নষ্ট সময়ের গল্প

বাংলা ভাষা (ফেব্রুয়ারী ২০১৩)

শাহ আকরাম রিয়াদ
  • ২০
“উলালা উলালা...... তুহি মেরী ফ্যান্টাসি” করতে করতে বড় রাস্তা ধরে ফিকআপ গাড়িটি নাচতে নাচতে চলে গেলো। আর সেখানে উন্মাদ প্রায় দশ পনের জন তরুণ, যুবক। রাস্তার পাশে হাটতে হাটতে থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে মসজিদের বড় হুজুর বলে উঠলেন :
-“তওবা আসতাগ্ফিরুল্লা.. তওবা আসতাগ্‌ফিরুল্লা.. ইগুণ কি হাগল অই গেছেনি, না ইগুণের মিরকি ব্যারাম আছে .. গাড়ির উরপে এক্কা বান্দরের মতন টক্কে কিল্লাই !”
পাশে ছিলো স্ব-ভাষী আকবর সোবহান। হুজুরের কথায় হাসতে হাসতে তিনি কৌতুক করে বললেন
-হুজুর আইজকা হেতারা বিজয় দিবস হালন করের।
ভ্রু কুঁচকে সোবহানের দিকে তাকালেন বড় হুজুর। একটু বিরক্তও হলেন মনে হল।
-এইক্কা করিনি বিজয় দিবস হালন করে! আহারে হোলাহাইন অগল... তোগো বাপ-দাদারা রক্ত দিই এই দ্যাশ স্বাধীন কইচ্ছে, আর তোরা এ্যান বান্দরের মতন নাচি-কুদি-টক্কি, শইরলে ছেঁড়া কোত্তা-কাপড় গাদ্দি উলালা উলালা করি বিজয় দিবস হালন করছ!
কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বড় হুজুর।
অন্য দিকে আকবর সোবহান অন্য বিষয়ে ডুবে গেলেন।
সেদিন তার ছয় বছরের ছেলে আদিবের কণ্ঠে- মুন্নী বদনাম হুয়ী.. ডার্লিং তেরে লিয়ে.... হিন্দি গানটি শুনে তাজ্জব হয়ে গেলো। আদরের ছোট্ট ছেলেটাকে কষে একটা চড় দেওয়ার ইচ্ছা হল। কিন্ত ছোট্ট বলে কিছুই করল না। শুধু গত বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো। সেদিন গাড়ির এফএমটি ছাড়া ছিল। এক পর্যায়ে এক আরজে বলছে, ‘ডিয়ার ফ্রেন্ডস এখন প্লে করছি ২১শে ফেব্রুয়ারির স্পেশাল ট্রাক—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি... তো শুনতে থাকো আর এনজয় করো অ্যান্ড অফ কোর্স একুশের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করো।’ । গানটি পরপরই এফএমটি বন্ধ করে দিয়েছিলো সোবহান। সে ভাবল এই যদি হয় উপস্থাপকের জ্ঞান তো শিখবে কোথায় থেকে নতুন প্রজন্ম।
বড় হুজুরের ধাক্কায় আবার সম্বিৎ ফিরে এলো সোবহান সাহেবের।
-সোবহান ভাই লাগে উলালা উলালায় ফিদা অই গেছেন!
-না হুজুর উলালা উলালা নয়, মুন্নী বদনাম হুয়ীতে এতক্কন ফিদা অই ছিলাম।
-হেইডা আবার কি, খায় না- মাতাত দেয়?
-আরে হুজুর এইটা খায়ও না মাতাতও দেয় না, এইটা গায়।
-কে গায়?
-আঁর ছয় বছরের হোলায়।
-তওবা আস্তাগফিরুল্লা, তওবা আস্তাগফিরুল্লা, এসব কি কন মিয়া! তাড়াতাড়ি হোলাহাইনরে কন্টোল করেন।
হুজুরের কথায় সে আর প্রতি উত্তর করেনি। দুজনে রাস্তার ফুটপাত ধরে সামনের দিকে হাটতে লাগলো। কিছু দুর অগ্রসর হওয়ার পর হুজুরের কানে কোথায় থেকে যেন রাতা মোরগের আওয়াজ এলো। হুজুর এদিক-ওদিক চেয়ে কোন রাতা মোরগ দেখতে না পেয়ে সোবহান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন
-সোবহান ভাই, ইয়ানে রাতা মোরগে এইক্কা চিল্লায় কোনায়? আঁই তো রাতা মোরগ-টোরগ দেইরন্না। আন্নে দেন্নী?
সোবহান সাহেব হুজুরের কথায় সায় দিয়ে বলল
-হুজুর এইটা রাতা মোরগের ডাক, কিন্তুক এইটা অরজিনাল রাতা মোরগ না।
-তই কেক্কা রাতা মোরগ?
-হুজুর এইটা হইলো গিয়া মোবাইলের রাতা মোরগ। ওই যে পোলা এইটারে দেখতাছেন্না এই ডাক হেতার মোবাইলের-তুন আইতাছে।
-ও মা ইয়ান আন্নে কিয়া কন, মোবাইলের মইধ্যে রাতা মোরগে ডাকে কেন্নে?
-হুজুর শুধু ডাকে না, গানও গায়। হুইনবেন আন্নে?
-হেতে আগ্নোরে হুনাইবোনি?
-আরে হুনাইবো, ধমক দুইটা দিলেই হুনাইবো। চলেন।
বড় হুজুর ও সোবহান সাহেব একটু পিছিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকা সে চৌদ্দ-পনের বছর বয়সী ছেলেটির কাছে গেলো। তখনও ছেলেটির মোবাইলে রাতা মোরগের রিমিক্স গানটি চলছিল। তাদের দুজনকে দেখে ছেলেটি এমন ভাবে উঠে দাঁড়াল, যেন ভয় পেয়েছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বড় হুজুর কথা শুরু করলেন
-এই হোলা রাতা মোরগ এক্কা ডাকে কোনায়?
ছেলেটা আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে পকেটে থাকা মোবাইলটা বের করল গানটি বন্ধ করার জন্য। বের করার পর হুজুর বুঝতে পারল এইটা হইল রাতা মোরগের গান। এখন হুজুর বুঝতে পারছেনা এইটা ছেলের কণ্ঠ না মেয়ের কণ্ঠ। তাই জানার জন্য সোবহান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো।
-সোবহান ভাই, এইটা কি হোলার গলা না মাইয়্যার গলা?
-হুজুর আমিওতো বুঝতাম হারিয়েরন্না,
তারপর আবার বড় হুজুর ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলো
-এইটা কি পোলা না মাইয়্যা গাইতাছে।
ছেলেটার ততক্ষণে ভয় একটু কেটে গিয়েছিলো। সে ভাবলো এই হুজুর হয়তো ডিজিটাল হুজুর। তাই গান শুনতে চাচ্ছে।
তবুও সে একটু আমতা আমতা করে বললো
- হুজুর, এইটা পোলা না মাইয়্যা এইটা আমিও জানিনা।
বড় হুজুর আর সোবহান সাহেব অবাক হয়ে গেলেন ছেলেটার কথা শুনে। বড় হুজুর এবার রেগে গিয়ে কড়া একটা ধমক লাগিয়ে বললেন
-পুরা বেকুবেয়েনা দেই, এ্যাঁরে বেকুব... হিচাদি হিডি দিশা হারা আলামু, পোলা না মাইয়্যা গায় এইটাও জানোস না, আবার এই গান হুনোশ!

হুজুরের কড়া ধমক খেয়ে ছেলেটার হাত থেকে মোবাইল সেটটি পড়ে গেলো পাকা রাস্তায়। সাথে সাথে চায়না মোবাইল সেটটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। ছেলেটিকে পেছনে রেখে বড় হুজুর আর সোবাহান সাহেব আবার সামনের দিকে হাটতে লাগলেন।
-বুঝচ্ছেনি সোবহান ভাই, পোলাপাইনগুন পুরা নষ্ট অই গেছে। এই পোলার মোবাইলের কোন দরকার আছে? হারাদিন কানের লগে মোবাইল এক্কানরে লাগাই রাইখবো, আর বডর বডর কইরবো।

হুজুরের কথার পরে সোবহান সাহেব আর কথা বলে না। সে শুধু ভাবছে তার ছোট্ট আদিবের কথা। তাকে নিয়ে যেন সে সামনে আঁধার দেখছে। কি করে এই দুষিত পরিবেশ থেকে তাকে বাঁচাবে তাই ভাবছে। পাশের বাড়ির স্পিকারে জোরে জোরে চালানো মুন্নী বদনাম, উলালা.. উলালা.. আর সিলা কি জাওয়ানী তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সব খেয়ে ফেলছে গপগপ করে একে একে। এই লজ্জা কোথায় রাখে সে? অতি আগ্রাসী বানিজ্যকীকরন নষ্ট করে দিচ্ছে তার অতীতের সুবর্ণ ইতিহাস। তবুও সে আশার আলো খুঁজে বেড়ায় , সামনে হেটে যায়, ভরাট গলায় গান গায়... পাশে থেকে মুগ্ধ চোখে বড় হুজুর তার দিকে চেয়ে থাকে।
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
(মাগো) তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।।...”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাইম ইসলাম আঞ্চলিকতা নষ্ট সময়ের গল্পকে প্রাণ দিয়েছে। বিষয় ও গল্প গাথুনীতে দক্ষতার ছাপ আছে।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
অনেক অনেক ধন্যবাদ নাইম ভাই..
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
হিমেল চৌধুরী সুন্দর, খুব ভাল লিখেছেন।
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
তানি হক ছোট গল্পে অনেক শিক্ষনীয় ব্যাপার উঠে এসেছে ..হুজুর এবং সোবহান সাহের চরিত্র দুটি মনে রাখার মত ..আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার মুগ্ধ করে ছেড়েছে ..ভালো লাগলো ..খুব ভালো লাগলো রিয়াদ ভায়ের গল্পটি ...শুভকামনা রইলো
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
অনেক অনেক ধন্যবাদ সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য।
ভালো লাগেনি ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
রোদের ছায়া ''হুজুরের কথার পরে সোবহান সাহেব আর কথা বলে না। সে শুধু ভাবছে তার ছোট্ট আদিবের কথা। তাকে নিয়ে যেন সে সামনে আঁধার দেখছে। কি করে এই দুষিত পরিবেশ থেকে তাকে বাঁচাবে তাই ভাবছে। পাশের বাড়ির স্পিকারে জোরে জোরে চালানো মুন্নী বদনাম, উলালা.. উলালা.. আর সিলা কি জাওয়ানী তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সব খেয়ে ফেলছে গপগপ করে একে একে। এই লজ্জা কোথায় রাখে সে? অতি আগ্রাসী বানিজ্যকীকরন নষ্ট করে দিচ্ছে তার অতীতের সুবর্ণ ইতিহাস। '' ...............কি আর বলব অতিব সত্যি কথা । আমরা কথায় যে ভেসে যাচ্ছি ? অনেক সুন্দর লেখনি বিশেষ করে নয়াখালির আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার ......।খুব ভালো লাগলো ...
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
ছায়া'পু নয়াখালি না নোয়াখালী। হা হা হা। অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
মিলন বনিক সে শুধু ভাবছে তার ছোট্ট আদিবের কথা। রিয়াদ ভাই আমাদের সকলের এই ভাবনাটি ভাববার সময় এসেছে...খুব ভালো লাগল......শুভ কামনা....
ভালো লাগেনি ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাল লাগাটুকু জানানোর জন্য ত্রিনয়ন দা।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
Lutful Bari Panna দুর্দান্ত রিয়াদ। যেমন বিষয় নির্বাচন তেমন বর্ণনার যাদু। আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ গল্পটিকে শানিত করে তুলেছে।
ভালো লাগেনি ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
মনে হলো কত যুগ আপনার সাথে কথা বললাম। গল্পে চেষ্টা করেছি নিজের আঞ্চলিকতাটাকে তুলে ধরার। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগছে। পান্না ভাই জানিনা কার দোষে আমরা আপনার লেখা হতে বঞ্চিত হচ্ছি। আশাকরি আমাদের কথা মনে করে হলেও লেখা দিবেন। এই লেখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। ভাল থাকুন সবসময়।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
মো. ইকবাল হোসেন চমৎকার শিক্ষণীয় গল্প । ভাল লাগল । বাণিজ্যিকরণে আমাদের সংস্কৃতি কোথায় যে যাবে তা উপরওয়ালাই জানেন।
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ইকবাল ভাই।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
মিনহাজুর রহমান জয় বেশ হয়েছে. আমার গল্পটি পরার অনুরোধ রইলো.
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ। যাচ্ছি পড়বো।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় চমৎকার গল্প--স্থানীয় ভাষার সব কিছু বুঝতে না পারলেও গল্পের পরিচ্ছন্নতা,ধারাবাহিকতা,কথোপকথন,সঠিক ভাষার প্রয়োগ গল্পটির আলাদা একটা মান এনে দিয়েছে।অনেক ধ্ন্যবাদ আপনাকে,ভাই!
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
আপনাকেও ধন্যবাদ তাপস দা। অনেক কৃতজ্ঞতা ।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
মোঃ আক্তারুজ্জামান বাস্তবতার সুন্দর প্রতিফলন। খুব ভাল লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল আক্তার ভাই।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

২১ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