পাখির কল-কাকলী, বাতাসের মর্মর শব্দ, সাগরের উচ্ছ্বাস ভালো লাগারও একটা সময় আছে। চারদিকে যখন সুখের ঘনঘটা, মন যখন স্বপ্নের জাল বুনে, শান্তিময় মন-প্রাণে সবকিছুই ভালো লাগে। কিন্তু আজ আমার মন ভালো নেই। তাই পৃথিবীর সব কোলাহল, স্বজনদের বন্ধন ছেড়ে আজ আমি চলে এসেছি এখানে।
যেখানে এখন বসে আছি, সেটা একটা বিশাল ঘন বাগান। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। একটা গাছে পাখিদের কিচির মিচির চলছে অনবরত। অন্যসময় কোনো এক ভালোলাগার মুহূর্তে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করতাম। অথচ এ মুহূর্তে তা' লাগছে চরম বিরক্তিকর।
কী করবো, তা-ই ভাবছি বসে। গাছটায় একটা ঢিল ছুঁড়লে কেমন হয়? পাখিরা গাছ ছেড়ে পালাবে? আমার তা' মনে হয় না, বরং মনে হয় ওদের কিচিরমিচির আরো বেড়ে যাবে। বরং সবচে' সহজ সমাধান- আমি নিজেই স্থান ত্যাগ করি।
সন্ধ্যা সমাগত। উঠে দাঁড়ালাম। কোথায় যাবো তা' ভাবছি। আমার তো আর যাবার কোনো জায়গা নেই। আসলে আমি নিজে কে, কোথায় আমার গন্তব্য এ মুহূর্তে তা' যেন আমি ভুলেই গেছি। ভুলে যাবার যথেষ্ট কারণও আছে। জীবনের ওই সময়টায় ভাবতাম, 'পৃথিবীতে প্রেমই সব। প্রেম আছে বলে পৃথিবী তার কক্ষপথে অবিরত ঘুরছে। আমরা সবাই প্রেমের বদৌলতে বেঁচে আছি।' কথাগুলো মনে হলে এই নির্জন জন-মানবহীন পরিবশেও আমার হাসি পায়। প্রচণ্ড হাসি পেলোও। হাসতে লাগলাম মানসিক রোগীর মতো। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেলো। এক সময় বসে পড়লাম নরম দূর্বাঘাসের ওপর।
গাছ থেকে একটা আম পড়লো আমার মাথার ঠিক মাঝখান বরাবর। প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। কিন্তু হায়! ব্যথায় আমার চোখে অশ্রু এলো না। মস্তিষ্কসহ দেহের স্নায়ুগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। আঘাত পেলে কান্না আসে না। অনেক চেষ্টা করলাম কাঁদব বলে, কিন্তু 'পাথর হৃদয় কাঁদতে জানে না'-এমনই হয়ে গেলাম।
এবার তাকালাম আমার মাথায় পড়া আমটার দিকে। নিউটন 'আপেলের পতনের কারণ' খুঁজতে গিয়ে ইউরেকা, অর্থাৎ পেয়েছিলেন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অজানা তথ্য। আমি কী পাবো?
না! আমার পাবার কিছুই নেই, আর হারাবারও কিছু নেই। কারণ, আমি একজন নিঃস্ব এবং রিক্ত মানব সন্তান। আমি উঠে মাথায় পড়া আমটি খেতে লাগলাম। কী মিষ্টি আম! ভেতরে কোনো পোকাও নেই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমি আস্তে আস্তে নির্জনতার আধার ছেড়ে লোকালয়ের উদ্দেশ্যে পা' বাড়ালাম। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। আমি গহীন অরণ্য ছেড়ে একটা বড় রাস্তামত জায়গায় এলাম। রাস্তা ধরে সামনে এগুতে থাকলাম। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও কেউ নেই। এমন সময় বহুদূর থেকে ভেসে আসা আর্তচিৎকার কানে প্রবেশ করলো।
ভূতপ্রেত হবে হয়তো! আমি ভাবলাম। কিন্তু আমি তো ভূতপ্রেত বিশ্বাস করি না। যদি করতাম, তাহলে এই গহীন অরণ্যে কীভাবে একা পথ চলছি!
