এক.
ঘড়ির কাঁটাগুলোর পানে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে পল্লব। কাঁটাগুলো নড়ছে না, স্থির হয়ে আছে। মনে হয় ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। 'হায়রে কপাল!' প্রায় স্বগোক্তি করলো সে, 'শেষ পর্যন্ত তুই ও আমার সাথে অসহযোগিতা শুরু করলি!'
পল্লব জানে, মানুষের জীবনে যখন দুঃখ আসে, তখন দুর্দিনও আসে। অথচ ভরা নদী মাঝে ভাটা যেমন হয়, কিছু সময় পরেই আবার জোয়ারের উত্থান। কিন্তু মানুষের জীবনে যখন ভাটার টান শুরু হয় তখন জোয়ার আসতে অনেক সময় ও সাধনার ব্যাপার। কারো কারো জীবন নদীতে ভাটার টান শুরু হলে জোয়ারের মুখ দেখা প্রায় কঠিন হয়ে যায়।
শার্টের পকেটে হাত দিলো সে। অল্প কয়েকটি টাকা। ভেবে কূল-কিনারা পায় না। জীবন নদীর অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। কী করবে, কোথায় যাবে- কিছুই মাথায় আসছে না। জীবনের স্বপ্নগুলোও আজ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। স্বপ্নরা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলো পল্লব।
দুই.
ফ্লাশব্যাক (জীবনের অন্য অধ্যায়)
বাবা মারা যাওয়ার অল্প কয়েক মাস পর মাও মারা গেলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। বাবার অনেক আশা ছিলো ছেলেকে পড়াশুনা করাবে। কিন্তু সে আশাও সফল হলো না। বিএ পরীক্ষার ফরম ফিলআপের আগেই তিনি পরপারে চলে যাওয়ায় পড়াশুনার সেখানেই ইতি ঘটলো। অনেক চেষ্টা করেছে একটা চাকুরির জন্যে। কিন্তু আইএ পাস মানুষের জন্যে কেরানির চাকুরিও পাওয়া কঠিন। নিরুপায় হয়ে চলে এলো গ্রামের বাড়িতে। জায়গা-সম্পত্তি যা ছিলো সেগুলো দেখাশোনা করে মোটামুটি সংসার চলতো তার। তাছাড়া একটি বিরাট পুকুর আছে তাদের, সেই পুকুরটিতে মাছ চাষ করে ভালো টাকা উপার্জন করতে লাগলো সে। এভাবেই চলছিলো জীবন তার। কিন্তু বিধিবাম! 'অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়'। একদিন তার চাচা আকবর মিয়া জানালেন এ সম্পত্তি এখন আর পল্লবের নয়। পল্লবের বাবা মারা যাবার আগে সব সম্পত্তি আকবর মিয়ার কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। এখন যেহেতু পল্লব সেই টাকা শোধ করতে পারবে না। তাই এ সম্পত্তি আকবর মিয়া এখন আকবর মিয়া। কিছুদিনের মধ্যেই সব সম্পত্তি আকবর মিয়া দখল করে নিলো।
নিঃস্ব হয়ে গেলো পল্লব। উপায়ন্তর না পেয়ে শহর অভিমুখী হলো সে। শহরে এসে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছিলো সে। এমন সময় একদিন সুমন আহমেদ নামে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো তার। অনেক বছর পর দু'বন্ধুর দেখা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সুমন আহমেদ জানালো, সে বর্তমানে একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছে। পল্লব যদি চায় তাহলে পল্লব ওই পত্রিকায় বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে পারে। সম্মানী পাবে মাসে ৫ হাজার টাকা।
কথাটা শুনে পল্লব কী করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। যেখানে নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বহারা একজন মানুষ সে। আর তাকেই কি-না তার প্রিয় বাল্যবন্ধু প্রস্তাব দিলো মাসে পাঁচ হাজার টাকায় চাকুরি করার জন্যে! মহান আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলো সে। কিন্তু সে বন্ধু সুমন আহমেদকে প্রশ্ন করলো যে, সে যে বিভাগে কাজ করার জন্যে তাকে প্রস্তাব দিয়েছে সেটি কোন্ বিভাগ? সুমন আহমেদ বললো, 'তুই তো দেখতাম স্কুল-কলেজ জীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা-গল্প-ফিচার লিখতি। সেগুলো অনেক পত্রিকায় ছাপাতে দেয়া হতো, কেউ ছাপতো না। তবে আমি জানি, তোর মধ্যে প্রতিভা আছে, একটু চর্চা করলেই তোর মধ্য থেকে খাঁটি মুক্তো বেরুবে। আসলে আমি মনে মনে তোকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছি কিন্তু তোর দেখা পাইনি। আমাদের পত্রিকার সাহিত্য পাতায় পূর্বে যে কাজ করতো তার ভালো চাকুরি হয়েছে বিধায় সে আগামী মাসের পর অন্য জায়গায় কাজে যোগদান করবে। এখন ওই সাহিত্যপাতায় একজন বিভাগীয় সম্পাদক খুব প্রয়োজন। ভাবছি তুই সেখানে কাজ করলে ভালোই হবে। কি পারবি তো?'
'দোস্ত, মানলাম আমি কবিতা-গল্প লিখতাম। সাহিত্যচর্চা করতাম। কিন্তু আমি তো তা' সখের বশেই করেছি। আমি কি পারবো তোমাদের এমন একটা জনপ্রিয় স্থানীয় পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে?'
'আরে আমরা আছি না? তুই শুরু কর, দেখবি কোনো সমস্যাই নয়। তাছাড়া স্কুল জীবনে দেখেছি তোর বাংলা বানান জ্ঞান খুব টনটনে। তুই মাঝে মাঝে আমার ভুলগুলো শুধরে দেয়ার চেষ্টা করতি। আর তুই কি-না জিজ্ঞেস করছিস পারবি কি-না? চল আমার সাথে।' সুমন আহমেদ পল্লবকে নিয়ে বসলো একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া-দাওয়ার পর তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলো। পল্লব মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া আদায় করলো এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, কোনোদিনও বন্ধুর প্রতি অবিচার করবে না এবং বন্ধুর উপকারের প্রতিদান জীবন দিয়ে হলেও শোধ করবে।
কিছুদিনের মধ্যেই কাজে লেগে গেলো পল্লব। কাজ করতে গিয়ে সে দেখে আসলেই সুমন আহমেদ যা বলেছে, সত্যি-ই বলেছে। সে সব রকমের সহযোগিতাই পায় তার কাছ থেকে। তাছাড়া সুমন আহমেদ পল্লবের জন্যে থাকার একটা মেসও দেখে দিয়েছে। মাসে দেড় হাজার টাকা ভাড়া। খাওয়া দাওয়াসহ মাসে বেতনের টাকা পুরোটা খরচ হয়ে যায়। তবুও ভালো, বন্ধুর উসিলায় একটা ঠিকানাতো পাওয়া গেছে। জীবনের এই অবেলায়, বিপদের মুহূর্তে সুমন আহমেদ এগিয়ে না এলে কি যে হতো ভাবতেই পল্লবের মুখ শুকিয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে শুনেছে 'বিপদে বন্ধুর পরিচয়' সত্যিই তাই। বিপদের সময়ই প্রকৃত বন্ধু চেনা যায়। যারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে তারাই তো সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। যেখানে আমাদের সমাজে আজকাল বিপদের সময় নিজের আত্মীয়-স্বজনরাই মুখ ঘুরিয়ে নেয় সেখানে বন্ধুতো অনেক দূরের মানুষ। অথচ আজ দেখা গেলো তার উল্টো। কাছের মানুষরা, আত্মীয়-স্বজনরা হয়ে গেছে পর, আর দূরের মানুষরাই হয়েছে অতি নিকটের আপন মানুষ। পৃথিবীটা সত্যিই সেলুকাস। এখানে বিচিত্র রকম ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলে। কখনো যাকে মানুষ সবচেয়ে কাছের বলে ভালোবাসে সে মানুষটিই তাকে দেয় চরম আঘাত, আর যাকে শত্রু ভাবে মানুষ সেও অনেক সময় দূর্যোগের মুহূর্তে সবার আগে এগিয়ে আসে। ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় কিন্তু মানুষকে চেনা সত্যি দায়।
তিন.
পল্লব পত্রিকায় খুব মনোযোগ সহকারে কাজ করতে লাগলো। প্রায় ছয় মাস সাহিত্য পাতায় সুনামের সঙ্গে সফলভাবে কাজ করার পর একদিন সুমন আহমেদ জানালো, শুধু সাহিত্য পাতা-ই নয়। তাকে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ অলংকার করতে হবে। পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের আমেরিকার ডিভি ভিসা হয়ে গেছে। সে মাসখানেকের মধ্যেই চলে যাচ্ছে আমেরিকায়। এখন ওই পদটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। পল্লব পত্রিকায় বিভাগীয় কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে এবং কাজও করেছে যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণভাবে। তাই তাকে বার্তা সম্পাদকের পদে নিয়োগ দেয়া হবে। পল্লব বললো, 'দোস্ত, আমি কি পারবো অমন একটা নির্ভরযোগ্য, গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে? আমি তো শহরের অনেককেই চিনি না, জানি না। কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করবো। তাছাড়া হয়তো ছোটকাল থেকে লেখালেখি করি বিধায় সাহিত্য পাতার কাজ করতে পারছি, কিন্তু আমি তো নিজেই কোনোদিন কোনো রিপোর্ট বা নিউজ লিখিনি। সম্পাদনা করবো কীভাবে?'
'সব হয়ে যাবে। তুই চিন্তা করিস্ না। আমরা আছি না? তোকে এ নিয়ে অত ভাবতে হবে না। আমি তোকে ট্রেনিং দিয়ে দেবো, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।'
এরপরের কাহিনী ঘটলো খুবই দ্রুত। যেন ছায়াছবির কাহিনীর মতোই জীবনটা হয়ে গেলো তার। সুমন আহমেদ যেখানে যায়, পল্লবকেও সেখানে নিয়ে যায়। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পল্লব দ্বিধায় ভোগে কিন্তু সুমন আহমেদ তাকে সাহস যোগায়। এভাবে ক্রমে ক্রমে পল্লবের শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, অফিস-আদালত সবকিছুই চেনাজানা হয়ে যায়। ফলে এখন আর তার কাজ করতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। তাছাড়া কয়েকদিন সুমন আহমেদ পল্লবকে নিয়ে তার বাসায় বসে। নিউজ অ্যাডিটের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হাতে-কলমে শিখিয়ে দেয়। পল্লবও মনোযোগ দিয়ে দেখে, শুনে ও শিখে এবং মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে অজানা কিছু থাকলে তা রপ্ত করে নেয়।
পুরোদমে কাজ করতে লাগলো পল্লব। মাঝে মাঝে সুমন আহমেদ তার কাজের প্রশংসা করে। পল্লবও সুন্দর, গোছালো, দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করতে থাকে।
কিন্তু একদিন ঘটলো এক বিপত্তি। সে অফিসেরই একটা কাজে চলে গিয়েছিলো ঢাকায়। তার অবর্তমানে সহকারী বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক ওই কাজগুলো দেখাশোনা করতো। ঢাকা থেকে ফিরে এসে দেখে ওইদিন শহরের এক জুয়া ও সন্ত্রাসীদের আড্ডা নিয়ে একটা রিপোর্ট করা হয়েছে তাদের পত্রিকায়। রিপোর্টারের নাম নেই, পত্রিকার নামে রিপোর্ট করা হয়েছে। অনন্ত অফিসে নেই। জানতে পারলো সে তার স্ত্রী সহ কঙ্বাজারে গিয়েছে। পল্লব সহকারী বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের কাছে জানতে চাইলো, নিউজটি কে করেছে। তারা জানালো তাদেরই একজন স্টাফ করেছে। পল্লব বললো, আমি এবং প্রধান সম্পাদক না থাকা অবস্থায় এ ধরনের রিপোর্ট না করাই উচিৎ ছিলো। তাছাড়া রিপোর্টটি পূর্ণাঙ্গ নয়। যাদের ব্যাপারে রিপোর্ট করা হয়েছে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। তাদেরও বক্তব্য নেয়া উচিৎ ছিলো। তাছাড়া এ ধরনের রিপোর্ট করতে হলে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের অবশ্যই দৃষ্টিগোচরে থাকতে হবে। তা না হলে সমস্যা হয়।
সহকারী বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক জানালেন, পল্লব যে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছে, সেটি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। ওরা এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে বলে মনে হয় না।
আর কি করবে পল্লব। সে ভাবলো সুমন আহমেদ না আসা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কথা বলে লাভ নেই। সে আসুক, তারপর এ নিয়ে মিটিংয়ে কথা বলা যাবে এবং সতর্ক করে দেয়া হবে, যাতে পরবতর্ীতে এমন রিপোর্ট করার আগে পত্রিকার ঊধর্্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে পল্লব মেসে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল প্রায় ১০টা। পল্লব ঘুমাচ্ছিলো। এমন সময় সুমন আহমেদের ফোন এলো। সে জানালো, বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে পত্রিকার। অাঁতকে উঠলো পল্লব। জিজ্ঞেস করলো, 'বন্ধু কী হয়েছে?'
'তুমি ঠিকমতো নিউজগুলো দেখোনি?'
'আমি ঢাকায় ছিলাম। রাতে এসে দেখি ওইদিনের পত্রিকার নেগেটিভ হয়ে গেছে। সহ-বার্তা সম্পাদক আরফান রুমি ও নির্বাহী সম্পাদক মামুন আজিজ হোসেন বললো, সে ভালোভাবে দেখেছে। কোনো সমস্যা নেই। কী হয়েছে এখন?'
'জুয়া ও সন্ত্রাসীদের নিয়ে যে রিপোর্টটি প্রকাশ হয়েছে সেই রিপোর্টটা এখন আমাদের অনেক ভোগাবে। ওদের গডফাদারের নাম গোলাম কিবরিয়া খন্দকার। সে হুমকি দিয়েছে, মামলা করবে। এইমাত্র ফোন করলো সে। লোকটির পেশীশক্তি আছে। সে চাইলে যা কিছুই করতে পারে। তুমি কেনো নিজে এসে দেখলে না। এটাই কি তোমার দায়িত্ব পালন?'
কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না পল্লব। অনেকক্ষণ চিন্তা করে সে বললো, 'দোস্ত আমার ঢাকা থেকে আসতে দেরি হয়ে গেছে। আমি এসে দেখি পজেটিভ হয়ে গেছে। আমি ক্লান্ত থাকায় আর বেশিদূর দেখতে পারিনি। ওরা জানালো ভালোভাবেই সবদিক দেখা হয়েছে। কোনো সমস্যা নেই। যাই হোক এটা আমার অন্যায় হয়েছে। এখন কী করবো বলো?'
সুমন আহমেদ আর কিছু বললো না। লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলো। পল্লবের মনে হলো, যেন সে নিজেই স্বীয় ট্র্যাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। মনে মনে নিজকে ধিক্কার দিতে লাগলো, কেনো সে এমন দায়িত্বহীন কাজ করলো। কেনো সে পজেটিভ ভালোভাবে দেখলো না।
পরদিন সুমন আহমেদ চট্টগ্রাম থেকে ফিরে সকালে অফিসে এলো। পল্লবের সাথে কোনো কথা বললো না। পল্লব সুমন আহমেদের রুমে দেখা করতে গেলো। সে খুব রাগ করে বসে আছে।
কি বলবে পল্লব ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বললো, 'সুমন আমার ভুল হয়ে গেছে রে, আমাকে ক্ষমা করে দে দোস্ত।'
'আমার কাছে ক্ষমা চাইলে হবে না। এর শাস্তি তোকে ভোগ করতেই হবে। কেনো দায়িত্বে অবহেলা করছিলি?'
'এই কানে ধরলাম।' পল্লব কানে ধরে বললো, 'আর ভুল হবে না দোস্ত।'
হেসে উঠলো সুমন আহমেদ। 'আয় বস। নাস্তা খেয়েছিস্?'
'না।'
সুমন আহমেদ পিয়নকে নাস্তা আনতে বললো। দু'বন্ধু এক সাথে নাস্তা খেতে লাগলো। সুমন আহমেদ বললো, 'শোনো, ঢাকা থেকে টিআইবির একটা সুভ্যেনির প্রকাশের জন্যে দুনর্ীতি বিষয়ক একটা ফিচার আমার কাছে চেয়েছে। আমার ব্যস্ত সময়। তুই একটা কাজ কর, আজ রাতের মধ্যে লেখাটা লিখে কাল আমাকে মেইল করে দিবি। আমি ঢাকায় কালই পাঠিয়ে দেবো। তোর নামেই প্রকাশ হবে।
'কার নামে হবে, সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। তুই চেয়েছিস্, আমি লিখে দেবো, ব্যাস। হলো তো?' পল্লব বললো।
সারারাত ধরে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে শ্রম-ঘাম ব্যয় করে জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটা লিখে সে সুমন আহমেদের মেইল অ্যাড্রেসে সেন্ড করলো। পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখলো তার জন্যে পুলিশ অপেক্ষা করছে। জানতে পারলো, গোলাম কিবরিয়া খন্দকার পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক এবং বার্তা সম্পাদকের নামে মামলা করেছে, তাই পুলিশ এসেছে তাদের অ্যারেস্ট করতে। পল্লবকে অফিসে পেয়েই পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করলো। তার কোনো কথা তারা শুনলো না।
চার.
পল্লব জেলে। এদিকে সুমন আহমেদ পল্লবের সাথে প্রতারণা করে নিজের নামেই পল্লবের লেখা দুনর্ীতিবিষয়ক ফিচারটি প্রকাশের জন্যে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলো। লেখাটি প্রকাশিত হলে ওই সংস্থা সুমন আহমেদকে জানালো, সে লেখাটির জন্যে ত্রিশ হাজার টাকা সম্মানী ও ক্রেস্ট পাবে। মাসতিনেক পর দিনক্ষণ নির্ধারিত করে পুরস্কার ও সম্মানী প্রদান করা হবে।
এর মধ্যে প্রায় তিন মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পেলো পল্লব। এসেই মেসে এসে দেখে তার সিটটি কতর্ৃপক্ষ ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। সেখানে অন্য একজন বাস করছে। সে বন্ধু সুমন আহমেদের মোবাইলে রিং্#৬১৪৭২;করলো। কিন্তু জানানো হলো, এই মুহূর্তে মোবাইলটি বন্ধ আছে। দয়া করে আবার ফোন করুন...।
পাঁচ.
এবার ফিরে আসি বর্তমানে (যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একেলা চলো রে)
পল্লবের হাত ঘড়িটা বন্ধ। পকেটে দেখলো অল্প কয়েকটি মাত্র টাকা। এদিকে মেসে প্রায় থাকা খাওয়া মিলে দশ-বারো হাজার টাক দেনা আছে সে। মেস ম্যানেজার জানিয়েছে, টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার মালামাল বিক্রি করে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে নেবে।
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না পল্লব। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দু'তিন দিন হয়ে গেলো। টাকা-পয়সার অভাবে তেমন একটা খাওয়া দাওয়াও করতে পারছে না। ধারে কাছের মানুষগুলো তাকে দেখলে যেন অচেনার ভান করে দূরে সরে যায়। সুমন আহমেদ ছাড়া তার আরো কয়েকজন বন্ধু ছিলো তাদের কাছে গিয়েছে সে। কিন্তু জেল ফেরৎ বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রাখতে সবাই নারাজ। তাকে দেখলেই যেন অন্য বন্ধুরা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে কেটে পড়ে।
নিরূপায় হয়ে অফিসে গেলো পল্লব। গিয়ে দেখলো সুমন আহমেদ নেই। অন্যদিকে অফিসের অনেক কর্মকর্তাই নতুন। দু'একজনকে ছাড়া কাউকে চিনতে পারছে না সে। কি করবে সে। আবার ফিরে এলো রাস্তায়। শহরে আরো কয়েকজন পরিচিত মানুষ ছিলো তার। যারা তার সুসময়ে তার কাছে ভিড়তে চাইতে, সুবিধা গ্রহণ করতে চাইতো, তাদের কাছে গেলো সে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। পল্লবকে তারা যেন চিনেই না।
পল্লবের মনে হলো তার বিপদের সময়তো সব বন্ধু-বান্ধবকেই পরীক্ষা করে দেখেছে, সবার কাছেই গিয়েছে। বিপদের কথা জানতে পেরে কেউ তাকে আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। হঠাৎই কলেজ জীবনের বন্ধু (ক্লাসমেট) শাহানাজ আক্তারের কথা মনে হলো তার। শুনেছে সে এই শহরেই বাস করে। পরদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার বাসার খোঁজ পেলো পল্লব। পল্লবকে প্রথমে দেখেই শাহানাজ অবাক হলো। তারপর পল্লবের জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সে পল্লবের সব কথা শুনলো। তারপর বললো, 'তুই চিন্তা করিস্ না পল্লব। যার জন্যে কেউ নেই, তার জন্যে আল্লাহ্ আছেন। তুই যতদিন মনে চায় আমার বাসায়ই থাক। আমার স্বামী শুনলেও খুশি হবেন।
পল্লবের মনে হলো শাহানাজ আক্তার যেনো তার বন্ধু বা ক্লাসমেট নয়। তার আপন মায়ের পেটের বোন। সে অবাক দৃষ্টিতে শাহানাজের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ছয়.
ঢাকা থেকে টিআইবির লোকেরা ফোন করলো সুমন আহমেদের কাছে। তারা জানালো, পরদিন অনুষ্ঠান। ঢাকায় গিয়ে সুমন আহমেদকে পুরস্কার গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানালো। সুমন আহমেদ তার এক বন্ধু তুহিনকে নিয়ে পুরস্কার গ্রহণের জন্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সেখানে বিরাট আয়োজন। প্রায় সারাদিন ধরে চললো অনুষ্ঠান। দেশি-বিদেশি অনেক গণ্যমান্য আমন্ত্রিত অতিথি। দেশের শীর্ষস্থানীয় লোক। লোকে লোকারণ্য। প্রতিটি জেলা থেকে একজন করে ছত্রিশজনকে সম্মানী ও ক্রেস্ট প্রদান করা হলো দুনর্ীতিবিষয়ক বিশেষ ফিচার রচনার জন্যে। সুমন আহমেদও গ্রহণ করলো সম্মানী ও ক্রেস্ট। এতো নামী-দামী মানুষের কাছ থেকে জাতীয় পর্যায়ে এই প্রথম কোনো পুরস্কার গ্রহণ করলো সে।
পুরস্কার গ্রহণ শেষে অভিজাত হোটেলে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে খুশি মনে বাগ বাগ হয়ে তুহিনসহ দু'বন্ধু রওনা হলো নিজস্ব গাড়িতে করে। কুমিল্লার চান্দিনায় আসার পর তুহিন বললো, 'দোস্ত একটু গাড়ি থামা। সিগারেট কিনবো।'
দু'বন্ধু গাড়ি থামিয়ে সিগারেট কিনে ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে গাড়িতে উঠলো। খুব আয়েশ করেই দু'জন সিগারেট পান করছে। গাড়ি চলতে লাগলো। মাইল দুয়েক গাড়ি চলার পর নির্জন একটা জায়গায় যখন এলো তখন তুহিন বললো, 'দোস্ত গাড়িটা একটু থামা, আমি হিসি করবো।'
'এই ব্যাটা, সারাদিন তোর শুধু হিসি পায় নাকি রে! ওটায় একটা বোতল বেঁধে রাখ।' সুমন আহমেদ বললো।
'কী করবো দোস্ত। সারাদিন জার্নি তাছাড়া খাওয়া-দাওয়াও তো হয়েছে বেশ। আমি আবার হিসি চেপে রাখতে পারি না।'
'চল গাধা।' তুহিনের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললো সুমন আহমেদ, চল আমিও যাবো। আমারও হাল্কা নিম্নচাপ আছে।' দুজনে হাসতে হাসতে রাস্তার পাশে চলে গেলো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে।
সাত.
রাত প্রায় এগারোটা। রাস্তার পাশে ল্যাম্পোস্টে নিয়ন বাতি জ্বলছে মৃদু মৃদু। গাড়ি ও জনমানুষের সংখ্য একদম কম। প্রাকৃতিক কর্ম সেরে সুমন আহমেদ যেই মাত্র উঠে দাঁড়ালো। দেখলো- তুহিনের হাতে কি যেন একটা ঝিলিক মেরে উঠলো। অবাক হয়ে সে দেখলো, তুহিনের হাতে একটা ছোরা চক চক করছে। তুহিন সুমন আহমেদকে বেশি কিছু বললো না। টান মেরে অনন্তের পেছনের প্যান্টের পকেট থেকে ত্রিশ হাজার টাকা এবং ক্রেস্টটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো সে। তারপর বললো, 'তোর যদি বন্ধু পল্লবের সাথে বেঈমানী করে, তার লেখা নিজের নামে প্রকাশ করে পুরস্কার গ্রহণ করে অপরাধ না হয়। তাহলে আমি তোর কাছ থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিলেও কোনো অপরাধ হবে না। তুই তোর বন্ধুর সাথে বেঈমানী করেছিস্, অগত্যা আমিও তোর সাথে বেঈমানী করলাম। মনে কষ্ট নিস না দোস্, আমার টাকার খুব প্রয়োজন। আর মনে কষ্ট নেয়ারও প্রয়োজন নেই কারণ টাকাগুলো তোর না, পল্লবের। সে যখন কষ্ট করে লিখে টাকাগুলো পায়নি, তাহলে তোরও এ টাকা পাবার অধিকার নেই।'
বিস্ময়ে থ' হয়ে গেলো সুমন আহমেদ। সে বললো, 'তুহিন, তুই আমার বাল্যকালের বন্ধু। তুই আমার সাথে এমন বেঈমানী করতে পারিস্ না। তাহলে ইতিহাসে বন্ধুত্বের জগতে তুই কুখ্যাত হয়ে যাবি। মানুষ বন্ধুকে আর কোনোদিন বিশ্বাস করবে না।'
'কেন, তুই যখন পল্লবের সাথে প্রতারণা করলি, সে জেলে ঢোকার পর তুই তার সাথে কোনোরকম খোঁজ-খবর রাখলি না, তখন কি সেটা প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে না? তুই কি বন্ধুত্বের জগতে প্রতারণার জন্যে কুখ্যাত হয়ে যাসনি? তোর মতো একজন প্রতারকের সাথে প্রতারণা করা কি দোষের নাকি? আর কথা বলিস্ না। তাহলে আমার হাতের চুরিটা তোর পেটে আমুল বসিয়ে দেবো।
'বন্ধু হয়ে কি সেটা তাই পারবি?'
'ইতিহাসে এমন নজির অনেক আছে। বন্ধু বন্ধুকে খুন করছে টাকার জন্যে, প্রেমের জন্যে, ভালোবাসার পাবার জন্যে। আর আমি টাকার জন্যে তোকে খুন করাটা অসম্ভব কিছু নয়। যা সোজা চলে যা। একদম পেছন ফিরে তাকাবি না। মনে করবি প্রতারণা করে পাওয়া টাকাগুলো হারিয়ে গেছে, অথবা কোনো এতিমকে দান করে দিয়েছিস। যা, চলে যা।'
সুমন আহমেদ স্থবির হয়ে গেলো। পা তার চলছে না। বন্ধু হয়ে বন্ধুর প্রতি এমন ডায়লগ তো শুধু সিনেমা-নাটকে দেখেছে সে। বাস্তবে কোনোদিন দেখেনি। আজ দেখলো। মানুষের জীবনে কতো কিছু ঘটে, ভাবছে সে।
টাকা ও ক্রেস্ট নিয়ে চোখের পলকে তুহিন উধাও হয়ে গেলো। সুমনের যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন সামনে আর কাউকে চোখে পড়লো না। কি করবে এখন সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভ করতে লাগলো চাঁদপুরের পথে। কিছুদূর গাড়ি চালিয়ে আসতেই সামনে একটা মোড় পড়লো। সেদিকে সুমন আহমেদের কোনো খেয়াল নেই। আপন মনে ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছে সে। সামনে একটা লরি, কিন্তু তার কোনো খেয়াল নেই। গাড়িটা আরো কাছে এসে গেলো। সুমন চিন্তায় মশগুল বিধায় সেটি তার চোখে পড়ছে না, সে ভাবনার রাজ্যে। হঠাৎ করেই বিশাল লরিটা তার চোখে পড়লো। কিন্তু তখন সময় শেষ। আর মাত্র পাঁচ-ছয় হাত বাকি, এখনই ঘটবে সামনাসামনি সংঘর্ষ। সুমন ঠিক সেই মুহূর্তে ব্রেকে চাপ দিলো, আর সাথে সাথেই হাতের স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে দিলো রাস্তার ঢালের দিকে। সংঘর্ষ হলো না। তবে সুমন গাড়ি সমেত পড়ে গেলো রাস্তার নিচে, এরপর জ্ঞান হারালো সে। সেখান লোকেরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় কুমিল্লা হাসপাতালে নিয়ে গেলো।
হাসপাতালে যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন সে দেখলো, তার সামনে পল্লব উদ্বিগ্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞান ফিরতেই পল্লব তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তারপর বললো, 'দোস্ত খবরটা শোনার পরই আল্লাহর কাছে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে মোনাজাত করেছি, আল্লাহ্ তুমি আমার প্রাণ নিয়ে নাও। কিন্তু আমার বন্ধু সুমন আহমেদের জীবনটা ভিক্ষা দাও। আল্লাহ্ আমার কথা শুনেছে। তোকে আমি আবার ফিরে পেয়েছি দোস্ত। এখন আর আমি মরে গেলেও কোনো আফসোস থাকবে না।'
তারপর পল্লব ওপরের দিকে তাকিয়ে বললো, 'হে আল্লাহ্, আমার বন্ধুকে তুমি নতুন জীবন দান করছো। এবার তুমি আমার জীবনটা নিয়ে নাও খোদা, আমার জীবনটা নিয়ে নাও। আমার কোনো দুঃখ নেই, আমি আমার বন্ধুকে জীবিত অবস্থায় পেয়েছি এটাই আমার সুখ, এটাই আমার শান্তি।'
শত কষ্ট-যন্ত্রণার মাঝেও সুমন উঠে বসলো। তারপর ইশারায় পল্লবকে কাঁদতে বারণ করলো।
আট.
সুস্থ হয়ে বিধ্বস্ত মনে বাসায় এলো সুমন আহমেদ। এখনও বুকে ও ঘাড়ে ব্যথা রয়েছে তার। ডাক্তার বলেছে, নিয়মিত ঔষধ খেলে দু'একদিনের মধ্যেই ব্যথা সেরে যাবে।
সারারাত তার ঘুম হলো না। শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা এখন তার বেশি হয়ে দেখা দিয়েছে। তুহিন টাকা নিয়ে ভেগে গেছে সেটা তার দুঃখ নয়, কিন্তু সেযে এমন একজন হিতাকাঙ্ক্ষি বন্ধুর সাথে প্রতারণা করলো, যে নিজের জীবন দিয়ে হলেও বন্ধুর সুস্থতার জন্যে খোদার কাছে প্রার্থনা করে। তাকে সে প্রতারণা ও অবহেলা করেছে।
সে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। না, কোনো ক্রমেই এই টাকা তুহিনকে ভোগ করতে দেয়া যাবে না। যার ন্যায্য পাওনা টাকা তাকেই বুঝিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে মাপ চেয়ে নিতে হবে। বন্ধুর সাথে বেঈমানী আর নয়, প্রয়োজনে তার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইবে সে।
পরের দিনই সে পল্লবের মেসে গিয়ে হাজির। সেখানে গিয়ে শুনে পল্লব মেসে থাকে না। তার এক ক্লাসমেট শাহানাজের বাসায় থাকে। অনেক কষ্ট করে ঠিকানা সংগ্রহ করে সুমন সেখানে গিয়ে হাজির। সেখানে গিয়ে দেখে পল্লব বসে বসে চা পান করছে। পাশে অ্যাশট্রেতে একটা অর্ধপোড়া জ্বলন্ত সিগারেট।
পল্লব সুমন আহমেদকে দেখে বিস্মিত হলো। বললো, 'দোস্ত তোর তো এখনও চিকিৎসা চলছে। তুই কেনো কষ্ট করে আমার কাছে এলি। ফোন করলেই তো আমি তোর বাসায় যেতাম।'
'না, তুই কেনো যাবি, এখন তো আমিই তোর কাছে আসবো। কারণ আমি যা করেছি তার প্রায়চিত্ত না করার পর্যন্ত আমাকে বার বার তোর কাছে আসতেই হবে।'
অবাক হলো পল্লব। 'কি এমন করেছিস্ তুই দোস্ত? না, তুই তো আমার সাথে কোনো অন্যায় করিস্নি। বরং তুই আমার যতো উপকার করেছিস। সে তুলনায় আমি তোর জন্যে কিছুই করতে পারিনি।'
কোনোকিছু না বলেই সুমন আহমেদ পল্লবের পা জড়িয়ে ধরলো। পল্লব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কি ঘটছে বুঝতে না পেরে পাঁচ সেকেন্ড থ' হয়ে রইলো। এরপর সে বন্ধুকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'এটা তুই কি করছিস? যেখানে আমি তোর পা জড়িয়ে ধরার কথা সেখানে তুই কেনো এমন করছিস? আমি তো সর্বক্ষেত্রেই তোর কাছে ঋণী রে সুমন।'
'না। আমি ভুল করেছি।' ক্রমে ক্রমে সব ঘটনা পল্লবকে বললো সুমন আহমেদ। পল্লব সব শুনে হাসলো। এমন সময় কামরায় প্রবেশ করলো তুহিন।
সুমন আহমেদ তুহিনকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তারপর কোনোরকমে উঠে গিয়ে সুমনের কলার চেপে ধরে বললো, 'বল হারামজাদা টাকাগুলো কোথায়?'
তুহিন মিটিমিটি হাসছে। সে পল্লবের দিকে তাকালো। পল্লব বললো, 'তুহিন সেদিনই টাকাগুলো এনে আমাকে দিয়েছে। আমি বলেছি, এ টাকা আমার লাগবে না। এটা তুমি সুমনকেই ফেরৎ দিয়ে আসো। সুমন আমার জন্যে যা করেছে, আমার যতো উপকার করেছে এ টাকা তার কাছে কিছুই নয়। বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্যে ত্রিশ হাজার কেনো, জীবনও তো তুচ্ছ রে দোস্ত।'
সুমন আহমেদ যেনো এই প্রথম জীবনে এমন একজন মহৎ বন্ধুর কথা শুনলো। সে তুহিনের শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে বললো, 'শয়তান বন্ধু তুহিন। তুই শয়তানি না করলে আমি আসলে সঠিক রাস্তা পেতাম না। তুই আসলে একটা মিচকা শয়তান। যে শুধু আড়ালে থেকে শয়তানি করে, অথচ তার শয়তানিই অন্যবন্ধুর জীবনের সঠিক রাস্তা বাতলিয়ে দেয়। তোকে ধন্যবাদ মিচকা শয়তান।'
তিনবন্ধুই একসাথে হেসে উঠে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো।
নয়.
পল্লবসহ পত্রিকার অন্য স্টাফদের নামে করা মামলা ডিসমিশ হয়েছে। এরপর পুলিশ পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক হাতেনাতে জুয়াড়ী ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করেছে জেলে প্রেরণ করেছে। ভেঙ্গে গেছে জুয়ার আড্ডা। ওই পত্রিকার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে জেলা পেরিয়ে পুরো দেশে। পল্লবও কাজে যোগদান করেছে নতুন করে। পত্রিকারও সাকর্ুলেশন বেড়েছে, সেই সাথে পল্লবেরও সম্মানী বেড়েছে। সে এখন সম্মানী পায় মাসে পনের হাজার টাকার মতো।
এক মাসের বেতন পেয়ে পল্লব, সুমন আহমেদ ও তুহিন মিলে শাহানাজের বাসায় মিষ্টি নিয়ে যায়। তারপর পল্লব নিজ হাতে শাহানাজকে মিষ্টি খাওয়ায়। সুমন আহমেদ পল্লবের বিপদের মুহূর্তে শাহানাজ তাকে সহযোগিতা করায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলে, 'বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আর বিপদ এলে কে বন্ধু কে শত্রু তা' চেনা যায় না।'
মিচকা শয়তান উপাধি পাওয়া তুহিন জোরে চিমটি কাটে সুমনের পিঠে। সুমন চেঁচিয়ে উঠে বলে, 'ওহ্ শয়তানটার শয়তানী আর গেলো নারে। ওরে বাবা আমার পিঠে যেন বোমা মেরেছেরে!
সবাই হেসে ওঠে সুমনের কথা। পল্লবের চোখে জল আসে খুশিতে।
(গল্পটির প্রতিটি চরিত্রের নামধাম ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তব কোনো ঘটনা, স্থান-কাল, পাত্রের সাথে কাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। গল্পে বর্ণিত কাহিনী কারো জীবনের কোনো ঘটনার সাথে মিলে গেলে সেটা নিতান্তই কাকতালীয়। সেজন্যে লেখক দায়ী নন। -লেখক। মেইল-সরুধহৎধহধনফ@ুধযড়ড়.পড়স)