শরাব মিয়ার দিন রাত

রাত (মে ২০১৪)

মোজাম্মেল কবির
  • ১০
কেউ কেউ অন্ধকার ভয় পায় কেউ আবার আলোকে। কারো কাছে অন্ধকার আয়নার মতো কারো কাছে দিনটা বড়ই বিব্রতকর। বাদুড় যেমন দিনের আলো সহ্য করতে পারে না। কারণ তার চোখের জ্যোতি এতটাই বেশী যে পরিষ্কার দেখতে তার সাধারণ আলোর প্রয়োজন হয় না।
শরাব মিয়ার কাছে দিন রাত সমান। বরং দিনের চাইতে রাতটাই তার কাছে বেশী পরিষ্কার। বয়স পঁয়ষট্টি। বয়স বাড়লে রাতের ঘুম চলে যায়। এই জন্যই মানুষ বয়স্ক গার্ড খুজে। এই বয়সে জৈবিক তাড়না থাকেনা। মৃত্যু চিন্তায় রাতটা পলকে পার হয়ে যায়। দিনে কিছুটা ঝিম ধরা ভাব আসে। কিন্তু উপায় কি।
চার তলার বাচ্চা ছেলেটা বিকেল বেলা এসে গল্প করে। শরাবকে বলে -আংকেল তুমি দিনের বেলা একটু ঘুমাতে পার না?
-অপু, তুমি কুকুরকে ঘুমাতে দেখেছো?
-হ্যা দেখেছি।
-কুকুর রাতে পাহারা দেয় দিনে ঝিমায়। ঘুমায় না। পাশ দিয়ে কেউ হেটে গেলে জাগতে হয় কুকুরকে। -আংকেল তুমিতো মানুষ।
-কিছু কিছু মানুষকে কুকুরের ডিউটি করতে হয়। এতে সম্মান যায় না।
তবে অসম্মান বোধ আছে একটা বিষয় নিয়ে। শরাব আবার মানুষের নাম হয় নাকি। অনেক বার প্রশ্ন জেগেছে মনে। নিজের নামটা তো আর নিজে রাখা হয় নি। বাবা রেখেছে। বাবা প্রচুর শরাব পান করতো। শরাবের নেশায় বুঁদ হয়ে প্রতি রাতে বাড়ি ফিরে মাকে মার ধর করতো। প্রিয় জিনিসের নামে ছেলের নাম রাখা। কয়েক বছর পরেই অনুতাপ আসে বাবার মনে। নাম পরিবর্তনের সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত তো কিছু একটা দিয়ে করতে হবে। ছেলেকে হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়। এতে যদি নিজের পাপ মোচনের কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।
শরাব হাফেজি শেষ করতে পারে নি। কয়েক পাড়া মুখস্ত করে ক্বারি হয়। একটা মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকুরী নেয়। আজান দিতে হয়। আজান দেয়া খুব কষ্টের কাজ তার কাছে। বুক ধড়ফড় করে। চাকরীটা বেশী দিন করতে পারে নি।

তার নতুন চাকুরীটা দারোয়ানের। ছয় তলা বাড়ির গেটে বসে থাকা। কে আসে কে যায়। কার কাছে যাবে। চোর ছ্যাচড় বাটপার ঢুকে পড়ে কি না। এই সব খেয়াল রাখতে হয়। কাজটা তার পছন্দ হয়েছে। পাঁচটি ফ্লোরে পাঁচ পরিবার থাকে।
দোতলায় থাকে নব দম্পতি । স্ত্রী নাটকে অভিনয় করে। দেখতে পুতুলের মতো সুন্দরী। স্বামীর এড ফার্ম আছে। সুখী সংসার। লিফট থেকে বের হয় এক জন অন্য জনের বগল বাধা হয়ে। গাড়িতে করে দুজন সন্ধ্যায় বের হয় ফিরে রাত একটায়। গা থেকে একেক দিন একেক রকম পারফিউমের গন্ধ আসে।
তিন তলায় থাকে একজন শিক্ষক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। একটা বাচ্চা ফেলে রেখে কিছু দিন আগে বউটা চলে গেছে স্বামীর এক ছাত্রের সাথে। খুব ভালো মানুষ। এমন ভালো মানুষের সংসার ছড়ে যে চলে যায় তার পোড়া কপাল। বাচ্চাটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর সংসার করবেনা বলে ঠিক করেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ক্বাযা হয় না তার। খুব মায়া হয় মানুষটাকে দেখলে।

চার তলায় একজন গৃহিণী থাকে একটা বাচ্চা নিয়ে। স্বামী মালয়েশিয়া থাকে। স্বামী বছরে এক বার এসে এক দেড় মাস দেশে থেকে আবার চলে যায়। এই মহিলার মুখ দেখার সুযোগ হয় নি শরাব মিয়ার। বোরকা পড়ে অপুকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতে দেখে শুধু। এমন ধার্মিক মেয়ে মানুষ আজকাল খুব কম দেখা যায়।

পাঁচ তলায় থাকে এক জন নেতা। সে সরকারী দলের রাজনীতি করে। এক মন্ত্রীর ভাগ্নে। বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। বিয়ে শাদী করে নি। কখন আসে কখন যায় ঠিক নাই। তার কাছে নানা রকম লোকের আসা যাওয়া। একা থাকে।

ছয় তলায় থাকে একজন বদ মেজাজি লোক। খুব রুক্ষ আচরণ। সালাম দিলে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। গাড়ি নেই। হেটে কিংবা রিক্সায় চলা ফেরা করে। তার কোন বন্ধু নেই। কি করে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। লোকটা নাকি একটা পত্রিকায় কাজ করে। কবিতা টবিতা লেখে বলে শোনা যায়। বউ বাচ্চা আমেরিকায় থাকে। বয়স ষাট বাষট্টি হবে। এই লোকটা সম্পর্কে সবার খুব বাজে ধারণা। লোকটা বেশ অসামাজিক। নেতার নাকে প্রয়ই গাঁজার গন্ধ আসে। তার ধারণা এই বেটা গাঁজা খায়।

এই মানুষগুলোকে নিয়ে শরাব মিয়ার জগৎ। মানুষ গুলোকে সবাই যে ভাবে চিনে শরাব চিনে অন্য ভাবে। অনুবিক্ষণ যন্ত্রে যেমন দই দেখলে ব্যাকটিরিয়া কিলবিল করতে দেখা যায়। রাত হচ্ছে সেই যন্ত্র। রাতে লাজুক নিস্পাপ মানুষকেও নির্লজ্জ দিগম্বর হাটতে দেখে শরাব মিয়া।

শরাব মিয়ার একটি রাত ছিল এমন। দোতলার স্বামীটি দেশের বাইরে শুটিং করতে গেছে। স্বামী দেশের বাইরে থাকলে বরাবরের মতো এক জন গেস্ট রাত্রি যাপন করে দোতলার ম্যাডামের সাথে। গেস্ট আসে পাঁচ তলার নেতার গাড়িতে করে। ভোর রাতে নেতা একটা বিদেশী মদের খালি বোতল শরাবের হাতে ধরিয়ে দেয়।

আরেকটি রাতের কথা। বেশ কয়ক বার শরাব মনে করেছে ভুলটা তার নিজের। কিন্তু সেই রাতে নিশ্চত হয় যে তার কোন ভুল নেই। শিক্ষকের ফ্লোরের লিফ্টের বাটন দুই কিন্তু সে চাপে তিন! সেই রাতে শিক্ষকের স্ত্রী ঘটনা টের পায়। এই নিয় কোন হৈ চৈ হয় নি। পর দিন শিক্ষকের স্ত্রী যখন চলে যায় স্বামীর ছাত্রের সাথে তা নিয়েও কেও মাথা ঘামায় নি। কার এতো সময় আছে কে কার সাথে শুতে গেলো তার খবর রাখার! সবারই তো নিজ নিজ ধন্ধায় সময় দিতে হয়।

সেদিন রাত তিনটার সময় ঘটনা। বুকে ব্যাথা উঠে শরাবের। ব্যাথায় চিৎকারের শব্দ দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত পৌছেনি। পৌছে ছয় তলার বদ মেজাজী লোকটার কানে। সেই লোকটাই শরাবকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শরাব সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দেয়।

এখনো আগের মতোই চলে শরাবের দিন রাত। দিনের আলোয় আর রাতের আঁধারে সব কিছু আগের মতোই চলে। রাতের আঁধারে যতটা পরিষ্কার দেখে দিনের আলোয় তা ভুলে যেতে হয়।

এখনো দিনের বেলা দোতলার দম্পতি বগল বাধা হয়ে লিফ্ট থেকে বের হয়। এখনো অপুর মা বোরকা পড়ে চলে। শিক্ষক নিয়মিত লিফ্টের তিন নাম্বার বাটন চাপে। নেতা অপেক্ষায় আছে যে কোন দিন গাঁজা সহ ধরে ফলবে ছয় তলার বদ মেজাজী লোকটাকে। এখনো বদ মেজাজী লোকটা ঠিক মতো সালামের উত্তর দেয় না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শামীম খান অন্ধকার নেমে এলেই দেখা যায় পশুদের । দিনের আলোয় তারাও মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ায় , মানুষের ভাষায় কথা বলে । চমৎকার লিখেছেন ভাই । শুভ কামনা রইল ।
আখতারুজ্জামান সোহাগ একজন গার্ডের রোজনামচা। পাঁচটা চরিত্র। লেখকের দেশ দর্শন, পাঁচ চরিত্রের মধ্য থেকে। বিশেষ বার্তা পেলাম গল্পটি থেকে। পেলাম উপস্থাপনে নতুনত্ব। সাধুবাদ লেখককে।
চমৎকার মন্তব্যের জন্য রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা... ভােলা থাকুন।
সকাল রয় দারুন লাগলো আমার কাছে
Salma Siddika এক ধাক্কায় গল্পটা পড়ে ফেললাম!! চরিত্রগুলো খুব চেনা, আমাদের চার পাশেই আছে. দারুন, ভোট করলাম এক্কেবারে টপ লেভেলে
কতোটা গুরুত্ব সহকারে পড়লে এমন মন্তব্য করা যায় আমি জানি... ভোটের চাইতে স্বীকৃতি অনেক অনেক বেশী মূল্যবান আমার কাছে। সেই জন্য শুধু ধন্যবাদ নয় সাথে রইলো কৃতজ্ঞতা... ভালো থাকুন।
biplobi biplob Shorab miya chorithrota darun futa utasa abaro.
আমাদের শরাব মিয়ারা আজীবন নিরব... ভালো থাকুন। অনেক ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন আমরা নিজেকেই ঠিকমত চিনিনা, অপরকে চিনব কীভাবে? ভাল লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইল
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।
আপেল মাহমুদ ভালো লিখেছেন। আসলে রাত অন্ধকার হলেও দিনের চেয়ে অনেক বিষয় পরিস্কার দেখা যায়। ধন্যবাদ লেখককে।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
দীপঙ্কর বেরা ভাল লাগল গল্পটি । রাত থেকে যায় রাতে
ওয়াহিদ মামুন লাভলু রাতের মূল্যবান চিত্রাবলী তুলে ধরেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
চার পাশে যা ঘটছে শুধু চেষ্টা করেছি চিত্রায়িত করতে... ভালো থাকুন আপনি।
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী