এক
এর নাম জয় নাকি পরাজয় তা ভেবে ভেবে এ মুহূর্তে আর কোন কূল পান না রাবেয়া খাতুন ! দু’ ছেলের মধ্যে কাউকে জয়ী ভাবলে বুকটা তাঁর গুমোট দুঃখ ব্যথায় ভারী হয়ে যায় । আবার কাউকে পরাজিত হতে দেখলেও কেমন একটা হতাশাবোধ ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে তাঁকে। এখন কি করবেন তিনি ? এই অন্তর্ভেদী মুহূর্তে কোন সন্তানের পক্ষেই বা যাবেন ? কাকেই বা তেমন কোরে বলতে পারবেন - বাবা , রুনু তোরই ভালবাসার ধন !
রাবেয়া খাতুনের ভাবনায় এখন কেবলি তাঁর দুই সন্তানের জয় পরাজয়ের ব্যথা । সুফিয়ান আর রায়হান ! প্রথম জনকে এ মুহূর্তে জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত , পরাজিত আর বিধ্বস্ত এক মানুষ বলেই ধরে নেয়া যায় । সব থেকেও দুর্ভাগ্যের ফেরে যার আজ কিছুই যেন নেই । কিন্তু অন্যজন ? যদিও তাঁকে প্রাণ মন থেকে ইদানীং খুবই কম পছন্দ করেন তিনি , তারপরও মা বলে কথা । মায়ের খালি বুকটায় সে একরকম জোর করেই মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ে ! দিকবিদিক মাতাল কোরে বিজয়ের ঘন্টা বাজায় । রাবেয়া খাতুন তাঁর দু সন্তানকেই কম বেশী সুখী দেখতে চান । কিন্তু তা যেন হবার নয় । নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর । সে যা ভাবার তাই ভাববে । যা করার তাইই করবে !
রাবেয়া খাতুন আর ভাবতে পারেন না । বেশী চিন্তা করতে গেলে তাঁর বুকটা ভয়ে তরাসে বেদনায় ক্যামন যেন চিন চিন কোরে উঠে। সাগরের কূল না পাওয়া বিশাল সেই জলরাশির মতো ভয়ঙ্কর এক দুঃসহ ব্যথা –বেদনায় যেন তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি গহীন কোন ভুবনে । নিদারুন শোকে , দুঃখে পাগলের মতো পথের দিশা খুঁজে ফিরছেন এখন তিনি ! আপন বুকের মানিক যে ছেলেকে আজ প্রায় চার চারটে বছর হোল হন্যে হোয়ে খুঁজে বেরিয়েছেন, যার পায়ের প্রতীক্ষিত একটা মৃদু শব্দ শোনার জন্য কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন , সেই ছেলে তাঁর আজ দরজায় । তাঁকে পরম মমতায় আর গভীর স্নেহে আপন কোরে বুকে টেনে নিয়েছেন বটে তিনি, কিন্তু এরপর কি হবে , সেই অনভিপ্রেত প্রশ্নটাই যেন এখন তাঁকে বৃশ্চিকের মতো দংশন কোরে চলছে । তা থেকে কোন মুক্তি নেই যেন তাঁর !
দুই
পাশের ঘরে বসে আছে সুফিয়ান ! এ মুহূর্তে বড় নিঃসঙ্গ , একাকী সে । অনেক অনেক দিন বাদে আপন ঘরে ফিরে এসেছে রাবেয়া খাতুনের হারিয়ে যাওয়া সাত রাজার ধন মানিক । সুফিয়ান তাঁকে জীবনে প্রথম মা হবার অপার্থিব আনন্দ গৌরবে ভাসিয়েছিল । বড় ছেলের জন্মের প্রায় তিন বছরের মাথায় জন্ম হয়েছিলো রায়হানের ! একবৃন্তে যেন দুটি কুঁড়ি ! ওদের বাবা মিলিয়ে মিলিয়ে দু’ছেলের যেমন নাম রেখেছিলেন তেমনি তাঁদেরকে সমানভাবে ভালবাসারও কোন ঘাটতি ছিল না স্বামী স্ত্রির মধ্যে । স্বামী মারা যাবার পর নানা অসুবিধার সম্মুখীন হোলেও কোনদিন সে অভ্যাসের এতটুকুও পরিবর্তন ঘটতে দেননি রাবেয়া খাতুন !
স্নেহ দিয়ে , আদর , ভালবাসা আর শাসন দিয়ে দু’ ছেলেকেই মনের মতো কোরে গড়ে তোলার অসাধ্য সাধনা ছিল যেন রাবেয়া খাতুনের ! একই রকম পোশাক , একই রকম খানাপিনা , একই স্কুল , নুতুন নতুন বই ইত্যাদি । এক ছেলে নতুন কিছুর জন্য বায়না ধরলে , অন্যজনকেও তা যেভাবেই হোক কিনে দিয়েছেন তিনি ! এরপরও দু ছেলেকে নিয়ে ছোটখাট বিড়ম্বনা কম পোহাতে হয়নি তাঁকে !
ছোট ছেলে রায়হান চিরকাল ধরেই একরোখা আর জেদী স্বভাবের । যা তার চাই , তা যেন তাঁকে তক্ষুনি দিতে হবেই হবে । আর বড় ছেলে সুফিয়ান বেশ কিছুটা বাপের ঘেঁষা । সে ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত ভদ্র , বিনয়ী আর নীতিবান ! তারপরও তারও গোঁয়ার্তুমি কম ছিল না । দু’ ভাইয়ে মিল ছিল বটে কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে ক্যামন যেন একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব সারাক্ষণ লেগেই থাকতো বলে মনে হতো রাবেয়া খাতুনের । আর তা যে ওদের চাচাতো বোন রুনুকে ঘিরেই- সেকথা মুখ ফুটে ছেলেরা স্বীকার না করলেও রাবেয়া খাতুন তা ঠিক ঠিকই টের পেতেন !
রুনু নামের একহারা , শ্যামলা আর মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটি রাবেয়া খাতুনের দূরসম্পর্কের দেবর রুহুলের বড় মেয়ে । অনেক সাধ্য সাধনার পর রুহুলের বউ রুমানার গর্ভে যখন রুনুর জন্ম হয় , তখন তাঁকে মায়ের কোলে দেখেই রাবেয়া খাতুনের মনটা কেন জানি এক অজানা আনন্দ পুলকে ভরে যায় । কালো টানা টানা ডাগর দুটি চোখ মেয়েটির আর সেই সাথে খুব মিষ্টি একটা পান মুখ । সেদিন কিছুটা নাই নাই কথার ছলেই রাবেয়া খাতুন হঠাৎ কোরেই রুনুকে তাঁর বড় ছেলে সুফিয়ানের বউ করবেন বলে ওঁর মার কাছ থেকে কথা আদায় করে নেন !
একেবারেই কথার কথা কি ছিল কি তা ? হতে পারে আবার নাও হোতে পারে । কিন্তু রুনুর বাবা মায়ের কাছে এ কথার গুরুত্ব ছিল অনেকখানি ! তাই এই আনন্দের কথা লোকে মুখে ছড়াতে আর বেশীদিন সময় লাগেনি । বোঝবার মতো বয়স হোলে , দু’ছেলের কানেও গিয়েছে এসব কথা ! আর এ কারণেই কিনা , কিংবা নিতান্তই ছেলেমানুষি বশতঃই , সেই ছেলেবেলা থেকেই সুফিয়ান আর রায়হানের মধ্যে রুনুকে ঘিরে অহরহ ক্যামন যেন একটা অঘোষিত যুদ্ধ চলেছে । ওদের কেউ তা মুখ ফুটে না বললেও , আচার আচরণে রুনুকে ঘিরে দু’ছেলের এই মানসিক টানপোড়ন তিনি মা হয়ে ঠিক ঠিকই টের পেয়েছেন !
কোন কোন দিন সাংসারিক কাজের নানা ব্যস্ততার মাঝেও রাবেয়া খাতুন ঠিকিই দেখতে পেতেন , খেলাচ্ছলে ওদের দু’ভাইয়ের কোন একজন রুনুর নরম কোমল হাতটা ধরলেই , কোথা থেকে অপরজন যেন চিলের মতো উড়ে এসে মেয়েটির অন্য হাতটা ফস কোরে ধরে ফেলে জানান দিয়েছে - এই , রুনু আমার দলে ! রুনুর যেন কোন নিস্তার নেই । কিন্তু যাকে নিয়ে এতশত ভাগাভাগি আর মনকষাকষি সেই রুনু কিন্তু দারুন নিপুনতার সাথেই সামলিয়েছে বেড়ে ওঠা দু’ভাইকে । এরপর অবশ্য দু ‘ ভাই বড় হোয়ে উঠলে , রুনুকে নিয়ে তাঁদের সেই ভাগাভাগি আর মারামারির খেলা অনেকটাই কমে এসেছে ।
তবে বেড়ে ওঠার পর প্রায় সমবয়সী রায়হানের সাথেই রুনুর ভাবটা বেশী জমে উঠে । যেমন- একসাথে কলেজে যাওয়া । সিনেমা দেখা । মার্কেট যাওয়া । ইত্যাদি । রুনুকে সব সময় কাছে না পেলে রায়হানের মেজাজটা যেত সপ্তমে চড়ে । কিন্তু সুফিয়ানের সাথে রুনুর সম্পর্কটা কিংবা ভাবটা যেন অন্য রকম । মনে মনে ভাব -ভালবাসার এক ফল্গুধারা চির প্রবাহমাণ ছিল দু’জন দুজনাকে ঘিরে ! কিন্তু রুনু ভুলেও সুফিয়ানকে তাঁর মনের কথা কথা বুঝতে দেবে না । ইচ্ছে কোরেই সে রায়হানকে নিয়ে মাঝে মধ্যে এমন ভাব দেখাতো যে তাঁকে ছাড়া সে নিজে যেন অচল । আর এসব নিয়ে সুফিয়ানের মনে রুনুর উপর এক অবুঝ অভিমান ভারী হয়ে থাকতো ! তারপর রুনুকেই অনেক সাধ্যি সাধনা করে সবার অগোচরে সুফিয়ানের রাগ ভাঙ্গাতে হতো !
কিন্তু সে সময়টাতে কেউই যা ভাবেইনি , একদিন হঠাৎ কোরেই তাই হোয়ে গেল ! কাউকে বলা নেই , কওয়া নেই সত্যি সত্যি রুনুর সাথে সুফিয়ানের বিয়ে দিয়ে দিলেন রাবেয়া খাতুন । এত চটজলদি বিয়ের জন্য রুনুর বাবা মা কিংবা রাবেয়া খাতুন কোনমতেই প্রস্তুত ছিলেন না । এমনকি রুনু আর সুফিয়ানও নয় । এ যেন সেই – ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে ! সুফিয়ানের তখনও তো এম এ পরীক্ষাটা শেষ হয়নি । এরপর রয়েছে চাকরি বাকরির খোঁজ করার পালা । আয় ইনকাম । তারপরেই তো কেবল বিয়ে । আর রুনুও তখন সবে কলেজের চৌকাঠে পা রেখেছে । এমন অসময়ে হুট কোরে খুব অতিসাধারণভাবেই রুনু আর সুফিয়ানের বিয়ে হোয়ে গেল ।
হোয়ে গেল , কেননা সময় বলে কথা ! চারদিকে সাজ সাজ রব । উত্তেজনা ! ভয় ! ভীতি ! অসহায়ত্ব ! দেশ নাকি স্বাধীন হতে চলছে ! কিন্তু তার আগে যুদ্ধ । যুদ্ধ না করলে কি আর মুক্তি আসে ? বিজয় আসে ? বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের মাঠে ঘোষনা দিয়েছেন , ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার । আর যার যেখানে যা আছে তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার ।
প্রথম প্রথম সুফিয়ান তাঁর বয়সী আর সব তরুণ যুবার মতো দেশের স্বাধীনতা নিয়ে বড় বেশী ব্যাকুল হোয়েছিল ! যুদ্ধ ! মুক্তি । মুক্তিযুদ্ধ ! কিন্তু হঠাৎ কোরে বিয়ে হোয়ে রুনুকে পাবার পর, যুদ্ধে যাবার কথা মনে হলেই এক নিদারুন শূন্যতা যেন ঘিরে ধরতো তাঁকে । কিন্তু গ্রামে তাঁর বয়সী কেউ আর ঘরে বসে নাই । শত্রুর শাণিত চক্ষু এড়িয়ে মাইলের মাইল হেঁটে , নৌকায় , গরু গাড়ীতে পার হয়ে সারা দেশের মানুষগুলো যে যার মতো চলে যাচ্ছে ওপারে । কেউ কেউ প্রাণভয়ে আশ্রয় নিতে । আবার কেউবা মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে । কিন্তু এখন সুফিয়ানের যেন এসবে নজর থেকেও নেই । তাঁর রাতদিন নতুন বউকে ঘিরে কোথা থেকে কখন কিভাবে যে পার হোয়ে যায় , তা সে নিজেও টের পায় না । তবে মাঝে মাঝে কেবল তাঁর নজরে পরে ছোট ভাই রায়হানের পাগলাটে দুটো চোখ ! সত্যি কি পাগল হোয়ে যাবে সে রুনুকে না পেয়ে ? কাকে যেন অহরহ মনে মনে খোঁজে সে । সে নিশ্চয়ই রুনু । কিন্তু রুনু তো সুফিয়ানের । সেই ছেলেবেলায় মার কথা দেয়া । রায়হানের অবস্থা দেখে মাঝে মধ্যে সুফিয়ানের খুব কষ্ট হয় । কিন্তু তারই বা এ বিষয়ে কোরবার কি আছে ? রায়হানকে ঘিরে সুফিয়ানের ইদানীংকার এতসব ভাবনার কথা রুনুকে বললেই - সে যেন কিছুই না এভাবে খিলখিলিয়ে হাসে । তারপর হাসতে হাসতে বলে- এই বোকা , মনটা কি আর কুমড়ার ফালি ! যাকে ইচ্ছে তাঁকে কেটে কেটে বিলিয়ে দিলাম ! রুনু কাব্য কবিতা পড়ে পড়ে এসব কথা বেশ সাজিয়ে গুজিয়েই বলতে পারে !
এত হাসি -আনন্দের পরও কেন জানি কোন কোন দিন গভীর রাতে সুফিয়ান যেন নিশির ডাক শুনতে পায় । গগণবিদারী চারদিকে উতলা করা সে আহ্বান ! কে যেন তাঁকে হেঁকে হেঁকে বলে- কি হোল তোর সুফিয়ান ? সবাই যে যার মতো যুদ্ধে গেল দেশের জন্য ! মানুষের জন্য ! আর তুই কি কোরছিস ? নিতান্ত স্বার্থপরের মতো সুন্দরী বউ নিয়ে প্রেমলীলা কোরে দিন কাটাচ্ছিস । এখন কি এসব করার সময় ! তুই না যুদ্ধে যাবি বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলি ?
হাঁ , তাইতো । বাড়ীর কাউকে না বলে যুদ্ধে যাবার জন্য সে মনে মনে অনেকদিন হয় শপথ নিয়েছিল । কিন্তু , রুনুর সাথে হঠাৎ কোরে এই বিয়েটা হোয়ে যাবার পর , কি যে হোল তাঁর – সে তা নিজেই যেন জানে না। সে যুদ্ধে না গিয়ে , মা আর রুনুকে আগলিয়ে দেশে থাকাটা ঠিক না বেঠিক তাও ঠাহর কোরতে পারছে না । আবার অন্যদিকে যুদ্ধের দামামা তাঁকে পাগল কোরে তুলছে । সে কি তবে নরাধম ! কিন্তু মনের এতসব কথা রুনুকে বলা যায় না । মাকে তো নয়ই । কিন্তু একটা সিন্ধান্তে তাঁকে যে আসতেই হবে । আর তা যত দ্রুত হয় ততই যেন মঙ্গল !
চারদিন থেকে এক এক কোরে ভয় , ত্রাসের খবর যেন উড়ে উড়ে আসছে । গভীর আতঙ্কের চিহ্ন গাঁয়ের সবার চোখে মুখে । মা , রুনুও এ থেকে বাদ পড়ে না ! আর রায়হান ? সে আছে তার মতো । কিছুই যেন হয় নাই , এমন একটা ভাব নিয়ে সে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে । খাচ্ছে দাচ্ছে । এই অসময়ে ছোট ছেলের এহেন নির্বিকার কাণ্ড -কারখানা দেখে রাবেয়া খাতুনের মনটা কেমন যেন কু ডাকে বারে বারে !
তবে এতশত ভয় আর আশঙ্কার মাঝে একটা আশার কথা হোল এই যে , সুফিয়ানদের গ্রামটা শহরের কোলাহল থেকে অনেক অনেকটাই দূরে । গ্রামের চারদিকে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ । উদ্দাম ঢেউ আর জলের খেলা অহরহ । জল আর জল । অদূরে গাড়ো পাহাড় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদম্য প্রহরীর মতো। দূর থেকে দেখা যায় মেষ আর গরুর পাল , ওদের চোখেও যেন অজানা আশঙ্কার কালো ছায়া । কোন কোন দিন সময়ে অসময়ে শোনা যায় বন্য হাতির ডাক । নিশুতি রাতে ক্ষুধার্ত ক্ষুব্ধ বাঘের গর্জন । এসবকে ভয় পায় না , এ অঞ্চলের মেহনতি মানুষগুলো । কিন্তু তারা ইদানীং ভয় পেতে শুরু করছে কিছু মানুষকে ! সেই অমানুষগুলোকে !
সুফিয়ান শুনেছে বটে , পানিতে নাকি ভীষণ ভয় ঐ সব পাকিস্থানী সেনাদের । তবে এক্ষণে রুনুকে নিয়েও তাঁর শুরু হয়েছে এক অন্য রকম ভাবনা । শোনা যাচ্ছে সৈন্যরা নাকি বাড়ী বাড়ী থেকে যুবতী মেয়ে বউ ঝিদের উঠিয়ে উঠিয়ে ব্যারাকে নিয়ে যাচ্ছে । তারপর তাঁদের উপর চলছে বীভৎস পাশবিক নারকীয় নির্যাতন ! অত্যাচার ! আর এসব কাজে নাকি তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছে এ দেশী কিছু শয়তান মানুষ ! রুনুকে অরক্ষিত রেখে , মাকে একা ফেলে - সে যুদ্ধে গেলে এদেরকে বাঁচাবে কে ? শোনা গেছে , রুনুর বাবা মারা নাকি আরও তস্য গাঁয়ে প্রাণভয়ে চলে গেছেন । আগে জানলে রুনুকে তাদের সাথে পাঠানো যেত । কিন্তু তাঁকে ছেড়ে রুনু কি ওঁদের সাথে যেতে চাইতো ?
এসব নিয়ে ভেবে ভেবে আর অহরহ নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে , তারপর একদিন যুদ্ধে যোগ দেওয়াটাকেই অতিসঙ্গত বলে মনে হোল সুফিয়ানের ! তবে মা কিংবা রুনুকে আগেভাগে তাঁর এহেন সঙ্কল্পের কথা কিছুতেই জানলো না সে, নির্ঘাত বাঁধা পাওয়ার ভয়েই ! রায়হানকে বলি বলি কোরেও কিছুই বলা হোল না । সে যে অন্য একটা বাজে বলয়ে ঢুকে পড়েছে , সে সব কথা এর ওর মুখে শুনেছে বটে সুফিয়ান । যাহোক এতো প্রতিকূলতার পরও , সেই অটল সাহসী প্রত্যয়েরই যেন জয় হোল ! সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে সত্যি সত্যি নিজের প্রিয় গ্রাম, সংসার আর মানুষগুলোকে ফেলে কাউকে কিছু না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ী ছাড়লো সুফিয়ান !
প্রতিদিনের মতো অতি ভোরে ফজর নামাজ পড়ার জন্য কলের পারে ওযু করতে এসে রাবেয়া খাতুন দেখতে পেলেন, তাঁর বড় ছেলের ঘরের কপাট ভেজানো । তা দেখে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি ! সেই সাথে ঘুম ঘুম দু’ চোখ রুনুও ! কাঁদতে থাকলো ওঁরা দুজনেই , আর সে কান্নার যেন অদ্যাবধি পরিসমাপ্তি নেই । শেষ নেই !
তিন
এক্ষণে তৃষ্ণার্ত চাতক পাখীর মতো দু’ নয়ন মেলে বসে আছে রুনুর প্রতীক্ষায় একজন । আর সে হোল যুদ্ধ জয়ী , গাজী সুফিয়ান ! কয়েকটা মাস ধরে চলেছে সেই সংগ্রাম । কত মানুষ অকাতরে দিয়েছে নিজের প্রাণ । নিজেকে নিজেই দিয়েছে বিলিয়ে শত্রুর মুখে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও । এরপর যুদ্ধ শেষ । বিজয় ! কতকাল বাদে আপন ঘরে ফিরে এসেছে সুফিয়ান । কিন্তু রুনু কোথায় ? আসবার সময় পথে ঘাটে এর ওর মুখে রুনুকে নিয়ে কি একটা যেন শুনেছে সে । কিন্তু বিশ্বাস হয়নি তাঁর । মাত্রর চার বছরের ব্যবধানে রুনু তাঁকে ভুলে যাবে এটা মেনে নেয়া বা বিশ্বাস করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ! । কিন্তু মা কোথায় ? সেই যে তাঁকে জাপ্টিয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ কাঁদাকাটি কোরে , তিনি যে কোথায় হাওয়া হোয়ে গেলেন , কেন হলেন তা বুঝে উঠতে পারছে না সুফিয়ান ।
কোথায় গেলেন মা ? তাঁর জন্য খাবার তৈরী করতে । নাকি আশেপাশের সবাইকে খবর দিতে ? ফিরে এসেছে , তাঁর হারিয়ে যাওয়া পরম গৌরবের ধন বিজয়ী ছেলে আজ ঘরে । ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে না এলে ঘরটা কি আর মানায় ? নাকি ভরে থাকে ফুলে ফলে । কিন্তু সুফিয়ানের তো এ মুহূর্তে আর কাউকে দেখার দরকার নেই । প্রয়োজন নেই কথা বলার । তার এখন কেবলই চাই রুনুকে । রুনু । তাঁর রুনু । সেকি কোনদিন পর হোয়ে যেতে পারে ? সত্যি বলতে কি, রুনুকে দেখবার জন্য বোধহয় সে আজ মৃত্যুর ঘর থেকে নতুন কোরে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে ! তা না হোলে কলকাতার রানাঘাটের অজানা অচেনা সেই ছোটখাট হাসপাতালটাতে তাঁকে বছরের পর বছর অসহায়ের মতো নিদারুন মানসিক যন্ত্রণায় একাকী পরে থাকতে হতো । আর তা কতটা কাল কে জানে !
সে কি ? না একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ! ব্যস এটুকুই ছিল সেখানে তাঁর পরিচয়। এ পরিচয়ের জোরেই অবশ্য হাসপাতালের মানুষজন দিনের পর দিন বছরের পর বছর বিনা পয়সায় তাঁকে সারিয়ে তোলার অসাধ্য সাধনা করেছেন। হসপিটালের নার্সদের মুখে শুনেছে সে- এখানে কে যেন দয়াপরবেশ হয়ে তাঁকে নিজের পকেটের পয়সা খরচ কোরে ভর্তি কোরে দিয়েছিল । তখন তাঁর এক হাঁটুতে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন । সারা শরীরে লাল টকটকে রক্তের ছোঁয়া । শরীরের ভেতরে ছোট বড় নানা ধরণের ইস্পাতের ঠিকানা । ভালো মতো কথা কইতে পারতো সে । নিজের হাতে কোন খাবার মুখে তোলার শক্তি ছিল না তাঁর । কেবল যন্ত্রণা । শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে খাক হোয়ে যাচ্ছিল সে। নিজেকে নিজের কোরে প্রকাশের সব ভাষা কেঁড়ে নিয়েছিলেন যেন বিধাতা ! তেমন পষ্ট কোরে কিছুই মনে পড়তো না তাঁর । ঘরের কথা । গ্রামের কথা । আপনজনদের কথা । তবে একটা শ্যামলা মিষ্টি মুখ মাঝে মাঝে মনের কোনে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যেত ! তার সাথে মাঝ বয়সী ধূসর বাদামী পাড়ের শাড়ী পড়া মমতাময়ী এক মায়ের মুখচ্ছবি ! কিন্তু এরা কারা ? আর সেই বা কে ? কিছুই মনে করতে পারতো না সে !
তারপর একদিন হঠাৎ কোরেই অতীতের সব কথা মনে হওয়া । আর তা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চেয়েও মহার্ঘ । তারপর এই প্রিয় আপনভূমের মানুষগুলোর কাছে ফিরে আসা !
কিন্তু রুনু এখনও তাঁর কাছে আসছে না ক্যানো ? সেকি এখন বাড়ীতে আছে ? নাকি তাঁর নিজের বাবামার বাড়ীতে মা তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু এখান থেকে রুনুদের বাড়ী তো ততটা দূরের পথ নয় । রিক্সায় বড় জোর ঘণ্টা খানেক । মা কি তবে তাঁকে একা বসিয়ে রেখে রুনুকে ডেকে আনতে গ্যাছেন ? না , তাই বা হয় কি করে ? মা তাঁকে ফেলে এ সময়ে কোথাও যাবেন তা যেন ভাবনার অতীত । আর সেই রায়হানটাই বা কোথায় । মা যদিও বলে গ্যাছেন –সে কদিন হয় ব্যবসার কাজে বাড়ীর বাহিরে গ্যাছে।
সুফিয়ান এখন যে ঘরটিতে বসে আছে তা তাঁর মায়ের ঘর । চারদিকে বাবার অসংখ্য মায়া মমতার চিহ্ন জড়ানো । মা , কেমন সুন্দর কোরে বাবাকে এখনও আগের মতো করেই ভালবেসে জরিয়ে কুরিয়ে রেখেছেন । সুফিয়ানের বড়ই জানতে ইচ্ছে কোরছে – আজও কি রুনু তাঁকে মনের কোনায় ধরে রেখেছে ঠিক আগের মতো করেই ।
কিন্তু সেকি রুনুকে খুঁজতে এক্ষুনি সোজা তাঁর নিজের ঘরের দিকে যাবে , যেখানে রুনু আর তাঁর অনেক ভালবাসার সুবাস জড়িয়ে আছে !
চার
রুনু , তুই পালিয়ে যা ! এক্ষণই ! মনের মধ্যে থেকে কে যেন রুনুকে ডেকে বারে বারে বলে । না হোলে, তুই মর রুনু ! তুই জলের ধারে যা । নদী ভরা জল । তোর মরবার সব পথই খোলা । আর কিইবা পিছুটান তোর !
কাঁদছে রুনু । একাকী । নির্জনে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । কিন্তু তা বড়ই নিঃশব্দে । পাছে মায়ের ঘরে বসা সেই হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার মানুষটি তাঁর কান্নার শব্দ শুনতে পায় !
কি হোয়ছিল সেদিন , সেসব দিনগুলোতে ! সব , সব মনে আছে আজোও রুনুর ! সুফিয়ান যেদিন সবাইকে না বলে এক কাপড়ে বাড়ী থেকে যুদ্ধে চলে গেল , তারপর কতদিন কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে তার লেখাজোখা নেই যেন । কেবলি শঙ্কা । তারপরও প্রত্যাশা হয়তো বা ক’দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে সুফিয়ান । তাঁর স্বামী । মাও বলতো তাই, ভাবতোও রুনুর মতো করেই । সুফিয়ান তাঁকে একা রেখে থাকতে পারে না , পারবে না- এ কথাই মনে করে রুনু মিথ্যে সুখ পেত দিনমান !
