থাকে শুধু অন্ধকার

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

সানোয়ার রাসেল
আলো—অন্ধকার—আলো—আলো—অন্ধকার—অন্ধকার—অন্ধকার—অন্ধকার—আলো—অন্ধকার......অন্ধকার............
আলো আর অন্ধকারের জয় পরাজয়ের সংখ্যা গণনা করা হচ্ছে। এক মাস আগে, কোন এক তর্কময় সন্ধ্যায় আলো আর অন্ধকার বাজি ধরেছিলো। পবিত্র শরবত পান করতে করতে আলো বলছিলো-
- বুঝলে হে অন্ধকার, পৃথিবীর সব মানুষই আলোর পথে চলতে চায়, আলোর অভাবেই কেবল অন্ধকারের পথে চলে যায় তারা। অন্ধকার? সে তো আলোর অনুপস্থিতি মাত্র। মানুষ জন্মগতভাবেই আলোকের রাজ্যের বাসিন্দা।
শরাবের পেয়ালায় লম্বা চুমুক দিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে অন্ধকার আলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো-
- মানুষ বিষয়ক তোমার জ্ঞানের বহর দেখে তোমার জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না আমার। মানুষের জন্মই হয় আঁধারে, স্বভাবতই সে আঁধারের বাসিন্দা। কেবল আমার অকর্মণ্যতাই তাদের তোমার দিকে ধাবিত করে। তুমি কি দেখ না সুযোগ পেলেই তাদের ভিতরের আঁধার কিভাবে ঠেলে বেরিয়ে আসে!
- অসম্ভব, তোমার কথা মানতে পারলাম না।
- ঠিক আছে, তো হয়ে যাক বাজি। দেখি আজ থেকে এক মাসের মধ্যে কতজন মানুষকে তুমি আলোর পথে চালিত করতে পার আর আমি আঁধারের পথে? রাজি?
- রাজি।
তো আজ সেই এক মাস পূর্ণ হয়েছে। আর আলো বিস্মিত-বিমর্ষ হৃদয়ে দেখছে অন্ধকারের কাছে সে শোচনীয় ভাবে পরাজিত। তবে সে এতদিন যা জেনে এসেছে তা সবই ভুল! মানুষ কি জন্মগতভাবেই আঁধার পথের যাত্রী?
‘হে ঈশ্বর!’, বিলাপ করে উঠে আলো। ‘ তবে আমার এ অস্তিত্বের আর মূল্য কি? মানুষই যখন আমায় আকাঙ্ক্ষা করে না, যাচনা করে না, তখন এ অনাকাংক্ষিত অযাচিত জীবন রেখে আর লাভ কী? আমি নিজেকে ধ্বংস করে দেবো।’
‘ আরে রোসো’, তাকে থামায় অন্ধকার, ‘ এত সহজেই মরে গিয়ে বেঁচে যাবে ভাবছো? আমার জয়ের গল্প তোমাকে রসিয়ে রসিয়ে বলে তোমার অন্তর্দহন আরো বাড়িয়ে তবেই না আমার প্রকৃত সুখ।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে আলো বললো, ‘ আরো অন্তর্দহন? তোমার জন্য আমার মৃত্যুই কি যথেষ্ঠ আনন্দদায়ক নয়?’
‘ উফ, তুমি বড় অস্থির আলো’ ধমকে উঠে বলে অন্ধকার। ‘ মরার এতো তাড়া কেন? আগে শোনোই না আমার জয়ের ঘটনাগুলো। কোনটা বলি, কোনটা বলি... হুম... রাবু নামের মেয়েটা যে অন্ধকারের পথ বেছে নিলো সেই ঘটনাটা বলি। শোন তবে।’

রহিমপুরের কাদু মিয়ার মেয়ে রাবু। বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড়। বর্গাদার কাদু মিয়ার অভাবের সংসার, অসুস্থ পরিবার আর আন্ডাগন্ডা ছেলেপুলে নিয়ে নিতান্তই কষ্টে কাটে তার দিন। এই কষ্টের মধ্যেও রাবুটাকে নাইন পর্যন্ত পড়াচ্ছিলো কাদু মিয়া। না, মেয়েকে জজ ব্যারিস্টার বানানোর স্বপ্ন দেখতো না সে। শত অভাবের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তা একটা জিনিষের অভাব দেন নি তার সংসারে, আর তা হলো রাবুর রূপ। ‘মেয়েটার চেহারা যেন বড়লোকের ঘরের মেমদের মত’, ভাবে কাদু মিয়া। দশ ক্লাশ পাশ করালে হয়তো রূপের জোরে একটা ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পারবে এই আশায় পেটে পাথর বেঁধে মেয়েকে পড়াচ্ছিলো কাদু মিয়া। রাবুও বুঝতো তাদের অভবের কষ্ট, যখন যেভাবে পারতো সংসারের কাজে সাহায্য করতো। এইটুকু বয়সেই ভাবতো কিভাবে সংসারে একটু সুখ একটু স্বচ্ছলতা আসে। কিভাবে সংসারের দুঃখের অন্ধকার দূর করে সুখের আলো জ্বালানো যায়। সেই সময় বাচ্চুর রূপ ধরে তার সামনে আবির্ভাভূত হলাম আমি, অন্ধকার। প্রথম প্রথম ওর স্কুলে আসা যাওয়ার পথে বসে ওকে লাইন মারতে লাগলাম। সেও লক্ষ করলো। আমার ঠাঁট বাট আর শহুরে ভাব তাকে আকৃষ্ট করেছিলো। পাঁচ দিন পর তার রূপের প্রশংসা করে গদ্য পদ্য মিশিয়ে একটা চিঠি হাতে গুজে দিয়ে সটকে পড়লাম। বলেছিলাম আমাকে ভালো লাগলে যেন চিঠিতে লেখা জায়গায় চলে আসে। পরদিন সে এলো, মনের অনেক কথা হলো, আমি ভালোমানুষ শ্রোতার মত শুনে গেলাম, সে তার পরিবারের কথা বললো, অভাবের সংসারের কথা বললো। আমি তার রূপের প্রশংসা করলাম, আমার সাথে শহরের নামি দামী চিত্র পরিচালকের পরিচয়ের কথা বললাম, শহরের চাকচিক্যের গল্প শোনালাম, চিত্রতারকাদের বিলাস বহুল আলো ঝলমলে জীবনের গল্প শোনালাম। তার চোখ স্বপ্নময় হল, চোখের মনি উত্তেজনায় উজ্জ্বল হল, সে যেন সেই না দেখা ভূবনের স্বাদ চোখের মনি দিয়ে আমার গল্প থেকে শুষে নিতে চাইছিলো। সব শেষে আমি আমার মোক্ষম চাল চাললাম। ওকে বললাম ওর যে রূপ আর বয়স আমি যদি একটু চেষ্টা করি তবে ওকে কোন এক ফিল্মের নায়িকা বানিয়ে দিতে পারি। ও যখন বিখ্যাত নায়িকা হবে তখন তাদের আর কোন অভাব থাকবে না, তার মায়ের আর অসুখ থাকবে না, বাপকে আর বর্গা খাটতে হবে না। সংসারে কোন অন্ধকার থাকবে না, শুধু আলো আর আলো। আর ওর যে চেহারা, যে রূপ, ও যে বিখ্যাত নায়িকা হবেই এতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু সাহস করে কাউকে কিছু না বলে আমার সাথে শহরে যেতে হবে, ব্যস।
- ‘তারপর, তারপর কি হল?’ আলো কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো।
- তারপর আর কি? রাবু চলে এলো বাচ্চুর সাথে আলোর জগতের খোঁজে শহরে, তারপর এ হাত সে হাতে সে বদল হতে থাকলো, তার রূপ যৌবন হাঁটে হাঁটে সুলভে বিক্রী হতে লাগলো, সিনেমায় সে নেমেছে বটে, তবে নায়িকা হয়ে নয়। এক্সট্রা হয়ে। এখন আর আলো অন্ধকার নিয়ে এতো ভাবে না, শরীরটাকে মাগনা বিলানোর চেয়ে কিছু মূল্যের বিনিময়ে বেচাটাকেই সে যৌক্তিক মনে করে। অন্ধকারই এখন তার জীবন, অন্ধকারই তার নিয়তি।
- ‘হায় ঈশ্বর’, আবার আর্তনাদ করে উঠে আলো। ‘ আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।’
- ‘তুমি কি এখনো আত্মহত্যা করতে চাও?’, অন্ধকার প্রশ্ন করে।
- ‘এছাড়া আর কিই বা করার আছে?’
- ‘তুমি কি ঘটনাটা শুনে কিছুই বুঝতে পার নি? তুমি কি বুঝতে পারছো না যে তোমার কথাই ঠিক? পৃথিবীর সব মানুষই আলোর পথে চলতে চায়, আলোর অভাবেই কেবল অন্ধকারের পথে চলে যায় তারা। খেয়াল করে দেখ, আমি কি করেছি? আমি কেবল রাবুকে আলোর জগতের স্বপ্ন দেখিয়েছি, তাকে বলেছি আমার সাথে চল, আমি তোমাকে আলোর পথে নিয়ে যাবো। সে অন্ধকারে পা বাড়িয়েছে শুধু আলোর পথে যাবে বলে! আলোই তার কাংক্ষিত ছিল, আঁধার নয়। এমনি করে আমি এই এক মাসে যতজনকে অন্ধকারের পথে এনেছি সব্বাইকে শুধু একটাই কথা বলেছি, আলো, সামনে আরো অনেক আলো, চলো আলোর পথে। আর ওরা আলো খুঁজতে এসে আঁধারে হারিয়ে গেছে। আসলে তুমিই জয়ী হয়েছো।’ অন্ধকার শরাবের পেয়ালা ভরতে ভরতে বলে।
- ‘সত্যি বলছো? এভাবে আলোর খোজে যদি মানুষ আঁধারেই হারিয়ে যায় তবেই বা আমার বেঁচে থেকে কী লাভ? আর তুমিই বা আমাকে বাঁচাতে চাইছো কেন?’ আলো এবার বিস্মিত।
- ‘তুমি সত্যিই বোকা, আমি তাদের অন্ধকারের পথে চালিত করতে পেরেছি কারন সেখানে জ্ঞান উপস্থিত ছিলোনা, ওরা আলো আর অন্ধকারের প্রভেদ বুঝতে পারেনি। কাজেই তোমার উচিত এখন জ্ঞানের সন্ধানে বের হওয়া’, অন্ধকার এক চুমক দেয় পেয়ালায়। ‘আর তোমাকে বাঁচাতে চাইছি কেন? তুমি না থাকলে আমারই বা কাজ কি? সারাক্ষণ তো আর পেয়ালা নিয়ে বসে থাকা যায় না, তাই না? মাঝে মাঝে তোমার পেছনে লাগি বলেই তো আমার জীবনে কিছু আনন্দ আসে, যাও, এই এক মাস ম্যালা খাটিয়েছো, এখন তুমি জ্ঞানের সন্ধানে যাও আর আমায় একটু শান্তিতে পেয়ালায় চুমুক দিতে দাও।’
- ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, তাই যাই’, বলে আলো আনন্দিত মনে জ্ঞানের সন্ধানে গেলো।
আর অন্ধকার? সে তখন একাকী বসে শরাবের পাত্রে চুমুক দিতে লাগলো আর জড়ানো স্বরে আবৃতি করতে লাগলো তার প্রিয় দুটি লাইন,
‘সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। হা হা হা, থাকে শুধু অন্ধকার হে, হিইক, আর কিছু থাকেনা কখনো, থাকে-শুধু- অন-ধ-অ-কা-আ-র।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # নতুন আঙ্গিকে---নোতুন ফ্লেবার জরানো দারুন একটি গল্প । এর শুরু ---পথচলা ও সমাপ্তির শিহরনটা বেশ অভিনব । এক কথায় অনেক সুন্দর ও চমৎকার । লেখককে ধন্যবাদ ।।
ধন্যবাদ জুয়েল ভাই। গল্পটি ভালো লেগেছে জেনে পুলকিত হলাম।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি আলো আর আধারের তুলনা দিয়ে গল্পের শেস ....এবং জীবনানন্দের কবিতার রেশ খুব ভাল লাগলো......রাসেল ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ.............
জ্যোতিদা, সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, আপনাকে মিস করছিলাম।
মোঃ আক্তারুজ্জামান চমৎকার উপস্থাপনার গল্প। খুব ভালো লাগল- ধন্যবাদ।
সূর্য একটা বিভেদ থাকতেই পারে, মানুষ আলো খুজতে অন্ধকারে হারায় না অন্ধকারে আলো খোজে। বাচ্চু রূপে ভর করা অন্ধকারের রসবোধ আর সরল স্বিকারোক্তি "তুমি কি বুঝতে পারছো না যে তোমার কথাই ঠিক? পৃথিবীর সব মানুষই আলোর পথে চলতে চায়, আলোর অভাবেই কেবল অন্ধকারের পথে চলে যায় তারা।" গল্পের দার্শনিকতা বেশ স্পষ্ট করেছে। চমৎকার পরিপূর্ণ একটা গল্পের জন্য লেখক অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
ধন্যবাদ সূর্য। আমি দার্শনিক নই। গল্প লেখকমাত্র। গল্প নিজেই তার দর্শন বেছে নিয়েছে। লেখক এখানে গৌন হয়ে গেছে।
মিলন বনিক দুটো আপেক্ষিক বিষয়ের অসাধারণ উপস্থাপনায় রীতিমত মুগ্ধ....অনন্য অসাধারণ.....অনেক ভালো লাগলো...শুভ কামনা...
অদিতি ভট্টাচার্য্য গল্পের শুরুতে আলো আর অন্ধকারের সংলাপ, তারপর অন্ধকারের রূপ হিসেবে বাচ্চুর প্রবেশ, আলোর স্বপ্ন চোখে নিয়ে অন্ধকারের পথে রাবুর যাত্রা – সব মিলিয়ে অত্যন্ত অভিনব। সাবলীল ভাষা গল্পকে আরো আকর্ষণীয় করেছে।
চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ অদিতি।
তাপসকিরণ রায় খুব সুন্দর লেগেছে গল্পটি--সঠিক যৌক্তিক উপমার মাধ্যমে লেখাতি পরিবেশিত হয়েছে।ভাব ভাষা দারাবাহিকতা বেশ ভাল।
ধন্যবাদ তাপসদা, প্রতি সংখ্যায় লেখা প্রকাশ হবার পর আপনার মন্তব্য জানতে উন্মুখ হয়ে থাকি।
রোদের ছায়া আলো আর অন্ধকারের এই দোটানার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কতো জীবন । খুব সাবলীল আর দক্ষতার সাথে এগিয়েছে গল্পটি । আলো আর অন্ধকারের আলাপচারিতা এটাও বেশ ভিন্নতার স্বাদ দিলো । আর শেষও করলেন সুন্দর একটা কবিতার সুন্দর একটা লাইন দিয়ে.........দারুন ।
ভালো লেগেছে জেনে সুখী হলাম। আর চমতকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এশরার লতিফ দারুন পরিপক্ক এবং পরিপূর্ণ গল্প। প্লেটোর সংলাপের মত দার্শনিকতাময়।
এশরার ভাই, লজ্জায় ফেলে দিলেন।

০১ ডিসেম্বর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী