দেহান্তর

শুন্যতা (অক্টোবর ২০১৩)

মোজাম্মেল কবির

ডাক্তার হরি শংকর মহা বিপদে আছে রুগীটিকে নিয়ে। বছর খানেক ধরে কোন সুরাহা হচ্ছেনা। শরীরের সবকিছু একাধিক বার পরিক্ষা করে দেখা হয়েছে কোন সমস্যা নেই। রুগীটি প্রতি বার জ্বর নিয়ে আসে। ওষুধ দিলে তিন দিন পরে জ্বর কমে যায়। জ্বর উঠার কারণ বেশ অদ্ভুত, মন খারাপ হলে তার জ্বর উঠে । মানুষ দুর্বল চিত্তের হলে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে এর বেলায় বরং উল্টো । বয়স বিশ একুশ হবে। লিকলিকে শরীর কিন্তু চোখ দুটি ভরা আত্মবিশ্বাস। কথায় জড়তার লেশ মাত্র নেই। বাবার বয়সী কাউকে ঘাবড়ে দেয়ার মতো আজব ক্ষমতা রাখে। ওর মধ্যে অদ্ভুত একটা শক্তি কাজ করে কিন্তু কি শক্তি সেটা বুঝতে পারেনা ডাক্তার সাহেব । পনর দিন পর রুটিন চেকাপে আসলে ডাক্তার রুগীর অসুখ নিয়ে কথা বলছে এমন সময় রুগীটি বলে ডাক্তারকে- স্যার, আজকাল আপনি চোখের উপর খুব প্রেসার দিচ্ছেন।
-যেমন? রুগীর কথাটিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলো ডাক্তার।
-আপনি মনে হয় আজকাল অনেক রাত জেগে বই পড়ছেন।
-কিভাবে বুঝলে?
-আপনার নিজ হাতেই লেখা আমার রঞ্জু নামটা আজ আপনি দুই বার পড়েছেন রঞ্জন।
হুমায়ূন আহমেদের সবগুলো বই পড়া হয়নি হরি শংকরের। লেখক চলে যাওয়ার পর রাত জেগে পড়ে শেষ করতে চাইছে বাকী সবগুলো বই। কিন্তু ছেলেটা ঠিক কি করে তার সমস্যার জায়গাটিতে হাত দিলো অবাক লাগছে ডাক্তারের। প্রথম দিন যখন রঞ্জুকে ওর বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে সেদিন ডাক্তারকে বলে রঞ্জু- স্যার আমার রোগ আপনি ভালো করতে পারবেন না।
-কেন তোমার এমন মনে হচ্ছে? ডাক্তার সাহেব জানতে চায়।
-আমার আসলে কোনো অসুখ নাই।
হরি শংকর এত দিনে নিজেও বুঝতে পেরেছে সত্যিই ছেলেটির অসুখ নেই। তবুও বার বার আসতে হয় ডাক্তারের কাছে। রুগীর নামটি মনে রাখতে পারেনা ডাক্তার কিন্তু ওর একেকটা কথা মাথার জট খুলে দেয় আবার কখনো জট পাকায়। সত্তুর বছর বয়সে এই বাচ্চা ছেলেটি ডাক্তারের মাথায় গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। একদিন রঞ্জু ডাক্তারকে বলে – স্যার, মানুষ মরণশীল এই বিষয়টি চিন্তা করেছেন কখনো।
ডাক্তার বলল চিন্তা করবোনা কেন এটা চিরন্তন সত্যি কথা!
