এক (ভাবছি নিরালায়) :
চিরদীপ্ত সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে যে মেঘমালা দিনের আলোকে অন্ধকারের বুকে ঢেকে দেয়; সে মেঘমালা আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীর মাটির উর্বরতা বাড়ায়। বৃক্ষরাজিকে সতেজ করে আর মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা চিরবিষাদকে করে প্রাণবন্ত। আবার কখনো এ মেঘমালা অবিরত বর্ষণে পথ-ঘাট করে কর্দমাক্ত, খাল-বিল, নদীকে ভরিয়ে বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ ও মানুষের বাঁচার সব উপকরণ। একই জিনিসের কতো রূপ-বৈচিত্র্য প্রকাশ! বৃষ্টির ফলে যেমন মানুষের ভালোও হয়, আবার মন্দও হয়।
বর্ষার এক বৃষ্টিমুখর দিনে জীবনের সব লেনদেন ফেলে রেখে এসব বিষয় নিয়েই ভাবছি বসে নিরালায়। বাতায়ন খুলে রেখেছিলাম; ঝিরঝির বাতাস বইছে। সে বাতাস আমার শরীর-রন্দ্রে মৃদু শিহরণ তুলছে। আজ কেনো যেনো গান শুনতে বেশ মন চাইছে। কম্পিউটার ওপেন করলাম। একটি অডিও সিডি প্লে করলাম। সিডিটির নাম 'অভিপ্রায়'। সুরের মুচ্র্ছনা নিয়ে কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো গানটি-
"কতটা দুঃখ দিলে দেখে যাও একবার
এ মনটা কাঁদে কেনো তোমার জন্যে বারেবার?
হয়তো ভেঙ্গে যাবো কোনো শ্রাবণের ঝড় এলে
দুঃখ পাখি হয়ে উড়ে যাবো আকাশে
তবু তুমি পড়বে মনে আমার প্রতি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে....।"
সংগীতের অনর্্তকথায় মন উদাস হওয়া গানটি তন্ময় হয়ে শুনছি, আর ভাবছি পুরোনো দিনের স্মৃতি হয়ে জমে থাকা কথাগুলো। এই গানটির সাথে যেনো কেমন করে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কিছু খণ্ড-দৃশ্যের মিল খুঁজে পাই। এসব দৃশ্য ভাবতে ভাবতে দু'চোখের কোণে জমা হলো অশ্রুবিন্দু। সেগুলো ক্রমে ক্রমে বড় হতে হতে টুপ্ করে পড়লো গালে, এরপর গাল বেয়ে নিচে।
আমি অশ্রুবিন্দুগুলো রুখতে চাইনি। কারণ, জীবনের পুরোনো স্মৃতিগুলো যখোন ভেসে ওঠে মানসপটে তখন এমনই হয়। তবে আজ গানটি শুনে আরো বেশি করে অশ্রুপাত হচ্ছে। হতে থাকুক, কি অদ্ভুত ভালো লাগে অশ্রুবিসর্জনে! তা' অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানে না। মানুষের জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন কান্নায় অদ্ভুত আনন্দ মেলে।
হঠাৎ করেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কেনো আমি এতো আবেগপ্রবণ? কেনো আমি আজও অন্তলীন স্মৃতিবিজড়িত অসম্পূর্ণ ভালোবাসাকে মনে রেখেছি এতোকাল ধরে? সে তো ঠকিয়ে- প্রতারিত করে দূরে ঠেলে দিয়ে চলে গেছে আমার অজান্তে; একা করে। ভেঙ্গে দিয়ে গেছে সব ঠিকানা, আশ্রয়স্থল, প্রেম-ভালোবাসা, হৃদয়ের আকুতি- সবকিছু। তবুও কেনো তার কথা মনে করে আজও বরষার এই শুভলগ্নে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি?
আমি যুক্তি দিয়ে মনে মনে উপলব্ধি করলাম, তাকে চরম ঘৃণা করি। আর ঘৃণা করি বলে তা' প্রকাশ করতে না পেরেই কাঁদছি। আমার কান্না উসকে দিয়েছে ওই গানটি। পুশ বাটনে ক্লিক করে গানটি পুশ করে রাখলাম। না! এ গান শোনবো না। কম্পিউটার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। চিৎকার করে বলতে লাগলাম, 'তোমাকে ঘৃণা করি, তোমাকে ঘৃণা...'। আর বলতে পারলাম না। সামনে যাকে দেখলাম তাকে দেখে আমি যেনো ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে গেলাম। লোকটি আমার প্রিয় বন্ধু অনির্বাণ ময়ূখ।
দুই. (গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে)
অনির্বাণ বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি বললাম, 'অনির্বাণ আমি কি কিছু বলেছিলাম?
'হঁ্যা'। উত্তর দিলো সে।
'কী বলছিলাম?'
'তুই কাকে যেনো ঘৃণা করিস।'
'কাকে করি জানিস?'
'আমাকে?' নিজের বুকে হাত রেখে বললো অনির্বাণ।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, 'শালা! তোকে ঘৃণা করতে যাবো কেনো রে? তুই তো আমার পরাণের শালা। শালাদের কেউ ঘৃণা করে না, বুঝলি?'
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো অনির্বাণ। প্রশ্ন করলো, 'তুষার! তুই কি এখনো তাকে ভালোবাসিস?'
'কাকে?'
'সীমানাকে?'
'সে তো এখন চাঁদের চেয়েও বেশি দূরত্বে অবস্থান করছে রে শালা। পরস্ত্রী হয়ে সুখে আছে। তুই কি ভাবছিস এখনো আমি তাকে ভালোবাসি? চরম ঘৃণা করি তাকে? সামনে পেলে...।
'কিছুই করতে পারবি না...' কথা কেড়ে নিলো সে। 'এখন সে পরস্ত্রী।'
আমার সংলাপ ওর মুখে শুনে এতো কষ্টেও হাসি পেলো। আমি বললাম, 'অনির্বাণ! এদেশে আমি আর থাকবো না। আমার ইচ্ছে, তোকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়বো দেশ থেকে দেশান্তরে, পৃথিবীময় প্রকৃতির বিচিত্র অপার সৌন্দর্য অবলোকনের জন্যে। আমি সব দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে যেতে চাই।'
'প্রকৃতির বিচিত্র লীলাখেলা যদি দেখতে চাও তাহলে তোমাকে আর পৃথিবী ঘুরতে হবে না।' বলতে লাগলো অনির্বাণ, 'প্রকৃতির অপূর্ব রহস্যময় সৌন্দর্য্য বিরাজ করছে আমাদেরই গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে। তবে তুমি বেশি মোহনীয় ও সম্মোহিত হবে সিলেটের জাফলং গেলে।'
'কী আছে সেখানে?' আমি প্রশ্ন করলাম।
'কবি-সাহিত্যক বা ভাবুকদের জন্যে রয়েছে জাফলংয়ে অশেষ সাহিত্য-বিনোদনের উপাদান। যেখানে গেলে তোমার শুধু লিখতে, আনন্দ উপভোগ করতেই মনে চাইবে। ফিরে আসতে মনে চাইবে না।'
'সত্যি নাকি?
'তুই কি গিয়েছিস?'
'না। তবে কিছুদিন আগে চাঁদপুরের একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেব তাঁর অধ্যাপক বন্ধুসহ সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি জাফলং সম্পর্কে ফিচার লিখেছেন, তাতে জাফলং, শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি।' বললো অনির্বাণ।
'তাহলে তো যেতেই হয় সেখানে। ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে লেখালেখি উঠছে শিকেয়। মনে কোনো প্রকার সাহিত্য উপাদান আসছে না। কিন্তু আমাকে তো লিখতেই হবে। না লিখলে যে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমি পাগল হয়ে যাবো।'
'তাহলে চল, জাফলং যাই।' অনির্বাণ উৎসাহিত হলো।
তিন. (গ্রাম বাংলার রূপ ও একটি মেয়ে)
হঁ্যা, অনির্বাণের কথাই ঠিক। আমি এখানে এসে যেনো পাগল হয়ে গেলাম। কী নেই এখানে! লেখার অনুষঙ্গ-উপকরণ সবই আছে।
আমার গ্রামবাংলার বিচিত্র রূপ আমি এখানেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। শহরে জন্মগ্রহণ, সেখানেই বসবাস। সারাজীবন শহরেই কেটেছে। গ্রামে তেমন একটা যাওয়া হয়নি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে বাসে বা ট্রেনে যেটুকু গ্রাম-বাংলার দৃশ্য দেখতাম- ব্যাস। কিন্তু এভাবে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে কখনোই দেখা হয়নি আমার।
এখানে এসে দেখলাম কতো সুন্দর সুন্দর গাছপালা, জঙ্গল, জীবন্ত পাথর; এছাড়াও রয়েছে প্রকৃতির সৃষ্ট অ্যাকুরিয়াম। পিয়াইন নদীতে জোয়ারের সময় যখন পানি অনেক ওপরে ওঠে, তখন কিছু কিছু গর্তের মতো জায়গা নির্মল পানিতে ভরে যায়। ভাটার টানে যখন পানি নেমে যায়, সেই গর্ত-মতো জায়গায় স্বচ্ছ স্ফটিক পানিতে বিচিত্র মাছেদের দেখা মেলে। লাল, নীল, হলুদ রংয়ের ছোট ছোট মাছ পানির নিচে ঘুরে বেড়ায়।
আমি কবিতা লিখতে বসে গেলাম। কয়েকটি কবিতা রচনার পর মনে হলো, একটি গল্প লিখবো। কিন্তু কী লিখবো? মাছেদের নিয়ে গল্প মাথায় আসছে না। অনির্বাণকে জানালাম কথাটা। সে বললো, 'একটু সবুর কর। সামনে কয়েকটি পিকনিক স্পট আছে। সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে বিচিত্র মানুষেরা আসে। হয়তো সেখানে গেলে তোর গল্প লেখার উপকরণ মিলে যেতে পারে।'
অনির্বাণ যেনো জ্যোতিষ মানুষ। কী করে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো? পিকনিক স্পটে হাজারো মানুষের সমাহার। আমরা ঘুরে ফিরে সেখানে আসামাত্রই দেখা মিলে গেলো বিচিত্র খেয়ালের এক মানবীর সাথে। তার সাথে একটি সাদা কুকুর। সে কুকুরটির সাথে কি বিচিত্রভাবে খেলছে! একটা ছোট ফুটবল ছুঁড়ে মারছে কুকুরটির কাছে, কুকুরটি হেড করছে, ড্রিবলিং করে ছুঁড়ে মারছে। আমি অবাক হলাম।
চার (জেনিফার ও লোপাজ) :
ওদের খেলা শেষ হলে কাছে গেলাম। অপরিচিত মেয়েটি অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
'তোমার নাম?' আমি প্রশ্ন করলাম।
'জেনিফার।' সহাস্যে উত্তর দিলো মেয়েটি।
জেনিফারের সাথে পরিচিত হলাম। তাকে বললাম, 'কুকুরটি কি তোমার?'
জেনিফার যেনো কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। সে বললো, 'একে কুকুর বলবে না। ওর নাম লোপাজ, লোপাজ নামে ডাকবে। কুকুর বললে সে ক্ষেপে যাবে।'
'দুঃখিত।' আমি বিনয়ের অবতার হলাম যেনো। 'লোপাজ কি তোমার খুব প্রিয়?' প্রশ্ন করলাম।
'হঁ্যা, আমার খুব প্রিয় লোপাজ। ওকে ছাড়া একদণ্ড থাকতে পারি না। দিন-রাত চবি্বশ ঘণ্টা সে আমার পাশে থাকে। আমাকে মায়ের মতোই আদর করে।'
'মায়ের মতো!' ভ্যাবচ্যাকা খেলাম আমি। বলে কী মেয়েটা? 'তুমি কোন্ দেশ থেকে এসেছো?'
'বৃটেন। আমার বাবা বাংলাদেশী, মা ব্রিটিশ।' উত্তর দিলো সে। 'ঢাকার গুলশানে থাকি।'
'এখানে একাই এসেছো?'
'হঁ্যা, লোপাজকে নিয়ে আমি একাই এসেছি। সাথে গাড়ির ড্রাইভার ইলিয়াছ মিয়া আছে। দু'দিন থাকবো, তারপর চলে যাবো ঢাকায়।'
পাঁচ (রহস্যে ভরা জীবন) :
ভাবছি এই কুকুরটি নিয়ে কী গল্প লেখা যাবে? কি সুন্দর কুকুর। নাদুস-নুদুস, যেন কুকুর নয়, মানুষের মতোই হেলেদুলে চলছে, খেলছে, দৌড়াচ্ছে। আবার জেনিফারের কোলে উঠে আদর করছে জেনিফারকে।
হঠাৎ একটি ঘটনায় অবাক হয়ে গেলাম। মাথায় যেনো বজ্রাঘাত হলো, আমি কি ভুল শুনলাম? চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম পাশে কোনো শিশু ছেলেমেয়ে নেই। অথচ আমার কানে শুনলাম একটি শিশুর কণ্ঠ- 'মাম্মি'।
চারদিকে তাকাচ্ছি। অনির্বাণ বললো, 'কিরে এমন করে চোরা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিস কেনো?'
'আশেপাশে কোনো শিশু আছে?' আমি অনির্বাণকে প্রশ্ন করলাম।
'না। কেনো?' আশ্চর্য হলো সে।
'মাম্মি ডাকলো কে?'
'তুই পাগল হয়ে গেছিস, কে ডাকবে? আমি, তুই, জেনিফার ছাড়া তো শুধু কুকুরটিই আছে। কে ডাকবে মাম্মি?'
এমন সময় উঠে বসলো জেনিফার। সে তাড়াতাড়ি তার কুকুর নিয়ে চলে গেলো। বললাম, 'দাঁড়াও জেনিফার তোমার সাথে কথা আছে।'
জেনিফার কোনো কথা বললো না। দ্রুত কুকুরটি নিয়ে চলে গেলো।
আমি অনির্বাণকে নিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে জেনিফারের পিছু নিলাম। অনেক ঘুরেফিরে জেনিফার তার কুকুর লোপাজকে নিয়ে একটা রেস্ট হাউসে গিয়ে পৌঁছলো। আমরা ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, জেনিফার কুকুরটিকে তার বিছানার উপর শোয়ালো। এরপর একটি দুধ খাবার ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়াতে লাগলো। কুকুরটি লেজ নাড়ছে আর চুক চুক করে দুধ পান করছে। স্বাভাবিক দৃশ্য, কিন্তু আমার কেনো যেনো ব্যাপারটি একটু অস্বাভাবিক লাগছে। অনির্বাণকে ব্যাপারটি বলতেই সে হেসে উড়িয়ে দিলো। আমাকে জোর করে সেখান থেকে নিয়ে এলো।
ছয়. (রহস্য উন্মোচন)
রাত প্রায় আটটা হবে। আমার ঘুম আসছে না। কেনো যেনো কুকুরকে ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। এছাড়া কুকুরটির মুখে 'মাম্মি' ডাক শুনতে পেয়েছি। ব্যাপারটা কী? একটা কুকুর কি মানুষের মতো কথা বলতে পারে?
শয্যা ত্যাগ করে জেনিফারের রুমের পাশে উঁকি মেরে ভেতরে নজর দিলাম। আশ্চর্য! জেনিফার নেই, কুকুরটি বিছানায় ঘুমুচ্ছে। রুমের দিক হতে ঘাড় ফিরাতেই দেখলাম, জেনিফার আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বললাম, 'জেনিফার কেমন আছো?'
'ভালো। কিন্তু চোরের মতো এমন করে কী দেখছো?' প্রশ্ন করলো জেনিফার কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমাকে নিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো।
কুকুরটি ঘুমুচ্ছে, জেনিফার আমাকে বললো, 'তোমার নামটি কী জানতে পারি?'
'তুষার আহমেদ।' আমি জানালাম।
'নামটি খুব ভালো লাগলো। নামটির মাঝে কেমন যেনো কোমলতা ও মমতা জড়িয়ে আছে।'
সাত. (পিয়াইন নদীর পাড়ে জেনিফার ও আমি)
পিয়াইন নদীর পাড়ে পাথরের ওপর বসে আছি আমি এবং জেনিফার। নদীতে স্বচ্ছ জল। পানি নয়; যেনো এক টুকরো গ্লাস। নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। জেনিফার আমাকে বললো, 'তুষার তুমি মনে হয় লোপাজের ব্যাপারে জানতে খুব আগ্রহী, তাই না?
'হঁ্যা। কুকুরটির মুখে আমি মাম্মি ডাক শুনতে পেয়েছি?'
'লোপাজকে আমি নিজেই মাম্মি ডাক শিখিয়েছি।'
'কুকুর কি কখনো মানুষের মতো কথা বলতে পারে? আমার জানামতে তোতা পাখি তা' পারে।'
'এটা কুকুর নয়?' জেনিফার স্বচ্ছ জলে একটি ঢিল ছুঁড়ে বললো।
'মানে?' আমি জেনিফারের ছোঁড়া ঢিলের প্রতিক্রিয়ায় পানির ঢেউয়ের দিকে লক্ষ্য করে বললাম।
'লোপাজ আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। আমাকে কয়েকবার বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে? একবার আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, লোপাজ মোবাইলের বাটন টিপে পুলিশে খবর দিয়েছিলো। একবার আমাকে কয়েকটি বদমাস কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলো, লোপাজ কামড়ে সবক'টাকে রক্তাক্ত করে দিয়ে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিলো। এছাড়া লোপাজ আমার প্রত্যাহিক সব কাজে সহায়তা করে, তাই ওকে আমি কুকুর হিসাবে ভাবি না, এটি মানুষের চেয়েও বিশ্বস্ত বন্ধু। একজন মানুষ আরেক মানুষকে আঘাত দেয়, কষ্ট দেয়, প্রতারণা করে। কিন্তু এই কুকুরটির মধ্যে তা' নেই।'
'তুমি কী কারো কাছ থেকে আঘাত পেয়েছো?' স্বচ্ছ জলে জেনিফারের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
'নাহ্।' উদাসীনভাবে দূরে পাথর উত্তোলনকারী পরিশ্রান্ত মানুষদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো জেনিফার।
'তবে?'
'এক স্ফটিক নদীকে ভালোবেসেছিলাম; নদীর জল আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছিলো।' রহস্যময়ভাবে জবাব দিলো সে।
আট. (নদীর নাম পিয়াইন)
আমি জেনিফারের কথায় হাসলাম। বললাম, 'সে নদীর নাম কী?'
'নদীর নাম পিয়াইন।' উত্তর দিলো জেনিফার।
'আর কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় না?' আমি আরো ঘনিষ্ট হয়ে বসলাম।
'না। তবে যদি ...'। সে যেন এখানে এসে থেমে গেলো। কাছেই কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে বালতি দিয়ে পিয়াইন নদী থেকে ছেঁকে ছোট ছোট পাথর তুলছে। জেনিফার তাদের যেনো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
'যদি...?' আমি তার থেমে যাওয়া কথায় ফিরে এলাম।
'যদি ভালোবেসে হারানো বিকেল খুঁজি...। খুঁজি গ্রাম-বাংলার অপরূপ লাবণ্যপ্রভা চিরশান্তির পরশ। বিকেলের সু্ন্দর আকাশ, যেখানে নদীর জলে জলকেলিরত শাদা রাজহাঁস। বাংলার আকাশ-বাতাস-নদী বয়ে নিরবধি, হৃদয়ে আমার দোলা দেয় একরাশ প্রেম। সেই প্রেম শুধু জন্মভূমির, সেই প্রেম জন্মভূমির প্রতিটি মানুষের প্রতি।'
হা হা হা করে হাসলাম আমি। বললাম, এটাতো মনে হয় কোনো একটা গানের কলি। উত্তর দেয়া হলো না।'
'আমি একেই ভালোবাসা বলি। আমার জীবনে সে এসেছিলো মৃদু পায়ে; কিন্তু আসন পায়নি বলে নিরুদ্দেশ হয়েছে।' একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।
নয়. (ভালোবাসায় সীমারেখা ও গ্রাম বাংলার আকর্ষণ)
এই মুহূর্তে সীমানা'র কথা মনে পড়ে গেলো। সে আমার জীবনের প্রথম নারী। যার ছিলো গ্রাম-বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি বিচিত্র আকর্ষণ। আমাকে নিয়ে প্রায় সময়ই ভ্রমণে বের হতো। ঘুরতাম দু'জনে বাংলার পথে-প্রান্তরে। গ্রাম বাংলার রূপ-সৌন্দর্য দেখতাম দু'চোখ ভরে। একটার পর একটা কবিতা সাজাতাম হৃদয়ের আয়নায়। তারপর সেই কবিতা লিখে উপহার দিতাম সীমানাকে। সীমানা কবিতা আবৃত্তি করতো নির্জনে নিরালায়। কথা বলতো গাছের সাথে, মাছেদের সাথে- প্রকৃতির সাথে।
সীমানাকে আমি নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় ভাবতাম, ভালোবাসতাম। তাই ভালোবেসে আমার জীবনের মুহূর্তগুলো তাকে উপহার দিয়েছিলাম। যার ভালোবাসা পেতে আমার জীবন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো। সেসব কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে স্মৃতির তলদেশে তলিয়ে গেলাম।
জেনিফার বললো, 'কী ভাবছো তুষার?'
'আমি ভাবছি সীমানার কথা।' আমি অকপটে উত্তর দিলাম।
'ভালোবাসায় কোনো সীমানা রাখতে নেই।' জেনিফার বললো। 'ভালোবাসতে হলে সীমানাহীনভাবে ভালোবাসতে হয়; তাকে অাঁকড়িয়ে ধরতে হয়। ভালোবাসাহীন জীবন তাসের ঘর।'
আমি ভাবলাম, পৃথিবীতে যদি সব মানুষ এমন হতো। মানুষ যদি সীমাহীনভাবে মানুষকে ভালোবাসতো! সীমানা তার ভালোবাসার সীমারেখা পার হতে পারেনি কিন্তু জেনিফার কি পারবো সীমাহীনভাবে ভালোবাসতে? হয়তো কোনো এক গোধূলিলগ্নে সেও চলে যাবে। যাবার সময় আমাকে দিয়ে যাবে একরাশ কালো ধোঁয়া। যে ধোঁয়ার আচ্ছন্নে আমি তলিয়ে যাবো উদ্ভ্রান্তের মতো।
নাহ্, আমি এসব কী ভাবছি? স্বপ্নহীন মানুষের শুধু অাঁধারেই বসবাস। আবার স্বপ্ন দেখবো, বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো। স্বপ্নহীন মানুষ কাপুরুষ। আমি কাপুরুষ হতে চাই না।
এমন সময় অনির্বাণ এলো। সে আমাদের দু'জনকে একসাথে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললো, 'কি বন্ধু, গ্রাম-বাংলার চিরচেনা সেই রূপ তোমার ক্যামেরায় কি ধরা পড়েছে?'
'শালাহ, আবার তুই?' আমি হাত উঁচিয়ে মারতে গেলাম তাকে। অনির্বাণ আমাকে ভয় পেলো না। সে ক্রমে ক্রমে আমার কাছে এলো। তারপর বুকটা পেতে দিয়ে বললো, 'দোস্ত মার। কয়টা মারবি মার। আমি যে তোর হাতের মার খাবার জন্যেই জন্মেছি রে।' এই বলে টপটপ করে কেঁদে ফেললো।
আমি অবাক। বললাম, 'আরে ব্যাটা অনির্বাণ, তুই কি পাগল হয়েছিস নাকি? তুই হলি আমার পরাণের শালা, শালাদের কেউ মারে নাকি?'
জেনিফার হো হো করে হেসে ওঠলো। তারপর বললো, 'বিয়ে না করতেই শালা? অবাক কাণ্ড।'
'আমি তো জন্মগ্রহণ করার আগেই তোর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ছিলাম, তাই না রে তুষার?' কান্নাভুলে হাসতে হাসতে বললো অনির্বাণ ময়ূখ।
জেনিফার ও অনির্বাণকে নিয়ে নেমে পড়লাম পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলে। নদীর দু'পাশে গ্রাম-বাংলার সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। মনের মাঝে কি অপূর্ব ঢেউ খেলে আনন্দ-হিল্লোলে।
নদীর অগভীর স্ফটিক পানিতে নেমে উচ্ছল পানি খেলায় মেতে উঠলাম আমরা। জেনিফার আমাকে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিলো, আমিও ওকে।
কিছুক্ষণ পর অনির্বাণ ফিরে গিয়ে লোপাজকে নিয়ে এলো। ওরাও আমাদের সাথে পানি খেলায় মেতে উঠলো। পিয়াইন নদীর পানিতে আমরা ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। ঠিক এমন সময়ই ঘটলো এক অবাক কাণ্ড। লোপাজ ছুঁটে এলো আমার কাছে, তারপর আমার কোলে উঠে বসলো। উচ্চারণ করলো, 'ড্যাডি...।'