এক.
নিশুতি রাত। বৃষ্টিতে ভিজে ভেজা কাকের মত একাকী পথ চলছে অনন্যা। কাঁধে একটি ট্রাভেল ব্যাগ। হাজীগঞ্জের অদূরে বলাখাল রেল স্টেশনে নেমে স্টেশন মাস্টারের সাহায্য চেয়েছিলো সে। কিন্তু স্টেশন মাস্টার অযথা উপদ্রব ভেবে কোনো কথাই বলেনি তার সাথে। অগত্যা নিজেই ধরেছে নিজের পথ।
এরই মধ্যে হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি, মুষলধারে। পথের কাছাকাছি কোনো বাড়ি নেই যে, একটু আশ্রয় নেবে সে। মাইলখানেক চলার পর হঠাৎ দেখা গেলো অনতিদূরে একটা লণ্ঠনের আলো। বাড়ি হবে হয়তো সেটা। আশার ভেলা বাঁধলো সে। হাঁ যা, বাড়িই। বিশাল, তবে ভাঙ্গা-চোরা। পরিত্যক্ত প্রাচীন জমিদার বাড়ির মতো। উঠোনে একজন যুবক। হাতে একটা লণ্ঠন। গুনগুন গান গেয়ে ছাতা মাথায় কোলাব্যাঙের মতো হিসি করছে সে। অনন্যাকে দেখতে পায়নি। লোকটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে পেছনে ফেরে এবং ভয় পেয়ে যায় অনন্যাকে দেখে। তোতলাতে থাকে।
"আ... আ... আপ.... নি.... কে..কে....?"
"আমি মানুষ।" স্মিত হাসে অনন্যা। এতো রাতে এই মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছে সে। এতোটুকুও ভয় পায়নি। কিন্তু নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় একজন সামর্থবান পুরুষের ভয় পাওয়ায় হাসি চেপে রাখতে পারেনি, এতো দুর্যোগেও।
"মানুষ আপনি?" প্রশ্ন করে যুবক। "এই রাত-বিরাতে? কী চাই?"
"একটু আশ্রয়।" সাদামাটা জবাব।
"আমি একা থাকি এই বাড়িতে। কোনো মেয়ে-ছেলে নেই।" এড়িয়ে যেতে চায় যুবকটি।
"আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু আজকের রাতটা থাকবো। ভোর হলে চলে যাবো।"
নাছোড়বান্দা। পরী-টরী অথবা মায়াবিনী? ভাবে যুবক। কেন যে মাঝরাতে হিসি করতে বেরিয়েছিলাম! শালা, আজকে কপাল খারাপ। এ মাঝরাতে কোত্থেকে একটা মেয়েছেলে আসবে। না, এ হতেই পারে না। এ কোনো সাধারণ মানুষ নয়, অতিমানবীয় কোনো কিছু হয়তো হবে। একে জায়গা দিলে রাতে টুটি চেপে মেরে ফেলবে। এ ঝড় বৃষ্টির রাতে কোনো ভালো ঘরের মেয়ে বের হতে পারে না।
"কী ভাবছেন?" তাড়া দিলো অনন্যা। "দেখুন, আমি বড় বিপদে পড়ে আজকের রাতটা কাটাবার জন্যে আশ্রয় চেয়েছি । যদি অক্ষম হন তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।" অনন্যা পা বাড়ালো।
লোকটা কিছু বললো না। অনন্যা নিরাশ হয়ে কিছুদূর চলে যাবার পর দেখলো কে যেন পেছন পেছন আসছে। সাথে আলো। পেছন ফেরলো সে।
একজন বুড়ো মানুষ। কাঁধে গামছা। হাতে সেই ভয়ার্ত যুবকের ছাতাটি। লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে অনন্যার কাছে এসে বললো, "আমার নাম মলম আলী। আপনি আশ্রয় চেয়েছিলেন ইরফান ভাইয়ের কাছে, উনি রাজি হয়েছেন। চলুন আমার সাথে।"
যে ঘরটিতে অনন্যাকে শু'তে দেয়া হয়েছে, সে ঘরটায় তেলাপোকা, আরশোলা ভর্তি। ভ্যাপসা গন্ধ। পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি হবে হয়তো। অনন্যাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, খানাপিনা করবে কি-না। জবাবে অনন্যা 'না' বলেছিলো।
যুবকটি তার নাম 'ইরফান' বলে জানিয়েছিলো। সে বলেছিলো, "আপনি এখানে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মলম আলীকে জানাবেন দয়া করে।" যুবকটি প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো বলে হয়তো ওকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। পরে কী ভেবে মলম আলীকে পাঠিয়েছিলো। এখন পর্যন্ত আচার-ব্যবহারে খুব ভদ্রতা দেখিয়েছে। অনন্যা ভাবছে আর আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে।
ঘরের ভেতর আবছা আলো। কে যেন হাঁটছে। অনন্যার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান নামের সেই যুবকটি। হাতে একটা গ্লাস। শোয়া থেকে উঠে পড়ে অনন্যা।
"নিন, গ্লাসের দুধটুক পান করুন, গরম দুধ। জানি, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আপনি ক্লান্ত। দুধ পান করলে শরীরে শক্তি পাবেন।"
অনন্যা কোনো কথা বললো না, সে দুধটুকু পান করে ফেললো। আসলেই তার তৃষ্ণা পেয়েছিলো।
"এবার ঘুমান।" যুবকটি চলে যাচ্ছিলো। ডাক দিলো অনন্যা।
"এ বাড়িতে কোনো মেয়ে মানুষ নেই কেন?"
যুবকটি যেন ওর কথা শুনতেই পায়নি। সে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কোথায় যাবেন? কোন বাড়ি?"
"নারায়ণপুর, খান বাড়ি। আবুল ফতেহ খান আমার নানা।" জবাব দিলো অনন্যা।
দুই.
গভীর ঘুমের তলদেশ থেকে আস্তে আস্তে অনন্যা জেগে উঠলো। তারপর চোখ মেলে দেখলো তার নানা আবুল ফতেহ খান তার সামনে বসে আছে।
অনন্যা কোনো কথা বলছে না। ভাবছে গত রাতের সেই ঘটনা। সেটা কি তাহলে স্বপ্ন? কোথায় সেই যুবক ইরফান? সে তো ইরফানের বাড়িতে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ তার চেতনা ফিরে এলো। সে বললো, "নানা তুমি? আমাকে কে এখানে আনলো?"
"তুই কখন এলি মা? আমি তো চিন্তায় অস্থির। এ ঝড়-বৃষ্টির রাতে কীভাবে, কখন এলি তুই?"
ফ্যালফ্যাল করে নানার দিকে তাকিয়ে আছে অনন্যা। ভাবছে গতরাতের কথা। সে তো আশ্রয় নিয়েছিলো ইরফান নামের সেই যুবকটির বাড়িতে। যুবকটির হাতের এক গ্লাস দুধ পান করলো সে। তারপর ঘুমের ঘোরে অচেতন।
"জানিনা নানা, নিজে আমি এখানে আসিনি। ঝড়-বৃষ্টির রাত। আমাদের ট্রেন লেট হয়। স্টেশনে আসে রাত বারোটায়। রিক্সা না পেয়ে আমি একা একা হাঁটতে শুরু করি.........। পথে ঘটা পুরো ঘটনা খুলে বললো অনন্যা।
"তাহলে তুই বলেছিস ঘটনা স্বপ্ন নয়; বাস্তব।" প্রশ্ন করলো আবুল ফতেহ খান।
"স্বপ্ন হবে কীভাবে? তাহলে আমি কাল রাতে কীভাবে এলাম? আমি যদি রাতে তোমার বাড়িতে আসতাম তাহলে তো তোমাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ঘরের দরজা খুলে আসতাম। কিন্তু আমি এই ঘরে এলাম কীভাবে?"
