আই হেট ইউ!

ঘৃনা (আগষ্ট ২০১৫)

রীতা রায় মিঠু
আই হেট ইউ!

কাজ থেকে আজ একটু আগেই বেরিয়েছে রুমা, বাইরে অসম্ভব গরম, গায়ে ফোস্কা পড়ার মত অবস্থা। গাড়ি সারাদিন কে- মার্টের বিশাল পার্কিং এরিয়ায় রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা হয়েছে, গাড়ির ভেতর ঢুকতেই রুমার চোখ মুখ জ্বালা করে উঠলো। এসি অন করে দিয়েছে ঠিকই, এসি মেশিনে ফ্রিওন কমে গেছে বোধ হয়, সহজে ঠান্ডা হতে চায় না গাড়ি। রুমা গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে, তবে গাড়ি সার্ভিসিং, টায়ার বদলের কাজগুলোর জন্য ওকে নাসিমের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করতে হয়। মেজাজ ভাল থাকলে নাসিম এসি ঠিক করিয়ে আনতো, নাসিমের মেজাজ ভালো নেই। রুমার সাথে প্রতিদিন ঝগড়া চলছে।

মেজাজ রুমারই কি ভাল থাকার উপায় আছে? বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ক’দিন রুমার মন মেজাজ ভাল ছিল? আমেরিকাবাসী পাত্রের সন্ধান পেয়ে সুন্দরী বোনটাকে ভাইয়েরা সেই যে বেড়াল পার করে দিল, ভাইদের কেউ কি পাত্রের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে? উঠ ছেঁড়ি তোর বিয়া লাইগাছে’ বলে রুমাকে বিয়ে দিয়ে দিল, রুমা বুঝতেও পারলোনা বিয়ে কি জিনিস, বিয়ে আনন্দের নাকি দুঃখের। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে রুমা, বাপ মরা মেয়ে ভাইদের ঘাড়ে বোঝা হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেলো।

বিয়ের সাত দিনের মাথায় রুমাকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে নাসিম আমেরিকা চলে এসেছিল, রুমার দেহ মন থেকে লজ্জা, আড়ষ্টতা কাটেনি তখনও। নাসিমের সাথে মন খুলে কথা বলা হয়নি, সবাই বিয়ের পর হানিমুন করে, রুমার হানিমুনও হয়নি। আমেরিকান বর, বাসর ঘরে রুমা ভয়েই কাতর ছিল।

“ তোমার সাথে বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি, আমার মা’কে খুশী করতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে”---কথাটা যখন নাসিম বলল, রুমা কিছুই না বুঝে যন্ত্রচালিতের মত মাথা ঝুঁকিয়ে ‘আচ্ছা’ বলেছিল। রুমার ভয় করছিল, ছেলের অমতে বিয়ে করিয়েছে মা, কাল সকালেই যদি ছেলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে! রুমা চাইছিল, নাসিমকে আর বেশী না রাগাতে। সত্যিইতো, এই মানুষটার তো দোষ নেই, তার মা জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলে সে কী করে মায়ের কথা অমান্য করবে?

বাসর রাতে ওদের দুজনের মধ্যে আর কোন ভালোবাসার কথা হয়নি। দুই দিন পর ঘুমের ঘোরে অথবা রুমার রূপের মোহে আকৃষ্ট হয়ে নাসিম রুমাকে আদর সোহাগ করেছিল। আঠারো বছরের তরুণী আমেরিকা ফেরত ছেলের বুকের ভেতর লেপ্টে থেকে ভাবছিল, আহারে! কত ভালো মানুষটা, মা জোর করে বিয়ে করিয়েছে, তবুও রুমাকে কত আদর করছে।

পরের রাতে আদর সোহাগে গলে রুমা জিজ্ঞেস করলো, “ আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?”
নাসিম বলেছিল, “আমাকে তুমি পাবেই কতক্ষণ যে ডাকাডাকি করবে? আমি চলে যাচ্ছি।”
রুমা সাথে সাথে সাবধান হয়ে গেছে, আবারও মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছে, ‘আচ্ছা’।
নাসিম বলল, “ শোন রুমা, চারদিন পরেই আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। তোমাকে একটি সত্যি কথা বলি, আমেরিকায় আমার গার্ল ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম মনিকা, মনিকাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। মা আমাকে মিথ্যে কথা বলে দেশে এনেছে, এরপর জোর করে তোমার সাথে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমি ফিরে গিয়েই আবার মনিকার সাথে থাকবো। আমি কিন্তু তোমার কাছে ্কিছুই লুকালাম না।“

রুমা জিজ্ঞেস করলো, “ মনিকা ম্যাডাম কি খুব সুন্দর?”

নাসিম ফিক করে হেসে দিল, “মনিকা সুন্দর, তবে তোমার কাছে কিছুই না, তুমি খুব সুন্দর, আমার মায়ের পছন্দ ভাল। কিন্তু মনিকার সাথে আমার সম্পর্ক সাত বছর যাবৎ, ওকে ছাড়তে পারবোনা। আচ্ছা, এই কথা জানার পরও কি তোমার ইচ্ছে করবে আমেরিকা যেতে? আমি কিন্তু কাগজ পত্র সব পাঠাতে পারি, তুমি যাবে কিনা বলো।

রুমার খুব ভয় করছিল, এখন যদি মানুষটা বলে, “তোমাকে আমেরিকা নেয়া যাবেনা, তাহলে ভাইয়ারা ওর দোষ দিবে”। ঢোঁক গিলে রুমা বলল, “ আপনি যদি আমাকে আমেরিকা না নেন, তাইলে আশেপাশের মাইনষে আমার নামে বদনাম দিবে। আমার এই বয়স পর্যন্ত কেউ আমার নামে একটাও খারাপ কথা কইতে পারে নাই। এবার বলবে”।

“ আই অ্যাম রিয়েলি সরি রুমা। আচ্ছা, ভেবোনা, আমি গিয়ে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব, তুমি কিন্তু জানলে মনিকার সাথে আমার সম্পর্কের কথা”।
-চিন্তা করবেননা, এই কথা আমি কাউকে বলবোনা।
-রুমা, এত কথা শোনার পর আমাকে তোমার ঘেন্না করছেনা?
-জী না, মানুষকে আমি ঘেন্না করিনা। আপনি কোন অন্যায় করেন নাই, প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে অন্যায় নাই, আপনার মায়ের উপর রাগ পুইষা রাইখেননা, সবই আমার কপালের লিখন।


নাসিম আমেরিকা ফিরে যাওয়ার পরের তিন বছরে রুমা বি এ পাশ করেছে, নাসিম যদিও রুমার ভিসার জন্য কাগজপত্র পাঠিয়েছে, রুমার ভিসাও হয়েছে, তবুও নাসিম তিন বছরে রুমার খরচের টাকা পাঠায়নি। রুমার সাথে ফোনে একটিবারের জন্যও “ আই লাভ ইউ” বলেনি।
আমেরিকা আসার আগে মা’কে জড়িয়ে কয়েকদিন ঘুমিয়েছে রুমা, মায়ের শরীরের গন্ধ একেবারে নিজের সারা গায়ে মাখামাখি করে নিয়েছে, যেন মা’কে দেখতে ইচ্ছে করলে, মায়ের জন্য কান্না পেলে নিজের হাত শুঁকে মায়ের গন্ধ নিতে পারে। ভাইদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে, ভাইয়েরা বুঝতেও পারেনি তাদের উপর অভিমান করে রুমা চলে যাচ্ছে। শাশুড়িকে সালাম করার সময় রুমা একটুক্ষণের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল, দ্রুত তা সামলেও নিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের সকলেই রুমার সৌভাগ্য নিয়ে কত ইশারা ঠিশারা করে কথা বলেছে। সব কিছুকে পেছনে রেখে রুমা সতেরো বছর আগে চলে আসে আমেরিকা।

আমেরিকার মাটিতে পা দিয়ে রুমার মনে হয়েছিল, তিন বছর পর রুমাকে দেখবে নাসিম, বোধ হয় অফিস থেকে কয়েক দিন ছুটি নিয়েছে, বিয়ের পর হানিমুন হয়নি, রুমার কত শখ ছিল হানিমুনে যাবার। নিশচয়ই রুমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে সুন্দর কোন জায়গায়, রুমা জানে আমেরিকায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে।
রুমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসার পর নাসিম বলেছিল, “ ইয়ে, তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত, তুমি জামাকাপড় পালটে একটু খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দাও। আমি বরং অফিসে যাই, সন্ধ্যার সময় চলে আসবো”।
মা-ভাই, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের কোন দূরে রেখে রুমা এসেছিল স্বামীর কাছে, আর স্বামী কিনা রুমাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে এভাবে একা রেখে চলে যাচ্ছে অফিসে? রুমা মানুষকে ঘেন্না করেনা, কিন্তু আজ নাসিমকে ঘেন্না করলো, মনে মনেই ঘেন্না করলো, এক দলা থুতু নাসিমের মুখের উপর ছুঁড়ে দিল। নাসিম তা দেখতে পেলোনা, নাসিম শুধু দেখলো বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটি কেমন চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।




দুই

ক’দিন থেকেই মনটায় অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একমাত্র সন্তান রুবাবাকে নিয়ে অশান্তি, রুবাবার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। এত অস্থির মন নিয়ে হাইওয়েতে গাড়ি চালাতেও ভয় লাগে। গত পরশু স্পীডের কারণে পুলিশের টিকেট পেয়েছে, আনমনা হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল রুমা, স্পীড কখন উঠে গেছে খেয়াল করেনি। রুমার কপালটাই খারাপ, এর চেয়েও অনেক বেশী স্পীডে কত গাড়ি পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ছুটে যায়, তাদেরকে পুলিশ টিকিট দেয়না, টিকিট দেয় রুমার মত পোড়াকপালিকে। টিকেটে কত জরিমানা করেছে তা এখনও জানা হয়নি, আর কয়দিন পরেই মেইল আসবে। মেইলেই সব হিসেব নিকেশ দেয়া থাকবে। মেইল নাসিমের চোখে না পড়লেই হয়, নাসিম জানতে পারলে সমস্যা হবে।

আজ রুমা গাড়ির স্পীডোমিটারের দিকে কড়া নজর রেখেছে। জীবন কত বিচিত্র, কোথাকার এক ছোট্ট পাড়া গাঁয়ের মেয়ে রুমা, বাপ মরা মেয়ে রুমা, মা-ভাইয়ের আদরের কন্যা রুমা, আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। রুমার একটু হাসি পেলো কি!
রুমার মেয়ে বাবা-মায়ের উপর রাগ করে ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে, মেয়ের স্কুলের প্রিন্সিপাল সেদিন রুমাকে ডেকে বলেছে, সন্তানের প্রতি সজাগ দৃষ্টি না রাখতে পারলে রুমার মেয়েকে ওরা নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিবে।
রুমা আবার একটু হেসে ফেললো কি! হাসলো ঠিকই, অসহায়ত্বের হাসি। মা’র পোড়েনা মাসির দরদ এদের। মা যত্ন নিতে পারেনা মেয়ের, ওরা যত্ন নিবে। “নিয়ে যাও, নিয়ে খুব যত্ন করো, বিশাল মানুষ বানিয়ে দাও, আমি রুবাবার মা নই, আমি রুবাবার কেউ নই, আমি পারছিনা মেয়েকে মানুষ করতে, তোমরাই মানুষ করে দাও”।
রুমার দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে, এখন রুমা হাসছেনা, এখন রুমা কাঁদছেওনা, চোখের জলের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ নেই তাই জল বেরিয়ে যাচ্ছে শুধু।

বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর পার্কিং লটে ঢুকে গেলো রুমা। ছত্রিশটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ছত্রিশটি পার্কিং আইল। রুমা আঠারো নাম্বার পার্কিং আইলে গাড়ি পার্ক করে সাথে সাথে নামলোনা, স্টিয়ারিং পার্কিং এ দিয়ে চুপ করে বসে থাকলো। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে আলতো করে চোখের জলের দাগ মুছে ফেললো। নাহলে আবার সেদিনের মত কে কোথা দিয়ে দেখে ফেলবে, শুরু করবে গাড়ির জানালায় টুক টুক, “ হেলো ম্যাম, এনি প্রবলেম? নিড হেল্প?” রুমা চায় না আর কেউ ওর দুঃখগুলো জানুক। কারো কাছ থেকেই করুণা নিতে চায় না, ঘেন্না ধরে গেছে এই জীবনে।

রুবাবার স্কুল বাস আসবার সময় হয়েছে, রুমা দেখতে চায় বাস থেকে রুবাবা একা নামে নাকি সাথে আর কেউ নামে। দিন তিনেক আগে চব্বিশ নাম্বারের মিস থম্পসন রুমাকে হাত ইশারায় কাছে ডেকে বলেছিল, “ তোমার মেয়েকে আজ দেখলাম সিন্ডির সাথে। সিন্ডি খুব বাজে মেয়ে, ওকে আমি চিনি। মেয়েকে সিন্ডির সাথে মিশতে দিওনা”।
সিন্ডি কে, রুমা চিনে না।
মিস থম্পসন বলল, সিন্ডির মা ড্রাগ ব্যবসা করে, চোরাই মাল বিক্রি করতে গিয়ে কয়েকবার জেলে গেছে। সিন্ডির বাপ কে তা সিন্ডি জানেনা। সিন্ডিও খুব বেশী সুবিধার নয়।

রুবাবাকে নিয়ে রুমা ভীষণ অশান্তিতে আছে। দিন পনেরো আগে রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপাল রুবাবার পেরেন্টসকে ডেকেছিল। রুমাকে একা যেতে হয়েছিল, নাসিম যায়নি প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে। নাসিম রুবাবাকে সহ্য করতে পারেনা। নাসিম চায়নি রুবাবা জন্মাক, আমেরিকা আসবার দেড় মাসের মাথায় রুমা কনসিভ করেছিল, নাসিম বলেছিল এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়ার দরকার নেই। ক্লিনিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল অ্যাবর্ট করাতে। ক্লিনিকে গিয়ে সব হারাতে মন সায় দেয়নি রুমার, তাই বলেছিল, “ আমাদের প্রথম সন্তান আমাদের কাছে আসছে, আমরা ওকে আসতে দেবোনা কেন?”
নাসিম হিসহিস করে বলেছিল, “ তোমারে সাথে নিয়া ঘুমাই, আদর সোহাগ করি, এর চেয়ে বেশী আর কিছু চেয়োনা। দেশ থেকে আসার সময় বেশী করে পিল নিয়ে আসতে পারোনি?”

একুশ বছর বয়সটা খুব স্পর্শকাতর, নিজের দেয়া প্রাণ কেউ মেরে ফেলতে চায়, পাষন্ড ছাড়া? একুশ বছরের রুমা ঘাড় বাঁকা করে বলেছিল, “ আমাকে পাশে নিয়ে শোও কারণ আমি তোমার স্ত্রী, আমার গর্ভে যে ঘুমাচ্ছে, সে তোমার দেয়া প্রাণ, তুমি দিয়েছো আমি গ্রহণ করেছি। গ্রহণ করেছি যাকে তাকে ফেলতে পারবোনা।“

