ছড়াকার

সবুজ (জুলাই ২০১২)

হাসান আবাবিল
  • ১৮
এক
‘এই যে ভাই দুধ চা হবে ?’
‘হবে, পাঁচ টাকা কাপ, দিব ?’
‘আর লিকার ?’
‘তিন টাকা ।’
‘দু টাকায় এক কাপ দেয়া যায়না ভাই ?’
‘এই জামানায় এক গ্লাস পানির দাম দু’টাকা বুঝলেন। শায়েস্তা খানের কাছে যান, দু’টাকাতে গোটা একটা গরু না পেলেও একটা ছাগল পেয়ে যাবেন।’
চায়ের কাপে চিনি ঘুটতে ঘুটতে খটমটে মেজাজ নিয়ে বলল দোকানি।
শেষ মেষ কোন উপায়ান্ত না দেখে কাঁধের ব্যাগটা সামাল দিয়ে চা ষ্টল ত্যাগ করতে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আফসার সাহেব। তাছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর ষ্টলটাতে কোনও ফ্যানও নেই যে দু’দন্ড বসে একটু হাওয়া খাওয়া যায়। হাওয়া খেলে অন্তত পক্ষে কেউ টাকা চাইবে না। ল্যাচপেচে দু’টাকার নোটটা সমান দু ভাজ করে পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকালেন। পাঞ্জাবিটা ঘামে গায়ের সাথে মিলিয়ে গেছে। কপালে দু’একফোঁটা ঘাম জমলে পাঞ্জাবির হাতায় মুছে নেয়া যায় , কিন্তু শরীরের ঘাম মোছার কোন উপায় থাকে না। বাইরে যে প্রখর রোদ তা যদি কাঠ ফাটা বা মাটি ফাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত তাও মেনে নেয়া যেত। রোদের সাথে ভ্যাপসা গরম আর বাতাসের অনুপস্থিতি শরিরের উপর ষ্টিম রোলার চালাচ্ছে। দু’টাকার নোটটা পকেটে ঢুকিয়ে ষ্টল ছাড়তে পা বাড়ালেন আফসার সাহেব, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন কন্ঠস্বরের বাধায় তার পথ রুদ্ধ করলো।
এই যে ভাই দাঁড়ান ! টাকা লাগবে না, চা খেয়ে যান।’
এ যুগের শায়েস্তা খানের চেহারাটা এক নজর দেখার জন্য শরীরের দিক বদল করলেন আফসার সাহেব। একজন মাঝবয়েসী মানুষ, মাথায় চুল কিছুটা কমে এসেছে। আফসার সাহেবের দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে নিঃশব্দে হেসে উঠলো, দু’ঠোঁটের আড়াল থেকে পান খেয়ে লাল হয়ে থাকা দাঁত গুলো তাদের অবস্থান জানান দিল।
‘আরে ঐ আবুল্ল্যো, ভাই কে এক কাপ দুদচা দে, একে বারে দুদ চিনি দিয়্যে মালাই ম্যারে্য, বুঝলি।’
লুঙ্গিটা দু’হাতে সেঁটে নিয়ে বেঞ্চে পা তুলে বসলো লোকটা।
চা খাওয়ার প্রস্তাবে না সুচক জবাব দেয়ার আগেই, লোকটা তার হাসিতে শব্দ সংযোজন করে বলে উঠলো
‘আরে বসেন চাচা বসেন। লজ্জা করে্যন না, আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি, বুঝলেন।’
পেছন দিকে পানের পিক ফেলে, আবার হেসে উঠলো লোকটা। এবার হাসিতে শব্দের মাত্রা আরও বেড়েছে। আফসার সাহেবের হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসাল লোকটা।
‘শুনেন চাচা, জিনিস পত্রের দাম যে হারে বাড়ছে বুঝলেন, তাতে করে্য কুনু কিছুতে হাত দেওয়া মুশকিল।’
ততক্ষণে সামনের টেবিলে ধপ করে শব্দ তুলে দোকানী চায়ের কাপের অবস্থান জানান দিয়ে গেল।
‘লেন চাচা, চা হুয়ে গেলছে, চা খান, এই দুদ চিনি ঠিক মত দিয়েছিসতো?’
‘হ্যা হ্যা দিয়্যেছি’.... চুলোতে সিকের গুতো দিয়ে উত্তর করলো দোকানি। ডানহাতে চোখের চশমাটা একটু নাড়াচাড়া করলেন আফসার সাহেব।
‘কিন্তু আমিতো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা !’
‘ব্যুললেমতো আমাখে আপনি চিনবেন না। আমি আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। আপনি কবি আফসার হোসেন না ?’
আফসার সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘কবি না , ছড়াকার।’
‘আরে ঐ হলো একই কথা। আমার ছুটু ব্যাটাডা কেলাস কেজিতে পড়ে, ওর একটা বইয়ে আছে আপনার লেখা কবিতা। ওরতো সব কবিতাই মুখুস্তুু।’
আফসার সাহেব এবার চায়ের কাপের দিকে দৃষ্টি দিলেন। বুঝতে পারছেন না, চা টা পান করবেন কি না।
‘লেন লেন চা লেন, ঠান্ডা হয়ে যাবে। তা কবিতার বইয়ে আপনার ছবিড্যা দেখেছি বুঝলেন ঐ দেখেই চিনতে পারনু।’
‘ওটা কবিতার বই না, ছড়া।’
‘ঐ হলো। তা আমার ব্যাটা আপনার একটা কবিতা আছেনা . . .‘কদম আলী’ না কি যেন
“কদম আলীর দিনটা কাটে
সকাল দুপুর খেটে
দু’বেলা যায় অনাহারে
রাতে আঙ্গুল চেটে।”
ওড্যেতো ডেলি দুবার করে পড়ে শুনায়।’
‘ওটা কবিতা না ছড়া।’ বলতে বলতে চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়ালো আফসার সাহেব।
রেডিওতে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান চলছে, অনুষ্ঠানের ঘোষক শ্রোতাদের অনুরোধের চিঠিগুলো পড়ে সে মোতাবেক গান শোনাচ্ছেন।
চায়ের কাপটা হাতে তুলে কাপের গায়ে লেগে থাকা চিনি আর দুধের সরটা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মুছে তাতে চুমুক দিলেন ছড়াকার। প্রথম চুমুকেই মুখে এল গাড় মিস্টি দুধের সর। সরদার ডাক্তারের চিবিয়ে পানি খওয়ার কথা জানা আছে। কিন্তু এই প্রথম চিবিয়ে চা খাচ্ছেন তিনি। চা টা বেশ ভালই বানিয়েছে দোকানী, দুধ, লিকার, সর, চিনির একেবারে যুতসই সংমিশ্রণ।
রেড়িওতে ঘোষকের কন্ঠ মিলাতে না মিলাতে ভেসে উঠলো কলকাতার ছায়াছবির একটা গান। বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছে গানটা শোনার জন্য। গানটা মনে হয় দোকনিরও খুব পছন্দের আর সে কারণেই হয়তো রেডিওর ভলিউম খানিকটা বাড়ানো হল। সেই সাথে নড়েচড়ে বসলো আফসার সাহেবেকে চা খাওয়ানো এ যুগের শায়েস্তা খান।
‘গান দিয়েছেরে একটা। দে মামা, সাউন্ডটা আর ইট্টু বাড়িয়ে দে।’
রক্ত গরম করা বাজনার সাথে সাথে বাজতে লাগল ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধের গান, সে গান এ যুগের শায়েস্তা খানেরও কম পছন্দের নয়।
“প্রেম কি বুঝিনি
আগেতো খুজিনি
আজ কি হলোরে আমার...।”
চায়ের কাপে দ্বিতীয় বারের মতন তৃপ্তির চুমুক দিয়ে গানের মধ্যে ডুবে পড়লেন ছড়াকার। অন্তমিলের বেশ ভালই ব্যবহার করা হয়েছে সেই সাথে মাত্রারও। কিন্তু আধুনিক বাজনা আর প্রেমের এমন অত্যাধুনিক আহ্বান খানিকটা অবাক করলো আফসার সাহেবকে। এযুগের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য সিলেবাসের সাথে সাথে গানের রুচিও বদলেছে বলতে হয়। তৃতীয় বারের মত চায়ের কাপে চুমুক দেবেন ছড়াকার এমন সময় বাধ সাধলো এ যুগের শায়েস্তা খানের একটা প্রস্তাব।
‘কবি সাহেব এরেকুম ঝাক্কাস মার্খা গান লেখেন বুঝলেন। এরেকুম কদম আলী ফদম আলীর ছড়া কবিতা লেখে পেটে ভাত তো দুরে থাক দুধ’চাও খেতে পারবেন নাখো।’
কথা শেষ হতে না হতে আবার গানের মধ্যে মিশে গেল। একথা শোনার পর চায়ের কাপটা ছুড়ে মারতে ইচ্ছা হল আফসার সাহেবের। কিন্তু ওতে করে তেমন কিছু হবে না। পাশ্চাত্য নির্ভর রুচিতো আর বদলাবে না। সহজে রেগে যাওয়ার মানুষ আফসার সাহেব নন। কিন্তু কেউ যদি এভাবে অপমান করে তবে মুখ বুজে সহ্য করার মানসিকতাও তিনি রাখেন না। ঝড়ের গতিতে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরপর পকেট থেকে দু’টাকার নোটটা বের করে দোকানির সামনে রাখলেন।
‘এই নাও দু’টাকা, তোমার চায়ের বাকি তিন টাকা আমি পরে দিয়ে যাব।’
দোকানি খানিক অবাক আর আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ভাই, যে চা খেয়েছেন ওটা তো দুধ চা না, এই চায়ের দাম আট টাকা।’
‘ঠিক আছে বাকি ছয় টাকা আমি দিয়ে দেব’ . . . কথা পুরোটা শেষ হতে না হতে বেরিয়ে গেলেন ছড়াকার।
‘কি হলো কবি সাহেব ! চা খেলেন না যে ?’
খানিকটা চিৎকার করেই বললেন মাঝ বয়েসি লোকটা। কে জানে ছড়াকার শুনতে পেলেন কি না।

দুই
‘ভাত কাপড় দেয়ার মুরোদ নেই তো বিয়ে করার কি দরকার ছিল’ . . .
চুলায় জাল ঠেলতে ঠেলতে পৃথিবীর যতসব অশ্লিল ভাষায় আফসার সাহেবকে খিস্তি করছে আদরের বউ। বউ এর এসব গালিগালাজ ইদানিং আর তেমনটা গায়ে লাগেনা। দু’বছর ধরে শুনতে শুনতে তিনবেলা ডাল ভাতের মত হয়ে গেছে। বরং গালিগালাজ না শুনলেই সেদিন কেমন অপূর্ণ মনে হয়। মনে হয় সেদিনের তালিকা থেকে কি যেন বাদ চলে গেল। ঘরে বসে সাদা কাগজের উপর আঁচড়া আঁচড়ি করছিলেন আফসার আলী। বউ এর চিৎকার চেঁচামেচী আর অভাব অনটনের গানের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নতুন একটা ছড়া নিয়ে ভিষণ চিন্তিত। ভাবতে বসেছেন “উকিল” শব্দের সাথে “দু’কিল” শব্দের অন্তমিল ব্যাবহার করলে কোন প্রকার আইনি ঝামেলায় জড়াতে হবে কিনা। দৈনিক “মুন শাইন” এ সোম বারে সাহিত্য পাতা বেরোচ্ছে। বুধ বারে “রুপালী সংবাদ” আর শনিবারে “সোনালী দেশ” নিয়মিত সাহিত্য পাতা বের করছে। ইদানিং লেখার চাপটাও সে কারণে একটু বেশি। গালে হাত রেখে কলমের খাপ চিবাচ্ছিলেন ছড়াকার, এমন সময় হঠাৎ করে পেছন থেকে বউ এসে একটানে সাদা পাতাটা টেনে নিয়ে এক পলকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। ছড়াকার স্বঅবস্থানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুটা যে ভয় পাননি তা নয়।
‘সকাল থেকে বলছি কথা কি কানে যাচ্ছে না ? কেরোসিন শেষ হয়ে গেছে চুলা জ্বলছে না দেখতে পাচ্ছ না ?’
‘কিন্তু আমার কাছেতো টাকা পয়সা নেই।’
‘তা থাকবে কেন . . শুধু পড়ে থাক ঐ সব খাতা কলম নিয়ে’ . . .
আদিকালের ভাষা বলতে বলতে ঘর ছাড়লো আফসার আলীর বউ। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে দশ টাকার একটা নোট ছুড়ে দিল আফসার আলীর দিকে। মাটি থেকে টাকাটা তুলে নিতে নিতে প্রশ্ন করলো আফসার আলী,
‘টাকা পেলে কোথায় ?’
‘অতো ঢং দেখাতে হবে না। দু’পয়সা কামানোর মুরোদ নেই’ . . .
‘আহ্ বলোনা টাকা কোথায় পেলে ?’
‘মুরগিতে তিনটা ডিম দিয়েছিল। দুইটা বিক্রি করেছি। একটা রান্না করবো।’
‘একটা..! কে খাবে ?’
‘আমি খাবো, আর আপনি খাবেন ঝোল’ . . .
‘ইয়ে . . . আমাকে কি অর্ধেক দেয়া যায় না ?’
কিছুটা আবেদনের সুরে বললেন আফসার আলী। বউ এর মুখে রাগের সাথে সাথে মুচকি হাসি দেখতে পেলেন তিনি। বুকের ভিতর আনন্দের ঝাপটা পরশ লাগলো যেন।
‘চুলা জ্বালাবো . . তুমি কি যাবা নাকি পিঠের উপরে দু’টো কিল বসাতে হবে।’
এই বলে আফসার সাহেবের দিকে ছুটে এলো আদরের বউ। আর বউ এর কিল থেকে বাঁচার জন্য এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। যদিও বউ এর সেই কিলের মধ্যে মিষ্টি স্বাদটা তার মোটেও অপছন্দ নয়। ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই আফসার সাহেবের ছড়ার গিটটাও খুলে গেল। চট করে মনে এল ছড়ার নতুন দু’টো লাইন -
“যতই তুমি হওনা রাজা
বাদশা-উজির-উকিল ,
বউ এর হাতে রোজ তোমাকে
খেতেই হবে দু’কিল।”

তিন
ইদানিং গাড়ি ঘোড়াতে চড়ার কোনও উপায় নেই। ক’দিন আগেও রিক্সা-গাড়ির ভাড়া মানুষের আয়ত্তের মধ্যে ছিল। আজ কাল যে হারে ভাড়া চাওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয় ডাকাতি করার উপক্রম। এসব অবশ্য মধ্যবিত্ত , নিম্ন মধ্যবিত্ত আর দরিদ্রদের বেলায়। বড় লোকেরা দিব্যি মোটর গাড়ি চড়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। তাও আবার ড্রাইভারকে মাসের পর মাস মোটা টাকা বেতন দিয়ে। আজকাল স্বনামধন্য লেখকদের চেয়ে একটা ড্রাইভারেরই মনে হয় অনেক বেশি আয় উপার্জন।
পাঁয়ে হেঁটে যাবেন না রিক্সা করে বাড়ি ফিরবেন? ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথাই ভাবছিলেন আফসার আলী। যে ভ্যাপসা গরম পড়েছে তাতে করে পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। কিন্তু পকেটের সাধ্যের যে অবস্থা তাতে করে রিক্সা ভাড়া দেবার পর আধা কেজি চালের পয়সা হয়তো বাঁচবে কিন্তু একটা করে পেয়াজ মরিচ আর একটা ডিমের পয়সা হয়তো বাঁচবেনা। পত্রিকায় লেখা ছাপানোর বিলটা আজও হয়নি। দু’সপ্তাহ ধরে লেখা ছাপছে, ক’টাকা দিবে তারও কোন ঠিক নেই, এতেও আবার কয়েকবার ঘোরা হয়ে গেল। যা দেয় তাই লাভ। অন্যান্য পত্রিকায় তো কোন পয়সা দেয়না, সৌজন্য কপি আর কড়া লিকার চায়ের বিনিময়ে লেনদেন হয় কলামের পর কলাম লেখা। সম্পাদক মোখলেস সাহেবের কাছ থেকে পঞ্চাশটা টাকা হস্তগত করেছেন ছড়াকার। অবশ্য সেজন্য কয়েকটা মিথ্যা কথাও বলতে হয়েছে। বাসায় মানিব্যাগ ফেলে আসার নাটক সাজাতে হয়েছে। অবশ্য পরে লেখার বিল নেয়ার সময় এ্যডজাস্ট করে নেয়া যাবে। কয়েক মিনিট চিন্তা করে পাঁয়ে হেঁটেই রওনা হলেন আফসার আলী। এতে করে অন্তত পক্ষে দশ পনের টাকা বেঁচে যাবে। তাছাড়া রোদটাও এর মধ্যে একে বারে পড়ে গেছে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসতে পারে। বৃষ্টি আসার আগেই দোকান করে বাড়ি ফিরতে হবে। চলার গতি বৃদ্ধি করলেন আফসার আলী। আজও তিনি রুমাল নিতে ভুলে গেছেন। রুমাল আর চশমার কাভার ভুল করে বাসায় ফেলে আসা আফসার সাহেবের অনেক পুরোনো অভ্যাস। বউ যত বার করেই মনে করিয়ে দিক না কেন এ অভ্যাস ছড়াকারের থেকেই গেছে। পত্রিকা অফিসের সম্পাদক মোখলেস সাহেবের টেবিলের টিস্যু বক্স থেকে দু’টো টুকরো পকেটস্থ করা ছিল, সেখান থেকে একটা বের করে কপাল আর গালের ঘাম মুছে নিলেন। এতেই টিস্যুর অবস্থা একেবারে আটা আটা। তাই এক টুকরো টিস্যু দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মোছার আশায় গুড়ে বালিই হল।
আকাশের অবস্থা বেশি ভাল মনে হচ্ছে না। রাস্তার মাঝে মাঝে বাতাসের কুন্ডলি পাকিয়ে কাগজ আর পলিথিনের আবর্জনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। জোরে হাঁটা তো দুরের কথা দৌঁড়েও আর বাড়ি পৌঁছানো যাবে না, কারন এর মধ্যেই দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। আকাশটাও সন্ধ্যা নামার মত কাল অন্ধকার হয়ে এসেছে। আশে-পাশে দু’এক জন লোক দৌঁড়া দৌড়ি শুরু করেছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন আফসার আলী, সামনের দিক থেকে ঝাঁক বেধে শড় শড় শব্দে বৃষ্টি ধেয়ে আসছে। এক দৌঁড়ে দো-চালা চায়ের ষ্টলে আশ্রয় নিতে নিতেই অনেকটা ভিজে গেলেন তিনি। পকেট থেকে বাকি এক টুকরো টিস্যু বের করে মুখ মোছার বৃথা চেষ্টা করলেন। শরীরে ভেজা ঘামের সাথে সদ্য বৃষ্টির পানি মিশে অসহ্যকর একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। লোক জনের ভিড় না থাকলে হয়তো পাঞ্জাবিটা খুলে নেয়া যেত।
একেতো রোদের তাপে গরম হয়ে থাকা মাটি তার উপর বৃষ্টি পড়ে গরম গরম ভেজা মাটির একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। যা কিনা অন্যকিছুর সাথে মিলে না। গরমের সময় বৃষ্টি শুরুর সময় এই গন্ধটা নাকে এসে ঠেকলে বেশ মিষ্টি লাগে। বৃষ্টি ঝরতে থাকলে গন্ধটা একটু পরেই হারিয়ে যায়। সদ্য ভেজা মাটির গরম গরম ঘ্রাণ নাক দিয়ে টেনে বুক ভরতে বেশ ভাল লাগে আফসার সাহেবের। দেশ আর দেশের মাটি মায়ের মত। আর এই গন্ধটা সে জন্যই হয়তো নাড়িতে টান দেয় ছড়াকারের।
‘হটেন . . হটেন . . হটেন।’ উপদ্রবের মতোন একজন ভদ্রলোক রাস্তার দিক থেকে এসে আফসার সাহেবকে ঢেলে ঠুলে বৃথা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল, কারণ ভেতরে তিল ধারনের জায়গাটুকুও খালি নেই। প্রচন্ড বৃষ্টির তাড়াতেই বুঝি ভদ্রলোকের ঞ্জান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। চালের নিচে আশ্রয় পেয়েও ছাতাটা বন্ধ করেননি তিনি। পেছন থেকে দু একজন চিৎকার করে উঠলো,
‘এই যে ভাই ছাতাটা বন্ধ করেন না, গায়ে বৃষ্টি পড়ছে তো।’
তড়িঘড়ি করে ছাতাটা বন্ধ করলেন ভদ্রলোক। এতক্ষণে আফসার সাহেব ভদ্রলোকের চেহারাটা ভালমত দেখতে পেলেন, আর ভদ্রলোক চিনতেও পারলেন আফসার সাহেবকে।
‘আরে কবি সাহেব আপনি . . . এখানে . . তা কোথায় যাচ্ছেন ?’
প্রথমে ভদ্রলোককে চিনতে অসুবিধা হলেও পরে ঠিকই চিনতে পারলেন আফসার সাহেব। বনপাড়া পাবলিক লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান। গত বছর ঐ লাইব্রেরীর বার্ষিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা পুরস্কার নিতে গিয়ে উনার সাথে পরিচয় হয়েছে। নাম মিষ্টার কিনু। নামের মতই চেহারা একটু রোগা আর মাজা বাঁকা করে হাঁটেন। গত বছর পরিচিত হওয়ার সময় বেশ শান্ত শিষ্ট মনে হলেও এখন একটু চঞ্চল স্বভাবেরই মনে হচ্ছে।
‘এইতো একটু ওদিক থেকে আসছিলাম। পাশেই আমার বাসা।’
ঝুলতে থাকা ব্যাগটা কাঁধ বদল করে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন ছড়াকার, তাতে অনেকটা স্বানন্দেই সাড়া দিলেন।
‘আসেন আসেন ভিতরে চা খেতে খেতে কথা বলি।’
আফসার সাহেবের হাত না ছেড়ে, টানতে টানতে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন মিষ্টার কিনু। এর পর সোজা দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বসলেন। বেঞ্চে অযথা বসে থাকা দু’জন পাবলিক কাষ্টমারকে জায়গা ছেড়ে দিল।
‘বসেন কবি সাহেব। তা বলেন কেমন চলছে ?’
কি উত্তর করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। টিনের চালায় বৃষ্টির ভারি শব্দের কারণে একটু জোরে কথা বলতে হচ্ছে।
‘চায়ের সাথে কিছু দিব নাকি ? গরম কেক আছে।’
মি: কিনুর চেহারা দেখে মনে হল উনি বুঝি গরম কেকের অন্ধ ভক্ত, আর সে জন্যই বুঝি চট করেই প্রস্তাবটা মেনে নিলেন।
‘দে দে ভাল দেখে দু’পিছ কেক দে . . মধ্যে থেকে দিস, বড় বড় দেখে।’
‘না না কিনু ভাই আমি কেক খাব না !’
‘আরে খাব না বলে আবার কোন কথা আছে? নেন নেন শুরু করেন। ঐ চা কিন্তু একটু মোটা করে করিস, মালাই চা বুঝলি ।’
মালাই চায়ের কথা শুনে জিভের পানি আটকে রাখবে এমন দুঃসাহস ছড়াকারের নেই। পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে কেকটা হাতে তুলে নিলেন। গরম কেক তো দুরের কথা, শুকিয়ে কাঠ হবার উপক্রম, নাকের কাছে আনতেই শুটি শুটি গন্ধ লাগে। ওদিকে মিষ্টার কিনু সমানে গিলে যাচ্ছেন প্রস্তাবিত গরম গরম কেক।

চার
চায়ের কাপ খালি হওয়ার আগেই বৃষ্টি থেমে গেছে। যে যার গন্তব্যস্থলে চলে যাওয়ায় চায়ের ষ্টলটা অনেকটা খালি হয়ে গেছে বলতে হয়। মিষ্টার কিনু চা খাওয়ার পর দু’দুটো গোল্ডলিফ সিগারেট নিয়ে কোন বিল না দিয়ে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়েছেন। প্রথমেই অবস্য আফসার সাহেব এমনটাই সন্দেহ করেছিলেন। জোড়ায় জোড়ায় চা সিগারেট আর কেক সব মিলিয়ে বিল হয়েছে তেত্রিশ আর আগের দিনের ছ’টাকা মিলে উনচল্লিশ টাকা। পকেট থেকে কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকার নোট টা বের করে দিলেন আফসার সাহেব। নতুন টাকায় জাতির জনকের ছবি ছাপা হয়েছে। বঙ্গ বন্ধু মারা যাবার সময় অনেক ছোট ছিলেন ছড়াকার। তাই তেমন কিছু বুঝে ওঠেননি, কিন্তু এই পঞ্চাশ টাকাটা বের করে দিতে বুকের ভেতরটা খচমচিয়ে উঠল।
‘এই নেন কবি সাহেব এগার টাকা।’
ততক্ষণে আফসার সাহেবের কবি পরিচয়টা দোকানিরও জানা হয়ে গেছে। ভেজা পাঞ্জাবির পকেটে এগার টাকা বন্দি করে বাড়ি এসে পৌঁছাতেই আবার গৃহীনির তোপের মুখোমুখি হলেন তিনি।
‘বাড়িতে চাল ডাল কিছুই নেই, দুপুরে না হয় ভর্তা ভাত খাব কিন্তু রাতে খাব কি ?’
বউ এর কথায় কান না দিয়ে গামছায় মাথা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে গেলেন আফসার আলী এবং ভেজা পোশাক না খুলেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মি:কিনুকে এসময় সামনে পেলে হয়তো শ’দুয়েক সিগারেট আর কেক একত্রে মুখে গুঁজে দেয়া যেত। বিছানায় শুয়েই শেলফে রাখা সম্মাননা পদকটার উপর নজর পড়ল ছড়াকারের। মোটা পিতলের ওপর লেখা আছে খোদাই করে। ওজন কম করে হলেও পাঁচ-ছয়শো গ্রাম হবে। লোক মুখে শোনা আছে এসব ধাতুর দাম নাকি অনেক, প্রায় সোনার কাছা কাছি। বিদ্যুৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ছড়াকার। সম্মাননা পদকটা ব্যাগে পুরে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল মাত্র। এর পর বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে। উদ্দেশ্য রেল গেটের পুরেনো বাজারের দিকে। ওদিকে পুরোনো ধাতব জিনিস-পত্র কেনা বেচা হয়। অনুমান মত যদি ক্রেষ্টটার ওজন পাঁচশ গ্রামও হয় তাও দু’চারশো টাকা অন্তত পাওয়া যাবে। কমসে কম দু’শ পাওয়া গেলেও দু’দিনের সংসার খরচ।
‘কি হল তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ ?’
পেছন থেকে ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করলো বউ। অনেক আদরের বউটার কন্ঠ আজ যেন অভাবের তাড়নায় বিষাক্ত হয়ে পড়েছে আফসার সাহেবের কাছে। বউ এর কথার কোন উত্তর করলেন না তিনি। ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। বৃষ্টি থেমেছে সেই কখন। আবার রোদ হেঁসেছে আকাশের বুকে। পিচ ঢালা রাস্তার বুকে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ফর্সা আকাশের রোদের ছটা অনেকটা মরিচিকার মত দেখাচ্ছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আরিফ খান বলতেই হয় গল্পটি অনেক ভাল লাগল, .....
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
বশির আহমেদ অসম্ভব ভাল লাগার গল্প । লেখা ঝরঝড়ে তকতকে ।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
সূর্য একজন কবির আর্থিক অক্ষমতা আর সুবিধাবাদী আমাদের চরিত্র অনেক সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে গল্পে। অনেক ভাল লাগলো গল্পের বুনন।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি chomotkar sob vasar babohar golpo khub valo legechhe hasan vai..............
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
দিপা নূরী বিষয় যাই হোক প্রকাশ ভঙ্গিটাই আসল। সুন্দর বর্ণনায় জীবন চিত্র, ভালো গল্প।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
অষ্টবসু sundar athach bedanadayak galpa.bhalo likhechen
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
আহমেদ সাবের একজন ছড়াকারের আর্থিক অসঙ্গতির চিত্র বেশ চমৎকার ভাবেই ফুটে উঠেছে আপনার গল্পে। আপনার হয়তো জানা আছে, আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দের জীবন কেটেছে সীমাহীন দারিদ্রে। আপনার লেখার স্টাইলটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!! ছড়া লিখি কোন দাম পাইনা দাদা.. বিশ্বাস করুর..। নাটক লিখে টাকা পাই.. গল্প লিখে পাঠকের শুভেচ্ছা পাই, কবিতাতেও কারো কারো মন্তব্য পাই.... ছড়ার বদলেও কিছু অভিনন্দন পাই.. কিন্তু ভাল মানের ছড়ার পাশাপাশি, ছড়ার পাঠক আর ভক্তও কেন জানি কমে যাচ্ছে...!!!
আরমান হায়দার অনেক গোছানো একটি গল্প।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
মিলন বনিক পর্ব করে লেখা একজন শিল্পীর করুন চিত্র বর্তমান বাস্তবতারই আয়না...খুব ভালো লাগলো হাসান ভাই..শুভ কামনা...
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ....!!
মামুন ম. আজিজ চমৎকার বাস্তবতার ফলুঝুরি...ছড়াকারের আকাল অবস্থা ...হায় এ জাতির কি হবে?
জাতির আর যাই হোক ছড়াকার রা ভাত পায়না ভাই..

০৮ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