এক.
শেষ বিকেলের নীলিমা নীলাম্বরীতে আচ্ছাদিত হয়। দিন-শেষে সূর্যের হাসি বিলীন হতে থাকে। পৃথিবীর বুকে ঘনায় আঁধার। বন্ধ হয় ঝিঁঝির একটানা সুর। জোনাকিপোকারা আলোকবর্তিকায় বেরিয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। রাতের আঁধারে বেরোয় নিশাচর পশু-পাখির দল। বাদুরের ডানা ঝাঁপটানি, উড়ে চলা একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে জীবন ও জীবিকার অন্নষণে।
রাতশেষে আবার প্রভাতের জ্যোতিষ্মান আলো ধরায় প্রাণের ছোঁয়া জাগায়। নরম ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দুর দীপিত দীপ্তি প্রাণবন্ত কোরে। নিশাচর পশু-পাখিরা ফিরে যায় আপন আলয়ে। পৃথিবী মাঝে মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়ে। প্রভাতের সূর্যের আলো ক্রমে গাঢ় হয়। উষ্ণতা বাড়ে ঘরে-বাইরে, সবখানে।
শেষ বিকেলে-সাঁঝে আবার কর্মক্লান্ত মানুষের নীড়ে ফেরা। এভাবেই চলছে পৃথিবী। চলছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জৈবনিক আশা-আকাঙ্ক্ষার ভেলা। কেউ কামিয়াব হয়, আর কেউ পড়ে থাকে আশার ভেলায় সমুদ্র-সৈকতে- বালুচরে। আশা-নিরাশার পৃথিবীতে হাজার রকমের মানুষের আগমন ও প্রস্থান। এদের মধ্য থেকে ক’জন মানুষকে নিয়ে শুরু হল আমাদের ‘জীবনের প্রত্যয়ে’র গল্প
শুরুটা এভাবেই : যখন মানুষ সংসার সীমান্তের যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে পাড়ি জমায় অন্য শহরে এক অদ্ভুত আলোর দীপিকায়, কিন্তু তার শেষ কীভাবে? সে অন্য এক অধ্যায়, অন্যরকম পরিণতিতে।
ছয় মার্চ, উনিশশো একাত্তর।
নদীপথে লঞ্চে পাড়ি দিয়ে এক ইলিশের শহর চাঁদপুর থেকে ভোরবেলা ঢাকার সদরঘাটে এসে নামলেন গণি মিয়া। তিনি বড়ো আশা করে ঢাকায় এসেছেন। গ্রামে কাজকর্ম তেমন একটা নেই। সাংসারিক টানাপড়েন তাকে ফেলে দিয়েছে অথৈ সাগর মাঝে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, সাংসারিক দুরবস্থা, টানাটানি, ছেলেমেয়ের স্কুলের পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছেন না। জীবনের দুর্গম বাঁকে ক্লান্ত-পাখির বটের ডানার মতো উড়ে উড়ে ক‚লের জন্যে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গণি মিয়া সদরঘাটে নামলেন।
খাবার হোটেলে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলেন তিনি। পাশে ফুটপাতে বসে একজন দোকানি রুটি বানাচ্ছে। গ্রাম থেকে আসা গণি মিয়াকে দেখে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘চাচা, নাস্তা খাইবেন? আহেন।’
সম্মতি জানায় গণি মিয়া।
তারপর বলে, ‘হ বাপজান, বড়ই খিদা পাইছে। নাস্তা খাইতে অইবো। তয়, রুটির সাথে আর কী আছে?’
ফুটপাতের এই দোকানদার লোকটার নাম কাশেম আলী।
সে গণি মিয়ার খাবারের আগ্রহে খুশি হয়। তার খুশির কারণ সকালবেলায় এই প্রথম একজন ‘কাস্টমার’ পাওয়া গেলো। অন্য কাস্টমাররা বেশিরভাগই সামনের ওই আলীশান হোটেলটাতে বসে মজা করে খায়। তার এই ফুটপাতের অপরিচ্ছন্ন দোকানে তেমন একটা কেউ আসতে চায় না।
ঢাকা শহরে অনেক ধনী লোকের বাস। কেউ থাকে আটতলায় আর কেউ থাকে গাছতলায়। যারা আটতলায় থাকে তারা ওপর থেকে গাছতলার মানুষদের খুব ছোটো করে দেখে। এটা কাশেম আলী বেশ ভালো করেই জানে। ওপরতলার মানুষরা তাদের মতো গাছতলার মানুষদের সাথে মেশে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। কারণে-অকারণে বকে, মারে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এমনকি ভুলক্রমে পথ চলতে গিয়ে যদি কোনোদিন কোনো ওপরতলার মানুষদের গায়ে লাগে তাহলে তো আর রক্ষা নেই। গলাধাক্কা মারতেও দ্বিধাবোধ করে না।
গণি মিয়া কাশেম আলীর কাছে আসে। তার খাবারের প্রতি উৎসাহ দেখে কাশেম আলী বেশ খুশি হয়। সে একটা ছালার চট বিছিয়ে দেয় গণি মিয়ার সামনে। বলে, ‘আগে বহেন চাচা। ডিম, ভাজি, হালুয়া সবই আছে। কী খাইবেন?’
