ঈশ্বর হেথায়

ঐশ্বরিক (মার্চ ২০১৭)

রীতা রায় মিঠু
  • ১৩
পরমেশের মেজাজ মর্জি আজকাল ভাল যাচ্ছে না। মায়ার সাথে খিটিমিটি লেগেই আছে। কথায় বলে, অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়। পরমেশের হয়েছে সেই অবস্থা। তার মত অভাগা এই পৃথিবীতে কজন আছে! যে সোয়ামীর কপালে সুন্দরী বউয়ের কামাই লেখা থাকে, রাতে খোকার হিসির কাঁথা বদলানোর কথা লেখা থাকে তার মত অভাগা আর কেউ হয়?

নিতীশ চক্কোত্তি বললে বীরভূমের সকল মানুষ মাথা নুইয়ে প্রণাম করে যাঁর ঊদ্দেশ্যে, সেই নিতীশ ঠাকুরের একমাত্র পুত্র পরমেশ চক্কোত্তির আজ কী বেহাল দশা! “উফ! শ্লা মশারাও বাগে পেয়ে বামুনের রক্ত চুষে নিচ্ছে” বলে অন্ধকারেই বাম গালে এক চড় বসালো পরমেশ। অন্ধকার কারণ লোডশেডিং চলছে। সময়টা এখন ভাদ্র মাস, গা চিটচিটে গরম, তার মধ্যে লোডশেডিং। লোডশেডিং নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই পরমেশের, সমস্যা হয় খোকাকে নিয়ে। চার বছরের খোকা গরমে ঘুমুতে পারেনা ভাল করে। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেও কোন সুসার নেই। একটু পর পর কেঁদে ওঠে। কেন কাঁদে বুঝে উঠতে পারেনা পরমেশ। গরম লাগার কথা না, ও হাতপাখা চালিয়েই যাচ্ছে, মশার কামড়েও কাঁদতে পারে, নাহয় মায়ের জন্য কাঁদে। যেদিন মায়ার কাজ থাকেনা, সে রাতে খোকা ঘুমে কাদা হয়ে থাকে। গরমেও কাঁদেনা, মশার কামড়েও কাঁদেনা। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমায়। মায়াকে একটু আদর করে কাছে টেনে নিতে গেলেই খোকা নড়ে চড়ে ওঠে। সাথে সাথে মায়া এক ঝটকায় পরমেশের হাত সরিয়ে দেয়। এমন ভাল্লাগে কতদিন! কিছু বলতেও পারেনা, বউ কামাই করে, পরমেশকে তাই চুপ করে থাকতে হয়।

আজ গরমও পড়েছে ভ্যাপসা, লোডশেডিং চলছে। পাশেই খোকা ঘুমাচ্ছে, থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। মায়ার আজ শো আছে। শো শেষ করে আসতে আসতে রাত আড়াইটে তিনটে হয়ে যাবে। পরমেশকে অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়, মায়ার পায়ের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দিতে হয়। হিটার জ্বালিয়ে ডাল তরকারি গরম করে ভাত রেডি করে দিয়ে তবেই পরমেশের মুক্তি। এসব কাজ পরমেশ নিজ থেকেই করে, মায়া অবশ্য রাগ করে।

কতদিন বলেছে, “ তুমি কেন আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকো, কেন এত রাতে হিটার জ্বেলে ভাত তরকারি গরম করে দাও। ঠান্ডা ভাত খেতে আমার একটুও খারাপ লাগেনা, এত রাতে ক্ষিদেও থাকেনা। আমায় পাপের তলে ডুবাচ্ছো, আমার নরকেও ঠাঁই হবেনা। পতি পরমেশ্বর, পতির পায়ের নীচে সতীর স্বর্গ”!

মায়া বলে যায়, পরমেশ মনে মনে বলে, “ বাপ রে! এ যে দেখছি পুরো যাত্রার ডায়লগ ঝাড়ছে এখানে”, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সে বেকার, বউ যাত্রা করুক আর বাইজী নাচ নাচুক, রোজগার করে বেকার সোয়ামীকে খাওয়াচ্ছেতো! বউকে কিছু বলা যাবে না”।

মায়া তখনও নাঁকি সুরে বলে চলে, “ স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর সেবা করা। তুমি আমার শিবঠাকুর, কিন্তু এমনই পোড়াকপালি আমি যে তোমার প্রতি কোন কর্তব্যই করতে পারিনে, উলটো তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীর সেবা করছো! আমার যে নরকেও ঠাঁই হবে না গো”।

পরমেশ তবুও এসব কাজ করে যায়, এমন নয় যে স্ত্রীকে খুব ভালোবেসে করছে। নিজের উপর ধিক্কার এসেছে, বউয়ের কামাই খায় যে পুরুষ, সে কি পুরুষ নাকি? আর কদিন পর পরমেশ হাতে শাঁখা চুড়ি পরে নিবে, তাহলে রান্নাবান্নার কাজে মানিয়ে যাবে। মনে মনে নিজেকে আরেকবার ধিক্কার দিল “ শালার ঘুণে খাওয়া কপাল, বামুনের ছেলে হয়ে কেন যে সুন্দরী একট্রেসের প্রেমে মজতে গেলে বাপু! লাও, এখন ঠেলা সামলাও। স্ত্রীর সেবা করো, ছেলের কাঁথা পাল্টাও, পরমেশ, তুমি এই কাজ করার জন্যই জন্মেছো”।
আরেকটা থাপড় কষালো বাম গালে, মশাগুলো খুব বিটকেলে, সারাক্ষণ ওর বাম গালেই কামড় দিচ্ছে! কেন রে বাপু, আমার বাম গালে কি মধু মাখা আছে? নাকি আমার বাম গালটা তোদের বৌদিদিমণির মত গোলাপী! এত লোভ কেন আমার বাম গালের প্রতি। নাকি তোদের বৌদিমণির কামাই খাই বলে আক্রোশে কামড়ে দিচ্ছিস! কামড়ে দে, আর কত কামড়াবি কামড়ে নে। কাল সকালেই পাখি ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। তখন ভাল করে কামড়াস, আমাকে পাবিনা, মশারীর নেটেই কামড়াস। নেটেই বা কামড়াবি কি করে? নেট দেখা যায়না তো, সব দিকে শুধু তালি আর তালি। হি হি হি! মজা হবে, চকোত্তির পুতের গাল খুঁজে নাপেয়ে মশারীর তাপ্পির গালে কামড় দিস শালা”।

