ট্রিং টিং করে বেল বাজছে, সাঁই সাঁই করে রাস্তা আর আশেপাশের সবকিছু পার হয়ে যাচ্ছে। নতুন সাইকেলের গন্ধটা মাথার ভেতর খুশির সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কি দারুন একটা চকচকে নীল রঙের সাইকেল। সিটের উপর বসে প্যাডেল ঘোরানোর সময় নিজেকে রাজার মতন মনে হচ্ছে নিজেকে। কিন্তু কে যেন পিছন থেকে বার বার হালকা করে ধাক্কা দিচ্ছে। ধাক্কাটা এবার জোরে জোরে লাগছে, মনে হচ্ছে ও পড়ে যাবে আর একটু জোরে ধাক্কা লাগলে। কিন্তু পড়ে গেলেই ওর সাইকেলটা নষ্ট হয়ে যাবে। খুব শক্ত করে হ্যান্ডেলটা ধরে আছে ও এখন, যেন কিছুতেই পড়ে না যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা করা গেল না, ব্যালান্স হারিয়ে ও পড়ে যাচ্ছে নিচে। সাইকেলটা রাস্তায় বাড়ি খাওয়ার আগেই ওর সমস্ত চেতনা ফিরে এল।
আম্মা অনেক্ষন থেকে ডাকছেন, হাসিব, এই হাসিব! ওঠ বাবা। আর কতক্ষন ঘুমাবে?
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে আম্মা ওকে ডাকছেন। হাসিবের এবার মনে পড়ল, ও স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষন। ধুর! কি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল আর আম্মা এসে ওর ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিলেন। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে হাসিব বিড়বিড় করতে থাকল, ইস! কি সুন্দর একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
বিছানায় ওর পাশে এসে বসলেন মিলি। ছেলেটার মাথা ভর্তি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলেন, কি স্বপ্ন দেখছিলে তুমি? বলবে আমাকে!
হাসিব একটু লজ্জা পেল স্বপ্নটার কথা বলার সময়। সব শুনে মিলি একটু হাসলেন। তোমার আব্বুকে বলব তোমাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে কিন্তু সামনে পরীক্ষা, আগে রেজাল্ট ভাল কর।
হাসিবের একটু রাগ হল, সেই কবে থেকেই তো আপনি বলছেন রেজাল্ট ভাল কর তাহলে সাইকেল কিনে দেব। ক্লাস ফাইভের সময়ও আপনি এই কথা বলেছেন। আমার রেজাল্টতো অনেক ভাল হয়েছে, তবুও আব্বু সাইকেল কিনে দেননি।
মিলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। দিদারকে বলেছিলেন তিনি কিন্তু ব্যবসা নাকি ভাল যাচ্ছে না, এই সমস্যা সেই সমস্যা, তাই আর কেনা হয়নি। একটা সাইকেলের যে কি শখ হাসিবের কিন্তু কিনে দেব দেব করেও কিনে দেওয়া হচ্ছে না। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আমি তো আর চাকরি করি না রে বাবা। আমার কাছে টাকা থাকলে আমি এখুনি তোমাকে একটা সুন্দর সাইকেল কিনে দিতাম। এখন ওঠ, স্কুলে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
মিলি ছেলের কাছ থেকে উঠে ওর জন্য খাবার রেডি করতে গেলেন। কাল রাতে গাজরের হালুয়া বানিয়ে রেখেছেন। রুটি দিয়ে ছেলেটা এই হালুয়া খেতে খুব পছন্দ করে। অনেকগুলো রুটি বানিয়ে মিলি ডাইনিং টেবিলে রাখলেন। হাসিবকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে হালুয়ার বাটিটা তিনি ডাইনিং টেবিলের পাশের ড্রেসারের নিচে রেখে দিয়েছিলেন। ছেলেটা খেতে খুব পছন্দ করে, যে কোনও ভাল খাবার সামনে পেলে এক মুহুর্তে শেষ করে দেয় হাসিব।
যে কোনও ধরনের গল্প শুরু হলে, হাসিবের সেই গল্প যেয়ে খাবারের গল্পের সাথে মিশে যায়। যেমন ওকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার স্কুল কেমন হল আজ? হাসিব তখন বলবে, স্কুল খুব ভাল হয়েছে। এরপর বলবে, জান আম্মু! আজকে আমাদের এক বন্ধু কি টিফিন নিয়ে এসেছিল? তখন ওর চোখ মুখ চকচক করবে সেই সব কাল্পনিক খাবারের গল্পে। হাসিবকে দেখলে মনে হবে ও যেন সেই খাবারগুলো ঠিক ওর সামনে দেখতে পাচ্ছে। এত সুন্দর করে খাওয়ার গল্প করতে থাকবে, তখন আর ইচ্ছা হয় না ওকে বলে “তোমার স্কুলের গল্প কি শুধু খাবার দাবারের গল্পই হয় সবসময়”?
মিলি জানেন, লুকিয়ে না রাখলে সকাল পর্যন্ত হালুয়া রাখা যাবে না, তার আগেই শেষ হয়ে যাবে। নিচু হয়ে ড্রেসারের নিচে হাত দিলেন তিনি কিন্তু কিছু নেই ওখানে। পুরো ড্রেসারের নীচে, পাশে কোথায় হালুয়ার বাটিটা নেই। মিলির স্পষ্ট মনে আছে এখানেই তিনি রেখেছিলেন হালুয়ার বাটিটা। ফ্রিজের ভেতর খুলে দেখলেন, নাহ ! ওখানেও নেই। তাহলে গেল কোথায়? কাজের মেয়েটা ভুল করে কিচেনে রাখল নাকি? সেখানেও ভাল করে খুঁজে দেখলেন, কোথাও নেই গাজরের হালুয়া। একদম বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মিলি নিজের হাতে হালুয়ার বাটিটা ড্রেসারের নিচে রেখে গেছেন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে।
হাসিব রেডি হয়ে চলে এসেছে ডাইনিং টেবিলে। রুটিগুলো দেখে এবার ও ভয় পেল। আম্মু এখুনি বুঝে ফেলবে ও কি করেছে। ইস, এখন কি হবে? ভয়ে ভয়ে হাসিব ডাইনিং এর একটা চেয়ার টেনে বসল। অপেক্ষা করছে এর পর কি হয়। নির্ঘাত আজকে কান ধরে উঠ বস করতে হবে ওকে। ভুল করলেই কান ধরে উঠবস, কোনও মাফ নেই।
মিলি ডাইনিং এ ফিরে এসে দেখেন হাসিব মুখ নিচু করে বসে আছে। অনেক পিঁয়াজ আর ধুনেপাতা দিয়ে ডিম ভাজা হাসিব খুব পছন্দ করে। ওর সামনে ডিম ভাজা আর দুটো রুটি দিলেন তিনি। কিন্তু ছেলেটা মুখ নিচু করে বসে আছে কেন? এই হাসিব, মুখ নিচু করে বসে আছ কেন? তাড়াতাড়ি খাও, নাহলে তোমার অনেক দেরি হয়ে যাবে স্কুলে। রাস্তায় যে জ্যাম থাকে!
হঠাত মিলি বুঝতে পারল হাসিব কেন মাথা নিচু করে বসে আছে। তুমি কি গাজরের হালুয়া সবটুকু খেয়ে ফেলেছ? কখন খেয়েছ?
মাথা নিচু করেই হাসিব বলল, কালকে রাতে। ঘুমানোর আগে একটু খেলছিলাম বলটা নিয়ে, তখন হাত থেকে পড়ে আমার টেনিস বলটা গড়িয়ে এখানে চলে আসল। ড্রেসারের নিচে থেকে বলটা নিতে যেয়ে দেখি গাজরের হালুয়া। কিছুক্ষন আগের অপরাধীভাবটা চলে গেল ওর মুখ থেকে, দুই পাটি দাঁত বের করে বলল তারপর খেয়ে ফেললাম।
মিলি ওর হাসি দেখে আর রাগ করতে পারলেন না। সবটুকু খেয়ে ফেললে? একটু রাখতে পারতে? তাহলে এখন রুটি দিয়ে খেয়ে যেতে পারতে! তোমার জন্যই তো বানাই। তোমার আব্বু তো মিষ্টি জিনিস খায়ই না একদম।
মিলি ওকে বকা দেয়নি, মনে হয় এই খুশিতেই হাসিব গপাগপ করে রুটি ডিম দিয়ে খেয়ে নিল। নিচে থেকে দারোয়ান জানাল যে রিকসা এসে গেছে। হাসিবের টিফিন বক্স আগেই রেডি করে রেখেছেন মিলি। ওর স্কুল ব্যাগের ভেতর টিফিনের বাক্সটা দিয়ে ওকে বললেন খুব সাবধানে যাবে।
মিলির বেশিরভাগ সময় কাটে নামাজের পাটিতে, বাকি সময় সংসারের টুকটাক কাজ আর রান্না। সব কিছু বুয়াকে দিয়ে করালেও রান্নাটা তিনি নিজে করতে পছন্দ করেন। হাসিব স্কুলে চলে যাওয়ার পর মিলি বুয়াকে বলে আসলেন কি কি করতে হবে। এরা প্রতিদিন একই কাজ করে তারপরও মিলিকে সব বলে দিতে হয়। এখনও রান্নার অনেক দেরী আছে, ওজু করে মিলি তসবী নিয়ে বসলেন।
স্কুলের ছুটির এখনও আধাঘন্টা বাকি আছে। দিদারকে ফোন করেছিলেন গাড়ি পাঠানো যাবে কিনা জানার জন্য কিন্তু অফিসের ফোন কেউ ধরছে না আর মোবাইল বন্ধ। কয়েকবার ফোন করেও যখন কোনও সাড়া শব্দ পাননি তখন আর উপায় না দেখে পাশের ফ্লাটের রুমানা ভাবীকে জানালেন যেন উনাদের সাথে হাসিবকে নিয়ে আসেন। ভাবীর ছেলে সজীবও একই স্কুলে পড়ে, ক্লাস সেভেনে। প্রায় সময়ই হাসিব আর সজীব এক সাথে আসা যাওয়া করে।
খিলগাঁও বাজার থেকে শুরু করে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি পার হয়ে দক্ষিন শাহজাহানপুর জামে মসজিদ পর্যন্ত পুরোটা পথ একদম জমে আছে রিকসা, গাড়ি, সিএনজিতে। অনেক সময় লেগে গেল রিকসাটা শাহজাহানপুর কবরস্থান পর্যন্ত আসতে। আর একটু গেলেই সামনে ডিআইটি এভিনিউ এর মাথায় শহীদ স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত যেতে পারলেই বাকিটা হেটে যেতে পারবে। রিক্সা যখন ডিআইটি এভিনিউ এর কাছে তখন ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেল ওরা।
কিছুদুর দ্রুত হেঁটে মতিঝিল মডেল হাইস্কুল এন্ড কলেজের গেটের এক কোনায় বড় গাছটার নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছে সাইদ আর লিটন। সাইদ কি যেন বলল, লিটন খিকখিক করে হাসল সেই কথা শুনে। লিটনের হাতে চিকেন বার্গার এর প্যাকেট। দুর থেকে ওরা দেখল হাসিব স্কুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়েছে। লিটনের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু কাত করল সাইদ, তারপর হনহন করে ভীড়ের ভেতর মিশে গেল।
রুমানা সজীবকে নিয়ে স্কুলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। হাসিবকে দেখলেন তিনি, ছেলেটা স্কুলের ব্যাগটা হাতে নিয়ে গেটের দিকে হেঁটে আসছে। কাছে আসতেই রুমানা হাসিবকে ডাকলেন, তুমি আমাদের সাথে বাসায় যাবে আজ।
হাসিব একটু আগেই লিটনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে গাছের নীচে। লিটনের সাথে অনেকদিন কথা হয় না ওর। রুমানাকে ও বলল, আন্টি ! আপনি চলে যান। আমি আমার এক ভাই এর সাথে বাসায় যাব। লিটনের নামটা রুমানাকে বলেনি হাসিব।
রুমানা একটু ইতস্থত করলেন। বললেন, ঠিক আছে, কিন্তু তোমার ভাইকে বলবে বাসায় একটু জানিয়ে দিতে। তারপর রুমানা বেরিয়ে গেলেন তাদের গাড়ির দিকে তার ছেলে সজীবকে নিয়ে।
ওরা চলে যেতেই লিটন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। লিটনকে দেখে হাসিব খুব খুশি, ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল আপনি কখন আসলেন ভাইয়া?
হাসিবের দিকে একটা চিকেন বার্গারের প্যাকেট এগিয়ে দিল লিটন। ওর সাথে হাসিবের দারুন ভাব। প্রায় এক বছরেরও বেশী সময় ওরা হাসিবদের নীচের তলায় ভাড়া থাকত। কোরানে হাফেজ হওয়ার অনেক সুবিধা। এমনিতে ব্যাচেলর কাউকে ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না কিন্তু কোরানের আয়াত যার ভেতরে আছে তাকে যে কেউ বাড়ি ভাড়া দেবে। হাসিবকে প্রতিদিন কোরান শেখাত সে একসময়।
রিক্সায় বসে লিটন চিকেন বার্গারটা খাওয়া শুরু করল। হাসিবকেও ইশারা করল চিকেন বার্গারটার দিকে কিন্তু হাসিব জানাল সে বাসায় যেয়ে খাবে। ওদের রিক্সা বাসার দিকে না যেয়ে অন্য দিকে মোড় নিতেই হাসিব বলল, ভাইয়া ! এই রাস্তায় কেন? লিটন বলল তোমার জন্য একটা সাইকেল ঠিক করছি। তোমার পছন্দ হলে কাল কিংবা পরশু বাসায় দিয়ে আসব।
হাসিবের মনে হল এর চেয়ে সুন্দর দিন ওর জীবনে আর আসবে না। ওর নিজের একটা সাইকেল হবে? কিন্তু এত টাকা দিয়ে লিটন ভাই ওকে সাইকেল দেবে? আনন্দের শিহরন হাসিবের সমস্ত দেহে। অবাক বিশ্ময়ে ভাবছে ছোট্ট হাসিব যে কিভাবে স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়। আজকে সকালেই সে স্বপ্ন দেখেছে চকচকে সুন্দর একটা নীল রং এর সাইকেলের।
বিকাল পার হয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে কিন্তু এখনও হাসিবের কোনও খবর নেই। রুমানা ভাবী জানিয়েছেন ও নাকি কোন ভাইয়ার সাথে বাসায় আসবে। কার সাথে গেল ছেলেটা? দিদারকে অনেকবার ফোন করেছেন মিলি কিন্তু এখনও অফিসে ফেরেন নি সে। খুব অস্থির লাগছে মিলির।
সন্ধ্যার দিকে অফিসে ফিরে দিদার জানতে পারেন মিলি অনেকবার ফোন করেছিল। কিছু কাজ জমা হয়ে আছে কিন্তু আজ আর কিছু করা যাবে না। ফাইলগুলো ম্যানেজারকে ডেকে দিলেন তিনি, তারপর বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে কাল সকালে। এরপর দিদার সোজা বাসায় চলে আসলেন।
এখন রাত প্রায় দশটা বাজে। এর মধ্যে দিদার আশেপাশে সব জায়গায় খবর নিয়েছেন। কিন্তু কোথাও হাসিবের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও খবর নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মিলির সাথে কয়েকবার দিদার এর কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। হাসিবকে নিয়ে এই এক সমস্যা, না বলে মাঝে মাঝে এভাবে উধাও হয়ে যায়। কখনও পাড়ার কোনও বড় ভাই এর সাথে, কখনও ভাড়াটের ছেলেদের সাথে। কিন্তু কখনও এত দেরি করে না ছেলেটা। ছেলে বাচ্চাদের এই বয়সটাই হয়ত এমন। আশেপাশের সমস্ত হসপিটালেও খবর নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে দিদারের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন চলে এসেছেন, তারাও দৌড়াদৌড়ি করছেন। মিলি সেই বিকাল থেকে নামাজের পাটিতে, অঝোর ধারায় ক্রমাগত কাঁদছে সে। দিদার সিদ্ধান্ত নিলেন থানায় যাবেন।
টেলিফোনটা বেজে উঠল তীব্রভাবে। দৌড়ে যেয়ে দিদার ফোনটা ধরলেন, অপরপ্রান্তের কন্ঠ তার অপরিচিত। খুব ঠান্ডা গলায় দিদারকে স্পষ্ট ভাবে জানানো হল হাসিব এখন তাদের কাছে। হাসিবকে সুস্থ অবস্থায় পেতে চাইলে একশ টাকার নোটে ক্যাশ দশ লাখ টাকা দিতে হবে ৪৮ ঘন্টার ভেতর। দিদারকে সাবধান করে দেওয়া হয় যেন পুলিশকে জানানো না হয়, যদি জানায় তাহলে হাসিবকে জীবন্ত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কোথায়, কখন আর কিভাবে টাকাটা দিতে হবে এটা সময়মত জানানো হবে বলে ফোন কেটে দেয় যে ফোনটা করেছিল। দিদারের এক বন্ধুর উদ্যোগে ডিবি পুলিশ ঘটনা তদন্তের ভার নেয়।
হাসিবের দুই হাত আর পা পিছন থেকে বেঁধে রাখা, মুখে কাপড় ভরে তারপর মুখ বেঁধে দিয়েছে ওরা। লিটন ভাইয়া ওকে সাইকেল দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এখানে নিয়ে এসেছে। প্রচন্ড ভয়ে আর আতঙ্কে হাসিবের খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু এখনও সে শক্ত হয়ে বসে আছে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। বয়স ১১ হলেও ওর শরীর অন্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু ভারী ও বেশ মোটাসোটা। দড়িগুলো ওর হাত আর পায়ের ভেতর বসে গেছে, রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। প্রচন্ড ক্ষুধায় তার এখন মাথা ঘুরছে। শারীরিক ব্যাথা এখন আর টের পাচ্ছে না হাসিব। বার্গারটা আর খাওয়া হয়নি ওর, স্কুলের ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়েছিল বাসায় যেয়ে খাবে বলে, এখন ব্যাগটা পড়ে আছে ঘরের এক কোনায়।
এখানে আনার পর লিটন ভাই এই চেয়ারে বসতে দেয় ওকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুইজন এসে ওর হাত পা বেঁধে ফেলে দড়ি দিয়ে। হাসিব ভয় পেয়ে চিৎকার করার আগেই ওর মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে দেয় ওরা। এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। হাসিবের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। হাসিব জানে, ওর আব্বু ওকে ঠিকই এখান থেকে নিয়ে যাবেন। আব্বু ! আব্বু! আমাকে বাঁচান। অনেকবার মনে মনে হাসিব বলেছে একথা।
ডিবি পুলিশ সাধ্যমতন চেষ্টা করছে কিন্তু এখনও কোনও খোঁজ পায়নি তারা। টেলিফোন ট্র্যাক করে জানা যায় ফোনটা করা হয়েছিল একটা বুথ থেকে। সারারাত কারো চোখেই ঘুম ছিল না, বাড়িতে খাওয়া বলতে কিছুই নেই। বড় মেয়েটা না খেয়ে বসে আছে মিলির সাথে নামাজের পাটিতে, এক নাগাড়ে কান্নার জন্য কারোর চোখেই পানি থাকার কথা না। কিন্তু অবিরাম কান্নার বেগ থামছে না। এভাবে রাত পার হয়ে পরের দিনও শেষ হয়ে গেল, কিন্তু কোনও খোঁজ পাওয়া যায় হাসিবের ।
ডিবি পুলিশ সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় খুঁজেছে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়িয়েছে ডিবির ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অফিসাররা। পরদিন রাত এগারটার সময় আবার এল ফোনটা, দিদার ফোনটা পাশে নিয়েই বসে ছিলেন। এবার যে ফোনটা করেছে সে আগের জন নয়। চাপা গলায় জানাল কোথায়, কখন আর কিভাবে টাকা দিতে হবে।
পরদিন সকাল দশটায় টাকাটা পৌঁছে দেওয়ার কথা। আগে থেকেই ডিবির পুলিশ ওখানে ছদ্মবেশে অপেক্ষায় ছিল। কয়েক ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও কাউকে ওখানে আসতে দেখা যায়নি। কিন্তু ডিবির পুলিশ আশেপাশে সব জায়গায় ছিল, বেলা বারোটার দিকে দুইজন ধরা পড়ে খিলগাঁও এলাকা থেকে। একটা ডাষ্টবিনের ভেতর কাপড়ের থলিতে কিছু ফেলতে আসে ওরা। থলেটা ফেলে মটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। থলেটায় একটা হাত পাওয়া যায়, কব্জি থেকে কাটা।
দিদার হতভম্ব হয়ে যায়। পুরো বাড়িতে নেমে আসে শোকের কাল ছায়া। শেষ আশাটাও নিভে গেছে সবার মন থেকে কারন কাটা হাতটা হাসিবের। ভয়ঙ্কর কষ্টের সাথে সাথে দিদারের মধ্যে একটা আক্রোশ চলে আসে। মিলি আর হাসিবের বড় বোন হেনার মুখে কোনও কথা নেই, দুজনেই সম্পুর্ন বোবা হয়ে গেছে।
ডিবি ওই দুজনের কাছ থেকে আর কিছুই জানতে পারেনি কারন একজন ফোন করে ওদেরকে এই থলে ফেলার কাজ দেয়। ফোন নাম্বার ট্র্যাক করে জানা যায় এটা গোরানের একটা বুথ থেকে এসেছিল। ডিবি তৎক্ষণাৎ পুরো গোরান এলাকা ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে।
বিকাল চারটার সময় আবারও ফোন আসে অপরিচিত ব্যাক্তির কাছ থেকে। এবার ওরা ভয়ঙ্কর হিংস্রভাবে হুমকি দেয় দিদারকে যেন পুলিশকে এর মধ্যে না আনে। ভালয় ভালয় টাকাটা যদি দিয়ে দেয় তাহলে রাত আটটার ভেতর ওরা হাসিবকে ছেড়ে দেবে তা-না হলে হাসিবের লাশ পাঠিয়ে দেবে। দিদার আর ঝুঁকি নিলেন না এবার। ডিবিকে না জানিয়ে তিনি টাকার ব্যাগটা পৌঁছে দিলেন নির্দেশিত জায়গায়। কিন্তু দিদার টাকার ব্যাগ রেখে আসার দশ মিনিটের মাথায় ডিবি পুলিশ শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে হাসিবের খন্ড খন্ড দেহের বিভিন্ন অংশ। মোট ছয়টা ব্যাগে হাসিবের দেহের সব অংশ ভাগ ভাগ করে ফেলেছে ওরা।
ডিবি পুলিশ টাকার ব্যাগ নিতে আসা লিটন আর সাইদকেও ধরে ফেলে। রাত এগারোটার ভেতর মোট নয়জন ধরা পড়ে। উত্তর গোরানের যে ক্লাব ঘরে হাসিবকে গলা টিপে মারা হয় সেখান থেকে ওর স্কুল ব্যাগটা উদ্ধার করা হয়। পরদিন ময়না তদন্তে জানা যায় হাসিবকে দুইদিন আগেই মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর ছোট্ট হাসিবের শিশু দেহটাকে খন্ড খন্ড করা হয়েছে কসাই এর মতন।
মিলি জানেন না তিনি কে কারন তার স্মৃতি হারিয়ে গেছে। নির্বাক দৃষ্টিতে তিনি সবাইকে দেখছেন। অনুভুতি জিনিসটা কি তিনি এখন আর জানেন না। আজ দুদিন হয়ে গেল হাসিবের দেহের টুকরোগুলো পাওয়ার পর। এই দুদিন পুরো বাড়িটা ছিল মৃত্যুপুরী, কোনও শব্দ নেই, বাতাসও এখানে থমকে আছে। ডিবি পুলিশের কাছ থেকে জানা গেছে লিটন, সাইদ এরা দুবাই যাওয়ার সমস্ত ব্যাবস্থা করে তারপর হাসিবকে কিডন্যাপ করেছিল। সংসদ এমপি জুলেখার আদম পাচারকারী এজেন্টের মাধ্যমে দুবাই যাওয়ার ব্যাবস্থা হয়েছিল লিটন। জুলেখার পরামর্শেই ওরা হাসিবকে কিডন্যাপ করে। ওদের প্রয়োজন ছিল দশ লাখ টাকার। হাসিবকে সাইকেলের লোভ দেখিয়ে জুলেখার উত্তর গোরানের ক্লাব ঘরেই নিয়ে যায় লিটন এবং ওইদিন রাতেই ওরা গলা টিপে ওকে মেরে ফেলে। রাত বারোটার পর চাপাতি আর চাকু দিয়ে হাসিবের দেহটা ওরা টুকরো টুকরো করে।
নাসিম নামের ছেলেটার কাছ থেকে আরও জানা যায় হাসিব কাঁদতে কাঁদতে অনেকবার ওদেরকে অনুরোধ করেছিল ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বলেছিল, লিটন ভাইয়া! আমাকে ছেড়ে দেন। আমি আম্মা আব্বুর কসম খেয়ে বলছি কোনওদিন কেউ জানবে না আপনি আমাকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন।
হাসিবের স্কুল ব্যাগটা থেকে পুলিশ বইপত্র, কিছু ছোট খেলনা গাড়ি, টিফিনের বক্স আর কয়েকটা এনভেলাপ পেয়েছে। জিনিসগুলো আজ সকালে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। মিলি ব্যাগটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিন্তু কিছুই বলছেন না। দিদার ব্যাগটা নিয়ে অনেক্ষন বসে থেকে ছেলেটার জিনিসগুলোর উপর হাত বুলাচ্ছেন, অনুভব করার চেষ্টা করছেন ওর অস্তিত্ব। এনভেলাপ গুলোতে স্কুলের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিপত্র। একটা ব্রাউন রং এর এনভেলাপ হাতে নিলেন দিদার। ভেতরে হাতে বানানো একটা গ্রিটিং কার্ড, একটা ছোট্ট কাগজে হাসিবের হাতে লেখা চিঠি আর আটশ পঞ্চাশ টাকা।
দিদার কাঁপা হাতে কার্ডটা খুললেন, বুকের ভেতরটা মনে হল ছিড়ে যাবে। কার্ডে লেখা “পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবার জন্য বাবা দিবসে অনেক শুভেচ্ছা”, তার নীচে কার্ডের মাঝখানে দিদারের সাথে হাসিবের একটা প্রিন্ট করা ছবি। তার নিচে ছোট্ট করে হাতে লেখা “আব্বু তোমার জন্য - হাসিব”। ছবিটা দুই বছর আগে হাসিবের জন্মদিনে তোলা।
চিঠিতে লেখা “আব্বু, তোমার জন্য আমি কি কিনব বুঝতে পারছি না। আমি ঈদের সালামির টাকাগুলো জমিয়ে রেখেছিলাম। এটা দিয়ে তুমি একটা সুন্দর শার্ট কিনবে। যদি টাকা কম পড়ে তাহলে এখন তোমার কাছ থেকে দিয়ে দিও, আমি এইবারের ঈদে যত সালামি পাব সেখান থেকে তোমাকে দিয়ে দেব। আমাদের ক্লাসটিচার আমাদেরকে বাবা দিবস উপলক্ষ্যে এই কার্ড বানাতে দিয়েছিলেন। কার্ডটা সুন্দর হয়েছে আব্বু?
আচ্ছা আব্বু! বাবা দিবস, মা দিবস আছে তাহলে পুত্রদিবস নেই কেন? টিচারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু উনি খুব হাসলেন আমার কথা শুনে। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন পুত্রদিবস থাকলে কি হত। আমি টিচারকে বলেছি, পুত্রদিবস থাকলে আব্বুও আমাকে এইরকম একটা সুন্দর কার্ড বানিয়ে দিতেন আর অবশ্যই আমার জন্য কিছু কিনতেন। পুত্রদিবস যদি থাকত, তাহলে কি তুমি আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে আব্বু?
সাইকেলের কথা বলেছি বলে কি তুমি রাগ করলে আব্বু? আম্মা বলেছে খুব ভাল রেজাল্ট করতে, তাহলে তুমি আমাকে সাইকেল কিনে দেবে। আমি এইবার খুব ভাল রেজাল্ট করব আব্বু। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি আব্বু!”
দিদারের দুচোখ ভিজে গেল, অশ্রুরা বেসামাল হয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। বুকের ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে। ব্রাউন রং এর খামটা ভিজে গেল। হাসিবের সব কথায় একসময় খাওয়া দাওয়া চলে আসে। এই প্রথম ছেলেটা খাওয়া দাওয়ার কথা বলেনি, শুধু একটা সাইকেল চেয়েছিল।