গণি মিয়া সেই ছালার চটে বসলেন।
কাশেম আলীর ফুটপাতের অপরিচ্ছন্ন দোকানটাতে বসে গণি মিয়া পেটপুরে রুটি-হালুয়া খেলেন। মুখ মুছলেন কাশেম আলীর তেলচটচটে নোংরা গামছায়।
তারপর খাবারের দাম দিয়ে গণি মিয়া কাশেম আলীকে প্রশ্ন করলো, ‘বা’জান, এইহান থাইক্কা ঢাহা বিশ্ববিদ্যালয় কতো দূর?’
কাশেম আলীর জন্যে এসব প্রশ্ন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। সে জানে এই সদরঘাটে প্রতিদিন বারো রঙের মানুষ আসে। সবাই জানতে চায় তার গন্তব্যের দূরত্ব কতদূর।
কাশেম আলী দিনে সদরঘাটের ফুটপাতে র“টি-ভাজি-হালুয়া বিক্রি করে। এটাই তার আসল র“জি নয়। এটা হচ্ছে তার ফ্যাশন বা পোশাক। এখানে বসে সে প্রতিদিন হালুয়া-রুটি বিক্রি করে আর মানুষজনদের দেখে। সে মানুষদের দেখে বুঝতে পারে কার পকেটভারী, কারটা হাল্কা। সাথে সাথে অন্য সাথীদের কাছে সেই খবরটা পৌঁছে যায়। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি সবই তার দলের লোকেরা করে। এটাই তাদের আসল পেশা।
কাশেম আলী সরাসরি এসব করে না। সে শুধু খবরটা পৌঁছে দেয়। বিনিময়ে সে পায় দলের সম্মিলিত ধান্ধার কিছু অংশ। আর সে অংশটা মাঝে মাঝে অনেক বড়ো ধরনের হয়ে যায়।
এখন এই যে গণি মিয়া লোকটা তার সামনেই কোমরের খুট থেকে টাকা বের করলো সেটা সে গুণে ফেলেছে দ্রুত। গণি মিয়ার কোমরের খুট থেকে বেরিয়েছে অল্প কয়েকটি টাকা। সেই টাকা থেকে সে নাস্তার বিল মিটিয়েছে। বাকি টাকা তার কাছে কিছুই নয়।
কাশেম আলীরা এসব অল্প টাকা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারণ তাদের দলে লোকের সংখ্যা অনেক। ছোটখাটো চুরি, ছিনতাই তাদের পোষে না। একটা ধান্ধা করলে সবাই যেহেতু ভাগ পায় তাই তাদেরকে বড় বড় ধান্ধা কোরতে হয়।
কাশেম আলীকে ভাবতে দেখে গণি মিয়া আবারও প্রশ্ন করলো, ‘ভাইজান বিশ্ববিদ্যালয় কতো দূর?’
এবার বাস্তবে ফিরে এলো কাশেম আলী। সে হাতের তর্জনী উঁচিয়ে উত্তর দিলো, ‘বেশি দূর না। ওই তো সামনেই।’
রাস্তায় নামতেই একজন রিক্সাঅলা আগ্রহভরে জানতে চাইলো, ‘চাচা, কুনহানে যাইবেন? ওঠেন আমার রিকশায়।’
‘বাবা, ঢাহা বিশ্ববিদ্যালয় যামু। তুমি যাইবানি?’
রিকশাঅলা মৃদু হাসলো।
‘হাসছো ক্যান বাপজান? এইডা কি হাসার কথা অইলো?’ প্রশ্ন করে গণি মিয়া।
‘আপনে এই বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অইবেন? বয়স ত কম অইলো না!’
এবার গণি মিয়াও হাসলেন।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন, ‘হ, কথাডা ঠিক। আমার বয়স অইছে। তয় বিশ্ববিদ্যালয় আমি ভরতি অমু না। আমাগো পাশের বাড়ির এক ভাতিজা ইরফান। অয় পড়ে। হের লগে দেহা করতে যামু। যাইবানি তুমি?’
রাজি হয়ে গেলো রিকশাঅলা।
তারপর উত্তরে জানালো, ‘হ যামু। তয় ইরফান ভাই কোন্ হলে থাহে?’
‘হুনছি কারজন হলে থাহে। জায়গাডা চিনোনি তুমি?’
‘চিনি। আপনে ওডেন রিকশায়।’
গণি মিয়া আল্লাহ্-নবীর নাম নিয়ে রিকশায় ওঠলেন।
দু’জনের আলাপচারিতায় জানা গেলো- রিকশাঅলার নাম হামিদ বেপারী। পথ চলতে চলতে আরো জানা গেলো, তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। চার-পাঁচ বছর আগে ঢাকায় এসেছে কাজের সন্ধানে। কাজ-কর্ম জুতসই না পেয়ে ঢাকায় এখন রিকশা চালায়। গ্রামে স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধা মা আছে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। মাঝে মাঝে আবার গ্যারেজে রিকশা রেখে স্ত্রী-সন্তান ও মাকে দেখাশোনা করার জন্যে গ্রামের বাড়িতে যায় সে।
রিকশা চালিয়ে দৈনিক যা আয় করে তাতে তার ও পরিবারের সদস্যদের কোনোমতে দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে ঝড়-বৃষ্টি বা হরতাল হলে রিকশা চালাতে না পারলে ঢাকায় তার এক ব্যবসায়ী বন্ধু আলি মিয়ার কাছ থেকে টাকা-পয়সা ধার নেয়। আবার রুজি-রোজগার হলে সময়মতো টাকা ফেরত দিয়ে আসে।
গণি মিয়া রিকশায় যেতে যেতে রিকশাচালক হামিদ বেপারীর জীবনের নানা কথা শোনে।
গণি মিয়ার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর মহকুমার হাজীগঞ্জ এলাকায়। হামিদ বেপারীর বাড়ি কুমিল্লা জেলার কোর্টবাড়ি এলাকায়। পাশাপাশি জেলা ও মহকুমায় দু’জনের বাড়ি হওয়ায় উভয়ের মধ্যে ক্ষণিকের মধ্যেই একটা হৃদয়ের টান জন্ম নেয়।
চলতে চলতে হামিদ বেপারীও গণি মিয়ার সুখ-দুঃখের কথা শোনে মন দিয়ে। গণি মিয়ার কাছ থেকে জানতে পারে ঢাকায় কাজের সন্ধানে এসেছে। গ্রামে তারও পরিবার-পরিজন আছে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ, পরিবারের নৈমিত্তিক খরচের সঙ্কুলান না করতে পেরে সে শহরে এসেছে ইরফান নামক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর কাছে। গণি মিয়া তার সাথে দেখা করে একটা চাকরি-বাকরি বা কাজকর্মের জন্যে সাহায্য চাইবেন।
হামিদ বেপারীসহ কার্জন হলে গিয়ে গণি মিয়া ইরফান নামক যুবকটিকে খুঁজে পেলেন না। ইরফানের বন্ধুরা জানালো পরদিন ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাও আসতে পারে। তাই ইরফান বন্ধুদের নিয়ে ওই জনসভায় যোগদানের প্রাক-মিটিং করছে কোনো এক জায়গায়।
অনেক খুঁজেও গণি মিয়া যখন ইরফানকে খুঁজে পেলেন না, তখন রিকশাচালক হামিদ বেপারী বললেন, ‘ভাইজান! ঢাকা শহরে সবাই ব্যস্ত। কে কার খোঁজ-খবর নেয়। আপনে আমার গরিবখানায় বিশ্রাম করেন। আমি ঠিক সুময় ইরফান ভাইরে খুঁইজা আপনের লগে দেহা করাইয়া দিমু।’
‘ভাই, আপনে এতো কষ্ট কোরবেন?’ গণি মিয়া অবাক হয়।
পান খাওয়া লাল টকটকে দাঁতগুলো বের কোরে হাসে হামিদ বেপারী। তারপর বলে, ‘এইডা আর এতো কী কষ্ট ভাইজান! সারাদিন রোদে পুড়ি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলি। বৃষ্টিতে ভিইজ্জা ভিইজ্জা কাঁপতে কাঁপতে রিকশা চালাই। হেইডাই তো কষ্ট মোনে অয় না। আপনে আমার দ্যাশের এলাকার মানুষ। আপনের লাইগা যদি এট্টু-আধটু উপকার কোরতে পারি, তাইলে তো আল্লাহ্পাক খুশি অইবেন। আপনে চিন্তা কোরবেন না। আইজ রাইতের মইধ্যেই ওনার দেখা পাইবেন। লন, এখন আমার লগে।’
হামিদ বেপারী গণি মিয়ার হাত ধরে। গণি মিয়া আরো অবাক হয় তার কথায়। কিংবর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকে কতক্ষণ। বুঝতে পারে না কী করবে সে।
গণি মিয়ার দ্বিধা-দ্বদ্ব্ন বুঝতে পারে হামিদ বেপারী। টান মেরে জোর করে তার রিকশায় ওঠায় গণি মিয়াকে।
দুই.
একটা বন্ধ দরোজা-জানালাবিহীন ঘর। ঠিক দেখতে একটা গুদামের মতো, বেশ উঁচুতে টিনের চাল। ভেতরে কয়েকজন যুবক-যুবতী। মিটিং চলছে। একজন বক্তা। তার নাম ইরফান। সে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছে। তার সামনে বন্ধু-সহযোদ্ধারা নীরব-নিঃস্থব্ধভাবে দীপ্র-দীর্ঘ বক্তার কথা শুনছে।
ইরফানের চোখে-মুখে আগুনের ফুলকি। তার মুখ থেকে যে কথাগুলো বের হচ্ছে তা’ বন্ধুদের হৃদয়প্রচীরে আঘাত হানছে বজ্রের মতো। ইরফান বলে চলছে, ‘বন্ধুরা! আমাদের এই দেশটা ছিলো এককালে একটি মণিদ্বীপ। মণিদ্বীপ হচ্ছে মণিময় প্রদীপ- অতি মূল্যবান স্মরণযোগ্য বস্তু। আমাদের দেশের এই মণি-মুক্তোরূপী প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের জন্যে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, মগ জলদস্যুরা যেমোন এসেছে তেমনি এসেছে ইংরেজরা। আমাদের দেশের সম্পদে ইংল্যান্ডে গড়ে তোলে সুদৃশ্য অট্টালিকা। ওরা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লুট করে যখন দেশটা তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হলো তখনই তা দু’টি ডোমোনিয়ামের ভিত্তিতে ভাগ করে দিয়ে চলে যায়। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ- পূর্ব পাকিস্তান। দেশের জনগণ আশা করছিলো এবার তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। জনগণ পাবে পূর্ণ স্বাধীনতা। পাবে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার। কিন্তু না, জনগণের এ আশা পূর্ণ হলো না। শুরু হয় নব্য পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির পদচারণ। তবে এবার বিদেশী শক্তি নয়, এবার আমাদেরকে শোষণ করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র ছলে-বলে-কৌশলে শুরু করে নানা টালবাহানা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক- সবক্ষেত্রেই তারা আমাদের অধিকার হরণ করা শুরু করলো। তারা বায়ান্নে আঘাত হানলো ভাষার ওপর। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের রক্তদানে তারা সফল হলো না। ১৯৫৪ সালে ১০ মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কোরে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাঙালির এই বিজয় মেনে নেয়নি। ক্ষমতা দখলে রাখার এবং বাঙালিদেরকে শোষণ ও নির্যাতন করার হীন মানসে আড়াই মাসের মধ্যে ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। ১৯৫৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হলে বাঙালিদের মধ্যে বিপুল সাড়া দেখা দেয়। জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি, সুতরাং এই নির্বাচনের ফলাফল চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র শুরু কোরে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন তুলে নেয়া হলে শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ তাদের অধিকারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯ জুন ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা কোরে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ১৯৬৯ সালে পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলের ৬ দফা দাবি গণদাবীতে পরিণত হয়। বাঙালি একক জাতিসত্তার আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই গণ-আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ২০ জানুয়ারি ছাত্র আসাদুজ্জামান এবং ২৪ জানুয়ারি আমাদের ভাই স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান শহীদ হন। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন আরও পূর্ণমাত্রা লাভ করে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যুসংবাদ গণ-আন্দোলনে আরেকটি নতুন মাত্রা সংযোজন করে। প্রচণ্ড-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবর রহমানসহ অভিযুক্ত সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল গণ-সংবর্ধনায় শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছয় দফা ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে।’
একটু দম নিলো ইরফান। তারপর বলতে লাগলো, ‘প্রত্যাশা করেছিলাম এবার বাঙালিদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-নির্যাতন-নিপীড়নের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন হবে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ছলনার আশ্রয় নিয়ে শাসকগোষ্ঠী সে অধিকার দেয়নি। বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্যে মাওলানা ভাসানীসহ অনেক রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে এ দেশে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। রক্তদান করেছে আমাদের অসংখ্য ভাই-বোন। সেকথা তোমাদের জানা আছে। আজ বাঙালি জাতির ক্রান্তিলগ্নে আমরা আবারও ঐক্যবদ্ধ হোতে চাই। নিজেদেরকে দেশমাতার জন্যে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হোতে চাই। আমাদের অধিকার ফিরে পেতে চাই। সেজন্যে আগামীকাল রেসকোর্সে সমবেত হচ্ছি আমরা। নেতার নির্দেশনায় আমরা ওদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। প্রয়োজন হলে শেষ রক্তবিন্দুটি দিয়ে হলেও মা-জননীকে আমরা শত্রুমুক্ত করে ছাড়বো।’
ইরফানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে বন্ধুরা শুনছিলো। তাদের সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ইরফান, ‘তোমরা কি দেশের জন্যে যে কোনো মুহূর্তে জীবন দিতে প্রস্তুত?’
