গহীনে রক্তক্ষরণ

বাবা দিবস (জুলাই ২০১৪)

এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
  • ১৩৪৪
অনেক্ষণ হয়ে গেল লাঠিটার ওপর ভর করে নেহাল সাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন । এর আগে কখনো তাকে এভাবে দেখিনি। তাই কৌতুহল বশতঃ খুব কাছে এসে দেখলাম, প্রধান ফটকের ওপরে বড় হরফে লেখা সাইনবোর্ডটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছেন। আমি কয়েকবার তাকে ডাকলাম । উনি একবার তাকালেন। মনে হল যেন আমাকে চিনতেই পারলেন না। কোন কথা না বলে উনি আবার সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি এবার উনার হাত ধরে একটু নিজের দিকে টান দিলাম । বললাম,
নেহাল সাহেব, আপনার কি শরীরটা খারাপ ?
সম্বিত ফিরে পেলেন ।
-অ্যা ? ও, আচ্ছা, আপনি ? খেয়াল করি নি ।
হ্যা, সে আমি বুঝতে পেরেছি। অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করছি, আপনি খুব মনোযোগের সাথে ওদিকে কী যেন দেখছিলেন। কি দেখছিলেন ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-না, না, কিছু নয়। ক্লান্তি, অবসাদ । এখন আর পা চলতে চায় না, জানেন ? কিছুক্ষণ হাটার পর মনে হয় আর হাটতে পারব না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
বেশ তো, তাহলে কষ্ট করে হাটার দরকার কি ? চেক আপ করিয়েছেন ?
-বহুদিনের অভ্যাস । না হাটলেও ভাল লাগে না। আর চেক আপ ? এখন আর ও করিয়ে কি হবে, বলুন ? ছুটির ঘন্টাটা ঢং ঢং করে বাজছে । মনের ছুটি মূলতঃ হয়েই গেছে। কেন জানি মনে হয়, কোন এক অজ্ঞাত কারণে কার্যকাল অব্যাহত রেখেছে শরীরটা ।
বেশ । তা একা একা এভাবে বের হওয়াটা কি ঠিক ? কাউকে সংগে নিয়ে বের“লেই তো হয় , না কি ?

কথাটা শুনে তিনি যেন না শোনার ভান করলেন । প্রসংগটা এড়িয়ে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

-এখন কি ধরনের লেখা লিখছেন ?

কেন জানিনা, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রসংগে কথা উঠলেই উনি খুব দ্রুত অন্য প্রসংগে চলে যান। এটা অনেকদিন যাবৎ খেয়াল করেছি। কিন্তু কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে অতি কৌতুহলী হওয়া আমার একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু তার সংগে আমার বন্ধুত্ব যে পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে তাতে উভয়ই আরো একটু নিকটবর্তী হতে বাঁধা থাকার কথা নয়। হয়তোবা কোন কষ্ট উনি লুকোতে চাইছেন, ভেতরের কষ্টকে বের করে এনে তাকে আরো কষ্ট দিতে মন চাইল না। অতএব, আমি তার ট্য্রাকেই উঠে পড়লাম।

অনেকদিন হয়, কলম আর ধরতে পারছি না। সময় হয়ে উঠছে না। লেখবার জন্য তবে মাথাটা পীড়া দিয়েই চলেছে।
-হাতের কব্জিতে যতদিন জোর আছে, পুরো কাজে লাগিয়ে যান। আমার মত নেতিয়ে পড়লে তো আর পারবেন না। চালিয়ে যান । নতুন কোন লেখা বেরিয়েছে ?
না, এখন লেখা দিতেই পারছি না। হাতে একদম সময় নেই।
- আমার মিসেসও কিন্তু আপনার একজন ভক্ত হয়ে উঠেছেন । প্রথম দিকে সে এসব পাত্তাই দিত না। কিন্তু আমাকে এভাবে মুখ গুজে পড়তে দেখে একদিন সে আমার অজান্তে আপনার একটা লেখা নাকি কৌতুহল বশতঃ পড়েছিল । আরো বলে কি জানেন ? তিনি না কি আমাকে ক্ষেপানোর জন্যই তা পড়েছিলেন।
তাই বুঝি ? একথাগুলো শুনতে আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে ।
-শুনুন না ? তিনি পড়তে বসেছেন তো, আর ওঠেন নি। শেষ না করে না কি তিনি উঠতেই পারছিলেন না। পরে পান চিবুতে চিবুতে আমার কাছে এসে বললেন,
হ্যা, গো, তোমার বন্ধুটি তো ভালই লেখেন । তা আর কি কি লিখেছেন, আমাকে দিও তো । নতুন কিছু থাকলে অবশ্যই দিবেন কিন্তু ।
ভাবী সাহেবানকে অনেক ধন্যবাদ । অবশ্যই দিব ।
-তবে এখন থেকে একটা সফ্ট কপি দিতে হবে তার জন্য ।
কেন ?
-ছোট ছেলের কাছে গেছেন, আমেরিকায় । সেখানে চিকিৎসার জন্য তাকে অনেকদিন থাকতে হবে।
আহারে, তাহলে তো এখন আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনিও যেতে পারতেন ।
কিছুদিন আগেই এলাম কি না, তাই ।
লক্ষ্য করলাম, তার মিসেসের প্রতি অগাধ ভালবাসার আবেগে কিছুটা পারিবারিক আলাপে ঢুকে পড়েছেন। এই সুযোগে আমি আরো খানিক অগ্রসর হতে চাইলাম। কিন্তু তিনি আর কিছুতেই এগুলেন না। এমন কৌশলে বেরিয়ে গেলেন, আমি আর তার নাগাল পেলাম না। তার এই এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা আমাকে দারুনভাবে ভাবিয়ে তুলল।
এর পর বেশ কিছুদিন হতে চলল, নেহাল সাহেবকে দেখতে পেলাম না। অসম বয়সী বন্ধূত্ব । ওয়াকওয়েতে একদিন হঠাৎ তার সাথে আলাপ । বলা যায়, অযাচিতভাবেই পরিচয়। বয়স্ক মানুষ। বিশালকায় সুঠাম দেহ। গলাটা ভরাট। তো, কি জানি কোন এক যুবকের সাথে বচসা শুরু হলে তিনি ভরাট কন্ঠে গর্জে উঠলেন,
এত বড়াই ভাল নয় । যৌবন আমারও ছিল ।
তার এ আচমকা গর্জে ওঠায় যুবকটাও হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি এ নিয়ে আর কোন বিতর্কে যেতে চাইলেন না। তার কথার আর কোন প্রতিবাদ না করে তিনি আবার দৌড়াতে শুরু করলেন।
কি নিয়ে বচসা শুরু হয়েছিল তা জানি না। তবে নেহাল সাহেবের অতিশয় ভরাট কন্ঠের আওয়াজ অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। কেউ আর এ নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই বা কোথায়। কারো প্লাজমা গ্লুকোজ টেষ্ট রেজাল্ট খাবার আগে ৮ গরষষরসড়ষব ঢ়বৎ খরঃবৎ এবং খাবার পরে ১৪ (৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘন্টা পরের রিপোর্ট )। কারো ১৫ এবং ২১ পয়েন্টে উঠে গেছে। কারো বা তার চেয়েও বেশী। সবার লক্ষ্য একটাই এটির পরবর্তী টেষ্ট রেজাল্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে যতটা সম্ভব খাবার আগে লেস দ্যান ৬.