অন্ধকার পথে

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

জি সি ভট্টাচার্য
  • 0
সেদিন সকালে আমার দশ বছরের ভাগ্নী স্বপ্না বেড়াতে এসেছিল। গরমের ছুটি হয়ে গিয়েছিল স্কুলে। বাদল আর চঞ্চলের সাথে গল্প, খেলা এইসব চলছিল। খানিক পরে সে হঠাৎ চেঁচিয়ে মেঁচিয়ে উঠে বললো-‘মামা, তুমি দেখ না, বাদলদা অন্যরকমভাবে কি সব নতুন অক্ষরে ওর মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছে আমাকে। এ তো আমি পড়তে ও পারছি না’।

ভাগ্নির হাত থেকে কাগজটা না নিয়েই আমি বললুম-‘তা বাদল এখন করছেটা কী বলোতো, স্বপ্নারাণী’।

কি সব বিচ্ছিরি কবিতা পড়ছে বসে –নির্জনপথে জ্যোৎস্না আলোতে, সন্ন্যাসী একা যাত্রী….’

‘ও তো কবিগুরুর কবিতা, বাজে নয়। সুতরাং বাদল এখন বাংলাভাষার জগতে আছে, তাই আমার মনে হয় ফোন নম্বরটা ও বাংলাতেই লিখে ফেলেছে ভূলে। তুমি তো কনভেন্টের ছাত্রী। তাও এই অখাদ্য হিন্দিভাষী ইয়ু০পি০তে। বাংলার মর্ম তুমি কি বুঝবে? বাদল তো এই তেরো বছর বয়সেই বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী ছাড়া ও ভোজপুরী, ওড়িয়া, নেপালী, এমন কি পূর্ব বাংলা অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের প্রচলিত ভাষা ও দিব্যি জানে’।

আমার অপরূপ সুন্দর পরীর দেশের রাজকুমার ভাইপো চঞ্চল আমার পাশে বসে একটা কমিক্স পড়ছিল। চঞ্চল কবিতাটা জানতো। ছেলেটা প্যারোডি বানাতে ও খুব পটু।

শুনেই বললো-‘নির্জন পথে অন্ধকার রাতে, আমি হই একা যাত্রী,
মাথার ওপরে তরুবিথিকায়, পেঁচা চিৎকার করে বার বার,
এতদিন পরে এসেছে কি মোর,
আজি অভিসার রাত্রি?’

‘ও কাকু, বলো তো অন্ধকার ভালো না আলো?’

আমি বললুম-‘আলো…’

চঞ্চল কিন্তু মানতে রাজিই নয়। বললো-‘উঁহু, কাকু, ঠিক হ’লো না। অন্ধকার না থাকলে আর আলোর কি মূল্য? জ্যোৎস্নারাতের চেয়ে অন্ধকারেই তো অভিসার বেশ সহজ হয়। তাই না?’

চঞ্চল অবশ্য অভিসার শব্দের মানে বেড়ানোই বুঝেছে, তা ঠিক। তবে বাদল ঠিক জানে আসল অর্থ। জিনিয়াস ছেলে বাদল নিজেই যে আস্ত ‘চলন্তিকা’ একখানা।

আমি মনে মনে বললুম- ‘হুঁ, চোরেদের অভিসার সহজ হয় বই কি। কথায় আছে না-‘অমাবস্যার রাত্তিরেতে, চান্দের বড় বিদ্ধি, ধর ধর করে লোকে ধরে কার সাধ্যি…চোরের নাম যে চাঁদ…..’

কোটেশনটা বাদল হ’লে ঠিক ধরতে পারতো। ডিটেল ও বলে দিতো গড়গড় করে। যা ছেলে না একখানা বাদল….অবশ্য চঞ্চলকে বলে কোন লাভ নেই জানি।

তাই মুখে বললুম-‘খুব ঠিক কথা চঞ্চল, তবে অন্ধকার বিভ্রম ঘটায় বেশী। দৃষ্টির ও আর মনেরও। আর মনের অন্ধকার তো আর ও বেশী ঝামেলার জিনিষ কেননা বাইরের অন্ধকার সহজেই দূর করা যায়, ভাই। মনের অন্ধকার আগুনে পুড়লেও যায় না। জানো তো কথায় আছে-‘কয়লা কি ময়লা তব ছুটে, যব আগ করে পরবেশ’। তাই ওই সব অন্ধকারের ঝামেলায় আমি নেই বাপু। তা তুমি স্বপ্নাকে ফোন নম্বরটা ঠিক করিয়ে দাও তো দেখি, আগে’।

মনে হয় বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে বসে একটু হেসেছিলেন তখন আমার কথা শুনে।

রূপসী মেয়ে স্বপ্না বেশ পাকামো করে বললো-‘না না, থাক ইলেক্ট্রিকদা, তোমার সাহায্য চাই না আমার একদম। তুমি তোমার কাকুর কাছে এখানেই বসে থাকো। তুমি ছুঁলেই তো আবার শক লাগবে। তোমার দিকে তাকালেই মাথা ঘোরে আমার খুব। তুমি না দারুণ গরম কালের ঝকঝকে রোদ, তাকায় কার সাধ্যি তোমার দিকে। আমার বাদলদাই ভালো। ও হ’লো শীতের নরম রোদ্দূর। আমি নম্বর ঠিক করিয়ে নিচ্ছি বাদলদাকে দিয়েই’।

বোনের কথায় চঞ্চল তেড়ে উঠলো-‘এ্যাই মেয়ে….আমার বাদলদা মানে? বাদল আমার বন্ধু তাও মোটে গোনাগুনতি একখানা, তুই নজর দিবি না বলছি ওর দিকে। ওর ফোন নম্বর নিয়ে তুই কি করবি, শুনি?’

‘ফোন করব, আবার কি করবো? হিঃ.. হিঃ… হিঃ….তবে তোমার বন্ধু যে কখন কোন জগতে থাকে, তা বোঝাই যায় না। বাদলদা না একটা অদ্ভূত ছেলে…তা কি আর করা? আমার ভাগ্যই খারাপ রে দাদা। আমি এখন আসি…’

তা সে’দিন বিকেলেই নতুন এক ঘটনা ঘটালেন বিধাতা পুরুষ। ডাকে একখানা চিঠি এসে হাজির হ’লো আমার নামে। চিঠি খানার বয়ান ছিল এইরকম-

নবকানন
চুণার, মির্জাপুর।

‘ভাই সিদ্ধার্থ,
কেমন আছিস?
অনেক দিন পরে চিঠি লিখছি। আশাকরি বন্ধুকে ভূলে মেরে দিসনি। আমি যে মোপেডখানা কিনেছিলাম, তার কথা তোর মনে আছে কি?
টি০ভি০এস০এক্স০ টি০ মডেলের, এখন ও নতুনই আছে প্রায়। বাজার দর দশ হাজারের চেয়ে অনেক সস্তায়, মাত্র তিন হাজারে এক পরিচিত ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিনেছিলাম। তা আমি এখন তো নতুন হীরো পুক কিনবো ঠিক করেছি, ও গাড়ী পড়েই থাকবে। তুই যদি নিতে চাস তো কালই চলে আয় দেখি। পয়সা না হয় পরে দিবি। তোর ওপরে আমার অবিশ্বাস নেই আর ওই গাড়ীতে গিয়ারের কোন ঝামেলা ও নেই বলে তোর চালাতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু গিয়ারওয়ালা হীরো পুকের তুলনায় স্পীড কম নেয় না মোটেই। মোট কথা হ’লো যে গাড়িটা নিলে তোকে কিন্তু ঠকতে হবে না। নিজের একটা ফটো সঙ্গে আনবি । তোর অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি-
অনিল’।

বন্ধুর চিঠি পড়ে বেশ সস্তায় মোপেডখানা পাবার আশায় মনটা খুব খুশী হয়ে উঠেছিল সেদিন। মনে ভাবলুম যে আমার কলেজ যেতে সুবিধে তো হবেই, দরকারে অভিসার ও জমবে বেশ।

চিঠিটা বাদলকে দেখালুম। পড়ে অবশ্য ছেলে নিজের সুন্দর ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো-‘মাত্র তিনহাজার? আমার সন্দেহ হচ্ছে বেশ, কাকু। ধাপ্পাবাজী নয় তো’?

‘হোক না, গিয়ে দেখতে আর দোষটা কি? তবে তোমার বন্ধু রূপকুমার চঞ্চল মানে স্বপ্নার ইলেক্ট্রিকদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই ওই অভিসারে’

বাদল অ্যাডভেঞ্চারের বদলে অভিসার শুনেই খিল খিল করে হেসে দিল। তারপরে ধীরে ধীরে বলল-‘হুঁ, পয়সা পরে দিলে ও হবে। মানে বড্ড তাড়া, নাঃ, কিছু তো আছেই ব্যাপার’।

আমি কিন্তু তেরো বছরের অতি রূপবান মিষ্টি ছেলে বাদলকে বেশ করে সাজিয়ে টাজিয়ে দামী পোষাক পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে পরদিনই বেলা এগারোটায় গোধূলিয়া হতে একটা অটো নিয়ে বেনারস ক্যান্ট স্টেশনে গিয়ে হাজির হয়ে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে মহানগরী এক্সপ্রেসে উঠে বিকেল তিনটের পর সোজা চুণারে গিয়ে নামলুম।

অনিল থাকে সেই কেল্লার কাছে পুরণো শহরে। স্টেশন থেকে দূর অনেকটা। তাই রিক্সা নিতে হ’লো। তবু ও চারটে বাজল পৌঁছতে। বেলা তখন বেশ পড়ে আসছে।

অনিল আমাকে দেখা মাত্র সাগ্রহে বলল-‘এসেছিস, যাক, বাঁচা গেল। দে তোর ফটোটা, তোর জন্য আগে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে ফেলি চট করে’।

‘সে কি রে? তুই কি করে বানাবি? সে তো সরকারী আর০ টি০ ও০ অফিসে বানানো হয়’.।

বলাবাহুল্য যে তখনো আধুনিক ধরনের ল্যামিনেটেড আই০ডি০ কার্ডের মতন ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরী হয় নি। একখানা মোটা ক্লথ বাউন্ড কাগজ দিয়ে কাজ চালানো হতো। তাইতে সই সীল মোহর সবই লাগানো থাকতো। নাম টাম ও হাতেই লেখা হতো।

তখন তো দিল্লিতে ও প্লেনের বোর্ডিং পাশ পর্যন্ত হাতে লিখে তৈরী করে দেওয়া হ’তো। কম্পুটারের অভাবে। সে সব এখন ঐতিহাসিক বস্তু। আমার সংগ্রহে আছে একখানা, তাই বলছি জোর দিয়ে’।

অনিল বললো--‘সে না হয় পরে বানিয়ে নিস তুই, তা এখনকার মতন তো চাই কিছু কাজ চলবার মতন। সঙ্গে কাকে এনেছিস? তোর ছেলে?’
‘হ্যাঁ’

‘কি নাম?’

‘বাদল’

‘নামে মিল আছে কিন্তু বয়স তো খুব কম। আর নাম ও বদল হবে না। তা তুই তো আমারই বয়সী, পঁচিশ চলছে তো। তুই অনিল হয়ে যা আপাতত’।

‘সে কি করে হবো রে বাবা?’

‘কেন? ফটো বদলে, এইভাবে…’

বলেই সাবধানে নিজের ফটোটা. তুলে নিয়ে আমার ফটোটা লাইসেন্সে আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়ে একটা গোল প্ল্যাস্টিকের ঢাকনি নিয়ে প্যাডে বসিয়ে আধখানা গোল স্ট্যাম্প ও বসিয়ে দিল ফটোতে, ঠিক যেমনটি আগে লাগানো ছিল ওর নিজের ফটোতে। ব্যস, ফটোর আর কাগজের ওপরের আধখানা মিলিয়ে পুরো গোল রবার স্ট্যাম্প ওয়ালা ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরী। অবশ্য নাম অনিলের, কিন্তু ফটো তো আমার আর ঠিকানা ও বেনারসের যেখানে অনিল থাকতো আগে। কে নকল ধরতে পারবে? অনিলের বাহাদূরী আছে তা মানতে হয় বইকি।

আমি আর বললুম না যে বাদল আমার ছেলে নয়। নইলে তো মাত্র বারো বছর বয়সেই আমার বাবা হয়ে যাবার কথা। তা আমার পরীর দেশের রাজকুমার একমাত্র ভাইপো চঞ্চলের এই রূপবান, সুকুমার ও তীক্ষ্নবুদ্ধি, সাহসী বন্ধুকে আমি নিজের ছেলেই বানিয়ে নিয়েছি এখন।

অনিল বলল-‘আমি আমার জন্য অন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে নেব। পরে তুই ও নতুন একটা করিয়ে নিস নিজের। আর শোন, তেল বেশী নেই কিন্তু গাড়িতে। এক লিটার ভরিয়ে নিস জি০টি০ রোডের মোড়ের পেট্রল পাম্প থেকে। বেনারস পৌঁছে যাবি অনায়াসে। তবে সন্ধ্যে তো হয়ে আসছে। আয়, একটু চা টা খেয়ে নিয়েই রওনা হয়ে পড় দেখি দুর্গা বলে’।

চা পানান্তে এসে অনিলের বাড়ির বাইরে গাড়িটাকে টেনে এনে স্টার্ট দিতেই ইন্জিন গর্জে উঠল। আমি ও উঠে বসলুম লম্বা সীটের সামনের দিকে। বাদল তেলের নব ঘুরিয়ে দিল আর আমার পিছনে উঠে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিল নিজের দুই নরম, মসৃণ, চকচকে বাহু দিয়ে। আমি অনিলকে বাই করে থ্রটল একটু টানতেই গাড়ী গতি নিল।

যে পথ রিক্সায় এসেছিলাম দশ টাকা ভাড়া দিয়ে আধ ঘন্টায়, সেই পথ পার হয়ে এলাম আমরা সাত মিনিটেই। ।

রেল গেট পার হয়ে জি০ টি০ রোডে উঠে আমি বাঁদিকে ঘুরে স্পীড বাড়াতেই বাদল বলে উঠল- ‘এই না কাকু, আগে তো গাড়িতে তেল চাই’।

গাড়ী চালাবার আনন্দে আমি তো ভূলেই গিয়েছিলাম তেলের কথা। বাদল ঠিক মনে করে রেখেছে। এইজন্যেই বাদলকে ছাড়া আমার কাজ চলে না। তেলের অভাবে একটু
পরেই ‘তেপান্তরে অচল গাড়ী থামলো ঘটাং ঘট’ হয়ে যেতো নির্ঘাৎ। তাই তখন একটা ইন্ডিয়ান অয়েলের আউটলেটে গিয়ে দেড় লিটার তেল আর মবিল ভরিয়ে নিলাম আমি গাড়িতে।

গাড়িতে আবার উঠে বসল বাদল।

বলল-‘এইবার চলো, কাকু। তবে কি জানো? মানুষ যখন কোন কারণে খুব অস্থির হয়ে ওঠে, তখন সে টাকা ও চায় না আর কোন অন্যায় কাজেই পিছপা’ ও হয় না দেখা গেল, কাকু। নকল লাইসেন্সটা তোমার কিন্তু দারুণ হয়েছে। তবে অনিল কাকুর এত গরজটা যে কিসের জন্য, তা আমার জানা একান্ত দরকার। কিছু একটা গন্ডগোল তো আছেই এই গাড়িখানার। কাকু শোন, তুমি প্রথমেই বেশী স্পীড নিও না কিন্তু’।

তা সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে বেশ ধীরেই মোপেডখানা চালাচ্ছিলাম আমি। প্রায় ৫৫-৬০ কি০মি০ পথ যেতে হবে। সময় অনেকটা লেগে যাবে। বেশী রাতে পৌঁছে বাদলকে আর বাড়ী পাঠানো ও হবে না।

একটু পরে বাদলই আবার বলল-‘ও কাকু, এই গাড়ির ভাইব্রেশন কিন্তু বেশ জোরালো আর অন্যরকমের। তুমি তো জানোই যে আমি একটু বেশী রকমের সেন্সিটিভ ছেলে, তাই আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে বেশ এই গাড়ীতে বসে। কেমন যেন হাত পা ঝিমঝিম করছে। তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। তুমি একটু স্পীড বাড়িয়ে দেবে, কাকু?’

‘তবে আগে তুমি আমার সামনে এসে বসো দেখি, বাদল। জোরে চালালে তুমি পড়ে না যাও, সেই ভয় পাচ্ছি’।

বাদল তখনই নেমে এসে আমার সামনে সীটেতে উঠে বসতে আমি একটু পিছিয়ে বসে ছেলেটাকে দুই হাতের মধ্যে ঘিরে নিয়ে গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে আবার স্টার্ট নিলুম।

রূপবান ছেলে বাদলের শরীরে বেশ একটা সহজাত মিষ্টি সুগন্ধ আছে। অনেকের যেমন শরীরে কেমন যেন একটা কটুগন্ধ থাকে না? তাদের কাছে গেলেই বেশ একটু বমি মতন পায় না? তা বাদলের তো সবই উল্টো। তাই আমার বেশ ভালো লাগলো আর গাড়ির স্পীড ও চল্লিশ পার হয়ে গেল দেখতে দেখতে। সাঁ সাঁ করে পথের দু’ধারের গাছপালা পিছন দিকে ছুটছে।

ও রে বাবা, হঠাৎ দেখি যে স্পীড কখন ৬৫ পার হয়ে গেছে। সামনে টার্ন আসছে দেখে আমি থ্রটল ছাড়তেই স্প্রিংয়ের জোরে সেটা ঘুরে গেল উল্টোদিকে। আপনিই কমবে এইবার স্পীড। বেশ অন্ধকার ও হয়ে গেছে তখন। আলোবিহীন পথে গাড়ির হেডলাইটের আলোতে আমরা চলেছি এগিয়ে।

স্পীড কমছে ও, কিন্তু একটু পরেই বাদল বললো- ‘ও কাকু, রাস্তা এতো সরু হয়ে গেল কেমন করে হঠাৎ? এই কি জি০ টি০ রোড না কী? আমার মনে কিন্তু আবার একটা দারুণ সন্দেহ হচ্ছে, কাকু’।

‘কি?’

‘আমরা হয়তো অন্ধকারে ভূল পথে চলে এসেছি, কাকু’।

‘অ্যাঁ, সে আবার কী কথা? হঠাৎ পথ হারালুম কি করে রে বাবা? আমরা তো সোজাই যাচ্ছি। কোথা ও তো টার্ন নিইনি’।

তখনি দূরে কোন গাছ থেকে পেঁচার কর্কশ ডাক ভেসে এলো।

বাদল আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে বললো-‘ও কাকু, এ কি সত্যি কোন পেঁচা ডাকছে? সন্ধ্যা রাতেই? আশ্চর্য তো। না কি নকল ডাক ডেকে কেউ কোন সংকেত দিচ্ছে অন্য কোন লোককে?’ …..

‘আর জানো কাকু, তুমি বলছো বটে কিন্তু আমার মনে হয় না যে আমরা সোজাই যাচ্ছি। মেন রোডের গা ঘেঁসে থাকা বাঁ হাতি কোন সরু রাস্তায় চলে আসতেই পারি আমরা। তুমি বুঝতে ও পারো নি’।

‘আর হয়তো আমি পড়ে যেতে পারি এই ভয়ে আমাকে সামনে বসিয়ে নিয়ে ও তুমি ভূল করেছ, কাকু। পথে তো ঘোর অন্ধকার। তুমি ঠিক করে হয়তো রাস্তা দেখতেই পাও নি। আমি চার পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট ছেলে হ’লে তোমার কিন্তু এই অসুবিধা হ’তো না, কাকু। কিন্তু এতো বড় একটা ছেলেকে এইভাবে সামনে বসিয়ে নিয়ে এই অন্ধকার পথে গাড়ী চালানো সহজ কাজ নয়, কাকু। তুমি এইবার আবার স্পীড কমাও’।

‘থ্রটল ছেড়ে দিলুম আমি কিন্তু গাড়ির স্পীড কমলো না। যদি ও ইন্জিনের শব্দ কমে গেল একদম । আমি ব্রেক কষতে যেতে আমার হাতের ওপরে হাত রেখে বাদল বললো-‘নাঃ, থাক কাকু, মনে হয় খানিক আগে বেশ গাছপালা আছে। এই ন্যাড়া জায়গায় থামতে হবে না। আপনিই থামবে গাড়ী। পথটা বেশ ঢালুমতন বলে স্পীড কমছে না। ইন্জিনটা বন্ধ হয়ে গেলে…’।

ঝপ করে হেড লাইট নিভলো আমার গাড়ির।

নিঃশব্দে অন্ধকারে আমরা এগিয়ে চলেছি অজানা পথে। দু’ধারে খাঁ খাঁ করা নির্জন প্রান্তর আর ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। দূরে মনে হয় বিয়ে বাড়ী টাড়ি কিছু আছে, লাউডস্পিকারে হিন্দী গানের রেশ ভেসে আসছে।

বাদল ঠিকই বলছিলো। সত্যিই অ্যাক্সিলেরাশন বন্ধ বলে ইন্জিন ও বন্ধ হয়ে গেছে আপনিই। খানিক পরে গাড়ী অনেকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ঝুপসি অন্ধকার মতন গাছতলায় নিঃশব্দে থেমে গেল।

আমি বলতে গেলুম-‘এ’বারে কি, বাদল? নেমে গাড়ী ঘোরাতে হবে তো?’

নিজের নরম তর্জনী আঙুল আমার ঠোঁটে রেখে ফিসফিস করে বাদল কানে কানে বললো-‘চুপ, কাকু। আমি এ’খানে বেশ কয়েকজন লোকের সাড়া পাচ্ছি। নিশ্চয়ই তারা এই সময় এ’খানে অন্ধকারে হাওয়া খেতে বা অভিসারে আসেনি। তুমি নেমে সাইড স্ট্যান্ড লাগাও গাড়ির নিঃশব্দে, কাকু। তারপরে আমাদের দূরের অন্য গাছের আড়ালে সরে যেতে হবে। গতিক সুবিধের নয়’।
‘তথাস্তু, বাদল’। গাড়িটাকে আরো এগিয়ে একটা ঝোপের ভেতরে ঠেলে দিয়ে তাই করলুম আমি। ।

একটা মৃদু শিষের শব্দ হ’তেই দু’জন লোক যেন পাতাল ফুঁড়ে উঠে এলো পথে। আমরা সরে না এলে আমাদের তারা ঠিক দেখে ফেলতো।

‘এনেছিস?’

‘হ্যাঁ, সর্দার’।

‘দে’।

‘আরে, এ্যাই রামুয়া…’

‘জী সর্দার…;

‘এই লে পাউডার। যা, মাত্র এক চিমটি করে শালাদের শর্বতে বা জলে মিলিয়ে দিবি। না হ’লে খানায় ছেড়ে দিবি। সব শালে লোগ খাবার পরে পাঁচ মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়বে। তিন ঘন্টার মতন তখন নিশ্চিন্তি। ঘুম ভেঙ্গে ও শালে লোগদের কিছু মনে পড়লে তো। মেয়ের বিয়ের জন্য তিলকে রামখেলাওন পচাশ হাজার ড্রাফ্টে দিয়েছে আর আজ সমধিকে বাকি পচাশ নগদ দেবে। খবর পেয়েছি যে বিশ পঁচিশ ভরির জেবর ও আছে। আর অন্য সব লোকের আনা উপহার আর তাদের ও পকেট ফাঁক করে নিয়ে সমস্ত মিলিয়ে লাখ তো পেরোবেই। তবে খবর্দার, কেউ কোন লৌন্ডিয়াকে উঠিয়ে আনতে যাবি না ভূলেও। শালে মোহসিন না কি যেন নাম সেই হারামী পুলিশ ইন্সপেক্টর জানতে পারলে, খাল খিঁচে…’

‘উ তো কব কা মর গয়া সর্দার। আওর অব তো রঘু অহীর ইন্সপেক্টর বন কর আয়া হ্যায়। উ তো হ্যায় হমরা আদমী’।

‘আবে চুপ। উ শালে মর কে ভি পরেত বন কর জরুর আয়ী শাদি কে ওখত মে ডকৈতী দেখকে। রঘু তো নেওতা খানে কো আয়া রে। উ কা করি? হিস্সওয়া ভেজ দেব কাল। অব তু জো। কাম হো যায় তো মাস্ক লগায়কে ইস অনার কো ফুঁক দেনা। গাঁওবালে সমঝী কি আতিশবাজী হোত হও শাদি মে…. ঔর সব শালে লোগ যো বচল রহি উসব ভি শো যাই…হাঃ হাঃ হাঃ ….’
তারপরে সব চুপচাপ।

বাদলকে জড়িয়ে ধরে গাছতলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। নড়বার ও সাহস নেই। বেশ বুঝতে পারছি যে কুখ্যাত মির্জাপুরী ডাকাতদের খপ্পরে এসে পড়েছি, নির্ঘাৎ। বিপদ আসন্ন। মিনিট নয় যেন ঘন্টা কাটছে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে আশেপাশে। মশার গুন্জন ও বাড়ছে। অনেকটা দূরে খুব ব্যান্ড বাজনা বাজছে তখন কোথাও। অল্প অল্প শোনা যাচ্ছে। সেই বিয়ে বাড়িতেই হবে। একটু পরেই সেখানে ডাকাত পড়বে। সব কিছুই লুটপাট হয়ে যাবে। আমরা অসহায়। এই নিরস্ত্র অবস্থায় আমরা দু’জনে কি প্রতিকার করতে পারি?’

প্রায় একঘন্টা পরে দূরে কোথাও সোঁওওও …..করে কেমন আওয়াজ হ’লো আর তুবড়ির আলোর ফোয়ারা দেখা গেল গাছের ফাঁক দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আবার পেঁচার ডাক শোনা গেল জোরে, কাছেই কোথাও .. আর দূরের গাছগুলো থেকে ঝুপঝাপ করে প্রায় দশজন লোক লাফিয়ে নেমে পড়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সামনে, দল বেঁধে।

ভাগ্যিস আমি আর এক পা ও এগিয়ে যাবার মতন বোকামী করিনি। নইলে নকল পেঁচাদের খপ্পরে পড়তে হ’তো নির্ঘাৎ।

এইবার আমি বললুম-‘চল বাদল, এখনি আমাদের গাড়ি টেনে নিয়ে পালাই আমরা এই ফাঁকে। তিন ফার্লং গিয়ে তবে স্টার্ট দেব। পাক্কা অভিসারই বটে নির্জন পথে অন্ধকার রাতে….চঞ্চল যে খুব ঠিক বানিয়েছিল প্যারোডি,তা বোঝা যাচ্ছে। তবে পরীর দেশের রাজকুমার ছেলেটাকে এই দুর্দান্ত অভিসারে সঙ্গে না এনে ঠিক কাজই আমি করেছি ….’।

গাড়ির কাছে গিয়েই কিন্তু আঁক করে আঁৎকে উঠতে হোল আমাকে।

একজন ছায়ামূর্তি গাড়ির সীটে উঠে বসে আছে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে আরাম করে। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পা ধরে গেল। কি সব কান্ড রে বাবা। এ নির্ঘাৎ ডাকাতের চর। এখন উপায়? গাড়ী বেদখল হয়ে গেছে। এখন বাড়ী যাব কি করে আমরা?

বাদল রাগ করে তখনি নীচু হয়ে রাস্তা থেকে বড় দেখে একটা আধলা ইঁট কুড়িয়ে নিল হঠাৎ। আর সেটা হাতে তুলে নিয়েই লোকটার মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল।

বাদলের লক্ষ্য যে অব্যর্থ আমি তা বেশ জানি। তবে এই অন্ধকারে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই পারে। লোকটার আর্তনাদ তো শোনা গেলই না উল্টে সেই ছায়াটা এক লাফে গাড়ী থেকে নেমে এসে দাঁত কিড়িমিড়ি করে ফ্যাঁসফ্যাস করে বললো-‘হালার পোলাপান। ঢিলা ম্যালা মারো ক্যান আমারে? দিমু না কি তাল গাছের মাথায় উল্টা কইরা ঝুলাইয়া? তহন বোঝবা…’

প্রতিভাবান ছেলে বাদল পূর্ব বাংলার ভাষা শিখেছিল স্কুলে এক বন্ধুর মুখে শুনে অনেক দিন আগে। এখন ঠিক তেমনিভাবে সে ও বলে উঠলো-‘ ঢিলা মারুম না তো কি ফুল মারুম ছুঁইড়্যা? আমাগো গাড়িডা ক্যান দখল কইরা লইছো?’

‘অ্যা, এইডা কয় কি? গাড়িডা তো আমারই, আর এই পোলাডা কয় কি না দখল করসি। হাঃ… হাঃ …হাঃ …তা গাড়িডা তোমারেই দিয়া দিমু অনে, আমার আর কি কাম ওইডারে লইয়া এহন? তয় অভ্যাসডা ছাড়ন যায় না ….কিন্তু হালার ডাকাত গুলানরে সোজা করন লাগবো। আমারে হেল্প করবা? কও…’

‘করুম, চাচা…’

‘তুমি আমারে চাচা কও ক্যান? ক্যামনে চেনলা আমারে?’

‘আপনে এত বড় ইন্সপেক্টর আর আপনারে চিনুম না? কয়েন কি, চাচা?’

‘ইন্সাল্লাহ, এই না হলি দ্যাশের গুণ? বাঃ.. বাঃ..তয় খাড়াও এইহানে। আমি কাঠ লইয়া আই, একখান জাল ও লাগবো আর লাগবো শলাই । তুমি গাড়ির ত্যাল বাইর করতে পারবা?’

‘কিসে বাইর করুম?’

‘খাড়াও, কাঠ লইয়া আইত্যাছি। হাতে কইর্য্যা নিয়া ঢাইল্যা দিবা…’

নক্ষত্রালোকে আবছা মতন দেখা যাচ্ছিল সব কিছু। মনে হ’লো দেখতে দেখতে বিস্তর শুকনো ডালপালা এসে জড়ো হচ্ছে দু’তিনটে গাছের নিচে। একটা কিসের শক্ত জাল ও এসে গোটা রাস্তায় বিছিয়ে পড়ে রইলো আর তার দড়িটা একটা বড় গাছের ডালের ওপর দিয়ে অবলীলায় ঘুরে এসে পড়ল বাদলের হাতে। পরে বুঝেছিলাম যে সেই জালটা ছিল স্টিলের তৈরী ।
‘দড়ির এই মুড়াডারে গাছের গায়ে বাইন্ধ্যা ফ্যালাও’।

বাদল দড়িটা একটা গাছে বেঁধে রেখে গাড়ির পাইপ খুলে তেল বার করে আঁজলা করে সেই কাঠে ছড়িয়ে দিলো।

‘আমার লগে আইস, বিয়া বাড়িডা দেখাইয়া দিতেছি তোমারে। বেশী দূর না আর যা যা করতে হইবো কইয়া দিই। হক্কলডি করবা যেমনডি কইয়া দিমু…’

বাদল সঙ্কেতে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে নির্ভয়ে সেই অন্ধকারের মধ্যে সামনে এগিয়ে গেল। কি ছেলেরে বাবা? আমি তো ভয়েই মরি। বাদল ফিরলো বিশ মিনিট পরে। তারপরে আবার শবরীর প্রতীক্ষা শুরু হ’য়ে গেল আমাদের ।

কেউ আর আসে না।

অনেকক্ষন কাটবার পর দূরে কিছু লোকের পদশব্দ শোনা গেল আর আমি বাদলকে টেনে নিয়ে গিয়ে আবার একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। সেই ছায়ামূর্তির চিহ্ন ও নেই তখন কোথাও। একে একে জনা দশেক লোক এগিয়ে এলো ।

একজন কেউ বললো-‘আরে মদন সিং, জ্বালা দেখি তুই একটা মশাল আগে। তবে তো ভাগ বাঁটোয়ারা হবে। তবে সাবধান….আরে পায়ের নীচে এটা কী? শক্তমতন দড়ি না কী পড়ে? দেখ তো ….আরে এ কী? কে আমাদের টানছে ওপরদিকে? এ…এ কি কান্ড? আমরা কি লিফ্টে উঠেছি না কী?’

অন্য একজন কেউ বলল-‘না সর্দার। এ হচ্ছে জালের লিফ্ট। আমরা যেমন পাউডার ব্যবহার করি তেমনই এই ধরনের জাল ব্যবহার করতো ইন্সপেক্টার মোহসিন। আমরা এখন ফাঁদে আটক হয়েছি মনে হয়’।

অন্ধকারে কি যে হচ্ছে তা তখন কিছুই বুঝছি না আমি।

হঠাৎ একটা আলোর বিন্দু জ্বলে উঠলো আর একটা আলোর তীর ঠিকরে গেল সামনে পড়ে থাকা কাঠের ঢিপির ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো কাঠের স্তুপ। সেই আলোতে দৃশ্যটা পরিষ্কার হ’লো। একটা জালে জনা দশেক লোক জড়িয়ে প্রায় দশ ফুট উঁচুতে ঝুলছে আর তাদের পায়ের নীচে জ্বলছে আগুন।

হাত থেকে দেশলাইটাকে ফেলে দিয়ে বাদল গাছের আড়াল থেকেই চেঁচিয়ে বললো-‘যার কাছে যা কিছু আছে সব নীচে ফেলতে শুরু করে দাও, বন্ধুরা। নইলে বিপদে পড়বে…’

উত্তরে একজন ডাকাত গুড়ুম গুড়ুম করে বার দুই গুলী চালিয়ে দিলো আমাদের গাছের দিকে। গাছের গুঁড়িতে এসে কোথা ও যেন দু’টো গুলিই বিঁধলো। কিন্তু তার ফলে গাছে বেঁধে রাখা দড়িটা খানিক ঢিলে হয়ে গেল কি ভাবে তা আমি বুঝলুম না কিন্তু জালের খাঁচাটা সড় সড় করে হাত তিনেক নেমে এলো আগুনের ওপরে আর আগুন ও নতুন সব কাঠের টুকরো আর শুকনো গাছের ডালপালাতে ধরে গিয়ে জোর হয়ে উঠলো।

দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন আর এতোগুলো লোক একসাথে ঝলসে যাচ্ছে বেশ। অর্থাৎ ডাকাতদের রোষ্ট তৈরী করা হচ্ছে সেখানে।

অল্পক্ষন পরেই তাদের বিষম চিৎকার শুরু হয়ে গেল।

বাদল চুপ।

তার আদেশ তখন ও পালিত হয় নি তাই সে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আর আগুনের শিখা ক্রমেই ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ডাকাতদের জামাকাপড়ে আগুন ধরবে মনে হয় এইবারে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছে তারা সবাই।

ঝপাঝপ শব্দে এইবার অনেক কিছুই নীচে এসে পড়তে শুরু হয়ে গেলো হঠাৎ। টাকা, গয়নার পুঁটলী, রুপোর বাসনপত্র ও ঝনঝন করে নীচে পড়ছে একে একে। তবে মনে হয় অস্ত্র শস্ত্র কিছুই নীচে পড়ে নি।

সত্যিই তাই । বাদল একটা ঢিল ছুঁড়লো যেখানে সব কিছু এসে পড়ছিল আর সঙ্গে সঙ্গে সেইখানে সাঁ করে ওপর থেকে নেমে এসে মাটিতে গেঁথে গেল একটা বিরাট বড় ছোরা। কিন্তু আবার ও তার ফল হ’লো বিপরীত।

আর ও একটু নেমে এলো জালের খাঁচা আর একজন ডাকাতের জামাতে আগুন ধরে গেল। তারা আগুন নেভাবার জন্যে তখন আপ্রান চেষ্টা করছে সেই জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। কিন্তু আগুনের তেজ ক্রমেই বেড়ে উঠছে।

বাদল আবার জোরে বলে উঠলো-‘আমার কিন্তু আর কোন দোষ নেই। তোমরা মোহসিন ইন্সপেক্টার সাহেবের আদেশ মানলে না। পুড়ে মরা তোমাদের আজ কেউ আটকাতে আর পারবে না’।

নামটা শোনা মাত্রই… বাবা’রে…. মা’রে…. করে উঠলো ডাকাতের দল এবং ঝনঝন করে ছোরা- ছুরী, কুড়ুল, কাস্তে, পিস্তল কত সব কি যে এসে মাটিতে পড়তে শুরু হয়ে গেল তার আর ঠিক নেই। ঘন ধোঁয়া আর লকলকে আগুন একে একে সব ডাকাতদের ঘিরে ধরেছে তখন।

হঠাৎ আগুন একটু যেন স্তিমিত হ’লো আর অনেকেই চাপড়ে টাপড়ে গায়ের আগুনও নিভিয়ে আনলো কিন্তু কালো ঘন ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে একে একে তারা অজ্ঞান হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।

একজন ও আর দাঁড়িয়ে রইলো না।

বাদল তখন এগিয়ে গেল আর সবকিছু টাকা পয়সা, গয়না টয়না আর রুপোর জিনিষপত্র কুড়িয়ে নিয়ে নিজের গায়ের জামাটা খুলে ফেলে একটা বড় পোঁটলা মতন বেঁধে নিয়ে বললো—‘এসো কাকু, বিয়ে বাড়িতে এইগুলো আবার আগে রেখে আসা যাক। নইলে তো আর বিয়েই হয়ে উঠবে না। তারপরে গেলেই হবে । এই ডাকাতের দল তো অন্য সবাইকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ায় আর এখন নিজেরা সামান্য ধোঁয়া খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো দেখছি। অবশ্য আগুনের জোর আছে তাই অন্ততপক্ষে আধসেদ্ধ হয়ে যাবে সবাই বেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই। জীবনে আর ওদের ডাকাতি করতে হবে না’।

তা আমরা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখি তখনও সবাই সে’খানে ও দিব্যি ঘুমে অচেতন।

বাদল লুটের জিনিষপত্র, টাকা পয়সা, উপহার সামগ্রী সব কিছুই একে একে বিয়ের বেদিতে সাজিয়ে রেখে দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে নিজের জামাটা গায়ে প’রে নিয়ে দ্রুত ফিরে এলো।

‘চলো কাকু। কাজ হয়ে গেছে। এ’বার কেউ জেগে ওঠবার আগেই আমরা চলে যাই চলো নইলে ঝামেলার একশেষ হবে’।

আগের জায়গায় দ্রুত ফিরে এসে দেখি যে তখন আগুন কমে এসেছে আর অজ্ঞান অবস্থায় ডাকাতগুলো সব মাটিতে পড়ে আছে।
মনে ভাবলুম-‘কে নীচে নামালো ও’দের? ইন্সপেক্টর মোহসিন না কী?’

সে যেই হোক, আমার দেখার বা জানার দরকার নেই। আমি তখন তাড়াতাড়ি গাড়ী টেনে এনে স্টার্ট দিচ্ছি।

বাদল উঠে বসতেই আমি চালিয়ে দিলুম গাড়ী।

প্রায় দশ মিনিট পরে জি০টি০রোডে এসে উঠতেই স্পীড দ্বিগুন করে দিলুম আমি।

তবু ও কেলহট বাজার হয়ে নারায়ণপুর, রামনগর, পড়াও, গঙ্গার ওপরে বিখ্যাত ট্রেন ও গাড়ি চলবার দু’তলা মালবীয় ব্রিজ, রাজঘাট, বিশ্বেশ্বরগন্জ বাজার, মৈদাগীন, চক বাজার, গোধূলিয়া সব পার হয়ে বাড়ী ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল আমাদের।

আগে পথের নোংরা আর ধূলো ময়লা কাটাতে বাদলকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাবান মাখিয়ে ভালো করে স্নান করাতে বসলুম আমি। তারপরে নিজেও স্নান টান সেরে নিয়ে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে চটপট করে খিচুড়ী আর আলু-পাঁপড়ভাজা তৈরী করে নিলুম আমি। শেষ পাতে মিষ্টি দই ও বোঁদের লাড্ডু দিয়ে ডিনার সেরে নিলুম দু’জনে। যা ক্ষিধে পেয়েছিল না আমাদের, সে আর বলবার নয়।

রাত এগারোটায় যখন বাদল জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে তখন আমি গিয়ে চঞ্চলের অভাবে বাদলকেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে নিয়ে ঘরেই পায়চারী করতে করতে বাদলকে খুব খানিক আদর ও করে নিলুম।

তার পরে বললুম-‘বাদল, ইন্সপেক্টার মোহসিন নির্ঘাৎ করে ভূত। শুনলে না ডাকাতগুলো বলছিলো যে উনি অনেকদিন আগে মারা গিয়েছেন। তাই আজ আমরা অভিসার করতে গিয়ে এক্কেবারে ভূত আর মির্জাপুরী ডাকাতদের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলাম আর কি। বাপ রে বাপ…..’।

আমার কথা শুনে অতি সুন্দর ছেলেটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে ফেলল।

তারপরে বললো-‘না কাকু, উনি ভূত নন। সে আমি তো জিজ্ঞাসা করেছিলাম যখন বিয়ে বাড়ীর লোকেশন ও রাস্তা দেখে আসতে যাই ওনার সাথে’।

‘তবে কি? মানুষ?’

‘ঠিক তাও নয়’।

‘তার মানে, বাদল?’

‘চোর ডাকাতদের সব ধরে ধরে ইন্সপেক্টার আংকল ভীষণ শাস্তি দিতেন তো। দেখতেই তো পেলে ডাকাতদের শাস্তির বহর আজ। তাই তারা ওনার গাড়ির সাথে একটা ভীষণ রকমের দুর্ঘটনা ঘটায়। গাড়িটার বেশী ক্ষতি হয় নি তবে আংকল ভীষণ আহত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিটমেন্ট করিয়ে ও বাঁচাতে পারে নি এখানকার ডাক্তারের দল। তাই তখন সরকারী ব্যবস্থায় ওনাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায় বিশেষ প্লেনে করে’।

‘সেখানে বিজ্ঞানীরা অনেক ভেবে চিন্তে ওনার মৃত্যুর সাথে সাথেই ব্রেনটা ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করে দেন একটা আধুনিক রোবোট বা সাইবর্গের শরীরে। কৃত্রিম বুদ্ধির বদলে আসল বুদ্ধির প্রযুক্তি সফল হয় তবে শরীরটা মানুষের নয় তো তাই ইচ্ছেমতন অদৃশ্য ও হতে পারেন আর অনেক জোর ও আছে ওনার গায়ে। দশজন মানুষকে জালে বেঁধে টেনে তোলা সামান্য কাজ ওনার কাছে। তবে স্টিলের তৈরী না হয়ে সিন্থেটিকে তৈরী বডির জন্য একটু সাবধানে থাকেন তাই আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। শীগ্গির করে এই ত্রুটি টুকু ও দূর করে দেবেন বৈজ্ঞানিকেরা।’।

‘গাড়িটা ও তো ওনারই ছিল। মৃত্যুর পরে যিনি কিনে নেন তিনি ভূতের ভয়ে বেচে দিয়েছিলেন তোমার বন্ধুকে। মনে হয় তোমার বন্ধু ও ভয় পেয়ে হিঃ হিঃ হিঃ’…..

‘তবে উনি গাড়িটা আমাকে ঊপহার দিয়ে দেবেন বলেছেন তাই হয়ত আর তোমার কোন অসুবিধা হবে না চালাতে, কাকু। তবে ওইরকম কিছু দুষ্টু লোকেদের দুষ্টুমির কান্ড দেখে হয়তো মাঝে মধ্যে তোমার গাড়ী বিগড়ে যেতে ও পারে। হাজার হোক সিপাহী কা ঘোড়া তো হিঃ হিঃ হিঃ’

হাসতে হাসতে বাদল বললো--‘তা কাকু, রাত তো এখন অনেক হয়ে গেল, কাকু। এইবার শুয়ে পড়বে চলো না হয়। কালকে অবশ্য চঞ্চল এসে না আমাকে ধরে আচ্ছা করে ঠেঙাবে, তা তুমি দেখে নিও কাকু। ওকে ফাঁকি দিয়ে আমরা দু’জনে দিব্যি মজা করে অভিসারে গিয়েছি আবার রাতে ও আমরা ওকে আনতে যাই নি, তাই বলে দারুণ রাগ ও করবে ছেলেটা। তার আর আমি কি করব বলো না তুমিই, কাকু? অন্ধকার পথের অভিসার যে কেমন জমেছিল আমাদের আজ, সে তো ওই পরীর দেশের রাজকুমার অপরূপ সুন্দর ছেলেটা বিশ্বাসই করবে না’।

আমি বাদলকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললুম- ‘তবে তাই চলো, বাদল। কালকের কথা কালকে ভাবলেই হবে না হয়। আমরা আজ একটু মনের সুখে ঘুমিয়ে নিই গিয়ে এখন মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ে। দারুণ ঘুম ও তো পাচ্ছে পেট ভরে খেয়ে উঠে। চঞ্চলের অবশ্য ঘুম হবে না ভালো করে আজ রাতে, বাড়িতে মায়ের কাছে শুয়ে। অভ্যাস দোষ যাবে কোথায়? আর তাই ছেলেটা বেশ রেগে ও যাবে নির্ঘাৎ করে। তার আর কি করা?’।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # বেশ বড় গল্প । অনেক রোমাঞ্চকর ও শিক্ষনীয় । লেখককে ধন্যবাদ ।।
এশরার লতিফ বেশ সুখপাঠ্য কিশোর-গল্প। ভালো লাগলো।
তাপসকিরণ রায় গল্পটি সামান্য বড় হলেও বেশ ভাল লাগল।ধন্যবাদ আপনাকে।এ সাইটে আপনি নতুন,সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়া উচিত।আলোচনা,বার্তালাপ ইত্যাদির মাধ্যমে কিছুটা চেনা জানা হলে ভাল।অবশ্য এটা আমার বক্তব্য--কতটা ঠিক বেঠিক জানি না--বিবেচনা তো আপনার হাতে।
সূর্য চমৎকার গল্প। বেশ ভালো লাগলো।
মামুন ম. আজিজ চমঃকার ফ্যান্টাসী গল।প। এক্কেবারে পরিপণত মষ্তিষ্কের পরিণত ফ্যানটাসী

২৩ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