আবারো চিৎকার। তবে চিৎকারটা এবার যেন খুব কাছেই মনে হলো। আমি চিৎকার রহস্যের প্রতি কান খাড়া করলাম। এবার চাপা শব্দ, 'চুপ! শব্দ করলে তোকে মেরেই ফেলবো।'
রাস্তার চারদিকে ঘনঝোঁপ। আমি সামনে এগুচ্ছি। কিছুদূর এগুতেই মুঠো ফোনের অস্পষ্ট আলো-আঁধারে যা দেখলাম, তাতে মাথায় রক্ত উঠে গেলো। দু'জন মোটাসোটা লোক এক কমবয়সী কিশোরীকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে। আমি কাছে যেতেই লোক দুটো পালালো। কিশোরী মেয়েটি মুহূর্তেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার পানে।
'কোনো ভয় নেই তোমার।' আমি অভয় দিয়ে বললাম। 'বাড়ি কোথায় তোমার?'
কিশোরী মেয়েটি আমার আরো কাছে এলো। এবার মেয়েটির চেহারা আমার কাছে কিছুটা স্পষ্ট হলো।
মেয়েটি জানালো ওর নাম, জিনজিয়া। তাকে ওই লোকগুলো এখানে জোর করে ধরে এনেছে।
'তোমার বাড়ি কোথায়?' আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।
হাত ইশারায় দূরের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, 'তুমি তোমার বাড়ি চিনতে পারবে?'
সে হাঁ সূচক উত্তর দিলো।
জিনজিয়া আমাকে পথ দেখিয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। যখন বাড়ির কাছে পেঁৗছলাম তখন গভীর রাত। একটা পুরাতন ভাঙ্গামতো বাড়ি। বাড়িতে পেঁৗছেই আমি অবাক হলাম। বাড়ির ভেতরে মানুষের বাসযোগ্য কোনো কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটি স্যাঁতস্যাঁতে কামরায় একটি পুরাতন ভাঙ্গা খাটিয়া। আমি তাকে বললাম, তোমার বাবা-মা কোথায়?'
'বাবা-মা নেই।' সংক্ষিপ্ত উত্তর জিনজিয়ার।
আমি মর্মাহত হলাম মেয়েটি এতিম বলে। বললাম, 'তুমি কি একা থাক?'
'না, ওরা থাকে।' দেয়ালে আঁকা কয়েকটি প্রাচীন আমলের মানুষ আকৃতির তৈলচিত্রের দিকে তাকিয়ে বললো সে।
আমি হাসলাম। বললাম, 'এগুলো তো নিষ্প্রাণ। এগুলো কি তোমাকে সঙ্গ দিতে পারে? একা থাকতে তোমার সমস্যা হয় না?'
'না। এরা নিষ্প্রাণ নয়, জীবিত। এই যে, দেখছেন একজন মহিলার ছবি, ওনি আমার মা। আমার মা সব সময় ছায়ার মতো আমার পাশে থাকে।'
আমি ওর মা'র তৈলচিত্রের দিকে তাকালাম। বললাম, 'তোমার মা কবে মারা গিয়েছেন?'
'আমার মা জীবিত। কিছুদিন পর তিনি একটা এক্সিডেন্ট হবেন। শুনুন আরেফিন সাহেব, আমি জানি আপনি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আপনার মনটা কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্ত বলে আপনি এই বনে এসেছিলেন। আর আমারও সৌভাগ্য আপনার মতো মহৎ হৃদয়ের মানুষের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম বলে আপনি আমাকে উদ্ধার করেছেন। আপনি আমার উপকার করেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ, তাই আমি আপনার একটা উপকার করতে চাই। আসুন আমার সঙ্গে।'
যারপরনাই অবাক হলাম আমি। মেয়েটিকে আমি আমার নাম জানিয়েছি বলে তো মনে হয় না। সে আমার নাম জানে কি করে?
জিনজিয়া হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলো পাশের কুঠুরিমতো একটা ঘরে। সেখানে আমাকে নিয়ে একটা গুপ্ত সিঁড়িপথ দিয়ে নেমে গেলো নিচের দিকে। ঘরটা আলোময়, কিন্তু কোথায় থেকে আলোর উৎপত্তি তা দেখা গেলো না। জিনজিয়া একটা পুরাতন জরাজীর্ণ আলমিরা খুলে একটা কালো কাপড়ে মোড়া থলে আমার হাতে দিলো।
আমি বললাম, কি এটা?
'আপনার ভাগ্য বদলে দিবে।' বলতে লাগলো সে, 'এতে আছে অনেকগুলো হীরে। আর্থিক অসামর্থবান বলে আপনার প্রিয়জনরা আপনাকে আঘাতে জর্জরিত করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আপনি এই হীরেগুলো বিক্রি করে নিজের জীবনটাকে ভালোভাবে গড়ে তুলবেন। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, যখন দেখবেন কোনো কারণে এ সম্পদ আপনার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন শুধুই অসামর্থবান বা কোনো অসহায় মানুষকে দান করে দেবেন।'
আমি বললাম, 'তুমি বললে তোমার মা জীবিত এবং তিনি কিছুদিন পর এক্সিডেন্ট হবেন। কথাটার মানে বোঝালাম না। এছাড়াও তুমি আমার নাম, ব্যক্তিগত সব ব্যাপারগুলো জানো দেখছি। এটা কিভাবে সম্ভব? এই নির্জন জায়গায় তোমার মতো পনের বছর বয়েসী একটি মেয়ে একা থাকাটাও কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।'
মেয়েটি খিলখিল করে হাসল। সে হাসির প্রতিধ্বনি ঝনঝন করে চারদিকে বাজতে লাগলো। ঘরের মাঝে কেমন যেন একটা অস্পষ্ট স্বর্গীয় আলোর প্রতিসরণ ঘটলো। জিনজিয়ার হাসি ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে জিনজিয়া আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি ডাকলাম, জিনজিয়া, জিনজিয়া।
অদৃশ্যস্থান হতে জিনজিয়া অস্পষ্টভাবে বলল, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন, আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।'
আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো, ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম আমার জানা নেই। ঘুম থেকে উঠে হাত ঘড়িতে দেখলাম সকাল দশটা বাজে। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি একটা খোলা প্রান্তরে শুয়ে আছি। চারদিকে শুধু গাছ-গাছালি। উঠে বসলাম, ভাবতে লাগলাম পূর্বোক্ত ঘটনাগুলো কি আমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখেছি, না সত্য ঘটনা। হঠাৎ আমার পায়ের কাছে একটা থলে গোচরীভূত হলো। সেই থলেটা, যেটা জিনজিয়া আমাকে দিয়েছিলো। আমি থলেটা খুললাম, সত্যিই তাতে আছে অনেকগুলো হীরে, সূর্যের আলোয় একরাশ আলোর ঝলকানি শুরু হলো সে হীরেগুলো থেকে।
হীরেগুলো বিশ কোটি টাকায় বিক্রি করলাম। ঢাকার কাঁঠাল বাগানে দো-তলা বাড়ি করলাম। বাড়ির বেলকনিতে সব ধরণের ফুলের টব, অ্যাকুরিয়াম দিয়ে মনের মতো করে সাজালাম। দামী দামী আসবাব-পত্র কিনে আমার লেখার ঘর ভরিয়ে ফেললাম। বাড়িতে একজন গৃহভৃত্য রাখলাম। আমার সব কাজে সাহায্য করে সে।
প্রতিদিনই আমার বাড়িতে গরীব দুঃখী মানুষের আনাগোনা হতে লাগলো। আমি ইচ্ছেমতো মানুষদের দান করতে লাগলাম। আমার প্রিয়জন, যারা আমাকে গরীব বলে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলো তারা আমাকে ঈর্ষা করতে লাগলো আমার শান শওকত দেখে। কেউ কেউ আমার শরণাপন্ন হলো, দয়া ভিক্ষা চাইলো। আমি কাউকে ফিরিয়ে দিলাম না। সবাইকে দান করতে লাগলাম। ফলে আমার গুণকীর্তন, টাকার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
একদিন বাড়িতে বসে বসে উপরোক্ত ঘটনা নিয়ে একটা উপন্যাসের কাঠামো দাঁড় করাচ্ছিলাম, এমন সময় আবির্ভাব হলো চারজন মানুষের। ওরা আমাকে সালাম জানিয়ে আমার চতুর্দিকে বসে পড়লো। আমি গৃহভৃত্যকে চায়ের ফরমায়েশ দিলাম। ওরা বলল, আমরা চা পান করতে আসি নাই, এসেছি আপনার কাছে সরকারি কাজে।
'সরকারি কাজে?' আমি অবাক হবার ভাণ করলাম।
'হ্যাঁ, আপনি কি চাকুরী করেন, না ব্যবসা করেন?
'লেখালেখি করি।'
'কোনো বই বাজারে প্রকাশ হয়েছে?
'একটা মাত্র বই, নাম- অন্ধকারে আমি একা'।
'একটি মাত্র বই লিখে আপনি কয়েক কোটি টাকার মালিক হলেন কী করে? কোথায় পেয়েছেন এত টাকা?'
'আমাকে একজন দান করেছে?
'এত টাকা কে দান করলো আপনাকে?'
'পনের বছর বয়েসী একটা মেয়ে?
ওরা সবাই হেসে উঠল। একজন বলল, লেখক মানুষ তো, তাই আবেগ প্রকাশ করছে। শুনুন সাহিত্যিক সাহেব, সরকারি কাজে আবেগ চলে না। আমরা দুনীতি দমন কমিশন থেকে এসেছি। এই ফরমগুলো পূরণ করে অফিসে জমা দেবেন, এখানে আপনার অর্জিত টাকার উৎস, পরিমাণ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব ইত্যাদির বর্ণনা দিয়ে দিবেন। পনের দিনের মধ্যে যদি ফরমগুলো জমা না দেন তাহলে আপনি এ্যারেস্ট হবেন।'
লোকগুলো চলে গেলো। আমি ভাবছি কি করবো। এমন সময় ল্যান্ডফোন বেজে ওঠল। আমি রিসিভার তুললাম। কানের কাছে নিতেই গমগমে একটা কণ্ঠ বলল, আপনি আরেফিন সাহেব না?
'জি।'
'আমরা পিচ্চি ইলিয়াছের লোক।'
'আমার সাথে তো কোনো পিচ্চি মানুষের সম্পর্ক নেই ভাই।' আমি বিনয় করে বললাম।
ধমকে উঠলো কণ্ঠস্বর। 'স্যার বলে কথা বলুন, নামে পিচ্চি কিন্তু কাজে নয়। ভালো করে শুনুন, শুনতে পেলাম আপনি নাকি খুব দয়াবান লোক। মানুষকে অকাতরে দান খয়রাত করেন। তাই আপনার কাছে ফোন করলাম।'
'বলুন কী চান?'
'আমরা দশকোটি টাকা চাই। দেশটাকে সোনার বাংলায় গড়ে তোলার জন্য টাকাটা আমাদের প্রয়োজন।'
'দেশটাকে সোনার বাংলা গড়বেন, না নিজের উদরপূর্তি করবেন।'
'দেখুন বেশি প্যাঁচাল পাড়বেন না। টাকা রেডি করে রাখবেন, নইলে আপনার মুণ্ডুটা ঘাড়ে থাকবে না।' লোকটা লাইন কেটে দিলো।
আমার মাথা থেকে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ঘামে শরীর একসা হয়ে গেলো। কি করবো আমি? যখন নিঃস্ব ছিলাম, ভালোই ছিলাম। কোনো ঝামেলায় ছিলাম না, এখন অঢেল টাকা নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়ে গেছি। টাকার উৎস'র হিসাব দিতে হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের কথা শুনতে হচ্ছে, এরপর না জানি আরো কি কপালে আছে! মনে পড়লো, জিনজিয়া বলেছিলো, যখন দেখবেন কোনো কারণে এ সম্পদ আপনার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন শুধুই অসামর্থবান কোনো অসহায় মানুষকে দান করে দেবেন।'
এর মধ্যে কয়েকদিন গত হলো। পেলাম না তেমন কোনো অসামর্থবান মানুষ। গতকাল রাতে দুনীতি দমন কমিশন থেকে ফোন এসেছিলো, ফরম জমা দেইনি বলে ওরা বলেছে আগামীকাল আসবে আমাকে এ্যারেস্ট করার জন্য। পিচ্চি ইলিয়াছের লোকেরাও ফোন করেছে আমি বলেছি আগামীকাল সকাল দশটায় আসার জন্য। আমি আজ বসে আছি একজন অসামর্থবান মানুষের আসায়।
বসে বসে চা পান করছি। এমন সময় এলো একটি চৌদ্দ পনের বছর বয়েসী কিশোরী মেয়ে। মেয়েটির গড়ন অবিকল জিনজিয়ার মতো। আমি বললাম, জিনজিয়া তুমি?
'আমার নাম জিনিয়া।' মেয়েটি বলল। আমার মাকে সন্ত্রাসীরা নির্যাতন করেছে। তিনি মৃত্যুর সাথে লড়ছেন, ডাক্তার বলেছে মাকে বাঁচাতে হলে দরকার অনেক টাকা। আমি শুনেছি আপনি খুব দয়াবান লোক। আপনি যদি দয়া করে আমাকে কিছু টাকা দেন তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে।'
আমি খুব ভালো করে জিনিয়াকে দেখছি। একদম অবিকল জিনজিয়ার মতো। জিনিয়ার নাকের পাশে ছোট্ট একটি কাটা দাগ ছিলো, এ মেয়েটিরও তাই। যেন জিনজিয়ার ক্লোন।
'কী দেখছেন এমন করে?'
'তোমার না কী আসলেই জিনিয়া?
'জি। কেন, এই নামে কাউকে চিনতেন নাকি?'
'শোন মেয়ে, আমার এ অঢেল সম্পত্তি যার কাছে আমি পেয়েছি তার নাম জিনজিয়া। তোমার চেহারার সাথে অবিকল মিল। সে আমাকে বলেছিলো, যদি কখনো দেখি সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন শুধুই অসামর্থবান কোনো অসহায় মানুষকে দান করে দেবেন। এখন পরিস্থিতি যা বলছে, সব সম্পত্তি ধরে রাখা কঠিন হবে। তাই আমি তোমাকে সব দান করে যাবো। আমি বুঝেছি এ সম্পদের ভার বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিঃস্ব ছিলাম, তা'ই ভালো। সম্পদ ও সম্পত্তি শুধুই অনিষ্টকর। এতে আমার মঙ্গল হবে না। বরং আমার যা আছে সব তোমাকে দান করে ঘুরে বেড়াবো পথে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে, শুনবো পাখিদের কুজন, বাতাসের মর্মর শব্দ, সাগরের উচ্ছ্বাস। আর লিখতে থাকবো কবিতা, গল্প মনের মতো। লিখার জন্য বাধাহীন জীবন আজ আমার বড়োই প্রয়োজন।'
সম্পত্তির দলিলপত্র, ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদি জিনিয়ার নামে তৈরি করে তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলাম। পরদিন পুলিশ নিয়ে দুনীতি দমন কমিশনের লোকেরা এলো আমাকে গ্রেফতার করতে। তারা বলল, 'চলুন আমাদের সাথে।'
'কেন?' আমি প্রশ্ন করলাম।
'আপনি আপনার সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেননি। আপনি দুর্নীতিবাজ। দুনীতি ছাড়া এত টাকা-পয়সা করা একজন গরীব মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়।'
'আমার কোনো সম্পত্তিই এখন আর অবশিষ্ট নেই।' আমি নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিলাম।
ওরা থ' বনে গেলো। একজন বলল, কি বলেন মশাই, এত এত প্রপার্টিজ, ব্যাংক ব্যালেন্স সব কোথায় গেলো তাহলে।'
এমন সময় জিনিয়া এলো। আমি তাকে দেখিয়ে কমিশনের লোকদের বললাম, 'একে দান করে দিয়েছি।'
'লোকটা একটা ধান্দাবাজ বটে।' বলল একজন। 'সব কিছু ঠিক রাখতে নিজের মেয়ের নামে দান করে দিয়েছে।'
আরেকজন বলল, 'শুনুন মশাই, নিজের মেয়েকে দান করেও পার পাবেন না। হিসাব আপনাকে দিতেই হবে।'
'মেয়েটা আমার নিজের মেয়ে নয়, তাছাড়া ওর সাথে আত্মীয়তারও কোনো সম্পর্ক নেই।' আমি স্থির দৃষ্টিতে অবিচল কণ্ঠে বললাম।
ওরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। 'কি বলেন, পরের মেয়েকে সব দান করে দিয়েছেন? দাতা হাতেমতায়ী নাকি?' বলল একজন।
'না ওসব কিছুই নয়।' আমি বললাম, আমাকে এসব সম্পত্তি যে দান করেছিলো তার চেহারা ঠিক এই মেয়েটার মতোই।' আমি আমার সম্পদ ও সম্পত্তির টাকার উৎস সম্পর্কে তাদেরকে সত্য ঘটনা খুলে বললাম। তারা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। একজন বলে উঠলো, 'যত সব আজগুবি বানানো গল্প।'
এমন সময় কলিং বেলের তীক্ষ্ণ শব্দ হলো। আমি কমিশনের লোকদের বললাম, দেখুন আমার কাছে চাঁদা চাইতে পিচ্চি ইলিয়াছের লোকেরা এসেছে মনে হয়। আপনারা কি তাদের এ্যারেস্ট করতে পারবেন?'
ওরা আমার পানে হা করে তাকিয়ে আছে।
আমি ওদের উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুললাম। চার/পাঁচজন যুবক, লম্বা চুল, সানগ্লাস চোখে। একজন আমাকে বলল, 'টাকা রেডি করে রেখেছেন?'
এমন সময় ওদের চোখ পড়ল পাশে বসা পুলিশদের দিকে। তারা পালাতে চাইল। কিন্তু সব ক'টাই এ্যারেস্ট হলো।
পিচ্চি ইলিয়াছের দলের লোকদের নিয়ে চলে যাবার সময় কমিশনের লোকেরা গেলো, আমরা আপনার দিকে নজর রাখবো। দেখবো আপনার কথা সত্যি কি-না। যদি সত্যি না হয় তাহলে আপনি পস্তাবেন।'
জিনিয়ার মা'কে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তাকে দেখে অবাক হলাম। জিনজিয়া আমাকে যে তৈলচিত্রটি দেখিয়ে বলেছিলো, এটা তার মায়ের ছবি, বাস্তবে এখন জিনিয়ার মায়ের চেহারাও তেমন। অবিকল। যাই হোক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ওর মায়ের পূর্ণ চিকিৎসা করালাম। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠলেন।
সুস্থ হওয়ার পর জিনিয়া ওর মাকে অর্থ-সম্পদ প্রাপ্তির শুভ সংবাদ জানালো। তিনি এত অর্থ-সম্পদ পাওয়ার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমি বললাম, সবই সত্য। আপনারা অনেক সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন।
আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি। আমি বললাম, দেখুন আমি একটা রহস্যের সন্ধান পেতে আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি আমাকে সেই রহস্যের ইতিবৃত্ত জানাতে পারবেন?
'কি সেই রহস্য?'
'আমার পক্ষ থেকে আপনাদেরকে দান করা এই অর্থ-সম্পদ আমি জিনজিয়া নামে এক কিশোরীর কাছে পেয়েছি। জিনজিয়া তার মায়ের ছবি আমাকে দেখিয়েছিলো। এখন দেখছি সেই ছবি আর আপনার চেহারা একই রকম। আর জিনজিয়া আর জিনিয়ার চেহারাও একই রকম। জিনজিয়া নামে আমি যাকে জানি, আপনার মেয়ে জিনিয়া কি একজনই? দয়া করে আমাকে এই রহস্যের ইতিবৃত্ত জানালে খুশি হবো।'
জিনিয়ার মা আমার কথাগুলো খুব শান্তভাবে শুনলো। তারপর বললো, 'যদি জিনিয়ার মতো কাউকে আপনি দেখে থাকেন তবে নিশ্চয়ই সে জিনজিয়া। জিনিয়া আর জিনজিয়া আমার যমজ দুই মেয়ে ছিলো। একটা এক্সিডেন্টে জিনজিয়া মারা যায়। অথচ আপনি বলেছেন জিনজিয়া আপনাকে অর্থ সম্পদ দান করেছেন? কিভাবে সম্ভব সেটা। আমার মেয়েকে আমরা নিজে দাফন করে আমাদের গ্রামে কবরস্থানে মাটি দিয়েছি।'
'আমি অবশ্যই জিনজিয়াকে দেখেছি। সে আমাকে বলেছিলো তার মা বেঁচে আছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই এক্সিডেন্ট হবে। আর আপনিও ধরতে গেলে এক্সিডেন্ট হলেন। সে আমার ব্যক্তিগত সব কিছু এমনকি আমার নামটি পর্যন্তও আমাকে বলেছিলো। ব্যাপারটি নিয়ে আমি ভাবতে গেলে কেমন যেন আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।'
আমি আর কোনো কথা বললাম না। জিনিয়া ও তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলাম। তাকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন, আমি নাকি সবই স্বপ্নের ঘোরে দেখেছি।
আমি আবারো সেই বনের প্রান্তরে গেলাম। যে বাড়িতে জিনজিয়া আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো অনেক খোঁজাখুঁজি করে সেই বাড়িটির সন্ধান পেলাম। যেখানে আমার সাথে জিনজিয়ার কথা হয়েছিলো সেখানে ছোট্ট খাটিয়ার ওপর জিনজিয়া যেন শুয়ে আছে। আমি ডাকলাম, জিনজিয়া। কোনো উত্তর নেই। আমি জিনজিয়ার আরো কাছে অগ্রসর হলাম। দেখলাম তার মুখে হাসি। ডাকলাম, জিনজিয়া ওঠো। আমি তোমার সব সম্পদ তোমার কথামতো অসামর্থবানদের দান করেছি। তুমি খুশি হয়েছো তো?
জিনজিয়া উঠলো না। তার নাকের কাছে হাত রেখে দেখলাম শ্বাস-প্রশ্বাস বের হচ্ছে না। মৃত। যেন এই মাত্র তার প্রাণবায়ু গত হয়েছে।
হঠাৎ আমাকে বিস্মিত করে জিনজিয়ার শরীর থেকে একটা আলো ঠিকরে বেরুতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে সে আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, জিনজিয়ার শরীরটা ক্রমে ক্রমে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে এক সময় আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো।
কী ঘটলো আমি বুঝতে পারলাম না। আমি যা দেখলাম তা' কি সত্যি? কী রহস্য লুকিয়ে আছে জিনজিয়া নামক এই মেয়েটাকে ঘিরে? নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম।
পৃথিবীতে এমন কিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটে যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে, এর কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।