সবাই বজ্রমুষ্টি তুলে উচ্চস্বরে স্লোগান তুলে দেশের জন্যে নিজেদের প্রাণ বিলানোর দীপ্ত শপথ করলো।
ইরফান নির্দেশ দেয়, ‘আগামীকাল বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। আমি জানতে পেরেছি, তিনি ওই সমাবেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা নাও দেন তবে কৌশলগত কারণে তাঁর ওই ভাষণের মধ্যেই থাকবে স্বাধীনতার উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর। তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও ওই জনসভাকে সফল করার জন্যে। আমরা ওই জনসভায় যোগদান করে আমাদেরকে ইতিহাসের পাতায় লিখে যেতে চাই।’
ইরফান কথা শেষ করে আরো কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করলো বন্ধু-সহযোদ্ধাদের। মিটিং শেষ করে একে একে সবাই বাইরে এলো। হঠাৎ করেই ইরফানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো অদূরে দাঁড়ানো এক নারীকে দেখে।
বেশ দূরেই দাঁড়ানো ছিলো সে নারী। হঠাৎ করেই ছুটে এলো ইরফানের কাছে। তারপর তাকিয়ে থাকলো তার দৃষ্টিসীমানায়।
‘কী হয়েছে অপর্ণা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে নারীর কাছে জানতে চাইলো ইরফান।
‘শুনেছি তুমি কাল বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগদান করতে যাচ্ছো।’ অপর্ণা জিজ্ঞেস কোরে।
‘অবশ্যই।’
‘আমিও যাবো।’ বায়না ধরে সে।
‘দেখো অপর্ণা, ওই জনসভায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হবে। ভিড়ের মধ্যে কী হয় না হয়। তাছাড়া পুলিশ কখন টিয়ার শেল ছোঁড়ে, গুলি কোরে তার ইয়ত্তা নেই। একজন নারী হোয়ে তোমার ওখানে যাবার প্রয়োজন আছে কি?’
‘এসব কী বলছো তুমি? আমি জানতে পেরেছি ওই জনসভায় কয়েক হাজার নারী যোগদান করবেন। আমিও তাঁদের একজন হোতে চাই।’
অপর্ণা ইরফানের কোনো কথাই শুনলো না। তার বাঁধভাঙ্গা দেশপ্রেমের অদম্য জোয়ারে ইরফানের মনের কঠিন বরফ গলতে শুর“ করলো। অবশেষে ইরফান রাজি হলো অপর্ণাকে জনসভায় তাদের সঙ্গী কোরতে।
তিন.
রিকশাচালক হামিদ বেপারীর টিনের ভাঙ্গা ঘরে শুয়ে আছে গণি মিয়া। শুয়ে শুয়ে ভাবছে নানা কথা। এমন সময় হামিদ বেপারী এলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো গণি মিয়া। তারপর হামিদ বেপারীকে প্রশ্ন কোরলো, ‘ইরফানরে খুঁইজা পাইছো?’
‘না চাচা। পাই নাই। তয়, হুনছি আগামীকাইল ইরফান ভাই ও তার বন্ধুরা বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগদান কোরবো। আমারও কালকে রিকশা নিয়া যাওন অইবো না। চিন্তা করছি, আপনেরে লইয়া অই জনসভায় যামু। ইরফান ভাইরেও খোঁজা অইবো, আর বঙ্গবন্ধুরও ভাষণডাও শুনা অইবো।’
‘তুমি কি বঙ্গবন্ধুরে খুউব পছন্দ করো?’
‘ক্যান করুম না। লোকটা তো অন্যায় কিছুই কয় না। ক’দিন পর পর দ্যাশের লাইগা, দ্যাশের মানুষের অধিকার আদায়ের লাইগা কথা কইতে গিয়া গেরেফতার অয়, জেলে যায়। অই মানুষের চেহারাডা দেখলেও মনডা শান্তি অয়। আহা! কি সোন্দর চেহারা, কি শান্তির কথা কয় মানুষটা।’
‘হ, বুঝছি। তুমি বঙ্গবন্ধুর দেওয়ানা-আশিক মানুষ। কিন্তু অইযে মানুষেরা কয়, মুসলিম লীগ নাকি ইসলামের দল, আর আওয়ামী লীগ নাকি ভারতের হিন্দুগো দল। হেইডা কি বুঝায়া কইবার পারো?’
‘আরে চাচা মিয়া, আপনেরা আগের কালের মানুষ। হের লাইগা আগের যুগেই রইয়া গেলেন। কে আসল আর কে নকল, কারা আল্লাহ্-নবীজীর নাম বেইচা ব্যবসা করে, হেইডা তো অহনও বুঝবার পারলেন না। তয় একখান কথা, আমি কিন্তু দিব্যচোখে অনেক কিছু দেখবার পারি।’
‘হেইডা কী?’
‘আমি জানি, মুজিবই এই দ্যাশের মানুষের আসল বন্ধু। এই মুজিব ভাঙবো, তয় মচকাইবো না। জান দিবো, তয় আপোষ করবো না। হেইদিন পরমান অইবো, কারা আসল আর কারা নকল- বর্ণচোরা।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গণি মিয়া। তারপর বললেন, ‘কি জানি মিয়া। হুনছি মুজিব এই দেশের শত্রু। আর যারা মুসলিম লীগ করে, উর্দু ভাষায় কথা কইতে চায়, হেরা আমাগো বন্ধু। অহন তুমি হুনাইলা মুজিবই নাকি আমাগো বাঙালির বন্ধু। তয় তোমার মুখে এইসব কথা হুইনা অই মুজিব ভাইরে একটু দেখবার মোন চাইতাছে। ওনার কথা হুনবার লাইগা মোন চাইতাছে। হুনছি কাইল নাকি উনি ভাষণ দিবেন।’
‘হ, ঠিক কইছেন চাচাজান। চলেন আমরা ওইখানেই যাই। বঙ্গবন্ধুর কথা হুনাও অইবো, আর এদিগে ইরফান ভাইরেও খোঁজা অইবো।’
গণি মিয়া ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালেন। খুশিতে মনটা ভরে ওঠে রিকশাচালক হামিদ বেপারীর।
চার.
সাত মার্চ, ঊনিশশো একাত্তর।
রেসকোর্স ময়দানে লোকে লোকারণ্য। মানুষের মাথা গোণা ভার। কিছুক্ষণ পর পর জনতা শ্লোগান তুলছে, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ। এ সমাবেশে নারী-পুরুষ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কোনো জাত-পাত নেই। লোকেরা এসেছে আজ এক মহামানবের মুখ থেকে নিঃসৃত শান্তির বাণী শ্রবণ করার জন্যে।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায়-জুলুম, নির্যাতনে পুরো জাতি অতিষ্ঠ। তাই তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শোনার জন্যে। বঙ্গবন্ধু আজ দিক নির্দেশনা দেবেন- জাতি তাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে জাতির এক মুক্তিদূতের বাণী শোনার অপেক্ষায়।
ইরফান বন্ধুদের নিয়ে সকাল থেকে রেসকোর্সে অবস্থান করছে। মঞ্চসহ নানাবিধ তদারকির কাজ অপর্ণাসহ তারা সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই মানুষের ঢল নেমেছে ময়দানে। তখন ময়দানটিতে মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
মঞ্চের পূর্ব দিকের কোণে ইরফান তার বন্ধুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায়। এইমাত্র খবর এসেছে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসছেন। লোকজনের ছুটাছুটি শুরু হয়েছে। সবাই শশব্যস্থ।
গণি মিয়া রিকশাচালক হামিদ বেপারীকে নিয়ে এসেছে জনসভায়। পূর্বদিনে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ইরফানের দেখা মিলেনি। তাই হামিদ বেপারীর সঙ্গে কথা বলে ইরফানের খোঁজে আজ এই জনসভায় যোগদান কোরেছে।
হামিদ বেপারী জানিয়েছে ইরফান যেহেতু ছাত্র রাজনীতির প্রথম সারির লোক, তাকে মঞ্চের ধারে-কাছেই পাওয়া যেতে পারে। তাই হামিদ বেপারী গণি মিয়াকে নিয়ে লাখ জনতার ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে মঞ্চের কাছাকাছি চলে এলো।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরই হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেলো ইরফানের সাথে। ব্যস্ততার জন্যে ইরফান গণি মিয়াকে দেখে প্রথম চিনতে পারেনি। পরে যখন বুঝতে পারলো লোকটি গণি মিয়া তখন ঝাঁপটে ধরে কোলাকুলি কোরলো তার সাথে।
এমন সময়ই একজন খবর দিলো, বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসছেন। লাখ লাখ জনতা শ্লোগান ধরলো, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ আকাশে-বাতাসে তার প্রতিধ্বনি হলো।
ভিড়ের মধ্যে মুখটা গণি মিয়ার কানের কাছে এনে ইরফান বললো, ‘চাচা তুমি আশেপাশেই থেকো। আমি আসছি।’
ইরফান মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করে তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। অপর্ণাসহ তার বন্ধুরাও ইরফানের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো।
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে। জনতা এখন শান্ত। শুধু ফিসফাস- ‘এই, এই চুপ। বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন।’
হঠাৎ করে আকাশ-বাতাস চিরে বজ্রকন্ঠে ধ্বনিত হলো- ‘ভাইয়েরা আমার ...।’
জনতা পুরোপুরি স্তব্ধ, ফিসফাস, গুঞ্জন বন্ধ। যেনো আসমান ভেদ করে এক পশলা বিদ্যুৎচমক পৃথিবীর বুকে ঝলসে উঠছে।
‘আজ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি ....।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কথা নয় যেনো আবৃত্তি শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু।
জনতা উদগ্রীব শোনার জন্যে। বঙ্গবন্ধু আজ একটা গল্প বলবেন। সেই গল্পটি হবে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের জিঞ্জির হতে বাঙালি জাতির ঘোর অমানিশার মুক্তির গল্প। লাখ লাখ মানুষের মাঝে গণি মিয়াও একজন উৎসাহী শ্রোতার মতো কান পেতে আছে জাতির সেই মুক্তির গল্প শোনার জন্যে।
এতো মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকেও গণি মিয়া বঙ্গবন্ধুর পুরো কথাগুলো শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। যখন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...” তখন গণি মিয়া বুঝতে পারলেন সময় অত্যাসন্ন।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই যা বলার বলে ফেলেছেন। আর রাখ-ঢাক করেননি। গণি মিয়ার মনে আশঙ্কা জাগলো বর্বর পাকিস্তানী আর্মি হয়তো এই মানুষটিকে আর বেশিদিন জীবিত রাখবে না। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্যে যারাই যুগে যুগে সত্য উচ্চারণ করেছে, তাদেরকেই মরতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে কি তার ব্যতিক্রম হবে?
ভাষণের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানালেন। এরপর শুরু হলো সর্বাত্মক অসহযোগ।
পাঁচ.
গণি মিয়া ও হামিদ বেপারীকে নিয়ে একটা হোটেলে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলো ইরফান। হাতমুখ ধুয়ে গণি মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ইরফান তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে চাচাজান। এতো বড় নিঃশ্বাস ফেললেন যে!’
এবার ঈষৎ হাসলেন গণি মিয়া। তারপর প্রসন্নচিত্তে বললেন, ‘অনেক দিন পর গরুর গোশত দিয়া ভাত খাইলাম ভাতিজা।’
হাসলেন ইরফান। ‘চাচা, তুমি ঢাকায় কেনো এসেছো, তা-তো বললেন না। হঠাৎ করে এই উন্মাতাল সময়ে তুমি ঢাকায় কেনো? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
গণি মিয়া ঢাকায় আসার সুখ-দুঃখের কাহিনী খুলে বলে ইরফানের কাছে।
ইরফান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘চাচা। জানি তুমি খুব সমস্যায় আছো। আমি তোমার সমস্যা উপলব্ধি করি। কিন্তু এ মুহূর্তে পুরো দেশটাতেই সমস্যার পাহাড়। আমাদের দেশের গরিবরা কোনোদিনও সুখের মুখ দেখবে কি-না সেটা আল্লাহ্ই ভালো জানেন। তবে তোমাকে একটা কথা বলি, যতদিন পাকিস্তানী অথর্ব শাসক-শোষক গোষ্ঠী আমাদের জাতির ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে থাকবে, এদেশের অর্থ-কড়ি লুট করে এদেশের মানুষকে গোলামীর জিঞ্জির পরিয়ে রাখবে, ততদিন আমার মতো সংগ্রামী ইরফান আর তোমার মতো গণি মিয়াদের সংসারের টানাটানি চলতেই থাকবে।’
কথা বললো হামিদ বেপারী, ‘হ ভাইজান। ঠিকই কইছেন। একদম ঠিক কথা। এই পশ্চিম পাকিস্তানী হারামজাদারা আমাগোরে ভীতু বাঙালি বানাইয়া নিজেরা রাজ সিংহাসনে বইসা আমাগো দ্যাশের ট্যাকা দিয়া আরাম-আয়েশ করে আর পশ্চিম পাকিস্তানে কল-কারখানা বানায়। আমাগো দ্যাশে কোনো কল-কারখানা নাই। মানুষের কাম-কাইজ নাই। মানুষ বেকার হইয়া রাস্তাঘাটে ঘুরে। এর চাইতে তো ব্রিটিশের রাজত্বই ভালা ছিলো। ওরা দুই জাতি তত্ত্ব গিলাইয়া আমাগোরে কী দিছে? মানুষের কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ করবার পারেই না। অথচ পূর্ব বাংলার মানুষগোরে গোলাম বানাইয়া রাখবার চায়। হের লাইগা আমাগো অহন গা ঝাড়া দিয়া উঠবার সময় অইছে।’
ইরফান হামিদ বেপারীর কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বলতে লাগলো, ‘চাচা, হামিদ বেপারী খুব সুন্দর কথাই বলছে। আমাদের এখন সময় হয়েছে ...।’
‘কী?’ প্রশ্ন করলো গণি মিয়া।
‘ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, সুখ-দুঃখ না ভেবে পুরো জাতির সুখ-দুঃখের কথা ভাবনা।’
গণি মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইরফান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দীর্ঘশ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস। যেদিন মীরজাফরদের হাতে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার পতন ঘটলো সেদিন বাংলার স্বাধীন নবাব পরাধীনতায় বন্দী হয়ে তাঁর প্রথম দীর্ঘশ্বাসটি ছেড়েছিলেন। সেই দীর্ঘশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়ে বাংলার আকাশে শুরু হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মেলা। যা আজও চলমান আছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন অশক্তির ওপর ভর করে। বাংলার মাটি হতে এই অপশক্তিকে তাড়াতে হবে। দূর করতে হবে বাংলার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাসের অপচ্ছায়া। তা না হলে এ জাতির ভাগ্য কোনোদিন সুপ্রসন্ন হবে না।’
গণি মিয়া অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলেন ইরফানের প্রতি। মনে পড়ে এই ইরফান বাল্যকালে তার বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলে যেতো। তাদের বাড়ির পাশে ছিলো প্রকাণ্ড একটি আমগাছ। ইরফান ঢিল ছুঁড়ে সে আম পেড়ে খেতো। সেজন্যে গণি মিয়া মাঝে মাঝে তাকে বকুনি দিতেন। বলতেন, ‘ভাতিজা আমারে কইলেই তো আমি তোমারে আম পাইড়া দিতে পারি। তুমি অকারণ কষ্ট কইরা ঢিল ছুইড়া আম খাইতে চাও কেনো?’
ইরফান জবাবে বলতো, ‘চাচা, নিজের মর্জিমাফিক চলাফেরার স্বাদই আলাদা। অন্যের ওপর ভর করে আমি কিছু করতে চাই না। তুমি আম দেবে, আর আমি আম খাবো, সেই আশায় কতক্ষণ বসে থাকবো। আম খেতে মনে চেয়েছে, আমি আমার ইচ্ছেমতো খাবো। যদি তোমার সমস্যা হয় বলো। তাহলো আর কোনোদিন আম খাবো না।’
গণি মিয়া ইরফানকে কখনো ‘না’ করেননি। বলেছেন, ‘ভাতিজা এটা কি কও। তোমাদের বাপ-দাদাদের কতো নিমক খেয়েছি। সেগুলোর ঋণই তো কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। তুমি আর কয়টা আমই আর খাবো। ঠিক আছে তোমার যখন খুশি, যেভাবে খুশি আম পেড়ে খাবে। আমি তোমাকে বাধা দেবো না।’
গণি মিয়া ভাবলেন, ইরফান বাল্যকাল থেকেই স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। তার স্বাধীনতায় সেজন্যে গ্রামের কেউ কোনোদিন হস্তক্ষেপ করেনি। আর ইরফানও স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে কারো অধিকার খর্ব করেনি।
গণি মিয়া বুঝতে পারেন কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে প্রাপ্ত প্রতিভা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তার মধ্যে তিনি দেখেছেন বাংলার এক সুযোগ্য নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অনুসারী ইরফান। এরা হয়তো জন্মেছেনই পরের জন্যে নিজেদের বিলিয়ে দেবার জন্যে। দেশের আপামর মানুষের সুখ-দুঃখের কথা ভাবার জন্যে। নিজেদের কথা ভাবনার সময় এঁদের খুব কম।
গণি মিয়ার ভাবনায় বাধা পড়লো। ইরফান প্রশ্ন করলো, ‘চাচা তোমার ছেলে-সন্তানরা পড়ালেখা করছো তো?’
‘হ্যাঁ, করছে।’ উত্তর দিলো গণি মিয়া।
‘চাচা, যদি দেশে কখনো মুক্তিযুদ্ধ শুর“ হয়, তাহলে তুমি কী করবে?’
‘জানি না।’ উদাস উত্তর গণি মিয়ার।
এবার ইরফান হামিদ বেপারীর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। হামিদ বেপারীর চোখে দৃঢ় প্রত্যয় দেখতে পেলো সে। চোখ দুটো জ্বলছে, যেনো মনে মনে সে শপথ নিচ্ছে, বাংলা থেকে নেমকহারাম পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ ও অত্যাচারের নানা মাত্রা থেকে পূর্ব বাংলার মানুষকে যে কোনো মূল্যেই হোক রক্ষা করতে হবে।
( প্রত্যয়ের এ গল্প চলমান। এ ধারা চলতে পারে যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ....)