১ এবং খাবার পরে লেস দ্যান ৭.৮ এর কাছাকাছি আনা যায়। এ যেন তারই প্রতিযোগীতা চলছে । যত হাটা যায় ততোই মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার বাসনায় যে যার মত ব্যস্ত। আমি অধম এসবের ধারে কাছেও নেই। তবে আমার হাটার গতি দেখে আমার এক কলিগ বলেছিলেন, রেইট কততে উঠেছে? আমি বললাম, নো রেইট । তিনি হেসে বললেন, যা বাব্বা , তাতেই হাটার তেজ এত ? আমি বললাম, যাতে রেইটের হাতে বন্দী হতে না হয় তার জন্যই পূর্ব প্রস্তুতি । ছোট মেয়েটার বয়স কেবল ৩ বছর, তাই ----। লেখার উপাত্ত পাবার আশায় মাঝে মধ্যে এরকম পরিস্থিতিতে কিছটু নাক গলাবার অভ্যাস ছাড়তে পারি না। অভ্যাসবশতঃ মুরুব্বীকে বললাম,
এত রেগে গেলেন যে ? এ বয়সে এরকম রেগে যাওয়া শরীরের জন্য ভাল নয়।
আমার কথায় কিছুটা ¯^¯ি— পেলেন ভদ্রলোক। সুযোগ পেয়ে মনের আবেগ ঝেড়ে দিলেন নিমেষেই।
-রক্ত গরম । বুঝলেন ? রক্ত গরমের তেজ দেখায় । আরে, ওরকম রক্তের তেজ আমারও একদিন ছিল । আমাকে বলে কি না, আমি নাকি বার বার ওর দৌড়ে ডিসটার্ব করছি । দৌড়বি , দৌড়া । যায়গার কি অভাব আছে ? ঐ তো খোলা বিশাল মাঠ রয়েছে, ওখানে যা। এই চাপা ওয়াকওয়েতে কেন ? বলুন তো, তাহলে আমরা বুড়োরা যাব কোথায় ?
আপনি ঠিকই বলেছেন। এটাতো দৌড়ানোর জন্য না । এটা শুধুমাত্র হাটার জন্য।
-দেখেন, আপনিও একজন যুবক হয়ে ঠিক বুঝেছেন, অথচ কেমন বেয়াদব। বাপ বয়সী একজন মুর“ব্বী মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তাও শেখেনি। হবে না, বুঝলেন, এদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দেশটা দিনে দিনে কোন দিকে যে যাচ্ছে, আল­াহই জানেন।
ভদ্রলোকের কথা শুনতে আমার বেশ ভালই লাগছিল। কিছু¶ণ উনার সাথে আলাপের পর উনি আমাকে উনার একজন আপনার লোক হিসেবে ধরেই নিয়েছেন। প্রাণ খুলে মনের যত কথা আছে সব বলতে লাগলেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মাঝ পথে এ অযাচিত নাক গলাতে যেয়ে আমার দ্র“ত হাটার গতি কিছুটা মন্থর হয়ে গেল। কী আর করা। এখন কত দ্র“ত উনার কথার ফাঁক দিয়ে নিজেকে মুক্ত করা যায়, তার পথ খুঁজছি। কিন্তু উনি এত¶ণে যে মনো¯—া¯ি—ক শাšি— এবং ¯^¯ি— পেয়ে আমাকে উনার একজন পরম বন্ধু হিসেবে বেঁধে ফেলেছেন, সে বাঁধন থেকে ঐ দিন আর মুক্ত হতে পারলাম না।
এর পর থেকে উনার সাথে আমার প্রায়ই এখানে আলাপ হয়। কোনদিন হাটতে যেতে মিস করলে উনি আমার প্রতী¶ায় থাকেন। একটু দেরী হলেই উনি খুব চিšি—ত হয়ে পড়েন। ভাবেন, অসুখ করল না তো ? সামান্য একটুখানি মনো¯—া¯ি—ক সংগ দেয়ায় উনি যে আমাকে এতখানি আপনার করে নেবেন, সেটা আমি ভাবতেও পারি নি। সেই থেকে উনি আমার এক পরম বন্ধু হিসেবে আমার জীবনে বিরাজ করছেন। কিন্তু সেই অজানা রহস্যটা আজো উদ্ঘাটিত হল না। ভেবেছিলাম, যিনি আমাকে এতটা অনুভব করেন, নিজের সš—ানকে দেখতে না পেয়ে বাবার যেমন উৎকন্ঠা বেড়ে যায়, তেমনি আমার সাথে একদিন যার দেখা না হলে অস্থির হয়ে ওঠেন। সেই তিনি, এবার অš—ত তার জড়তা দূর করে আমাকে আরো কাছে টেনে নেবেন। সুযোগটা আমি প্রথমে নিতে চাইলাম। বললাম,