রায়হান তাঁর বড় ভাই সুফিয়ানের যুদ্ধে যাওয়াটকে কোনদিনও ভালো চোখে নিতে পারে নি । এত ভাবনা আর দুশ্চিন্তার মাঝেও সে ইনিয়ে বিনিয়ে রুনু আর রাবেয়া খাতুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো ; ভাইয়ার কি এ কাজটা করা ঠিক হোল । আসলে খুব বোকামী করেছে সে। পরে এর ফল বুঝতে পারবে সে ঠিক ঠিকই । রায়হান যেন নিশ্চিত এ যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর জয়লাভ করা একেবারেই অসম্ভব । কি আছে তাদের যে তারা শক্তপোক্ত পাকিস্থানীদের হারিয়ে দেবে । এ যেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নিয়ে ইংরেজদের সাথে অসম রণ , রায়হান খুব আয়েস করে হেসে হেসে বলতো!
আবার মাঝে মধ্যেই মা আর রুনুকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাথা গরম কোরে বলতে থাকতো সে - দ্যাখো আমাদের কপালে কি আছে । ভাইয়া যুদ্ধে গ্যাছে সারা গাঁ জেনে গ্যাছে । এবার রাজাকার আর আলবদরের কমান্ডাররা আমাদের চিলের মতো এসে ছোঁ মারবে ! আসলে রায়হান মুক্তি বাহিনীর বিপক্ষে আর রাজাকার আলবদরদের পক্ষে চলে গিয়েছিল ! বড় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে ! রুনু আর রাবেয়া খাতুনের তা বুঝতে আর বাকি ছিল না ! রায়হানের সেই বিষময় রক্তলাল চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেন ঘৃণা হোত মা আর তাঁর ছেলে বউয়ের । কিন্তু ভয়ে রায়হানের মতের বিরুদ্ধে কোন উচ্চবাচ্য করার সাহস দিনকে দিন যেন হারিয়ে ফেলছিলো এ দু’জন অসহায় রমণী !
রায়হানের কারণে রুনুর উপর নজর পড়েনি বটে মন্দ লোকজনের । কিন্তু সে নিজেই সেই দলের একজন হয়ে রুনুকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল । রায়হানকে সেই ছেলেবেলার মতো দুরন্ত একরোখা আর ছেলেমানুষ ভাবতে খুব কষ্ট হতো তখন রুনুর । দিনকে দিন কেমন যেন রক্তচোষা ভাম্পায়ার হোয়ে উঠছিল সে । সে যেন ভেবেই নিয়েছিলো , সুফিয়ান আর কোনদিন জীবিত অবস্থায় যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারবে না । তাঁর ভয়ে যুদ্ধের দিনগুলোতে রুনু নিজেকে অনেক সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছে । কখনও শ্বাশুড়ীর স্নেহ আঁচলে । আবার কখনো বা আপন ঘরে স্বেচ্ছা বন্দিনী হয়ে !
যুদ্ধ থেমে গেলে সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে এলো । যারা আসতে পারলো না , তাঁদের মা বাবা আত্নীয় পরিবারবর্গ জানতে পারলেন , ফিরে না আসার কারণ । কেননা এ সব মানুষগুলো দেশের জন্য আপনার জীবন বলিদান করেছেন । বিজয়ী বীর তাঁরা । তাঁরা শহীদ । তাঁদের আত্না অমর । কোনদিন যেন ক্ষয় নেই তাঁদের । সেই বয়স , সেই মন , সেই সব ক্ষণ থির হোয়ে তাঁদেরকে ঘিরে রেখেছে ! কিন্তু সুফিয়ানের কোন সঠিক খবর কেন জানি কেউই দিতে পারলো না । তার সমসাথীদের কেউ কেউ বললো - ডিসেম্বেরের শেষ মুহূর্তেও তাঁকে জীবিত দেখা গ্যাছে , দেখা গ্যাছে পরম নির্ভয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে । কেউ কেউ আবার প্রবল শঙ্কা ভরে বলেও ফেলেছে - কি জানি প্রচণ্ড সেই শেষ সংগ্রামে শুনেছিতো আমাদের প্রচুর সাহসী মুক্তি যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে !
এসবের কোনটা বিশ্বাস করবেন রাবেয়া খাতুন আর রুনু ! তাঁদের কেবলি প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা ! প্রতীক্ষার প্রহর অনেক ভারী আর কান্নাময় । ব্রহ্মপুত্রের জলের মতো তা অতল আর বহুরূপী । যে কোন সময় ছোটখাট পশ্চিমা বাতাসের ধাক্কায় তা বড় উতলা হয়ে উঠে ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় একটা বছর রায়হান অন্যসব বেঈমান মানুষগুলোর মতো গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে - এখানে সেখানে । যতদিন সে বাড়ীতে ছিল না , ততদিন যেন মহাশান্তি আর স্বস্তিতে ছিল বাড়ীর এ দু’জন অসম বয়সী নারী । তাঁদের লক্ষ্য এক । প্রতীক্ষা এক । আর তা হলো সুফিয়ানের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা । সে ফিরে না এলে , এ কিসের বিজয় । এ বিজয় কেমন তরো ! কিভাবে এ বিজয়কে বুকে ধরে তাঁরা সুখী সুখী বটের সবুজ পাতার মতো আনন্দে নেচে উঠবে কিংবা গেয়ে উঠবে সবুজ টিয়ার গান !
