কবে থেকে তোমায় চিনি তা বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি যবে থেকে চেতনা অনুভব করতে শিখেছি তবে থেকে তোমার মুখটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার পুরোটা স্বত্ত্বা জুড়ে তোমার বিচরণ। খেলার মাঠে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। অদ্ভুত এক রকম শান্তি লাগত মনে, ভাবতাম এই তো আর কিছুক্ষণ তারপর বাড়ি গেলেই তোমার নিরাপদ ছায়া পাব।
প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় তোমার মুখটা খুব করুণ হয়ে উঠত। একা একা না খেয়ে রোজ আমার জন্য অপেক্ষা করতে। আমি যখন বাড়ি ফিরতাম দরজা খুলে কি পবিত্র একটা হাসিই না দিতে তুমি। অবুঝ আমি তোমার খুশির কারন বুঝতাম না! আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে তবে তুমি নিজে খেতে। রাতে ঘুমানোর সময় আমি খুব ভয় পেতাম, আমার পা দুটো তোমার পায়ের ভাঁজে গুজে দিতাম পাছে ভূত এসে আমার পা খেয়ে ফেলে! কি বোকাই না ছিলাম আমি। তুমি খুব হাঁসতে আমার পাগলামি দেখে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। হঠাৎ তুমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে। আমাদের দু ভাইয়ের দেখাশোনা করতে করতে নিজের একদম যত্ন নিতে না। ডাক্তার, হসপিটাল দৌঁড়াদৌড়ি সে এক হযবরল অবস্থা। ঠিক হল তোমার অপারেশন করা হবে। আমি তো ভয়ে শেষ। এই বুঝি তোমাকে হারালাম! দিনরাত শুধু কাঁদতাম আর আল্লাহ্কে ডাকতাম যেন আল্লাহ্ তোমাকে সুস্থ করে দেন। আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করলেন। তোমার অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হল। তুমি আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকলে। তখন আমার খুশি দেখে কে? এভাবে তিনটা মাস কেটে গেল। আজও মনে পড়ে সেই তিনটা মাস জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। তোমাকে ফিরে পাবার আনন্দে আমরা সবাই আত্নহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। ভীষণ একাকীত্বে ভোগা তুমি খুব চাইতে আমি যেন তোমাকে বেশি বেশি সময় দিই। হায়রে অবুঝ-অপদার্থ আমি তোমার সেই না বলা চাওয়াটা কখনো বুঝতে পারিনি, হয়তো বয়স কম ছিল বলে।
একদিন তোমার খুব জ্বর উঠল। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন টাইফয়েড জ্বর। ঠিকমত ওষুধ খেলে কয়েকদিনের মাঝেই তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। চিকিৎসা চলতে থাকল। কিন্তু তোমার অবস্থার উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হতে থাকল। এক পর্যায়ে তুমি একদম চুপ হয়ে গেলে। কোন কথা বলতে না, নড়াচড়া করতে না, এমনকি চোখের পলক পর্যন্ত ফেলতে না! জানতে পারলাম ডাক্তারি ভাষায় একে ‘কোমা’ বলে। ডাক্তার যখন তোমার হাতে ইনজেকশন দিতেন, ছলকে তোমার হাত থেকে রক্ত বের হয়ে পড়তো, অথচ তোমার কোন বিকারই হত না। আমার খুব কষ্ট হত তোমাকে দেখে। আমি শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল তুমি কোমায় চলে গিয়ে আমার মাঝে কি যে এক শূন্যতা সৃষ্টি করেছিলে তা বলে বোঝাতে পারব না। সেদিন ছিল বুধবার। রাতে তোমাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে তোমাকে এক নজর দেখে হাসপাতালের বেডেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ভেবেছিলাম পরদিন এসে তোমাকে ভালো করে দেখে যাব। কিন্তু হায়, মহান আল্লাহ্ আমাদের ভবিষ্যতে কি লিখে রেখেছেন তা কি আর আমরা জানি? কে জানতো সেটাই হবে তোমাকে আমার শেষ দেখা। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে দেখি ভাইয়া, খালামনি বাসার সবাই পাগলের মত কাঁদছে। যে ভয়টা গত ৭ দিন যাবৎ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাই সত্যে পরিণত হল। দীর্ঘ ৭ দিন কোমায় থেকে তুমি চলে গেলে না ফেরার দেশে! কষ্টে দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। কি নিষ্ঠুর নিয়তি। আমি যদি জানতাম তুমি চলে যাবে তাহলে কি ক্লান্তির কারনে অত কম সময় তোমার পাশে থাকতাম? বড় দুঃখ হয় মা। দেখো কি অপদার্থ, দুর্ভাগা ছেলে আমি। জীবনে একটা বিকেলেও তোমাকে সময় দিই নি! জীবনের কোন বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাবার আগে তোমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারি নি। তোমাকে কখনো বলতে পারি নি কতটা ভালোবাসি। ভাবলে কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠে। দেখতে দেখতে ১১টা বছর কেটে গেছে! আজও প্রতি বিকেলে আমি তোমার কথা ভেবে কাঁদি মা। চিৎকার করে শুধু বলতে ইচ্ছে করে, তোমায় বড় ভালোবাসি মা, তোমায় বড় ভালোবাসি। পরম করুণাময় ও অশেষ দয়ালু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তোমাকে জান্নাত দান করুন। আমিন।
ইতি
তোমার ছোট্ট ছেলে
ফারহান
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
০৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।