এতখানি মায়ার বাঁধনে আমাকে যে বেঁধে ফেললেন, এর পর কি আমাদের সম্পর্ক কেবল এই পার্কে থাকা উচিত? আজ আর কোন কথা শুনছি না, আমার বাসায় আজ আপনাকে যেতেই হবে।
কথার জালে আটকে গিয়ে তিনি বেশ খানিকটা অ¯^¯ি—কর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন, সেটা তার অবয়বে ফুটে উঠেছে। আমার এ দাওয়াত কবুল না করার পেছনে যে আর কোন যুক্তি নেই , এটা তিনি পরিস্কার বুঝতে পারছেন, কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার শর্টকাট কৌশল খুঁজছেন। তিনি কেবল এটুকুই বলে দ্র“ত আমার কাছ থেকে পালাতে চাইলেন,
-থাকনা বন্ধু, এখানে যতটুকু আবেগ, উচ্ছাস আর ভালবাসার বিনিময়ে আপনাকে এতটা কাছে পেয়েছি- পাছে সেটা যাতে না হারিয়ে যায়, সেই কি ভাল নয় ? আজ একটু তাড়া আছে। সময় পেলে অন্য আর একদিন ---- । আচ্ছা, আজ চালি , কেমন ?
খেয়াল করলাম, কথাগুলো বলার সময় তার কন্ঠ¯^রটা ভারী হয়ে গেল। আমার দাওয়াত এড়িয়ে যেতে তার যেমন কষ্ট হচ্ছিল, তেমনি সে মুহুর্তে উনিও আসলে আমাকে দাওয়াত করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেছিল উনার মন। কিন্তু কোন এক অশুভ শক্তির টানে আটকে গেলেন। আর এগুতে পারলেন না। তার হৃদয়ের গহীনে যে রক্ত¶রণ হয়ে গেল তা বুঝতে আমার এতটুকু কষ্ট হল না। তার এ সং¶িপ্ত কথাগুলো থেকে অনুমান করা যায় , অনেক বড় ধরনের প্রলয়ংকরী ঝড়ে বিদ্ধ¯— এই মানুষ ! তার পা এখন বলতে গেলে চলতেই চায় না। অথচ তিনি রোজ ওয়াকওয়েতে আসছেন। বাচ্চাদের মত হাটি হাটি পা পা করে এক পা দু’ পা হাটছেন। কষ্ট হলেও এখানে এসে কিছুটা ¯^¯ি—র নিঃশ্বাস ফেলছেন। কিন্তু সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে আমি কেবল ভাবছি, যে কোন উপায়েই হোক, তাকে একটা থরো মেডিকেল চেকআপ করানো দরকার। আর যাই হোক, এই বয়সের একজন অসুস্থ্য বাবাকে দেশে একলা রেখে কেবল মাকে চিকিৎসার জন্য ছেলে আমেরিকায় নিয়ে গেল, এটা ঠিক হিসেবে মিলছে না। নেহাল সাহেবের চোখে মুখে অš—ত সে প্রশাšি—র ইংগিত দেখা যায় না। তাই অনেক দিন ধরেই প­্যান করে আসছি, সুকৌশলে একবার আমার ভাতিজার চেম্বারে ওনাকে নিয়ে যাব। আজ অনেকটা রেডি হয়েই এসেছি। ভাতিজাকে বলেছি, আজ সকালে সাড়ে সাতটায় তার চেম্বারে বসতে। ও খুব ঘুম কাতর। কিছুতেই রাজী ছিলনা। কিন্তু আমার অভিপ্রায় জানার পর সে তার মনের বির“দ্ধে জেহাদ করতে রাজী হয়ে গেল। কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন, সেই নেহাল সাহেব কৈ ?

নিজেকে বড় আপরাধী মনে হতে লাগল। কেন যে তার ঠিকানাটা সুকৌশলে সংগ্রহ করতে পারলাম না , সে অ¶মতার জন্য নিজেকে ¶মা করতে পারছি না। অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল, তিনি যে বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, সেই বয়সে আবার যে এই ওয়াকওয়েতে ওনাকে পাওয়া যাবে, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে ? উহ! এ আমি কি করলাম ? আর যদি তার সাথে আমার দেখা না হয় ? ভাবতেই গা শিউরে উঠল। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। নিজেকে চরম নির্বোধ মনে হচ্ছে। সেদিন কি তাহলে ঐ সাইন বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে উনি নিজের এ শেষ ঠিকানাটা নিশ্চিত জেনে গিয়েছিলেন ? বুকটা কেঁপে উঠল । মরতে তো হবে আমাদের সবাইকেই । তার জন্য বুকটা কাঁপছে না। কিন্তু যে অপুর্ণতা নিয়ে এই বন্ধুত্বের অবসান হতে চলেছে - তাই ভেবে আমার এ বেসামল অবস্থা। আমার আর সেদিন পা চলল না। অজাšে—ই আমার চোখ ঝাপ্সা হয়ে গেল । একটু দ্র“ত হেটে উত্তর প্রাšে— এসে আমাদের সেক্টরের কেন্দ্রীয় গোরস্থানের রোডে গেলাম। প্রধান ফটকের সেই বড় সাইনবোর্ডটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকলাম অনে¶ণ। ঠিক নেহাল সাহেব যেমন করে তাকিয়েছিলেন। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা, দু’এক দিনের মধ্যে কোন লাশ কবর দেয়া হয়েছে , এখানে ?
না, স্যার ।
একটু ¯^¯ি— পেলাম । কিন্তু মনটার অস্থিরতা কাটছে না কিছুতেই ।
নেহাল সাহেবের শরীরের গঠণ ,চেহারার বর্ণনা দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-চেনো ? উনার বাসা কোথায় ?
স্যার যে কি কন ? এই রহম বুড়ো মানুষ তো এইহানে শত শত হাটেন। কার কতা কমু ?
আমিও বোকার মত তাকে এ প্রশ্ন করার জন্য লজ্জিত হলাম ।
-ঠিক আছে । সরি, সরি ।
আনমনে হেটে চলেছি। খুব আ¯ে— আ¯ে— হাটছি। ঠিক যেন নেহাল সাহেবের মত নেতিয়ে পড়েছি। আর একটা পা এগুতে চাইছে না।
আমার সামনে নেহাল সাহেবের চেয়ে কিছু কম বয়সী দু’জন ভদ্রলোক হাটছেন। তদেরকে অতিক্রম করে যেতে মন চাইছে না।
তাদের মধ্যে অনেক রকম কথা হচ্ছিল, হঠাৎ একটু অন্য রকম কথা কানে আসায় তাদের কথাগুলো শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম ।
-খবর কিছু শুনেছেন ?
হ্যা , শুনেছি। বেচারার জন্য সত্যিই দুঃখ হয় । এই ছেলেদের জন্য কী না করেছেন তিনি , আর আজ এই তার পুরস্কার ?
-বেঁচে গেছি, ভাই আমার ছেলে হয়নি বলে কত নিন্দা করত আমাকে সবাই। এ অপরাধে আমার বউটাকে তো আমার বাপ মা দু’চোখে দেখতেই পেতেন না । এখন দেখেন, আলহামদুলিল­াহ। মেয়ে জামাই নিয়ে কত সুখে আছি। হ্যা, এটা ঠিক যে আমরা বুড়ো বুড়ি এখন একা । কিন্তু, দেখেন, এমন কোন দিন নেই যেদিন মেয়েরা ওদের বাড়ি থেকে এসে আমাদেরকে সংগ না দেয়। আর আমেরিকার মেয়ে জামাইতো প্রায় প্রতিদিনই ওয়েবক্যামে কথা বলছে।
হু , আপনার মত সুখী আর কে আছে ।
- আপনিওতো আল­াহর রহমতে অনেক ভাল আছেন । একটা মাত্র ছেলে । সোনার টুকরো। এরকম ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে ? আর বৌ মা ? সে তো আর এক অসাধারণ নেয়ামত আপনার ঘরে।
হ্যা, তা যা বলেছেন। সত্যিই আমি বড় ভাগ্যবান । আল­াহর দরবারে লাখো -কোটি শুকরিয়াহ । কিন্তু উনি যে কেন এরকম ব্যর্থ হলেন, তা কোন হিসেবেই মেলাতে পারি না। লোকটা সারা জীবনে কোন অন্যায় করেছেন বলে শুনিনি। কোন বেফাঁস কথা-বার্তাও কানে আসেনি। পাচওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন, আজীবন। কিন্তু কেন যে উনার ছেলেদের সাথে সম্পর্ক এত তিক্ত হল, আর কেন যে এই শেষ বয়সে উনার এত অগাধ ধন সম্পদ থাকা ¯^ত্তেও শেষ পর্যš— উনাকে ওল্ড হোমে যেতে হল, তা ভাবতে অবাক হতে হয়। অনেক ষ্টাডি করে দেখেছি। কিন্তু কোন ফর্মুলায় ফেলতে পারি না।
-হ্যা, ঠিকই বলেছেন। উনি একেবারে চাঁপা ¯^ভাবের মানুষ ছিলেন। নিজের ভেতরে এত দুঃখ, কষ্ট পুষে রাখতেন। কোনদিন কারো সাথে শেয়ার করেন নি। আমাকে উনি অনেক ভালবাসতেন, আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু উনার সমস্যাগুলো নিয়ে কোনদিন কোন কথা উঠলেই উনি সুকৌশলে এড়িয়ে যেতেন। কারো সাথে শেয়ার করতে চাইতেন না। আহারে! বেচারা, যদি নিজের জীবনের লুকোন দুঃখগুলো শেয়ার করতে পারতেন, তাহলে তার জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতে পারতো।
সবই আল­াহর ইচ্ছা । আচ্ছা, জানাজা কি কেন্দ্রীয় মসজিদেই হবে ?
-হ্যা, ফজরের সময়ইতো মাইকে ঘোষণা হয়েছে, শোনেন নি ? আসরের নামাজ বাদ জানাজা।
আজ জামাতে যেতে পারি নি। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ফজরের নামাজ একেবারে জেরওয়াক্তে পড়ে আবার ঘুমিয়েছিলাম। তবে উনার ছেলেরা এখন খুব আফসোস করছেন ।
-ন্যাকামো। এখন আর আফসোস করে কী করবি ? বেটারা যে এভাবে বউ এর গোলাম হয় কেন, এ আমার বুঝে আসে না। এরা কি পুর“ষ ? এরা পুর“ষ নামের কলংক ।
পুর“ষ সবাই হতে পারে না। এর জন্য আলাদা যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এরা হচ্ছে অযোগ্য পুর“ষ মানুষ । একজন যোগ্য পুর“ষের কাজ হল তার বউকে সে পর্যাপ্ত পরিমান ভালবাসবে, যতটা ভালবাসা সে তার কাছ থেকে আশা করে, পাশাপাশি সে তার বাবা মাকে অতটাই মাথার মুকুট করে রাখবে যতটা তার জন্য আল­াহপাক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ কাজ খুব শক্তও নয় আবার খুব সহজও নয় । কৌশুলী হতে হয়। কিন্তু সে কৌশল খুব শক্ত হাতে যোগ্যতা আর দ¶তার সাথে সুনিপুনভাবে পরিচালনা করাইতো পুর“ষ মানুষের কাজ, তাই না ? সে একজন ভাল পরিচালক হলে কি আর কোন সমস্যা হতে পারে ?
- হ্যা, খুব খাঁটি কথা বলেছেন ।
আমি ভাবলাম, একবার জিজ্ঞেস করি, কার জানাজা ? কিন্তু জিজ্ঞেস করা হল না। সময় আর হাতে নেই। দ্র“ত বাসায় এলাম।
অফিসে সারাদিন কাজে তেমন মন বসল না। বসকে বলে আজ লাঞ্চের পর ছুটি নিলাম। অনেকদিন পর এ সময় বাসায় আসলাম দেখে গিন্নি হতবাক হয়ে বলল,
শরীর খারাপ করে নাই তো ?
-নাঃ শরীর ঠিক আছে। এমনিই আসলাম । শরীরটা খুব ক্লাš— লাগছে।
আজ আসরের নামাজ পড়তে কেন্দ্রীয় মসজিদে এলাম । অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছে । সাধারণতঃ এরকম সময় এত মুসুল­ী হয় না। আমার বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে যেতে লাগল। যথারীতি জামাত শেষে একটা এলান শোনান হল,
অত্র এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবী জনাব মোঃ নেহালউদ্দিন আজ সকালে ইšে—কাল ফরমাইয়াছেন। ইন্নালিল­াহে ওয়াইন্নাইলায়হে রাজিউন। মরহুমের নামাজে জানাজা এখুনি শুর“ হবে । আপনারা কাতার সোজা করে নিন। জানাজার আগে মরহুমের বড় ছেলে কিছু বলতে চান।
-আ¯­ামুআলাইকুম। আমি আমার বাবার বড় ছেলে। আমার বাবা যদি কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাহলে তাকে ¶মা করে দিবেন। আর কেউ যদি উনার কাছে কোন টাকা পয়সা বা কোন কিছু পাওনা থেকে থাকেন, আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। ইনশাল­াহ আপনাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
ঘোষণা যে এরকমই হবে সেটা ওয়াকওয়েতে হাটার সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম। চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। আমি আবেগ সামলিয়ে বললাম, আমার একটা জিনিষ উনার কাছে পাওনা আছে।
-জানাজা শেষে আমার সাথে কথা বলবেন, প­ীজ ।
নাঃ , আমি এখুনি বলতে চাই।
-বলুন ।
উনি আমাকে উনার বাসায় দাওয়াত করার জন্য অনেকদিন চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেন জানিনা, উনি দাওয়াতটা দিতে পারেন নি। আমার কাছে মনে হয়েছে, উনি আমাকে দাওয়াত দেবার জন্য অপে¶া করেছিলেন, আমি সেই দাওয়াতটা পেতে চাই ।
-মাথা নীচু করে অত্যš— ভীর“ কন্ঠে ছেলেটা বলল, কিন্তু উনি তো আর বেঁচে নেই । ঠিক আছে, নামাজ শেষে আমি আপনার সাথে আমি কথা বলব ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছেন। করুন পরিণতি হৃদয় ছুঁয়ে গেল। খুব ভাল লিখেছেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম আসুন, আমরা মেকী বাবা দিবস আর মেকী মা দিবস- কালচার এ অভ্যস্থ না হয়ে আমাদের চেতনায় ধারন করি ঃ আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই হোক আমার বাবা দিবস , আমার মা দিবস !!

২৯ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