প্রতিশোধ

সবুজ (জুলাই ২০১২)

sakil
  • ৩৮
আকাশে তখনো ঝলমলে রোদ।নীলাকাশ।সাদা আভা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে অচেনা কোন দেশে। আকাশের নীল যেন ছুঁতে চায় মহাকাশের অনন্ত সীমানা।জ্যৈষ্ঠের দুপুর।দক্ষিণা মৃদু বাতাস ক্লান্ত পথিকের জন্য অনেক প্রশান্তির হয়ে আসে। ক্লান্ত পথিক শান্তির ছোঁয়া পেয়ে পথ চলতে থাকে।ফসল কাটা শুকনো মাঠ , কেটে নেওয়া ধানের গোড়াগুলো শুকিয়ে একাকার আগুনের ছোঁয়া পেলে জ্বলে উঠবে যেন এখুনি। মরে যাওয়া নদী শুকিয়ে আছে। নদীর পাড়ে গৃহহারা কিছু মানুষের অস্থায়ী বসবাস।অনতি দূরে রেলের রাস্তা , অন্যপাশে ব্যাস্তময় পাকা সড়ক। দুই রাস্তার মাঝে ছোট একটি গ্রাম।কয়েকটি বনেদী পরিবার আর কিছু দারিদ্র মানুষের বসবাস।সব মিলিয়ে অবস্থা আর আট দশটা গ্রামের মত।
বৃদ্ধা আমেনা এই গ্রামের দাঈ’মা।সকলে অবশ্য আমুনি’দাঈ বলে ডাকে। কেউ আবার বড়মা বলে ও ডাকে। একসময় আমেনা দাঈয়ের অনেক নাম ছিল। পাড়ায় কারো সন্তান সম্ভাবনা হলে আমেনা দাঈয়ের ডাক পড়ত সবার আগে। সেই সময় বেশ ভালো রোজগার হত। আমেনার এই ব্যাপারে কোন ধরাবাধা নিয়ম ছিলনা। যার যা সামর্থ্য ছিল সে তাই দিত। আমেনা দাঈয়ের হাত ধরে আসা অনেকে ছেলে মেয়ে আজ অনেক বড় নামকরা মানুষ।কেউ ডাক্তার , কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ নতুন পাটের শাড়ি দিত, কেউ পাঁচসের চাউল এক পোয়া সর্ষের তৈল একটি কাপড় ধোয়ার সাবান। পয়সা ওয়ালা কেউ আবার সুগন্ধি তৈল এবং গায়ে মাখার সাবান ও দিত। এতে করে আমেনা দাঈয়ের সংসার চলে যেত সাচ্ছন্দে । বছরে দশ বারো খান কাম হত।
আমেনা দাঈয়ের একমাত্র মেয়ে আছিয়া। দেখতে শ্যামলা , কিন্তু মায়াবী দু’চোখ। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে।এরপর আর স্কুলে যায়নি। গ্রামে প্রাইমারি স্কুল থাকায় ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পেরেছে।গ্রাম থেকে হাই স্কুল দুই কিঃমিঃ দূরে। তাই লেখাপড়া বন্ধ।ছোট একটা কুঁড়ে ঘর। ছনের ছাউনি।বর্ষা এলে পানি ছুঁইয়ে ঘর ভেসে যায়। তখন মা মেয়ে জবুথবু হয়ে সারের কাগজ( পলিথিন) পেছিয়ে ঘরের এক কোনায় বসে থাকে। দিনে দিনে মানুষ আধুনিক হয়ে যাওয়ায় আমেনা দাঈয়ের কাজ কমে গেছে। নেহায়েত দারিদ্র মানুষের ঘরে এখন ডাক পড়ে আমেনা দাঈয়ের। মেয়ের জন্য বেশ চিন্তা হয়। বয়স পনের ছুঁই ছুঁই করছে। রাতের বেলায় বদ ছেলের দল ঘরের বাইরে কুই দেয়। রাতে ঠিক মত ঘুম আসে না ।আজ যদি আছিয়ার বাবা বেঁচে থাকত তাহলে আর চিন্তা করতে হত না , ভাবে আমেনা দাঈ।
যুদ্ধের বছর ছিল তখন। চারদিকে থমথমে অবস্থা। গ্রামের সকলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে মিলিটারির ভয়ে। নতুন বিয়ে হয়েছিল আমিনার। স্বামী আকবর মিয়া খেয়া ঘাটের মাঝি। সারা বছর গ্রামের লোকদের নদী পার করে দেয়। বিনিময়ে ফি বছর গ্রামের সকলে মিলে চাল ডাল ও নানা দরকারি জিনিস দেয় আকবর মিয়াকে। গ্রামের মির্জা বাড়ির বড় কর্তা মাসে মাসে কিছু টাকা দেন । তাতে করে ভালোই চলে যেত দু’জনের সংসার । একদিন রাতে আমেনা সুখবর দিল আকবর মিয়াকে, তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে। সেই কথা শুনে আকবর মিয়ার খুশি যেন থামে না । পরদিন পুরো গ্রামে জানাজানি হয়ে গেল সেই খবর। কেউ নিয়ে আসে নিজের ক্ষেতের লাউ, কেউ নিয়ে আসে নিজের পালিত একটা মুরগীর বাচ্চা। সকলে আমেনাকে নানা উপদেশ দেয়। বাড়ির পাশের বৌয়েরা এসে রান্না করে দেয়, পানি এনে দেয়। কি সুখ , কি ভালোবাসা আমেনা ভাবত সেই সময়। কিন্তু বিধতা মানুষের কপালে সুখ বুঝি বেশিদিন লিখেন না । দেশে তখন অস্থির অবস্থা। আমেনা অবশ্য এসবের কিছুই জানেনা। তবে রাতে খাবার সময় আকবর মিয়ার মুখে কেমন যেন চিন্তার রেখা দেখতে পেত। আকবর মিয়া বলত।
-এবার একটা কিছু হবেরে বউ।দেখিস এবার আমরা স্বাধীন হইয়্যা যামু।
আমেনা এসব কথার মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝত না। কিন্তু এখন বুঝে।একদিন রাতে আকবর মিয়া এসে বলে বৌ আমাগো এলাকায় মিলিটারি আইস্যা গেছে। পরদিন সকালে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল অজানা গন্তব্যে। আমেনা আর আকবর মিয়া রয়ে গেল। তাদের যাওয়ার কোন জায়গা ছিলনা। আর আমেনার এই অবস্থায় কোথাও যাবার কথা ভাবতে ও পারল না আকবর মিয়া। সেই সময়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা ও এসে অবস্থান নিল রেলে লাইনের ওপাশের গ্রামে। রাতের বেলায় প্রায় দুই পক্ষের মাঝে প্রচণ্ড গোলাগুলি হত। একদিন রাতে পাকসেনারা এসে আকবর মিয়াকে জোর করে নিয়ে গেল খেয়া বাইতে। নদীর ওপাড়ে মুক্তি সেনাদের ক্যাম্পে হানা দিবে সেই লক্ষ্যে। আকবর মিয়া প্রথমে অপারগতা জানালে গুলি মারার ভয় দেখায় পাক হায়নারা।পাকসেনাদের নিয়ে নদী পার হচ্ছিল আকবর মাঝি । মাঝ নদীতে এসে আকবর মিয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।নদীর ওপাড়ে থাকা মুক্তি সেনারা টের পেয়ে যায়। হ্যাজাক লাইটের আলো জ্বেলে নদীর বুকে পাকবাহীনির সেনাদের দেখতে পেয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। পাল্টা জবাব দেয় পাকসেনারা। নদীর পাড় থেকে মুক্তি যোদ্ধারা গুলি করে বেশ কয়েকজন পাকসেনাকে খতম করে দেয়। কিন্তু নদীর বুকে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে অ্যামবুশ হয়ে মারা যান আকবর মিয়া।পরদিন সবুজ ঘাসের উপর আকবর আলির লাশ নিয়ে আসে পাশের বাড়ির রহমান। নদীর মাঝে নাকি ভেসেছিল আকবর মিয়ার মৃতদেহ। আমেনা দু’চোখে আঁধার দেখেন। এরপর দেশ স্বাধীন হয়, কন্যা আছিয়ার জন্ম হয়।সেই সব অনেক কথা, একেকটা কষ্টের গল্প।আমেনা হাল ছাড়েননি। পাশের বাড়ির ছমিরন দাঈ তাকে বেঁচে থাকার প্রেরনা জোগায়। দাঈয়ের কাজ শেখান। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের সাথে লড়ে যাচ্ছেন আমেনা দাঈ।
বদলে গেছে চিরচেনা সমাজ। ভিন দেশী সভ্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে প্রতিদিন বাংলার সংস্কৃতি। মুক্তি যুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে । দেশ পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্তি পেল বটে, আসল মুক্তি কিন্তু মিলল না । দিনের পর দিন অবস্থার অবনতি ঘটছে। আছিয়ার যখন চার বছর সেই সময় শেখ সাহেব কে মেরে ফেলে কিছু দূরবিত্ত। এরপর জিয়া’কে ও মেরে ফেলল অন্য একদল রক্ত পিশাচ। দেশের যতই পরিবর্তন হোক না কেন , সেই সময় বাংলার এক গ্রামে আমেনা দাঈয়ের চলছে জীবন যুদ্ধের খেলা। গ্রামের বাড়িতে দাঈয়ের কাজ করে চলতে লাগল সংসার খুঁড়িয়ে । সকালে পান্তা ভাত আর কাঁচা পেঁয়াজের সাথে জমির মিয়ার কাছ থেকে চেয়ে আনা কাঁচা লঙ্কা। আজ অনেক দিন গত হল সকালে পান্তা ও জুটে না।আমেনা দাঈয়ের বাড়ির পাশের জমিতে জমির মিয়া পাট লাগিয়েছে। লকলক করে বেড়ে উঠছে পাটের চারা। সবুজে চেয়ে গেছে মাঠ। জমির মিয়া মাঝে মাঝে পাটশাক দেয়। রাতের বেলা সেই শাক সিদ্ধ করে লবন দিয়ে মেখে খায় মা মেয়ে দু’জনে। পরনের কাপড় এখন আর কাপড় বলে চেনার উপায় নেই। শত ছেঁড়া জায়গায় সুতা দিয়ে সেলানো । তবু বেঁচে আছে বেঁচে থাকতে হয় বলে।

বর্ষা এসে গেছে চারদিক পানিতে থই থই করছে। খালের মাঝে সবুজ রঙের কচুরিপানা ভেসে যায় এখান থেকে সেখানে। দিনের বেশিরভাগ সময় বর্ষার ভারীবর্ষণ হচ্ছে নিয়মিত। চারদিকে সবুজের সমারোহ। প্রকৃতি সেজেছে নবরূপে। কাঁচা রাস্তার পথ কাদা পানিতে পিচ্ছিল। একটু অসাবধান হলে পিছলে পড়ছে অনেকেই। কাদাপানিতে মেখে একাকার হচ্ছে অনেকেই। নদী পারাপারের মাঝির এই সময় পোয়াবারো। গঞ্জের বাজারে ছাতা বিক্রির ধুম পড়েছে। সেই সাথে গ্রামের অনেক ছাতির শিক দিয়ে মাছ মারার যন্ত্র চল ( ছাতির শিক দিয়ে নির্মিত মাছ ধরার এক প্রকার যন্ত্র) বানাচ্ছে। ঘরে বসে আছিয়ার দিন কাটতে চায় না । তাই মাঝে মাঝে নদীর পাড়ে যায় । নদীর পাড়ে কত মানুষ আসে গঞ্জ থেকে। তাদের সকলের হাতে ব্যাগ ভর্তি কাঁচা বাজার এবং অন্যান্য সদাই। হাতে ঝুলানো বড় বড় মাছ। ঈশ!আমার যদি বাবা থাকত তাহলে এমন করে বাজার নিয়ে আসত।ধুর! বাবা আসবে কোত্থেকে । উনি তো আমার জন্মের পূর্বেই মরে ভুত।
মির্জা বাড়ির ছেলে জুনায়েদ বিলেত থেকে এসেছে মাস দুই হল। এই জুনায়েদের দাঈ’মা ছিল আমেনা। জুনায়েদ বেশ শিক্ষিত । বর্ষার বিকেল দেখতে নদীর পাড়ে এসেছে। দূর থেকে আছিয়াকে দেখতে পায় খেয়া ঘাটের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। এগিয়ে যায় জুনায়েদ। নদীর পাড়ে হেলেঞ্চা শাকের জঙ্গল আর সেই সাথে রিফুজি পাতা যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সেই রিফুজি পাতা আর হেলেঞ্চার দঙ্গল মাড়িয়ে আছিয়ার কাছাকাছি এল। দৃষ্টির সামনে জলজ্যান্ত একটা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে দেখে আছিয়ার হুস হল। সম্বিত ফিরে পেয়ে বাড়িতে যাবার জন্য পা বাড়াল। জুনায়েদ বলল
-তুমি কে?