গত পাঁচ বছর যাবৎ চলছে এই কষ্ট, আর সইতে পারছে না পরমেশ। বীরভূমের জাগ্রত কালী মন্দিরের পুরুত নিতীশ চক্কোত্তির একমাত্র ছেলে পরমেশ চক্কোত্তি। ভক্তদের দান দক্ষিণায় নিতীশ চক্কোত্তির বাড়িঘরের অবস্থা বেশ ভাল। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সম্পত্তির ভোগ দখল সবই পরমেশের জন্য তোলা ছিল। কিন্তু একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ার কারণে মা বাপের আদর পেয়ে পরমেশ ছোটবেলা থেকেই ত্যাঁদোর হয়ে গেছে। স্কুল শেষ করেনি, বাবার সাথে মন্দিরের কাজেও যোগ দেয়নি, সে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, কলকাত্তা গিয়ে ঘুরেছে ফিরেছে, সিনেমা থ্যাটার দেখে মন খুশী করে আবার বীরভূমে ফিরেছে।
এখানেও রথের মেলায়, দুর্গাপূজোর সময়, চোত বোশেখের মেলায়, শীতের সময় পালাগানের আসর হয়, যাত্রা দলের সপ্তাহব্যাপী যাত্রা হয়, সার্কাস দেখানো হয়, পুতুল নাচ দেখায়। পরমেশের সময় কাটানোর অভাব নেই। এমনই যাত্রা দেখতে গিয়েই নিউ অপেরা যাত্রা দলের প্রিন্সেস গুলাবীর প্রেমে পড়ে যায়।
প্রিন্সেস গুলাবীর আসল নাম মায়া। যাত্রাদলের পরিচালক মায়া নাম পালটে গুলাবী দিয়েছেন। মায়ার গায়ের রঙ গোলাপ ফুলের মত বলেই কি গুলাবী নাম দিয়েছে কিনা, পরমেশ তা জানেনা। প্রিন্সেস গুলাবীকে প্রথম পালাতে রাই কিশোরীর ভূমিকায় দেখেই পরমেশের বুকে প্রেমের বন্যা জেগেছিল। সে কি দূর্দমনীয় টান গুলাবীর জন্য। এমন অবস্থা হয়েছিল যে যাত্রা পালা শেষ হয়ে গেলেও পরমেশ বাড়ি ফিরতোনা। যাত্রা দলের ম্যানেজারের সাথে খাতির করে নিয়েছিল, ম্যানেজারের ঘরেই শরীর মুড়ে শুয়ে থাকতো। ভোরের আলো ফুটবার আগেই পরমেশ ঘুম থেকে উঠে যেত। ম্যানেজার নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে, পরমেশ বাইরে বেরিয়ে আসতো। তাঁবুর ঘর সব সারি সারি, এর কোন একটির মধ্যে প্রিন্সেস গুলাবী আছে। গুলাবীকে ভোরের আলোয় দেখার জন্য পরমেশ কত ভোর ম্যানেজারের তাঁবুর দরজায় বসে থেকেছে। এক ভোরে ঠিকই গুলাবীকে দেখতে পেয়েছিল, হাতে জলের ঘটি নিয়ে গুলাবী তাঁবুর পেছন দিকে যাচ্ছিল। পরমেশের মনে হচ্ছিলো এক ছুটে গুলাবীর হাত দুটো ধরে বলে, “ প্রিন্সেস গুলাবী, আমিই রাধাকিশোর, তোমায় নিতে এসেছি”। কিন্তু গুলাবীকে হাতে জলের ঘটি নিয়ে তাঁবুর পেছন দিকে যেতে দেখে সব ইচ্ছে নিভে গেলো।

এরপর ম্যানেজারকে হাত করে ফেললো পরমেশ, গুলাবীর সাথে নিরালায় কথা হলো। কি কথা হয়েছিল কেউ জানেনা, কিন্তু পরমেশ বাড়ি ফিরে ঘোষণা দিল, সে নিউ অপেরা যাত্রা দলের প্রিন্সেস গুলাবীকে বিয়ে করবে। একমাত্র পুত্রের মুখে এমন সব্বোনেশে কথা শুনেই পরমেশের মায়ের বিলাপ শুরু হলো। পরমেশের মা বিরযাবালা দেবী ছেলের মন ফেরাবার জন্য কত ঝাড়ফুঁক করিয়েছেন, পাগলা পীরের কাছ থেকে তাবিজ মাদুলী আনিয়ে ছেলের হাতে আর গলায় পরিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। পাগলা পীর খুবই জাগ্রত পীর, এই পীরের তাবিজ মাদুলিতে বদ্ধ উন্মাদ ভাল হয়ে যায়, অথচ পরমেশের মাথা থেকে গুলাবীর আছর যায়না!
বাড়ি থেকে বেরিয়েই পরমেশ কব্জিতে বাঁধা মাদুলী ছিঁড়ে ফেলতো, গলার তাবিজটা অবশ্য পরমেশকে ভাল মানিয়েছিল, আয়নার সামনে দাঁড়ালে মিঠুন চক্রবর্তির মত লাগতো দেখতে। কালো সূতোয় বাঁধা তাবিজটা গলা থেকে খুলতে ইচ্ছে করেনি কিন্তু তাবিজের কারণে যদি গুলাবীর মন পালটে গিয়ে হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই ভয়ে মিঠুন চক্রবর্তি মার্কা তাবিজটাও গলা থেকে খুলে ফেলেছিল, তবে ছিঁড়ে ফেলেনি।

ওদিকে নিউ অপেরা যাত্রা দলের মধ্যেও গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছিল। গুলাবী হলো অপেরা দলের মধ্যমণি, দলের মধ্যমণি যদি এই সময় বিয়ে করে সংসারী হয়ে যায়, দলের কি হবে! মানুষ যাত্রা দেখতে আসেইতো প্রিন্সেস গুলাবীর টানে। গুলাবী দেখতে যেমন সুন্দর, গানের গলাটাও ভারী মিষ্টি। কৃষ্ণ বিহনে রাধার বিলাপ গুলাবীর কন্ঠে এমন ঢেউ তোলে দর্শকের হৃদয়ে, সারা মাঠের দর্শক চোখের জল মুছতে থাকে।

জাত কূল মানের কথা না ভেবেই পরমেশ গুলাবীকে বিয়ে করার জন্য পণ করে। বিয়ে করে বউকে কি খাওয়াবে, সেদিকও ভেবে দেখেনি। পরমেশ রোজগার করেনা, নিতীশ চক্কোত্তি মশাই এখনও প্রতিদিন ভক্তবৃন্দের কাছ থেকে যে অর্ঘ্য পান, তাতে পরমেশের আয় রোজগার না করেই চলে যাচ্ছে। তাই বলে বেকার অবস্থায় বিয়ে করে সংসারে আরেকজন সদস্য বাড়াবে, এ কেমন কথা! ঠাকুরমশাই ছেলের এই বিয়েতে কোনভাবেই রাজী নন। তাছাড়া জাত কূলের মেয়ে হলেও কথা ছিল, মুখে রঙ মেখে যাত্রা দলে নটি সেজে গান গায় যে মেয়ে, সে মেয়েকে ঠাকুরবাড়ির বউ করে আনলে ভক্তদের কাছে তিনি মুখ দেখাতে পারবেন?
ছেলে বিবাগী হয়ে যেতে পারে—এই কথা বলে বিরযাবালা দেবী স্বামীকে এমনও বলেছিলেন, “ যাত্রা দলেতো সে ঠাকুর দেবতার পালা করে, খারাপ কিছু করেনা কো। আমিও একদিন পালা দেখেছি, রাধা বিনোদিনী সেজেছিল সে, মনে হয়েছে যেন সাক্ষাৎ রাধিকা কেঁদে আকুল হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের বিরহে। মেয়ে রাধার মতই সুন্দরী”।

কোন দিকেই লাভ হয়নি। নিতীশ চক্কোত্তিও নিজের মত বদলাননি, পরমেশেরও পাগলামী থামেনি। বাপ মাকে রাজী করাতে না পেরে শেষে নিউ অপেরা যাত্রা দলের মালিকের সাথে পরমেশ এবং মায়ার কথা পাকা হয়, বিয়ে ওরা করতে পারবে তবে মায়া দল ছাড়তে পারবে না। পরমেশও ভেবে দেখলো, বাবা মা যদি এই বিয়েতে রাজী না হয়, তাহলেতো মায়াকে নিয়ে আলাদা ঘর খুঁজতে হবে। মায়া যদি দল না ছাড়ে, তাহলেতো ওর তাঁবুতেই সংসার করা যাবে।


যাত্রা দলের প্রিন্সেস গুলাবীকে বিয়ে করার অপরাধে পরমেশের বাপ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করতে চেয়েছিল, কিন্তু মরার সময় একমাত্র পুত্রের হাতে জল পাওয়ার দরকার আছে ভেবে এবং মরার পর পুত্রের হাতে মুখে আগুন পাওয়ার অদম্য লোভেই বোধ হয় পরমেশকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেনি।

সেই থেকে প্রিন্সেস গুলাবীকে নিয়ে নিউ অপেরা যাত্রা দলের সাথে আছে পরমেশ। বামুন হয়েতো আর যে সে কাজ করা চলেনা, তার লেখাপড়ার বিদ্যেও কম, স্কুলে মাস্টারিও জুটবেনা। বীরভূমের নিতীশ চক্কোত্তি মশায়ের ছেলেকে দিয়ে কেউ হাট বাজার, দোকানের কাজও করাতে সাহস পায়না, পাপ হবে যে তাহলে। সেই থেকে মায়া যাত্রার পালা করে, পরমেশ দলে বামুনের ছেলে হিসেবে অভিভাবকত্ব দেখায়।

তাঁবুর সংসারে এক বছর যেতেই মায়ার কোল জুড়ে পুত্র সন্তান এলো! আহা! কী সুন্দর চাঁদাপানা রূপ! ছেলের নাম রাখলো কৌশিক। তাঁবুর সংসারে ওদের আর পোষাচ্ছিলো না। যাত্রা দলের তো আর এক জায়গায় বসত গাড়ার উপায় নেই। সিজনে সিজনে নানা জায়গা থেকে বায়না আসে, ওরা দলবল নিয়ে সেখানে চলে যায়। ছোট শিশুকে নিয়ে এত দৌড়ঝাঁপ পোষায়না। কিন্তু ওকে কোথায় রেখে যাবে! মায়া যে অভিনয় ছেড়ে দিবে, তাহলে তিনটা প্রাণীর চলবে কি করে? পরমেশ কোন কাজ করেনা তো। একদিন পরমেশ খোকাকে কোলে নিয়ে মায়ের কাছে গেছিলো, বংশের বাতির মুখ দেখলে মা কত খুশী হবে। নাতিকে দেখে বিরযাবালা দেবী অনেক কাঁদলেন, বুকে জড়িয়ে রাখলেন। কিন্তু এর বেশী কিছু করতে পারলেন না। নিতীশ চক্কোত্তি আগেই বলে দিয়েছেন, নটি বউ ছেড়ে আসে যদি তবেই এ বাড়িতে ঠাঁই হবে। ঠাকুরবাড়িকে বেশ্যাবাড়ি বানানো যাবেনা। স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে বিরযাবালা দেবী খুব কেঁদেছেন। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেছেন, “ তুমি কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে মায়ের পূজো করো, ধূপ পুড়িয়ে মায়ের আরতি করো, বৌমাও গান গেয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ডাকেন। খারাপ তো কিছু নয়।“

বামনির কথায় বামুন ঠাকুর তেতে উঠে পা থেকে খড়ম তুলে প্রায় মেরেই বসেছিলেন, কি মনে করে সামলে নিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “ মহাপাতকী হবে তুমি। যাত্রা দলের নটির সাথে আমাকে তুলনা দিলে?”



দুই

সংসার পেতে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে পরমেশ। বাপের ঘরে থাকতে আদর আপ্যায়ন পেয়েছে, না চাইতেই গেলাস ভরা দুধ, মায়ের বুক ঘেঁষে শুয়ে ঘুম। আহা, আর এখন, একমাত্র ছেলে কৌশিকের দুধই জোগাড় হয় না, পরমেশ কোথা থেকে পাবে। দুধ ভাত বড্ড প্রিয় খাবার ছিল, সেদিনের কথা মনে পড়লে মনটায় বড্ড আফসোস হয় আজকাল। নিউ অপেরার মালিক গুনধর বাবু দয়ালু, বিচক্ষণ মানুষ। মায়ার মত সুন্দরী, সুকন্ঠী, সুঅভিনেত্রী চাইলেই সহজে মিলবেনা বুঝেন বলেই মায়াকে ওর স্বামী সন্তানসহ নিজের আশ্রয়ে রেখেছেন। সিউড়িতে গুনধর বাবুর জায়গা জমি আছে, সেখানেই ছোট করে একখানা ঘর তুলে দিয়েছেন মায়াকে, স্বামী পুত্র নিয়ে সংসার করার জন্য। নিউ অপেরা যাত্রা দলের চাহিদা এখনও খুব ভাল, সারা বছরই তারা বায়না পায়। ধারে কাছে বায়না পেলে সমস্যা হয়না, পালা শেষ হলে দলের দুই কর্মচারীকে সাথে দিয়ে মায়াকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যখন দূরে বায়না পাওয়া যায়, পরমেশকে বাড়িতে থাকতে হয় খোকাকে নিয়ে। কারণ খোকাকে সাথে নিয়ে যাত্রা দলের সাথে ঘুরতে হলে খোকা নেতিয়ে পড়ে। যে কদিন বাইরে থাকতে হয়, সে কদিনের জন্য গুনধর বাবু নাদুর দিদিমাকে মায়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বুড়ি রান্না করে, ঘর দোর ঝাঁটপাট করে, জল তুলে দেয়, খোকার কাপড় কেচে দেয়।

গুনধর বাবুর বয়েস ষাটের উপর, মায়া গুনধর বাবুকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করে। মায়ার মা বাবা মায়ার ছোটবেলাতেই মারা যায়, ভাইদের সংসারে মায়ার তেমন আদর যত্ন হতো না। কিন্তু ছোটবেলাতেই মায়ার গলায় দারুণ সুর খেলতো। ভাইদের কোন শাসন ছিলোনা, মায়া বাউলের আখরায় গিয়ে বসে থাকতো। সেখানেই ওর গানের হাতে খড়ি, সেখানেই গুনধর বাবুর সাথে দেখা। বাবু মায়াকে নিজের দলে ভর্তি করে নিলেন। সেই থেকে আজও মায়া গুনধর বাবুর ছায়ায় বাস করছে।


“ শালার লোডশেডিং কখন শেষ হবে কে জানে! গরমে সেদ্ধ হয়ে একেবারে আলুমাখা হয়ে যাচ্ছি। এঃ হেঃ সারা গা ঘামে চিটচিটে হয়ে আছে। শালার শেষ রাতটাও একটু আরাম পাবোনা!”
হ্যাঁ, আজ পরমেশের পাঁচ বছরের সংসারে শেষ রাত। পরমেশ কাল সকালেই চলে যাবে নিজের বাড়ি। মা অনেক দিন থেকেই সংবাদ পাঠাচ্ছে, পরমেশ যদি ফিরে না যায় তাহলে ঠাকুরের সম্পত্তি জামাইবাবুরা লোপাট করে দিবে। পরমেশ মায়ের একমাত্র ছেলে, মা কি করে এটা সইবেন! মা জানিয়েছে, পরমেশ যেন প্রথমে একা যায়। দুই তিন মাস থাকুক, বাপের মন মর্জি ঠান্ডা হলেই বউ আর নাতিকে নিয়ে যাবে।

মায়া রাজী হচ্ছেনা কোনমতেই, মায়ার ধারণা পরমেশ ওদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। অনেক কেঁদেছে মায়া, “ খোকার বয়স মাত্র চার, দুধের শিশু। মুখে নাক শুঁকে দেখো, এখনও দুধের গন্ধ। এই শিশুকে এভাবে ফেলে চলে যাবে?”
পরমেশ বলেছে, “ একবারে যাচ্ছিনাতো। মা বলেছে, আগে আমি যাই, দুই তিনমাস পর তোমাদের নিয়ে যাব।“
মায়া বলেছে, “ পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলেতো বাবাঠাকুরের সম্পত্তি ছাড়াই, এখানেতো মোটামুটি ভালোই আছি আমরা।“

-ভালো আছি আমরা? আমরা ভালো আছি? কি ভালো আছি? ঘরের বউ সারা রাত আসরে নাচ গান করে বেড়ায়, মাঝ রাতে ঘরে ফেরে, আর আমি শালা ন্যাবদা পুরুষ, ঘরে বসে বউয়ের জন্য ভাত তরকারী গরম করে বসে থাকি, ছেলের হিসির কাঁথা পাল্টাই, মশার কামড় খেতে খেতে হাড়মাস কালা করে ফেলছি। আমি কি পুরুষ? আমি একটা মাদী ঘোড়া।

-ছি ছি ছি, অমন করে বোলোনা, তোমার পায়ে পড়ি, ওভাবে বলোনা। ‘বাবা’ আমাদের কত যত্ন করেন, কত খেয়াল রাখেন। আমাদের কিছু ছিলনা, বাবা আমাদের পা রাখার মাটি দিয়েছেন, মাথা গুঁজবার ঠাঁই দিয়েছেন। আমি নাচ গান করি মানে কি? এটা একটা শিল্প, যাত্রা গান করি, ঠাকুর দেবতার পালা করি। খারাপ কিছুতো করিনা, পাপী তাপী মানুষ, পূজো আচ্চা করার সময় পাইনা, পালাগানের মধ্যে দিয়েই ভগবানের বন্দনা করি। রাত বিরেতে আমি কি একা ফিরি? বলাই আর নিত্য আমাকে ‘মা’ ডাকে, ওরা পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে। ‘বাবা’ আমার ভগবান, তুমিও আমার ভগবান। বাবা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তুমি কেন আশ্রয় থেকে দূরে সরে যেতে চাচ্ছো?

-দূরে সরে যেতে চাইছি মানে? যাত্রা দলের মালিক তোমার ‘বাবা, সেই বাবা তোমার কাছে বড় হয়ে গেলো আমার নিজের বাবার চেয়ে?

পরমেশের কথায় মায়া একটু চুপ থেকে খুব ধীরে ধীরে বলল, তোমার বাবা আমার পরম শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মশায়, তোমার বাবা আমারও বাবা । বাবার কাছে আমায় নিয়ে যেদিন গেছিলে, আমি প্রণাম করতে গেলাম, বাবা দুই পা সরিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, বেরিয়ে যাও, দূর হয়ে যাও। সত্যিকারের বাবা হলে যুবতী কন্যাকে বের করে দিতে পারতেননা। আর যাত্রা দলের ‘বাবা’, আমার সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই, তোমার সাথেও নেই, কিন্তু আমাকে তোমাকে মাটি দিয়েছেন। সত্যিকারের বাবা বলেই ছেলেমেয়েকে দূর করে দিতে পারেননি। আমার অপরাধ ক্ষমা করো। তুমি ফিরে যাও নিজ বাড়িতে। আমাকে নিয়ে আর খোকাকে নিয়ে চিন্তা করোনা। এখানে আমার বাবা আছেন যতদিন, আমি নিশ্চিন্ত।




তিন

কৌশিকের বয়স এখন একুশ বছর, জোয়ান তাগরা যুবক। লেখাপড়া বেশীদূর এগোয়নি, কোনমতে টুয়েলভ ক্লাস পাশ করে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। মা ছাড়া ওর জীবনে আর কেউ নেই। বাবা নামে একজন আছে এখনও, তবে কৌশিক বাবার কথা মনেও আনে না। বাবা দেখতে কেমন তাই ভুলে গেছে কৌশিক। ওর একটু একটু মনে পড়ে, বাবা মায়ের সাথে ঝগড়ার কিছু দৃশ্য। বাবা মনে হয় রাগী ছিল। বাবার নামে অবশ্য কোন খারাপ কথা মা শুনতেই চায় না। কিছু বলতে গেলেই বলে, “ খোকা, পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম”। বাবা পরম গুরু, বাবাকে খারাপ বলতে নেই।
কৌশিক জবাব দেয়, “ কেমন গুরু, চার বছরের ছেলেকে ফেলে পালিয়ে গেছে”।
-ওভাবে বলতে নেই খোকা, ভগবান রাগ করেন।
-রাখো তোমার ভগবান, ভগবান টগবান বলে কেউ নেই। আমার কাছে তুমিই হলে একমাত্র ভগবান। হ্যাঁ, বাবার নামে সত্যি কথা বললেই তুমি অবশ্য রাগ করো, সে হিসেবে ঠিকই বলেছো, ভগবান রাগ করবে।

কৌশিকের কথা শুনে মায়া হেসে ফেলে। মায়া আর কৌশিক আজও সেই বাড়িতেই আছে, তবে একটেরে ঘরের স্থানে পাকা দালান হয়েছে। পরমেশ যখন মায়াকে ফেলে চলে যায়, গুনধর বাবু মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ মা, ভয় পাস না, আমি বেঁচে থাকতে তোর ভাত কাপড়ের অভাব হবেনা। তিনি তখনই এক কাঠা জমি মায়ার নামে দলিল করে দেন। মায়া কিছু সঞ্চয় করেছিল, সেই টাকার সাথে গুনধর বাবু আরও কিছু টাকা দিয়ে তিন রুমের একখানা পাকা বাড়ি তুলে দিয়েছিলেন। পরমেশ চলে যাওয়ার পর থেকে মায়া নিজের যাত্রা পালার প্রতি আরও বেশী মনোযোগী হয়ে উঠলো। যতদূরে বায়না আসুক, মায়া রাজী হয়ে যেতো। ছোট্ট কৌশিককে সাথে নিয়ে যেতো। কৌশিকও খুব পছন্দ করতো গান বাজনা, হ্যাজাক লাইটের উজ্জ্বল আলো। দিনে দিনে মায়ের গানগুলো কৌশিক গুন গুন করে গাইতে শুরু করলো যখন, মায়া চমকে উঠলো। এই ছোট্ট ছেলে এত সুরে গাইছে কিভাবে! গুনধর বাবুও খুব অবাক হলেন। তিনি নিজে কৌশিককে নিয়ে গেলেন সঙ্গীত শিক্ষক রবি বাবুর কাছে। কৌশিক গান শেখা শুরু করলো।

কৌশিকের বয়স যখন বারো বছর, গুনধর বাবু চোখ বুজলেন। মায়া অথৈ জলে পড়ে গেলো। কারণ গুনধর বাবুর পরিবারের সদস্যদের কেউ নিউ অপেরা যাত্রা দলের দায়িত্ব নিতে চাইলো না। বন্ধ হয়ে গেলো এত বছরের নামকরা যাত্রা কোম্পানী নিউ অপেরা যাত্রা দল। দল ভেঙ্গে একেক জন একেক জায়গায় চলে গেলো। কৌশিক নিয়মিত গানের শিক্ষকের কাছে যেতো, সেই নিয়মে বাধা পড়লো। দুই মাস শিক্ষকের বেতন দিতে পারেনি বলে রবি বাবু কৌশিককে কিছুদিন বাড়িতে বসে গানের চর্চা করতে বললেন, অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলে দিলেন, বিনে পয়সায় আমি গান শেখাবোনা।

সে এক বিষম অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো ওরা। মা ঠোঙ্গা বানানোর কাজ শুরু করলো, আর খোঁজ নিতে লাগলো ধারে কাছে যাত্রা দলে কোন পাঠ পাওয়া যায় কিনা। কৌশিক একদিন বলেছিল, “ মা , চলো আমরা বাবার কাছে যাই”।
মা সিঁথি ভর্তি করে সিঁদুর দেয়, কপালে বড় করে টিপ পড়ে, হাতে শাঁখা আছে। তবুও মা বলল, “ নারে বাবা, ওটা তোর বাবার বাড়ি, ওখানে আমাদের জায়গা দিবেনা”।

-মা, বাবা যদি তোমাকে বাবার বাড়িতে জায়গা না দেয়, তাহলে তুমি কেন তার পরিচয়ে মাথায় সিঁদুর দাও?

-এ কেমন কথা খোকা? ওভাবে বলতে নেই, ভগবান রাগ করবেন, অমঙ্গল হবে।
-মা, বার বার বলেছি, ভগবান বলে কেউ নেই, তুমিই আমার ভগবান। অমঙ্গল হবে কেন? আমরা যেমন আছি, এর চেয়ে বড় অমঙ্গল আর কি হতে পারে?

-তবুও বাবা, মাথা ঠান্ডা রাখ। না খেয়েতো নেই, দু বেলা দুটো ভাত জুটে যাচ্ছেতো। তবে কেন হাত পাততে যাব?
-মা, মাস্টার মশাই আমাকে আর গান শেখাবেন না।
-খোকা, তুই ঘরে রেওয়াজ কর। মাস্টারমশাই যা শিখিয়েছেন এতদিন, তুই সেগুলোই রেওয়াজ করে যা। গলা তৈরী হোক, মা সরস্বতীর আরাধনা করো, জীবন অনেক লম্বা, একদিন ঈশ্বরের দেখা পাবে।
-মা, ঈশ্বর গরীবকে দেখা দেন না। মাস্টারমশাই মাত্র দেড়শ টাকার জন্য আমাকে মানা করে দিল!

-ঠিক আছে, আমি তোর বাবাকে খবর দেই। তিনি যদি সাময়িক তোর গানের টিচারের বেতন দিয়ে দেন, তাহলে চিন্তা কি।

খবর পেয়ে পরমেশ এসেছিল। এ কথা সে কথার পর মায়া বলেছিল, “ ‘বাবা’ চলে যাওয়ার পর দলটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠোঙ্গা বানিয়ে খোকা আর আমি কোনমতে চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু খোকার গানের ক্লাস বন্ধ, দু মাস বেতন দেয়া হয়নি। তুমি কি মাসে দেড়শ টাকা দিবে খোকার জন্য? লেখাপড়ায় মাথা নেই, সেই যে ছোটবেলায় একবার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল, তখন ব্রেইনটা দূর্বল হয়ে গেছে। তাই যদি গানটাই ভাল শিখতে পারে---

-গান শেখার দরকার নেই। ও কি কিশোর কুমার হবে নাকি? লেখাপড়াও করলোনা, মানুষ বানাতে পারলেনা। কোন কারখানায় কাজে ঢুকে পড়ুক।

-তা নাহয় কাজে ঢুকলো, কাজের সাথে গানটাও যদি শিখতে পারে, তুমি দেড়শ টাকা মাসে দিলেই হয়ে যাবে।

-আমার পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব হবেনা। ছোট বউ আবার পোয়াতি, দুটো মেয়েতো আগেই বিইয়েছে—
-ছিঃ, এত বিচ্ছিরি করে কথা বলো কেন?
-ওহো, ভুলেই গেছিলাম, তুমিতো আবার একট্রেস, তোমার সামনে সাবধানে কথা বলা উচিৎ ছিল। যাকগে, দেখো যদি কারখানায় ছেলেকে ঢুকাতে চাও জানিও, আমি বাসুদেবকে বলে দেব।


কৌশিক আর কোথাও যায়নি, সকাল সন্ধ্যে নিজের ঘরেই রেওয়াজ করেছে। ভোরে মা ঘুম থেকে ডেকে দিয়েছে, কৌশিক বাইরের উঠোনে গিয়ে গলা ছেড়ে সা রে গা মা সেধেছে।ফের ঘরে বসে গলা সেধেছে। রক গানের প্রতি ওর খুব নেশা। গত পূজোয় মায়া ওকে ছোট একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে দিয়েছিল। দুই একটা রক মিউজিকের ক্যাসেট জোগাড় করে ঘরে বাজিয়েছে আর সাথে সাথে নিজেও গেয়ে প্র্যাকটিস করেছে। একদিকে স্কুলের পড়া চালিয়েছে, অন্যদিকে গানের চর্চা। এভাবেই একসময় খুব সাধারণ রেজলাট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ফেলে।

তিন বছর আগে শহরের এক হোটেলে গান গাওয়ার চাকরি পেয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় হোটেলে যায়, রাত তিনটে পর্যন্ত গান বাজনা চলে, এরপর ও বাড়ি ফিরে আসে। এখন মোট তিনটি হোটেল থেকে ডাক আসে, কৌশিক রক গান এত ভাল গায় যে হোটেলে আসা গ্রাহকগণ কৌশিকের গান শুনে পাগল হয়ে যায়।

এবছরই গোড়ার দিকে হোটেল দখিনার শ্যাম দাদা কৌশিককে বলেছিল, “ শোন, তুই সামনেই তারা টিভির গানের পাখি কমপিটিশানে নাম দিবি। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

-কৌশিক বলেছে, কী বলছো দাদা, আমি গানের পাখি অডিশন রাউন্ডেই ছিটকে যাব। ওখানে কত ভাল ভাল গাইয়েরা আসে, আমিতো তেলাপোকা।

-যা বলেছি, তাই করবি।

মায়া শুনে বলেছে, বাবা এত ভয় পাস কেন? লেখাপড়া এগোলোনা, তুই গান ভালোবাসিস, গানটাতেই মন রাখ।
-মা, গরীবের শখ বলে কিছু থাকতে নেই।
-তুমি গরীব কে বলেছে? ভগবান তোমার কন্ঠে এত সুর দিয়েছেন, তুমি কত ভালো গাও

-উফ মা, সারাক্ষণ শুধু ভগবান ভগবান করো। তোমার ভগবান আমায় কি দিয়েছে? কিছুই দেয়নি। ভগবান কে? ভগবান কোথায় থাকে? আমাকে বলো তুমি। কষ্ট করছি আমি, বছরের পর বছর শীত গ্রীষ্ম বারোমাস ভোরে উঠে গলা সেধেছি, দুখানা ক্যাসেট বার বার শুনে শুনে গান রপ্ত করেছি, তিন নাম্বার ক্যাসেট কেনার পয়সা যেখানে ছিলনা আমাদের, সেখানে ভগবানকে ক্রেডিট দিয়ে লাভ কি?

-বাবা, অমন বলেনা। এই যে শ্যাম তোকে দিয়ে তারা টিভির গানের কমপিটিশনে গাওয়াতে চাইছে, এটাও ভগবানের ইশারা। শ্যামের কি দায় পড়েছে বল, তোর জন্য ভাবতে।


প্রথম অডিশনে কৌশিক খুব সহজে পাশ করেছে, দ্বিতীয়, তৃতীয়তেও তাই। চতুর্থ অডিশন ছিল শ্রীরামপুরে, কৌশিক ভয় পেয়ে গেলো। গত কয়েক অডিশন রাউন্ডে দেখেছে , শত শত পার্টিসিপ্যান্ট এসেছে, তাদের মধ্যে একমাত্র ওই গরীব, ভালো করে গান শেখার সুযোগও পায়নি। শ্রীরামপুরে যে কি হবে, তা ও ভাল বুঝতে পারছে। সেদিন ও ঘরেই ছিল, শ্যাম দত্ত বাড়ি বয়ে এসে খোঁজ নিলো, কৌশিক কোথায়। এরপর আর ঘরে থাকা গেলোনা। কৌশিক শ্রীরামপুর অডিশনেও পাশ করলো।


আজ তারা টিভির গানের পাখি অনুষ্ঠানে ফাইনাল অডিশন রাউন্ড। কৌশিকই প্রথম পার্টিসিপ্যান্ট। আজ মায়া সাথে এসেছে, ছেলেটার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। সারাপথ মায়া ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, বলেছে, “ খোকা উপরে ভগবান, নীচে আমরা। ভয় পাবিনা, তুই পারবি”।

কৌশিকের নাম ডাকতেই কৌশিক ডায়াসে গেলো। ও গাইলো,
“ এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো
এ কেমন কান্না তোমার আমায় যখন আদর করো”।

কৌশিক রক গান গায়, কোউশিকের কন্ঠে এই গান শুনে মায়ার শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। খোকা এই গান গাইছে! এত সুন্দর গাইছে! বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিল মায়া, মায়ার দুই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। ডায়াসে গান শেষ হতেই কৌশিকের উপর কাগজের ফুলঝুরি পড়তে লাগলো। বিচারক মন্ডলিতে ছিলেন পাঁচ জন ডাকসাইটে সঙ্গীত তারকা। তাঁরা আসন ছেড়ে ছুটে এলেন, কৌশিককে জড়িয়ে ধরলেন।



গানের পাখি রাউন্ডের পর রাউন্ড চলছে, কৌশিকের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। পঞ্চম রাউন্ডে কৌশিক গাইলো মাইলসের আইয়ুব বাচ্চুর গান, “ তুমি কেন বুঝোনা তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়”---- চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন সুরকার জিত গাঙ্গুলী। তিনিও প্রচুর রক গানের কম্পোজার। তিনি ঘোষণা দিলেন, তাঁর পরের ছায়াছবিতে টাইটেল সং কৌশিককে দিয়ে গাওয়াবেন।



গানের পাখির দশম রাউন্ড হচ্ছে আজ। কৌশিক এখন সকলের কাছে প্রিয়। আজ দারুণ একটা রোমান্টিক গান গাওয়া শেষ করতেই হোস্ট প্রমিত সকলকে জানালো, গত সপ্তাহে কৌশিক ‘আরজু’ ছবির টাইটেল সং গেয়েছে। পেছনে পর্দায় দেখানো হচ্ছিলো কৌশিক এবং তার মায়ের আবেগময় নানা মুহূর্তের ছবি।

কৃতজ্ঞতা জানানোর সময় কৌশিক শুধু বলল, “ আজকের এই আনন্দমুখর দিনে আমি কোন দুঃখের কথা বলবো না। আমার জীবনের দিনগুলি কিভাবে কেটেছে তা নাই বললাম, এটুকু বলি, যখনই ভেঙ্গে পরতাম মা বলতো, “ ভগবান আছেন, ভগবানকে স্মরণ করো”।
আমি মায়ের কথা পাত্তা দিতাম না। মাকে ঝাঁঝিয়ে বলতাম, “ ভগবান বলে কেউ নেই”। বলতাম কারণ আমি ভগবান দেখিনি, ভগবান দেখতে কেমন হয় জানতাম না। আজ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, “ আমার জীবনে ভগবান হিসেবে অনেককে পেয়েছি। প্রথম ভগবান আমার মা, দ্বিতীয় ভগবান আমাক যিনি গানের পাখিতে আসতে উৎসাহ দিয়েছেন সেই শ্যাম দাদা, তৃতীয় ভগবান আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন, জিত গাঙ্গুলী স্যার। আজ বলতে ইচ্ছে করছে, ভগবান ভগবান খুঁজি কোথায়, তাকিয়ে দেখি, ভগবান হেথায়”।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বাবুল আক্তার সিনেমা বানানো সম্ভব। সুন্দর লিখেছেন।
আহা রুবন একটু বড় হলেও মনযোগ দিয়ে পড়েছি। অবশ্য দিদি এমনই লেখেন। হ্যাঁ এমন কাহিনী নিয়ে গল্প-সিনেমা হতেই পারে। ভাল! ভোট দিলাম।
সিনেমা তোঁ জীবনেরই চিত্রনাট্যরূপ।
আফরিন সিদ্দিকা সুন্দর, ভোট রইল।
অনেক ধন্যবাদ আফরিন।
কাজী জাহাঙ্গীর কেন জানি না দিদির গল্প গুলো বেশ সিনেমাটিক সিনেমাটিক মনে হয়। বাংলাদেশে জাফর ইকবালের সাদা কালো ‘নয়নের আলো’ থেকে একালের ‘ভাই বন্ধু’ আর কলকাতায় উত্তম কুমারের ‘শাপ মোচন’ থেকে একালের তাপস পাল’র ‘গুরু দক্ষিণা’ সব এরকম গান কে উপজীব্য করে কাহিনী। আর ইন্ডিয়ান আইডল এর আন্নু মালিক যেভাবে আর পরবর্তী ছবিতে গান গাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দেন ঠিক সেরকম লাগল। তবে বর্ণনায় বেশ পটুতার ছাপ আছে। অপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ জাহাঙ্গীর ভাই। সত্যি খুব ভালো লাগলো আপনি গল্পটি পড়েছেন এবং কমেন্ট করেছেন দেখে। আমার লেখা গল্প সিনেমাটিক মনে হয়, এ যে আমার কত বড় পাওয়া! তার মানে চেষতা করলে আমি চিত্রনাট্য লিখতে পারবো। তবে কি জানেন, আমি সিনেমা দেখিনা, যে সিনেমাগুলোর নাম বলেছেন, একটাও দেখা হয়নি। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কড়া শাসন ছিল, সিনেমা দেখা হতোনা। কাজেই সিনেমার গল্পের অভিজ্ঞতা ছাড়াই সিনেমাটিক গল্প লিখতে পারা, দারুণ কমপ্লিমেন্ট! এবার মূল কথায় আসি, আমি যখন যে গল্প লিখি, সবগুলো সত্যি কাহিনী অবলম্বনে। এই গল্পটিও সত্যি কাহিনী। যদি ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখায় আপত্তি নাথাকে, তবে জি বাংলা সা রে গা মা পা এবছরেরটা দেখবেন। কৌশিককে পেয়ে যাবেন, অন্য নামে। জিত গাঙ্গুলীও আছেন। এখনও মুক্তি পায়নি নতুন ছবিটি, তার টাইটেল সং কৌশিক গেয়েছে। ছবির নাম 'চ্যামপ'। ভালো থাকবেন।
Jasim Ahmed গল্পটা পড়ার আগেই ভোট দিয়েছি, ভোট দেয়ার পর পড়ে মনে হলো ভোট দেয়া সার্থক হয়েছে। অসাধারণ গল্প।
অনেক ধন্যবাদ জসিম।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী বাহ! খুব চমৎকার লিখেছেন!! অনেক অনেক ভালো লাগলো। আর্শীবাদ ও ভোট রইলো।
প্রথম দিনেই এত সুন্দর আশা জাগানিয়া কমেন্ট পেলাম সিদ্দিকী, কী যে আনন্দ হচ্ছে!

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