বঙ্গবন্ধু সবখানে

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

বিশ্বজিত সেন
  • ১০
  • 0
  • ১৩২
চমক তার গ্রামের বাড়ির বড় পুকুরের বটতলাতে বসে একা একা কী যেন ভাবছিল। সূর্যটা দুপুরের কোল থেকে নেমে বিকালের কাঁধে চড়ে বসেছে। কয়েকটা শাদা মেঘের মাথায় সিঁদুরে আমের রঙ লেগেছে। চমক হা করে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। দূরে কোথাও হঠাৎ করে বেজে উঠলো বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৭ মার্চের অমর কবিতার মতো ভাষণটা!
চমকের ঠাকুরদা একাত্তরের শহীদ। শহীদী রক্ত বহমান চমকের ধমনীতেও। রঙ বদলানো মেঘের রাজ্য থেকে ধানের খেতে নেমে এলো চমকের দৃষ্টি। কানের দৃষ্টি গেল খুলে। বঙ্গবন্ধুর বাঙময় উপস্থিতি টের পেল সে। দূরের মাইক থেকে তিনি যেন ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন কয়েক হাত দূরের হলুদ ফুলের মুকুট পরা স্বর্ণালু গাছটার শৈল্পিক কাণ্ডে।
চমকে ওঠে চমক! টিভিতে দেখা বঙ্গবন্ধুর হুবহু লিভিং রিপ্লেকা! সাড়ে সতের বছরের কিশোর চমক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে, এ কি করে সম্ভব। ১৯৭৫ খৃস্টাব্দের ১৫ আগস্ট সপরিবারে যে লোকটা শহীদ হলেন কতগুলো মানুষরূপী হায়েনার হাতে, সেই লোকটা কি করে ওই তো ওখানে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন! এটা কি করে সম্ভব!- ভাবতে থাকে চমক।
দূরে কোথাও বাজ পড়লো কি? না না। বাজ না। বঙ্গবন্ধুর ষড়যন্ত্রের বাজনা! বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন:
" এই খোকা, কি নাম তোমার?"
যেন চমক বলছে না, বলছে তার ভিতর থেকে অন্য একজন : " আমার নাম চমক। ওই বাড়িটার ছেলে।"
বাজ কি কখনো অট্টহাসির মতো ফেটে পড়তে পারে? হয়ত পারে। তবে তা পারে শুধু একবার। কেবল একজনের জন্য। আর সেই একজন হচ্ছেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
অনেকটা অট্টহাসির মতোই একটা বজ্র যেন ফেটে পড়লো বর্ণচোরা মেঘজুটির আড়াল থেকে চমকের কয়েক হাত দূরের স্বর্ণালু গাছটায় ।
" খোকা, মন ভালো নেই বুঝি তোমার? কেউ বকেছে বুঝি?"
প্রশ্ন শুনে কি বলবে ভুলে গেল চমক। আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের জলে ভেসে গেল কপোল-বুক চমকের। কয়েক কদম এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। চমকের মাথায় হাত দিয়ে বিলি কাটতে লাগলেন। নিজের ঠাকুরদাকে কখনো দেখেনি চমক। মাথায় বঙ্গবন্ধুর হাতের ছোঁয়ায় অদেখা ঠাকুরদা স্বয়ং নিজেই নেমে এলেন যেন ক্ষণিকের জন্য। চমক কিছু বলার আগেই আবারো আকাশ হয়ে গেলেন তিনি।
" কই, বললে নাতো কেউ তোমাকে বকেছে কিনা?" _ আবারও জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু। এবার আর ভয় পেলো না চমক। কাঁদলও না। আবেগকে লাগাম পরিয়ে টেনে ধরে বলতে লাগলো সে:" আপনার পায়ে ধরে প্রণাম করতে চাই। অনুমতি দেবেন?"
" হা: হা: হা: হা: হা: __ অনুমতি! তোদের মতো শিশু কিশোরদের স্থানতো আমার বুকের এই মধ্যখানে। কর কর, যত ইচ্ছে প্রণাম কদমবুচি করবি কর। জানিস খোকা, এই যা:, তোর নাম তো চমক। না না, আমি তোকে খোকা নামেই যাকবো রে। কি বলিস, এ্যাঁ। তো_, জানিস খোকা বাংলাদেশের মানুষগুলোকে না আমি বড্ড বেশী ভালোবাসি। বাংলার আকাশ বাতাস নদী পাহাড় আর চারিদিকের সবুজ প্রাচীরের মতো গাছ-পালাগুলোকে আমার এত যে ভালো লাগে। মনে হয় একান্তই আপন জন। তাই অকারণে কেউ কোন গাছ কাটলে আমার কী যে দু:খ লাগে। জানিস খোকা, তা আমি কাউকে বোঝাতে পারি না।"
হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর বাগবচন বন্ধ হয়ে গেল। খোকা দেখলো_বঙ্গবন্ধু কাঁদছেন। বাঁ হাতে শক্ত করে ধরা পাইপটা। ডান হাতে পাঞ্জাবীর প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছছেন তিনি।
" বঙ্গবন্ধু, আপনি কি কাঁদছেন? "
" হ খোকা হ। কাঁদতাছি। আমার মানিকটাকে মানে ওই রাসেলটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। বড় চঞ্চল সে। দুষ্টের শিরোমণি। প্রজাপতির মতো সারাক্ষণ সারাদিন কেবল উড়ে বেড়ায়। কোথায় যে গেল আমার কলিজার টুকরোটা।"
খোকা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের করুণ পরিণতির ইতিহাস আগে থেকেই জানতো। বঙ্গবন্ধুর শেষতম কথায় নিজেকে সে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না_হু হু করে কেঁদে ফেললো।
খোকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন জাতির পিতা পিতৃকর্তব্যসিক্ত কণ্ঠে:" হইছেটা কি? আমিও কাঁদতাছি। আবার দেখছি তুইও কাঁদবার লাগছস। দেশটা স্বাধীন হলো মাত্র চারটা বছর_"
বঙ্গবন্ধু কথায় বাধা দিয়ে বলতে থাকে চমক:" বঙ্গবন্ধু, চার বছর কেন বলছেন, দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর আগে।"
"কি বলবার চাস তুই?"
"হ্যাঁ বঙ্গবন্ধু, এখন তো ২০১১ খৃস্টাব্দ। স্বাধীনতার চার বছর বয়স ছিল সেই কবে। সেই ১৯৭৫ খৃস্টাব্দে।"
নিমিষেই বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে অদ্ভুত অপরিচিত এক অমানবীয়ভাব ফুটে উঠলো। সূর্য ওঠার আগে পুব আকাশে যে ভাবটা বিরাজ করে, এই সেই ভাবটা যেন।
খোকার দু'চোখ জুড়ে রাজ্যের কুয়াশা। ধীরে ধীরে তা ধোঁয়াশা হতে লাগলো। অপসৃত প্রকৃতি আস্তে আস্তে পুন:প্রকাশিত হতে লাগলো চমকের দৃষ্টিতে।
" বঙ্গবন্ধু, আপনি কোথায়?"
" এইতো এইখানে।" _ বললেন জাতির পিতা অদূরের বড় বটগাছটার ঝাঁকাল মাথার কয়েকটা পাতা সরিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে।
" আমিতো এইখানে।" _ হলুদ ধান খেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন তিনি।
" দেখতে পাসনা, আমিতো সেই থেকে এইখানে।" _ বিকাল বেলায় পুব আকাশে আরেকটা সূর্যের মতোই জাজ্বল্যমান মূর্যমুখটা মেঘের আড়াল থেকে বের করে হাসতে হাসতে বললেন জাতির পিতা।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে চমক _ আকাশে বাতাসে পুকুরের জলে গাছের পাতায় ধানের মাঠে মেঘের ভেলায়, সবখানে যে বঙ্গবন্ধুর বাঙময় উপস্থিতি। কখনো হাসছেন। কখনো ভাবছেন। কখনোবা কাঁদছেন। কখনো কখনো হন্য হয়ে কাউকে খুঁজছেন এখানে ওখানে। উঁকি মারছেন গাছ_গাছালির জীবন্ত-হরিৎ অন্ধকারে।
এক সময় জেঁকে বসে অন্ধকার বড় পুকুরের পাড় ঘিরে। দু' চারটা নক্ষত্র ফুটতে শুরু করেছে মাথার উপরের কালো বাগানটায়!
স্মৃতি_বিদুরতা কিছুক্ষণের জন্য তাকে বসিয়ে দিল টাইম-মেশিনে। বাড়ির উঠোন থেকে ভেসে আসছে কয়েক বছর আগে গত হওয়া ঠাকুরমার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর:" অ_ ননাইয়া_, পোইরঅ পাড়ত্তুন গোরুয়া আনিয়েরে গোয়াইলৎ বাঁধি আয়। পঅলা হিয়াল উগ্ঘা বোউত গোরু ছঅল কঁরাইয়ে বল্।ে হন্ধ্যা বাত্তি দ্যনর সময় যারগোয়।(( পুকুর পাড় থেকে গরুটা এনে গোয়ালে বেঁধে আয়। একটা পাগলা শিয়াল অনেক গরু ছাগলকে নাকি কামড়িয়েছে। সন্ধ্যা বাতি দেবার সময় বয়ে যাচ্ছে।) ঠাকুরমারা অনেক সময় নাতিকে আদর করে 'ননাইয়া' নামে ডাকে।)
স্মৃতি-বিদুরতা থেকে মুক্তি পায় সে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় চমক। হাঁটতে হাঁটতে আবৃতি করতে থাকে সে অন্নদা শঙ্কর রায়ের নেই বিখ্যাত ছড়ার দু'টি পঙক্তি:
" যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।"
আকাশের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র চেয়ে থাকে ধরিত্রীর পানে এবং অতৃপ্তির বেদনায় হতে থাকে নীল থেকে আরো নীল। চমকের আবৃতি নক্ষত্রটা কি শুনতে পাচ্ছে?
[ ০৩/০৬/২০১১ খ্রি:]
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
পাঁচ হাজার আপনার লেখার হাত খুবই ভাল। নিয়মিত পাব বলে আশা রাখছি।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি স্মৃতি-বিদুরতা থেকে মুক্তি পায় সে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় চমক। হাঁটতে হাঁটতে আবৃতি করতে থাকে সে অন্নদা শঙ্কর রায়ের নেই বিখ্যাত ছড়ার দু'টি পঙক্তি: " যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।" আকাশের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র চেয়ে থাকে ধরিত্রীর পানে এবং অতৃপ্তির বেদনায় হতে থাকে নীল থেকে আরো নীল। চমকের আবৃতি // Khub Valo Laglo Sen Mohasoy......Golpoer plot Ba Kahini Nirbachoner Jonno Apnake Osesh Dhonnobad.....5 pawyer Joggota Apnar achhe...Tai Dilam...................
মাহবুব খান ভিসন ভালো /৫ দিলাম
আহমেদ সাবের সুন্দর লিখেছেন। অনেক করুণ স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।
মিলন বনিক সুন্দর হাতের নকশা..মন ভরে গেছে ভালো লাগায়...আগামীর লেখাও পড়ব আসা করছি..শুভ কামনা.....
মামুন ম. আজিজ শহীদ রাসেলের কথাগুলো যে জায়গায় এলো সেখানে করুন সুর হৃদয় নাড়িয়ে গেলো বিশেষ বেদনায়। বেশ ভাল লিখেছেন।
জহির উদ্দিন মোহাম্মেদ babar যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।-ভালো লাগল,
Lutful Bari Panna আপনার গল্প লেখার হাত ভাল। সময়ের সাথে আর একটু একাত্মতা প্রয়োজন ভাষার। লিখেছেন চমৎকার।
নিরব নিশাচর গল্প বুননের হাত অনেক সুন্দর.. অন্যের লেখা পড়ুন দাদা, আপনার লেখার পাঠক বাড়বে..

২১ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