-আমি আছিয়া।আমেনা দাঈয়ের মেয়ে।আপনি কে?
-আমি মির্জা বাড়ির ছেলে জুনায়েদ। তোমার আম্মা তো আমার দাঈ মা। চল তোমাদের বাড়িতে যাই।দাঈ’মাকে দেখে আসি।
-যাবেন, আমাগো বাড়ি?
বিস্ময় ভরা চোখে বলল আছিয়া।
-হ্যা , যাব।চল পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।
দু’জনে কিছুদুর যাবার পর ঝুম করে বৃষ্টি নামল। সামনে মৃধাদের কাছারি ঘর। দুইজনে দৌড়ে সেখানে আশ্রয় নিল।বৃষ্টিতে ভিজে দু’জনে একাকার। জোড়া তালি শাড়ী আছিয়ার যৌবন কে ঢেকে রাখতে পারছে না । বেশ পুরানো ব্লাউজ ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কুমারীর বুক জোড়া। জুনায়েদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেই ফুলে উঠা জ্বলন্ত বুকের দিকে। মনের মাঝে ক্যু ডেকে উঠল। মৃধা বাড়ির কাছারির দরজা খোলা সেটা প্রথমে লক্ষ্য করল জুনায়েদ। জুনায়েদ ভেতরে ঢুকে দেখল ফাঁকা কাছারি কেউ নেই। মনের মাঝে অন্যরকম একটা ভাবনা হল যা আগে কখনো হয়নি। আছিয়াকে ডেকে ঘরের ভেতর আসতে বলল। আছিয়া সরল মনে ঘরের ভেতর গেল। জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে আছিয়া বুঝল এ তো মির্জা বাড়ীর বাবু নয় , পাড়ার গুন্ডা গুলোর মতন লাগছে তাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই জুনায়েদ জড়িয়ে ধরল আছিয়াকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল । কিন্তু ক্ষুধার্ত আর দুর্বল আছিয়ার পক্ষে তা সম্ভব হল না । এরপরের সময়টা জোরাজুরি আর ধস্তাধস্তির। একসময় দুর্বল আছিয়া নিস্তেজ হয়ে পড়ে জুনায়েদের পেশীবহুল হাতের পেষণে। বুকে বলিষ্ঠ হাতের চাপ অনুভব করে, এরপর ,...............।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুঁড়ে ঘরে ফিরে আসে আছিয়া। নাভির নীচে তখন প্রচণ্ড ব্যাথা।কিছু বলার ভাষা নেই। তার মা তখনো ফেরেনি । আজ দুপুরে রমিজ মিয়াদের বাড়ি গেছে আমেনা দাঈ। রমিজ মিয়ার ছেলের বৌয়ের বাচ্চা হবে। মা খাবার নিয়ে আসবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল আছিয়া।

রমিজ মিয়ার নাতি হয়েছে, তাই বাড়ির সকলে ভীষণ খুশী।মুরগীর মাংসের তরকারী আর কালোজিরা চালের পোলাও দিয়ে দুপুরে পেট ভরিয়ে খেতে দিয়েছে রমিজ মিয়ার বৌ। রাতে ফিরবার সময় পাঁচশত টাকার একটি নোট সেই সাথে দুইসের আতপ চাউল,একশিশি সর্ষের তৈল, একথালা পোলাও সাথে কিছু মুরগীর মাংস দিয়েছে। তাই নিয়ে আঁধারে পথ চলছে আমেনা দাঈ। মেঘ সরে গেলে মাঝে মাঝে চাঁদের মলিন আলো পড়ছে ভেজা ঘাসের উপর। কাদোমাখা পথে একহাতে খাবারের থালাটা মলিন কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বয়স হয়ে গেছে। ইদানিং রাতের বেলায় ঠিকমত ঠাহর করতে পারছেনা। তবু ও পথ চলতে হয়। মেয়েকে কত করে বলে তার সাথে কাজে যেতে , কিন্তু সে যাবে না । তার নাকি এসব ভালো লাগে না।
