিতা আর তারপর অনিতার হাত ঘুরে খগেন !
ত্রী , আমার কিন্তু তর সইছে না । ভয়ানক বজ্জাত তো বুড়ী । লিখেও দেবে না । ঘর ছেড়ে বেরও হবে না । ওটাকে বাহিরে না নিয়ে গেলে কিছুতেই তো ওর হাত থেকে কিছু আদায় করা যাবে না ।
আর গায়েত্রীও ভয় পাচ্ছে । অঞ্জনা দিদিমা নেই বটে , কিন্তু শেখরের জেগে উঠতে কতক্ষণ । তাঁর আপন মা তো বটে এই বুড়ীটা ।
তাহলে কি আগেভাগে ঘুমন্ত শেখরের চোখ দুটো বেঁধে রাখবে সে , যাতে সে টের না পায় তাঁদের কান্ড কারখানা !
এ এক তেলেসমাতির খেলা ! আর একটু পরের এই ঘর দোর জমি জমা পুকুর সব সব গায়েত্রীর হাতে চলে আসবে । খগেনের বুদ্ধি আছে বটে ! আগে ভাগে শক্ত মহুরীকে দিয়ে পাকা দলিল কোরে এনেছে সে । আর তার সার অর্থ হোল – অনিতা দাস সজ্ঞাণে স্বইচ্ছায় তাঁর স্থাবর অস্থাবর সব স ম্প ত্তি তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ গায়েত্রী রানী দাসকে অর্পণ করছে । নিজের সম্পদ , যাকে ইচ্ছে তাঁকে দেয়া যায় ! কার তাতে কি ? কিন্তু নিজের একমাত্র ছেলেকে বাদ দিয়ে অন্যের মেয়েকে সব দান করা ? লোকে যদি অনিতাকে জিজ্ঞেস করে ?
আহা , অনিতাকে কোথায় পাবে তাঁরা ? সে তো হাপিশ । পদ্মা নদীর জলের গহীনে তাঁর তখন ঘর । বিশেষভাবে বানানো চটের ব্যাগটা আর তাঁতে দশ দশটা ইটের বোঝা । কার সাধ্য অন্ততঃ লাশখানিও ফেরত পাওয়া । অনিতা নামের বুড়ীটা ফিনিস। গলায় তাঁর শোভা পাবে দামী পালস্টিকের দড়ি । অনিতারই নিজের হাতে কেনা বড় শখ করে জলের দিনে ঘরের ভেতর আধভেজা কাপড়চোপড় মেলে দেবার জন্য !
ত্রীরে তর শ্বাশুরির চয়েস আছে বটে দেখ কেমন সুন্দর দড়ি কিনেছে । কি তাঁর রঙ আর কি তার বাহার – খগেন তাঁর বিচ্ছিরি বত্রিশ দাঁতের দুই পাটি বের করে হাসে আর বলে ! বাজে ইঙ্গিতও দেয় !
অনিতা এখন বড় নির্বাক । সে যেন বুঝে গ্যাছে এই পিশাচগুলোর হাত থেকে তাঁর আর মুক্তি নাই । স্বামীর শান্ত সৌম্য সুন্দর মুখটা বারে বারে মনে পড়ে । চোখের সামনে ভাসে নিজের ছেলে শেখরের সরল মুখটা । কি বড় ভুলটাই করছিলি বাছা আমার । আজ তাঁর খেসারত দিতে হোচ্ছে সবাইকে । একদিন সব বুঝবে বোকা শোকা লাজুক স্বভাবের ছেলেটা । কিন্তু তাঁর তখন আর কি বা করার থাকবে ।
জলের নীচে চিরদিনের জন্য আপন গেহ আজ বানাতে যাচ্ছে অনিতা । তবে তা তাঁর নিজের ইচ্ছেয় নয় । পরের ইচ্ছেয় । হায় ভগবান , এই বেঘোরে প্রাণ দেবার কথা কি স্বপনেও ভাবতে পেরেছিল সে কোনদিন ? জলের নীচে ঘর ! সে ঘর ক্যামন । ক্যামন করেই বা দেখবে অনিতা । সেতো তখন অন্ধ । কানা । বোবা । বধীর । কানার আবার ঘরবাড়ী ! কানার আবার হাটবাজার !
কিন্তু কতদিন সে তো নিজেই অঞ্জনা পিসিকে সেধে সেধে বলেছে ; অ পিসি আমারে একবার তমার সেই মাসতুতো দাদার বাড়ী নিয়া যাবা । সেই টাঙ্গাইল শহরে । যেখানে যেতে পদ্মা নদীর জল পেরুতে হয় । ভয়ংকর সেই নদী । চারদিকে জল আর জল । দেখা যায় না এপার ওপার । ক্যাবল জল আর জল । মাঝখানে ছোট্ট একটা তরী । অঞ্জনা পিসি টেস দিয়ে বলে ; তরী নয়রে মুরখু , ফেরী । আর তার উপর ছোট বড় কত আকারের আর রঙের গাড়ী ।
জলের উপর গাড়ীর ভেতর বসে থাকতে ভয় করে না অঞ্জনা পিসি তোমার , ভয়ে কান্না চাপে না ।
দূর বোকা , ভয় লাগবে ক্যান ? আর চক্ষের জলই বা পড়বে ক্যান ? আমরা ত জলের উপর ফেরীর মধ্যে । সেখানে বাড়ীর মতো । ধর , জলের বাড়ী । জলের ঘর । কোন ভয় ডর নাই । কান্না কাটি নাই । তবে বর্ষা কালে ভারী বিপদ রে অনি । কি ফুলা ফুলা সে জল । আর সে সময়টাতে আকাশে মেঘা আসলে ত কুন কথাই নাই । সবাই প্রাণের ভয়ে তরাসে ভগবান , আল্লাহ আল্লাহ করে । যার যা ইচ্ছা । তয় জল বড় শান্তির স্থানরে অনি !
অঞ্জনা পিসির কথামতো এতদিন বাদে অনিতা তো সেই শান্তির জলে বসত গড়তে যাচ্ছে । তাহলে তাঁর এত কান্না পাচ্ছে ক্যানো ? জলের কথা মনে হতেই ভয়ে তরাসে বুকটা ছাঁৎ ছাঁৎ করে উঠছে ক্যানো ? সেকি গায়েত্রী আর খগেনের হাতপা ধরে বলবে – আমায় এবারের মতো খামা দে তোরা । আমার বড় কষ্টের , বড় আদরের এসব ধন , তরা নিবি তা কোন মুখে ।
না বলবে , সাবধান , গায়েত্রী আর খগেন । এ ধন তরা ছুঁচনে , ছুঁলে ধ্বংস হয়ে যাবি তঁরা ! জলের তলের ঘরেও তদের ঠাঁই মিলবে না । লোহার ঘরে ঠাঁই পাবি তরা । কিন্তু এতো কথা যে কইবে অনিতা তাঁর সে জোর কোথায় ?
ঘরের দরজায় জোরে জোরে শব্দ । ধমাধম । ধম ধম ! কে এলো ? শেখর না অঞ্জনা পিসি ? আনন্দ চিত্তে উঠে বসে অনিতা ! জলের ঘরে বসত আর গড়তে চায় না সে । ওদেরকে সব খুলে বলবে আজ অনিতা । বলবে এক্ষুনি !