এক শিশু মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

তাপসকিরণ রায়
  • ২৫
  • ১০
(মুক্তি যোদ্ধাদের কাহিনী বেশী দূরের ইতিহাস নয়।তাই সত্যকে বাদ দিয়ে কোন কিছু লেখার অবকাশ এখানে নেই বললেই চলে।তবু গল্পের খাতিরে নিবন্ধর একঘেয়েমির প্যাটার্নকে এড়িয়ে যেতে কিছু নড়েচড়ে চলতে হয় বৈকি!এজন্যে পরিবেশ পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে নিজের মত করে কিছু কথোপকথন যুক্ত করেছি।বলা বাহুল্য,তা গল্পের খাতিরেই আমায় করতে হয়েছে।তবে সম্ভাব্যতাকে কথাও পার হতে দিতে চাই নি। নামধাম,সংখ্যা ইত্যাদি ব্যাপারগুলির আলাদা ভাবে শুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।দু একটি আর্টিকেলে দেখেছি কোথাও সিদ্দুর,কথাও সিদ্দিক নামের ব্যাবহার হয়েছে।আমিও এর ব্যতিক্রমে যাই নি।আমি যে রেফারেন্স ধরে চলেছি সে গুলির উল্লেখ গল্পের শেষে দিয়েছি।তার পরেও যদি কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে থাকে সে জন্যে শুরুতেই পাঠকের কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি)

আগুন,আগুন,আগুন,চারিদিকে চাপা কোলাহল ও গুঞ্জন উঠলো।দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো এক প্রত্যন্ত পল্লী গ্রাম,গাঁওগরার এক ঘর।ভয় ত্রস্ত গ্রামবাসীরা চাপা উত্তেজনায় নিজেদের বাঁচাবার জন্যে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে ফিরছিল।
ঘরের ছোট্ট এগারো বছরের শিশু মোঃ সিদ্দুর রহমানের চোখে আতঙ্কের ছায়া!তাঁর বড় ভাই জিন্দার আলী তাকে নিয়ে তাদের ঘরের অদূরের এক জঙ্গলের দিকে ছুটে চলেছে।বাঁচতে হলে ওই জঙ্গলে নিতে হবে আশ্রয়। ওরা তাড়াতাড়ি জঙ্গলের এক গভীর জাগা নিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
আগুন,আগুন,কোলাহলের শব্দকে ম্লান করে দিয়ে যে শব্দগুলি আরও তীব্র হয়ে বুকের কাঁটা হয়ে বাঁধছিল তা হল উল্লাস,উন্মত্ততার কিছু উন্মাদ চীৎকার--সে চীৎকার ছিল বর্বরতার,ধ্বংসের--মানুষের মনুষ্যত্বকে দলে পিষে মাড়িয়ে যাবার চীৎকার!
তখন দাউ দাউ করে সে আগুন আরও অনেক লেলিহান শিখা নিয়ে যেন আকাশকে গ্রাস করার মিথ্যা আস্ফালন করে চলছিল।হা হা অট্টহাস রাজাকার ও পাক বাহিনীর লোকদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল।সিদ্দুর ও তার দাদা জিন্দার আলীর কানে সব কিছু পৌঁছচ্ছিল।ওদের চোখে তখন ছিল আতংকের ছায়া।বাবা,মা, পরিবারের সবার চিন্তায় ওরা ছিল ব্যাকুল। মন ওদের ছটফট করে উঠছিল। জঙ্গলের এপাশ ওপাশ থেকে ঝোপ ঝাড় সরিয়ে ওরা দেখ ছিল ক্রমশ পুড়ে যাওয়া নিজেদের ঘরখানিকে!সিদ্দুর একটা হাত শক্ত করে ধরে ছিল জিন্দার,তার বড় ভাই।
--বাবা!মা!,বলে চীত্কার করতে যাচ্ছিল সিদ্দুর।
--চুপ,বলে মুখ চেপে ধরেছিল জিন্দার, ফিসফিস চাপা শব্দে বলে উঠেছিল, চুপ,ভাই!কোন শব্দ করা চলবে না--ওই আতংকীরা জানতে পারলে আমাদের যানে মেরে দেবে!
রাগে ফুঁসছিল ছোট সিদ্দিক।কান্নার আওয়াজ বুকের মধ্যেই থামিয়ে রেখেছিল ও।ফিসফিসিয়ে কান্নার মত করে ডেকে উঠেছিল,মা! বাবা!
ও চোখের সামনে নিজেদের ঘর পুড়ে যেতে দেখল।বাবা,মার জন্যে ওর প্রাণ যেন পুড়ে যাচ্ছিল।কিছুই করতে পারছিল না!তবু এক প্রতিবাদী ভাব তার মধ্যে বিদ্রোহের ভাব সৃজন করে চল ছিল।ওর অজান্তেই ওর দাঁতে দাঁত ঘষে যাচ্ছিল।
একাত্তর মানেই জ্বলে ওঠা দেশের কথা মনে পড়ে,একাত্তর মানেই সেই আকাশে,বাতাসে ভেসে যাওয়া আগুন ছড়ানো গানের কথা মনে পড়ে। একাত্তর মানেই তো বাংলার প্রিয় স্বাধীনতা,বাংলা মায়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন!

এক দিকে বর্বর পাকবাহিনীর নৃশংস অত্যাচার,অন্য দিকে নিপীড়িত মানুষের জীবন মরণ হাহাকার!নিপীড়িত,নিরীহ মানুষগুলি সহ্যের সীমা পার করে এক দিন রুখে দাঁড়ালো।চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ তরতাজা মানুষের নৃশংস হত্যা--হাজারও নারীর শ্লীলতা হানীর ঘটনার ভেতর দিয়েই তো উন্মেষিত হল সেই চেতনা,সেই উদ্বুদ্ধতা—যা দিয়ে সৃষ্টি হল মুক্তির আগুন জ্বালার গান।সৃষ্টি হল হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা!
সেই একাত্তরের কথা,তখনই জ্বলে উঠে ছিল লক্ষ লক্ষ মুক্তি পাগল মানুষের মত এক প্রত্যন্ত গ্রামের এগার বছরের শিশু--নাম তার মোঃ সিদ্দিক রহমান।পৃথিবীর ইতিহাসে সেই এক মাত্র কনিষ্ঠ তম মুক্তিযোদ্ধা। তার জীবনের কিছু ঘটনাকেই আজ আমরা স্মরণ করতে চলেছি।
জিন্দার অনেক আগেই মুক্তি যোদ্ধার দলে নাম লিখিয়ে ছিলেন।ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে বাড়িতে বাবা,মার সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিলেন।এ খবর মুহূর্তের মধ্যেই রাজাকারদের কানে পৌঁছে যায়।রাজাকা পাকবাহিনী সহ তাদের গ্রামে এসে জিন্দার-সিদ্দুরদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারপর ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন জিন্দারকে পায়নি তখন ওরা ওদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।নিজের প্রাণ বাঁচাতে তাই তো জিন্দার সিদ্দুরকে নিয়ে লুকিয়ে গিয়ে ছিলেন ঘরের অদূরের জঙ্গলে।সেই জঙ্গলে সিদ্দিক আর তার বড় ভাই,জিন্দার অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাটালো। তাদের ঘর তখন ভস্মীভূত।পাকবাহিনী তাদের অত্যাচার ছেড়ে এক সময় কখন যেন চলে গেছে।ওরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো।জিন্দার জানতেন পাক বুড়বকের দল ওঁদের বাঁচতে দেবে না।
ওদের বাবা গোলাম আলীও তা ভালো ভাবে বুঝতে পেরে ছিলেন।আর দেরী না করে তাই তিনি অশ্রু সজন নয়নে সিদ্দিক ও জিন্দারকে পাঠিয়ে দিলেন ভারতে।মার স্নেহাঁচল ছেড়ে তাঁরা ঘর ছেড়ে পাড়ি দিলেন
ভারতে।
