ভালোবাসার সুরেলা বাঁশি

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

এনামুল হক টগর
  • 0
ছোট বেলায় সিদ্দিক আর মারুফা এক সাথে স্কুলে যেত, গ্রামের আঁকা বাঁকা বেশ কিছু পথ পেরিয়ে। মারুফা ছিল খুব মেধাবী ছাত্রী। সিদ্দিকের বাড়ি থেকে কিছু দূরে মারুফার বাড়ি। মাঝে মাঝে তার বাড়িতে সিদ্দিক যেত।

এই নিয়ে পাড়ার মানুষ নানা রকম কথা বলতো। ছোট বেলায় সব কথার অর্থ বুঝা যায় না। মারুফার প্রতি গাঁয়ের অনেক ছেলেরই ক্ষোভ, তা শুধু সুন্দরী হওয়ার কারণে। সিদ্দিককে মাঝে মাঝে ওরা শাসাতো কিন্তু সিদ্দিক ভয় করতো না। তার মনের গভীরে এক প্রেমের সুরেলা বাঁশি বাজতো। মনে হতো জন্ম জন্মান্তর ধরে মারুফা তার। এই পৃথিবীতে মারুফার জন্মই হয়েছে সিদ্দিকের জন্য।

পদ্মার চর জেগে উঠতো। জোছনা রাতে সিদ্দিক মাঝিদের সাথে প্রেমের সুরে বাঁশি বাজাতো। জোছনার আলোয় ভাঙনের নদীতে পুরাতন সাকিন জেগে উঠতো। যেখানে পূর্বকালে মানুষেরা ঘর বেঁধেছিল। পাড়ভাঙা নদীর স্্েরাতে আবাদের কৃষক কেঁদে উঠতো।

ক্ষুধায় কাতর স্বপ্নহারা সেই আহাজারী শুনে অতন্দ্রায় হেঁটে যেতো কালের বধুরা। মাঝে মাঝে মারুফা তার মা বাবার সাথে জোছনা রাতে পদ্মা নদীর তীরে এসে দাঁড়াতো। নদীর পাশেই তাদের বাড়ি ছিল। আরো ছিল সাত পুরুষের স্মৃতিময় ভিটে।

নদীতে জোছনা দেখার নাম করে মাঝে মাঝে মারুফা সিদ্দিকের সাথে দেখা করতো। মারুফা আর সিদ্দিক আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। আগামী বছর তারা এস, এস, সি পরীক্ষা দিবে। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি চলছে। দুজন ভালো ফলাফল করবে বলে তারা বিশ্বাস করে।

সিদ্দিকের বাবা একজন কৃষক। নতুন ফসল ফলানোর চেষ্টায় মাটিকে ভেঙে আবাদের উপযোগী করে তোলেন। সিদ্দিককে নিয়ে তার অনেক বড় স্বপ্ন। তার সন্তান লেখা পড়া করে অনেক বড় হবে। মানুষকে ভালোবাসবে, দেশকে ভালোবাসবে। জীবনের কল্যাণে সিদ্দিক অনেক দূর পথ হেঁটে যাবে।

সিদ্দিকও নিজেকে দক্ষ ভাবে গড়ে তুলতে চায়। মারুফার বাবা একজন ছোট চাকুরিজীবী। একটি মাত্র মেয়ে তার। সব সময় মেয়ের লেখা পড়ার খোঁজ রাখেন। নিয়মিত স্কুলের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করেন। মারুফা বরাবরই তার ক্লাসে প্রথম। সিদ্দিক কখনো দ্বিতীয় কখনো তৃতীয় হয়। আস্তে আস্তে তারা উভয়ই উপরের ক্লাসে উঠতে লাগলো। বক্ষময় সুন্দর তরুণ তরুণীর রূপ ধারন করলো। সোনালী শস্যের বুক ছুঁয়ে পাখিরা উড়ে গেলো। জীবনের অক্লান্ত গান নিত্য নতুন জেগে উঠলো।

ফেব্র“য়ারী মাসে এস, এস, সি পরীক্ষা, মাত্র তিন মাস সময় আছে। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী রীতিমত পড়াশোনা শুরু করেছে। আষাঢ় মাস গভীর রাত। একদিন নদীতে বর্ষার গর্জন শোনা গেলো। এমন ভয়ংকর গর্জন সিদ্দিক জীবনে শোনেনি। নদীর বান দ্র“তবেগে ছুটে আসছে। সিদ্দিক তার বাবাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাবাকে বললো মারূফাদের বাড়ির দিকে যেতে। অন্ধকার রাত বাতাস আর বৃষ্টি ঝরছে। মারুফাদের বাড়িতে যাওয়ার পথ পানিতে ভরে গেছে। সিদ্দিক তার বাবাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ভয়ংকর এক ঢেউ এসে সিদ্দিক আর তার বাবাকে পৃথক করে ফেললো।

সিদ্দিকের বাবা কোথায় ভেসে গেলেন একমাত্র নদীই বলতে পারে। সিদ্দিক ভাসতে ভাসতে এক উঁচু দ্বীপের উপর গিয়ে দাঁড়ায়। নদী তাকে ভালোবেসে দ্বীপের উপর পৌঁছে দিয়েছে। গভীর রাত্রে অনেকেই এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সিদ্দিক তার বাবা মা, ভাই বোন কারো কোন খোঁজ জানে না।

বাবাকে তো এই নদীর ভয়ংকর ঢেউ তার সামনে থেকেই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মারুফা কোথায় কেমন আছে সিদ্দিক তা জানে না। কেবল নদীর বিভৎস আওয়াজ তাকে বিপন্ন করে তোলে। কোন মৃত পথিক ঘুমিয়ে আছে বটের শেকড়ে। নষ্ট প্রহর পচনের গলিত লাশ ভেসে যায় দূরে। ক্ষুধার্ত অনাহারীর আহাজারী, শেয়াল কুকুরের ছিঁড়ে খাওয়া দেহ। নিখোঁজ পাখিরা আর নীড়ে ফিরেনি।

জীবনের ক্লান্ত গানে এই নিসর্গ বিরাণ ভূমিতে মারুফার কথা তার মনে পড়ে। অসহ দহন, ভোরের প্রহরে জেগে উঠেছে তার অস্তিত্বের ভেতর দূর্ভিক্ষের ছবি। এই বিষণœ মহামারি আতংকভরা জাতি। নিত্য জন্ম মৃত্যু জ্বলন্ত শিখায় কালের ধ্বনি শোনে দূর লোকালয় থেকে। বিদীর্ণ জ্বালা ভয়ার্ত দুঃসময়ে এক কালো নির্মম সকাল উঠেছে জেগে। সিদ্দিক দ্বীপ থেকে দূরে তাকালো। কোথাও কোন গ্রাম চোখে পড়লো না। শুধু ধু-ধু শূন্য।

সিদ্দিক মনে মনে ভাবে বর্ষার এই ভয়ংকর দাপটে বাবা, মা ভাই বোন কেউ হয়তো বেঁচে নেই। থাকলেও আমার মতো নদীর পানি ভালোবেসে হয়তো তাদেরকে কোন দ্বীপে পৌঁছে দিয়েছে। মারুফা হয়তো তার পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও ভেসে গেছে। ছায়াহীন বৃক্ষের নীচে মানুষের এক দীর্ঘ রাত কেটে যাচ্ছে। ঘুমহীন জীবনের চোখ উলঙ্গ মানুষের মতো হাহাকারে কাঁদে। সিদ্দিক ভাবে আলাদা আলাদা পথে আমরা সবাই হারিয়ে গেলাম। ভাঙনের গান রুদ্ধ করে দিলো আমাদের জীবন।

কোথায় মারুফা কোথায় আমি আমরা কেউ কারো খবর জানি না। শুধু নদী জানে আমাদের ঠিকানা। এভাবে দিন যায় রাত যায়। সিদ্দিক ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। কখনো কখনো নদীর তীরে বসে ভালোবাসার সুরেলা বাঁশি বাজায়। যে বাঁশির সুরে একদিন মারুফা ছুটে আসতো নদীর তীরে। সেই প্রাচীন ব্যথিত জীবনের কান্না, অমীমাংসিত ক্ষোভ, দহন বিষে ভ্রষ্ট আঁধারের মতো সিদ্দিককে কাঁদায়। জীর্ণ কৃষকের বুকে জ্বলে শানিত আগুন। ক্ষুধার অনাহারী পেট ছিঁড়ে ফেলে ঘাতকের অস্ত্র। সিদ্দিক চেয়ে থাকে নদীর পানে।

কখন ফিরে আসবে তার আপন জনেরা। কবে তার ভালোবাসার বাঁশি নতুন করে সুর ফিরে পাবে। এভাবে মাস যায়, বছর যায়। প্রায় এক যুগ পরে হঠাৎ একদিন সিদ্দিকের বাঁশির সুরে নদীর ঘাটে একটি নৌকা দাঁড়ায়।

নৌকা থেকে নেমে একজন মহিলা ধীরে ধীরে সিদ্দিকের দিকে আসছে। সিদ্দিকের বাঁশির সুর তার ঠিকানা। বহুদিন পরে সিদ্দিকের বাঁশির সুর তার কানে গিয়ে বিঁধেছে। জীবনের ভালোবাসা গুলো শস্য বীজের মতো অঙ্কুরিত হচ্ছে অতীত স্মৃতির গন্ধে। পুরানো দিনের কথা তার মনে পড়েছে। সিদ্দিক চেয়ে দেখে এ যে মারুফা! দুর্যোগ অন্ধকার ভাঙা সেই পুরাতন পরিচিত মুখ। যে কঠিন তিমিরে হারিয়ে গিয়েছিল। সিদ্দিকের ক্লান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। প্রিয়তমার রঙিন বিষণœ চোখ দেখে, দুঃখের রঙ দিয়ে, সিদ্দিক যে ভালোবাসা একদিন এঁকেছিল তার দেহের ছোট্ট ঘরে। অনেক স্বপ্ন দিয়ে কষ্ট দিয়ে নির্মাণ করেছিল সুন্দর একটি ছবি। সে আজ বহু বছর পর তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

যেন হৃদয়ের মর্মমূলে আঁকড়ে ধরেছে নতুন শেকড়। দুর্যোগ দিনে হারিয়ে যাওয়া অনাহার পীড়িত সেই কিশোরী হেঁটে এসেছে তার ঠিকানার পথে। নির্জন এই নদীর তীরে জীবনকে ভালোবেসে জীবন কথা বলে। সরল স্বপ্নের সংসার জাগে সিদ্দিকের মনে। দেহের ভেতরে শীতল আশা। শেষ বিকেলের তমসা ঝরে পড়েছে সবুজ মাটির বুকে। দিনের রোদ ঝরে ঝরে সন্ধ্যা নেমে আসছে আঁধারের খোঁজে। সিদ্দিক আর মারুফা দাঁড়িয়ে আছে অনুকুল বিশ্বাসী জীবনের বেদনায়।

হঠাৎ একটি কিশোর আর একটি মাঝ বয়সী লোক নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মারুফার কাছে এসে দাঁড়ালো। মারুফা বললো, এই কিশোর আমার সন্তান। আমার স্বামী ব্যবসা করে গঞ্জের নতুন বাজারে। সময় পেলে তুমি আমাদের বাড়িতে এসো। কথাগুলো বলে মারুফা তার স্বামী সন্তানকে নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকাটির দিকে হাঁটতে থাকলে সিদ্দিকের বুকে নিঃশব্দ মৃত্যুর নীরব ক্ষত বিক্ষত বেদনা কেঁদে উঠলো।

তার ক্লান্ত বাঁশী থেমে গেলো। স্বেচ্ছাদহনে নিরূপায় মাঝি নদীর পথ হারালো। বিশাল পৃথিবীর অক্ষম বেদনা তার বুকে এসে বিঁধলো। পরাজিত ব্যর্থ দেহে রাতের আঁধার নেমে এলো। গ­ানির স্পর্শে করুণার চাঁদ মেঘে ঢেকে গেলো।

মনে হয় অনিদ্রার শোকে পৃথিবী জেগে আছে। এই মাটি শ্যামলিমা বালুর চর পেরিয়ে উদাসী রাখাল বাঁশি হাতে আঁধারে পথে হাঁটতে হাঁটতে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে। জীবনের শেষ সুরেলা বাঁশি তার হৃদয়ের গভীরে ক্লান্ত সুর তুলেছে এক অচিন জগতের খোঁজে...।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Arif Billah অসাধারণ গল্প। খুব ভালো লাগলো। শ্রদ্ধা জানবেন।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
সৃজন শারফিনুল ভাল লাগলো খুব অনেক শুভ কামনা।।।
ভালো লাগেনি ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
রবিউল ই রুবেন ভালো লেগেছে কিন্তু সুন্দর হয়েছে।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

২১ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৯৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