ঘরের দরজা খোলা। মেয়েটা বাঁশের মাচানে শুয়ে আছে। কাপড় সরে গেছে অনেকটাই। সেদিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয় লেগে উঠল আমেনা দাঈয়ের। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শোঁ শোঁ করে বাতাস বইতে শুরু করল। আমেনা মেয়েকে সজাগ করতে তার শরীরে হাত দিলেন।উমা শরীর তো আগুনে পুড়ে যাচ্ছে।
-উঠ মা ।দেখ তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি দেখ।
মায়ের ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে যায় আমেনার। সাথে সাথে মনে পড়ে যায়,বিকালের কথা। ডুমরে কান্না আসছে কিছুতেই সামলাতে পারছে না।
-কি হয়েছে মা?কাঁদছিস কেন?
-মা! মা...গো আমার ......।
-কি হয়েছে মা?
বিকালে যা ঘটেছে তা সংক্ষেপে বলল আছিয়া তার মাকে। তা শুনে বৃদ্ধ দাঈয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু এখন কি করবেন তিনি। সমাজের নিচুস্তরের মানুষ তারা । যাদের খাবার জুটে না নিয়মিত। তাদের কথা কি এই সমাজ বিশ্বাস করবে?আমেনা দাঈ জানে কেউ বিশ্বাস করবে না তার মেয়ের কথা। সকলে মির্জা বাড়ীর ছেলেকে কিচ্ছুটি বলবে না।

রক্তের স্বাদ যে বাঘ একবার পায় , সে বাঘ রক্তের জন্য হন্য হয়ে উঠে।জুনায়েদের অবস্থা এখন সে রকম। আছিয়া’র মাঝে যে সুখ পেয়েছে , সেই সুখের জন্য মন ব্যাকুল হচ্ছে বারবার। ভুলে গেছে জাতের বিচার। নারীলোভী নরপিশাচের মত হয়ে গেছে মির্জা বাড়ির শিক্ষিত ছেলে জুনায়েদ। আছিয়া সুন্দরী না হলে কি হবে তার দেহের গঠন জুনায়েদ কে পাগল করে তুলছে বারবার। ঘটনাটার পর থেকে শুধু আছিয়ার শরীর নিয়ে ভাবছে, আর ভাবছে সেই খেলা নিয়ে। ছেলের এমন পরিবর্তন দেখে জুনায়েদের মা চিন্তিত হয়ে মির্জা সাহেব কে জানান। মির্জা সাহেব জুনায়েদ কে ঢেকে নিয়ে ছেলের খোঁজ খবর জানতে চান। কিন্তু ছেলে এমন এক কথা বলে যা শুনে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। ছেলে তার বলে কিনা আমুনি দাঈয়ের মেয়ে আছিয়াকে বিয়ে করবে।
-কি দেখে পাগল হয়েছিস তুই বাপ।
-সেটা আমি জানি বাবা, তুমি আমাকে আছিয়াকে এনে দাও।
ছেলের সাথে কথা না বাড়িয়ে মির্জা সাহেব ব্যাপারটা কি জানার জন্য আছিয়াকে বিকেল বেলা ডেকে পাঠায়।ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে আছিয়া আছিয়া মির্জা সাহেবের সামনে দাড়ায়। আছিয়া যা ঘটেছে তা বলে। মির্জা সাহেব থপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। তার ছেলে হয়ে কিনা, ছিঃছিঃ এমন জঘন্য কাজ করেছে।মির্জা সাহেব আছিয়াকে যা হয়েছে তা চেপে যেতে বলে। আছিয়া ঘরে ফেরার পথে জুনায়েদ পথ আগলায়। জুনায়েদ নানা কথা বলে , এক সময় আছিয়াকে বিয়ে করবে সে কথা ও বলে। অসহায় এবং সহজ সরল আছিয়া জুনায়েদ কে বিশ্বাস করে। জুনায়েদ সেই বিশ্বাসের মুল্য আছিয়ার শরীর থেকে আদায় করে নেয় পাশের বাড়ির জঙ্গলে নিয়ে। এরপর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের লীলা চলতে থাকে। মাস তিনেক পরে আমেনা দাঈ মেয়ের শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করে মির্জা বাড়িতে ছুটে যায়।
মির্জা সাহেব তখন ছেলের বিয়ে নিয়ে ব্যাস্ত। দাঈয়ের কথা শুনে মির্জা দুই হাজার টাকা দিয়ে বলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাচ্চা নস্ট করে ফেলতে। বড় কর্তার এই বিচার দেখে কাঁদতে কাঁদতে জুনায়েদের কাছে যায় দাঈ। জুনায়েদ সাফ অস্বীকার করে । বলে
-এই বুড়ি তোর মেয়ে কার সাথে না কার সাথে কুকর্ম করে পেট বাঁধিয়েছে সেই দায় কি আমার?
আছিয়া মায়ের কাছ থেকে সব শুনে চুপ করে থাকে। সে জুনায়েদ মির্জা কে খবর দেয়। জুনায়েদ দেখা করতে আসে না । দু’দিন পর জুনায়েদের বিয়ে হবে। মির্জা বাড়িতে সাজসাজ রব। মাইকে জ্ঞান বাজনা হচ্ছে। দূর থেকে আছিয়া শুনছে । অবশেষে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। আবার জুনায়েদ কে খবর দিল। এবার জুনায়েদ দেখা করতে এসেছে। বাড়ির পাশের পাট গাছ গুলো তখন বুক সমান বড় হয়ে আছে।পাট ক্ষেত পেরিয়ে ঘন জঙ্গল। এদিকটায় মানুষের তেমন একটা যাতায়েত নেই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আছিয়া আজ অনেক সেজেছে। ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক, চোখে কাজল , চুলে সুগন্ধি তৈল। মায়ের টাঙ্ক থেকে বের করেছে লাল শাড়ি। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।
এমন সাজে আছিয়াকে দেখে জুনায়েদের ক্ষুধাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আছিয়া ও তেমনি চায়। আছিয়া বলে উঠে
-চল পাশের জঙ্গলে চলে যাই।
জুনায়েদ খুশী হয়ে বলে
-চল যাই।
জঙ্গলে গিয়ে দু’জনে আদিম খেলায় মেতে উঠতে থাকে । জুনায়েদ ভাবে তার কি সৌভাগ্য আজ ও আছিয়াকে ভোগ করতে পারছে। আর আছিয়া তখন ভাবছে চরম প্রতিশোধের কথা। দু’জনে যখন মিলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছিয়া তখন লুকানো ব্লেড হাতে নিল অতি সাবধানে। জুনায়েদ তখন মগ্ন নারীদেহের মোহজালে। ধীরে ধীরে আছিয়ার হাত নিচের দিকে নেমে এল। এরপর শুধু গগন বিধারি চিৎকারে পাড়ার লোক জড় হল। জঙ্গলের সবুজ ঘাসের উপর তখন জুনায়েদের পুরুষটা পড়ে আছে একটা মাংসের দলার মত।সেদিকে তাকিয়ে দেখছে পাড়ার সকলে। অন্যদিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে জুনায়েদ মির্জা।সবুজ ঘাসের উপর তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্ত আর রক্ত।আছিয়ার শাড়ী পড়ে আছে অন্যপাশের সবুজ ঘাসের জঙ্গলে। আছিয়া বসে আছে ঘাসের উপর। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশ এসে যাবে। জুনায়েদ কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। পাড়ার মহিলারা মুখে কিছু না বললে ও মনে মনে ধন্যবাদ জানাচ্ছে আছিয়াকে । সকলের অগোচরে আমেনা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা বোতলটা বের করে ভেতরের ওষুধ টুকু খেয়ে নিল।এরপর এলিয়ে দিল নিজের শরীর সবুজ ঘাসের উপর। ‘আহ! কি শান্তি’ মনে মনে বলল আছিয়া।চরম প্রতিশোধ নিতে ফেরে তার কাছে বেশ ভালো লাগছে। ঝাপসা চোখে দেখতে পেল তার বৃদ্ধ মা অনতি দূরে বসে কাঁদছে ফুফিয়ে ফুফিয়ে।
পুলিশ এসে আছিয়াকে ধরতে যায়। কিন্তু আছিয়া তখন চলে গেছে মহা বিচারকের কাছে । সেই বিচারক শুধু জানে এতে আছিয়ার দোষ কতটুকু।তবে নরলোভী নরপিশাচদের একটা শিক্ষা হয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। পুলিশের ওসি মাথার টুপি খুলে কেন জানি স্যালুট জানায় আছিয়ার মৃতদেহের প্রতি। মর্গে পাঠানোর জন্য লাশ যখন ভ্যান গাড়িতে তুলতে যাবে সেই সময় আমেনা দাঈ দৌড়ে আসে , তার হাতে ধরা একটি সবুজ রঙ্গের শাড়ী। আছিয়া খুব পছন্দ করত এই শাড়ীটি । সেই সবুজ শাড়ী দিয়ে ঢেকে দেয় আছিয়ার মৃতদেহ। সবুজ শাড়ীর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় গাঁয়ের সহজ সরল আছিয়ার লাশ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের সকল মেয়ের দল । সকলে হাত উচিয়ে স্যালুট দিচ্ছে প্রতিবাদী আছিয়াকে। আছিয়ার নিথর দেহ নিয়ে পুলিশের গাড়ী ছুটছে হাসপাতালের মর্গের দিকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক বাস্তব একটি গল্প //অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়াকে গল্পটির জন্য ..ঠিক এমনি একটি ঘটনা পেপারে পড়েছিলাম ..আজ যেন সরাসরি দেখলাম ..সুভেচ্ছা ও সালাম ভাইয়াকে
এফ, আই , জুয়েল # বেশ বড়---অনেক সুন্দর । ভাবকে আর সংক্সেপে প্রকাশের চেষ্টা করা দরকার ।।
সেলিনা ইসলাম বাস্তবতার ছাপ স্পষ্টত --সুন্দর সাবলীল গল্প । শুভকামনা
আহমাদ মুকুল তোমার আগের ক’টা গল্পেও দেখেছি, গ্রামবাংলার নির্যাতন বিশেষ করে নারীর প্রতি অবমাননা দারুনভাবে ফোটাও। এটিও নিঁখুত পটে আঁকা একটি ছবি যেন। এসব গল্প চেতনায় আঘাত করে, অনেককে লড়েইয়ের শক্তি জোগায়, সুতরাং বারবার ‘আছিয়া’দের হার দেখতে চাই না। প্রতিশোধ নিয়ে ‘আছিয়া’রা যেন বুক চিতিয়ে লড়াই করে....ওদের দেখে অনেকে যেন প্রেরণা নেয়।
রাসেল অনেক ভালো লাগলো.... ভালো তে রাখলাম l
ইউশা হামিদ আছিয়ার পরিণতি মনে অনেক কষ্ট দেয় ---- লেখক সার্থক । শুভ কামনা থাকল ।
Arup Kumar Barua আপনার ভুমিকাটা লেখার আবহ সৃষ্টি করে যা গল্পের মান বাড়ায় | ভালো লেখার প্রত্যাশী |
Jontitu ভালো লাগলো।
স্বাধীন নির্যাতিত সব আছিয়ারা যদি প্রতিশোধ নিতে পারত, কপট ভন্ড একটা গোষ্ঠি বিলীন হয়ে যেত। সুন্দর গল্প
সিয়াম সোহানূর পরিচ্ছন্ন একটি গল্প পড়লাম। পৃথিবীর সব আছিয়ারা জেগে উঠুক। শুভকামনা শাকিল ভাই।

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী