শাওন এবং তার বাবা

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

sakil
  • ৫৫
  • 0

শাওন আজ সকাল থেকে কেমন অন্যমনস্ক। কেন সে নিজে ও জানে না । মাঝে মাঝে এমনি হয় সে দিনটা ভালো যায় না শাওনের । আল্লাই জানে আজ কি আছে কপালে । ভার্সিটি বন্ধ বেশ কয়েকদিন । দেশের অসুস্থ রাজনীতির কারনে । আজ এই দলের কর্মসূচি হলে অন্য দল আগামিকাল অন্য কর্মসূচি দেবে । এযেন এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নেমেছে দেশের প্রধান দু'ই রাজনৈতিক দল ।মাঝখান থেকে সাধারন মানুষের কি অবস্থা তা দেখার জন্য কেউ নেই । এমন কোন দিন নেই যে দু'য়েকটি খুনের ঘটনা ঘটছেনা । পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে এমন খবর এখন স্বাভাবিক ভাবে ছাপা এবং দেখানো হচ্ছে । দেশের বাইরে থেকে দেশের প্রতি সকলে একটা আতঙ্কের মাঝে ভুগে প্রতিনিয়ত। মায়ের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ল শাওনের। এখন আবার বাজারে যেতে হবে বাজার করতে । গ্রামে এলেই মা তাকে দিয়ে এই কাজটি করাবে প্রতিনিয়ত। কোথায় একটু শুয়ে শুয়ে ঘুমাবে , আর তাকে কিনা বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছুটতে হবে বাজারে । জীবন বড়ই ঝামেলার ভাবে শাওন ।
বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাসা ছেড়ে বাজারের পথে হাটতে থাকে শাওন অনেকটা আনমনে ।গলির রাস্তা পেরিয়ে সামনের বড় রাস্তায় উঠার সময় মানুষের জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় শাওন। দু'হাতে জটলার মানুষদের সরিয়ে যা দেখল তাতে স্তম্বিত হয়ে গেল শাওন। একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার শরীরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শুকনো রক্তের দাগ । সকলে বলাবলি করছে ব্যাপারটা ঘুম খুন। কেউ লোকটিকে স্পর্শ করছে না থানা পুলিশের ভয়ে। সেদিকে কান না দিয়ে শাওন উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটির পাশে হাটুগেড়ে বসে পড়ল অনায়াসে কোনকিছু চিন্তা না করে । অতি সন্তপর্ণে লোকটির একটি হাত ধরে দেখল শিরা চলাচল করছে । এমন সময় জোরে চেঁচিয়ে বলল এখন ও মরে নি বেঁচে আছে । শাওনের কথা শুনে ওর বয়সী কয়েকজন এগিয়ে এল । ধরাধরি করি লোকটাকে চিতকরে শুইয়ে দিল। ঠিক বুকের মাঝ বরাবর একটি গভীর ফুটো সম্ভবত গুলি করে ফেলে গেছে কেউ। চেহারা দেখে কেউ চিনতে পারলনা । লোকটির বামহাত এখনো কোটের মাঝে ঢুকানো । শাওন সেই হাতধরে আস্তে করে বের করল । হাতের মাঝে ছোট একটা পকেট ডাইরি ধরা আছে রক্তে মাখামাখি হয়ে । সবার অগোচরে ডাইরিটি বাজারের ব্যাগে চালান করে দিল শাওন। ব্যাস্ত জনগন কেউ খেয়াল করেনি ব্যাপারটা । সবাই ধরাধরি করে একটি ভ্যানে উঠিয়ে দিল লোকটাকে সাথে শাওন এবং অন্য দুজন চলল হাসপাতালের দিকে । সকলের মনে প্রশ্ন কে এই লোক ?কিভাবে খুন হল , কেন হল ?ইত্যাদি।

তারেক সাহেবের ছোট সংসার এক ছেলে একমেয়ে এবং স্ত্রী রোকেয়া । তারেক সাহেব পয়সাওয়ালা লোক । তাদের এলাকাটা ঠিক গ্রাম বলা চলে না , শহরতলী থেকে সামান্য দুরে। শহুরে চাকচিক্যের অনেকটা এখানে ও বিদ্যমান। তবে এখানে সমাজ ব্যাবস্থা আছে । গ্রামের হাটে হাতেগোনা কয়েকজন পয়সাওয়ালা লোকের ভিড়ে তারেক সাহেবের নাম সবার উপরেই বলা চলে। ইদানিং তারেক সাহেব একাকী কি যেন চিন্তা করেন । স্ত্রী রোকেয়া বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করে ও কোন সদুত্তর পাননি । স্বামীর এমন বেহাল অবস্থা তিনি এর আগে কখন দেখেননি । তাই ভয় লাগে কি থেকে কি হয় । স্থানীয় বাজারে তারেক সাহেবের তিনতিনটি কাঠের দোকান আছে । বাজারের সবাই টিম্বার মার্চেন্ট তারেক সাহেব কে একনামে চেনে ।
অনেকে বলাবলি করে তারেক সাহেবের এত টাকা পয়সা নাকি বৈধ নয় । মহান মুক্তিযোদ্ধের সময় তার ভুমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু সাহস করে সে কথা বলার লোক নেই । আর বলেই বা কি লাভ হবে তিনি নিজেই এখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন জোর গলায়। মুক্তিযোদ্ধের সার্টিফিকেট ও আছে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমিটির চেয়ারম্যান এখন তিনি । তার এই ভুমিকায় অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা চুপ হয়ে থাকে । কারন তাদেরকে আজ তারেক সাহেবের মত লোকদের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয় ।
তারেক সাহেব আসলে ভেতরে ভেতরে এক মাদক ব্যাবসায়ি। তার কাঠের ব্যাবসাটা নামে মাত্র। পার্বত্য অঞ্ছল থেকে গাছের ভেতর করে ভারতীয় বিভিন্ন নেশা বাংলাদেশে চালান করেন খুব সহজে । অতি দূর্ত লোক তিনি। তার এই ব্যাবসার খোজ তেমন বেশী লোকে জানেনা । তবে গত কয়েকদিন ধরে অচেনা এক লোককে তার দোকানের আশে পাশে ঘুরঘুর করতে দেখে তার মন অজানা আশংকায় ভীত হয়ে উঠে। সমর আলী কসাই কে গতকাল থেকে লোকটার উপর চোখ রাখতে বলে তারেক সাহেব। সমর আলী কসাই সারাদিন সারা রাত লোকটার পেছনে ঝোঁকের মত লেগে আছে । অবস্থা খারাপ দেখলে সমর আলী নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই বিশ্বাস তারেক সাহেবের আছে । কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে তার ছেলে শাওন কে নিয়ে । আদর্শবাদী ছেলে , অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে জানেনা। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে তার মত এমন লোকের ঘরে এমন সন্তান আল্লাহ তাকে কিভাবে দিয়েছে ।তবে তার ছেলে তাকে ভালমানুষ হিসাবেই জানে ।
*****
শাওন অন্যরকম ছেলে , দেশের প্রতি তার মমত্তের শেষ নেই। দেশীয় পন্য ছাড়া অন্য পন্য তেমন ব্যাবহার করে না শাওন। মনে সব সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটা ভালোবাসা লালন করে । তার বাবা ও একজন মুক্তিযোদ্ধা , আর একজন মুক্তি যোদ্ধার সন্তান হতে পেরে সে গর্বিত বোধকরে । দেশের ভাষার জন্য যারা প্রান দিয়ে শহীদ হয়েছে তাদের স্মরণে প্রতিবছর শহীদ মিনার নিজ হাতে সাজায় শাওন। বাজারে যখন বিদেশী পন্যে সয়লাব তখন সে স্বদেশী পন্য খোঁজে চুপিসারে । স্বভাব বেশ শান্ত বলে গ্রামের লোকেরা তাকে বেশ আদর করে । তারা তাকে ভালবেসে ছোট সাহেব বলে ডাকে।
