সেই ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম বাইরে পড়তে যাবো। দেশের গন্ডী ছেড়ে দূর কোন দেশে। ধার করে আনবো কিছু জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দৃষ্টিভঙ্গি। বুয়েটে পড়তে গিয়ে অনেক হিসেব নিকেশ গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। জীবনে কী চেয়েছি আর বাস্তবে কী পেয়েছি তার ছক কাটতে কাটতেই অনেকটা মূল্যবান সময় হেলায় হারিয়ে ফেলেছি। আমি আসলে খুব অতীত নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষই আছেন, যারা এক ফুঁ দিয়ে দুঃসহ অতীতকে ঝেড়ে ফেলতে পারে। অতীত তাদের কাছে শুধুমাত্র একটা যাপিত অধ্যায়। সুখময় অতীতকে তারা চারণ করে, কিন্তু বিবর্ণ অতীত কে বর্তমানের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
জীবনে অনেক ঠোক্কর খেয়ে এখন বেশ রেলিশ করে মানুষ দেখি আমি। কতো রঙের বিচিত্র সব মানুষ বাস করে এই পৃথিবীতে! কারো অতীতটা হয়তো একেবারেই বিবর্ণ, এতোটুকু রঙের ছিটেফোটা নেই কোথাও। অথচ সে তার মনের অসীম উদারতায় হাজার রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে নিজের জীবনটাকে। আবার কারো হয়তো পেছনে আছে অপার আলোর দিশা, কিন্তু তার জীবনের চলার পথে সেই আলোর উৎসটাকেই হয়তো হারিয়ে ফেলেছে সে। হতভাগ্যের মতো হাতড়িয়ে খুঁজতে চাইছে সামনের পথ। একদল মধ্যপন্থীও আছে এদের ভীড়ে, যারা অতীত থেকে শিক্ষা নেয়...ভবিষ্যতকে মাথায় রাখে আর বর্তমানকে জীবিত রাখে। জানি না, আমি কোন দলভূক্ত। এখানেও হয়তো আমি একাধিক পথের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিয়েছি।
মেঘে মেঘে ফুরিয়ে গেছে অনেক বেলা। মধ্যবেলাতে এসেও মনে হলো, সময় তো ফুরিয়ে যায়নি! এখনো তো ধুকপুক করে চলছে হৃৎপিণ্ড, শরীরের ইথারে ইথারে বয়ে চলেছে উষ্ণ রক্তের সঞ্জীবনী ধারা। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সময় একেবারেই তো শেষ হয়ে যায়নি। প্রত্যাশার বাঁধভাঙা ঢল হয়তো স্তিমিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার সাধ তো আমার এখনো মেটেনি!
ঠিক দশ বছর আগে একবার আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলাম। ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ এম এস শেষ করেছিলাম অনেক কষ্টে। চাকরিতে তখন সবে যোগদান করেছি। নয়মাসের ইয়াবড় একটা পেট নিয়ে থিসিস শেষ করেছি। কয়েক মাসের বাচ্চাকে বাসায় রেখে ডিফেন্স এও জয়লাভ করেছি। ইচ্ছে ছিল, তালে তালে পি,এইচ,ডি টাও করে ফেলবো। আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে থেকে কোনোমতে সেরে ফেলতে পারলেই হলো। কিন্তু একটা জিনিস খানিকটা বিস্মৃত হয়েছিলাম। তা হচ্ছে ভাগ্য!
এই বস্তুটি ভারী রসিক। মাঝে মাঝে খুব খুব জটিল সময়ে সে চু্পিসারে কাঁধে হাত রাখে। আশ্বস্ত করে বলে, ‘ভয় কীসের?’ সব যখন এলোমেলো হওয়ার কথা তখন ভাগ্য এনে ছেড়ে দেয় নির্ধারিত লক্ষ্যে। আবার সবকিছু যখন চলতে থাকে নির্ধারিত স্বাভাবিক গতিতে, আশংকা থাকে না কোনরকম ছন্দপতনের...তখন কোত্থেকে এসে যেন বাগড়া দেয় এই ভাগ্যই।
পি,এইচ,ডি’র চিন্তা স্থগিত রেখে ফিরে এলাম দেশে। একটি একটি করে চলে গেলো দশ দশটি বছর। দীর্ঘ বিরতি শেষে আবারো ভাগ্য চুপিসারে হাত রাখলো কাঁধে। কীভাবে কীভাবে যেনো আল্লাহ সবকিছু ঠিকঠাক মিলিয়ে দিলেন! গবেষণার কাজে আমার স্বামী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলো, সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়েই এম এস এর সুযোগ পেয়ে গেলাম। এবারের এম,এস এর বিষয় টা পাল্টে নিলাম কেবল।
আসলে এই লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল এদের শিক্ষাদান পদ্ধতির বিষয়ে কিছু কথা বলা। প্রসঙ্গান্তরে চলে এসেছি একেবারে। কী লিখতে গিয়ে কী লিখছি!
বাইরে পড়তে আসার ইচ্ছে মানেই উন্নত কিছুর সাথে পরিচত হওয়ার বাসনা। দেশে আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, এবং যেসব ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়াশুনা করে তারা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। সারা পৃথিবীর উন্নত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা অহরহই তাদের চুড়ান্ত মেধার প্রমান রেখে চলেছে। দেশের ভেতরে তো অবশ্যই দেশের বাইরেও অনেক অধ্যাপক ‘বুয়েট’ শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছেন এখানে অধীত শিক্ষার্থীদের মানের ভিত্তিতে।
কিন্তু ‘রেটিং’ বলে একটা শব্দ আছে। বিভিন্ন বিষয়ের মাপকাঠিতে এই রেটিং নির্ধারিত হয়ে থাকে। গবেষণার মান, এই বাবদ প্রদত্ত অর্থ, ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা, ছাত্র শিক্ষক অনুপাত, আন্তর্জাতিক ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা..এরকম আরো হাজার হাজার বিষয়কে বিবেচনা করে কষ্টিপাথরে যাচাই বাছাই করে এই রেটিং নির্ধারন করা হয়ে থাকে। আর বলাইবাহুল্য সেই কষ্টিপাথরের বিচারে বুয়েটের স্থান জুটেছে ১৫৯ তম হিসেবে। (QS world university ranking)
তাই রেটিং এ এগিয়ে থাকা বিশ্বমানের সেই সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞান আহরণের ইচ্ছেটা আমার সবসময়ই ছিল। কেমন তাদের পাঠদান পদ্ধতি, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক, ছাত্র ছাত্রীদের মেধাগত অবস্থান।
কিছুদিন হলো এসেছি মাত্র। এখনো সেভাবে সবকিছুর সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারি নাই। সবে মাত্র ইন্ডাকশন পদ্ধতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি বলা যেতে পারে।
প্রথমেই যেটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে, এখানকার অধ্যাপকদের অ-অধ্যাপকসুলভ আচরণ। বয়সজনিত ব্যবধান না থাকলে কে শিক্ষক আর কে ছাত্র বোঝা মুশকিল। দুজনেই যেন শিক্ষার্থী। উভয়েই উভয়ের কাছ থেকে শিখছে। শিক্ষক রা ছেলেমানুষের মতো ছাত্র ছাত্রীদের প্রশ্ন করছে। প্রচুর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এখানে। ইংরেজী বোঝা এবং বলতে পারার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন উদ্বেগ, আকুলতা তেমনি শিক্ষকদের মাঝেও প্রানান্তকর চেষ্টা সঠিক উচ্চারণে শিক্ষার্থীর নামটা উচ্চারণ করা।
প্রথমদিন বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচিত করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এখানে প্রচুর রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তাই রিপোর্ট কীভাবে লিখতে হবে সেটা নিয়ে আলাপচারিতা শুরু হলো। প্রথমেই ছিল একটা দু’ঘণ্টার ক্লাস। বিষয়, ‘রিফারেন্সিং।’
রিপোর্ট লিখতে গেলে নানা বিষয়ের রিফারেন্স দিতে হবে। অতএব বুঝলাম সেই বিষয়েই হয়তো গুরুগম্ভীর কোন লেকচার দেওয়া হবে। শিক্ষিকা এলেন, নাচতে নাচতে। চেহারা, আকৃতি, চলা বলার ধরনে একেবারেই বালিকা। এসেই আমাদের কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন টেবিলে বসতে বললেন। তারপরে সেই টেবিলগুলোতে একটা করে লেগোর বক্স এনে দিলেন। আমাদের বললেন, ‘তোমাদের প্রিয় প্রাণী কোনটি? আজ তোমরা তোমাদের প্রিয় প্রাণীটি বানিয়ে আমাকে দেখাবে। দেখি কে কতো ভালো বানাতে পারো। তোমাদের কাছে যেসব লেগো আছে সেসবের বাইরেও যদি আরো লেগো লাগে, আশ পাশের টেবিল থেকে নিতে পারো। সময় দশ মিনিট।’
আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। এ কী তামাশা! শেষমেষ এনিমেল? তাও আবার লেগো দিয়ে?! আমরা প্রানান্তকর চেষ্টা জুড়ে দিলাম। কেউ কাউকে চিনি না। গ্রুপ ওয়ার্ক হবে কীভাবে? একজন পা বানানোর চেষ্টা করি, তো একজন মুখ। মিলিতভাবে কিছুই হয়ে উঠে না। আমাদের টেবিলের অবস্থাই ছিল সবচেয়ে বেশি খারাপ। অন্য টেবিল গুলোতে স্বজাতীয় রা সুবিধামতো বসে নিয়েছে। তাই তাদের মধ্যে মিলিত একটা কিছু তৈরি করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল ভাবে দেখা দিলো। কিন্তু আমাদের টেবিল একেবারে আন্তর্জাতিক। কী নেই সেখানে? বাংলাদেশি(আমি স্বয়ং), ভারতীয়, চাইনিজ, কুয়েতী এবং ব্রিটিশ। আমি চুপচাপ আছি। যা পারি না তা নিয়ে কথা বার্তা না বলাই উত্তম। ভারতীয় মেয়েটি আগ বাড়িয়ে লিড নিলো। অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটার ঠ্যাং বানানোর চেষ্টা করলো। ব্রিটিশ মেয়েটি ভারি কিউট। সে দুটো চোখ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শেষপর্যন্ত একটা কিছুর মুখ বানিয়ে ফেললো। তবে সেটা কীসের মুখ বেচারা নিজেও বুঝতে পারলো না। ব্রিটিশ ছেলেটা ভেরি নাইস ভেরি নাইস বলে তাকে সাহস জুগিয়ে গেলো। কুয়েতী দুটো ছেলে ছিল। এরা ‘আই ক্যান মেক কাউ, ইট’স ইজি’ বলে শেষমেষ একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণির আকৃতি বানিয়ে ছাড়লো। নিজেই দিশেহারা হয়ে সেটার নাম দিলো ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাউ’। সেই বিরল বস্তুটি্র একটা ছবি তুলে রাখতে হতো। বিষয়টা মাথায় ছিল না।
অন্য টেবিল গুলোতে কুকু্র, বিড়াল, উটপাখী সব প্রাণীই অনায়াসে তৈরি হয়ে গেলো। একইসাথে আমরা বিভিন্ন টেবিল থেকে লেগো ধারাধারি করতে লাগলাম। প্রাণী বানানো শেষে আমাদের মুখটা একটু কালোই হলো। বুঝতে পারলাম, আমরা গাধার উপাধি পেতে যাচ্ছি। প্রথমদিনেই কী লজ্জা!
শিক্ষিকা এলেন। আমাদের ‘কাউ’ নিয়ে একটু মশকরাও করলেন। সবার এনিমেল দেখা শেষে মুখখানাকে হঠাত বেশ গম্ভীর করে জানতে চাইলেন, কোন কোন টেবিল থেকে আমরা কী কী ধার করেছি। যারা চমৎকার চমৎকার প্রাণী তৈরি করেছে তারা বলতে গেলে তেমন কিছুই ধার করেনি, আর করলেও কোথা থেকে করেছে তা ঠিকঠাক মনে করতে পারলো না। আমরা মার্কামারা প্রাণি তৈরি করলেও ধার করেছি দেদারসে এবং সেই সকল ধারের স্মৃতি আমরা হুবহু মনে রেখে দিয়েছি। অর্থাৎ ধারের উৎস মোটেও ভুলি নাই। শিক্ষিকা হঠাৎ আমাদের উপর বেজায় খুশি হয়ে উঠলেন। খুশির কারণ, আমরা রেফারেন্সিং এ কোন ভুল করি নাই। আমরা যারপরনাই টাশকী খেলাম। কীসের মধ্যে কী! কিন্তু ঠিক তো! এটাই ত রিফারেন্সিং! জিনিস খুব ভালো করে তৈরি করলাম, কিন্তু কার কাছ থেকে ধার করেছিলাম সেটাই ভুলে খেলাম তাহলে যা তৈরি করেছিলাম সেটা ঘোড়ার ডিম বৈ অন্য কিছু নয়।
সবচেয়ে সুন্দর প্রানী যারা তৈরি করেছিলো(উটপাখী)শেষ অবধি তাদের মুখটাই কালো হয়েছিল সবথেকে বেশি। উটপাখি তৈরি করার ব্যাপক তাগিদে তারা অন্য সব কিছু ভুলে গিয়েছিল।
আর আমরা! কালো থেকে সাদা কীভাবে হতে হয় সেদিন আমরা ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলী ব্যবহার না করেও জেনে গেলাম।
শিখতেই তো এসেছি! এভাবেও যে শেখানো যায় এটা কেন আমাদের কাছে আজো অজানা?
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।