তারপর কত মাঠঘাট,নদী,বিল পেরিয়ে এক সময় ওরা পৌঁছালেন ভারতের বনগাঁর এক ক্যাম্পে।বনগাঁ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন সিদ্দুর দুলা ভাই,জাহাতাব উদ্দিন।ছোট্ট সিদ্দুর এখানে এসে দেখে যায় যুদ্ধ প্রশিক্ষণ,যুদ্ধের নানান কলা কৌশল।সে দূর থেকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে সেই ভাবী মুক্তি বাহিনীর দিকে।ওর শরীরে যোশ ভরে যায়।মনের মধ্যে ভীষণ এক বিদ্রোহী আগুন যেন প্রতি নিয়ত ওর বুকে জ্বলতে থাকে।তার দেশের মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার,জঙ্গি পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যার লীলা,নারী ধর্ষণের পশু বৃত্তি তার মনকে কঠোর ভাবে নাড়িয়ে যেতে থাকে।ছোট্ট ছেলের চেহারায় তার মনের উত্তাল ঢেউ বাইরে থেকে ধরা পড়ে না।কারো বোঝার উপায় ছিল না যে ঐটুকু ছেলের বুকে জ্বলে যাচ্ছে অগ্নি দাব!তাই তো সেই ছেলে এক দিন তার কমান্ডার দুলা ভাইকে নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে বসলো।
--দুলাভাই!আমি মুক্তিযুদ্ধে নামতে চাই!
দুলাভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন,তিনি খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সিদ্দুর দিকে।তিনি দেখলেন,অতি সাধারণ একটি ছেলে, চেহারায় বিশেষ কিছুই নজরে পড়ে না!তবে বয়সের তুলনায় বড় বেশী ধীর স্থির!তিনি বললেন,তুই?তুই তো বড় ছোট রে!এ বয়সে তোকে কে যুদ্ধে যেতে দেবে বল?
সিদ্দিক স্থির অবিচল হয়ে বলল,না,আমি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেব,দুলাভাই! মনে হল যেন কোন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের কোন কথন!
দুলাভাই দেখতে পেলেন তাঁর সামনে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সে ছোট্ট হলেও মোটেও দুর্বল নয়!দৃঢ়চেতা,ঋজুটান ছেলেটির বুকেও বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে কি?এতটুকু ছেলে কি পারবে এই যুদ্ধের লড়াইয়ে নামতে?
একই কথা বারবার বলে যায় সিদ্দুর। দুলাভাই আর,না,করতে পারলেন না, বললেন,তবে এই লাইনে দাঁড়িয়ে দেখ--যুদ্ধের প্রশিক্ষণে তোর নাম লেখায় কি না?
সিদ্দুর একটাও কথা বলে না,সোজা গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে।ছোট্ট শিশুই তো বলা চলে ওকে!ও দেখল,সবাই অবাক হয়ে বারবার ওর দিকে ফিরে ফিরে তাকায়,কেউ বা মুচকি হাসে,কেউবা চোখে মুখে আশ্চর্যের প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে চুপ করে যায়!আশপাশের সব লোকদের দৃষ্টি তখন সিদ্দুর দিকে।তাকে নিয়ে কিছু হাসাহাসি,টিপ্পনীর শব্দও কি ওর কানে গিয়ে পৌঁছেছিল?
প্রশিক্ষণার্থীদের লাইন ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলো।সিদ্দিকের মনের কোনে একই প্রশ্ন,পারবে কি সে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণে যোগ দিতে?তার চেহারা দেখে ওরা কি ওকে ওদের দলে নেবে?
--কি নাম তোমার?বিস্মিত প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলেন সামনে দাঁড়ানো ঈষৎ গম্ভীর লোকটি।তিনিই তো বেছে নিচ্ছিলেন প্রশিক্ষণার্থীদের।
--সিদ্দিক!সংক্ষিপ্ত জবাব সিদ্দিকের।
--না,না।তুমি খুব ছোট--বন্দুকই ভালো করে তুলে ধরতে পারবে না!
নিরাশ হলেও সিদ্দুর থেমে গেল না,এবার সে গিয়ে দাঁড়ালো ব্যারাক পুর ক্যাম্পের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের লাইনে।সেই একই ব্যাপার পুনরাবৃত্তি হল।লাইনের সবাই ফিরে ফিরে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো শিশুটিকে। দু এক জন তাকে লাইন থেকে সরে দাঁড়াতেও বলল।কেউ কেউ হেসে ছিল,ব্যঙ্গ করে ছিল।কিন্তু সে অচল,অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো লাইনে!
ক্যাপ্টেন শিশু সিদ্দিককে দেখে অবাক হয়ে গেলেন,তিনি তাকে,যুদ্ধে নাম না লেখাবার কথা নানা ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।কিন্তু কে কার কথা শোনে!সে কিছুই বুঝতে চায় না,সে যুদ্ধে যাবেই।ক্যাপ্টেন এবার রেগে গেলেন,এতটুকু ছেলের এত জেদ!তিনি ওর বুকে এক থাপ্পড় মেরে দিলেন।সিদ্দিক তখন তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এর পর বীরভূম ক্যাম্পে আটাশ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিশু সিদ্দিক। এখানকার ক্যাম্পে সে যুদ্ধের বিভিন্ন কলা কৌশল রপ্ত করে।আর দশটা যোদ্ধা প্রশিক্ষণার্থীর মতই সে এগিয়ে যায় যুদ্ধের তৌর তরিকার শিক্ষার দিকে ।অভ্যাস ও একনিষ্ঠতা এক সময় তাকে সফলতা এনে দেয়।সে হয়ে ওঠে রণকৌশল এক শিশু যোদ্ধা!
এইবার সিদ্দিক পারবে তার দেশকে বাঁচাতে।পরাধীন বাংলা মায়ের শৃঙ্খল খুলে দিতে সে ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। অবিচার, অত্যাচার,রক্ত ক্ষরণের অস্থির বাংলাকে বাঁচাতে হবে।দেশদ্রোহী পাক জঙ্গিদের দিতে হবে উচিত শিক্ষা।ওদের হাত থেকে কলুষিত বাঙ্গালীকে,বাংলার মাটিকে,বাংলা মাকে যে বাঁচাতেই হবে! ওর খুব করে মনে পড়ছিল,ওর বাবা,মা,ওদের ঘরের কথা!যে ঘর এই পাকবাহিনীর জঙ্গীরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে!আবার ছোট সিদ্দিক নিজের অজান্তেই দাঁতে দাঁত পিষল।
এবার সম্মুখ সমরের পালা।বদলা নেবার সুযোগ এসেছে।ঐ দুরাচারী, অত্যাচারী পাক জঙ্গিদের ওরা কিছুতেই ছাড়বে না!ওদের কারণেই আজ তাদের এই ছন্নছাড়া বিদ্রোহী জীবন!সিদ্দিকের মনে হয় কে জানে বাবা,মা,বাঁচে আছে কিনা!পোড়া ঘর আবার ভীত নিয়ে দাঁড়িয়েছে কি না!এক সময় তার চোখের দু কোণ ভিজে যাচ্ছিল। না, তাড়াতাড়ি সে হাত দিয়ে দেখল,স্নেহ,প্রেম,ভালোবাসার সৃজিত সামান্য অশ্রু তার দু চোখের কোলে জমেছে বটে!চটপট সে মুছে নিলো সেই জল। না,তাকে এত দুর্বল হলে তো চলবে না!তাকে তো বদলা নিতে হবে—তাকে সম্মুখ সমরে নামতে হবে।
--হে আল্লাহ,হে খোদা!তুমি যেখানেই থাক আমায় শক্তি দাও!যুদ্ধে যেন বারবার জয়ী হতে পারি।বাংলা মায়ের দুঃখ যেন ঘুচাতে পারি--সিদ্দিকের আন্তরিক করুন প্রার্থনা যেন আকাশে বাতাসে রণিত হতে লাগলো।
ট্রাক চলেছে যশোরের চৌগাছা উপজেলার ধুলিয়ানী সীমান্তে।একশ চল্লিশ জন মুক্তি যোদ্ধা যুদ্ধ স্থলে চলেছেন।সঙ্গে বড় ভাই,জিন্দার আলী আর চাচা তবিবর রহমান। সবাই আজ মুক্তি যোদ্ধা! আর কিছু সময় পরেই সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে শত্রু বিনাশের লড়াইয়ে।সিদ্দিক চুপ চাপ বসে আছে।দেখে চলেছে রাস্তার দু পাশের জঙ্গল,মাঠ,ফসলের খেত,নদী,পুকুর,বিল—গ্রাম,গঞ্জ,পল্লী ছাড়িয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে।যেতে যেতে তার চোখে পড়ল,মাঠ সীমার কোন প্রান্তে জনশূন্য উজাড় কোন গ্রাম--অনেক জাগায় চোখে পড়ল,সবুজ কোমল প্রকৃতির সৌন্দর্য জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে।ট্রাক ছুটে চলেছে--হুহু বয়ে যাওয়া হাওয়া যেন কেঁদে কেঁদে কিছু বলে যাচ্ছে!হায় রে বাংলা মা! আজ তোমার এ কি দশা!
যশোরের চৌগাছা উপজেলার ধুলিয়ানী সীমান্ত আজ থম থম করছে। সামান্য পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তি যোদ্ধারা,গর্জে উঠল গুলি, বোমার আওয়াজ!বারুদী গন্ধে ভরে গেল হরিত প্রান্তর!চীত্কার চ্যাঁচামেচি হৈ হুল্লোড়ের মাঝে যুদ্ধ চলতে লাগলো।পাকবাহিনীর গোলাগুলি,বোমা ফেটে পড়ছে।মুক্তি যোদ্ধারাও শান্ত হয়ে বসে নেই—তাঁরাও নিজেদের আড়াল করে ছুঁড়ে যাচ্ছেন গুলি,বোমার ঝাঁক।এই সংঘর্ষের মধ্যেই কখন হঠাৎ দূর থেকে কারো আর্ত চীত্কার ভেসে আসলো--সে চীৎকার মৃত্যুর আর্তনাদ বলেই মনে হল।সিদ্দিক ছুটে গিয়ে দেখল তার বড় ভাই, জিন্দারের মৃত্যু হয়েছে।সে দেখল,সামান্য দূরত্বেই এক পাশে পড়ে আছে যে অন্য এক লাশ সেটা তার চাচা তবিবর রহমানের! সিদ্দিক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।সে কি করবে এখন কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।চারিদিকে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিবেশ,মাঝে মাঝে কান ফাটা শব্দ,আর্তনাদ।
বেশ কিছু সময় পরে শান্ত হল যুদ্ধ ক্ষেত্র।দেখা গেল যুদ্ধ ক্ষেত্র শূন্য পড়ে আছে--লাশের পর লাশ বিছিয়ে আছে চারি দিকে।
ধুলিয়ানীর রণক্ষেত্র ছিল তখন স্তব্ধ। সেখানকার এক যোদ্ধা সদস্য বিছিয়ে থাকা লাশের মধ্যে দেখলেন সিদ্দিকের দেহ পড়ে আছে--তাহলে কি সেও মারা গেল--ইতিহাসের সর্ব কনিষ্ঠ শিশু যোদ্ধাও কি তা হলে মৃত? এমনি সময় সদস্যটি দেখলেন ছেলেটি যেন নড়ে চড়ে উঠলো বলে মনে হল!প্রথমে ভ্রম বলেই তাঁর মনে হয়ে ছিল।ছেলেটির দিকে তিনি ছুটে গেলেন।ওর নাকের কাছে হাত রেখে পরখ করতে লাগলেন।হঠাৎ তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন শিশুটি নড়ে উঠলো--তার মানে সিদ্দিক বেঁচে আছে!ও মরে নি!ওকে তিনি নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। কিছু দিনের সেবা শুশ্রূষায় আবার সিদ্দিক ভালো হয়ে উঠলো।এ ঘটনার কিছু দিন পরে সিদ্দিকের বাবা মারা যান।বড় দাদা,চাচা,বাবা--সবাইকে হারিয়ে বড় আশায় হয়ে পড়ে ছিল শিশু সিদ্দিক।পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শেষে সে ছিল জীবন যুদ্ধের সৈনিক!
আর কত দিন,দুঃখের পরেই ত সুখ আসে!তাই উজ্জ্বল এক সকাল এলো।শিশু সিদ্দিক রাত শেষের ঘুম ভেঙ্গে ঘরের বাইরে এসে দেখল,স্নাত সূর্যের এক সকাল! দুঃসময়ের কুয়াশা ভেঙ্গে যেন নতুন সূর্য উঠে আসছে!হ্যাঁ,সত্যি তাই,একদিন ১৯৭১সালের ৯ মাসের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।তার চূড়ান্ত ফল হিসাবে বাংলা পেলো স্বাধীনতা।
আজ মহামহিম সিদ্দিক নিজের প্রচেষ্টায় সুপ্রতিষ্ঠিত।

সমাপ্ত

গল্প সাজাতে যে সমস্ত তথ্য আমার সাহায্যে এসেছে:
(১)বি২৪ নিউজ ডট কম,ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকের সাক্ষাতকার।
(২) বি২৪ নিউজ ডট কম,ঢাকার বার্তা প্রধান কাজী আব্দুস সামাদের সাক্ষাতকার।
(৩)পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র স্বীকৃত সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তি যোদ্ধা হিসাবে গিনেস বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে মেম্বার শিপ মনোনয়ন পেয়েছেন (claim-ld-213031,Membership No.188143).
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবেই গল্পটা তুলে ধরেছেন খুব ভাল লাগল শুভকামনা
ইউশা হামিদ দারুণ তথ্য সমৃদ্ধ গল্প লেখার জন্য অভিনন্দন তাপস দাদা ।
প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস ভালো লাগলো ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা সত্য কাহিনী। ধন্যবাদ দাদা, শুভেচ্ছা রইলো।
ফিদাতো মিশকা সুন্দর লিখেছেন প্রিয়
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম কিন্তু দু:খ কেবল এই যে, স্বাধীন দেশে ৪১টা বছর ধরে প্রতিটা দায়িত্বশীল ব্যক্তি সিদ্দিককে অপমান করেছে। এখনো করছে । এজন্যই আমি আমার আব্বার একটা প্রশ্নের সমাধান বলতে খুব পছন্দ করি । এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত ? তিনি এর সমাধান দেন এভাবে " সাড়েসাতকোটি মানুষ - (মাইনাস) তালিকাভূক্ত রাজাকার= মোট মুক্তিযোদ্ধা ।" এ সমাধান খুব যুক্তিসংগত মনে হয় আমার কাছে । কেননা সে সময়ে কোলের শিশুটা তার মায়ের বুকে তাড়া খেয়ে ফিরেছে জীবনের প্রয়োজনে ।যারা বাস্তব না দেখেছে, তারা বুঝবে না এই শিশু + তার মা প্রকান্তরে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছে কত করুণভাবে । তাহলে তার মা এবং তাকে কেন সে তালিকা থেকে বাদ রাখবেন ? আজ কেন জানি মনে হয় দেশের সরকার এ বিষয়ক একটা মন্ত্রণালয় এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা করে কিছু সুবিধে দিতে যেয়ে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে উপহাস করছে ।
শাহ আকরাম রিয়াদ লেখাটি পড়ে এই প্রথম জানতে পারলাম আমাদের ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধার কথা। ভাল লাগলো। লেখাটি যদিও পূর্বে পড়েছিলাম, তথাপি কমেন্ট করেছিলাম, কিন্তু ইন্টারনেটের বিড়ম্বনায় কমেন্ট পোষ্ট হয়নি।
সূর্য সাবলীল বর্ণনায় তথ্য বহুল কাহিনী। তবে এটাই আপনার সাফল্য যে গল্পটায় বাহুল্য চেপে বসতে দেননি। উল্লেখ না করলে এটা সাবলীল একটা গল্পই মনে হতো।
আহমেদ সাবের বাস্তব ঘটনার আলোকে লেখা গল্পটা আপনার কুশলী হাতের সাবলীল লেখায় প্রাণ পেয়েছে। বেশ ভালো লাগলো।
গাজী তারেক আজিজ ভালো লেগেছে। ভালো থাকুন।

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