এস,এস,সি পাশের পর নিজের সম্পূর্ণ চেষ্টায় শাওন এলাকার নিরক্ষর লোককে অক্ষরজ্ঞান করিয়েছে । পড়ে অবশ্য তার দেখাদেখি কয়েকজন ছাত্র এগিয়ে আসে তার স্কুলের সেই সাথে কয়েকটি এন জি ও এগিয়ে আসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। ভাল কাজ একবার শুরু করতে পারলে হয় । এরপর সে তার আপন গতিতে ছুটে চলে । গ্রীষ্মের ছুটিতে গত বছর খাল কেটে রাস্তা বেধেছে সে এবং তার বন্ধুর দল। তাতে গ্রামের যেমন প্রশংসা পেয়েছে , তেমনি প্রশংসা পেয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে। নিজের জীবনের সুখের চেয়ে অন্যের জীবনের কষ্ট দুঃখ লাঘব করাই শাওনের প্রাধান কাজে পরিনত হয়েছে। শাওন এই বছর তার বাবার কাছে রাস্তার পাশের জমিটুকু চেয়েছে গনপাঠাগার করার জন্য । তার বাবা অবশ্য তার প্রস্তাবকে ভালোভাবে মেনে নিয়েছে। বাবার সম্মতি পেয়ে বিভিন্ন এন,জি,ও এবং পত্রিকা অফিসে চিঠি পাঠিয়েছে সে তার পাঠাগারের সৌজন্য সংখ্যার জন্য। তার আবেদনে অনেকে সাড়া দিয়েছে আনন্দের সাথে। দেশের মধ্যে না হোক, তার গ্রামের মাঝে যদি শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পারে তাহলে সকল আঁধার দূর হয়ে যাবে নিমিষেই , এই বিশ্বাস নিয়েই শাওনের কাজ ।
কিন্তু আজ সকালে লোকটাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকে তার মন খারাপ । তাদের এলাকায় এমন কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে বলে তার মনে নেই । কে এই লোক , কারা তাকে খুন করতে চেয়েছিল। এসব প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই । বাজারের ব্যাগ থেকে অনেক আগেই রক্তমাখা ডায়রিটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়েছে সেই কবে কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা পড়া হয়নি । সেই ডায়রিতে নিশ্চয় অনেক গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য আছে । কিন্তু পুলিশের কাছে সে কেন ডায়রিটা জমা দিল না ? তা সে বুঝতে পারছে না । হাসপাতালের ডাক্তার অবশ্য বলেছে লোকটার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। গুলিটা হৃদপিণ্ডের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে । তবে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারনে জ্ঞান ফিরতে দুই দিন লাগবে । সেই সময়ে পুলিশ এসে শাওন এবং তার সাথে সাহায্যকারী সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিতে বলে। বাকী ব্যাপারটা পুলিশ দেখবে । তাদের কে এই ব্যাপার নিয়ে চিন্তা না করার জন্য বলেছে । হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাজারে গেল শাওন । সেখান থেকে দ্রুত কিছু বাজার করে বাসার উদ্দেশ্য হাটতে লাগল আনমনে । মনের মধ্যে তখন হাজারো প্রশ্নের উত্তর খেলা করছে । সেই সব থেকে মুক্তি দিতে পারে প্যান্টের পকেটে থাকা ডায়রিটা।

রিনা'র বিয়ে হয়েছে চার মাস হল। একমাত্র শাশুড়ি আর তার স্বামী , ছোট সংসার। হুট করে যেমন বিয়ে হয়ে যায় মেয়েদের , তাদের ব্যাপারটা তেমন নয় মোটেও । জেনে শুনে চার বছরের প্রেমের পর বিয়ে। রিনা বি এ পাশ করে ওকালতি প্র্যাকটিস করছে নিজের মত। তার স্বামী সুমন ব্যাস্ত তার চাকুরী নিয়ে । অত্যান্ত সৎ এবং সাহসী তার স্বামী। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার লোক। পুলিশের লোক হলে যে দুর্নাম হয় , সেটা তার স্বামীর নেই। চার মাসে স্বামীকে কাছে পেয়েছে মাত্র কয়েকটা দিন । বাসর রাতের অর্ধেক সময়ের পর যে পুরুষ ঘর ছেড়ে কাজের জন্য চলে যায়, তাকে আর যাই হোক ভালোবাসা দিয়ে বেধে রাখা যায় না । তার কাছে দেশ এবং কর্তব্য সবার আগে । এক্ষেত্রে রিনা স্বামীকে কিছু বলে না , সে জানে কর্তব্য এমনি এক জিনিস তার কাছে পরিবার পরিজন অতি তুচ্ছ। অন্যদিকে গোয়েন্দা বিভাগের চাকুরীতে নিজের বলে সময় খুব কম । দু'জন যখন একসাথে থাকে তখন বেশ ভালো লাগে । দুনিয়ার কোন স্ত্রী চাইবে না স্বামী তার পাশে থাকুক। তবে এমন মধুময় সময় গত চারমাসে তেমন না মিললে ও দু'জনে দু'জনকে পেয়ে দারুন সুখি। চাকুরীতে সৎ থাকলে প্রতিসপ্তায় না হোক প্রতি মাসে বদলী হবে সেটা নিশ্চিত। যেখানেই যায় সুমন দু'একটা কেইসের সমাধা করলেই ট্র্যান্সফার । ইদানিং ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে । তবে ভাগ্য বলতে হচ্ছে বিয়ের পর থেকে এখন ও কোন বদলির অর্ডার আসেনি । রিনা সকালে চলে যায় তার নতুন অফিসে। সুমন চাকুরীতে। হঠাৎ করে গত সপ্তাহে হেড অফিস থেকে একটা নতুন কাজ এল । অতি গোপন কাজ । একজন মাদক ব্যাবসায়ীকে প্রমান সাপেক্ষ ধরতে হবে । সে শুধু মাত্র সে এলাকার নয় বরঞ্চ পুরো দেশ ব্যাপী নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে মাদক ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে । প্রথম দিকে তার ব্যাবসা স্থানীয় ভাবে চললে ও এখন প্রায় পুরো দেশ চেয়ে গেছে । প্রথমে সে শুধু গাঁজা আনত ভারতের বর্ডার দিয়ে , কিন্তু ইদানিং সে এক পাকিস্তানীর মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে , হেরোইন, আফিম এবং ভারত থেকে নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসে। আর তার সেই মাদকে এই দেশের তরুন , কিশোর , যুবক সকলে নেশার জগতে পা দিচ্ছে না বুঝে । আর যে একবার সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে সে আর ফিরে আসতে পারছে না মাদকের ভয়াবহ জাল ছিন্ন করে ।
দেশের সেই শ্ত্রুকে যেভাবেই হোক প্রমান সহ ধরিয়ে দিতে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সুমনের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করা হয়েছে। সরকারের উপরের মহলের সকলেই জানে সুমন একজন চৌকশ তরুন গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার । অন্য অফিসাররা যেখানে নাস্তানুবোধ হয়ে ফিরে আসে সেখানে সুমন সবসময় বিজয়ীর বেশে ফিরে আসে। অফিসের বড় কর্তা মামুন সাহেব সুমন কে অপারেশন "গর্জনের "জন্য সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন ।
এরপর থেকে অত্যান্ত গোপনীয়তার সাথে তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে লাগল । যখন তথ্য গুলো সংগ্রহ একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন বুঝতে পারলেন কেউ একজন ঠিকই তার পিছু নিয়েছে ছায়ার মত। এই অপারেশনের কথা কেউ জানার কথা নয় তার পর ও কিভাবে জানলো সেই ব্যাপারটা নিয়ে মনে নানা সন্দেহ দেখা দিল । দেশ মাতার জন্য প্রান দিতে রাজি সুমন কিন্তু আপোষ কাকে বলে , শেখেনি সে।মনের সন্দেহ কে যথেষ্ট গুরত্ব দিল। সব কিছু হাতের মিনি ডাইরিতে লেখে নিল সংক্ষেপে । এরপর রিপোর্ট করতে গেল বড় কর্তা মামুন সাহেবের অফিসে । মামুন সাহেব বেশ খুশী হলেন সুমনের দুঃসাহসিক কাজে । এমনকি সুমনকে আশ্বাস দিলেন আজ রাতের শেষ প্রহরে অপরাধীকে প্রমান সহ হাতে নাতে ধরা হবে । তাই সুমনকে বাসায় গিয়ে বাকী সময়টুকু রেস্ট নিতে বললেন।
অফিস থেকে বাসায় যাবার পথে ঘটে ঘটনাটা । দুইজন লোক তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করে এবং একজন লোক বুক বরাবর গুলী করে রাস্তার পাশে ফেলে চলে যায়। সুমন ছদ্মবেশে চলাচল করত চাকুরীর খাতিরে তাই তাকে সেই খানে কেউ তেমন একটা চিনত না।

শাওন বাসায় এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে রক্তমাখা ডায়রিটা বের করল। দ্রুত একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল পাগলের মত । রক্তের জন্য কিছু লেখা ঝাপসা হয়ে দেখা যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই শাওনের । এদিকে ছেলে বাজার থেকে এসে বাথরুমে ঢুকে এখন ও বাহির হচ্ছে না দেখে তারেক সাহেব চিন্তিত বোধ করলেন এবং দরজার পাশে গিয়ে ডাকলেন
-কি হয়েছে বাবা এতক্ষণ কি করছ বাথরুমে , শরীর খারাপ করেনি তো ।
বাবার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল শাওন।
-না তেমন কিছু না পেট খারাপ করেছে তাই। কোনমতে কথাগুলো বললেও মাথা ঘুরছে ভনভন করে । ডায়রির শেষ কয়েক পৃষ্ঠা এখন বাকী । চোখমুখ ফোলা অবস্থায় শাওন বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাকিব সাহেব ঘাবড়ে গেলেন ।
-কি হয়েছে বাবা । ডাক্তার ডাকব।
-না বাবা কিছু হয়নি । বাজারে যাবার পথে একজন লোককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম । শেষে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তাই একটু খারাপ লাগছে। কথাটা বলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শাওন। লক্ষ্য করল কোন পরিবর্তন হয় কিনা?
তারেক সাহেব কথাটা শুনে থতমত খেয়ে উঠলেন । কিন্তু ছেলেকে বুঝতে দিলেন না
-লোকটা কি বেঁচে আছে।শাওন
-হ্যাঁ । বাবা বেঁচে আছে । শুনলাম পুলিশের লোক ।সৎ এবং সাহসী। এসব লোকদের মৃত্য হয় না বাবা। এরা সত্যিকারের দেশ প্রেমিক , দেশের স্বার্থে এরা নিজেদের উৎসর্গ করে , এরা একজন চলে গেলে আরেক জন আসে। এদের থামানোর ক্ষমতা কারো নেই।
-গ্রামের অবস্থা ভালো নয় । তুই বরং ভার্সিটিতে চলে যা।
-ভার্সিটি বন্ধ বাবা। এছাড়া লোকটার কি হয় না হয় দেখে যাবনা ।
-আচ্ছা ঠিক আছে , তবে রাত বিরাতে বাহির হবি না।
-ঠিক আছে ।তবে আজ রাতে একবার বেরুবো বাবা (মনে মনে বলল শাওন) ।
ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখে তারেক সাহেবের কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতর । কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারল না । সমর আলী কসাই এমন একটা কাঁচা কাজ করবে ভাবতে পারছে না তারেক সাহেব । ছেলেকে উত্তেজিত দেখে এখন একটু একটু টেনশন হচ্ছে । আবার ভাবছে চিন্তা কিসের থানার ওসি , ডিসি সবাইকে হাত করা আছে।
দেশের জন্য আসলে তিনি কিছু করেননি । এতদিনে এই কথা মনে করে বেশ আপসোস হচ্ছে তারেক সাহেবের । সেই যুদ্ধের সময় তিনি নিজে রাজাকার ছিলেন সে কথা আর কেউ না জানুক তিনি সে কথা ভাল করে জানেন । আসলে সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত দেশকে দেওয়ার মত অনেক কিছুই ছিল , কিন্তু তিনি কিছুই দিতে পারেননি । সেই তুলনায় তার ছেলে কত দেশ প্রেমিক ।
দূর এসব তিনি কি ভাবছেন। মনে মনে বললেন তারেক সাহেব। তার এখন হাসপাতালে খোজ নিয়ে লোকটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে । সে বেঁচে থাকলে তার সকল মান সন্মান ধুলোয় মিশে যাবে।

সরকারী হাসপাতালে সুমনের চিকিৎসা চলছিল । কিন্তু হুট করে একজন লোক একটা গাড়ী নিয়ে এসে সুমনকে সেখান থেকে নিয়ে গেল অতি গোপনে । সে লোকটি মফস্বল ছেড়ে শহরের একটি ক্লিনিকে সুমন কে ভর্তি করে সোজা চলে গেল র্যা বের একজন অফিসারের কাছে ।
র্যা বের সেই অফিসারের কাছে সব কিছু খুলে বলল শাওন। সে তার বাবাকে ধরিয়ে দিতে এসেছে । কারন সুমনের ডায়রির প্রতিটি পাতায় তার বাবার সমাজ এবং দেশ বিরোধী কুকর্মের কথা সে জেনে গেছে । তাই সচেতন নাগরিক হিসাবে সেই তার বাবাকে আইনের হাতে তুলে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল । অফিসার শাওনের কথা বেশ মনোযোগ সহকারে শুনল এবং শাওনের কাছ থেকে ডায়রিটি নিয়ে নিল । শাওন কে আশ্বাস দিল ঘরে ফিরে যেতে । কিছুক্ষণ পর তারা তার বাবাকে হাতে নাতে ধরার জন্য অফারেশন চালু করবে। সেই সময়ে অফিসারের মোবাইল বেজে উঠল। অফিসার সরি বলে ভেতরে চলে গেল । কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এল । এসে শাওনকে বলল
-আপনি চিন্তা করবেন না । আপনি সঠিক জায়গায় এসেছেন। ও আচ্ছা সুমন সাহেব কে কোন হাসপাতালে রেখেছেন ।
-শাওন ক্লিনিকের নাম বলে বাড়ির পথে রওনা দিল । বাজার থেকে বাড়িতে যেতে কয়েকমিনিটের পথ । জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার । মনের মাঝে বাবাকে নিয়ে অনেক ঘৃণা । সেই সময় ঠাস করে একটি শব্দ হল । পরখনেই শাওনকে বুকে হাত দিয়ে পড়ে যেতে দেখা গেল । মুখ দিয়ে ছোট্ট একটি শব্দ বেরুল । এরপর আরো দুই তিন বার সেই শব্দ হল । বয়স্ক একটা লোক খামের আড়াল থেকে বেরিয়ে দ্রুত শাওন দের বাড়ির দিকে হন হন করে হেটে গেল ।
শাওনের মা স্বামী কে এত ব্যাস্ততার মাঝে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বলল
-কি হয়েছে তোমার । এত রাতে কোথা থেকে এলে ।
- না কিছু হয়নি । নতুন কিছু কাঠ এসেছে তা দেখতে গিয়েছিলাম। শাওন কোথায় । এখনো ফেরেনি ।
-না এখনো ফেরেনি । যাবার আগে আমাকে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে।
-ও আচ্ছা । আমি গোসল করে ঘুমাব । শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে । তুমি শুয়ে পড় ।
-খাবে না ।
-না। আজ খেতে ইচ্ছে করছে না ।
পরিশিষ্টঃ
সকালে সকলে শাওনের লাশ দেখতে পায় ।চারদিকে পুলিশের এবং র্যা বের লোক। সারা পাড়ায় কান্নার রোল উঠে । তারেক সাহেব কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে দেখতে যান। শাওনের মা প্রচন্ড মানসিক আঘাতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সেই সময় র্যাকবের সেই অফিসার তারেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে (অগোচরে) সাংবাদিকদের বলেন
-শাওন একজন দেশদ্রোহী এবং সন্ত্রাসী ছিল। গতকাল রাতে র্যাফবের সাথে ক্রসফায়ারে সে মারা যায় (যদি ও কথাটা সত্য নয়) । এছাড়া শাওন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সৎ এবং সাহসী অফিসার সুমনকে হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে শহরের এক বন্ধুর বাসায় খুন করে । শাওনের সকল অপরাধের সাক্ষী ছিলেন সেই অফিসার।
শাওন র্যাএবের অফিসারের বাসায় যাওয়ার আগে সকল তথ্য সুমনের স্ত্রী রিনা'র কাছে দিয়ে যায়। রিনা সেই সব তথ্য নিয়ে রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে শহর ত্যাগ করে। এতক্ষণে হয়ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে সব কিছু বলেদিয়েছে রিনা ।এর পর কি হবে তা রিনার জানা নেই। সে তখন আহত স্বামীর জন্য চিন্তিত।
পুলিশ শাওনের লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছে ময়না তদন্তের জন্য ।র্যা বের অফিসার পকেট থেকে সুমনের ডায়রিটা বের করে তারেক সাহেবের হাতে দিয়ে বলে আপনার ছেলের শেষ চিহ্ন । রেখে দিয়েন যত্ন করে । এমন সময় ভীড় থেলে বাজারের পাগলা রহিম তারেক সাহেবের কানের কাছে এসে বললেন মৃদু স্বরে
- আমি সব দেখেছি তারেক । যুদ্ধের সময় দেশের সাথে গাদ্দারি করেছিস , আর আজ নিজের ছেলের সাথে। তুই ধরা পড়বি একদিন । সময় ঘনিয়ে এসেছে।যাবার সময়
- ছিঃ! বলে একদলা থুথু তারেক সাহেবের মুখে ছুড়ে মারল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন অনেক কষ্ট লাগল গল্পটা পড়ে :( মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বেইমানি করলো দেশের সাথে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশ ও দেশের মানুষের সাথে মুনাফেকী করলো। শেষ পর্যন্ত নিজের দেশপ্রেমিক ছেলেকেও খুন করলো!!! এতো পাষাণ হয় কি করে মানুষ? শাওনের জন্য খুব কষ্ট লাগছে খুব। আপনার এবারের গল্পটা মনে দাগ কেটে যাওয়ার মত। শুভকামনা রইলো।
আরিফুল হাসান শুভো কামনা
sakil kh anisur rohman joti ভাই আপনার ভাল লেগেছে জেনে বেশ খুশি হলাম । ধন্যবাদ আপনাকে
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি খুব ভালো লেখা।শাকিল আবারো ধন্যবাদ আপনাকে, সুন্দর লেখার জন্য...................
বিষণ্ন সুমন শাকিল ও তানভীরের জন্য আরো একটা মজার খবর হলো, আমার শাশুড়ি আম্মার নাম'ও কিন্তু রোকেয়া । তাহলে সুমন, শাকিল, তানভির এর সাথে তোমাদের ভাবি'ও (শিফা) যোগ হলো, কি বল !
sakil @ পাচ হাজার @ তানভির ভাইয়া আপনাদেরকে ধন্যবাদ . গল্প ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম .
sakil @ বশির আহমেদ @ এম এ হালিম @ সূর্য ভাই আপনাদের মন্তব্য আমাকে কিছু লেখার প্রেরণা জোগায় . আর সেই কারণেই লিখি , কিংবা লিখছি .
তানভীর আহমেদ কি? শাকিল ভাইয়ের মায়ের নাম রোকেয়া, সুমন ভাইয়ের মায়ের নামও তাই! এজন্য সুমন ভাই “আমার ভাই” বলে সম্বোধন করেছে আপনাকে! এবার আমার কথা বলছি, আমার মায়ের নামও রোকেয়া। মিথ্যে নয়, সত্যি। তাহলে আমরা তিন ভাই! সুমন-শাকিল-তানভীর। কি বলেন শাকিল ভাই? আর অসাধারণ লেখার জন্য। পাঁচে পাঁচ।
পাঁচ হাজার অনেক ভাল লাগল শাকিল ভাই আপনার গল্পটা।
সূর্য মাঝে মাঝে তোমার গল্প কবিতায় প্রথম দিকের লেখাগুলো মনে করে হাসি পায়। কেন জান তখন যে তোমাকে উপদেশ দিয়েছিলাম! হা হা হা আর এখন শুধু প্রশংসা করতে হয়। শাকিল উন্নতির এ ধারাটা ধরে রাখলে অনেক অনেক পরিপূর্ণ গল্প পাব তোমার কাছ থেকে। ও হ্যা গল্প অনেক অনেক ভাল লেগেছে।

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী