প্রিয় শিমুল
চিঠিটা শেষ পর্যন্ত পাবে কিনা জানি না। তবু আজকে লিখতেই হবে।
ঠিক কিভাবে, কোথা থেকে শুরু করব জানি না। গানের শুরু থেকেই করি। কবে থেকে গান আমার সাথে জড়িয়ে গেল , মনে নেই।বাবার কাছে শুনেছি আমার বয়স যখন চার বছর, তখন রেডিওতে 'পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে' গানটা শুনে শিখে ফেলেছিলাম।বাবার বন্ধুদের সামনে নেচে গেয়ে অস্থির! মেয়ের গানে বাবা মুগ্ধ হলেন। ঠিক করে ফেললেন তার মেয়েকে গান শেখাবেন।
মা আপত্তি করলেন, মুসলমানের মেয়েদের আবার গান নাচ শিখতে হবে কেন? কিন্তু আমার বাবা বললেন গান নাকি আল্লাহর দান, সবার গলায় হয় না। তাই এটাকে অবহেলা করা যাবে না।
বাবার উৎসাহে গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম, ভালোবেসে ফেললাম গানকে । বয়স যখন বারো , মা বললেন আর গান শিখতে হবে না। আমার কান্না দেখে মার মনও গলে গেলো। গান চলতে থাকলো। তার সাথে যোগ হলো কবিতা লেখা। আমার স্বপ্নের জগৎ তখন রঙিন। আমি ডানা মেলা পাখি, কল্পনায় পৃথিবী ঘুরে বেড়াই । গান নিয়ে এত মগ্ন থাকলাম, লেখা পড়ায় অনমযোগীতা বাড়তে থাকলো।
আমার বয়স যখন সতের, আন্তঃজেলা গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। মার মোটেই ইচ্ছা ছিল না আমি প্রতিযোগিতায় যাই। বাবা আমার ভরসা। বাবা নিয়ে গেলেন। আমি গাইলাম
'নয় এ মধুর খেলা--
তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা ॥'
তোমার বাবা সেই গান শুনে মুগ্ধ হলেন। আমি দেখতেও যে খারাপ ছিলাম, তা কিন্তু না। জানি না আমার আগের কোনো ছবি তুমি দেখতে পেয়েছ কিনা। হয়ত পাও নি, যতদুর জানি তোমার কাছ থেকে আমার সব স্মৃতি সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তোমার বাবা আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। বাবা মা খুব খুশি। এত ভালো শিক্ষিত পরিবার , বনেদী বংশ , টাকা পয়সার কোনো অভাব নাই। আর কি লাগবে? তাদের মেয়ে তো গান ছাড়া কিছুই পারে না। লেখা পড়ায় মন নেই, বিয়ে হলেই ভালো।
বিয়ে হয়ে গেল আমার। অল্প দিনেই আমার ডানা মেলা পাখিটা খাচায় আটকা পড়লো।
বনেদী পরিবারের বৌরা রান্না করবে, ঘর সামলাবে, ধর্ম কর্ম, স্বামী সেবা করবে- এর বাইরে তাদের কোনো জগত নেই। গানের চর্চা করার তো প্রশ্নই আসে না। গান নাচ তো বেদাতি কারবার। সারাদিন রান্না করা ছাড়া আমার তেমন কোনো কাজ নেই। তোমার বাবা অনেক সকালে চলে যেতেন কাজে ফিরতেন গভীর রাতে। মাঝে মাঝে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কবিতা লিখতে চেচ্ষ্টা করতাম। ছুটির দিনে কখনো তোমার বাবাকে গান কবিতা গুলো শোনাতে চেষ্টা করতাম। উনি বিরক্ত হয়ে বলতেন, এখন কি ঘ্যান ঘ্যান সুরু করলে? যে গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সে গান হয়ে গেল বিষ! আমি গুন গুন করে গান গাইলেও তার ভালো লাগত না।
আমি ঘ্যান ঘ্যান থামিয়ে দিলাম। আমার গান কবিতার রঙিন জগতকে ঢেকে ফেললাম বাস্তবতায়। তোমার বাবা অন্য নারীতে আসক্ত- বুঝতে পারলাম অল্প কিছু দিনেই। এক নারীতে তার আগ্রহ থাকে না বেশিদিন।
তোমার বাবা একবার আমাকে তার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক উঠতি কবি তার স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনালেন।কবিতার ভুল কেন জানি সহ্য হয়নি আমার। হঠাৎ আমি বলে ফেললাম, আপনার কবিতায় স্বর বৃত্ত ঠিক হয়নি।
কবি অবাক হয়ে তাকালেন! বেনারসরী শাড়িতে ঘোমটা টানা জুবুথুবু বউ এমন কথা বলতে পারে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি।
তার কিছু দিন পর একগুঁয়ে কবি বাড়িতে এসে হাজির, আমি তার কি এমন ভুল বলতে চেয়েছি- যেন কৈফিয়ত দেই।শ্বশুড় বাড়ির সবার চোখ বড় বড় হলো। কিন্তু আমার কেন যেনো ভালো লাগলো কিছুক্ষণ কবিতা নিয়ে কথা বলতে।
কিভাবে যেন দিন মাস ঘুরে যাচ্ছিল এই বনেদী বৌএর।বছর ঘুরতে তোমার জন্ম হলো। আমার ছোট্ট খেলার সাথী, আমার সুখ দু:ক্ষের সহচর।বৃষ্টির পর রং ধনুর মতো তুমি আসলে। আমার সব জমানো কথা তোমাকে বলি। তোমার কি মনে পড়ে সেসব?
তুমি যখন ঘুমাতে চাইতে না বা খেতে চাইতে না, আমার জং ধরা গলায় গান গেয়ে শোনাতাম। আমি গান গাইলেই তুমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে , চুপ চাপ খেয়ে নিয়ে, নয়তো ঘুমিয়ে পড়তে। একটু বড় হলে যখন, তখন আমার সাথে গান গাইতে চেষ্টা করতে।
সবার থেকে লুকিয়ে বাবার কাছ থেকে আমার পুরনো হারমোনিয়াম নিয়ে আসলাম। কত বছর পর হারমোনিয়ামটা স্পর্শ করলাম! আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার চোখে পানি এসেছিল। আমার চাকুরিজীবি বাবার হিসেবী সঞ্চয় থেকে কত সখ করে কিনে দিয়েছিলেন, কত সুরের খেলা খেলেছি এই হারমোনিয়ামে, প্রতিটা রিড আমার অতি চেনা , আপন। যেন হারিয়ে যাওয়া প্রানের বন্ধুকে পেলাম হাজার বছর পর।
ঘরের দরজা বন্ধ করে তোমাকে গান শেখাতে শুরু করলাম, তোমাকে শিখলাম নাকি নিজেকেই আবার শেখালাম , জানি না ।
বন্ধ ঘরের বাইরে সে খবর পৌছাতে দেরী হলো না।
আমার শ্বশুড় সাহেব আমার জন্য বিচার বসালেন। জুম্মা বারে সবাই নামাজ পড়তে যায় আর তার ঘরের বউ ছেলেকে গান শেখায়? এ কেমন বউ? আজকে থেকে গান সম্পূর্ণ বন্ধ। আমার অতি প্রিয় হারমোনিয়াম বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো ।
আমার স্বামী কিছু বললেন না, একবারও প্রতিবাদ করলেন না। এই গান ই তো বেধেছিল আমাদের দুইজনকে। এই গান আমার ভিতরে স্পন্দন, কেমন করে আমার স্পন্দন বন্ধ করে দিতে চাও তোমরা সবাই? আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই. কি এমন অন্যায় করেছি আমি?
তোমার বয়স তখন ছয় বছর। আমার শ্বশুর রায় দিলেন, আমার কাছে থাকলে ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে, ধর্ম কর্ম কিছুই শিখবে না। তোমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
আমার ছোট্ট সোনা ময়না পাখি, আমার গানের বন্ধু , আমার সুখ দুঃখের সাথীকে আমার থেকে সরিয়ে নেয়া হলো। যাওয়ার দিনের করুন দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলবো না। তোমার কি সেসব মনে পড়ে?আমার হাত থেকে তোমার হাত ছাড়িয়ে নেয়ার কথা?
আমি শূন্য হয়ে পড়ে থাকলাম। মনে হচ্ছিল এখানে আমি আর বাচতে পারব না, দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।
কবি সাহেব তখন এগিয়ে আসলেন। বিকেলে যখন বাড়ির অন্যরা ঘুমিয়ে থাকত , তখন ফোন করতেন। মিথ্যা বলব না, তার সেই সামান্য আগ্রহ আমাকে জাগিয়ে রাখত। ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আকড়ে ধরার মতো।
তোমার কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছি না, কারো কাছে কখন কৈফিয়ত দেইনি। তুমিই বোলো ,কারো ভালবাসা পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই? এ বাড়িতে কেউ তো আমাকে পছন্দই করত না, এক বাড়িতে থেকেও আমি এক ঘরে, সবার থেকে আলাদা। তোমার বাবা গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না তখন। তখন কবি সাহেবের সামান্য স্নেহ ভালবাসা আগ্রহ হাত পেতে নেয়া কি অন্যায়?
বাবা মার কাছে ফেরত যেতাম? বাবা তত দিনে আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেক দুরের দেশে। মা থাকেন ভাইয়ার কাছে। আমি কিভাবে যাব ভাইয়ের ঘরে বোঝা বাড়াতে।
কবির সাথে সখ্যতা বেড়ে গেল, একদিন তার হাত ধরে ও বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চাইলাম।
সমাজে ঢি ঢি পরে গেল। ছি ছি, নষ্টা মেয়ে মানুষ। স্বামী ছেলে ছেড়ে আরেকজনের হাত ধরে পালিয়ে গেলো!
কান বন্ধ করে কবির সাথে থাকতে শুরু করলাম। না, আমাদের বিয়ে হয়নি। বিয়ে হলেই কি মানুষের মধ্যে ভালবাসা হয়?
কবি আমার কবিতা গুলা বিভিন্ন পত্রিকায় ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন। নতুন হারমোনিয়াম কিনে দিলেন। ভাবলাম, ভালবাসার মানুষ আমার পাশে, মুক্ত হাওয়ায় ডানা মেলে উড়ার দিন আবার এসেছে। আমার কবিতার বেশ সুনাম ও হলো।
কিছুদিন পর দেখলাম আমার লেখা কবিতা নিজের নাম প্রকাশ করেছেন কবি। আমি অবাক হলাম। কবি বললেন, কবিতা ছাপা হয়েছে এটাই তো বড়, কার নাম গেল তাতে কি? আমরা দুইজন তো একই।
হতবাক হলাম! একটু লজ্জাও করলো না চুরি করতে! এত নিচে নামনে পারে মানুষ!
কিছুদিন পর আরেক আবদার, আমি যেন পুরো একটা কবিতার বই বের করার উপযুক্ত পরিমান কবিতা লিখে দেই, বই মেলায় কবির নমে সেটা প্রকাশ পাবে!
আমি বললাম, কবিতা তো রুটি বানানোর মত না, যখন খুশি যত খুশি বানিয়ে দিলাম। কবি তার নরম ভাবুক হাতে একটা চড় বসিয়ে দিলেন গালে।
তারপর আবার সেই একই খাচায় বন্দী হলাম। বাইরে সবার জন্য অতি অমায়িক কবি ঘরের ভেতর আগ্নেয়গিরি হলেন।তার সাথে থাকতে হলে তার কথা মত চলতে হবে। ভাবলাম, থাক, না হয় কবিতা লিখে দেই, তাতেও যদি কবি শান্ত থাকে, আমাকে একটু ভালবাসে। সবি মিথ্যা আশা।
আমি তো রাস্তার মেয়েদের থেকেও খারাপ, ঘর পালানো বউ। কেউ নেই আমার জন্য। ভালোবেসে সংসার করা আমার ভাগ্যে নেই।
আমি কবির আসল চেহারা বাইরে নিয়ে আসলাম। আমার তো হারানোর কিছু নেই।
আবার আমাকে নিয়ে অনেক কেচ্ছা কাহিনী হলো।কত বড় নষ্টা মেয়ে আমি। যে যা ভাবুক, তুমি কি একবার বুঝতে পারো আমি শুধু আমার আকাশে ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলাম, মুক্ত আর স্বাধীন। গান গাইতে চেয়েছিলাম, কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম, ভালবাসতে চেয়েছিলাম।আর কিছুই না।
তোমার হোস্টেলে অনেক চিঠি লিখেছি। পর জেনেছি তোমার হোস্টেল বদল করে দেয়া হয়েছিল যাতে কোনো ভাবেই আমি যোগাযোগ করতে না পারি। তোমাকে ফোন করে কথা বলতে চেয়েছি। তুমি কথা বলোনি । তুমি নিশ্চই তোমার এই খারাপ মা কে ঘৃনা করতেই শিখেছো , বড় দুর্ভাগ্য আমার।তারপরও কেন যে আমার মনে হয়, একমাত্র তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো।
কত বড় হয়েছো তুমি, পত্রিকায় তোমার সাফল্যের গল্প পড়েছি ।তুমি বিদেশে চলে যাচ্ছ,জানতে পেরেছি।
আমি খুব অসুস্থ। একবার আসবে আমার কাছে? আমার গানের সাথী, সুখ দুঃখের সাথী হয়ে একবার আসবে আমার সামনে? আমার মনে হয় তুমি একবার আসলেই আমার সব কষ্ট মিলিয়ে যাবে।
ইতি
তোমার মা