অন্ধ প্রাসাদ

রাত (মে ২০১৪)

এনামুল হক টগর
  • 0
নিদ্রামগ্ন সারারাত ক্লান্ত। রূপালী নদীর মুখে ঝর্ণা মিশে যায়। নদী বয়ে চলে শেষে সাগরের পাথে। পৃথিবীর বুকে অসংখ্য প্রাণের খেলা। বহু বছর ধরে এই রূপালী নদীর পরিত্যক্ত অন্ধ প্রাসাদ পড়ে আছে।

দুই জন পরির এখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। গভীর রাতে তাদের মনে এই অন্ধ প্রাসাদের মর্মান্তিক ঘটনা গুলো জেগে ওঠে। দুইজন পরি একে অপরকে এই প্রাসাদের অতীতের কথাগুলি বলাবলি করে।

নিবিড় প্রেমের বাঁধনে একদিন এই প্রাসাদে রাজা, রাণী, রাজপুত্র আর রাজকন্যা বাস করতো। স্বর্গের সম্মোহিত বাতাস বইতো এই প্রাসাদে। মুখরিত সঙ্গীত লহরী গানে ভরে থাকতো এই প্রাসাদ।

হঠাৎ এক গভীর রাতের অন্ধকারে রাজকন্যা এই প্রাসাদে মৃত্যু বরণ করে। রাজা রাণী এই করুণ মৃত্যুতে মর্মাহত হয়। রাজা রাণী উভয়ই রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসতো। রাজকন্যা ছিল অলক গুচ্ছ তারা ঝলমল সোনালী নক্ষত্রের মতো।

এই মৃত্যু রাজা রাণীর জীবনকে কাঁদায়। একদিন রাজার এক পণ্ডিত রাজরানীকে পরামর্শ দিয়েছিল রাজকন্যার জন্য একজন শিশু কন্যাকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিতে হবে।

রাজরানী পন্ডিতের পরামর্শের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয় নাই। রাজারাণী জানে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টিকর্তার নিয়মে চলে। রাজকন্যার মৃত্যুর কারণে রাজা রাণী খুবই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। রাজকন্যার মৃত্যুর বেদনায় তারা ক্লান্ত।

এভাবে দিন যায় রাত যায়। আবার একদিন রাজার পণ্ডিত এসে রাজা রাণীকে পরামর্শ দিল যে রাজপুত্রের জন্য একজন ছেলে শিশুকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিতে হবে। রাজা এ বিষয়ে রাণীর সাথে পরামর্শ করে কিš— রাণী এই নিষ্ঠুর কাজের ব্যাপারে রাজী হয় না।

রাণীর মন ছিল মায়া মমতায় ভরা। এভাবে দিন যেতে যেতে গভীর রাত আসে। হঠাৎ এই গভীর রাতে রাজপুত্র প্রাসাদে শোবার ঘরে মৃত্যু বরণ করে।

পরদিন ভোর বেলায় রাজপুত্রের মৃত্যুর সংবাদ শুনে রাজরানী ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাজা রাণীর বুক জুরে উত্তাপের আগুন জ্বলছে। মুখ তার লাল, চোখ তার জ্বলš— দাহ। মনের ভিতরে পন্ডিতের পরামর্শ জেগে ওঠে এবং নরপশু শয়তানের জ্ঞান রাজা রাণীর মাথায় ঢোকে।

রাজা রাণী চিন্তা করে পন্ডিতের কথা মতো একটি শিশু কন্যা আর একটি শিশু পুত্র দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিলে হয়তো এমনটা হতো না। রাজা রাণী ভুলে গেলো পৃথিবীর প্রথম খুনি কাবিলের কথা। যে আজো মাথার উপর অভিশাপ নিয়ে ক্ষমার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দেবতা খুশি থাকলে আমাদের সন্তানরা জীবিত থাকতো এমন ভুল ধারণা শয়তান পন্ডিতের মাধ্যমে রাজা রাণীর মাথায় আসে।

এমন সময় শয়তান পণ্ডিত রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং রাজা রাণীকে পুনরায় পরামর্শ দেয় রাজপুত্র আর রাজকন্যার আত্মার শান্তির জন্য এবং এই রাজ্যের মঙ্গলের জন্য প্রতি বছর একটি নিখুঁত মেয়ে শিশু আর একটি নিখুঁত ছেলে শিশুকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিতে হবে।

এই বলী দেওয়ার কারণে দেবতা খুশি হবে এবং আপনাদের পুত্র কন্যার আত্মা শান্তি পাবে আর রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে, যা আপনাদের জন্য কল্যাণ। রাজা রাণী শয়তান পন্ডিতের পরামর্শের প্রতি গুরুত্ব দেয় এবং তারা রাজ্যের শিশুদের প্রতি নির্দয় মনোভাব পোষণ করে।

রাজা রাণী মনে করে প্রতি বছর দেবতাকে খুশি করার জন্য একটি মেয়ে শিশু আর একটি ছেলে শিশু বলী দিতে হবে নইলে আমাদের সন্তানের আত্মা শান্তি পাবে না। আর রাজ্যেরও মঙ্গল আসবে না। এ প্রাসাদের সাতটি গেইট আছে। প্রতি বছর একটি গেইটের সামনে একটি করে শিশু বলী দেওয়া হয়।

রাজা রাণী মনে করে এই বলিদান দেবতাকে খুশি করবে। প্রতিটি গেইটে যেন শিশুদের মৃত্যু দোল খায়। ধূসর অতীত কান্না ঝরে পড়ে দুর্গম অচেনা রাতের গভীরে। রাজা রাণীর ধারণা এই গেইট দিয়ে দেব দেবীরা প্রাসাদের ভিতরে যাতায়াত করে। প্রতি বছর দেবতাদের উদ্দেশ্যে একটি করে শিশু বলী দিলে দেবতারা সে রক্ত পান করে খুশি হবে এবং রাজ্যে শান্তি আসবে এবং মানুষের কল্যাণ হবে আর আমাদের সন্তানদের আত্মা শান্তি পাবে।

শিশুদেরকে বলী দিয়ে উৎসর্গ করা হবে দেবতাদের উদ্দেশ্যে। গভীর রাতে রাজ প্রসাদে উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে শিশুদেরকে রাজা ও রাণীর সামনে বলী দেওয়া হবে।

শিশুরা যাতে বলী দেওয়ার সময় চিৎকার করতে না পারে সে জন্য আগে থেকে তাদের জিব কেটে দেওয়া হয়। রাজা রাণী তার কর্মচারী আর জল্লাদকে বলে দিলো প্রতি বছর রাজ্যের সবচেয়ে নিখুঁত শিশুটি খুঁজে এনে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দেওয়া হবে।

রাজা রাণীর সিদ্ধান্তের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে জল্লাদরা প্রতি বছর রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর নিখুঁত শিশুটি রাজার বলীর জন্য সামনে নিয়ে আসে। রাজারাণী নির্দিষ্ট সময় মত গভীর রাতে দেবতার উদ্দেশ্যে তাদের বলী দেওয়া হবে বলে জানায়।

রাজারাণীর ধারণা ঘন কুয়াশা, ছায়া ছায়া জোছনা, অনাহার হতবিহবল, পাহাড় সমুদ্র, জন্ম বিদায় আর গভীর নীরবতার মাঝে দেবতা মাঝ রাতে এই প্রাসাদে প্রবেশ করে।

যেহেতু তার রাজপুত্র আর রাজকন্যা গভীর রাতে মৃত্যু বরণ করেছে। ছেলে শিশুকে দেবতার উদ্দেশ্যের বলী দেওয়া হতো আর মেয়ে শিশুদেরকে বলী দেওয়া হতো দেবীর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। মেয়ে শিশুদেরকে গলা কেটে সব রক্ত বের করা হতো এবং শরীরটা টুকরো করে কেটে তার রক্তের সাথে মিশ্রণ করে রাজ প্রাসাদের সাতটি গেইটের সামনে গভীর রাতে রেখে দেওয়া হতো।

উৎসর্গ করা এই শিশু মেয়েদেরকে স্বর্গবাসী বলে রাজপরিবার থেকে তার বাবা মাকে জানিয়ে দেওয়া হতো আরো জানিয়ে দেওয়া হতো যে, এই শিশু একদিন তোমাদের জন্য দেবতার কাছে সুপারিশ করে তোমাদেরকে স্বর্গে নিয়ে যাবে।

ভয়ে বাবা মা এ বুঝ নিয়ে গভীর রাতে বলিদান শেষে নিজ বাড়ি ফিরতো। ওদের বলী দেওয়ার সময় ধুপ জ্বালানো হতো, ফুল ছিটানো হতো। ওরা যাতে পরকালে গিয়ে বাবা মা দেশের মানুষের আর রাজ্যের কল্যাণের জন্য সুপারিশ করে।

রাজারাণী তার সন্তান হারাবার পর ধারণা শিশু বলিদান না করলে মাঠে কোন ফসল ফলবে না। তাদের ধারণা এই সময় দেব উপবাস করে। কারণ শয়তানের সাথে এই সময় তাদের যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। বাবা মা তাদের সš—ান বাঁচার জন্য সব ধরণের চেষ্টা করতো।

তাদের মুখে কালি দিয়ে রাখা হতো। রাজা বলী দানের বিষয়ে একটি আইন করে, যে প্রথমে ক্রীতদাস পরিবার থেকে এই সব শিশু আসবে। পরে আস্তে আস্তে রাজ্যের অন্যান্য পরিবার থেকে একটি করে শিশু উক্ত উৎসর্গের জন্য আনা হবে। কোন রকম খুঁতয়লা শিশুকে দেব দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা যাবে না। এমন কথা শুনে রাজ্যের মানুষ তাদের শিশুদের শরীর বিকৃতি করতে থাকে। কারো অঙ্গুল কাটা হয়, কারো কান কাটা হয় অথবা শরীরে যে কোন অংশ কেটে ফেলে তারা। রাজ্যের মানুষ এক সময় তাদের নিজেদের সন্তান না দিয়ে পতিতাদের কাছ থেকে বেওয়ারিশ শিশুদের নিয়ে দেব দেবীর উদ্দেশ্যে বলিদান করে উৎসর্গ করতো।

রাজারাণী এই সব প্রতারণার কথা জানার পরও না জানার ভান করতো। কারণ রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। অভিজাত পরিবার তাদের মেয়েদের ঘরে না রেখে পাশের রাজ্যে বিবাহ দিয়ে দিত। রাজারাণী অভিজাত পরিবারের সম্পর্কে সতর্ক থাকতো। যে মেয়ে বা ছেলে শিশুকে বলী দিয়ে উৎসর্গ করা হতো সেই ছেলে বা মেয়েটা রাজ্যের যে পরিবারের নাম উলে­খ করতো রাজা রানী সেই পরিবারের প্রতি সম্মান দেখাতো এবং দূত মারফত সংবাদ পাঠাতো যে, আপনার সন্তান এখন স্বর্গে আছে এবং আপনাদেরকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবতার কাছে সুপারিশ করছে।

উৎসর্গ করা ছেলে মেয়েদের বেশ কিছুদিন প্রাসাদে আটক রাখা হতো। তাদের সেবা দেওয়া হতো ভালো খাবার দেওয়া হতো এবং সুন্দর চেহারার জন্য দামী দামী কসমেটিক দেওয়া হতো। তাদেরকে স্বর্গের শান্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। স্বর্গে গেলে সারাটা জীবন অমর হয়ে ভালো থাকা যায়।

বলিদান দেওয়া হতো ছন্দময় গান আর নাচের অনুষ্ঠানে। সংগীত লহরী সুরের মধ্যে সবাই যখন মদ খেয়ে মাতাল হতো ঠিক তখনই বলিদান করে হত্যা করা হতো ঐ শিশুদের। সবাইকে বুঝাতো ওদের আত্মদানের উপর সারা রাজ্যের কল্যাণ নির্ভর করছে। জীবনকে দান করানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করানো হতো। নীরব কান্না দিয়ে দেবীর গান করা হতো। এই সব গানের মধ্যে থাকতো গভীর প্রেম ভালোবাসা অব্যক্ত বেদনার ভাষাহীন সুর। এই ভাবে রাজ্যে অনেক দিন পার হয়ে যায়। অল্প লোকই এখন রাজারাণীকে ভালোবাসে। রাজ্যের অধিকাংশ লোকের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব দেখা দিয়েছে।

প্রাসাদের কর্মচারীরা এখন আগের মতো তাদের বলিদান অনুষ্ঠান করতে ভয় পায়। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষই এই ধরণের শিশু বলিদান করে দেবতার সন্তুষ্টি চায় না। তাদের মনের গভীরে অতীতের কথা গুলো জেগে ওঠে। কিভাবে শিশুদেরকে চুলের মুঠি ধরে বলিদান উৎসবে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের করুণ আর্ত চিৎকার আজ রাজ্যের অধিকাংশ লোকের কানে ভেসে আসে।
যাদের সন্তান বলিদান করা হয়েছে তাদের বাবা মা আজ অধিকাংশই উন্মাদ পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে আবার কেউ কেউ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। আতংক ক্রোধ আর এই সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে নাই। রাজা রাণী তাদের সন্তানদের আত্মার শান্তির জন্য শুধু মাত্র এইসব শিশুদেরকে দেব দেবীর নামে উৎসর্গ করেছে।

স্বৈরাচারী রাজারাণীর পতনের সুর ভেসে উঠেছে। রাজ্যের মানুষ গভীর রাতে প্রাসাদে আক্রমণ করে রাজা রাণীকে হত্যা করে। পরিরা এই অতি প্রাচীন পুরনো গল্প বলতে বলতে বেশ ক্লান্ত। এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

রাজা রাণী তার দুই সন্তানকে হারিয়ে ঈর্ষাপরায়ণ আর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। সে দেব-দেবীর খুশি করার জন্য শয়তান পন্ডিতের পরামর্শ মতে এইসব ঘটনা ঘটায়।

দুইজন পরি এই ঘটনা বলতে বলতে খুব মন খারাপ করে। তারা ভাবে পৃথিবীতে এই ধরণের ঘটনা হয়তো আরো অনেক আছে। এই বলতে বলতে তারা দুইজন পৃথিবীর অন্য কোন পরিত্যক্ত প্রাসাদের সন্ধানে দিগন্তে পাখা মেলে।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। নিষ্পাপ শিশুগলোর জন্য ব্যথায় ভরে উঠল বুক।
Gazi Nishad খুব খুব ভালোলাগা। আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইলো ভাই।
এফ, আই , জুয়েল # অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।

২১ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৯৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