"সকালে উঠে দেখি, এ ঘরের দরজা আবছা খোলা। কেউ হয়তো বাইরে থেকে কোনো লোহার রড দিয়ে দরজা খুলে তোকে এখানে রেখে গেছে।"
অনন্যা বিভ্রান্তের মতো ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলো।
"কিন্তু আমাকে সে লোকটি কীভাবে এখানে এনে রেখে গেছে? আমি কেন কিছুই টের পেলাম না?"
"তোকে সম্ভবত: দুধের সাথে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে।" রহস্যের জাল ছিন্ন করে সামান্য হাসলো আবুল ফতেহ খান। "তা' তুই কি সেই যুবকটির নাম জানিস? যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলি?"
"যুবকটি তার নাম 'ইরফান' বলে জানিয়েছিলো, তাদের বাড়িতে কোনো মেয়েছেলে ছিলো না।"
লাফিয়ে উঠলো যেন আবুল ফতেহ খান। চোখ কপালে তুলে বলতে লাগলো সে, "ইরফান! সে তো একটা ডাকাত! খুনি, সর্বহারা কমরেড। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো, যুদ্ধ শেষে সে তার অস্ত্র জমা দেয়নি। বলে, দেশতো এখনও স্বাধীন হয়নি। তারপর থেকে একটা দল গঠন করে- কম্যুনিস্ট_ চরমপন্থি দল। এ দল বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তোর কোনো ক্ষতি করেনি তো?" অপলক নেত্রে অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছেন নানা।
হাসে অনন্যা। " নানা! যদি ক্ষতি হতো, তাহলে কি ওরা এখানে এনে আমাকে রেখে যেতো? অবশ্যই মেরে ফেলতো। লোকটি আমার গায়েও টাচ করেনি।"
বিড়বিড় করে কথা বলছে আবুল ফতেহ খান, "লোকটি সম্পর্কে অনেক কথা কানে আসে। সবাই বলে, লোকটি খারাপ। মাওবাদী, কম্যুনিস্ট। ওরা সবাই ডাকাতি করে, খুন করে। কিন্তু এতো রাতে একজন যুবতীকে কাছে পেয়েও কেন মানুষের অগোচরে নিজ বাড়িতে রেখে গেলো? এর রহস্য ভেদ করতেই হবে।"
ভাবছে অনন্যা। হাঁ যা, রহস্য ভেদ করতেই হবে।
তিন.
পরদিন দুপুর। নানাসহ সেই ভাঙা বাড়িতে হাজির হলো ওরা। কিন্তু সেখানে কোনো জন-প্রাণীর বাস পর্যন্ত যেন নেই। আশেপাশের মানুষরা জানিয়েছে, এখানে কোনো মানুষ থাকে না। বাড়িটি পরিত্যক্ত। রাতে শুধু আলো দেখা যায়। সবাই বলে এ বাড়িতে জিন-ভূত বাস করে। রাতে ভূতের চিৎকার শোনা যায় বলে এ বাড়িতে ভয়ে কোনো মানুষ আসে না।
রহস্য আরও ঘনীভূত হলো। আবার গেলো ওরা। তবে দিনে নয়, রাতে। ঠিক বারোটায়।
দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে সাড়া এলো। "কে?"
"আমি অনন্যা।"
কিছুক্ষণ নীরবতা। দরজা খুললো না কেউ। শুধু পায়ের ধুপধাপ শব্দ।
প্রায় পনেরো মিনিট পর খুললো দরজা। সেই যুবক, ইরফান। হাতে একটা স্টেনগান তাক করা অনন্যার বুকে। পেছনে আরও দশ-পনের জন। ওরা সবাই নিশ্চলভাবে অনন্যা ও তার নানার বুকে দিকে তাক করে অস্ত্র ধরে আছে।
ইংগিতে অনন্যাকে ভেতরে আসতে বললো ইরফান। ওরা ভেতরে প্রবেশ করলো।
নীরবতা ভাঙল অনন্যা। "এভাবে আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন কেন?"
"তুমি নিশ্চয়ই পুলিশ নিয়ে এসেছ, তাই না অনন্যা?" রহস্যময় হাসি হাসলো ইরফান। "যদি আমার কথা সত্যি হয়, তাহলে তোমাদের দু'জনেরই বিপদ আছে।"
অনন্যা তাকিয়ে আছে ইরফানের চোখের দিকে। সে ভাবতে থাকে- এই যুবকটিই সে যুবক, যে কি-না অনন্যাকে দেখে ভয় পেয়েছিলো? যে কি-না নিজ হাতে তাকে দুধ পান করিয়েছিলো। অথচ আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। বিদ্রোহী বিদ্রোহী ভাব। যেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। আশ্চর্য!
"বলুন," ধমকে উঠলো ইরফান।
"আমি কখনো উপকারীর অপকার করি না" সুললিত কণ্ঠে বললো অনন্যা। "আপনি আমার উপকার করেছেন, আর আমি আপনার অপকার করবো? আপনি যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তার বিচারের ভার রাষ্ট্রের, আমার একার নয়। আপনি আমার হিতাকাঙ্খী।"
ইরফানের সাথীরা কোনো কথা বলছে না। ওরা অনন্যা এবং আবুল ফতেহ খানের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। ইরফান সঙ্গীদের ইশারা করতেই ওরা অস্ত্র নামিয়ে রাখল।
হাসলো অনন্যা। "আমাকে বিশ্বাস করলেন? কিন্তু কেন? যদি বাইরে পুলিশ এসে থাকে?"
সঙ্গীরা অস্ত্রের দিকে হাত দিতেই ইরফান ইশারায় তাদের অস্ত্র উঠাতে বারণ করলো। ওরা নিষ্ক্রিয় রইলো।
"আপনি কেন এসেছেন বলুন?" ইরফান জানতে চাইলো।
"আমি আপনার হৃদয়ে কিছু মানবতার আলোর সন্ধান দেখতে পেয়েছি। তাই এসেছি আপনাকে সত্যের পথে নিয়ে যেতে। আপনি কি আমার সাথে একই ভেলায় সঙ্গী হয়ে যাবেন চিরসত্যের পথে?"
হাসলো ইরফান। হা হা হা করে পাগলের মতো হাসি। সেই হাসি সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে আবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। হাসি থামিয়ে যেন কৌতুকের ছলে বলতে লাগলো, "আপনি জানেন না কে আমি! যদি জানতেন তাহলে এ কথা বলতেন না!"
"কে আপনি? কী পরিচয় আপনার?" অনন্যা যেন বিমোহিত হয়ে পড়েছে।
"আমি ইরফান। আমার বাবা-মা, ভাই-বোনদের হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে। আর হারিয়েছি আমার মনের মানুষটিকে। তার নাম মুক্তা। পুরো নাম মুক্তা ইয়াসমিন, যাকে আমি পৃথিবীর কোটি কোটি টাকা মূল্যের হীরা-জহরতের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। সেই তাকেও হারিয়েছি। আপনজনদের হারানোর দুঃখ-কষ্ট যাতনা এবং একাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, সহিংসতা, অন্যায় হত্যাকাণ্ড আমার বুকে কষ্টের আগুনের পাহাড় হয়ে জমেছে। তাই আজ আমি মনের ভিতর ভালোমানুষটিকে, আমার ব্যক্তিত্বকে চির নির্বাসন দিয়েছি। আজ আমি আর ইরফান নই, একজন চরমপন্থি। কোনো মানুষ চরমপন্থা গ্রহণ করে কেন জানেন? জানেন না। যারা স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণ করেছে তারা কোনোদিনও জানতে পারবে না এ দেশ গঠনের প্রকৃত ইতিহাস। যারা এ দেশের জন্যে প্রকৃত অর্থে রক্ত ঝরিয়েছে, প্রিয়জনকে হারিয়েছে তাদের এই আত্মত্যাগের কথা অনেকেই জানে না। এই আমি ইরফান। আমার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ওঠেনি। কোনোদিন কেউ জানবেও না যে, ইরফান নামের কথিত সন্ত্রাসী চরমপন্থি মানুষটি একাত্তরের একজন নির্ভীক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। যে কি-না দেশের জন্যে, মাতৃভূমির জন্যে, দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা লাঘবের জন্যে নির্বিকারে একের পর এক ট্রিগারে চেপে পাক-হানাদার ও তাদের দোসরদের ভূপাতিত করেছিলো।"
ইরফান একটু দম নিলো। পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি পান করলো। তারপর বলতে লাগলো, "এভাবেই ইরফান নামের যোদ্ধারা মনের কষ্টে যুদ্ধ করে মরে, শহীদ হয়। কেউ তাদের খবরও রাখে না। মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদদের কাতারে তাদের নামও উঠে না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বাহাদুর হিসেবে খ্যাতি পায় একাত্তরের গণধর্ষণকারী আল-বদর, রাজাকাররা। ওরা মন্ত্রীদের সাথে ঘুরে বেড়ায় সরকারি গাড়িতে। ওদের আজ গাড়ি-বাড়ি সুউচ্চ ইমারত। কোটি কোটি টাকার মালিক ওরা। দেশ স্বাধীন হবার এতদিন পরও কেন ওদের বিচার করা গেলো না। যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মীরজাফর, রাজাকারদের অন্যায়ের জন্যে বিচার না হয়, তাহলে আমার মতো ইরফানের বিচার হবে কেনো? কেনো?" ইরফানের বজ্রমুষ্টির প্রতিঘাতে বিদ্যুৎগতিতে আঘাত হলো পাশের টেবিলটাতে। সবাই কেঁপে ওঠলো।
আবার বলতে লাগলো ইরফান, "কিন্তু পবিত্র দেশমাতা দেশের সাহসী সন্তানদের কখনো ভুলে না। এই যেমন ভুলিনি আমি। আমি আজও যে বেঁচে আছি, একথা কেউ জানে না। কারণ আমি জানতে দেইনি।"
"কেন জানতে দেননি?" প্রশ্ন করলো অনন্যা
"তুমি বুঝবে না স্বাধীনতার পরে জন্ম গ্রহণকারিণী মেয়ে! তুমি বুঝবে না। এ বুকে দুঃখ-যন্ত্রণা ও সীমাহীন কষ্টের প্রচণ্ড লাভার উদ্গীরণ হচ্ছে। স্বজন হারানো স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কি এখনও পেরেছি নিম্নশ্রেণীর অভুক্ত মানুষের মুখে আহার জোটাতে? আমরা কি পেরেছি, একাত্তরের স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করতে? আমরা কি পেরেছি, বেকার যুবকদের কাজের সন্ধান দিতে? কী পেরেছি আমরা? পেরেছি শুধু অমূলক বিষয় নিয়ে অযথা দলাদলি, মারামারি করে জনগণকে প্রতারিত করতে। আর পেরেছি, গরিব মেহনতি মানুষদের ঘামের অর্থগুলো শোষণ, দুনীতি করে বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়তে। কালো টাকার প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে আজ আকাশচুম্বী প্রায়। গরিবরা যা আয় করে, ব্যয় তার চেয়ে হাজারগুণ; ফলে তাদের জীবন-জীবিকা থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষ না খেয়ে ডাস্টবিনের কাছে মরে পড়ে থাকে এখনো, যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। দেশের লুটেরারা দেশটাকে দুনীতির শীর্ষে ৫ বার আরোহণ করিয়েছে- এ ছাড়া আর কী পেরেছি আমরা। বলো, জবাব দাও অনন্যা।" আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো যেন জ্বলে উঠলো ইরফান নামের এ চির সংগ্রামী যুবকটি।
অনন্যা নির্বাক।
"তুমি আমাকে আলোর পথে নিতে এসেছ? কী লাভ আমি একা আলোর পথে যেয়ে? যেখানে সারাটা দেশ অন্ধকারে ডুবে আছে, সেখানে আমি একজন সুবিধাভোগী হয়ে কী লাভ! তার চেয়ে আমার অন্ধকারের পথই ভালো। হয়তো আমার মৃত্যু হবে পুলিশের একটি গুলিতে। কিন্তু আমার সহযোদ্ধারা থাকবে। তাদের মাঝে বেঁচে থাকবো আমি। যতদিন বেঁচে থাকি, দুনীতি, শোষণের বিরুদ্ধে লড়ে যাবে আমি ও আমার সঙ্গীরা।"
অনন্যা তাকিয়ে আছে ইরফানের দিকে। সে ভাবে, যে ইরফানের হাতে মরেছিলো রাজাকার, হানাদার বাহিনী, আজ সে ইরফান চরমপন্থি সন্ত্রাসী। কিন্তু কেন? কী চায় সে? কেন বেছে নিয়েছে চরমপন্থা? শুধুই খুন-খারাবির জন্যে? ডাকাতি করার জন্যে, নাকি এর মধ্যে কোনো সত্য লুকিয়ে আছে?
"আপনার মতো লোকের খুবই দরকার এ সমাজে।" বলতে লাগলো অনন্যা। "কিন্তু এভাবে নয়। আজ দেশ স্বাধীন। আমরা জানি, দেশে শোষণ-দুনীতি আছে, জনগণের মনে পাওয়া-না পাওয়ার কষ্টের পাহাড় আছে। এটি সত্যি কথা। সেজন্যে তো অস্ত্র দিয়ে এভাবে লুটতরাজ, খুন-খারাবি করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। অস্ত্র ছাড়া, লাঠি ছাড়া কি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়? পৃথিবীতে সত্যিকারার্থে অস্ত্র দিয়ে কোনোদিন চিরশান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ভালোবাসা, ত্যাগ, ধৈর্য, অধ্যবসায় দিয়ে।"
চার.
চরম সত্যটি ক্রমে ক্রমে ইরফান ও তার সঙ্গীদের বুঝাতে লাগলো অনন্যা। অনন্যার অকাট্য যুক্তির কাছে ইরফানরা হেরে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে চরমপন্থা কোনো শান্তির পথ নয়, আলোর পথ নয়। মানুষের মুক্তির ধূয়া তুলে দেশেকে অস্থিতিশীল করা কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের কাজ নয়। দেশকে সত্যিই যদি ভালোবাসি, তাহলে আমাদের সবারই ভালো হতে হবে। সন্ত্রাসের পথে সত্য আসে না। সত্য আসে হয়তো গভীর কোনো এক চন্দ্রমাখা পূর্ণিমা রাতে, কাউকে না জানিয়ে। তারপর সে ধীরে ধীরে মিশে যায় সাধারণের মাঝে। মানুষের বুকে যখন সৃষ্টিকর্তার ভীতি জাগরিত হয়, তখন সত্য মাথা তোলে সুদূর আকাশে। আর যখন মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়, অন্যায়-অসত্য, দুনীতি, ক্ষমতা অপব্যবহার করে, সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে অশান্তির আগুন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানিরা যেমন করে বাংলার মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের মনে কষ্টের সীমাহীন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, আর সেই অধিকারকে ফিরিয়ে পেতে- সত্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আমাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিলো '৫২, '৬৯, '৭১ সালে। নির্দয় পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের ওপর যখন অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলো তখন সত্য ও ন্যায়ের পথ বেরিয়ে এসেছে চুপিসারে- তবে বহু প্রাণের বিনিময়ে। স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের সব সময় মূল্যায়ন করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে।
পাঁচ.
আজ ইরফানকে অন্যরকম লাগছে। যেন এইমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে। মনের ছাইচাপা কষ্টের পাহাড় নেমে গেছে তার, যে কষ্ট নিয়ে অনেক কাল ইরফান এগিয়েছিলো অন্ধকারের পথে।
অনন্যার হাত ধরে সামনে এগুচ্ছে ইরফান। সামনে তাদের আলোকিত জোছনার মতো নির্ভেজাল সত্যের পথ, পেছনে অন্ধকার।