তারপর একদিন সব কিছু ক্যামন যেন ঠাণ্ডা হোয়ে গেল । আর সেই সুযোগে ঠিক ঠিকই ঘরে ফিরে এলো রায়হান । সেই আগের মতোই মন্দ বিশ্রী সেই স্বভাবে । আগের মতই সেই সর্বগ্রাসী রুপ নিয়ে । রাবেয়া খাতুন , রুনুকে সহজে রায়হানের সাথে মেলামেশা কোরতে , এমনকি কথা বলতেও সাবধান করে দিয়েছিলেন । নিজের পেটের ছেলে হোলে কি হবে ! সে এখন তো আর আগের মতো মানুষ নেই । রুপ পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর । পরিবর্তন হোয়েছে তাঁর চেহারার। আচরণের আর মানসিকতার । তাঁকে দেখলে বা তাঁর সাথে কথা কইলে , তাঁকে নিজের পেটের ছেলে বোলে ভাবতে খুব কষ্ট হোত রাবেয়া খাতুনের ।
সুফিয়ানের আশার আসায় এমন করে এ দুজন অবলা নারীর কেটে গেল প্রায় তিনটে বছর । দিনকে দিন রায়হানের সুতীব্র লালসার কাছে রুনু যেন অসহায় । সদ্য বাবাকে হারিয়েছে সে । অতএব বাবার বাড়ীতে মেয়েকে আশ্রয় দেবার মতো সঙ্গতি রুনুর মায়ের নেই ! বাড়ীর চারপাশের দুষ্ট লোকেরা ফাঁক পেলেই এটা ওটা নিয়ে মন্দ কথা শোনায় রাবেয়া খাতুনকে ! এক ছেলে বেঁচে নেই , অন্য জোয়ান ছেলের মুখের সামনে যুবতী বউকে সাজিয়ে রেখেছে সে , কোন সাহসে ! কোন নিয়মে । রায়হানও সুযোগ বুঝে জোর গলায় রুনুকে তাঁর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলে !
হায়রে নিয়তি ! নিজের একান্ত ভালবাসার মানুষটার ছবি আঁকড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার সাধ্য যেন নারীর নেই ! এতই নিরুপায় সে ! এতই পরাশ্রয়ী সে ! এতই সংসারের বোঝা সে !
মায়ের কোন কথা , নিষেধ বারণ , রুনুর অশ্রু জল –এসব কোন কিছুরই সামান্য মূল্য দিলো না শেষ পর্যন্ত রায়হান ! একদিন কাজী ডেকে এনে জোর করে রুনুর সাথে নিজের বিয়ের কলমা পড়িয়ে নিল সে । এখন থেকে রুনু তারই । রুনুর আর কোন পূর্ব পরিচয় নেই , থাকতে পারে না।
এই অনাচার মেনে না নিয়ে অতি সহজে নদীর জলে নিজেকে বিসর্জন দিতে পারতো রুনু । কিন্তু সে তা দিতে পারলো না । ক্যামন যেন একটা অদম্য ভালবাসার স্বপ্ন তখনও তাঁর বুক জুড়ে ।সে যেন জানতোই একদিন না একদিন সুফিয়ান তাঁর কাছে ফিরে আসবেই ! আহা, তাঁকে না পেলে মরে যাবে সেই ক্লান্ত মানুষটি !
সত্যি সত্যি আজ ঘরে ফিরে এসেছে সুফিয়ান ! তাঁর কাছে । কিন্তু এখন কি করবে রুনু ! কি করবে সে ! ক্যামন করেই বা ফিরে যাবে সেই প্রিয় মানুষটার কাছে ? সে কি তবে তাঁর এই পরস্ত্রী পরিচয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে আজীবন ! নাকি ভালবাসার মানুষটার সেই নির্ভীক সুঠাম হাতটা ধরে অবিচল কণ্ঠে বলে উঠবে- এই সমাজ সংসার কিছুই মানি না আমি । আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি । তোমাকেই চাই । যে বিয়েতে কেবল দেহের উপর দখলদারিত্ব- সে বিয়ে কি সত্যিকারের কোন বাঁধন ! সে বিয়েতে যে কেবল পরাজয়ের ছায়া ! পরাজয়ের কালো গ্লানি ।
সুফিয়ানকে আর কিছুতেই একা হোতে দেবে না রুনু ! কিছুতেই না ! সে বেঁচে থাকতে না ! তাঁর সুফিয়ান ! সেতো চিরটাকাল বিজয়ীর বেশে মাথা উঁচিয়ে থেকেছে ! রায়হানের মতো কুলাঙ্গার সেই মানুষগুলোর জয়-পরাজয়ে এখন যেন আর কিছুই যায় আসে না রুনুর !