এভাবে না, আপনি বাতিটা নিভিয়ে ঘুমোতে গেছেন। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছেন, চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জেগে থাকা আর ঘুমিয়ে থাকার মাঝামাঝি একটা সময়। তখন সব মানুষের মন পবিত্র থাকে। চাইলেও মানুষ তখন অন্যের ক্ষতির চিন্তা কিংবা কুমতলব মাথায় আনতে পারেনা। এমন সময় মনে করবেন, একদিন ডাক্তার হরি শংকর নামে পৃথিবীতে কেউ থাকবেনা।
এর পর হরি শংকর বেশ কয়েক দিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। বাতি নিভিয়ে বালিশে মাথা রাখলেই দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। একদিন পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব থাকবে না। এই লোনা ধরা পুরনো দালানটা থাকবে, ভোরে বাড়ীর পাশের পুরনো বট গাছের ডালে প্রতিদিন কাক কা... কা... করবে। বাড়ীর ফাঁক ফোঁকরে আশ্রয় নেয়া চড়ুই পাখি গুলো বছরের পর বছর বাচ্চা দিয়ে যাবে, কিচির মিচির করবে। থাকবেনা শুধু ডাক্তার হরি শংকর। সে কোথায় যাবে মৃত্যুর পর... সব তালগোল পাকিয়ে যায়। ফেলে আসা জীবনের যেই সিদ্ধান্ত গুলো এতদিন খুব স্বাভাবিক আর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে আজ মনে হচ্ছে সব ভুল ছিল । সংসার করলে আজ ছেলে মেয়ে থাকতো, যারা তার অস্তিত্ব বয়ে বেড়াতো হাজার হাজার বছর। আজ সে মারা গেলে লাখ লাখ বছরের বংশগতি থেমে যাবে হরি শংকরের মৃত্যুতে। এই ভুল শোধরানোর পথ নেই, প্রথম যৌবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই নিয়ে সংশয় থাকলেও এতটা তীব্র কষ্ট এর আগে কোনো দিন হয় নি। একটা গাছ বাঁচে দুইশ বছর, গাছ মানুষের চাইতেও বেশী উপভোগ করে এই পৃথিবীকে! পুরনো বট গাছটার বয়স কতো হবে? বাবা জয় শংকর ছোট কাল থেকেই নাকি বট গাছটাকে এমনই দেখেছে। জয় শংকর গত হয়েছে একাত্তুরে, গাছটার বয়স দুইশ বছর তো হবেই। পুরুষ মানুষের সত্তুর আশি বছর বয়সেও প্রজনন ক্ষমতা থেকে। কিন্তু বুড়ো হরি ডাক্তারের কাছে কে কন্যাদান করবে?
বাতি নিভালেই অন্ধকার, অন্ধকার মানে শূন্যতা হরি শংকরের কাছে। শূন্যতাকে ভয় পায়না সে, পুরোটা জীবন তো এভাবেই কেটে গেলো। রঞ্জু তার গোপন স্থানে নাড়া দিয়ে সব এলোমেলো করে ফেলেছে। এত বছরের জীবনের পুরনো ছন্দ হারিয়ে গেছে। বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে গেলেই চোখে ভাসে চ্যাংড়াটা তাকে উপদেশ দিচ্ছে... মুচকি হাসছে... খুব বিরক্ত লাগে হরি শংকরের, সাথে ভয়ও! সেই থেকে হরি শংকর রাতের বেশী সময় বই পড়ে কাটাতে চেষ্টা করে।

গোরস্থানের পাশে বুড়ো চালতা গাছের নিচে বসে পূর্ণিমা দেখতে প্রতি মাসে একবার গ্রামে আসে রঞ্জু। পূর্ণিমা দেখার আনন্দ সে ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য রাখেনা বলে মনে করে। এই আনন্দ একা উপভোগ করে পূর্ণতা আসেনা তার। সে চায় মা বাবা ভাই বোন বন্ধু সবাই এক সাথে মিলে চাঁদের আলোয় গল্প করতে। খুব কষ্ট হয় যখন এই নির্মল আনন্দ প্রিয় মানুষগুলোর মনে রেখাপাত করে না। এই গোরস্থানে রঞ্জুর দাদা সহ ছয় পুরুষের কবর। প্রতি পূর্ণিমায় তাদের সাথে যেন দেখা সাক্ষাৎ হয় রঞ্জুর। দাদা, তার দাদা সবার কাল্পনিক ছবি আঁকা আছে রঞ্জুর মনে। একেকটা পরিচিত মুখ দেখলেই চিনতে পারে সে। দুশ বছর আগে তাদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তারও ভিডিও চিত্র ভেসে উঠে এখানে বসে। দাদা মারা যায় রঞ্জুর জন্মের আগেই। তার সাথেই ভাব একটু বেশী। অনেক গল্প হয়, ঈদ এর দিনে কেমন আনন্দ হতো সেই গল্প, নদীতে মাছ ধরার গল্প, ছেলে বেলায় তার বাবার দুরন্তপনার গল্প। এই সবের ফাঁকে দাদা একদিন একটা দরকারি কথা বলে -দাদা ভাই, ঐ যে পূর্ব পাশের তিন বিঘা জমিটা দেখছ সেটা বর্গা চাষি হামিদুলের বাবার। হামিদুল ছেলে পুলে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটায়। তোমার বাবাকে বলবে জমিটা ওকে যেন ফিরিয়ে দেয়।
-আচ্ছা।
রঞ্জু এই কথা বাবাকে বলার সাহস পায় না। সে মনে করে জমিজমা নিয়ে বাবার সাথে এমন কথা বলার বয়স হয়নি তার। দাদা যদি আরেক দিন এই জমি নিয়ে কথা বলে তাহলে এই সত্যি কথাটিই বলবে সে। পাকুন্দিয়া বাজারে একটা মিষ্টির দোকান আছে। শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এই দোকানে প্রতি রবিবার হাটের দিন দাদা তার বাবাকে নিয়ে মিষ্টি খেতে যেতো। গ্রামে এলে এই দোকানে রঞ্জু মাঝে মাঝে মিষ্টি খেত। দাদা যেদিন ছেলের হাত ধরে মিষ্টি খাওয়ার গল্প বলে তার পর থেকে রঞ্জু এই দোকানে মিষ্টি খেতে যায় না। সেই থেকে রঞ্জুর মনে হয় পছন্দের কোন খাবার একা খেয়ে মজা নেই। প্রিয় মানুষকে নিয়ে খেতে হয়।
আশরাফ মনে করে নিজের আবাদি জমিতে নিয়মিত পা না রাখলে মালিকানা দুর্বল হয়ে যায়। বর্গাচাষিরা এক সময় দখল করে মালিকানা দাবী করে বসে। পাশের জমিওয়ালা প্রতিবার হাল চাষ দেয়ার সময় এক দুই ইঞ্চি করে ঢুকে পরে জমিতে। আশরাফ দীর্ঘ দিন গ্রামের জমিজমা দেখাশোনা করেছে, বড়ভাই আজগরও ঢাকা থেকে যেতেন মাঝে মাঝে। কৃষি জমি বণ্টন হয়ে যাওয়ার পর আশরাফ চায় ছেলে রঞ্জু নিয়মিত গ্রামে যাবে ফসলের খোঁজ খবর রাখবে, বর্গা চাষিদের সাথে যোগাযোগ করবে। রঞ্জু মাসে এক দুই বার গ্রামে যায় কিন্তু জমিজমা নিয়ে খবরদারী তার ভালো লাগে না। সে গ্রামে যায় পূর্ব পুরুষের টানে, তাদের সাথে গল্প গুঁজব করতে। রঞ্জু মনে মনে খুব হাসে –মানুষ আবার জমির মালিক হয় কি করে!

শহিদুল সপ্তা খানেক ধরে সারা রাত হরি কাকুর পাশে বসে থাকে। কখনো চা কখনো গরম জল দিতে হয়। শরীরটা যত না খারাপ তার চাইতে মনের অবস্থা যেন একটু বেশী খারাপ। হাসপাতালে নেয়ার মতো অবস্থা না। তেমন হলে নিজেই বলতেন। শহিদুলের দুই মেয়ে শিউলি আর বকুল যখন দাদা ভাই বলে ডাকে হরি শংকরের মনে হয় এরা তার জীবনের অপূর্ণতা সব দূর করে দিয়েছে। এই বাড়িতেই মেয়ে দুটির জন্ম। সময় মতো চা দেয়া ঘর দোর গুছিয়ে রাখা সব দুই বোন করে। গত বছর শহিদুলের ছোট মেয়ে বকুল যখন প্রাইমারী সমাপনি পরীক্ষায় স্কুলে সেরা রেজাল্ট করে আনন্দে হরি শংকর চোখে জল ধরে রাখতে পারে নি।
আজ বিকেলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলেও যাবেনা হরি শংকর । বিকেলটা বারান্দায় বসে বই পড়ে কাটাবে। হরি শংকরের দোতলা বাড়ির সদর দরজা উত্তর দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ মুখী। এক সময় নদী পথে কলিকাতা যাতায়াত করতো বাবা জয় শংকর। তখন দক্ষিণ পাশটা বাড়ির পিছন দিক ছিল। এখন দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে পাকা সড়ক তাই ওদিকে যাতায়াতের রাস্তা বানাতে হয়েছে। বাড়ীর নীচতলা প্রায় অর্ধেক মাটির নিচে। বৃষ্টি এলে নীচতলায় পানি জমে। একটা সিঁড়ি বানাতে হয়েছে পাকা সড়কে উঠতে। নীচ তলায় দুইটা রুম নিয়ে শহিদুল তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে থাকে। শহিদুল বিশ বছর ধরে তার চেম্বারে কাজ করে। দোতলায় চেম্বার আর একটি রুম রুগীদের বসার জন্য। একটা পড়ার ঘর একটা ঘর হরি সংকরের শোবার । আরেকটা ঘর আছে আত্মীয় স্বজন এলে থাকার জন্য কিন্তু গত দশ বছরে এক জন আত্মীয় আসেনি । কেউ আসবেনা জেনেও রুমটি পরিপাটি রাখা হয়, যদি কেউ চলেই আসে ।
অবসরে উত্তর পাশে দোতলার বারান্দায় বসে বই পড়ে সময় কাটে। ব্রাহ্মমপুত্রের রুপ বদল খুব বেশী পরিচিত। বর্ষায় থৈ থৈ পানি শরতে সাদা কাশ ফুল আর শীতে বালু চর। এই বাড়িতে এক সময় মা বাবা ভাই বোন নিয়ে ১৪ জনের যৌথ পরিবার ছিল। ছেলে মুক্তিযোদ্ধা এই অপরাধে একাত্তুরে বাবা জয় শংকরকে পাকবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে বাড়ীর পূর্ব পাশে বট গাছের নীচে গুলি করে হত্যা করে। এই বট গাছটাকে ঘিরে এখন পৌর পার্ক বানানো হয়েছে। একটা সুদৃশ্য ফুয়ারা, বসার বেঞ্চ গুলো মার্বেল পাথরে মোড়ানো। দুপুর বেলা স্কুলের ইউনিফর্ম পড়া ছেলে মেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেয় এই ছোট্ট পার্কটিতে। হরি শংকরের চোখ এখনো ঝোপ ঝার জংলায় ঢাকা বট গাছের নীচে বাবার পরে থাকা রক্তাক্ত মৃত দেহটি খুঁজে। যুদ্ধে থাকায় বাবার লাশ দেখার সুযোগ হয় নি বলে এমন মনে হতে পারে।
বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সবাই ভারতে চলে যায়। আর ফিরে আসে নি। শুধু হরি শংকর জন্মভূমির মায়া ছাড়তে পারেনি। জ্বলে পুড়ে ছাড়খার নতুন একটি দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই গা ঢাকার কাপড় নেই অসুখ বিসুখে চিকিৎসা করার টাকা পাবে কথায়। মানুষের সেবা করে নিজের ঘর গোছানোর সময় হয়ে উঠেনি। আজ কাল দেশে অনেক মানুষের টাকা হয়েছে। বিনা পয়সায় কেউ চিকিৎসা নিতে আসে না। ঈদ পূজায় আলোক সজ্জা হয়। খুব আনন্দ করে মানুষ। দেখে হরি সংকরের মনেও আনন্দ জাগে। মন খারাপ হয় দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যোগ হয় নতুন নতুন মুখ। মনের দুঃখে হরি শংকর কয়েক বছর ধরে এই সব অনুষ্ঠান বর্জন করছে।
গত দুই তিন দিন ধরে বই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। চোখ পড়ে যায় কিন্তু মন ভাবে অন্য কথা। একটা পাতা এই নিয়ে তিন বার পড়া হল কি পড়েছে কিছুই মনে নেই। মায়ের মুখটা ভেসে উঠছে বার বার। মায়ের গানের গলা ছিল চমৎকার। ছোট কালে মা এই বারান্দায় বসে বাবাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনাত। শিশু হরি শংকর বারান্দার রেলিং এ গালটা লাগিয়ে নদীর পানিতে বৃষ্টি পরা দেখত। কখনো হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখত। মা একটার পর একটা গান গেয়ে যেতো। ১৯৮১ সালের এক বর্ষায় মা মারা গেছেন। তখন মায়ের অসুখে কয়েকটা দিন পাশে থাকার সুযোগ হয়েছে সেখানে। মারা যাওয়ার আগে মা এই বাড়ীর স্মৃতি মনে করে প্রায়ই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন।

রঞ্জুর পিসিতে গেইমস নেই। লেখাপড়ার কাজে সে ব্যাবহার করে পিসিটা। নোট সেভ করে রাখা, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রয়োজন হলে নেটে খুঁজে বের করা, এমন সব প্রয়োজনীয় কাজ। এস এস সি পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় বাবা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনে দেয়। ওর বয়সী ছেলেরা পিসিতে গেইমস নিয়ে ব্যাস্ত থাকে রঞ্জুর এই সবে আগ্রহ নেই মোটেই। বাবা কম্পিউটার ইন্টারনেট বুঝেনা তবে এটা বুঝে যে ছেলে ভালো কিছু করছে ভালো কিছু শিখছে। কম্পিউটারের সাথে মানুষের আজব এক মিল খুঁজে পেয়েছে রঞ্জু। মাউস কিবোর্ড মনিটর হার্ডডিস্ক প্রসেসর মাদারবোর্ড এই সব হচ্ছে মানুষের হাত শরীর মুখ ব্রেইন লিভার কিডনি। অপারেটিং সিস্টেম আর সফটওয়্যার গুলো হচ্ছে মানুষের আত্মা মন। বিভিন্ন ভাইরাস যেমন কম্পিউটারকে ভুল পথে পরিচালনা করে ঠিক তেমনি লোভ লালসা ক্রোধ মানুষকে বিপথগামী করে। কম্পিউটার ভাইরাস মুক্ত রাখতে যেমন এন্টিভাইরাস ব্যবহার করতে হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এমন সিস্টেম আছে কিন্তু মানুষ সে সব ব্যবহারে বড়ই উদাসীন । রঞ্জু মনে করে বাংলাদেশের ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ মানুষ শক্তিশালী ভাইরাসে আক্রান্ত, কোন এন্টিভাইরাসে কাজ করবে বলে মনে হয় না, সবার অপারেটিং সিস্টেম সেটআপ দেয়া দরকার। মানুষের সফটওয়্যার ব্যবহারে বড় যে পরিবর্তনটি খুব জরুরী তা হচ্ছে গুন্ডা-মাস্তান, পুলিশ, নেতা, মন্ত্রী সবাইকে একই সফটওয়্যারে না চালিয়ে প্রত্যেকের জন্য আলাদা সফটওয়্যার ব্যবহার করা দরকার।
কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন আসিফ স্যার। বুঝানোর অদ্ভুত ক্ষমতা আছে স্যারের। একটাই সমস্যা কথায় কথায় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অপদার্থ শব্দটি ব্যবহার করেন স্যার। রঞ্জু অপদার্থ শব্দটি নিয়ে অনেক চিন্তা করেছে, এই নিয়ে স্যারের মনের বিভ্রান্তিটি দূর করা দরকার। যে কোন ভাবে হোক স্যার তাকে অপদার্থ বললেই হয় শুধরে দেয়ার সুযোগটা পাওয়া যাবে। লেকচারে লাই ডিটেক্টর যন্ত্রের প্রসঙ্গটা আসে। স্যার ছাত্রদের বুঝাচ্ছেন কিভাবে যন্ত্রটি একজন অপরাধীর মিথ্যা কথা নিখুত ভাবে সনাক্ত করে। আজ রঞ্জুর কাছে মনে হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ, রঞ্জু দাড়িয়ে কথা বলার সুযোগ চাইছে স্যারের কাছে -স্যার এই যন্ত্রটার ব্যবহার নিয়ে আমার কিছু কথা আছে।
স্যার ঘুরে দাড়িয়ে অনুমতি দিলেন- বলো।
-স্যার এই যন্ত্রটি কেন শুধু চিহ্নিত অপরাধীদের জন্য ব্যবহার হবে, তারচে বরং যারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ছদ্মবেশী মিথ্যাবাদী তাদের মিথ্যা কথা ধরতে এই যন্ত্রটি কি ব্যাবহার করা যায় না?
-তুমি আসলে কাদের কথা বলতে চাচ্ছ?
-এই ধরুন, একজন মন্ত্রী যদি সংসদে দাড়িয়ে মিথ্যা কথা বলে তখন এই যন্ত্রের উপযোগিতা কি ভাবে আমরা পাবো?
প্রশ্নটা স্যারের কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে। স্যারের মনে হলো তার সমর্থিত দলের মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করেই যেন বলছে রঞ্জু। স্যার মেনে নিতে পারলেননা এটি একটি উদাহরণ! রেগে গেলে যা বলেন রঞ্জুকেও আজ তাই বললেন – অপদার্থ!
-স্যার, এই অপদার্থ নিয়েও আমার কিছু বলার আছে।
এবার স্যার চোখ দুটো বড় করে তাকালেন। রেগে গেছেন সন্ধেহ নেই কিন্তু রঞ্জুকে থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছেও নেই। স্যার কিছু না বললেও রঞ্জু বুঝতে পারল কথা বলার সুযোগ আছে। তাই সে বলে গেলো- স্যার, আমি অপদার্থ এটা সত্যি কথা, এমনকি আমরা সবাই অপদার্থ। এই নিয়ে আমাদের দুঃখ কিংবা গর্ব করার কিছুই থাকা উচিৎ না। আপনি যদি পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্র ধরেও এগিয়ে যান তাহলেও প্রমাণ করা সম্ভব যে আমি এবং আমরা সবাই অপদার্থ।
এবার স্যারের দৃষ্টিতে রাগ নয় বরং একটু আগ্রহ লক্ষ্য করে রঞ্জু। ক্লাসের সহপাঠী বন্ধুরাও সবাই রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে। রঞ্জু একটু খুলে না বললে ইচ্ছাটা অপূর্ণ থেকে যাবে, রঞ্জু বলে চললো -স্যার ধরুন আপনি একটা লোহা দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করলেন। লোহাটাও পদার্থ আমার মাথাটাও পদার্থ। ঘটনা যেটা ঘটলো একটা পদার্থ অন্য আরেকটা পদার্থকে ধ্বংস করলো। রক্তাক্ত যে দেহটা পরে থাকলো সেটা আমার মৃতদেহ, আমি না কিন্তু! আমাকে দেহ থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটতে পারলো। আমি নামক সফটওয়্যার কে আপনি কিন্তু ধরতে পারলেন না স্যার। আর সফটওয়্যার পদার্থ হয় না। মুহূর্তের জন্যে হলেও ক্লাসে নীরবতা নেমে আসে।
ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টায় ক্লাস রুমের নীরবতা ভাঙ্গে। আসিফ কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে যোগ্যতা বলে যথেষ্ট প্রতিযোগিতা করে এই চাকুরীটা পেয়াছে। কিন্তু মানুষের হার্ডওয়্যার সফটওয়্যার নিয়ে ভাবেনি কোনদিন। চিন্তা করে থাকলে হয়তো ছাত্রদের সে অপদার্থ বলতো না। আসিফ ক্লাস শেষ করে প্রতিদিন হেটে বাড়ি যায়। আজ তার মন খারাপ, কিছুই ভালো লাগছেনা। দশ মিনিটের পথ অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। পাশ দিয়ে রিক্সায় একটি শোক সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। এ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। প্রতিদিনই এমন শোক সংবাদ কানে আসে, কিন্তু আজ মাইকে একটি শব্দ খুব বেশী ভাবিয়ে তুলে আসিফকে। শোক সংবাদটি এভাবে শুনে আসিফ- একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ, গতকাল রাত্রির দ্বিপ্রহরে ডাক্তার হরি শংকর তার নিজ বাস ভবনে দেহান্তরিত হয়েছেন...
দেহান্তরিত শব্দটি শুনে আসিফের কাছে মনে হচ্ছে রঞ্জু ঠিকই বলেছে। মানুষ কিছুতেই পদার্থ হতে পারেনা! সত্যি, আমরা সবাই অপদার্থ।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শামীম খান বেশ ভাববার বিষয় । ভাল লাগলো ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু মানুষ কিছুতেই পদার্থ হতে পারেনা! সত্যি, আমরা সবাই অপদার্থ। ভাল লিখেছেন।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