নাসিম বলেছে, “ নাটলের সংলাপ শোনাবে না, ঠিক আছে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনদিন আমার সাথে কথা বলবেনা। মা হওয়ার শখ হয়েছে, নিজ দায়িত্বে মা হবে, আমাকে জড়াবেনা”।

আহা! কী সব দুঃসহ বেদনার দিন রাত পার করে রুমা আজ এখানে পৌঁছেছে। রুবাবার বয়স ষোল বছর, ওর বাবা ওকে কোনদিন কাছে ডাকেনি, ‘মা’ বলে ডাক দেয়নি। কোথাও বেড়াতে নেয়নি, ছোট্ট রুবাবা কতদিন বাবার হাত ধরে বায়না করেছে, ‘বার্বি কিনে দাও, মিনি মাউস কিনে দাও, সিনডেরেলা কিনে দাও” বলে। নাসিম ছোট্ট রুবাবার হাত সরিয়ে দিয়েছে।


তিন

রুবাবার স্কুল থেকে ফোন এসেছিল সেদিন, প্রিন্সিপাল রুবাবা সম্পর্কে ওর পেরেন্টসের সঙ্গে কথা বলতে চায়। রুবাবার পেরেন্টস বলতে একমাত্র রুমা। নাসিম কন্যার ভালোমন্দ কোনো কিছুতেই উৎসাহ দেখায় না। নাসিমের একটাই কথা, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান চাই নাই, তোমার শখ হইছে মা হওয়ার, তা হইছো। এখন মাতৃত্ব দেখাও। মেয়ের ভালোমন্দ নিয়া আমার কোনো চিন্তা নাই। তোমার মেয়ে তুমি বুঝবা।’

রুমা অবাক হয়ে ভাবে, কোনো বাবা এভাবে কথা বলতে পারে? রুমা কি ইচ্ছে করে মা হয়েছে? রুমা আমেরিকা আসার পরে বিছানায় বেহুঁশের মতো আচরণ কে করেছিল? রুমা, নাকি নাসিম? বাচ্চা কনসিভ করার পর যদি বলা হয়, বাচ্চা নষ্ট করতে হবে, কোনো মেয়ে পারে- হাতে ধরে পেটে আসা সন্তানকে মেরে ফেলতে? নাসিম অনেকবার বলেছিল অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতে, রুমা রাজি হয়নি। সেই থেকে নাসিম রুমার ওপর গোসা। রুমার পর গোসার ঝাল মেয়েটার ওপর ফলায়।

রুবাবাকে নাসিম কোনোদিন কোলে তোলেনি, আদর করেনি, একটা খেলনা পর্যন্ত কিনে দেয়নি। ছোট্ট রুবাবা তার বাবার কোলে যাওয়ার জন্য কত কান্নাকাটি করত, নাসিম বাচ্চার হাতটাও ছুঁয়ে দেখত না।

বাবার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই রুবাবা বড় হয়েছে, ওর বয়স এখন ১৬ বছর, দেখতে ফুটফুটে সুন্দর হলে কী হবে, স্বভাবে কিছু পাগলামি আছে। নাইনথ গ্রেডে পড়ে, স্কুল থেকে প্রায়-প্রায়ই কমপ্লেইন আসে। বাবা-মাকে ডাকা হয়। বাবা যায় না, মা যায়। কাউন্সেলর রুমাকে বলে দেয় রুবাবার প্রতি আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে। রুবাবা নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রুমা বুঝে উঠতে পারে না, রুবাবা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রুমা ওকে যথাসাধ্য যত্নে বড় করছে।




সেদিনই প্রথম জানতে পারলো রুমা, রুবাবা ক্লাসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে, বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। রুবাবা বন্ধুদের ‘এফ’ ওয়ার্ডে গালি দেয়। স্কুলে ‘এফ’ ওয়ার্ড, ‘বি’ ওয়ার্ড বলা নিষিদ্ধ। বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে গালি দেয়ার অভিযোগের পাশাপাশি এটিও বলে দেয়, রুবাবার ফ্যামিলিতে অশান্তি, রুবাবার পেরেন্টস খুবই নিষ্ঠুর, ওরা রুবাবার টেক কেয়ার করে না। তাই তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে, সব সময় তার ইচ্ছে করে সুইসাইড করতে। সঙ্গে করে রুবাবা ব্লেড নিয়ে আসে। মাঝে মাঝেই ব্লেড দিয়ে টেনে টেনে হাতের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলে। রক্ত বের হলে নাকি ওর মাথা ঠান্ডা হয়।

প্রিন্সিপাল রুবাবাকে ডেকেছিলেন, রুবাবার সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, রুবাবা নীরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ও জানিয়েছে, ওদের বাবা-মায়ের মধ্যে একটুও মিল নেই। বাবা কখনো রুবাবাকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে না। বাবা চায়নি, রুবাবা পৃথিবীতে আসুক। মা জোর করে রুবাবাকে এই বাজে পৃথিবীতে এনেছে। এখন তাকে নিয়েই বাবা-মা ঝগড়া করে। রুবাবার কারণেই ওর মাকে ওর বাবা প্রায়ই পেটায়। তার বাবা যখন ওর মাকে পেটায়, পাশের ঘরে বসে বসে রুবাবা তখন ব্লেড দিয়ে ওর হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা করে। রুবাবা এও জানিয়েছে, ওর বাবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে, সেই গার্ল ফ্রেন্ডের ঘরে ওর বাবার একটা ছেলে আছে, ছেলেটাকে রুবাবা দেখেছে। দশ-বারো বছর বয়স ছেলেটার। রুবাবা নিজের চোখে দেখেছে, ছেলের হাত ধরে ওর বাবা আইসক্রিম পার্লারে ঢুকেছে। রুবাবা এই পৃথিবীতে আর থাকতে চায়না, ও এই পৃথিবীটাকেই হেইট করে। মা’কে হেইট করে, বাবাকে হেইট করে, বন্ধুদের হেইট করে সবাইকে হেইট করে।

প্রিন্সিপাল যখন এসব কথা বলছিল, রুমা বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও অভিযোগের প্রায় সবটুকুই সত্য। রুমাকে নাসিম প্রায়ই মারধর করে। এক বিছানায় ওরা ঘুমায় না অনেক কাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রুমা চায়, নাসিমের পাশে শুতে, নাসিম তা পছন্দ করে না। একদিন নাসিম এমন কথাও বলেছে, ‘তুই যে আমার সঙ্গে শুইতে চাস, কেন চাস? আদর-সোহাগ পাওয়ার জন্য? শরীরের দিকে খেয়াল করছোস? যার বুনির চেয়ে পেট বড়, তারে দেখলে কোন বেটার শরীর জাগবো?’

সেই থেকে রুমা আর কখনো নাসিমের বিছানার ধারেকাছেও যায়নি। তবে রুমা এটাও জানতে পারেনি ওর প্রাণের ধন, মায়ের অপমানের শোধ নিজের ওপর দিয়ে তুলছে। প্রিন্সিপালের উপস্থিতিতেই রুমা দেখল, রুবাবার ফরসা হাত দুটোর সর্বত্র কাটা দাগ। এত দিন দাগগুলো খেয়াল করেনি কেন? রুবাবার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি রুমা। নিজের কালো মুখ মেয়েকে দেখাতে চায়নি।

রুমার সামনেই রুবাবা প্রিন্সিপালের কাছে বলেছে, ওর পেরেন্টস ভালো না, ওকে ভালোবাসেনা। পেরেন্টস সারাক্ষণ ঝগড়া করে। রুবাবার বাবা এত নোংরা ভাষায় ওর মাকে গালিগালাজ করে যে রুবাবার ইচ্ছে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। ওর ইচ্ছে করে মরে যেতে। বাবাকে ও ঘেন্না করে, মাকেও ঘেন্না করে।
রুবাবাকে ক্লাসে পাঠিয়ে প্রিন্সিপাল জানালেন, রুবাবা মানসিকভাবে খুবই ডিস্টার্বড। যদি রুমা রুবাবার প্রতি বিশেষ মনোযোগ না দিতে পারে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। সোশ্যাল ওয়ার্কারদের সাথে যোগাযোগ করবে, তারা হয়তো রুবাবার সার্বিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে রুবাবাকে ওদের কেয়ারে নিয়ে যেতে চাইবে। তেমন যদি ঘটে, রুমার সাধ্য নেই রুবাবাকে নিজের কাছে ধরে রাখার। কারণ, রুবাবাকে নিয়ে রুবাবার বায়োলজিক্যাল ফাদার নাসি্মের কোন আগ্রহ নেই। রুবাবার নিজেরও তার বাবা মায়ের প্রতি এতটুকু রেসপেক্ট বা ভালোবাসা নেই।



চার

রুবাবাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রুমা নিজেই নিয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্ট ইয়াং লেডি, ডঃ রয় খুব ভাল ডাক্তার। উনার খোঁজ দিয়েছেন রুবাবার স্কুলের ড্রামা শিক্ষক। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও রুবাবা একই কথা বলেছে। ডঃ রয় চেয়েছিলেন রুবাবার চিকিৎসার পাশাপাশি রুমা এবং নাসিমের সাথেও কথা বলতে। নাসিম আসেনি, আসবেনা বলেছে।
রুমা নাসিমের পায়ে পড়ে কেঁদেছিল, রুবাবাকে বাঁচাতেই হবে বলেছিল।
নাসিম বলেছে, “ নাটক করবেনা, নাটক আমি পছন্দ করিনা। সারাক্ষণ শুধু নাটক আর নাটক, ড্রামা কুইন, আই হেইট ইউ অল! গেট লস্ট!”

ডঃ রয় রুবাবার সাথে অনেক রকমের গল্প করেছেন, রুবাবা ডক্টরের সাথে কথা বলেছে। সপ্তাহে তিন দিন যেতে হয়। ডঃ রুমাকে বলেছে, একেবারে কাছে গিয়ে নয়, একটু আলগা থেকে রুবাবার দিকে নজর রাখতে যেন হাতের কাছে ধারালো কিছু না থাকে। সেই থেকে রুমা টিভির দিকে চোখ রেখে রাত তিনটে পর্যন্ত রুবাবার বিছানার পাশে বসে থাকে, রুবাবাও ঘুমায়না, রুমাও ঘুমায়না। রুবাবা চায়না ওর আশেপাশে কেউ থাকুক, এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে রুবাবার প্রতিটি কাজের ব্যাপারে রুমাকে সজাগ থাকতে।

রুবাবা আইপ্যাড কোলে নিয়ে শুয়ে থাকে, রুমা পাশের চেয়ারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মন থাকে রুবাবার দিকে। রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা বলেনা, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়না। সেদিন ইচ্ছে করেই গুণগুণ করছিল,
“আই হেইট ইউ অল, গো টু হেল”।

রুমার বুকের পাঁজরে গিয়ে বিঁধছিল। হঠাত খেয়াল করলো, বিছানার চাদরের যে কোণাটুকু মাটির দিকে ঝুলে আছে, সেখানে কয়েক ফোঁটা তাজা রক্তের দাগ। রুমা লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে রুবাবাকে জাপটে ধরলো, “ দাও ব্লেড দাও, কোথায় রেখেছো ব্লেড দাও, কোথায় কাটলে বলো, আমি ওষুধ লাগিয়ে দেই”।

রুবাবা হাসতে হাসতে বলল, “ওষুধ লাগবেনা, তোমাকে অবাক করে দিলাম। প্রতি রাতে তুমি আমাকে পাহারা দাও কেন? আমি কি কচি খুকী? তুমি পাহারা ছিলে, দেখো ঠিকই হাত কেটেছি, আমি চাইলে সুইসাইড করতে পারি। তোমরা এত ঝগড়া করো কেন? আমি কি দেখতে পচা ছিলাম? তাহলে বাবা আমাকে কোলে নেয়নি কেন? বাবা আমাকে আনতে স্কুলে যায়নি কখনও, বাবা কেন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে থাকবে? আমাকে বাবা চায়নি তাহলে বাবার কেন আরেকটি বাচ্চা হলো? তোমরা পচা। আমি তোমাদের সাথে কথা বলবোনা, তোমরা চাওনি আমি পৃথিবীতে আসি, তোমরা খুব বাজে। আমি পৃথিবী থেকে চলে যাব।”



গত পাঁচ দিন যাবৎ রুমা রুবাবার পাশে বসেনা, রুবাবার সাথে খুব নরম স্বরে কথা বলে। রুবাবাকে বাঁচার স্বপন দেখায়। নতুন কিছু সৃষ্টির কথা বলে উৎসাহিত করে। রুবাবা উত্তরও দেয়না, আবার রেগেও যায়না। মাঝে মাঝে মনেও হয়, রুবাবা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরশুদিন মিস থম্পসন যে বলল সিন্ডির কথা?
ঐ তো স্কুল বাস এসে থেমেছে। বাস থেকে যে মেয়েটা নামলো সে সিন্ডি? রুবাবা কোথায়? রুবাবা নামছেনা কেন? ওমা বাস তো আবার স্টার্ট দিলো, রুবাবা নামলোনা ত!

রুমা স্কুলে ফোন করলো, অফিস তখনও খোলা। অফিসের কেরানী মেয়েটির গলার আওয়াজ সুন্দর, বলল, ‘রুবাবা অফিস রুমে আছে, স্কুল বাস মিস করেছে এক বন্ধুর কারণে। সেই বন্ধুর নাম সিন্ডি। রুবাবা বাথরুমে গেছিল, সিন্ডি ওকে স্কুলে ফেলে রেখেই চলে এসেছে। এখন রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চায়।

হ্যালো বলতেই রুবাবা বলল, “ তোমরা সবাই খারাপ, সবাই আমাকে ঠকায়। সিন্ডি খুব খারাপ, আমি বাথরুমে গেছি, আমাকে না নিয়ে সিন্ডি চলে গেছে। আমি আর কোনদিন সিন্ডির সাথে কথা বলবোনা। তুমি কি একটু আসবে আমাকে নিয়ে যেতে? আমি আর কখনও তোমাকে “ আই হেট ইউ’ বলবোনা, তুমি আসো, আমাকে নিয়ে যাও। আমার আজকেও মাথা গরম হয়েছে, তবুও ব্লেড দিয়ে হাত কাটিনি। আমি আর হাত কাটবোনা, তুমি আসো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আবুল বাসার অনেক শুভেচ্ছা রইল।ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ বাসার!
মোজাম্মেল কবির গল্পটি দুই দিন আগে পড়েছি। কি মন্তব্য করবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। বার বার রুবাবা আর তার পরিবারের অশান্তির দৃশ্য গুলো চোখে ভাসতে থাকে... উন্নত জীবনের আশায় প্রবাস জীবন যদি মানুষকে এভাবে পশু বানিয়ে দেয় তাহলে কি দরকার এমন স্বচ্ছলতার? খেয়ে না খেয়ে জীবনের শান্তি বজায় রেখে কষ্টে দিন কাটালেও অনেক শান্তি। মন থেকে দূর করতে পারছিনা দিদি। এবার শিরোপা বুঝি আপনার... শুভ কামনা রইলো।
কবীর, অশান্তি দেশেও আছে।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
অনেক ধন্যবাদ গোবিন্দ!
Fahmida Bari Bipu পড়তে পড়তে বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
অনেক ধন্যবাদ গুণী লেখক!
আপা, আপনি আমাকে গুণী লেখক বললেন? হিউজ কমপ্লিমেন্ট!!

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী